গাইবান্ধায় নারী নির্যাতন, গাইবান্ধা
পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সব অঞলেই নারী নির্যাতন করেছে। গাইবান্ধা এঁর ব্যতিক্রম নয়। কত বিক্রিত উপায়ে, কত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তারা তা করেছে। এঁর এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন শাহনাজ পারভীন; রাজশাহীর ওপর লেখা তাঁর অভিসন্দর্ভে। সেখান থেকে নিম্নাক্ত তথ্যগুলো নেয়া হল।
বিভিন্ন তথ্য বিবরণীতে নারী নির্যাতনের যে চিত্র পাওয়া যায় অর্থাৎ বাঙালী নারীদের কত ভাবে কত উপায় কত বিকৃতভাবে নির্যাতিত করা হয়েছে। তা সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হল।
পাঞ্জাবি সেনারা প্রতিটি যুবতী মহিলা ও বালিকার পরনের কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে বীভৎস ধর্ষণে লিপ্ত হতো। পাকসেনারা অনেক সময় মেয়েদের ওপর পাগলের মোট ধর্ষণ করে আর ধারাল দাত বের করে বক্ষের স্তন ও গালের মাংশ কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিত, বর্বর পাক সেনাদের উদ্ধত ও উন্মত্ত কামরে অনেক কচি মেয়ের স্তন সহ বক্ষের মাংস উঠে এসেছিল ; মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বক্ষ, পিঠের ও কোমরের অংশ পাক সেনাদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে যেত। সাধারণত যে সকল বাঙালি যুবতী প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করতো তাদের তৎক্ষণাৎ নরপশু পাঞ্জাবী সেনারা চুল ধরে টেনে এনে স্তন ছিঁড়ে ফেলে ওদের যোনী ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে বীভৎসভাবে হত্যা করতো অএক উচ্চপদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসার মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মত উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙালি মহিলাদের ওপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করতো। বহু অল্প বয়স্ক বালিকা নরপশুদের উপর্যপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে রক্তাক্ত দেহে কত রাতে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতো। অনেক সময় প্রাণ ভয়ে অনান্য মেয়েরা সেচ্ছায় পাক নরপশুদের সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো। তাদেরও হঠাৎ একদিন ধরে ছুরি চালিয়ে শরীরের বভিন্ন অংশ কেটে বীভৎসভাবে হত্যা করে আনন্দ উপভোগ করতো পাকসেনারা। অনেক সময় যুবতী মেয়েকে মোটা লোহার রডের সাথে চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হত। পাকসেনারা প্রতিদিন সেখানে যাতায়াত করতো, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেত, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যোনিপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো, কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোন যুবতীর পাছার মাংশ আস্তে আস্তে কেটে আনন্দ করতো, কেউ উচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্মুক্তবক্ষ মেয়েদের স্তনে মুখ লাগিয়ে ধারালো দাত দিয়ে স্তনের মাংশ তুলে অট্টহাসি করতো। এ সব অত্যাচারে কোন মেয়ে কোন প্রকার চিৎকার করার চেষ্টা করলে যোনীপথ দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হত।
অনেক সময় মেয়েদের হাত পেছনের দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। পাঞ্জাবী সেনারা সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতাড়ি বেদম প্রহার করতো। এভাবে প্রতিদিন বিরামহীন প্রহারে মেয়েদের শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছিল। কোন মেয়ের মুখের সম্মুখের দিকে দাত ছিল না, ঠোটের দু দিকের মাংশ কামড়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল এবং প্রতিটি মেয়ের লাটি রডের অইরাম পিটুনিতে আঙ্গুল ভেঙ্গে, থেতলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তে জন্য এসব অত্যাচারিত লাঞ্ছিত মেয়েদের প্রস্রাব-পায়খানা করার জন্য হাতের বাধন খুলে দেয়া হত না। অবিরাম নির্মম ভাবে ধর্ষণের ফলে অনেক মেয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করত। অনেক সময় বন্দি বাঙালি মেয়েদের শিকল বাঁধা অবস্থায় স্নান করতে যেতে দিত। স্নান করতে একটু দেরি হলেই পাক সেনারা তাদের ঘাঁটি থেকে শিকল ধরে টানাটানি করত। অনেক সময় শিকলের টানাটানিতে প্রায় বিবস্ত্র রক্তাক্ত দেহে সেই মেয়েদের ঘাটিতে পৌছাতে হত। প্রথম অবস্থায় ক্যাম্পে পাকহানাদাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক নির্যাতিত বাঙালি মেয়ে পরিধানের ওরনা বা শাড়ির ফাস দিয়ে আত্ম হত্যা করলে এঁরপর পাকসেনারা এঁরপর মেয়েদের বিবস্ত্র অবস্থায় বন্দি করে রাখে। বর্বর পাক সেনারা গর্ভবতী মহিলাকেও নির্মমভাবে ধর্ষণ করে। এতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। পাকসেনারা হটাৎ গ্রামে অভিযান চালিয়ে পলায়নরত মহিলাকে তাড়িয়ে জোড় করে ধরে প্রকাশ্য দিবালোকে পথে প্রান্তরে ধর্ষণে লিপ্ত হত। হটাৎ কোন বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পিতার সামনে মেয়েকে ও স্বামীর সামনে স্ত্রীকে পাশবিক অত্যাচার চালাত। গাইবান্ধা জেলাতেও নারী নির্যাতন হয়েছে। এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে শাহনাজ পারভিন লিখেছেন; ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ পর্যন্ত গাইবান্ধা মহকুমা মুক্ত ছিল। এরপরই পাকসেনারা এসেই গোলাগুলি করে মানুষ হত্যা,লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর নারি নির্যাতন শুরু করে। পাকসেনা প্রবেশের কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই দালালদের (রাজাকার, আলবদর, আল শামস) সহায়তায় পাকদস্যুরা গাইবান্ধা শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং দালালরা মেয়েদের, বউদের জোর জলুম করে বের করে ইয়ে পাকসেনাদের শিবিরের ভোগের সামগ্রী হিসেবে পাঠাতে শুরু করে এবং নিজেরাও তাদের পাশ্ববিক কামনা চরিতার্থ করতে থাকে। গাইবান্ধা ক্যান্টনমেন্টে নারী নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্যাবসায়ী আব্দুর রউফ (৭ দিন ক্যান্টনমেন্টে আটক ছিলেন) জানান, একদিন রাতে হটাৎ শব্দ পেয়ে তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়। দেখতে পেলেন মিলিটারিরা দুটো যুবতী মেয়েকে জোর করে পাশের রুমে ধরে নিয়ে কিছুক্ষণ পর তাদের ওপর অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায়। এক এক করে সবাই ঐ দুটো মেয়ের উপর পৈশাচিক তাণ্ডবলীলা চালালে তাদের চিৎকারে রউফ মিয়া শিউরে উঠেছিলেন। অতঃপর তিনি পরপর দুটো গুলির শব্দ পেলেন সেই সঙ্গে শুনতে পেলেনদুটো নির্যাতিত নারীর শেষ করুণ আর্তনাদ। দৈনিক আজাদের গাইবান্ধা প্রতিনিধি সাফায়েত খন্দকার জানান যে গাইবান্ধায় নারী নির্যাতন সমস্থ জায়গায় রেকর্ড ছড়িয়ে যায়। গাইবান্ধা প্রবেশের পর মিলিটারিরা যে মেয়েকে পেয়েছে তাকেই তাদের খোরাক করেছে। পাক দস্যুরা হহিন্দু মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে ফাসি দিয়ে মেরে ফেলত। জনাব খন্দকার বর্ণনা দিতে গিয়ে এক হিন্দু পরিবারের উল্লেখ করেন। এই পরিবারের সাত আট বছরের নাবালিকা, একজন যুবতী পৌঢ়া মাতাকে দালাল্রা ধরে নিয়ে যায় ও মিলিটারির কাছে উপহার দেয়। হেলাল পার্কের শিবিরে পলাশবাড়ি, সাদল্লাপুর, কামারজানি, ফুলছরি, ভরতখালি, সুন্দরগঞ্জ এরূপ কিছু গ্রাম থেকে বহু যুবতীকে ধরে এনে পাশবিক অত্যাচার করে শেষ আশ্রয় হিসেবে গর্তে পুঁতে রাখা হতো। পনির উদ্দিনের ছেলে ছালু নামক এক রাজাকার গাইবান্ধায় অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালায়। এ রাজাকার বহু বাঙালি হত্যা ও নারী সম্ভ্রমহানীর জন্য দায়ী ছিল। গাইবান্ধার সকল হত্যাকাণ্ড ও নারী ধর্ষণের জন্য বেশিরভাগ দায়ী ছিল পাক মেজর শের খান ও মহসিন মির্জা। কত মেয়ের যে সতিত্ব হরণ করেছে এই দুই মেজর তার কোন হিসাব নেই।
[৫৮০] মো. মাহবুবর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত