You dont have javascript enabled! Please enable it!

চুকনগরের গণহত্যা, সাতক্ষীরা

ডুমুরিয়া উপজেলার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত চুকনগর একদিকে খুলনা-সাতক্ষীরা- যশোর জেলার সংগমস্থল, অন্যদিকে উক্ত তিন জেলা থেকে আগত তিনটি সড়ক ও সাতক্ষীরা-চুকনগর-দৌলতপুর-খুলনা সড়ক (পুরাতন) এখানে মিলিত হয়ে একটি চৌরাস্তার মোড়ের সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া এ বাজারসংলগ্ন ভদ্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে কয়েকটি ছোট খাল, যা স্থানীয়ভাবে আশপাশের এলাকসমূহের সাথে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছে। খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে সড়কপথে ভারত যাবার এটি ছিল একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। ফলে দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার মানুষ নৌ ও সড়কপথে চুকনগর এসে এখান থেকে ভারতে গমন করত। এ সকল কারণে চুকনগর বাজার এলাকা একটি ব্যস্ত এলাকায় পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক, বিশেষ করে, ভারতগামী সংখ্যালঘুরা এখানে এসে রাত যাপন করত এবং প্রাতরাশ শেষে আবার যাত্রা শুরু করত। অনেকে নৌকাযোগে সারারাত পথ চলার পর ভোরে এখানে পৌঁছে প্রাতরাশের পর্ব সেরে স্থলপথে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করত। এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটত এখানে। খুলনা, বাগেরহাটসহ তৎকালীন বরিশাল ও ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার- নির্যাতনের প্রেক্ষিতে ক্রমেই এই পথে ভারতগামীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
১৯৭১ সালে ১৯ মে রাত ও ২০ মে সকালের মধ্যে এখানে ভারতগামী লক্ষাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেত হয়। ১৯ মে বটিয়াঘাটা থানার বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের কারণে এ দিন আগন্তুকদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল বলে জানা যায়। ২০ মে বেলা ১০-১১টার মধ্যে সাতক্ষীরা সড়ক হয়ে দুটি গাড়িতে করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসে বাজারের দুদিক থেকে এদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এখানে প্রথম শহীদ হন চিকন মোড়ল নামক জনৈক কৃষক। চুকনগর বাজারের দক্ষিণপ্রান্তে মালতিয়া গ্রামে নিজ কৃষি খামারে তিনি কর্মরত ছিলেন। এ সময় এ খামারের পাশ দিয়ে হানাদার বাহিনীর একটি দল গাড়ি থেকে নেমে বাজারের দিকে এগুতে থাকলে তাদের আঘাত করার জন্য তিনি চিৎকার দিয়ে তাঁর সঙ্গীদের আহ্বান জানান এবং নিজে হাতে সংরক্ষিত নিড়ানী দিয়ে আঘাত করার উদ্দেশ্যে হানাদারদের দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী তাঁকে গুলি করে এবং তিনি ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। সম্ভবত চিকন মোড়ল বুঝতে পারেন যে, হানাদার বাহিনী চুকনগর বাজারে সমবেত হাজার হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষসহ এ এলাকার নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে ও বাড়িঘর লুটপাট করতে এসেছে। তাই তিনি তা প্রতিরোধের জন্য নিজের ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হন। এভাবে হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র একটি দলের ওপর এককভাবে গ্রামের একজন কৃষকের ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির ইতিহাসে বিরল। মৃত্যু অবধারিত জেনেও দেশের মানুষের জন্য এভাবে এগিয়ে আসার মতো একজন মহৎ মানুষকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিবেককে বিন্দুমাত্র নাড়া দেয়নি। তাঁকে হত্যা করে বর্বর এ বাহিনী এগিয়ে যায় এবং চুকনগর বাজারের দুই পাশ দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তারা হত্যার মহোৎসব শুরু করে। শত শত মানুষ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আকস্মিক এ আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে আহত ও অক্ষতরা ছুটাছুটি করে পালাতে চেষ্টা করলে অনেকে পদদলিত হয়ে নিহত হয়। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে ঘাতকরা নদীতে ভাসমান মানুষদের ওপরও গুলি চালায় এবং শত শত লোকের সলিল সমাধি ঘটে। ঘাতকরা চারদিকে পলায়নমান লোকদের ওপরও নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে বিভিন্ন খাদে, গাছে, নদীর তীরসংলগ্ন বট গাছের শিকড়ের আড়ালে প্রভৃতি জায়গায় লুকিয়ে থেকেও কেউ রক্ষা পায়নি। এমন কি, শত শত লাশের মধ্যে আহত হয়ে যারা আর্তনাদ করছিল কিংবা যারা অক্ষত অবস্থায় লাশের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল ঘাতকরা তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এভাবে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে বাঁচার জন্য পৈতৃক ভিটামাটি ছেড়ে আসা দশ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। এ হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি তারা পার্শ্ববর্তী নন্দীবাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি পড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চুকনগর হয়ে ভারতে গেলেও এর পূর্বে এ এলাকায় যাত্রীদের ওপর এ রকম আক্রমণের কোন ঘটনা ঘটে নি। যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ ও অলংকারাদি ছিনিয়ে নেবার অনেক ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটলেও ভারত যাওয়ার এই রুটে গণহত্যা এই প্রথম সংঘটিত হয়। ঘাতকরা লুটতরাজ না করে কেবল গণহত্যা চালিয়েই ফিরে যায়। তাই এ গণহত্যার পেছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল বলে মনে হয়। জানা যায়, এ সময় চুকনগরে ট্রাক ভাড়ায় পাওয়া যেত এবং এখানে সমবেত হওয়া ভারতগামী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিদিন ভাড়া করা ট্রাকে চড়ে ভারত যেত। এ সকল ট্রাকের ড্রাইভারদের কাছ থেকে স্তানীয় বাসস্ট্যান্ডের কর্চারীরা নাজমুস সামাদ টুকু যথারীতি চাঁদা আদায় করত। এ দিন চুকনগর বাসস্ট্যান্ডের জনৈক বিহারি ট্রাক ড্রাইভারের নিকট চাঁদা দাবি করলে ট্রাক ড্রাইভার তা দিতে অস্বীকার করে এবং এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে বচসা হয়। ফলে উক্ত ড্রাইভার ক্ষুব্ধ হয় এবং চাঁদা না দিয়ে ও যাত্রী বহন না করে চলে যায়। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পাকবাহিনী এসে হামলা চালায়। স্থানীয় মানুষের ধারণা যে, উক্ত ট্রাক ড্রাইভারের প্ররোচনায় পাকসেনারা এ হামলা করে। আর একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, এ দিন হত্যাকাণ্ডের কিছু আগে ঘোড়ায় চড়ে সাদা পাগড়ি পরা একটি লোক এলাকা গুরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর এ হমালা হয়। সেও পাকিস্তানি বাহিনীর তথ্য সরবরাহকারী হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এ থেকে বোঝা যায় যে, গণহত্যার জন্য তারা সর্বত্র গুপ্তচর নিয়োগ করে। চুকনগরে সেদিন কত মানুষ খুন করছে পাকবাহিনী তার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই কারও হাতে, তবে ধারণা করা হয় এ সংখ্যা কমপক্ষে ছয় থেকে দশ হাজার।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!