কান্দাপাড়া নির্যাতন ও গনহত্যা, বাগেরহাট
বাগেরহাটের উত্তর অংশে বেশরগাতি গ্রামের শেখ হাবিবুর রহমান হবি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন এবং চিতলমারীর পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটা গ্রাম তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ঐ অঞ্চলে বাহিনীটি তখন হবির পার্টি নামে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে। এই পার্টির সক্রিয়তার গুনে মে মাসের মধ্যে সমস্ত বাংলাদেশ যেখানে পাকবাহিনীর কব্জায় চলে আসে সেখানে জুন মাসের মাঝামাঝি পার হয়ে যাওয়া স্বত্বেও ঐ অঞ্চল পাকবাহিনী বা রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে যায়নি। বাগেরহাটে অবস্থিত পাকবাহিনী ও রাজাকারদের জন্য হবির পার্টি তাই বিশেষ গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘরও লুটতরাজ হচ্ছে না, সেটিও তাঁদের খুব চিন্তিত করে। শেষ পর্যন্ত সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে বেশরগাতির হাবিবুর রহমান হবির ওপর। ইতিমধ্যে শান্তি কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কান্দাপাড়া হাইস্কুলের শিক্ষক শেখ অলিউর রহমান শান্তি কমিটির কাছে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার কথা অবগত করিয়ে ইংরেজিতে একটি পত্র লিখেছিলেন। রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের নিকট পত্রটি পৌছানো মাত্র তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন এবং তাঁর বাহিনী নিয়ে সম্ভাব্য আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
১৮ জুন শুক্রুবার বাগেরহাটের রাজাকার বাহিনী দুই ভাগে ভাগ হয়ে একদল বাগেরহাট থেকে মুন্সিগঞ্জ খেয়া পার হয়ে বাগেরহাট-চিতলমারী সড়কপথে অগ্রসর হতে থাকে, অন্য একটি দল আসে ফকিরহাটের মূলঘর থেকে কুচিবগা খালের পথে। কান্দাপাড়া হাইস্কুলের শিক্ষক খোন্দকার জহুরুল হক তাঁর সহকর্মী অলিউর রহমানের গতিবিধি লক্ষ করে বিষয়টি আচ করতে পারেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেশরগাতি প্রাইমারি স্কুলের ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্প কমান্ডার হাবিবুর রহমানকে খবর দেন। ফলে রাজাকার বাহিনী কান্দাপাড়া-বেশরগাতিতে পৌছানোর আগেই হাবিবুর রহমান তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অদূরবর্তী শুড়িগাতি গ্রামে গিয়ে আত্মগোপন করেন। কেননা ততদিনে রজ্জব আলীর বাহিনীর শক্তি এতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তাকে সামনাসামনি মোকাবিলা করা হাবিবুর রহমানের বোকামি হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন দুর্দিনে কোনো রকম লোকক্ষয় হোক, তাও তিনি চাননি, তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে কান্দাপাড়া-বেশরগাতিতে তাঁর সমর্থকদের এভাবে হত্যা করা হবে, তা জানলে তিনি হয়তো অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতেও পারতেন। রাজাকার বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার সিরাজ মাস্টার ততদিনে ছোটখাটো খান্নাসে পরিণত হয়ে গেছেন। খুলনায় তিনি যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেই স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করেছিলেন বেশরগাতি গ্রামের শেখ ছায়েল উদ্দিনের দুই ছেলে শেখ আব্দুল আলী এবং শেখ মকবুল আলী। রাজাকার বাহিনীর মধ্যে তাঁদের শিক্ষক আছেন ভেবে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন তাঁদের শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে পরিচয় দিলে তিনি হয়তো এ এলাকার কোনো রকম ক্ষতি হতে দেবেন না। কিন্তু আব্দুল আলী এবং মকবুল আলীর ধারণায় ভুল ছিল, পাকিস্তানের নামে উন্মত্ত তাঁদের শিক্ষককে তারা চিনতে পারেননি। তাছাড়া অলিউর রহমানের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে তাঁদের নামও যে অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা তারা জানতেন না। তাই সিরাজ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করা মাত্রই, তিনি তাঁর সহযোগীদের নির্দেশ দিলেন ওদের বেঁধে ফেলার জন্য।
কান্দাপাড়া ও বেশরগাতি গ্রামের সাধারণ মানুষ কল্পনা করতে পারেনি যে, রাজাকার বাহিনীর লোকজন তাঁদের বড়িঘর লুটপাট করতে ও অগ্নিসংযোগ করতে পারে অথবা তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। রাজাকার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়েও সাধারণ মানুষ যে যার বাড়িতে অবস্থান করছিল। তাছাড়া দিনটি শুক্রুবার হওয়ায় অনেকে সেদিন জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময়ে পাইকপাড়া গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য কাজী আব্দুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলতি গ্রামে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পলায়নের খবর পেয়ে রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে যাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল পালাক্রমে তাঁদের সকলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, তাঁদের বাড়িঘর লুটতরাজ করা হয় এবং অভিযুক্তদের বেঁধে কান্দাপাড়া বাজারে এনে জড়ো করা হতে থাকে। অন্যতম অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন মাস্টার এবং ইব্রাহিম হোসেন মাস্টারকে বাড়িতে না পাওয়ার তাঁদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
রাজাকার বাহিনীর প্রথম শিকার হয়েছিলেন হামজা আলী। রাজাকারদের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে তিনি যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন এক রাজাকারের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর তাঁর মৃতদেহটিকে টেনে-হিচড়ে কান্দাপাড়া বাজারে নিয়ে আসা হয়।
ফকিরহাট থেকে আসা রাজাকারদের দ্বিতীয় দলটি কদমতলা গ্রামের অজিত বসু এবং উৎকুল গ্রামের নারায়ণচন্দ্র দাসকে পথ থেকে ধরে এনেছিল। বেশরগাতি গ্রামের শেখ ছায়েল উদ্দিনের দুই ছেলে শেখ আব্দুল আলী ও শেখ মকবুল আলী সিরাজ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সেখানেই তাঁদের বাঁধা হয়েছিল, পরে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের ধরা হয়। হাবিবুর রহমানের গোষ্টির লোক হওয়ার অপরাধে ঐ বাড়ি থেকে আরো পাচজনকে ধরে কান্দাপাড়া বাজারে নিয়ে আসা হয়েছিল। এভাবে দুপুর গড়াতে না গড়াতে হামজা আলীসহ মোট ২৫ জনকে বেঁধে জড়ো করা হয় কান্দাপাড়া বাজারের রাস্তার ওপর।
বন্দিদের কী করা হবে, তা নিয়ে রাজাকার নেতৃবৃন্দ স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা কাজী আব্দুর রহমানের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে সিরাজ মাস্টার এসে ২৫ জনের মধ্য থেকে ৭ জনকে বেছে বেছে আলাদা করেন এবং সামান্য কিছু দূরে নিয়ে একটার পর একটা জবাই করে নিকটস্থ গর্তের মধ্যে ফেলে দেন।
অবশিষ্ট হতভাগ্যদের গলায় একেরপর এক ছুরি চলতে থাকল। মঞ্জুর মোল্লার গলায় ছুরি বসানোর ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে হাটের দড়িটা খুলে ফেলেন, তারপর সিরাজ মাস্টারের ছুরি গলা বরাবর আসতে না আসতেই মঞ্জুর মোল্লা ছুরিটা ধরে ফেলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গিয়ে সিরাজ মাস্টারের পেটে একটা লাথি মেরে দৌড়ে পালাতে সক্ষম হন। এর ফাঁকেই চতুর সিরাজ মাস্টার তাঁর ছুরির আগাটা মঞ্জুরের পাঁজরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ক্ষত জায়গাটা চেপে ধরে মঞ্জুর মোল্লা দৌড়াতে দৌড়াতে সোজা চলে যান সোহরাব ডাক্তারের কাছে। ছোরাটা ফুসফুস পর্যন্ত ঢোকেনি, তাই কয়েক দিনের চিকিৎসায় মঞ্জুর মোল্লা সুস্থ হয়ে ওঠেন। সিরাজ মাস্টারের ছুরিতে সেদিন অনেকেই প্রাণ দিয়েছিলেন।
[১২৪] স্বরোচিষ সরকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত