You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.0.22 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মূল লক্ষ্য নিয়েই নাকি— | দেশের আদর্শ মানচিত্র চাই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২২শে মার্চ, শুক্রবার, ১৯৭৪, ৮ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

মূল লক্ষ্য নিয়েই নাকি—

অর্থনৈতিক সম্মেলন শেষ হয়েছে পরশু। কথা ছিল সতেরো, আঠারো এবং উনিশ এই তিনদিন সম্মেলন চলবে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের উপর এক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করায় সম্মেলনের মেয়াদ একদিন বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। মোট চারদিন দেশের সব প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তিতে এর বিকাশ এবং আমাদের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার উপর তাদের নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করেছেন। সবাই যে একে অপরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন তা নয় কিন্তু খোলাখুলি এই আলোচনার ফলে একে অপরকে জানবার, তার মতামত সম্পর্কে অবহিত হবার সুযোগ পেয়েছেন। আর এই সুযোগে আমরা সাধারণ মানুষরাও অর্থনীতির সব জটিল সমস্যাবলী ও তার সমাধানে প্রখ্যাত পন্ডিতবর্গের মতামত কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি।
অর্থনীতির এইসব বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এবং সব শেষ দিনে তাদের ‘বিতর্ক’ থেকে আমরা যারা ঐসব জটিল তত্ত্বের সবকিছুর হদিস খুঁজে পাইনা তাদের কাছে কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে নেতা-জনতার সৎ ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আরো অনেক কিছুর মতো দেশের অর্থনীতিও এগিয়ে চলছেনা। এই এগিয়ে না চলার ধকল অবশ্য আমাদের ইতিমধ্যেই কম পোহাতে হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যত সম্পর্কে কোনো উজ্জ্বল চিত্রের অভাব সেই ধকলের বেদনাটা আরো বৃদ্ধি করেছে।
আমরা আগামী পাঁচ বৎসরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে যে নীল নকশা আমাদের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের নিকট থেকে পেয়েছিলাম, অর্থনৈতিক সম্মেলনে তার মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এমনকি যথার্থতা সম্বন্ধেও নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কথা উঠেছে এমনকি সেই পরিকল্পনার লক্ষ্য ও আদর্শগত ভিত্তিকে নিয়েও। যারা পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যারা নিজেরা মিলে দেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জাতীয় অগ্রগতি সাধনের মূল রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন তাদেরই একজন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের পরিকল্পনা কোনো বিশেষ লক্ষ্য অর্জনকে সামনে রেখে নয় বরং আশংকিত অশুভ শক্তির অভ্যুদয়কে প্রতিরোধ করার দিকে দৃষ্টি রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছে।
এসব বক্তব্য থেকে অবশেষে আমাদের পূর্ব আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হতে চলেছে। বৎসরাধিকাল পূর্বে আমরা পরিকল্পনা কমিশনের সামনে পুঁজিবাদই এবং সমাজবাদী পরিকল্পনার গুণগত এবং বস্তুগত বিভেদটা তুলে ধরে সমাজবাদী পরিকল্পনার মূল উপাদান এবং লক্ষ্য সম্বন্ধে কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। আজ যখন শুনতে হয় সমাজতন্ত্র নিয়ে দেশে ‘বড় দ্বন্দ্ব থাকার’ সরকারের নিকট থেকে কমিশন মাঝামাঝি পথ বেছে নেয়ার পরামর্শ পেয়েছিলেন তখন স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে আমরা চলেছি কোথায়? নেতারা, অর্থনীতিবিদেরা, সমাজকর্তারা আমাদের কোন্ পথে নিয়ে চলেছেন। অন্ততঃ তাদের লক্ষ্যপথ সম্বন্ধে কি এদেশের মানুষকে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা তারা দেবেন?
সম্মেলন শেষ হয়েছে। সম্মেলনে পেশকৃত প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বক্তব্যের সংক্ষেপ সমন্বিত আকারে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে নাকি পেশ করা হবে। অপরদিকে সম্মেলনের পরামর্শ ও সুপারিশ পরিকল্পনা কমিশন ‘গভীরভাবে বিবেচনা করার’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান না রেখেও এটুকু বলা যেতে পারে কোনো পরিকল্পনাই তার মূল লক্ষ্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা এবং বিশ্বাস ছাড়া প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। আর বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্যেও রয়েছে নির্দিষ্ট সব পথ। স্বাধীনতা লাভের প্রায় ছাব্বিশ মাস পরেও আমরা আমাদের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের কাছে সেই একই আবেদন জানাবো যে, আবেদন জানিয়েছিলাম বৎসরাধিকার পূর্বেও। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বর্তমান সরকার জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ নিয়ে বড় কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাই মাঝামাঝি পথ গ্রহণের কোনো অর্থই হয় না। দু’কূল রক্ষা করতে গিয়ে গত দু’বৎসরেরও বেশী সময় সাধারণ মানুষকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তার অবসান যত শীঘ্র সম্ভব ততই মঙ্গল। সমাজবাদী পরিকল্পনাকে তার নিজস্ব কাঠামোতেই গড়ে তুলতে হবে। যদি আজ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের মনেই মূল লক্ষ্য সম্বন্ধে অস্পষ্টতা থেকে থাকে তবে তা কাটিয়ে উঠার সময় এখনো চলে যায়নি। বিলম্বে হলেও দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণ সুষ্ঠু এবং প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের প্রয়োজনেই আজ জরুরী হয়ে উঠেছে।

দেশের আদর্শ মানচিত্র চাই

মানচিত্রের দিকে একবার চক্ষু বুলোলেই একটা দেশের সার্বিক এবং হার্দিক পরিচয় চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিন্তু বড়োই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বাংলাদেশের সে রকম কোনো মানচিত্রই নেই—যে মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দেয়া মাত্র সমগ্র দেশের একটা পরিপূর্ণ পরিচয় চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশের যাও বা একটা রাজনৈতিক মানচিত্র লভ্য তাও নির্ভুল নয়, নয় পূর্ণাঙ্গও। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর পরই সার্বিক পরিচয় বহনকারী আদর্শ মানচিত্র প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা ছিলো। কিন্তু এই নতুন রাষ্ট্রের প্রতিটি বিশেষ বিশেষ দিকচিহ্নবাহী মানচিত্র আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। নিজের দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের খুঁটিনাটি জানা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। সরকারী উদ্যোগে প্রকাশিত রাজনৈতিক মানচিত্রটি এ ব্যাপারে দেশের নাগরিকদের চাহিদা পরিপূরণ করেনি। এই মানচিত্রটিতে সীমান্ত রেখা ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ তথ্য সংযোজিত না হওয়ায় একটি আদর্শ মানচিত্র প্রকাশ একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। দেশের মানচিত্রে যদি সেদেশের পরিপূর্ণ পরিচয় না থাকে, তাহলে বিদেশের মানুষ তো দূরের কথা, দেশের মানুষই বা নিজ দেশের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হবেন কেমন করে? দেশের ভূ-প্রকৃতি, নদ-নদী, জলবায়ু, মৃত্তিকা, বন, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, খনিজ দ্রব্য, হস্তশিল্প, পরিবহন, জনসংখ্যা, জনপদ, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, ভূমি ব্যবহার ইত্যাদির পরিচয় মানচিত্রের মাধ্যমেই তুলে ধরা সম্ভব। এই অবস্থায় কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তকে সন্নিবেশিত দায়সারা গোছের মানচিত্র প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো কাজেই লাগে না। বরং ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারী পরিসংখ্যান থেকে বঞ্চিত হয়ে দেশ সম্পর্কে একটা ভাসাভাষা জ্ঞান লাভ করে থাকে মাত্র। ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারই বলতে হবে। দেশের মানচিত্রের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ জাগিয়ে তোলার জন্য দেশের বিভিন্নমুখী পরিচয় চিহ্নিত মানচিত্রের প্রয়োজনীয়তাকে একেবারে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই জন্যই বাংলাদেশের একটা পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রণয়ন ও প্রকাশনার প্রতি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকারের তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর এ ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানচিত্রে এতো রকমারী তথ্য সন্নিবেশিত থাকে যে, আমরা নিজ দেশের চাইতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের খুঁটিনাটি বেশী জানি। এ অবস্থায় আমাদের জন্যে যেমন, তেমনি বিদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যও বাংলাদেশের ব্যাপক পরিচিতি সহ একটি মানচিত্র চাই। মানচিত্র হচ্ছে একটি দেশের আয়না। এই আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয় সমগ্র দেশ। কাজেই পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রকাশের প্রতি অবিলম্বে দৃষ্টিদান করতে হবে। এবং সেই মানচিত্রে যেন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দিকগুলোও প্রতিফলিত হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন