আতাইকুলা গণকবর, নওগাঁ
পাক হানাদারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ভবেশ্বর পাল সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা বর্নণা করেন। নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে ছোট যমুনা নদীর কিনারা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আতাইকুলা গ্রাম। শহর থেকে দূরে ও নদীর কিনারায় গ্রামটির অবস্থান হওয়ায় গ্রামবাসীর প্রায় সকলেই তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে যায়নি। তবে অনেকে তাঁদের পরিবারের মহিলা সদস্যদের সরিয়ে দিয়েছিল অন্যত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রোববার। আতাইকুলা গ্রামবাসী প্রতিদিনের মতো তাঁদের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করেছিল। সকাল ৮টার দিকে দেখা গেল খেয়াঘাটে ফিরিঙ্গী মাঝির নৌকায় করে একদল পাকহানাদার হঠাত গ্রামে এসে প্রবেশ করল। সঙ্গে বাঙালি দোসর। খেয়াঘাটের ফিরিঙ্গী মাঝির কাছে পাক হানাদাররা জানতে চাইল ভূপেন পাল কোথায়? (ভূপেন পাল সে সময় গ্রামের ধনী ও সর্বজন শ্রদ্ধেও ব্যক্তি ছিলেন)। ফিরিঙ্গী বলেছিলেন, ভূপেন পাল গ্রামে নেই, উনি শহরে থাকেন। এই উত্তরেই ঘটল যত বিপত্তি। তাঁদের ধারণা ভূপেন পাল গ্রামেই আছেন। তারা ফিরিঙ্গী মাঝিকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে ও পরে গুলি করে হত্যা করে। ইতিমধ্যে শতাধিক পাকসেনা গ্রামটি ঘিরে ফেলেছিল। গ্রাম থেকে পুরুষদের এক এক করে ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো যোগেন্দ্র নাথা পালের বাড়ির বিশাল আঙিনায়। এভাবে নিরীহ ৮০ জন গ্রামবাসীকে ধরে আনা হলো।
দুপুরের দিকে পাকসেনারা দু দফায় ৮০ জন ব্যক্তির ওপর ব্রাশফায়ার করে। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়া দেহের রক্তে ভেসে যায় যোগেন্দ্রনাথ পালের বিশাল প্রাঙ্গণ। এত কিছুর পরও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ৮০ জনের মধ্যে ২৮ জন। এঁদের অনেকের শরীরে রয়েছে গুলির আঘাতের চিহ্ন। এ ঘটনায় জীবিতদের মধ্যে খনো যারা গ্রামেই রয়েছেন তারা হলেন নিখিল চন্দ্র পাল, প্রদ্যুত পাল, গীরেন্দ্র নাথ পাল, ভবেশ্বর পাল। ২৫ এপ্রিল পাকসেনা আতাইকুলা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসী বেরিয়ে এসে গুরুত্বর আহতদের চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। অনেককে ভারতেও নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন ২৬ এপ্রিল ভবেশ্বর পালের নেতৃত্বে গোলক প্রামাণিক ও আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় যোগেন্দ্র নাথ পালের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটি গর্ত খুঁড়ে ঐ ৫২ জন শহীদকে গণকবর দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ যে, ৫২ জন শহীদের প্রত্যেকেই একই সম্প্রদায়ের লোক।
[৩৯৩] ফরিদুল আলম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত