খালিশপুর উপশহর গনহত্যা, নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভুমি,খুলনা
ভৈরব নদীর তীরে খালিশপুর থানা অবস্থিত। খুলনার অধীকাংশ শিলপ ও কলকারখানা এখানে অবস্থিত। নৌপথে সুযোগের কারণে এগুলো ভৈরব নদীর তীরে গড়ে উঠে। পিপলস জুট মিলস-এর পশ্চিম পাশেই অবস্থিত গয়ালাপাড়া বিদ্যুৎ উটপাদন কেন্দ্র ও একাধীক তেল কম্পানীর ডিপো। চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিস ও আবাসন, খালনার কাষ্টমস অফিস এবং খুলনার নৌবাহিনীর ঘাঁটিও খালিশপুরে অবস্থিত, যা খালিশপুরকে খুলনা মুল শহরের সাথে সংযুক্ত করেছে।
এহেন শিল্পসম্বৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাষনিক এলাকা ছিল বিহারি নামে পরিচিত অবাঙালিদের আবাসন, যা বিহারি কলনি নামে পরিচিত। এভাবে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার শ্রমিকের আবাসন, হাজার হাজার অবাঙালিদের অভিবাসন প্রভৃতির ফলে খালিশপুর এলাকা খুলনার উপশহরে পরিণত হয়।
দীর্ঘদিন ধরেই এ বিহারিরাসরকার ও মিল মালিক দের আনুকূল্য লাভ করে মিল ও ব্যাবসায়ের উপর কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি মিলের বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারিরা শোষিত ও নির্যাতিত হতে থাকে। ফলে এই দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব কোন্দল লেগেই থাকতো। তদানীন্তন পাকিস্থানি শাষকবর্গ মালিকপক্ষ নিজেদের সার্থে এই এলাকার শ্রমিক আন্দোলনসহ যে কন আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঐসব বিহারিকে ব্যবহার করত। ১৯৭১ সালেও সামরিক কর্তৃপক্ষ ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ অবাঙালীদের লেলিয়ে দেয় মুক্তি পাগল বাঙ্গালিদের উপর। এ সময় উওরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অবাঙালিরা কোনঠাসা হয়ে পড়লে তারা এলাকা ছেড়ে খুলনাতে চলে যায়।
বিহারিরা খালশপুর এলাকা থেকে বাঙ্গালিদের উচ্ছেদ ও ঘরবাড়ি লুট করেই ক্ষান্ত হয় নি, এলাকাটিকে গল্লাদ খানায় পরিণত করে। যুদ্ধের মাঝে নিজেদের ঘরবাড়ির সন্ধান নিতে আসা এবং পাক বাহিনীর মিথ্যা প্রচারণায় আশ্বস্থ হয়ে চাকুরিতে যোগ দিতে আসা লোকজন পাকবাহিনী ও বিহারিদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়।
এভাবে কাজে যগ দিতে আসা মানুশের সিংহ ভাগ ছিল বিভিন্ন শ্রমিক। এলাকার নিহত অধীকাংশের লাশ ভৈরব ন্দীতে ফেলে দেয়া হত। খালিশপুর শ্রমিক ময়দানের পাশে পরিত্যাক্ত একটি ডোবায়ও অসখ্য নর কঙ্কাল পাওয়া যায়। এছাড়া খালিশপুর নেভালবেজ, তেলের ডিপো প্রভৃতি স্থান ও বধ্যভুমি হিসেবে ব্যাবহৃত হতো।
খালিশপুর এলাকায় ভাষানি বিদ্যাপীঠের পাশে অবস্থিত পুরানো জমিদার বাড়ির পশ্চিম পাশের ফাঁকা মাঠে ছিল একটি সউচ্চ পানির ট্যাঙ্ক। এ ট্যাঙ্কের নিচে ও আশেপাশে ফাঁকা জায়গা একটি বধ্যভূমিতে পরিনত হয়। এ বধ্যভূমি সম্পর্কে সৈয়দ আলী হাকিম তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, আমার স্কুল তখন খোলেনি। সারা দিন আমি খালিশপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেঘুরে যুদ্ধের ক্ষত দেখে বেড়াতাম। দেখতাম। এখানে -ওখানে মানুষের হাড়-খুলি, রক্তাক্ত জামা-কাপড়, যুদ্ধের পোশাক-হেলমেট-বায়নেট, গুলিতে ভাঙা দেয়াল-ঘর-দরজা, আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ আর কত কি। কিন্তু যে জায়গার কথা আজ ভুলতে পারি নি যে জায়গা টা হল খালিশপুর হাউজিং -এর পানির ট্যাঙ্ক। ……এখানে অনেক মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুলি, রক্তাক্ত জামা কাপর প্রভৃতি। মানুষের মাংশ পচা দুর্গন্ধে এলাকা অনেক দিন পর্যন্ত ভারী হয়েছিল। আনাগোঁনা হত কুকুর-কাক-শকুনের। নয় মাস যুদ্ধের পরও আমি যখন ওখানে গিয়েছি তখন ও পচা মাংশ। এমন কি অনেক মাথার খুলিতে তখনও চুল লেগে ছিল।
দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয় অস্ত্র মানুষ হত্যার জন্য ব্যাবহার করা হত।এছাড়া জোর করে পানি সরবরাহের ট্যাঙ্কের উপর নিয়ে যাওয়া হত ও ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে নিচে ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যা করা হত।
খুলনা শত্রুমুক্ত হলে খালিশপুরে অবস্থিত গোয়ালপাড়া পাওয়ার হাউজের অভ্যান্তরে বেশ কিছু নতর কঙ্কাল পাওয়া যায়। তারপর স্বাভাবিক কারনেই এদের পরিচয় আজো অজ্ঞাত। এগুলো পাওয়ার হাওজের গেটে গন কবর দেয়া হয়। এখানে অবস্থিত আওয়ামিলীগ অফিস বিহারিরা দখল করে নেয়। তারা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে আটকিয়ে রাখত ও নির্যাতন করে বায়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করতো। এ অফিসটিকে বিহারিরা কসাইখানায় পরিনত করে।
খুলনার কল কারখানগুলো ছিল আরেক বধ্যভূমি । এগুলো সংরক্ষিত হওয়ায় এর ভেতরের খবর বাইরে প্রকাশ পাওয়ার কোন সুযগ ছিল না। ফলে ১৯৭১ সালে এ মিলগুলো ঘাতকরা বাঙালি হত্যার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেঁচে নেয়। ২৬ মার্চ থেকেই হাজার হাজার মানুষ খুলনা শহর ছেড়ে পাশ্ববর্তী গ্রাম সমুহে আশ্রয় নিতে থাকে। ২৭ মার্চ বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় বিহারিরা পর্যুদস্ত হলে বাঙালিদের মনোবল বেড়ে যায় এবং যশোর থেকে খুলনা অভিমুখী পাকসেনাদের প্রতিরধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। কিন্তু ২৮ মার্চ প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেলে খুলনা শহর পাক বাহিনী নিয়ন্ত্রনে চলে যায় এবং বিহারি ও পাকিস্থানি বাহিনীর দোসরদের সহায়তায় শুরু হয় গনহত্যা ও নির্যাতন। এতে খুলনা শহরের হাজার হাজার মানুষ আবার শর ছেড়ে পালাতে থাকে। কিন্তু তখন, পাকবাহিনী, বিহারি ও তাদের বাঙ্গালি দোসরদের তৎপরতায় অনেক শহর ছেড়ে যেতে ব্যর্থ হয়ে নিজ নিজ গৃহ্র আটকা পরে যায়।এমনিভাবে শ্রমিক কলনিসমুহে অনেক শ্রমিকও সপরিবারে অবেউদ্ধ হয়ে পরে। অবশ্য অনেক শ্রমিক সেচ্ছায় শহর থেকে যায়, ঘাতক ও দালালদের কাছে বাঙালি মানেই যে তাদের শত্রু, সরলমনা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মিলের শ্রমিকরা, টা বুঝতে পারে নি। ফলে মিল সমূহে কলনিগুলোত্ব সাধারণ শ্রমিকরা অতী সহজেই ঘাতদের শিকারে পরিণত হয়। মিল এলাকায় হত্যাযজ্ঞ কার্যক্রমে প্রধান ভূমিকায় ছিল বিহারিরা। তারা শ্রমিক কলনিতে বসবাসরত এ সকল দরিদ্র, নিরীহ ও অসহায় শ্রমিকদের সর্বস্ব লুট করেই থামেনি, পরিবারের শিশু- নারই সহ এদের সকলকে হত্যা করে পাশে প্রবাহমান ভৈরব নদীতে ফেলে দেয়। অনেককে মিলের জলন্ত বয়লারের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে মিল কলোনিসমূহ জল্লাদখানায় পরিনত করা হয়। এ হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন লুটতোরাজ প্রকৃয়া সচল রাখার উদ্দেশ্যে খালিশপুর শিল্প এলাকায়
পাকবাহিনী একটা বিশেষ প্রশাসন ব্যাবস্থা চালু করে । এই প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী অবাঙালিরা চালায় গণহত্যা ও নির্যাতন
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত