You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.21 | ইশান গোপালপুর গণহত্যা ও গণকবর | ফরিদপুর - সংগ্রামের নোটবুক

ইশান গোপালপুর গণহত্যা ও গণকবর, ফরিদপুর

ফরিদপুর শহরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। এর কিছুদিন পর ভাষানচর এলাকার রাজাকার জব্বার, দরা, সোনামুদ্দি, ইছা, সমশের অ মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি দল ঈশান গোপালপুর জমিদার বাড়িসহ আশেপাশের এলাকা লুট করতে আসে। এ সময় এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে লুটকারীদের ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। ১ মে সিআইডি অফিসের ওয়াচার লুতফর রহমান ও আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে ৬-৭ জন গোয়েন্দা ঈশান বাবুর জমিদার বাড়ি পর্যবেক্ষন করে আসে। তারা এবং লুটেরাদের কেউ কেউ পাকসেনাদের জানায়, জমিদার ঈশান বাবুর বাড়িতে আশ্রিত সবাই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাঁদের মদ্যে সুখেন্দু রায় অগাধ সম্পত্তির মালিক। জব্বার ও সোনামুদ্দির নেতৃত্বে ৬০-৭০ জনের পাকিস্তানি সেনাদল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে ঈশান গোপালপুর গ্রামে বিকল্প পথে প্রবেশ করে। এ এলাকাটি হলো ফরিদপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে এসেই প্রথমে গুলি করে এ গ্রামের বাবুল সরকারকে। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি বলেন, আমার বাড়ির পাশেই কেশব সরকারের বাড়িতে আমি তখন শুয়েছিলাম। পাকসেনারা গ্রামে প্রবেশ করেছে শুনে নিজের বাড়িতে এসে তাঁদের হাতে ধরা পড়ি। এ সময় আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হানাদাররা গুলি করলে আমি বাঁশ বাগানের দিকে দৌড়ে দিই। গুলি এসে ডান কাধের ওপর লাগে। এ অবস্থায় আমি দৌড়ে দেড় মাইল দূরে বিষ্ণুপুর মামার বাড়িতে আশ্রয় নিই। পাকবাহিনী এবং তাঁদের এদেশীয় দোসররা ২ মে জমিদার বাড়ি আক্রমণ করার সময় জমিদার ঈশান চন্দ্র সরকারের প্রপৌত্র লক্ষণ চন্দ্র সরকার বাড়িটির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি গ্রামে পাকসেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত পালিয়ে যান। সেনাদলটি বাড়িতে ঢুকেই একে একে ২৯ জনকে জমিদার বাড়ির পশ্চিম দিকে ক্ষিতিশ চন্দ্র ভবনের বড় একটি কক্ষে আটক করে। এরই মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। জমিদারবাড়ির প্রতিবেশী কৃষক ইউনুস মোল্লাকে (৬৯) পাকসেনারা ধরে এনে প্রচণ্ড মারধর করে পুকুর পাড়ে ফেলে রাখে। মুসলমান হওয়ার বেঁচে যান ইউনুস মোল্লা। তিনি জানান, ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে পাকসেনারা আট থেকে দশজন সেনা বাড়ির চারদিক ঘিরে রাখে এবং তখন বাড়ির মধ্যে বিভিন্ন কক্ষ থেকে মহিলাদের আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। এ সময় জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ৮-১০ জন মহিলাকে পাকসেনারা ধর্ষণ করে। বৃষ্টি কমে এলে হানাদাররা কক্ষে আটকে রাখা ব্যক্তিদের থেকে দুজন দুজন করে পুকুর পাড়ে এনে খেজুর গাছতলায় গুলি করে হত্যা করে। ইউনুস বলেন, বৃষ্টি না হলে পাকসেনারা গ্রামের আরও অনেক মা-বোনকে ধর্ষণ করত। তিনি আরও জানান, বৃষ্টি হওয়ার কারণে আমার চোখে-মুখে পানি লাগায় আমি কিছুটা জ্ঞান ফিরে পাই এবং তখন মাটিতে মৃতের মতো পড়ে থেকে এ বিষয়গুলো দেখছিলাম। হত্যাযজ্ঞের পরে পাকসেনারা ইউনুস মোল্লাকে টেনে হিঁচড়ে উঠিয়ে অস্ত্রের মুখে এক এক করে ২৮টি মৃতদেহ জমিদার বাড়ির দক্ষিন-পশ্চিমের একটি গর্তের মধ্যে ফেলতে বলে। পাকসেনারা চলে যাবার পর তিনি ঐ মৃতদেহগুলো শেয়াল কুকুরের হাত থেকে রক্ষার জন্য সারারাত পাহারা দেন। পরদিন এলাকাবাসী রুস্তম শেখ, মমি মৃধা, নালু মৃধা, জসীম মোল্লা, মদি মোল্লা ও মাসিম মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে পার্শ্ববর্তী খাদ থেকে মাটি এনে মৃতিদেহগুলো ঢেকে দেন। ঐদিন সকালেই ভাষানচর এলাকার শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্য ও বিহারীরা এসে জমিদারসহ আশেপাশের বাড়িঘরের সমস্ত মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ গনহত্যায় যারা শহীদ হন আশুতোষ সরকার ফটিক, বাদল সরকার, বাদল গোস্বামী, যাদব চন্দ্র বিশ্বাস, দয়াল চন্দ্র দাস, মন্টু চন্দ্র দাস, দুখীরাম দাস, মনীদ্র নাথ সিকদার, সহদেব সাহাব, হরিদাস দাস, সন্তোষ চন্দ্র দাস, বিমল চন্দ্র সাহা, শুমেষ চন্দ্র সরকার, বিষ্ণু ঠাকুর, তারাপদ গাঙ্গুলী, অশ্রু গাঙ্গুলী, গণেশ চন্দ্র সাহা, মুকুন্দ বিশ্বাস, বটা চন্দ্র সাহা, কালাচাঁদ বৈরাগীসহ অজ্ঞাত আরো পাঁচ ব্যক্তি। ঐ সময় কক্ষে আটককৃত ফরিদপুরের চক্ষু ডাক্তার ননীগোপাল সাহার কম্পাউন্ডার ক্ষিতিশ চন্দ্র ঘোষ নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেয়ার এবং সুন্নতে খৎনা থাকায় তাকে ছেড়ে দেয় পাকসেনারা। ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য তাঁর স্ত্রী অঞ্জলী ঘোষ দোতলা থেকে লাফ দিয়ে ইজ্জত রক্ষা করেন।
আরো যারা এ গনহত্যায় স্বজনদের হারিয়েছেন তাঁদের একজন তৎকালীন ন্যাপ নেতা চিত্তরঞ্জন ঘোষ। পাক বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাঁর পরিবারের লোকজন শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন জমিদার বাড়িতে। জমিদার লক্ষন চন্দ্র সরকার ছিলেন চিত্তরঞ্জন ঘোষের বন্ধু। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। চিত্ত ঘোষের বাবা যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, তাঁর ভাই গৌর গোপাল ঘোষ, কাকাতো ভাই বাবুল ঘোষ ঐদিন শহীদ হন।
[৩৪] দিলরুবা বেগম

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত