You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুলাউড়া শহর গনহত্যা ও বধ্যভূমি, মৌলভীবাজার

একাত্তরের ৭ মে মৌলভীবাজার দিক থেকে পাকবাহিনী এসে প্রবেশ করে কুলাউড়া শহরে। কুলাউড়া থানা শহরের আজম বোর্ডিং ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের আড্ডাখানা। এর মালিক মোবারক আলী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী-লীগার। তাই, আক্রমণ চালানো হয় তাঁর হোটেল কাম বোর্ডিংয়ের ওপর। মোবারক আলীকে না পেয়ে হোটেল ম্যানেজার আব্দুর রহমানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে কুলাউড়া হাসপাতালের সামনে নিয়ে গিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সাথে হত্যা করা হয় হালিম উল্লা নামের এক ব্যক্তিকেও। তারও আগে গুলি করে হত্যা করে তারা অপ্রকৃতিস্থ একজনকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসররা তখন এসে হাত মেলায় তাঁদের প্রভুদের সাথে।
এলাকার বহু দালাল শুধু রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি; পাকবাহিনীর সহায়তা নিয়ে অত্যাচার করেছে অসংখ্য নিরীহ মানুষের ওপর। তাঁদের অনেককে ধরে এনে তুলে দিয়েছে পাকবাহিনীর হাতে। শুধু তাই নয়, তারা এখানে গড়ে তোলে বেশ কিছু নির্যাতন কেন্দ্র। কুলাউড়া থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও নবীন চন্দ্র উচ্চবিদায়লয় প্রভৃতিস্থানে এসব নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে ছিল হানাদার বাহিনীর মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল এবং ক্যাপ্টেন দাউদ। মোগল-দাউদের নির্দেশে হানাদার সেনা ও তাঁদের দালালরা প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রাম থেকে যাদের ধরে আনত, তাঁদের দিনের পর দিন এসব নির্যাতন কেন্দ্রে অকথ্য অত্যাচার ভোগ করতে হতো। এরপর পৃথক পৃথক দলে ভাগ করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হতো বধ্যভূমিতে। হাসপাতালে প্রথমে বহু লাশ জমা হয়। তারপর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে চাতলগাওয়ের গোরস্থানে একটি বড় গর্ত করে সেখানে লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখে পাকবাহিনী। কুলাউড়া নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বিপরীত দিকে রেলপথের পূর্ব পাশে চিড়ল নামের এক রুহিদাসের বাড়িকে আর একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করে হায়েনার দল। রেল স্তেশনের দক্ষিণ পাশে এবং নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের দক্ষিণেও তাঁদের আরো দুটি বধ্যভূমি ছিল। কখনো কখনো হাসপাতাল বা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে তাঁদের হাতে নিহত নিরীহ বাঙালিদের মৃতদেহগুলো নিয়ে পুঁতে রাখত তারা এসব স্থানে। আবার কোনো কোনো সময় ওই স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত ধৃত দেশপ্রেমিক লোকজনকে। এভাবে হাসপাতালের সামনে আব্দুর রহমান ছাড়াও রাজনগরের শামসুল আলমকে হত্যা করে তারা। বিভিন্ন স্থান থীক দালালদের সহযোগিতায় ধরে এনে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতা আসদ আলী, ডা. সিকান্দার আলী ও আতাউল্লাহসহ অসংখ্য বীর বাঙালিকে।
আপ্তাব উদ্দিন নামের একজন দালাল এবং রাজাকাররা রঙিনকুলের হাজির আলীকে তাঁর বাড়ি থেকে ধরে আনে। তারপর শহীদ হন তিনি শত্রুর বুলেটে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এবং নাট্যশিল্পি ছিলেন মাগুরার সীতেশ চন্দ্র দেব। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় দেশত্যাগ করে চলে যান ভারতে। এ সময় তাঁর একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। এস অংবাদ শুনে গোপনে তিনি চলে আসেন পুত্রের মুখদর্শনে; কিন্তু সন্তানের দর্শন শেষে পালাতে পারেননি সীতেশ দেব। তাঁর আগেই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনার দল। তাঁর বুকও ঝাঁঝরা হয়ে যায় পাকবাহিনীর গুলিতে। কুলাউড়া নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে প্রাণ দিয়েছেন অসংখ্য বাঙালি। কত শত লোক যে এখানে নির্যাতিত হয়েছে, তাঁর হিসাব বের করা খুবই কঠিন কাজ।
বাহাদুরপুর গ্রামের আব্দুর নূর খান শ্রীমঙ্গলের এক চা বাগানের টিলা বাবু ছিলেন। একাত্তরের ভয়াল ইনগুলোতে এক পর্যায়ে চলে আসেন নিজের বাড়িতে কিন্তু তাঁর বাড়ি থেকেই তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। তাকে হত্যা করা হয় শ্রীমঙ্গলে নিয়ে গিয়ে। এই শহীদের স্ত্রীও পরে স্বামী-শোকে মারা যান। পরে তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তান লালিত ও বর্ধিত হয় অন্যের ঘরে। স্টেশন রোডের একজন ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদকেও হত্যা করে তারা। কুলাউড়া আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। তাকেও ক্যাপ্টেন দাউদ বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
২৭ মে লস্করপুর গ্রাম থেকে বন্দি করে কমিউনিষ্ট নেতা নূর আহমদকে বন্দি করে রাখে তাকে হাসপাতালের নির্যাতন কেন্দ্র। সেদিন হাসপাতালে ছিলেন মোট ৭৭ জন বাঙালি। তাঁদের ভেতর থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ জন করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো। আর ফিরে আসত না তারা। বধ্যভুমিতে নিয়ে যাওয়া প্রায় সবাইকে হত্যা করে পাকিস্তানি নরপশুরা। তবে নূর আহমদকে কয়েকবার বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনে তারা। অবশেষে মুক্তি দেয়া হহয় তাকে। এসময় নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে একটি গাছতলায় দাও দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বহু লোককে। নূর আহমেদকে ছাড়ার আগে অমানুষিক নির্যাতন করে তাঁর দান পা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয় শমসের নগরের নূর হোসেনকে। সাগরনাল থেকে ক্যাপ্টেন দাউদ ধরে এনে হত্যা করে নেছার আহমেদকে এবং পুসুপাইনগরের আব্দুল লতিফ, নগেন্দ্র দাশ ও সুরেন্দ্র বৈদ্য, বিহালার মতি মিয়া ও রঙিরকুলের বিনোদ বিহারি ধরকে।
ছাত্র ইউনিয়ন নেতা গোলাম কবিরকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনী থানায় আটক কএ তাঁর ওপর শারীরিরক নির্যাতন চালায়। অবশেষে দেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। কমিউনিস্ট নেতা আজিরউদ্দিন খান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুহিব উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখকে ধরে এনে তাঁদের সভায় বক্তৃতা দিতে বাধ্য করে পাকবাহিনী। ছাত্রলীগ নেতা রেজাউর রহমান চৌধুরীকে বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়েছিল। পরে প্রতি সপ্তাহে একবার করে পাকবাহিনীর ডেরায় এসে হাজিরা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাজার এলাকা থেকে ধরে আনে তারা দাগনচন্দ্র দত্ত বাবুল অধিকারীকে। নবীন চন্দ্র উদ্দবিদ্যালয়ে একদিন একরাত রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয় তাঁদের ওপর। নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত করা হয় তাঁদের দেশ। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়। চুনঘরের দরছ মিয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি থেকে প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে। শেষে ছেড়ে দেয়া হয় তাঁদের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে।
হাজিপুর ইউনিয়নের আমিনুর রহমানকে কুলাউড়া রেলস্টেশন থেকে ধরে নিয়ে যায় জুরিতে। সেখানে আটকে রেখে তাঁর ওপর চালানো হয় মারাত্মক শারীরিক নির্যাতন। এর আগে জুরিতে তাকে একবার ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। আর সর্বপ্রথম বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল মনুতে। সেই সাথে কাউকাপন গ্রামের ফজলুল হককেও। অভিযোগ, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন। একই দিনে তারা ধরে আনে আওয়ামী লীগ নেতা আমির আলী ও তাঁর বাবা হাজী আরজান উল্লাকে। গাছের সাথে বেঁধে তাঁদের প্রচণ্ড প্রহার করা হয়। পরে পাঠিয়ে দেয়া হয় শমসেরনগর। সেখানে তাঁদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক অত্যাচার। টিলাগাও ইউনিয়নের মিয়ার পাড়া গ্রামেও বহু লোকের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন ভোগকারীদের মধ্যে মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতলিব চৌধুরীও ছিলেন। গুড়াভুইয়ের সুকুমার চৌধুরীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে কুলাউড়া নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে রেখে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও সেই নির্যাতনের পরিণতিতে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। পাল্লাকান্দি থেকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করা হয় লাক্কাতুরা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক সৈয়দ মিরাজুল আবদালকে, দুটি রাজনৈতিক বই লিখেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন আহমদ। সেই অপরাধে তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। তাঁর ভাই আলাউদ্দিন আহমদ ও মুজাহির উদ্দিন আহমদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নির্যাতন কেন্দ্রে। পরে টাঙ্গাইল থেকে ডেকে এনে গিয়াস উদ্দিনকে আটক করে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!