You dont have javascript enabled! Please enable it! গল্লামারী গণহত্যা ও বধ্যভূমি | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

গল্লামারী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, খুলনা

গল্লামারী খুলনার সবচেয়ে বড় বধ্যভুমি বিস্তীর্ণ এলাকা লাশে ভরা ছিল। পাকসেনারা গল্লামারীতে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এখানকার বাসিন্দা মুজিবর রহমান, আবদুল গাফফার শেখ ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুস গাফফার সিকদার বলেন, পাকসেনারা এ অঞ্চলে লোকজনকে জবাই করে বেশি হত্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার সিকদার আরও জানান, স্বাধীন হবার আগে আমরা গল্লামারী রেডিও সেন্টার দখল করি। সেখানে আমরা গণহত্যার বিভীষিকাময় নির্দশন দেখি।স্তনকাটা অনেক মহিলার লাশ দেখর তে পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর এখনকার খালে বিলে বহু মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে দৈনিক বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধিও এ বিষয়ে আরও মর্মান্তিক বক্তব্য দেন। গল্লামারী খুলনা শহরের মাত্র দেড় মাইল দুরে।
সেখানে শুধু ধানের ক্ষেত ছিল। মার্চের পরে হাজার হাজার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে গল্লামারী। সারাদিন শহর ও গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে জেলখানা, হেলিপ্যাড ও ইউএফডি ক্লাবে জমায়েত করা হত। তারপর মধ্যরাত হলে সেইসব হতভাগা নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের পেছনে হাত বেঁধে বেতারকেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যাবহার করতো। রক্তাপ্লুত দেহে লুটায়ে পরতো হতভাগ্যরা । হত্যার আগে ট্রাকে ভরে যখন তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত তখন সেই সব নিরূপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার পাশের বাড়ির সবাই শুনতো। সেই আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে শেরে বাংলা রোডের এক ব্যাক্তি জানালা খুলে মুখ বাড়িয়েছিল মাত্র। ব্যস, অমনি তাঁকে লক্ষ করে হানাদার বাহিনী গুলি ছুড়লো তখনই তিনি বুলেটবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। জল্লাদরা প্রতি রাতে কম করেও শতাধিক ব্যাক্তিকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসত। কিন্তু কারোসাহস হত না তাদের দাফন করার কিছু দিন পর জল্লাদরা ঠিক করলো গুলি করে আর হত্যা নয়। এরপর থেকে শুরু হল জবাই। কিন্তু সংখ্যা কমল না। এরপর রাতের বদলে হত্যার জন্য দিনের বেলাকে বেছে নিল। সকলের চোখের সামনে দিনে পিঠমোড়া দেয়া ট্রাকভর্তি বাঙালি নিয়ে যাওয়া হত। আর ঘন্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসত। গল্লামারতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগে যাওয়া সেই সব মানুষের নশ্বর দেহ গুলো। প্রতিদিন সকালে সাধারণত একটি বড় ট্রাক ও পাওয়ার হাউজের ছোট একটি ট্রাক যেত। যেদিন বধযোগ্য মানুষ সংখ্যায় কম থাকতো, সেদিন পাওয়ার ঐ ছোট গাড়িটায় যেত। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারীর খাল থেকেই দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। খোজ করলে আরো অজস্র মাথার খুলি ও শরীরের হাড় পাওয়া যেতে পারে।
ছবি তোলবার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরে ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধীক লাশ পড়ে আছে সেখানে একটি কুকুর খাচ্ছে, আর দুরে ওপর একটি লাশের পাশে আরেকটি কুকুর বসে হাপাচ্ছে। মনে হয় মানুষ খেয়ে তার উদর অতীমাত্রায় পরিপূর্ণ। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে খ্যাত মানুষকে কুকুর টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
[৩৪, ১৩৭] দিলরুবা বেগম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত