কাটাখাল গণহত্যা ও নির্যাতন, বাগেরহাট
মে মাসের ৭ তারিখ ডুমুরদিয়া ব্রিজের কাটাখাল নামক নদীতে শরণার্থীদের ওপর হামলার আর এক ঘটনা ঘটে। তখন খুলনা শহরসহ বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে তিন-চারশ নৌকা নিয়ে হাজার হাজার শরনার্থী ভারতে যাত্রা শুরু করে। তারা বটিয়াঘাটা নদী দিয়ে শৈলমারির ধানিবুনিয়ার পাশ ঘেঁষে কাটাখাল নদীতে পৌছালেই দুটো গানবোট এগিয়ে এসে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। সৌভাগ্যের বিষয় গানবোট একটু দেরিতে আসায় বহু নৌকা তাঁদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এর বিশ-ত্রিশ মিনিট আগে হানাদারেরা সেখানে পৌছালে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটতো বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা। বিশাল নৌবহরের শেষের দিকের যারা হানাদারদের সামনে পড়ে তারাই শুধু আক্রমণের শিকার হয়।
তবুও কম করে হলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শতাধিক মানুষ এ বর্বর হামলায় মৃত্যুবরণ করে। গানবোটের ঢেউয়ের আঘাতেও বেশ কিছু নৌকা ডুবে যায়। শিশু বৃদ্ধসহ কয়েকজন পানিতে ডুবেও প্রাণ হারায়। এসব নিহত হতভাগ্য মানুষের নাম উদ্ধার করা আজ একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। খুলনা সেন্ট যোশেফস স্কুলের শিক্ষক অশোক কুমার মণ্ডল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনোক্রমে জীবন রক্ষা করেন। ঐ সময় তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর একদিনের বাচ্চা। তাকে নিয়ে সাঁতার দেয়ার সময় সে শিশুপুত্র শেওলার মধ্যে আটকে যায়। পরে তাকে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়। বি এল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক রণজিৎ কুমার বিশ্বাসও এ শরনার্থীদের দলে ছিলেন। তিনিও অল্পের জন্য রক্ষা পান। তবে তাঁর সঙ্গীদের দু-একজন এতে মারা যান। উপরোক্ত অশোক কুমার মণ্ডল ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতি। এভাবে হানাদার বাহিনী গুলি করতে করতে গানবোট নিয়ে ঘোনাবান্দা নামক হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ঢুকে পড়ে। উদ্দেশ্য সেখানে গণহত্যা চালানো। তবে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা পূর্বেই বাড়িঘর পরিত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিল। তাই সেখানকার এলাকা পরিত্যাক্ত দেখে পাকসেনারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসে।
নদনদী প্রধান এলাকা বলে এখানকার প্রতি স্বচ্ছল পরিবারেই নৌকা ছিল। এসব নৌকায় করেই তারা ভারতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। মে মাসের ১০-১১ তারিখের দিকে রওনা দেয়া শরনার্থীদের নৌকার এক বিরাট বহর ১৩ তারিখে ভদ্রা নদী নিয়ে সুতারখালি পৌছায়। এ বহরে ছিল প্রায় কয়েক হাজার নৌকা। গায়ে গায়ে মিশে চলার কারণে মাইলের পর মাইল জুড়ে সমগ্র ভদ্রা নদী ঢেকে গিয়েছিল নৌকায়। সেখান থেকে কালাবাগী হয়ে শিবসা নদী পেরিয়ে পৌছায় হড্ডায়। হড্ডা থেকে বেনেখালি অফিস রেখে জায়গীরমহল হয়ে ঘুগরোকাটি ছেড়ে কপোতাক্ষ নদীতে পড়ে। সেখান থেকে চৌদ্দরশির দোয়ানে পেরুলেই বুড়ি গোয়ালিনি ফরেস্ট অফিস। এর এক পারে ফরেস্ট অফিস অন্য পারে সুন্দরবন। মাঝখানে খালপেটুয়া নদী। অর্থাৎ একপাশে সুন্দরবন অন্য পাশে লোকালয়। সেখানে শরনার্থীদের এ নৌকার বহর জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তখন এ নৌকার বহরে এর নৌকা জড়ো হয়েছিল যে গায়ে গায়ে লেগে থাকার কারণে নৌকা বাওয়ারই কোনো সুযোগ ছিলনা। তাঁদের চলতে হচ্ছিল স্রোতের টানে। এর অতি কাছেই তিন চার কিলোমিটারের মধ্যে সীমান্ত অবস্থিত। এ বর্ডারের নাম কৈখালি বর্ডার। ওপারে সমশেরনগর। মাঝখানে কালিন্দী নদী।
হঠাত সেখান যমদূতের মতো দুটো গানবোট পৌছে যায়। এঁদের একটা নদীর মাঝখানে অবস্থান নেয় এবং অন্যটা নদীর তীরে ভিড়ে হানাদারদের নামিয়ে দেয়। তারা নেমে নৌকা থামিয়ে শরনার্থীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করতে থাকে। বাগেরহাটের বেশ কিছু শরনার্থী এ দলের মধ্যে পড়ে মারা যায়। এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বুড়ি গোয়ালিনী ফরেস্ট অফিসের পাশে। এখানে প্রায় কয়েকশত লোককে হত্যা করা হয় যার মধ্যে অনেকেই ছিলেন বটিয়াঘাটা দাকোপ মোরেলগঞ্জ ও রামপাল থানার মানুষ। গানবোট চলার সময় ঢেউয়ের ধাক্কায়ও বেশকিছু নৌকা ডুবে যায়। নারী-শিশু বৃদ্ধসহ তাঁর যাত্রীরা কোনক্রমে সাঁতরে কূলে ওঠে। অন্য শরনার্থীরা তাঁদের উঠতে সাহায্য করে। অনেকে সাঁতরে সুন্দরবনের পাড়ে গিয়ে ওঠে। এ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়ে অনেকে পথ হারিয়ে ফেলে। ভারতে পৌছানোর পূর্বে তারা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মূল পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। এখানে লুটতরাজও চলে। হানাদার বাহিনীর সাথে সাতেহ তাঁদের স্থানীয় দোসরেরাও এই লুটপাটে অংশ নেয়। অনেক নৌকার সোনাদানা টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়া হয়। শরনার্থীদের সঙ্গের মেয়েদেরও অসম্মান করা হয়। এখানে তখন গানবোট থেকে মাইকে ঘোষণা করা হয় – সামনে অনতিদূরে ‘আনোয়ারা’ নামক গানবোট পথ আগলে অপেক্ষা করছে। তাঁদের কাছে প্রত্যেক নৌকার স্বর্নালংকার টাকা-পয়সা সব দিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় সব নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হবে। ঠিক ঐ সময়েই সীমান্তের কালিন্দী নদীর মধ্যে নোঙ্গর করা ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ থেকে মাইকে ঘোষণা করা হতে থাকে যে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ আসছে, শরনার্থীরা যেন তাঁদের নৌকার বহর নিয়ে তারাতাড়ি ভারতীয় সীমান্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। শরনার্থীদের নৌকার বহর একটু গিয়ে আনোয়ারা নামক গানবোটের কাছে এলেই তাঁদের আটকে টাকা-পয়সা স্বর্ণালংকার সব নিয়ে নেয়া হতে থাকে। হানাদারেরা গানবোট থেকে দড়ি বেঁধে বস্তা নামিয়ে দেয়। সে বস্তার মধ্যে শরনার্থীদের সব কিছু তুলে নেয়া সম্ভব না হলেও অধিকাংশ নৌকা থেকেই হানাদারেরা মূল্যবান যা আছে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। এ জন্য যাত্রীদের সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকতে হয়। তবে সোউভাগ্যের বিষয় সে গানবোট থেকে নৌবহরের ওপর কোনো গুলিবর্ষণ করা হলে এখানে হাজার হাজার মানুষের সলিল সমাধি ঘটত। একবারই নয় শোনা যায় এখানে পর পর কয়েকবার এভাবে শরনার্থীদের অনেককেই ভারতে পৌছাতে হয় একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায়, এক বস্ত্রে, শুধু জীবনটুকু হাতে নিয়ে।
[১১২] শেখ গাউস মিয়া
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত