You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.05 | কলারোয়া বধ্যভূমি | সাতক্ষীরা - সংগ্রামের নোটবুক

কলারোয়া বধ্যভূমি, সাতক্ষীরা

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৫ এপ্রিল ’৭১ পাকিস্তানি হানাদাররা প্রথম কলারোয়ায় আসে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ঝিকরা গ্রামের মাজেদ আলী খান, জালালাবাদের মৃত সৈয়দ এরশাদ হোসেন, সোনাবাড়িয়ার মৃত ডা. আব্দুর রহমানসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল পার্শ্ববর্তী শার্শা থানার নাভারণ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বরণ করে কলারোয়ার মাটিতে নিয়ে এসে স্থানীয় ডাকবাংলায় আশ্রয় দেয়। পরে এরাই শান্তি কমিটি গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য পাচার করত। এমনকি শান্তি কমিটির সদস্য সোনাবাড়িয়ার ডা. আব্দুর রহমানের বাড়িতে ওয়্যারলেস টাওয়ার নির্মাণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত রাজাকাররা। তাঁদের তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও নির্মম নির্যাতন চালিয়ে পুরো কলারোয়াকে বধ্যভূমিতে পরিণত করে।
২৮ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদারদের প্রথম আক্রমণের শিকার হয় শ্রীপতিপুরের পালপাড়া। ঐ দিন হানাদারদের হাতে শহীদ হন বৈদ্যনাথ পাল, রঞ্জন পাল, বিমল পালসহ নয় জন। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে, উপস্থিত ছিলেন গদখালী গ্রামের নুরুল হক, লাঙ্গলঝাড়া গ্রামের আব্দুর রশিদ, শ্রীপতিপুর গ্রামের ইদ্রিস আলী ও শিবানন্দকাটি গ্রামের ফরমানসহ ২০ থেকে ২৫ জন এদেশীয় দালাল সহযোগী। এ সময় তারা সমগ্র পালপাড়া লুণ্ঠণ করে নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
এ পর্যন্ত কলারোয়ায় ৮টি বধ্যভুমিরর সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে নিহত শহীদদের সবার নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবে কলারোয়া হাইস্কুল মাঠের দক্ষিণ পাশে ৫ জন, শ্রীপতিপুরের পালপাড়ায় ৯ জন সোনাবাড়িয়ায় হিন্দুপাড়ায় ২ জন, বামনখালীতে ২ জন এবং পার্শ্ববর্তী শার্শা থানার জামতলা নামক স্থানে কলারোয়ার পাচনল গ্রামের মতিয়ার ও আব্দুর রশিদসহ অজ্ঞাত ৫ জনকে গণকবর দেয়া হয়। সোনাবাড়িয়ায় মঠ মন্দিরের পুরোহিত হাজরা গাঙ্গগুলি ও শিবু পোদ্দার। পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য ডা. আব্দুর রহমান মন্দিরের পুরোহিতকে মন্দির থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়ার ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা কলারোয়া থেকে মাহমুদপুর গ্রামের আফসার উদ্দীনকে তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরা সদর থানার গোবিন্দকাটি বিলের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে লাশ গাড়িতে তুলে চলে যায়। ঐদিন একই স্থানে পার্শ্ববর্তী মনিরামপুর থানার ছিয়ানব্বই গ্রাম থেকে আগত ২-৩ শত ভারতগামী নারী-পুরুষ ও শিশুর একটি আগন্তুক দলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে। এর ফলে ৩০-৪০ জন শহীদ ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এলাকাবাসী জানান, এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর শিশুকে মৃত মায়ের বুকের দুধ পান করার দৃশ্যও দেখা গেছে। এই হত্যার মূল নায়ক ছিল কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের ওয়াজেদ আলী ও ঝাউডাঙ্গার মতিয়ার রহমান। যুদ্ধকালীন সময়েই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এই দুই কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডারকে গুলি করে হত্যা করেন। অন্যান্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন: কাউরিয়া গ্রামের মো. হাফিজ উদ্দীন (কবর ভাদিয়ালী), আবু বকর (কবর তালা থানার মাগুরা গ্রামে), কেরালকাতা গ্রামের নূর মোহাম্মদ (কবর চন্দনপুর), পাটুলিয়ার শহারাব উদ্দীন (কবর খোরদো), বৈদ্যপুরের ডাকারিয়া (কবর বালিয়াডাঙ্গা)।
এ ছাড়া উপজেলার গোচমারা গ্রামে এক অজ্ঞাত মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত পাচপোতা গ্রামের মাস্টার আবু তাহের, বামনখালী গ্রামের রাজকুমার ঘোষ, মাদরা গ্রামের কামাল মুল্লুক মজুমদার ও অজিয়ার রহমানের সন্ধান আজো পাওয়া যায়নি। এলাকাবাসী জানান, চান্দার অজিয়ার রহমানকে শান্তি কমিটির নেতা সোনাবাড়িয়ার ডা. আব্দুর রহমান বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গলা কেটে ও গুলি করে হত্যা করে। কলারোয়া থানা ভবনের সবুজ চত্বর রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা কলারোয়া সদরের বেত্রবতী নদীর ব্রিজ ও দমদম ব্রিজ মাইন নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দিয়ে রাতে অজ্ঞাত ঐ সকল নিহত ব্যক্তিদের লাশ নিয়ে কলারোয়ার মাটি থেকে চিরবিদায় নেয়।
[৪২০] সংকলন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত