You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুলনা জেলার গণহত্যা ও নারী নির্যাতন, খুলনা

পাকিস্থানি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং রাজাকার সহ তাদের স্থানীয় সহযোগদের নির্মম গণহত্যায় গোটা খুলনা জেলা বধ্যভূমিতে পরিনত হয়। খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের বিচরণ ছিল এবং সব শ্রেণির মানুষ তাদের নির্মতার শিকার হয়।
নির্মমতার যত পদ্ধতি তাদের জানা ছিল তাঁর সবটুকুই তারা প্রয়োগ করে জিঘাংসা চরিতার্থ করে। কাঠ দিয়ে তৈরি বিশেষ একধরণের ফ্রেমের মধ্যে আটকিয়ে শাস্তি দেয়া হত। পেরেক পতা কাঠের তক্তার উপর শুইয়ে দিয়ে তার উপর বুট জুতা পড়ে উঠে পরতো। হাত-পা বাধা অবস্থায় বস্থায় ভরে কিম্বা সরাসরি নদীতে ফেলে দিত। পা গাছের সাথে বেঁধে মাথা নীচে ঝুলিয়ে রাখত। জুটমিলের জলন্ত বয়লারে জীবন্ত মানুষকে পা আগে প্রবেশ করিয়ে পর্যায়ক্রমে সমস্থ দেহটিকে পুড়িয়ে হত্যা করত। এভাবে শত শত মানুষকে তারা নির্যাতন করে হতা করে। সকল নির্যাতিত মানুষের কোন আর্তনাদ তাদের মনে বিন্দুমাত্র মায়ার উর্দেক করে নি। এভাবে তাদের হাতে খুলনা জেলার ও কুলনা জেলার বাইরের কত কত মানুষ নিহত ও নির্যাতিত হয়েছে তাঁর সঠিক পরিসখ্যানন করা সম্ভব না। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলমান অবস্থায় বাংলাদেশের অনান্য অঞ্চলের নিহতের শতকরা হারের চেয়ে খলনায় এর হার বেশ হবে বলেই মনে হয়। মুক্তিযুধ কালে হানাদার বাহিনী ও তাঁর বাঙালি দোসর কর্তক বাংলাদেশে সর্বত্ত গন হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি অবর্ণনীয় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। খুলনাও এর হাত থেকে রক্ষা পায় নি। খুলনার কপ্ল মনির রাজাকার ক্যাম্পে নারী, নির্যাতন, নসুখানের ইট ভাটায় ভারতগামী হিন্দু সপ্রদায়ের মহিলাদের ধর্ষণ প্রভৃতি বিবরণ ইতোপুর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্রিযুদ্ধ কালে হানাদার বাহিনি ও রাজকারের অবস্থানের প্রায় প্রতিটি স্থানে এরকম ঘটনা সর্বদাই ঘটেছে।
সামাজিক মর্যাদা ও অনান্য সীমাবদ্ধতার কারণে নারী নির্যাতনের শিকার হওয়াদের নাম পরিচয় সহ বিবিরণ দেয়া সম্ভব নয় । তবে পরিস্থিতি অনুধাবন করার জন্য খুলনায় নারী নির্যাতনের দু একটি ঘটনা সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করব।
পাকিস্থানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার খুলনা শহরের টুটপাড়ার অধীবাসী জিয়াউল ইসলাম এক সাক্ষাতকারে নারী নির্যাতনের এ ঘটনাটি অবহিত করেন তাঁর প্রদত্ত সাক্ষাতকার থেকে জানা যায় যে, তাঁকে পাকিস্থানি বাহিনী অকথ্য নির্যাতনের পর একটি কক্ষে রাখে। সেখানে আরো দশ থেকে বার জন নির্যাতিত মানুষ ছিল। পাশের কক্ষে কয়েকজন মহিলার কান্নাকাটি শুনে সেখানে নির্যাতিত মহিলাদের রাখা হয়েছিল বলে তিনি ধারণা করেন। পরেরদিন সকালে তিনি পার্শবর্তী কক্ষে বাবা, তুমি এসেছো? আমাকে বাচাও, আমাকে বাচাও বলে একটি কিশোরীর উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ শুনে দরজার ফাক দিয়ে তাকান। তিনি দেখতে পান যে, একজন বৃদ্ধ লোকেকে জড়িয়ে ধরে ১৩ থেকে ১৪ বৎসর বয়সী এক কিশোরী কাঁদছে। জিয়াউল ইসলামের ধারণা মেয়েটির বাবা ঐ বৃদ্ধ লোকটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক। বৃদ্ধ লোকটি মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে,মা তোর আর ভয় নেই, সাহেব বলেছে তোকে আজ ছেড়ে দেবে। কিন্তু এ সময় তাদের পাশে দাড়ানো উর্দি পড়া দুজন পাকিস্থানি সেনা হটাৎ মেয়েটির গায়ের পোশাক টেনে ছিড়ে তাঁকে বিবস্ত্র করে ফেলে।
এরপর বৃদ্ধলোকটিকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে আর্তচিৎকারে মেয়েটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিয়াউল ইসলাম এই বলে আবেগে আপ্লুত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সে দিন কক্ষের সকলে নিজেদের শারীরিক যন্ত্রনার কথা ভুলে গিয়ে ও মেয়েটির জন্য অঝরে কেঁদেছি। মুক্তিযুদ্ধ কালীন পাকিস্থানি বাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের এটি একটি খন্ডচিত্র মাত্র। খুলনায় কর্মরত পুলিশও এ থেকে পিছিয়ে ছিল না। এমন একতি ঘতনার বিবরণ দেন বাটিয়াঘাটার অধীবাসি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আফজাল হোসেন। তিনি তাঁর প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি ভারতে টাকি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থানকালে খুলনার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী তাঁর সাথে দেখা করে কন্দনরত অবস্থায় কিছু টাকা সাহায্য চান তিনি তাঁকে জানান যে, বটিয়াঘাটা হয়ে নৌকাযোগে ভারতে আসার পথে বটিয়াঘাটা থানার পুলিশ নৌকা থেকে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে থানায় তুলে নিয়ে যায় এবং অনেকদিন আটকিয়ে রেখে ধর্ষণ করে। পরেরদিন বিবস্ত্র অবস্থায় তাদের ফেরত দেয়। এবং তাঁর কাছে থাকা টাকা, গহনা, পোশাকাদি সবকিছু লুটে নেয়। তিনি আফজাল্কে আরো জানান যে, পাশ্ববর্তী নদীর ঘাটে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা বিবস্ত্র অবস্থায় আছে। তাদের নৌকা থেকে তুলে আনা দুটি শাড়ি কেনা তাঁর খুব দরকার। এ দুটি ঘটনা দিয়ে পাকিস্থানি বাহিনী ও তার বাঙ্গালি দোসরদের নারী নির্যাতন স্পষ্ট ভাবে অনুধাবন করা সম্ভব। খুলনায় যে অসংখ নারী তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার আর একটি প্রমান পাওয়া যায় খুলনার টুটপাড়ার খান ফজলে আহমেদ নামক জনৈক ব্যাক্তির সাক্ষাৎকারে। তিনি জানা যে,১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় তিনি খুলনা শহরে শেরে বাংলা সড়কের অবস্থিত রেডক্রস সযসাইটির অফিসে যান এবং সেখানে কর্মরত তাঁর এক বন্ধুর সাথে দেখা করেন। তিনি সেখানে রেডক্রসের গাড়ি ভর্তি মহিলা দেখতে পান। তিনি এদের সম্পর্কে তাঁর উক্ত বন্ধুর নিকট থেকে জানতে পারেন যে মুক্তিযুদ্ধ কালে ঐসকল মহিলা পাকিস্থানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে গর্ভবতী হয়েছে এবং এদের দায় দায়িত্ব রেডক্রস সসাইটি গ্রহন করেছে।
[৯২] মোল্লা আমির হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!