কামাইদ গণহত্যা, সিলেট
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর থেকে পাঁচমাইল পূর্ব-দক্ষিন দিকের একটি নিভৃত পল্লী কামাইদ। হাওড়-জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই গ্রামের নিরীহ মানুষজন নিজেদের এলাকাকে অধিকতর নিরাপদ মনে করে পুরো এপ্রিল মাসটা দেশের ভেতরেই ছিলেন। ইতিমধ্যে ১ মাইল দূরবর্তী সিলেট শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়ে গেছে। বিমান আক্রমণে শহীদ হয়েছেন বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা। তবুও কামাইদবাসী ভাবতে পারেননি যে এই দুর্গম অঞ্চলেও পাক নাৎসিরা আক্রমণ চালাবে।
৫ মে। এ দেশীয় পাকিস্তানি দালালরা নিজেদের লুটপাটের স্বার্থে পাকবাহিনীকে নিয়ে আসে গ্রামে। সকাল আটটার মধ্যেই বিশাল হাওড় পাড়ি দিয়ে হরিপুর থেকে এসে পৌছায় তারা ভোলানাথের টিলায়। শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ। পুরো গ্রামে মুহূর্ত কয়েকের ভেতরে কায়েম হয়ে যায় সন্ত্রাসের রাজত্ব।
মাতঙ্গিনী চক্রবর্তী এবং আর এক গৃহিণী তখন তাঁদের বাড়ির স্ব-স্ব গোয়ালঘর পরিষ্কার করছিলেন। গোয়ালঘর থেকে বেরুবার পথেই পাকবাহিনীর ছোড়া গুলি ভেদ করে গেল বুক। গৃহস্বামী অশ্বিনী চক্রবর্তী আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু প্রাণরক্ষা করা যে সম্ভব নয়, সেটা উপলব্ধি করে এবার প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলেন তিনি। নমষ্কার করার ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তোলার সাথে সাথেই রাইফেল থেকে বেরিয়ে এলো গুলি। মাতঙ্গিনী ও অশ্বিনীর মৃতদেহ পড়ে থাকল যথাস্থানে। এরপর পাকবাহিনী দালালদের দেখানো পথে আক্রমণ চালাল একের পর এক বাড়িতে। শত্রু নিধনের সফলতার আনন্দে তৃপ্ত পাকবাহিনী গ্রামের পূর্ব প্রান্তে বসে যখন মহানন্দে সিগারেট ফুকছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই হাজির হয় তাঁদের সহযোগী একজন দালাল। জানাল নীলমণি দাসের পরিবারের ছয়জন এখনো বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। এই বাঙালি বিশ্বাসঘাতকের দেখানো পথে পাক হায়েনারা আসে নীলমণি দাসের বাড়িতে, আত্মগোপন অবস্থান থেকে বের করে আনে তারা কথিত সেই ছয়জনকে। প্রতি দুজনকে একত্র করে মোট তিন জোড়ায় বাঁধা হলো তাঁদের। নিয়ে আসা হলো গ্রামের পূর্ব প্রান্তের একটি গোপাটে। সেখানেই বুলেটবিদ্ধ করে একে একে হত্যা করা হলো তাঁদের। তখন গ্রামের অবশিষ্ট মানুষজন প্রাণভয়ে বহু দূর চলে গেছে। পাক জল্লাদরা ফেরার পথে হাওরের ভেতর দিয়ে পলায়নপর রাখাল চক্রবর্তীকে হত্যা করে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত