গাইবান্ধা শহর (হেলাল পার্ক) বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, গাইবান্ধা
গাইবান্ধা শহরের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত স্টেডিয়ামের পাশের একটি নির্মাণাধীন বাড়ী ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। এ জায়গাটি হেলাল পার্ক নামে পরিচিত। এটি ছিল গাইবান্ধা শহরের বড় বধ্যভূমি। এই নির্যাতন কেন্দ্র তথা বধ্যভূমির কিছু কিছু খণ্ডচিত্র বিভিন্ন স্মৃতিচারন থেকে এখানে উদ্ধৃত করছি ;
এখানে (হেলাল পার্কের বধ্যভূমিতে) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শত শত নারী পুরুষকে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হত। এই বিশাল বাড়ির বিশাল চত্বরে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার প্র শত শত নারি পুরুষকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হত। এখানে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে শেষে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধিনতার পর এই ক্যাম্পে কয়েক’শ শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার, পেটিকোট পাওয়া গেছে।
…গাইবান্ধার হেলাল পার্কের কথা বলছি। অফিসার জনাব আজিজুল হক আমার প্রশ্নের জবাবে বলেন, সেখানে কত লোকের প্রাণ হরণ করা হয়েছে তা তিনি বলতে পারবেন না।
জনাব হক বল্লএন একদিন মেজর ডেকেছে। একটু দুরে পাশের রূমে বসে আছি। একজন সুবাদার মেজর গড়ে ঢুকল। মেজর প্রশ্ন করল কিতনা। সবাদার, তিনশো চুরানব্বে অর্থাৎ কম করে হলেও ৫০০ লোককে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। জনাব হক আরো বললেন আলাপের ধরন দেখে মনে হল কে কত হত্যা করতে পারল তার উপরই নির্ভর করছে তাদের পদন্নতি। ”
… ১৮ এপ্রিল গাইবান্ধা শহর থেকে সাইকেলে চড়ে ফিরছেন বদিখালির খোকা মিয়া। হটা ৎ দেখেন দুটো ছেলে একপাল ছাগল নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। পেছন তাকিয়ে দেখলেন দুটো জিপ।রাস্তার পাশে একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লেন তিনি। শুধু কয়েকটি মুরগির বাচ্চা ছাড়া জনমানবের চিহ্ন নেই। পাটখড়ির বেড়ার আরালে শুয়ে পড়লেন। ঠিক বাড়ির সামনেই জিপ দুটো থামলো। খান সেনারা পেছনের দিকে হাত বাঁধা সাদা কাপড় পড়া তিনজনকে জিপ থেকে নামালেন। সুজন যুবক। একজনের বয়স কত তা লক্ষ করেন নি। ওরা যুবক দুটিকে মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড় করালো। তারপর কোমরে লাথি মারল। লাথির ধাক্কায় দুজনে দৌড় দিতে শুরু করল। অমনি প্রথম জনকে গুলি করলো । হটাৎ একটা লাফ দিয়ে সে পড়ে গেল। া উঠলো না। দ্বিতীয়জন যেই ফিরে তাকিয়েছে অমনি তাকেও গুলি করলো। একটা আলের পাশে সে এলিয়ে পড়ল। ততক্ষণে ওরা চলে গেছে। দেখেশুনে বের হলাম। আমার মতই কোথাও লুকিয়ে থাকা আরেকটি ছেলে বেরিয়ে এল। আলের পাশে রক্ষিত যুবকের কাছে গেলাম। পানি দিলাম। ঢোঁক গিললো কিন্তু পরক্ষণেই গল্গল করে তাজা লালরক্ত বমি করল। তারপর সব শেষ হইয়ে গেল। খোকামিয়া আরো বললেন জুন মাস্র প্রথম দিক। কারফিও। রাস্তার পাশে দোকান ঘর বন্ধ। হরদম সামরিক গাড়ি আসা যাওয়া করছে। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। তখন হবে দ টো। ঠিক আমার ঘরের কাছে দুটো জিপ থামল। গাড়িতে চার-পাঁচটি মেয়ে। চিৎকার করছে প্রাণভয়ে। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। জিপ চলে গেল। অদের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানি না। স্বাধীনতার পর হেলাল পার্কের একটি দেয়াল ঘেরা স্থানের এক কোনে একটি গর্তের তাজা মাটি দেখে খনন করা হলে তাঁর মদ্ধ্যে থেকে অনেক গুলো মেয়ের লাশ পাওয়া যায়।
… গাইবান্ধা এমারজেন্সি ফোর্সে-এ কর্মরত সুবাদার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি খানসেনাদের অত্যাচার দেখেছেন। একাত্তুরের মে মাসের মাঝামাঝি। আফজাল ডেকে পাঠাল। জ্বালানি কাঠের ব্যাবস্থা করতে হবে।
গেলেন রাজ্জাক সাহেব। আত তখন ৮ টা। রাজ্জাক সাহেব বললেন সুবাদারের নাম এখন মনে নেই। সে মেজর আফজালের ঘর থেকে দুজন লোককে বের করে নিয়ে এল। সুবাদারকে শুধালাম, কিয়া ভাইয়া ইন দোকানরকা বিচার হো গিয়া। খান সুবাদারের জবাব, তোমহারা সামনে হোগা দেখো। ওদের দুজনকে মাঠে খাড়া করলো। সিপাইকে হুকুম দিল, এই লোগকা খারচা কার দো। লোক দুজনকে পেছনে ফিরতে ও চোখ বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর এক, দুই, তিন,চার। তারপর চারতে গুলি। কাটা মুরগির মত ছটফট করতে করতে ওরা মরে গেল।
তারপর তাদের কফিল শাহর গুদামের মাঠে যেখানে রয়েছে আরো শত শত মানষের সমাধী সেখানে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হলো। হেলাল পার্কে এবং এখানে যাদের হত্যা করা হয়েছে এই প্রাঙ্গনেই তারা শুয়ে আছে। শুয়ে আছে দশ বিশ জনে গাদাগাদি করে। আমার যে বনের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে পড়ে রয়েছে তাদের শাড়ির ছিন্ন অংশ। মাথার চুল। চোখে বাঁধা রয়েছে তাঁর রুমাল। গুদামের কক্ষগুলতে ছরিয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইট তাতে রক্তের দাগ। অনেককে গুলি খরচ না করে আছরে মারা হয়েছে। চি ৎ কার করতো বলে আর আশেপাশের লকেরা গুলির শব্দ শুনে শুনে গুনে গুনে রাখতো তাই পরের দিকে পশুরা ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলত। হেলাল পার্কের সংলগ্ন ওয়াপদা রোড পাড়ার আব্দুল ওয়াদুদ খান শাহীন। কলেজের ছাত্র। মুক্তিবাহিনির পক্ষে সে গুপ্তাচারবৃত্তি করেছে বলে এক বার নয় দুদুই বার করে ধরা হয়েছিল। শেষবার ৬ অক্টোবর প্রথমে তাঁর বন্ধু মাকসুদার রহমান মকুল এবং পড়ে শাহিনকে ধরা হয়। শাহীন আমাকে জানাল, ওরা আমাকে প্রথমে সিকিউরিটি অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। আমি মুক্ত এলাকায় যাতায়াত করার কথা স্বীকার করি। স্বীকার না করার উপায় ছিল না। ওদের লকেরা আমার যাতায়াতের সঠিক খবর রাখত। মেজর ছিল না তাই আমাকে এক ঘন্টার জন্য ছেড়ে দেয়া হল, বলা হল যদি না ফিরি আমার বংশে বাত্তি দেয়ার মত কাউকে রাখা হবে না। অগত্যা ১ ঘন্তা পর ফিরতে হল। মেজরের জিজ্ঞেসাবাদের পর কফিল শাহের গুদামঘরে হাত আর পা বেঁধে শুরু হল নির্যাতন।সেই ঘরে বিমানবাহিনী থেকে আগত একজন মুক্তিসেনাকে রক্তাপ্লুত ও উলঙ্গ অবস্থায় তিনি দেখতে পেয়েছেন। শাহীন জানাল আমার সামনেই দলে দলে লোক ধরে আনছে আর চালাচ্ছে অকথ্য অত্যাচার।
[৫৮০] ডা. মো. মাহবুবুর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত