You dont have javascript enabled! Please enable it!

কানাইপুর সিকদার বাড়ি হত্যাকাণ্ড, ফরিদপুর

৮মে বিহারি রাজাকারদের একটি সশস্ত্র দল ফরিদপুরের কানাইপুর গ্রামে প্রবেশ করে। ওই দিন সিকদার বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়িতে চড়াও হয়ে ১৮ জনকে জবাই করে হত্যা করে। এই পৈশাচিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা আচ করা যায়। সেদিনের কিশোর, আজকের সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বর্ণনায় ‘দিনটি ছিল ৮ মে, ১৯৭১। বাবা-কাকারাই এক ছাত্র রামদা উঁচিয়ে তারই বাবার নেতৃত্বে রাইফেল কাঁধে বিহারিদের নিয়ে আমাদের আটক করল। অনেক লোক। কেউ সক্রিয়, কেউ নিষ্ক্রিয়, কেউ দর্শক। বাবা বাড়িতে ছিলেন না। অবশ্য পরে আর কখনোই বাবাকে দেখিনি, আরো লোকজনকে ধরে দু কাকা, মামা, আমরা পাঁচ ভাই-বোন, মা, ঠাকুরমা এবং আরো অনেককে প্রস্তুতি চলল খুনের। বেছে বেছে খুনের। কাকা তাঁর ছাত্রটির সঙ্গে রফা করার চেষ্টা করলেন কিন্তু সবাইকে খুন করা হবে। কাউকে রেহাই দেয়া হবে না। দাঁড় করানো হলো লাইনে। সামনে তাঁর করা হলো রাইফেল। আমি আর আমার ছোট ভাই-বোনগুলোর লাইনে আসছিল নাম। ঘাতক দল তৎপর হলো। মা, কাকা, ঠাকুরমার ওপর নির্দেশ জারি করা হলো আমাদের উঁচু করে ধরার। আমাকে উঁচু করে ধরলেন আমার বড় কাকা। আমি লাইনের আগে; পেছনে তাকিয়ে দেখিনি আমার অন্য সব ভাই-বোনকে কারা উঁচু করে ধরেছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক হলো আবার রাইফেল তাক করা হলো। রাইফেলে চোখ রেখে সামনে ঘাতক। গুলি করা হবে এমন সময় একজন রাইফেল ঘুরিয়ে দিল। গুলি আর হলো না। ঘাতকে ঘাতকে পরামর্শ হলো। সিদ্ধান্ত হয় মেয়ে মানুষ আর বাচ্চাকাচ্চা মারা যাবে না। এ সিদ্ধান্তটিও ইসলামের নামে দেয়া হলো। তারপর লাইন ভেঙ্গে দেয়া হলো। আমরা বাচ্চাকাচ্চা আর মেয়ে মানুষ পৃথক হলাম। পাশেই ছিল রান্নাঘর। রান্নাঘরের বারান্দায় আমাদের বসিয়ে রাখল। উঠানের তুলসী তলায় একে একে জবাই চলল। কোনো রান্না নেই, আহাজারি নেই, বেঁচে থাকার আকুতি নেই, ওরা যেমন জবাই করার জন্য তৈরি, তেমনি এরাও জবাই হতে তৈরি। এক এক করে জবাই হলেন দিনেশ চন্দ্র সিকদার, জীবেশ চন্দ্র সিকদার, আনন্দ কুমার পোদ্দার, দুলাল চন্দ্র সিকদার, বিভূতিভূষণ সিকদার, অজিত কুমার সিকদার। আমাদের এতটুকু কাঁদতে দিল না। সেই রাইফেল যা লাইনে তাক করা হয়েছিল তাতে বেয়োনেট লাগিয়ে চোখ বরাবর ধরে রাখা হলো। যতক্ষন জবাই পর্ব চলল ততক্ষন বেয়োনেট চোখের ওপর নাচতে লাগল। জবাই পর্ব শেষে আমাদের আটকে রাখা হলো একটি ঘরের খাবার বন্ধ। প্রসাব-পায়খানা তাও বন্ধ। দেড়দিন এভাবে কাটাল। দেড়দিনের মাথায় একজন দফাদার আমাদের মুক্ত করল। বন্দিদশা থেকে বেরুনোর সময় সেই তুলসীতলা দিয়েই সিকদারবাড়ি ছেড়ে দিলাম। তখন লাশগুলো আর দেখিনি। শুধু চাপ চাপ রক্তের দাগ আর পিপড়ার সারি ছিল। কে একজন তুলসীতলার পাশে লাশ দেখে বলেছিল তোমার কাকারা ঐ কুয়ার ভেতর।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চলেছিল ব্যাপক লুটপাট। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে সোনাদানা, কাঁসাপিতল, বাসনকোসন, আসবাবপত্র, যার ঘরে যা ছিল তা বস্তা বেঁধে বিহারি ও বাঙালি রাজাকাররা নিয়ে যায়।
কানাইপুর, খাসকান্দি, লক্ষ্মীপুর, হোগলাকান্দির হিন্দুদের ঘরবাড়িতে ব্যাপক লুটপাট শেষে ঐসব বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।
[১৫] আবু সাঈদ খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!