কালাগুল চা বাগান গণহত্যা, সিলেট
২৬ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী আগমন করে কালাগুল বস্তিতে। পাকসেনা সদস্যরা গ্রামে প্রবেশ করেই লোকজনের ওপর অত্যাচার শুরু করে। গুলি করতে থাকে এলোপাতাড়ি। আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামময়। যেখানে যাকে প্রায় তারা, তাঁর ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুড়িয়ে দিতে থাকে একের পর এক ঘড়বাড়ি। গ্রামবাসী নারীপুরুষ সবাই পালাতে শুরু করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু নরপশুদের দৃষ্টি এড়াতে পারলেন না অনেকে। তারা তাঁদের পেছনে পেছনে ধাওয়া শুরু করে। যেই তারা একটু কাছাকাছি হয়, অমনি গর্জে ওঠে তাঁদের হাটের রাইফেলগুলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুজন বাঙালি। শূন্য মাঠে পড়ে থাকে তাঁদের মৃতদেহ। সূর্যের প্রখর তাপে একদিনের ব্যবধানেই ফুলে-ফেপে ওঠে সেই লাশ। কয়েক দিন পর জনাকয় সহৃদয় ব্যক্তি তাঁদের লাশ তুলে নিয়ে দাফনকাজ সম্পন্ন করেন।
আব্দুল মতালিব এবং আকলু মিয়াকে মাঠে হত্যা করার পর হানাদার সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি হানা দিতে শুরু করে। কিন্তু সব বাড়ি ফাঁকা। গ্রামবাসী তখন নানাভাবে আত্মগোপন করেছে। যে যেদিকে পারে, পালিয়ে গেছে। সারা গ্রাম খুজে তারা কেবল তিনজনের সন্ধান পায় এবং আটক করে। তারপর রাস্তার পাশে তাঁদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফেলে যায়। এভাবে গ্রামব্যাপী চলে একদফা লুটতরাজ এবং কয়েকজন মহিলার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
সামান্য একটু সময়ের ব্যবধানে তারা হত্যা করে গ্রামের ছয়জন বাসিন্দাকে। লুটতরাজ করে সমস্ত গ্রামে। পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি। পাশাপাশি নারী ধর্ষণ। আর সহ্য করতে পারেননি গ্রামবাসী। মরতে হয় সবাই মরবে। তবুও নিজেদের মা-বোন বা জায়া-জননীকে নিতে দেবে না। তাই গ্রামের উত্তর দিকে যারা ঝোপ জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন, তারা সবাই বেরিয়ে এসে জড়ো হলেন একত্রে। প্রতিবাদ করবে তারা এই অন্যায়-অবিচারের। কিন্তু তাঁর আগেই তারা বন্দি হলো সেনাদের হাতে। সংখ্যায় তখন তারা ২৯ জন। একটি মাত্র সারিতে দাঁড় করায় তাঁদের সবাইকে। তারপর আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে ধরে। গুলি ছোড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে নতুন একদল পাক সৈন্য অকুস্থলে উপস্থিত হয়। বাঁধা দেয় তারা গুলিবর্ষণে। আর, এভাবেই মুক্তি লাভ করে ২৯ জন গ্রামবাসী।
অন্যদিকে আব্দুস সামাদ এবং আহমদ আলীসহ তাঁদের পুরো পরিবার প্রাণ নিয়ে তখন পলায়নপর। প্রায় চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে চান্দাইয়ের হাওর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু আব্দুস সামাদকে নিরাপদ স্থলের পরিবর্তে আশ্রয় নিতে হলো মৃত্যুর কোলে। সেখানেও পাকসেনা। সেখানেও আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন আর বুলেট। সেইসব বুলেটের একটি এসে বিদ্ধ হয় সামাদের বুকে। সাথে সাথেই তিনি লুটিয়ে পড়েন মৃত্যুর কোলে। চান্দাই গ্রামেই তাকে সমাহিত করা হয়।
ফতেগড়ের আঞ্জব আলীও নিহত হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। তাকে হত্যা করা হয় ফতেগড়ের উত্তরের মাঠে। আনর মিয়ার বাড়িতে সেনারা ঢুকে অত্যাচার শুরু করলে আনর মিয়া সহ্য করতে পারেননি। জাপটে ধরেন একজন পাকসেনাকে। সাথে সাথেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে হায়েনারা। গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান তিনি। পাকসেনারাও তাকে মৃত ভেবে চলে যায় কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি।
এভাবে প্রায় ১৫টি গ্রাম একই সাথে পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী। নারী নির্যাতনও করেছে প্রতিটি গ্রামে। কালাগুলের বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ আলী ও পাখি মিয়া অপারেশন করতে এসে পাক সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে তারা। গন্ধব ইরাং নামের একজন অপ্রকৃতিস্থ যুবককেও হত্যা করা হয় হাওর এলাকায়।
পুরাইনকাটা গ্রামে গিয়ে হত্যা করে ছাওয়াব আলীর দুই স্ত্রী আপতেরা বিবি ও ছরতুন বিবিকে। একই সাথে হত্যা ক্রে আরো এক মহিলাকে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত