কচুয়ারপাড় গ্রাম গণহত্যা, সিলেট
কচুয়ারপাড় সিলেট থেকে ১০ মাইলের বেশি দূরত্ব হবে না। সালুটিকর বিমানবন্দর থেকে সোজাসুজি বড় জোর দেড় মাইল দূরত্ব। চেঙ্গের খালের উত্তর তীর বরাবর গ্রামটির অবস্থান। বর্ষায় থৈ-থৈ করে ভাসান পানি। নৌকা ছাড়া তখন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াত করাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। গ্রামটির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সালুটিকর বিমানবন্দরে তখন পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর বিরাট বহর। সমগ্র রানওয়েই বধ্যভূমি। পার্শ্ববর্তী বনজঙ্গলও কঙ্কালে কঙ্কালে পরিপূর্ণ। অদূরে ক্যাডেট কলেজ (তখন ছিল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল) এখানেও তাঁদের ঘাঁটি। এই ঘাটিকে বন্দিশিবির বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পও বলা যেতে পারে। কচুয়ারপাড় গ্রামের মাইলখানেক পশ্চিমে সালুটিকর ঘাট। পাকিস্তানি সৈন্যরা এর নতুন নামকরণ করেছিল ‘করাচি বন্দর’। এখানে এনে তারা শত শত লোককে হত্যা করেছে। আবার নদীর দক্ষিণ তীরের মহালদিক গ্রাম সম্পুর্ন ভষ্মীভূত করার পর এখানেও একটি ক্যাম্প স্থাপন করে তারা। গ্রামজুড়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায় সেই সাথে নারী নির্যাতনও চলেছে সমভাবে।
মহালদিক, উদ্দারপাড়া, ধোপাগুল, মোড়ারগাও, টিলাপাড়া, লীলাপাড়া প্রভৃতি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে পাকবাহিনী গণহত্যা ও নারী নির্যাতন শুরু করার পর এখানকার বহু লোক নদী অতিক্রম করে কচুয়ার পাড়, দাড়িকান্দি প্রভৃতি গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। হাজী আমজাদ আলীর ছেলের বউদেরসহ উদ্দারপাড়া ওহাব উল্লার দুই স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো মহিলা কয়েক গ্রামের কোথাও অবস্থান করার সাহস করেনি। আব্দুল বারির যুবতী মেয়েকেও তুলে নেয় পাকবাহিনী।
ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা লড়াইয়ে লড়াইয়ে পর্যদুস্ত করে তুলেছে পাকবাহিনীকে। আর সেটাই হলো কচুয়ারপাড়বাসীর জন্যে কাল। যুদ্ধ শেষে রাতের বেলা পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে। প্রথমেই তারা আসে দাড়িকান্দিতে। তিন দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে গ্রামটি। তারপর আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামের বাড়িঘরে কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই। একটি নয়, দুটি নয় বলতে গেলে প্রতিটা বাড়িতে মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেলে দাড়িকান্দির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তকে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই গরিব ও বিত্তবান গ্রামবাসীর বাড়িঘর পুড়ে ছাইভষ্মে পরিণত হলো। সেই সাথে তাঁদের সারা জীবনের স্নচিত সহায়-সম্পদও। কিন্তু সেদিকে আপাতত গ্রামবাসীর ভ্রূক্ষেপ মাত্র নাই। প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে তারা কচুয়ার হাওড়ের দিকে। নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই প্রানরক্ষার জন্য ছুটে চলেছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসী। পেছনে পুড়ছে তাঁদের বাস্তুভিটা আর ঘরবাড়ি। গ্রামে আশ্রয় গ্রহনকারী ভিন এলাকার লোকজনও একই সাথে ছুতে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। এই অবস্থায় কেউ কেউ ঝাপ দেন চেঙ্গেরখালের জলে। কেউ বা আত্মগোপন করে বনে বাদাড়ে ঝোপজঙ্গলে। তবুও অনেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। এরই মধ্যে পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে যায় দাড়িকান্দি ও কচুয়ারপাড় গ্রাম। পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি গ্রামের একই অবস্থা তখন।
দাড়িপাড়ের কান্দা নমঃশূদ্র তখনো ঘুমে অচেতন। আচমকা জেগে ওঠেন তিনি মানুষের কোলাহলে। আগুনের লেলিহান শিখা তাকে গ্রাস করতে উদ্যত। ঢুলুঢুলু চোখে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি নরপশুদের নজরে পড়ে যান তিনি। ফলে তাঁর বুক বিদ্ধ হয় তাঁদের ছুঁড়ে দেওয়া বুলেটে। তাঁর নিঃসাড় দেহ পড়ে থাকল রাস্তার ওপর।
দাড়িকান্দির নূর মিয়ার স্ত্রীও অন্যান্যদের মতো অন্ধকারে গাঁ ঢাকা দিয়ে পলায়নপর। তাকে ধরার জন্য পেছনে পেছনে ধাবমান পাকিস্তানি হায়েনারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তাকে ধরতে অক্ষম হওয়ায় পেছন থেকে গুলি ছোড়ে তাকে লক্ষ্য করে। মুহূর্তে সেই গুলি বিদ্ধ হয় মহিলার পায়ের। গুরুত্বর আহত হয়ে পড়ে যান তিনি। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরাও তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে চলে যায়।
হাজির আলীর হাতেও গুলি লাগে। ডান হাত তাঁর বিচ্ছিন্নপ্রায়। কিন্তু চিকিৎসা সাহায্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আহত অনেকেই এই সময় কবিরাজি চিকিৎসার শরণাপন্ন হন।
কচুয়ারপাড় গ্রামের এক কৃষক মো. ইছুব আলী। তাঁর বয়স ৫০ বছর। গ্রামের একজন মাতব্বর আচার-বিচারে। পালাতে পারেননি তিনি। পাকবাহিনী তাকে নিজের বাড়িতেই হাতের নাগালে পেয়ে হত্যা করে। একই গ্রামের আকবর আলী ছিলেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ। তাঁর লোলচর্মসার দেহও ভেদ করে হায়েনাদের বুলেট। ঢলে পড়লেন মাটিতে।
ময়মনা বিবি কচুয়ারপাড়কে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে এসেছিলেন এখানে মহালদিক থেকে; কিন্তু শেষরক্ষা হলো না তাঁর। ময়মনা বিবিও হয়ে গেলেন বাংলার স্বাধীনতার একজন শহীদ। একইভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন অন্য গ্রামের পেট্রোল মিয়ার স্ত্রী।
নাকচাপড়া গ্রামের নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। হায়েনাদের ভয়ে নদী অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছেন ইছুব আলীর বাড়িতে। কিন্তু তাঁর ওপর পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের লোলুপ দৃষ্টি, লুটে নিতে চায় ইজ্জত ও সম্ভব। বাধা দিতে এগিয়ে আসেন ইছুব আলীর ছেলে আব্দুল লতিফ (চান্দু মিয়া)। মহিলার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বোঝাবার চেষ্টা করেন তাঁদের। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। কোনো যুক্তিবুদ্ধি মানতে নারাজ তারা। কিন্তু চান্দু মিয়ারও একই কথা। তাঁর গৃহে আশ্রিত মহিলার মান্সম্ভ্রমের ওপর আক্রম কোনোমতেই মেনে নেবেন না। তাই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন চান্দু মিয়া। পাক দস্যুরা তাকে পাকড়াও করে দুগালে কষে মারে চড়। তারপর বুকে বসিয়ে দেয় পচন্ড লাথি। তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যান চান্দু। সেই অবস্থায় বুটের আঘাত চলল তাঁর ওপর উপর্যুপরি। রাইফেলের বাটের প্রহারও চলে সমানে। তাকে এভাবে মুমূর্ষু করে ফেলা হয়।
ইছুব আলীর অপর পুত্র আব্দুল জলিল। একদিন মুক্তিযোদ্ধা বলে অভিহিত করে নিয়ে যায় তারা সালুটিকর ঘাটে। সেখানে নিয়ে চালানো হয় অমানুষিক অত্যাচার। আনাই মিয়াকেও একইভাবে অত্যাচার করে। লীলাপাড়ার কনু মিয়ার চোখের সামনেই তাঁর স্ত্রীর ইজ্জত লুটে নিতে উদ্যত হয় পাকবাহিনী। কনু মিয়া তখন দিগ্বিদিকশূন্য। তাঁর হাতের কাছে ছিল একটা বোতল। তা দিয়েই তিনি আঘাত করেন হানাদার সৈন্যকে লক্ষ্য করে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সৈন্যটি। আর এই সুযোগে স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান কনু মিয়া।
চোইলতাবাড়ির মালু মিয়ার ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে রেকি করতে গেলে তিনি ধরা পড়েন এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। পুয়াইন কাটায় হত্যা করা হয় ওহাব উল্লার দুই স্ত্রীকে। তাঁর ছেলে আব্দুল কাদিরও গুলিবিদ্ধ হন। ধাপনাটিলার দরিদ্র কুটি মিয়া। তাকেও ঘাটে এনে হত্যা করে তারা। কচুয়ারপাড় এলাকার সমস্ত গরু-ছাগল ইত্যাদি নিয়ে যায় দালাল টুনু মিয়া।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত