আলোকদি বধ্যভূমি, ঢাকা
আলোকদি রাজধানী ঢাকার মিরপুরের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি গ্রাম (প্রকৃতপক্ষে গ্রামের নাম আলুব্দী)। শহুরে আগ্রাসনের চিহ্ন সব জায়গায়। তবুও স্থানীয় মানুষ এলাকাটিকে গ্রাম বলতেই ভালোবাসে। জিরো পয়েন্ট থেকে আলোকদি গ্রামটির দূরত্ব ১৩ কি.মি.। যেতে হয় সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে।
’৭১-এ আলোকদি গ্রামে যে পরিমাণ মানুষ এক রাতে হত্যা করা হয়, সারা বাংলাদেশে যদি এভাবে মানুষ হত্যা করা হতো তাহলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ বেঁচে থাকতো না। শুধু হত্যাই নয়, চলেছে সম্পদ লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ ও গৃহে অগ্নিসংযোগ সহ বর্বর হত্যাকাণ্ড।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের ২৪ তারিখ মাঝরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, এদেশীয় দালাল ও বিহারিরা পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এই গ্রামটিকে ধ্বংস করতে কামানের গোলা পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। গুলিবর্ষণ ও হত্যা চলে পরের দিন দুপুর ১টা পর্যন্ত। আলোকদি ঢুকতেই জলাশয়ের উত্তরে যে খালি জায়গাটি রয়েছে ওখানেই লাইন ধরে দাড় করিয়ে হত্যা করা হয় নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙালিদের। এমন কোনো কুয়া নেই যেটি শহীদদের লাশে পরিপূর্ণ ছিল না। কিতাব আলীর বাড়ির কুয়া, উত্তরপাড়া দলিল উদ্দিনের বাড়ির দুটি কুয়া, মধ্যপাড়া কালি মিয়ার বাড়ির কুয়া ও দক্ষিণ পাড়া চুনু ব্যাপারীর বাড়ির কুয়াগুলো ভর্তি ছিল শহীদদের লাশে।
স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন ওরফে কালাচানকে (৫০) আলোকদি বধ্যভূমি সম্পর্কে জানান, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ২৪ তারিখের ঘটনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাঁর এদেশীয় দালালরা মাঝরাতে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে। ভোর রাতে ভারি অস্ত্রের গুলিবর্ষণ শুরু হলে মুহুর্তেই আর্তচিতকারে ভারী হয়ে ওঠে আলোকদির বাতাস। এ হত্যাযজ্ঞে চলে টানা দুপুর ১টা পর্যন্ত। তখন সব শেষ। এই গ্রামে শহীদদের সংখ্যা আনুমানিক ২-৩ হাজার।
গ্রামে ঢুকতেই বাজারের পূর্ব পার্শ্বের জলাশয়ের পাশে মানুষ দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া এমন কোনো কুয়া ছিল না সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি। কুয়াগুলো ছিল-
দলিল উদ্দিনের বাড়ির দুটি কুয়া, মধ্যপাড়ার কালু মিঞার বাড়ির কুয়া, দক্ষিণপাড়া চুনু বাশরীর বাড়ির কুয়া ও কিতাব আলীর বাড়ির কুয়া।
স্থানীয় বাসিন্দা আলী আজগর (৫০) জানান, ’৭১-এ আমরা সপরিবারে পালিয়ে যাই। আমার বাবা অসুস্থ থাকায় তিনি গ্রামেই থেকে যান। জুন-জুলাই মাসের ঘটনা, বিহারিরা আমাদের বাড়ি লুট করতে এলে বাবা তাঁদের হাতে ধরা পড়েন। বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে দেখে আমার চাচাত ভাই আব্দুল মজিদ। পরে তাঁর লাশ দক্ষিণ পাড়া চুনু ব্যাপারীর কুয়ার ফেলে দেয়া হয়। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী হাজী আব্দুল করিম (৫২) জানান, ’৭১-এ আলোকদি গ্রামের পশ্চিম পাশে ঝোপের পাড়ে লুকিয়ে থাকতাম। বিহারিরা এলেই নদীর ঐ পারে চলে যেতাম। আলোকদি জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে বীভৎসভাবে হত্যা করা হয়। তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করলে তিনি মসজিদের মেঝেতে পড়ে যায়। পরে তাকে লাথি মারতে মারতে মসজিদ থেকে বের করে দাঁড়ি কেটে গুলি করে হত্যা করা হয়। এবং তাঁর লাশ আমাদের বাড়ির কুয়ার (কালু মিঞার বাড়ির কুয়ায়) ফেলা হয়।
একজন ইমামকে এভাবে মারার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি জানান, তখন বেশির ভাগ ইমাম পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে ছিল, সহযোগিতা করত কিন্তু আমাদের ইমাম সাহেব ছিলেন বাঙালিদের পক্ষে।
আমার বড় ভাই আব্দুর রহমানকে গ্রামের উত্তর পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। লাশ খুজে পাওয়া যায়নি। পরে শুনেছিলাম কিতাব আলীর বাড়ির কুয়ায় ফেলা হয়। হত্যার পর বাঙালিদের দিয়েই অস্ত্রের মুখে লাশ বহন করানো হতো এবং বিভিন্ন কুয়ায় ফেলা হতো। স্থানীয় গদু ব্যাপারী, বারেক মাতব্বর ও রহমান সহ অনেককেই জোর করে লাশ বহন ও বিভিন্ন ফেলতে বাধ্য করত। প্রতিটা বাড়ির দামি জিনিসপত্রই লুট হয় এবং গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা কিতাব আলী (৬৫) ‘আলোকদি বধ্যভূমি’ সম্পর্কে জানান, ’৭১ সালের মার্চের শেষের দিকে গ্রাম ছেড়ে পালাই, নদীর ঐপারে সাভারে। পুরা একাত্তরের সময় লুকিয়ে ছিলাম সাভারেই। ফিরে আসি ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে। সব বাড়িতেই কেউ না কেউ শহীদ হয়েছেন। এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়ি লুট হয়নি, আগুনে পুড়েনি। আমাদের বাড়িতে ১১টি গরুর একটিও ফিরে এসে পাইনি। বাড়ির কুয়াটি ভর্তি ছিল মুক্তিকামী বাঙালিদের লাশে। মানুষের শরীর-পচা দুর্গন্ধে বাড়িতে ঢোকা যেত না। বাড়ির কুয়ার মুখটি মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। আজও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে কিতাব আলীর বাড়ির কুয়াটি, যার ভেতরে রয়েছে অসংখ্য মানুষের দেহাবশেষ। কুয়ার ওপরেই তৈরি হয়েছে বসবাসের বাড়ি।
‘আলোকদি বধ্যভূমি’ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল বারেক (৭৮) জানান, (পিতা মৃত জনাব আলী) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও বিহারিদের বর্বর হত্যাযজ্ঞ সামনে থেকে দেখেছি। যেদিন আক্রমণ হয় এই গ্রামে (২৪ এপ্রিল, ১৯৭১) সেদিন হঠাত গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। মানুষের আর্তচিৎকার ও গুলির শব্দে দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরে একটা ঝোপসমেত গর্ত থেকে টেনে বের করে। পরে সব মানুষকে একত্রিত করে ৩০-৪০ জনের একটি করে দলে বিভক্ত করে দাঁড় করায়। আমার স্বাস্থ্য ভালো থাকায় আমাকে হত্যা না করে আলাদা দাঁড় করায়। আমার চোখের সামনেই শয়ে শয়ে মানুষকে হত্যা হতে দেখি। আমি সহ কালু মোল্লা (মৃত), মনসুর আলী দেওয়ান (মৃত), ওয়ার আলী দেওয়ান, গদু ব্যাপারী, বারেক মাতব্বর, রহমান ব্যাপারীসহ ১৫-২০ জনের একটি দলকে কাজে লাগানো হয় লাশ ফেলার কাজে। প্রথমে আমরা কালু মিঞার বাড়ির কুয়ার লাশ ফেলি। সেটি ভর্তি হয়ে গেলে একে একে দলিল উদ্দিনের বাড়ির দুটি কুয়া, উত্তরপাড়া কিতাব আলীর বাড়ির কুয়া ও চুনু ব্যাপারীর বাড়ির কুয়ার লাশ ফেলি। প্রিয় বন্ধু-স্বজনদের নিজ হাতে কুয়ায় ফেলি ও চোখ মুছি। আমাদের দিয়ে জোর করে মুরগী ও গরু ধরায়। ওগুলো ধরে এনে গাড়িতে ওঠায়। তাঁর মধ্যে লায়লার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
আলোকদি হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী মোহাম্মদ জইনউদ্দিন মিয়া, পিতা মৃত নূর মোহাম্মদ বলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ২৪ তারিখ সকাল ৮টার আলোকদি জামে মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং গুলিবিদ্ধ হন। একটি গুলি তাঁর বাঁ কাঁধে বিদ্ধ হয় এবং দ্বিতীয় গুলিটি তাঁর নিতম্বে ঢুকে উরু দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনার বর্ণনা জইনউদ্দিন বলেন, ’৭১-এ আমার বয়স ছিল আনুমানিক ৪০ বছর। তখন আমি গৃহস্থালি ও কৃষিকাজ করতাম। ১৯৭১-এর ২৪ এপ্রিল শনিবার ভোর রাত থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়। ঐ দিনই সকাল ৮টার দিকে গোলাগুলি একটু থামলে আলোকদি মসজিদের পশ্চিম পাশ দিয়ে সাভার যাওয়ার পথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আমি ও যবেদ আলীসহ মোট ৩ জন গ্রেফতার হই। পাকিস্তানি বাহিনী যে চতুর্দিক থেকে গ্রামটি ঘিরে রেখেছিল তা বুঝতে পারিনি। আমাদের ধরে ওখানে লাইন দিয়ে দাঁড় করায় এবং গুলি চালায়। আমার শরীরে মোট ২টি গুলি বিদ্ধ হয়। একটি গুলি বিদ্ধ হয় আমার বা কাঁধে এবং অপর গুলিটি আমার নিতম্বে ঢুকে উরু দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আমাকে মৃত ভেবে হানাদার বাহিনী চলে গেলে কোনো রকমে ওঠার চেষ্টা করি কিন্তু ব্যর্থ হই। আমার সাথের ২ জন ওখানেই মৃত্যুবরণ করেন। ঐ অবস্থায় আমি সারা দিন সারা রাত ওখানেই পরে ছিলাম। পরদিন ২৫ তারিখ সকাল ৮টার দিকে আমার ভাই আজিজ উদ্দিন ও মাতা কমলা খাতুন আমাকে উদ্ধার করে সাদুল্লাপুর নিয়ে যায়। সাদুল্লাপুর স্থানীয় চিকিৎসকের চিকিৎসায় দীর্ঘ দেড় বছর অসুস্থ থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। এখনো আমি হাঁটতে পারি না। ’৭১-এর পর আর আমি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারিনি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতৃক যে বর্বরোচিত গণহত্যা হয়েছে আর এক প্রত্যক্ষদর্শী ভুক্তভোগী মো. আইয়ুব নবীর বর্ননায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। ঘটনার বর্নণা দিতে গিয়ে আইয়ুব নবী বলেন, ১৯৭১-এ আমার বয়স ছিল আনুমানিক ৩৫ বছর, গৃহস্থালি ও কৃষিকাজ করতাম। আমাদের পাড়াটি ছিল মূলত বাঙালি অধ্যুষিত পাড়া। ক্যান্টনমেন্টের অপরদিকে ছিল বিহারিদের পাড়া অর্থাৎ ১২ নম্বর সেকশন। বিহারিরা আমাদের গ্রাম লুট করার অএক চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। অবশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ ভোর রাতে আমাদের পুরো গ্রামটি চতুর্দিক থেকে ঘিরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। গ্রামে এমন কোনো কূপ (ইন্দিরা, বড় মাপের কুয়া) পাওয়া যাবেনা যেটি শহীদদের লাশে ভর্তি ছিল না। গ্রামের অনেককেই হত্যার পর বেঁচে যাওয়া অন্য গ্রামবাসীদের দিয়ে সেই লাশ কুয়াতে ফেলা হয়। পরে তাদেরও হত্যা করা হয়। সেদিন সকাল ৬টায় আলোকদি মসজিদের উত্তরে তফিলউদ্দিন মোল্লার জমির ওপর দিয়ে প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলাম সাভার বিরুলিয়া গ্রামের দিকে। আমি পশ্চিম দিকে যাচ্ছিলাম। গুলি আসে দক্ষিণ দিক থেকে। গুলি আমার পেটের বা অংশে বিদ্ধ হয়ে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন আমি পাশে ডোবায় পড়ে যাই। গলায় জড়ানো গামছা দিয়ে পেটে শক্ত করে বাঁধ দেই। ওই অবস্থায় প্রায় ৯ ঘন্টা পানির মধ্যে পড়ে থাকি। পরে বেলা দুইটার দিকে আমার বড় ভাই সাইজুদ্দিন মাতব্বর আমাকে উদ্ধার করে বিরুলিয়া গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় উপরের অংশ শুকিয়ে গেলেও ভেতরে এখনো ক্ষত রয়ে গেছে। এখনো মাঝেমধ্যে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করি। মাঝেমধ্যে ব্যাথার তীব্রতায় পেটে বালিশ চেপে শুয়ে থাকি।
আর এক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আব্দুল হাই পিতা হাজী মোহাম্মদ নইমুদ্দিন। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১-এ আমার বয়স ছিল আনুমানিক ২৫ বছর। তখন আমি ঢাকা কলেজ বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। মূলত আমাদের গ্রামটি বাঙালি অধ্যুষিত হওয়ায় আমাদের গ্রামে হামলা হওয়ার আশঙ্কা আমরা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই টের পেয়েছিলাম। ফলে যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের গ্রামকে রক্ষা করার জন্য গ্রামে ঢোকার মুখেই একটি ফলস বাংকার তৈরি করেছিলাম। প্রয়াত হারুন মোল্লার দুটি দোনালা বন্দুক ছিল আমাদের সম্বল। স্থানীয় রাজাকার ও বিহারিরা মাঝেমধ্যেই গ্রামের মুখে এসে গুলি করে পরীক্ষা করত যে আমাদের কাছে অস্ত্র আছে কিনা? তখন আমরা পালটা গুলি করলে তারা ফিরে যেত। গ্রামে ঢোকার পথে অনেক বাঙালিকেই তারা রাস্তায় ধরে কালাপানিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত। ফলে আমাদের যাতায়াত করতে হতো সাভার দিয়ে। ’৭১-এ এপ্রিলের ২৪ তারিখ ভোর ৫টার ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হলে আলোকদি গ্রামের পূর্ব পাশে ওয়াজউদ্দিন মাতব্বরের বাড়ির পূর্ব পাশের দেয়াল ঘেঁষে আমরা পজিশন নিই। প্রথম একটি সেল নিক্ষেপ করলে দেয়ালটি পড়ে যায়। দ্বিতীয়টি নিক্ষেপ করলে সেলের স্পিন্টার আমার কপালে লেগে পিছলে যায়। কিছু স্পিন্টার ডান হাতের কবজি একটু উপরে এবং বা পায়ের হাঁটুতে লাগে। ঐ অবস্থায় আমরা পেছনের দিকে যেতে থাকি এবং সময় নিতে থাকি যেন গ্রামবাসী এই সুযোগে সাভারের দিকে পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু গ্রামের সম্মুখ ভাগ নয়, ঘিরে ফেলেছিল পুরো গ্রামকে। ফলে পালাতে গিয়ে অনেক গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হন এবং মারা যান। চতুর্দিক থেকে গ্রামটিকে ঘিরে হত্যা করতে করতে গ্রামের কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমি ক্রলিং করতে করতে গ্রামের শেষ প্রান্তে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হই এবং নদীতে ঝাপ দিই। আমার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ফলে অল্প কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পরেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কোনোভাবে নাক ভাসিয়ে নদীতে ভেসে থাকি এবং সাতারে উঠি। পাড়ে উঠেই আমি জ্ঞান হারাই। পরে স্থানীয় লোকজন আমাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করায়। আমার ডান হাতের স্পিন্টারটি ছিল বড়শির মতো বাঁকা। ফলে হাতের একটি বড় অংশ কেটে ওটা বের করতে হয়েছে। অবশ করার কোনো সুযোগ না থাকায় সজ্ঞানেই আমার হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়। হাটুর স্পিন্টারটি এখনো রয়ে গেছে।
আলোকদি হত্যাকাণ্ডের বেঁচে যাওয়া অপর ভুক্তভোগী কোহিনূর বেগম। তিনি এপ্রিলের ২৪ তারিখ যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। কোহিনূর বেগমের পিতা সাইজুদ্দিন জানান, ’৭১-এ ২৪ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে আমার পরিবার নিয়ে আলোকদির উত্তরে (বর্তমান ১৯৮ হোল্ডিং) আমার নিজ বাসভবন ত্যাগ করার সময় হঠাত করে গোলাগুলি শুরু হলে পালাতে শুরু করি। এক হাত ধরা ছিল আমার স্ত্রীর, অপর হাত ধরা ছিল কনিষ্ঠ কন্যা কহিনূর বেগম। হঠাত পরপর ৩টি গুলি আমার মেয়ের শরীরে বিদ্ধ হয়। ২টি গুলি বা হাতের কনুইয়ের নিচে ভেতরের অংশে লেগে পিছলে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে সাভার পালিয়ে যাই। স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় আমার মেয়ে সেরে উঠল ছয় মাস পর। কিন্তু এখনো সে ক্ষত আমার মেয়ে বহন করে বেড়াচ্ছে।
আলোকদি বর্বরতার কথা আরো জানা যায় বীরাঙ্গনা মোসাম্মাৎ লায়লীর কাছ থেকেও। সেদিন এ বাড়ির সবাই পালাতে পারলেও সে পালাতে পারেনি। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। তিনি জানান, ‘আমাকে তুলে নিয়ে প্রথমে যায় কালসী, সেখান থেকে বর্তমান সেকশন-৬ নম্বরের একটি বাড়িতে দীর্ঘ ৩ মাস আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। আমার চোখের সামনেই হত্যা হতে দেখি চাচা হাবিব মিঞাকে। তখন বাবা কাশেম আলী দৌড়ে পালায়। আমি আর এক খালা পালাতে পারিনি। পালাতে না পেরে ঘরের ভেতর চৌকির নিচে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু বিহারিরা আমাকে ওখান থেকে টেনে বের করে। আমাদের ঘরেই চলে পালাক্রমে শারীরিক নির্যাতন (ধর্ষণ)। তারপর গাড়িতে তোলা হয়, গাড়িতে আরও ৫-৬ জন মেয়ে ছিল। পরে যে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আমাকে আটকে রেখে প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতন করা হতো সেখানে আমি একাই ছিলাম। প্রথম দিন খানসেনারা নির্যাতন করে। বাকি ৩ মাস নির্যাতিত হই বিহারিদের হাতে। সকালে দুটি রুটি ও তরকারি, দুপুরে উপোস থেকে রাতে আবার রুটি। একদিন ভুলবশত দরজা খোলা রেখেই চলে যায়। আমি সন্ধ্যার দিকে পালিয়ে আমিন বাজার মামার বাড়ি চলে যাই। এলাকায় ফিরি না ভয়ে, তখন এলাকায় কেউ ছিলও না।
[৬৬] মিরাজ মিজু
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত