You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.14 | আদিত্যপুর গণহত্যা | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

আদিত্যপুর গণহত্যা, সিলেট

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার আদিতপুরে ১৪জুন হত্যাকাণ্ড চালায়। এ প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম লিখেছেন-সূর্যোদয়ের তখনও ঘন্টা দুই বাকি। রাতের আধার কাটতে শুরু করেছে সবে। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার আদিত্যপুরের কর্মক্লান্ত মানুষজন গভীর ঘুমে অচেতন। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ। কিন্তু হঠাত রাতের এই শেষ প্রহরের নীরবতা ভেদ করে চারটি সাঁজোয়া গাড়ি বোঝাই পাকসেনা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর কি অবাক ব্যাপার! আধ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই এ দেশীয় দালালদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী সমস্ত গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং ঘোষণা করে যে, শান্তি কমিটি গঠন ও প্রত্যকে গ্রামবাসীকে পরিচয় পত্র দেয়ার উদ্দেশ্যেই তারা আদিত্যপুরে এসেছে। কিন্তু গ্রামবাসীর মন থেকে সন্দেহ দূর হয় না। তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, শান্তি কমিটি গঠন আর পরিচয়পত্র দেয়ার জন্য তাঁদের প্রায় রাতের আঁধারে আসা কেন? অবশেষে সবাইকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জড়ো হতে বলা হয়। অস্ত্রের মুখে তাঁদের পাকসেনারা সেখানে নিয়ে যেতে না যেতেই সবকিছু দিনের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এক সময় ঘটনাস্থলে আগে থেকেই অবস্থানরত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী ছাদের সাথে পাকবাহিনীর আলোচনা হয়। আহাদ চৌধুরী পরামর্শ দিতেই জনৈক ক্যাপ্টেনের নির্দেশে সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে সেনাদের হাতে ধরা রাইফেলগুলো। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ে ৬৩টি তাজা প্রাণ। অবশ্য এঁদের মধ্যে কয়েকজন শেষ পর্যন্ত পালিয়ে অথবা মরার ভান করে পড়ে থেকে নিজেদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। নিরাপদ মনে করে যারা প্রাণভয়ে আগে থেকেই আদিত্যপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই এই হত্যাযজ্ঞে জীবন দিতে হয়।
এদিনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে যারা শহীদ হন তারা হলেন-আদিত্যপুরের রাধিকারঞ্জন সেন (শিক্ষক), শ্রীশ সেন (নায়েব), শৈলেন চন্দ্র দেব, দীনেশ চন্দ্র দেব, ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেব, সুরেশ চন্দ্র দেব, মতিলাল দেব, সুধীর চন্দ্র দাশ, বিপুল চন্দ্র দেব, সুখেন্দ্র সেন (ছাত্র), দক্ষিণা দেব, অতুল আচার্য, নরেশ দাশ, হৃদয় শুক্লবৈদ্য, কৃষ্ণ শীল, দিগেন্দ্র চন্দ্র শীল, যতীন্দ্র দাশ, রাকেশ শব্দকর, সুরেশ শুক্লবৈদ্য, সুধন দাশ, সত্যপুরের ধানাই রাম নমশুদ্র, বিহারী নমঃশূদ্র, বসন্ত নমঃশূদ্র, প্রভাত নমঃশূদ্র, বলাই নমঃশূদ্র, মহেন্দ্র নমঃশূদ্র, ইশান নমঃশূদ্র, বলই নমঃশূদ্র, নারায়ণ নমঃশূদ্র, লক্ষীপুরের সতীশ চন্দ্র দাশ, দাশপাড়ার দীনেশ দেব, ইলাশপুরের নরেশ ধর, দিগেন দেব, মশাখালার দিনেশ ও চান্দপুরের যতীন্দ্র দত্ত পুরকায়স্থ (চরকী বাবু), তাজপুরের খোকন, পশ্চিম সিরাজনগরের অমর দেব, ননী দেব এবং বুরুঙ্গার কলিন শব্দকর ও পরেশ শব্দকর। বাকি নামগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অথচ পাকবাহিনী সদর্পে এ ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেছিল, কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী সেনাবাহিনীর গাড়ি আক্রমণ করলে তাঁদের পালটা আক্রম্নে এঁরা মারা যায়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্ষ্যান্ত হয়নি। পরমুহুর্তেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গ্রামের যুবতীদের ওপর। চালিয়েছিল পাশবিক অত্যাচার। তাঁদের তারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের ক্যাম্পে। একজন যুবতীকে নেয়া হয়েছিল উল্লেখিত নেতার বাড়িতে। কদিন পর সে ফিরে এসেছিল ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে। আদিত্যপুরের ঘটনার শেষ এখানেই নয়, গুলির আঘাতে গুরুত্বরভাবে আহত হওয়ার পরও মৃত্যুকে জয় করে বুদ্ধি করে বেঁচে যান সুশান্ত গুপ্ত পুরকায়স্থ (মিলন) ও বুলু দে।
স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এখানে এসে মাটি খুঁড়ে নিহতদের লাশ উঠিয়ে নিয়ে যান সিলেটে। দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিকের উপস্থিতিতে লাশের সংখ্যা নিরূপণ ও লাশ সনাক্ত করে রেগুলো আবার নিয়ে আসা হয় আদিত্যপুরে। কবর দেয়া হয় পূর্ববর্তী স্থানেই।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত