You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুনিয়াদীঘি বধ্যভুমি, ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলাধীন হসেনগাও ইউনিয়নের ভান্ডারা গ্রাম। রানিশংকৈল থানা সদর থেকে মাত্র সিকি মাইল দক্ষিন –পশ্চিমে প্রায় ছয় একর এলাকা নিয়ে বিরাট জলাশয়। বহু বছর আগে থেকে নাম ছিল খুনিয়াদিঘি। খুনিয়া দিঘি কেন নামকরণ করা হয়েছিল টা কেউ জানে না। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এর নামকরণের সার্থকতা খুজে পাওয়া যায়। খুনিয়াদিঘি আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জরিয়ে আছে একটি বধ্যভূমি হিসেবে।
রানিশংকৈল থানা সদর খানসেনাদের দখলে যায় এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে। থানা সদর ক্যাম্প স্থাপন করে খানসেনারা তাদের তৎপরতা শুরু করে।
রানিশংকৈল এলাকায় স্থানীয় অধিবাসিদের তুলনায় বহিরাগত অধিবাসীর সংখাও নিতান্ত কম নয়। এদের সবাই ‘মালদাইয়া, নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময়ে তারা অত্র এলাকায় বসে বসতী শুরু করেছিল। প্রথম থেকে স্থানীয় অধীবাসিদের সঙ্গে তাদের মোট বিরোধ দেখা দেয়। স্থানীয় হাটের কর্তৃত্ব নিয়ে একসময় সংঘর্ষ শুরু হয়। এ থেকে স্পষ্ট ভাব দুটি ভিন্ন ধারায় সামাজিক অবস্থান গড়ে উঠেছিল।
খান্সেনারা ২২ এপ্রিল রানীশংকৈল দখল করার পর অধীকাংশ লোকই নিজ নিজ বাড়ি ঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেও স্থানীয় এবং অস্থানীয়রা মারামারি শুরু করে বলে জানা যায়। এ সূত্র ধরে মালদাইয়া”রা বাংলাদেশেএ অভ্যান্তরে ফিরে আসে এবং খান সেনাদের দোষ্র হিসেবে কাজ করে। এরা পরর্বতীতে ‘সেকেন্ড বিহারি’ নামে অভিহিত হয়েছিল। এরাই এলাকায় রাজাকার ও পিস কমেটির লোক হিসেবে কাজ করেছে।
খানসেনারা থানা সিদর থেকে কখনোই গ্রামাঞ্চলে অথবা সীমান্তবর্তী কোন এলাকায় যায়নি। ‘মালদাইয়া’ সম্প্রদায়কে লুটপাট,নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞের দোসর ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ‘মালদাইয়া’ রা সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে স্থানীয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা নির্বিশেষে ধরে থানায় নিয়ে আসতো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হতো যে, তারা মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দেয় ও খাবার সরবরাহ করে থাকে। মিষ্টার নজির নামে এক ক্যাপ্টেন ছিল থানার চার্জে। মালদাইয়াদের ধরে আনা লোকজনদের কোর্ট মার্শালে বিচার করে হত্যার নির্দেশ দেয়া হত, যা ছিল বিচারের নামে প্রহসন।
সন্ধার পর নিরপরাধ এ সব মানুষকে হাত বেধে নিয়ে আসা হত খুনিয়া দিঘীর পাড়ে। লাইন ধরে দার করিয়ে তারপর গুলি চালিয়ে হত্যা করা হত এবং বিশাল দিঘীর মধ্যে লাশ ঠেলে ফেলে দিত। কখনোবা বায়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হতো।
মতান্তরে এখানে চার থেকে পাঁচ হাজার লোককে খুন করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ সংখ্যা দু হাজারের কম হবে না বলে জানা যায়। দিনের বেলায় শকুন ার রাতে শেয়ালের মহৎসব বসত দিঘীর পাড়ে।
একরাতে একসংগে আঠারো জঙ্কে গুলি করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে এর মধ্যে একজন বেঁচে যায় এবং পরদিন সকালে তাঁর জ্ঞান ফিয়ে আসে।কোনমতে দিঘীর বিরাট কচুরীপানার মধ্যে দিন কাটিয়ে অসংখ লাশ ঠেলে তীরে ওঠে এবং আহত অবস্থায় ভারতে গিয়ে পৌছে। তাঁর কাছ থেকেই পাচার হয় বধ্যভূমি খুনিয়া দিঘীর বিভিষিকা। স্বধিনতার পর লোকজন তাদের বাড়ি ঘরে ফিরে এলে স্বজন হারানো
আর্তচিৎকারে খুনিয়াদিঘীর পরিবেশ ভারাক্রান্ত করে তোলে। জানা যায়, সে সময়ে চার থেকে পাঁচ ট্রাক মাথার খুলি ও হাড় কে বা কারা যেন নিয়ে এসেছিল। আজো অনেক খুলি ও অস্থি রয়েছে সেখানে।
[৯৫] মোহাম্মদ এমদাদুল হক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!