গোলাপগঞ্জ গণহত্যা, সিলেট
পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ উপজেলায় গনহত্যা সূচনা করে সম্ভবত ১০ এপ্রিল। ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে এখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও স্থাপিত হয়। এ ক্যাম্পের জন্য মেওয়া থেকে কিছু রসদপত্র নিয়ে আসা হয় একটি ট্রাকযোগে। সেদিন কিছু পথিকও ত্রাকে চড়েছিলেন। সেই ত্রাকে পাকিস্তানি বোমারু বিমান শেলিং করলে আটজন বাঙালি প্রাণ হারান।
শেরপুর গ্রামের মেয়ে মনোয়ারা বেগম চৌধুরী। স্বামীর সাথে ব্বাস করতেন রাজশাহীর সারদায়। মে মাসের পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর মনোয়ারা বেগমের সন্ধান কেউ পায়নি। একই গ্রামের নুরুল হক চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বাড়িতে ছুটি ভোগ করে ২৯ মারচ্চ পুনরায় যোগদান করতে গিয়ে আর ফেরেননি।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ওয়াজিউদ্দিন চৌধুরী, ফজলুর রহিম চৌধুরী এবং হারুন চৌধুরীর ওপর। মুক্তিযুদ্ধের অপর এক সাহসী সংগঠক নোমান আহমদ চৌধুরীর ওপরও নির্যাতন করে তাঁর দাত ভেঙ্গে ফেলা হয়। তেরা মিয়া খান ও আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরীকে (মধু মিয়া) আবাসিক স্কুলে আটক রেখে নির্যাতন করে পাকবাহিনী ও তাঁদের এদেশীয় দোসররা। নগর ক্যাম্পে ধরে আনে তারা আরো ৭ জনকে। তাঁদের আটক রেখে উপর্যুপরি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, নাজমুল হক প্রমুখের ওপরও শারীরিক নির্যাতন করে তারা। ওয়াজিউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণা দেয়।
গোপালগঞ্জ উপজেলার বারকোট গ্রামের মনোরঞ্জন চক্রবর্তীর বাড়িতে ২৯ এপ্রিল কয়েকজন দালাল ও পাকসেনা তাঁর বাড়িতে চাড়াও হয়। দালালরা তাঁর বাড়ি দেখিয়ে দিলে সৈন্যরা সেখানে প্রবেশ করে মনোরঞ্জন চক্রবর্তীকে হত্যা করে। এর আগে তিনি নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তা বিশ্বাস করে চলে যায়। কিন্তু দালালরা জানায়, তিনি হিন্দু এবং ভারতের গোয়েন্দা। তাঁর ঘরের ঢোলক দেখিয়ে জানায়, তিনি গানবাজনা করেন। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে আবার পাকসেনারা তাঁর বাড়িতে ফিরে আসে এবং তাকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্যেই মনোরঞ্জন চক্রবর্তীর ভাতিজা জ্ঞানেন্দ্র চক্রবর্তী (নিতাই) ভারতে চলে যান। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অস্ত্রসহ দেশে প্রবেশ করেন; কিন্তু নগর গ্রামের দালাল ইরফান আলী ধরিয়ে দেয় তাকে। তারপর নিতাইও হয়ে যান স্বাধীনতার বলি।
রণকেলী গ্রামের শফিক উদ্দিন চাকরি করতেন খুলনায় ই.পি.আর বাহিনীতে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসেনাদের বুলেটে শহীদ হন গোলাপগঞ্জের এই বীর সন্তান।
কিশোর সানোয়ার আলীর বাড়ি মুখিতলা গ্রামে। ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা পালাবার সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে সানোয়ার আলীকে।
গোলাপগঞ্জ থানার ভাদেশ্বর এলাকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হাফিজ। একাত্তর সালে ছিলেন জেলা মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। কিন্তু তিনি পাকবাহিনী ও তাঁদের দেশীয় দোসরদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ২৬ এপ্রিল বিয়ানীবাজারের দোহাল গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে। কুমিল্লায় হত্যা করা হয় শেরপুর গ্রামের ল্যান্স নায়েক নুরুল হক চৌধুরীকে।
পাক হায়েনারা অন্যদের মধ্যে হত্যা করে ঢাকা দক্ষিণের তোয়াহিদ আলী এবং ভাদেশ্বরের ইরফান আলীকে। তুতি মিয়া নামের অন্য একজনকেও হত্যা করে তারা। চন্দরপুরের আফতাব আলী ছিল একজন কুখ্যাত চোর। তাকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করায় রাজাকার শফিক আহমদ।
[৬৪] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত