You dont have javascript enabled! Please enable it! খলা গ্রাম গণহত্যা | মৌলভীবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

খলা গ্রাম গণহত্যা, মৌলভীবাজার

বধ্যভূমির নাম খলা গ্রাম। রাজনগর উপজেলায় এটি অবস্থিত। থানা সদর থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে এবং মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে এগারো মাইল উত্তর-পূর্বে এই খলা গ্রাম। নির্মিতব্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা গ্রামটির অদূরেই পাহাড় আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুন্সীবাজার ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন খলা গ্রাম। পাকবাহিনী যখন নিরীহ মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে সহস্র লোককে হত্যা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কলকারখানা ইত্যাদি ধ্বংস করে যাচ্ছে, তখন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ খলা গ্রামের জনগনও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী নয়টিলা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। সংগঠিত করতে লাগলেন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোকে। কিন্তু বিষয়টি প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াত ও মুসলিম লীগ প্রভৃতি সংগঠন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারল না। পাক সরকারের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীকে তারা আমন্ত্রন জানাল মুন্সীবাজারে। এ ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন ক্রে করিম্পুর চা বাগানের একজন বিহারি দোকানদার আলী বকস।
পাক দোসররা তাঁদের নরমেধযজ্ঞ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের তিনজন বীর সৈনিক সৈয়দ নজাবত, বাদশা ও রফিককে নিশ্চিহ্ন করার মতলব আটে। তখন দেশের অভ্যন্তরে ভাগ থেকে গোপনে অস্ত্র চালনা শিক্ষদানরত এই তিনজন অকুতোভয় বীর যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে হাজির করে পাকবাহিনী সদস্যদের কাছে। ছাত্রলীগ নেতা রফিক আলীর বাবা সুরুজ আলী সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করেছিলেন এই হীন কর্মে। তারপর সৈয়দ নজাবত, বাদশা ও রফিককে বেঁধে নিয়ে যায় একাত্তরের নব্য- নাৎসিরা। তারপর পথিমধ্যে পশুর মতো গুলি করে হত্যা করে এই তিন বীর বাঙালিকে। রক্তপিপাসু পাক হায়েনারা হয়ে ওঠে বেপরোয়া এবং তাঁদের এ দেশীয় সহযোগী দোসররা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে ওঠে।
পাকবাহিনীর দস্যুরা এবার আর এক কদম এগিয়ে এলো। একটি শান্তি কমিটি গঠন করার আশ্বাস দিয়ে বহু লোককে জমায়েত করতে সমর্থ হয় তারা। সভা বসে মুন্সীবাজারে। এর আগে মুন্সীবাজারের হিন্দু দোকাঙ্গুলো লুটপাট করা হয়। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগণ তথাকথিত এই শান্তি কমিটির সভা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে;কিন্তু স্থানীয় দালালরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে ধরে নিয়ে আসে।
আর এঁদের মধ্যে খলা গ্রামের সনৎ চক্রবর্তী, মুকুল দাস ও মতিলাল দাসকে আলাদা করে বেঁধে রাখে তারা। একইভাবে বেঁধে রাখে করিমপুর বস্তির খোকা সূত্রধর, নরেশ সূত্রধর, নগেন্দ্র বিহারী দাস ও বনমালী দাসকে। সরল বিশ্বাসে শান্তি কমিটির সভায় আগত নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের মধ্যে আরও ধরা হয় তহসিলদার সুরেশ ধর ও বন্ধু গোপাল দাসকে। না, শান্তি সভা আর হলো না। বিস্মিত হলেন জোরপূর্বক ধরে আনা এলাকাবাসী। সামরিক জিপে তুলে নিয়ে গেল তারা এই ৯ জন বাঙালিকে। যাত্রা করল অজানা গন্তব্য অভিমুখে। তারপর লংগুর পুলের ওপর এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হলো সনৎ চক্রবর্তী, মুকুল দাস ও মতিলালকে লক্ষ্য করে। করিমপুর বস্তি থেকে মৃত ছয়জন বীর বাঙালিকে ধরে যে সামরিক জিপে তোলা হয় সেটি লৌহাহিনীর পাহাড়ের সামনে এসে থামে। এখানেই গুলি করে হত্যা করা হলো সবাইকে।
হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদিতে স্থানীয় দালালরা পাকিস্তানিদের হার মানায়। প্রবাসী বৃধ দানু মিয়া তাকেও রেহাই দিলনা রাজাকার বাহিনীর ঘতকরা। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে দানু মিয়াকে পাকবাহিনীর কাছে হাজির করলে স্টেনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়। এই খলা গ্রামেরই এক বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে এসে লুটপাট করে নিয়ে যায় নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার ইত্যাদিসহ বহু টাকার মালামাল।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত