গোপালপুর সুগার মিল গণহত্যা, নাটোর
“আগে আমাকে গুলি কর। আমাকে গুলি না করে আমার লোকদের তোমরা গুলি করতে পারবে না।” লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম। নাটোরের সুগার মিলে আরও তিন শতাধিক হতভাগ্য মানুষের সঙ্গে নির্দয় হানাদার বাহিনী গুলিবিদ্ধ করেছিল একেও। পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৯৭১ সালের ৫ মে মাসে এক বর্বর উল্লাসে নরহত্যায় মেতেছিল গোপালপুর মিলের প্রাঙ্গণে।
মিসেস আজিম আরও জানালেন, হানাদার বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ঢুকেছিল গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। তাদের দোসর ছিল স্থানীয় অবাঙালিরা। প্রথম দলটি ঢুকেছিল মূল মিলের অভ্যন্তরে, অপর দলটি একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিলের পাশের কলোনিতে। প্রথম দলটি মিলে ঢুকে মিলের প্রশাসকসহ তিন শ-এরও বেশি কর্মচারী ও শ্রমিককে মিলের পুকুরের পাশে লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর গুলি করে হত্যা করে।
গোপালপুরের এই হত্যালীলার সঙ্গে যে সমস্ত পাক সামরিক অফিসার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, তারা হচ্ছে লম্পট মেজর শেরওয়ানি, ক্যাপ্টেন মোখতার ও মেজর উইলিয়াম। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত দুজন থাকত নাটোরে আর তৃতীয় জন থাকত ঈশ্বরদীতে।
মিলের অবাঙালি কর্মচারীদের যোগসাজশের কথা বলতে গিয়ে মিসেস আজিম জানালেন, ২৫ মার্চের কাল রাতের পর থেকেই এখানে অবাঙালিদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। তারা হিন্দুদের আর দেশপ্রেমিক অধিকারসচেতন মানুষের বাড়িঘর দখল করত, লুটপাট করত বিষয় সম্পত্তি। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না। কারণ তখন তারাই সর্বেসর্বা। কিছু বলতে গেলে বলত “ইয়ে চিজ কা ওপর হামলোগকা হক হ্যায়।” যোগসাজশকারীরা যা করছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। হানাদার সৈন্যরা গুলি করে তিন শ বাঙালিকে হত্যা করার পর মিল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এ সমস্ত দালাল মৃতজনদের আত্মীয়-স্বজনদের লাশের কাছে যেতে দেয়নি। পুকুরে এ সমস্ত হতভাগ্যের লাশ পচে যখন দুৰ্গন্ধ ছুটেছিল, তখন তারা গর্ত করে সেগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এর আগে লাশের মধ্য থেকেও ঘড়ি, আংটি, কলম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুটপাট করে। এছাড়া এই পশুরা সম্ভ্রন্ত বাঙালিদের ‘মিলিটারি আয়েগা’ বলে বারবার ভয় দেখায়। ফলে মিল অঞ্চলের বাঙালিরা সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে কেবল প্রাণ হাতে করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আজিম সাহেব গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলের গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছেন, সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায়ই হানাদার বাহিনীর মেজর আসলাম গোপালপুরে নিহত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে। তাই মিলে হত্যাকাণ্ড চালাবার আগে হানাদাররা জানতে চেয়েছিল মেজর আসলামকে কে মেরেছে। মিলের নিরীহ কর্মচারীদের বাঁচাবার আশায় রিজার্ভ বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট আজিম বলেছিলেন, “আমি মেরেছি, আমাকে ধরে নিয়ে চল তোমরা, কিন্তু মিলের কর্মচারীদের মেরো না।” কিন্তু দয়া বলে কোনো বস্তু ছিল না পশুদের অন্তরে, তাই মেশিনগান চালিয়ে পাইকারি হত্যা করে পৈশাচিকতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তারা গোপালপুরের বুকে।
যে পুকুরটিতে নরপশুরা ফেলে দিয়েছিল তিন শ হতভাগ্য মানুষের লাশ, গোপালপুরের সহানুভূতিশীল জনগণ সে পুকুরটির নাম দিয়েছে ‘শহীদ সাগর।’
[৩৮৪] সাখাওয়াত আলী খান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত