কেওয়াছড়া গণহত্যা, সিলেট
বিমানবন্দরের রানওয়ের পূর্বে কেওয়াছড়া চা বাগান। আকারে ক্ষুদ্র লাকাতুরার ফাড়ি। বাগান এলাকাটি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভ্রপুর। এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট খাল। দু পাশে চারাগাছ।
এ বাগানেও আগমন ঘটে একদিন হানাদার সেনাদের। তারা সহকারী ব্যবস্থাপকের নিজস্ব গাড়িটি নিয়ে যায়। তারপর বাংলোয় আগুন ধরিয়ে দেয়। বাংলোর সমস্ত সম্পত্তি লুট করে নিয়ে যায়। সহকারী ব্যবস্থাপককে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। দীর্ঘদিন বন্দি রেখে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। অবশেষে হত্যা করা হয়।
এর মধ্যে একদিন হানাদার বাহিনী গোটা বাগান এলাকা ঘেরাও করে। শ্রমিক বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় তারা আগুনের লেলিহান শিখা। সেই সাথে শ্রমিকদের যা কিছু সম্পদ-সামগ্রী ছিল, তার সব কিছুই লুট করে নিয়ে যায়। শ্রমিকদের লালনপালন করা গরু-ছাগল ইত্যাদিও তাদের লুটের হাত থেকে রেহাই পায় না। বাগান যখন পুড়ছে, নির্বিচার লুটপাটে মত্ত যখন পাকবাহিনী, তখন তাদের প্রখর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে লোকজন পালাতে থাকে জঙ্গলের ভেতরে কিংবা বাগানের চারাগাছের নিচে আশ্রয় নেয়ার জন্য। কিন্তু সবাই তা পারেননি। প্রাণ নিয়ে পালাতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধ্রা পড়ে যান অনেকে। তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় বাগানের ভেতর তেলচিবড়া বস্তিতে। তাদের একটি সুশৃঙ্খল সারিতে দাঁড়া করানো হয়। কাঁধের ওপর হাত তুলে আবারো সারিটি সোজা করা হয়। তারপ্র তাদের সামনে আসে একজন অস্ত্রধারী। তাক করে তার আগ্নেয়াস্ত্র। বেশ কিছুক্ষন সময় ব্যয় করে লক্ষ্য থিক করে। তারপর ট্রিগারে চাপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন গরিব শ্রমিকরা। সাথে সাথেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন তারা।
এদিকে পুরো শ্রমিক বস্তি ছাইভস্মে পরিণত হয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাংলো, ম্যানেজারের গ্যারেজ ইত্যাদি। টিলার ওপ্র তখন শুধু ছাইয়ের স্তুপ। নিচেই বাগানের অফিস, মেডিকেল সেন্টার, প্রাথমিক বিদ্যালয় ইত্যাদি। সবই গ্রাস করে আগুনের লেলিহান শিখা।
কেওয়াছড়া বাগান পোড়াবার পর সমস্ত শ্রমিক পালিয়ে যায় তেলহাটি বাগানে। সেখানেও একদিন পাকবাহিনী হানা দেয়। ধরে আনে ২৫ জন শ্রমিককে। বাংলাটিলায় তাদের দিয়ে বাঙ্কার তৈরি করায়। তারপর তাদের ওপর চালায় নির্যাতন। প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে তোলে তাদের। তেলহাটি বাগানের প্রহরী রুণ্ডা গুঞ্জকে বাগানে কর্মরত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত