গোয়ালখালী মুন্সি বাড়ির গণহত্যা, খুলনা
খুলনায় আর এক গণহত্যা সংঘটিত হয় গোয়ালখালীর মুন্সি সিদ্দিকুর রহমানের বাড়িতে। এ বাড়িটি যশোর-খুলনা মহাসড়কের উত্তর পাশে রেল লাইনের নিকটে অবস্থিত। মুন্সি সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের খালিশপুর শাখার সভাপতি এবং এলাকার সম্ভ্রান্ত ও সম্পদশালী ব্যক্তি। তিনি এলাকার সাধারণ মানুষ ও নিজ সংগঠনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। ২৭ মার্চ খালিশপুরে বাঙালি-বিহারিদের মধ্যে যে দাঙ্গা সংঘটিত হয় তাতে তিনি বাঙালিদের নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এলাকার নেতা-কর্মীদের নিয়ে নিজ বাড়িতে বৈঠক করে দলীয় কর্মসূচি ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করতেন। এ জন্য বিহারিরা তার ওপর ক্ষুব্ধ হয় এবং তাঁকে শায়েস্তা করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তাই ২৭ মার্চের ঘটনার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বিহারি নেতা মতিউল্লাহর নেতৃত্বে এ বাড়ি পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সংঘটিত হয় এক নির্মম গণহত্যা।
২৮ মার্চের পর খুলনা শহর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ স্বাধীনতাকামীদের অনেকেই খুলনা শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে। যারা শহর ছেড়ে যায়নি তারা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকে। কিন্তু অসম সাহসী সিদ্দিক মুন্সি শহর ছেড়ে না গিয়েও এলাকায় প্রকাশ্যভাবে অবস্থান করেন এবং সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। তাঁকে ধরার জন্য মতিউল্লাহ এক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে।
৬ এপ্রিল সকালে এলাকায় যৌথভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে সিদ্দিক মুন্সির সাথে মতিউল্লাহ সকালে দেখা করতে আসে। তার সাথে আসে স্বীয় সঙ্গী মোহাম্মদ আলী, ফরিদ মিয়া ও মুজগুন্নীর গোলাম। সিদ্দিক মুন্সির বৈঠকখানায় সকালের নাস্তা খাওয়ার পর উভয় পক্ষ একমত হয় যে, তারা যৌথভাবে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। এ বৈঠকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য দেয়ার জন্য একটি রিলিফ কমিটি গঠন করা হয় এবং সে মোতাবেক ৭ এপ্রিল খুলনা থেকে সরাসরি সাহায্যের ৫০০ মণ গম এনে মুন্সিবাড়িতে সিদ্দিক মুন্সির তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। এ সব গম বণ্টনের দায়িত্বও দেয়া হয় তাঁর ওপর। এ জন্য তিনি তাঁর দলীয় লোকদের নিয়ে বৈঠকখানায় এক বৈঠকে বসেন। এ বৈঠক চলাকালে বিকেল তিনটায় পাকসেনাদের গাড়ি আসার শব্দ পেয়ে তিনি কয়েকজন নেতা-কর্মী নিয়ে বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যান। তাঁর পলায়নের সাথে সাথেই মেজর বাবরের নেতৃত্বে চারটি গাড়িভর্তি পাকসেনা দ্রুত বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এ সময় গাড়ির ভেতর বসা ছিল মতিউল্লাহ, এজাজ, তোফায়েল ও হারুন। বাড়ির মধ্যে ঢুকেই তারা সিদ্দিক মুন্সিকে খুঁজতে থাকে। এ সময় শন্তু নামক একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীকে পেয়ে তাকে একটি ঘরের বারান্দায় বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে। সিদ্দিক মুন্সিকে না পেয়ে তারা বাড়িতে অবস্থানরত সকলকে ধরে এনে বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে গুলিবিদ্ধদের নিচে চাপা পড়ে আহত হয়েও বেঁচে যায় খান শহিদুল ইসলাম মন্টু ও আজিমউদ্দিন খান। পাকসেনারা চলে যাবার পর তারা বেরিয়ে আসে। এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে এলাকার লোকজন এত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে, লাশগুলো সৎকারের জন্য সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি। পরের দিন স্থানীয় লোকজন এসে লাশগুলো দ্রুত নিয়ে গোয়ালখালী ক্লাবের পূর্ব পাশে গণকবর দেয়।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত