You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) - 35-83 - কুসুম - সংগ্রামের নোটবুক

ঘটনা ও ব্যক্তি
সালের ১ মার্চ এক আকস্মিক বেতার ভাষণে ঢাকায় ২৫ থেকে নির্ধারিত পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অীধবেশন স্থগিত করার অর্থ ছিল ১৯৭০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের (১৮ বছর এবং তদূর্ধ্ব) ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অকুণ্ঠ বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে না দেয়া, ছয়দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পথ রুদ্ধ করা। বিশ শতকের প্রথম দুটি অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে আর তৃতীয়টি পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নিগড় থেকে মুক্তির জন্য, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির গণতান্ত্রিক রায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য। পাকিস্তানে বাঙালির অীধকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দমনের জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশে সর্বাত্মক সামরিক অীভযান ও গণহত্যা চালায়। বাঙালি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
[১০২] রফিকুল ইসলাম

অসহযোগ আন্দোলন : ক্রমপঞ্জি
১ মার্চ, ১৯৭১
মূলত ২৮ ফেব্রæয়ারি রাত পর্যন্তও সবাই ধারণা করছিল যে ১ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা পৌঁছাবেন এবং প্রেসিডেন্টের ঢাকা আসার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি সাধারণত নেয়া হয় তাও নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু ১ মার্চ দেখা যায়, যে বিমানে করে ইয়াহিয়ার ঢাকা আসার কথা সে বিমানটি ২ বার উড্ডয়নের বিলম্ব করা সত্তে¡ও শেষ পর্যন্ত করাচি থেকে বিমানটি ঢাকা এসে পৌঁছাল কিন্তু তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এলেন না। ১ মার্চ সকাল থেকেই সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। তখন (ঢাকা) স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এবং কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে ২য় ইনিংসের খেলা চলছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের খসড়া শাসনতন্ত্র বিলের চুড়ান্ত রূপ দিতে দলীয় কার্যালয়ে পূর্ণ বৈঠকে বসেছিল। এই কমিটি তখন পর্যন্ত পয়েলা মার্চকে চুড়ান্ত সময়সীমা ধরে কাজ প্রায় শেস করে এসেছিল। ঠিক এমন সময় খবর আস যে বেলা ১টার দিকে বেতারে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে।
সমস্ত কাজ বন্ধ করে সকলে অপেক্ষা করতে লাগল ঘোষণাটির জন্য। বেলা ১টা ৫ মিনিট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়অর বিবৃতি বলে ঘোষণা করা হলো যে আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণে বলেন যে বিগত কয়েক সপ্তাহ আমার

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে কিন্তু এতে রাজনৈতিক নেতারা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি। তিনি আরো বলেন যে কোনো কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল আগামী ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে রাজি হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যটি ছিল মূলত এ রকম- “পাকিস্তান আজ চরম রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন।” যে সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছার পরিবর্তে আমাদের কোন কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক মোকাবিলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষি।ট করেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ
পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবশেনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সঠিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহŸান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অর্থাৎ তাঁর এই ঘোষণার অর্থ দাঁড়ায় যে জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন এবং এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভেটো ক্ষমতা থাকবে এবং তাদের সাথে আগাম সমঝোতা ছাড়া সংখ্যা গরিষ্ঠরা পরিষদের বৈঠক ডাকতে পারবে না। তার মানে হলো বাঙালিরা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও তাদের অক্ষম করে দেয়া হলো।
একই দিনে আর একটি ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানকে পদচ্যুত করে তার স্থলে “খ” অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদাকে নিয়োগ দেন। আহসানের এই আকস্মিক পদচ্যুতিতে এটা আরো স্পষ্ট হলো যে যেহেতু তিনি বাঙালিদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বেশি ভালো সম্পর্ক ছিল তাই তাকে সরিয়ে দেয়া হলো।
ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সমস্ত পেশার সকল শ্রেণীর মানুষ দলমত ভুলে নেমে আসে রাস্তায়। ঢঅকা স্টেডিয়ামে যে ক্রিকেট খেলা চলছিল সে ম্যাচ ভণ্ডুল হয়ে যায়, সমস্ত দর্শক খেলা দেখা বাদ দিয়ে রাস্তায় এসে মিছিলে যোগ দেয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ সমস্ত

ঘটনা ও ব্যক্তি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ক্লাস বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সমস্ত ঢাকা মুহুর্তের মধ্যে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। এ সকল মিছিল চারদিক থেকে বায়তুল মোকাররম ও জিন্নাহ এভিনিউয়ের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) দিকে আসতে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে নির্দেশ লাভের উদ্দেশে পূর্বাণী হোটেলের দিকে যেতে থাকে। কারণ বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে যায় বেলা ৪টার আগেই। পূর্বাণী এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয় এবং “জয়বাংলা” “বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ ¯^াদীন করো”, এ ধরনের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ সকল ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় মিলিত হয় এবং সেখানে ছাত্রলীগ ডাকসু নেতারা বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অবস্থায় পল্টন ময়দানও আরেক জলসমুদ্রে পরিণত হয়।
হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি সদস্যরা বেলা তিনটার মদ্যেই এসে সমবেত হলেন। শেক মুজিবুর রহমান এলেন ৩.২০ মিনিটে। চরম উত্তেজনাকর একটা পরিস্থিতি, বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দেশী-বিদেশী সাংবাদিক। শেষে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। বিকেল ৪.৩০ মিনিটে শেক মুজিবুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য পরিষদ অীধবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করিতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। তাই বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।’ তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোার্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তিনি আরো বলেন যে ৭ মার্চের জনসভায় তিনি যে ৭ মার্চের জনসভায় তিনি আন্দোলনের পূণর্ৎাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু জনগণকে যে কোনো ত্যাগ ¯^ীকারে প্রস্তুত থাকার আহŸান জানান এবং হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহŸান জানান। তিনি তখনো পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পন্থায় শান্তি পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা চালানোর আশা ব্যক্ত করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের পূর্বে তার সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি- এটা তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে, তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিন্তানের জনগণকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
আহŸান জানাবেন বলেন উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করলেন। তাঁদের মধ্যে জননেতা মওলানা ভাসানী, নূরুল আমীন, আতাউর রহমান, মোজাফ্ফর আহমদ উল্লেখযোগ্য।
তিনি ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে ¯^াদীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে নূরে আলিম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এই চারজন এক গোপন বৈঠক করেন এবং বিকেলে ¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এদিন থেকে শুরু হয় বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়।

২ মার্চ, ১৯৭১
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহŸানে ঢাকায় ¯^তঃস্ফ‚ত হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, কলকারখানা, অীফস-আদালত সব স্তব্ধ হয়ে যায়। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ হরতালে অংশ নিয়ে রাজধানীতৈ অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এদিন ট্রেন ও বিমান চলাচলও বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ লাঠি ও রড হাতে রাজপথে নেমে আসে। এদিন সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় ডাকসু ও ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ছাত্র-জনতার এক বিশাল সমাবেশ। এই সমাবেশে শিল্পী শিবনারায়ণ দাশের পরিকল্পনা ও অঙ্কনে সবুজ পটভ‚ীমকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলার সোনালি মান চিত্র সংবলিত ¯^াদীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উত্তোলন করেন ডাকসুর তৎকালীন সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। স্মরণকালের ইতিহাসে ঐ বৃহত্তম ছাত্র সভাতে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালনি সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও পূর্বতন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ প্রমুখ। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিজ ক্ষমতাবলে প্রদেশগুলোতে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন এবং ১১০ নং সামরিক আইন বিধি জারি করে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। একই সাথে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে., .ে এস জি এম পীরজাদা ইয়াকুব খানকে এদিন গভর্নরের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণের কথা জানান। ঢাকার ফার্মগেটে সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনরত জনতার ওপর সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জে ৯ জনের মতো বাঙালি হতাহত হয়।
ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ও আতাউর রহমানের জাতীয় লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে এদিন বিকেলে অনির্ধারিত জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত

ঘটনা ও ব্যক্তি
হয়। সমাবেশ শেষে যখন সন্ধ্যার দিকে শ্রান্ত-ক্লান্ত অভ‚ক্ত জনতা রাজপথ ছেড়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ঠিক সে সময় আকস্মিকভাবে ভেসে আসে কারফিউ জারির ঘোষণা। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে ৩ মার্চ সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে, যা পরে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুনঃজারি করা হয়। বেতারেরমাধ্যমে কারফিউ জারির এই ঘোষণা শোনার সাথে সাথে সমস্ত এলাকার জনগণ আবার ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। কারফিউ ভঙ্গ করে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে ও মিছিল ¯েøাগানে মুখরিত করে তোলে সমগ্র ঢাকা শহর। শ্লোগানের সাথে ভেসে আসতে থাকে বুলেটের আওয়াজ। সেনাবাহিনী মিছিলকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে, যাতে অসংখ্য বাঙালি হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এবং তিনি সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করে শাসকচক্রের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশে আগুন জ¦ালাবেন না, তাতে আপনারাও রেহাই পাবেন না। তিনি আরো বলেন, লাঠি দিয়ে জনগণকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করবেন না। এদিন সন্দ্যায় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিনি পরবর্তী কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন-
পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। সকল সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পিআইএ, রেলওয়ে এবং অন্যঅন্য যোগাযোগমাধ্যম, পরিবহন, ব্যক্তি মালিকানা ও সরকারি মিল, ফ্যাক্টরি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট প্রভৃতি হরতালের আওতাভ‚ক্ত। আর অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি পরিবহন হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
৩ মার্চ বাঙালিদের জন্য শোকদিবস ঘোষণা করা হয়। (এ দিনেই অীধবেশন বসার কথা ছিল)
রেডিও, টেলিভিশণ এবং সংবাদপত্র যদি বাঙালিদের সংবাদ প্রকাশে ব্যর্থ হয় তা হলে কোনো বাঙালি এগুলোতে সহযোগিতা করবেন না।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের মাদ্যমে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্দেীশত হবে।
অসহযোগ আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ এবং শৃক্সখলার সাথে এগিয়ে নিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে আগত জনতার উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। সেখানে তিনি সকলকে সতর্ক থাকার আহŸান জানান, যাতে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাধে। তিনি আরো বলেন, এখানে বসবাসকারী বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সমান, সবাই আমাদের ভাই। এদিকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। সেখানে তারা শেখ মুজিবকে সমস্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ¯^াধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আহŸান জানান। ঐদিন সন্ধ্যায় করাচিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দেশের সর্বশেস রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার জন্য পিপিপি বাদে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আগামী ৫ দিনের মদ্যে জাতীয় পরিষদের অীধবেশন আহŸানের দাবি জানানো হয়।

৩ মার্চ, ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলায় প্রথম দিনের মতো সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বেলা ২টা পর্যন্ত হরতালের আহŸান করা হলেও রাজধানীতে মূলত সারা দিনই হরতাল পালিত হয়। এদিন সকালে ২ মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল বের করা হয় এবং হরতাল চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র ববাঙালির ওপর নির্মম গুলিবর্ষণ করে। প্রদেশব্যাপী হরতালে চট্টগ্রাম অচল হয়ে যায়। ঢঅকা ছাড়া সিলেট ও রংপুরেও কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকার কারফিউ- এর মেয়াদ কমিয়ে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্ডন্ত করা হয়। ঢঅকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ মিছিল করে এদিন শহীদ মিনারে জমায়েত হন। এদিন হরতাল চলাকালে সারাদেশে সেনাবাহিনীল গুলিতে শতাধিক বাঙালি শহীদ হন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ১২ জন নেতার সাথে আলোজচনার জন্য ১০ মাচর্ঃ এক গোলটেবিল বৈঠকের আহŸান করেন ঢঅকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান এবং বৈবঠক আহŸানকে “ঈৎঁবষ লড়শব” বা নির্দয় তামাশা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বেতারে প্রচারিত এই আমন্ত্রণের পটভ‚ীমতে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের পাইকারি হারে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি আরো বলেন, যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রয়েছে, কঠোর অস্ত্রের ধ্বনি আমাদের কানের কাছে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে, এ অবস্থায় একটি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো আর বন্দুকের সামনে আমন্ত্রণ

ঘটনা ও ব্যক্তি
জানানো একই কথা। যেখানে শত শত বাঙালির রক্তের দাগ এখনো রাজপথ থেকে শুকায়নি, শত শত বাঙালির লাশ এখনো দাফনের প্রতীক্ষায় এবং মত শত বুলেটবিদ্ধ বাঙালি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে- সেই পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না।
এদিন বিকেলে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় শেক মুজিবুর রহমান আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং ¯^াধীনতার ইস্তেহার প্রচার করা হয়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের নির্দেশ দেন এবং ৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেন। তিনি তাঁর ভাষণে সর্বঅত্মক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বাংলাদেশের সরাকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদৈর প্রতি নির্দেশ দেন, পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত আপনারা অীফস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখুন। প্রচার মাধ্যমের প্রতি নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, যদি আমাদের বক্তব্য বিবৃতি, আমাদের আন্দোলনের খবর প্রকাশ ও প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় সে নির্দেশ আপনারা লক্সঘন করুন। তিনি আরো বলেন, বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য গুলি খাওয়ার জন্যঃ নয়। তিনি ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গরিব বাঙালির পয়সায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপুরুষের মতো গণহত্যার বদলে, অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আগুণ নিয়ে খেলা করবেন না। যদি করেন পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, সামরিক সরকারের মত যদি পরিবর্তিত না হয় ৭ মাচের্ৎর পূর্বে, তবে ঐ দিন অর্থাৎ ৭ মার্চ ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সে সুযোগ আমাকে নাও দেয়া হতে পারে। তাই জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে। তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহŸান জানান সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবার এবং তিনি জনগণের প্রতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আপনারা যে যেখানে থাকুন নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করুন, আন্দোলনকে সংযত রাখুন।
এদিন থেকেই মূলত আওয়ামী লীগ প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ¯^াদীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক ছাত্রসভায় ছাত্র ইউনিয়নৈর তাৎকালীন সভাপতি নূরুল ইসলাম যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সংগ্রাম পরিচালনার আহŸান জানান। ভুট্টোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও মতবিরোধ দেখা

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
দেয়। এদিন পাঞ্জাব পাকিস্তান ফ্রন্টের আহŸায়ক মালিক গোলাম জিলানী পিপলস পার্টির সমালোচনা করে এক বিবৃতিতে একে ‘দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেন এবং একই সাথে তিনি ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানের একক প্রতিনিধিত্ব অ¯^ীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এদিন করাচির এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান সমস্যার একমাত্র সমাধান।

৪ মার্চ, ১৯৭১
বাংলার মুক্তিকামী জনতার অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্থ দিনটি ‘পূর্ণ হরতাল, বিক্ষুবদ্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও ¯^াদীনতার পশপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢঅকাসহ সমস্ত বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হয় জাতীয় পরিষদ অীধবেশন স্থগিত ও গণহত্যার প্রতিবাদে। এদিন ঢাকার কারফিউ তুলে নেয়া হলেও খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবত থাকে। খুলনায় পাকবাহিনীর গুলিতে বহু হতাহত হয়। যশোরে পাকবাহিনীর গুলিতে মিছিলকৃত একজন শহীদ হন, তার নাম চারুবালা ধর। ৩ ও ৪ মার্চ এই দুই দিনে চট্টগ্রামে ১২০ জন বাঙালি নিহত ও ৩৩৫ জন আহন হন। ঢঅকায় ও গত দুই দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। একই সাথে ফরিদপুরে সিটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়, যা ইতিহাসে বৃহত্তর প্রতিবাদ মিছিল ছিল। মোট কথা সমস্ত বাংলার সব শ্রেণীর, পেশার জনগণ বঙ্গবনস্ধুর আহŸানে ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে ¯^াধিকার আন্দোলনে যোগ দেয়।
ঢাকাসহ সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয় শহীদদের স্মরণে। আওয়ামী ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা হরতাল চলাকালে শান্তিরক্ষার জন্য শহরের রাজপথে টহল দিতে থাকেন। ঢঅকার সাথে জল-স্থল ও বিমানপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের টেলিফোনকর্মীরা পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রাঙ্কল বুক ও টেলিগ্রাম প্রেরণ থেকে বিরত থাকেন। এদিন হরতাল চলাকালে সেনাবাহিনীর প্রহরীদের তেমন টহল দিতে দেখা যায়। তবে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর ব্যঅরাকের বাঙালি জওয়ানরা রাজপথের মিছিলকারীদের সাথে একাগ্রতা প্রকাশ করেন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের মাধ্যমে। এদিন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বেতার ও টেলিভিশনের ২০ জন শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিকে ঢঅকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন শিক্ষক এক যৌথ বিবৃতিতে

তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভারের গণবিরোদী ভ‚ীমকার তীব্র সমালোচনা করেন।
‘ঃঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এদিন থেকে প্রতিদিন আরো দুবার বাংলায় স্থানীয় সংবাদ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিন অব্যাহতিপ্রাপ্ত গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসান রাতে বিমানে করে করাচি রওনা হন। যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের মাদ্যােম বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানান। অন্যদিকে করাচি প্রেসক্লাসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বৈ ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এদিন ঢঅকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢঅকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বৈ জাতীয় পরিষদের অীধবেশন ডাকার আহŸান জানান প্রেসিডেন্টের প্রতি। লেদ. জে. টিক্কা খানকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা সম্পর্কিত টেলিফোন সংবাদ জানার পর লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির ¯^াধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলিম রীগ, আওয়ামলী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আমি আন্দোলন করেছি। কিন্তু ৮৯ বছরের জীবনে এবারের মতো গণজাগরণ ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ কখনো দেখিনি।’ এদিকে যে কোনো মূল্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যঃয় ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশ জারি করা হয়। ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহŸান জানান লীগপ্রধান। তিনি আরো বলেন, যেসব সরকারি কর্মচারী এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুধু বাঙলাদেশের মধ্যে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙানো যাবে। স্টেটস ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলার বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না। হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার ও সাংবাদিকের গাড়ি, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সাপ্লাই, স্থানীয় টেলিফোন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার টেলিফোন যোগাযোগ, দমকল ও আবর্জনার গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বিশ^বাসী দেখুক, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বুলেটের মুখেও কী দুর্দান্ত সাহস ও দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
এদিন রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গভর্নরের বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুর কাছে কতিপয় প্রস্তাব নিয়ে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে তাঁর লোকেরা কীভাবে মারা

যাচ্ছে তার বর্ণনা দেন ও বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং আলোচনার এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে উপস্থিত হন এবং উপস্থিত হয়েই তিনি দৃঢ়কণ্ঠে রাও ফরমান আলীকে উদ্দেশ করে বলেন যে, এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়, তাছাড়া যেখানে ভুট্টো রয়েছৈ। এরপর আলোচনা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি ইবেং এই রাতেই প্রেসিডেন্ট রাও ফলমান আলী খানকে ইসলামাবাদে সাক্ষাতের নির্দেশ দেন।

৫ মার্চ, ১৯৭১
¯^াধিকারকামী জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল, গণজমায়েত ও বজ্র শপথের মধ্য দিয়ে বাঙলার জনগণের মুক্তি আন্দোলনের পঞ্চম দিন অতিবাহিত হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঢঅকার টঙ্গী শিল্প এলাকায় এদিন সকালে হরতাল পালনকালে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় ও ২৫ জন আহত হয়। এতে সমস্ত টঙ্গী এলাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা টঙ্গীর কংক্রিট ব্রিজের পাশের কাঠের ব্রিজটি আগুন দিঃেয় পুড়িয়ে দেয় ও বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদে ঢাকায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার এক বিরাট সমাবের হয় ও নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে রাজধানীতে মিছিল বের করা হয়। এদিন চটপ্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত হয় এবং গত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যোল কলেজ হাসপাতালে আরো ১০ জন আহত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এ হিসাবে চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৮ জন। খুলনা ও রাজশাহীতেও যথাক্রমে ২ জন ও ১ জন নিহত হয়।
জুমার নামাজের পর মসজিদে মসজিদে বিশেস মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায়। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ও পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম থেকে একটি লাঠি মিছিল বের করে সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে এবং বায়তুল মোকাররমে একটি মিটিং-এ অংশগ্রহণ করে সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করে। একই সাথে খিৗগাঁও ভ‚মি বন্দোবস্ত কমিটি বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে নারায়নগঞ্জে মহিলা, ছাত্র ও শিক্ষকরা মিছিল করেন। ঢাকার লেখক ও শিল্পীবৃন্দ জনহতার সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং শহীদ মিনারে ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে এক সভায় মিলিত হয়ে ¯^াধীনতার শপথ নেন। ঢাকার ৬৫১ পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এদিন সার্বিক পরিস্থিতি, গতিপ্রকৃতি ও শান্তি-শৃক্সখলা রক্ষার

জন্য কন্ট্রোলরুম খোলা হয় এবং একই সাথে প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় আওয়ামী ঃলীগের অফিসে কন্ট্রোলরুম ব্যবস্থা চালু করা হয়।
এদিন ঃফরিদপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ¯^াধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন দুপুরে করাচি থেকে ঢাকা আসেন আসগর খান এবং রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এক সাক্ষৎকারে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে শেক মুজিবুর রহমান নিজের সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে তাঁকে যে কোনো মুহুর্তে গ্রেফতার করা হবে কিংবা সেনাবাহিনী বা তার অনুচরেরা তাঁকে হত্যা করবে এবং বিষ্ময়কর হলেও সত্য যে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঠিক সেভাবেই ঘটে যাচ্ছিল। এদিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন যে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা মানবতার বিরুদে্ধু অপরাধ ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধের আহŸান জানান। একই সাথে বঙ্গবন্ধুও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশে নির্বাচন বন্ধের জন্য আহŸান জানান।
পাকিস্তান সামরিক সরকার এদিন সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাঞ্জাবের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জে. টিক্কা খানকে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্তির আদেশ জানান। একই দিনে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক আলোচনায় মিলিত হন এবং আলোচনা শেষে পিপিপির মুখপাত্র আব্দুল হাফিজ পীরজাদা জানান, অধিবেশন স্থগিতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। এ থেকে আরো স্পষ্ট হওয়া যায় যে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে এবং রাও ফরমান আলী পিন্ডিতে এক সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে লিখৈছেন, ‘ইয়াহিয়া খানকে মদের নেশায় ক্রুদ্ধ মনে হলো।- মন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, ঢাকাতে রক্তের খেলা চলছৈ আর ইসলামাবাদে জেনারেল সাহেবরা সুরা সাকী নিয়ে ব্যস্ত। ভুট্টো, ইয়াহিয়া, জেনারেলর হামিদ তিনজনই দেশের পরিস্থিতির কথা ভুলে গিয়ে সুরায় ডুব দিয়েছৈ।’ এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্র কি উন্মত্ত খেলায়ই না মেতে উঠেছিল ১৯৭১ সালের ঐ দিনগুলোতে।

৬ মার্চ, ১৯৭১
জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকা পাঁচ দিনব্যাপী হরতালের আজ শেস দিন। পূর্ণ উদ্যমে পালিন হয় হরতাল, চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। অলি আহাদের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং মুজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাপের এই গণসমাবেশে মুজাফফর আহমদ জনগণকে মুক্তির জন্য যে কোনো

ত্যাগ ¯^ীকারে প্রস্তুত হওয়ার আহŸান জানান। এ ছাড়া ঐ দিন সাংবাদিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রæপ), কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল, শ্রমিক ইউনিয়ন, গণশিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ¯^জনী ও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে বিক্ষুব্ধ মিছিল এবং বাংলা ন্যাশনাল লীগের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজধানীতে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করা হয় এবং সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাজী জাফরের সভাপতিত্বে এদিন শ্রমিক সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। এদিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে বের হয় এক বিরাট মশাল মিছিল। মহিলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়েঅজিত কেসন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে বাংলার বিক্ষুব্ধ নারীরা বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শেষে এক জঙ্গি মিছিল বের করেন তারা। একই সাথে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সাংবাদিক জনসমাবেশ।
‘আপসের বাণী আগুনে জ¦ালিয়ে দাও’ শীর্ষক আহŸান জানিয়ে প্রকাশিত হয় লেখক-শিল্পীদের মুখপত্র ‘প্রতিরোধ’- এর দ্বিতীয় সংখ্যা। এবং তাদের শ্লোগান ছিল- পরিষদ বৈঠক বর্জন কর, বাংলাদেশ ¯^াদীন কর। এদিকে সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিন প্রায় চার লক্ষ লোকের এক বিশাল গণবাহিনী যশোরে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনী ভীত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারা ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। এ সময় বহু পাকিস্তানি সৈন্য জনতার হাতে ধরা পড়ে ও অনেক বিহারি লূটতরাজের সময় জনরোষে নিহত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন আওয়ামী লীগকে সতর্ক করে এক ভাষণ দেন। সেখানে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় আহŸান করেন। এই সাথে লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগের সরকারি ঘোষণা দেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইয়াহিয়া খানের একটা ভাঁওতাবাজি। তার মুল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেন্য আমদানির জন্য প্রয়োজনয়ি কিছু সময় বৃদ্ধি করা। যার প্রমাণ আমরা পরবর্তী দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখতে পাই। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিককার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের এই ভাষণকে ¯^াগত জানায়। ইয়াহিয়া খানের এই বেতার ভাষণের পরপরই ঢঅকা ও নারায়ণগঞ্জে ¯^তঃস্ফ‚ুর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। প্রেসিডেন্টের এই ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগৈর কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশ শাখার ওয়ার্কিং

কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘন্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশৈস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলেঅচনা হয়। এদিন লাহোরে বিকেলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাম প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৬ জনকে একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আহুত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি জানান। এদিন সঠিক পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান দলীয় হাইকমান্ড এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওদিকে পল্টন ময়দানে জাতীয় লীগের জনসভায় আতাউর রহমান খান হত্যঅ ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য সামরিক সরকারের প্রতি আহŸান জানান। একই সাথে তিনি জনগণকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহŸান জানান।

৭ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের এই দিনটি বাংলার ইতিহাসে বিশেস স্মরণীয় দিন। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দান, যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। এদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলনের আহŸান জানায়। একই সাথে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমš^য় কমিটি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ¯^াধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহŸান জানায়। ন্যাপ (মুজাফফর) আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে ১৭ দফা গোষণা করেন ও এর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আহŸান জানান। এদিন সরকারি প্রেসনোটে গত ৬ দিনে ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহতের কথা ¯^ীকার করা হয়। তার পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ মিথ্যাচার বলে বাতিল করে দেন। তিনি দাবি করেন যে নিহত ও আহতের সংখ্যা কমিয়ে বলা হয়েছে।
ঢাকার সমস্ত রাজপথ এদিন রেসকোর্সে গিয়ে মেশে। বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে মুক্তির বানী শোনার জন্য সকাল থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হতে থাকে। সমস্ত পেশার, সকল বর্ণের, সকল বয়সের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, বুকে ¯^াধীনতার ¯^প্ন ও কণ্ঠে বিভিন্ন শ্লোগান নিয়ে সমবেত হয় রেসকোর্স ময়দানে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে “জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু” “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ” “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা” “তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব” “ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ ¯^াধীন করো” “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ ¯^াধীন করো”

“হুলিয়ার ঘোষণা, মানি না মানি না” এ ধরনের বিভিন্ন তেজদীপ্ত শ্লোগান। রুদ্ধদ্বার কক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ¯^াধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলোচনার কারণে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় আসতে একটু দেরি হয়। বেলঅ সোয়া তিনটায় তিনি সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাাবি আর তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক কালো কোট পরিহিত অবস্থায় তিনি সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন দশ লক্ষাধিক মুক্তিপাগল বীর বাঙালির উপস্থিতিতে আয়েঅজিত, জনসভায়। চারদিকে উড়ছে সোনার বাংলার মানচিত্রখচিত লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা, সাথে মুহুর্মুহু শ্লোগানের মধ্য দিয়ে শুরু করেন তাঁর ভাষণ। তিনি তাঁর ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম ¯^াধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে তিনি ২৫ মার্চের অধিবেশনে যোগ দিতে চারটি শর্তের উল্লেখ করেন। শর্তসমূহ হচ্ছে-
ক. অনতিবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা
খ. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া
গ. সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা
ঘ. সঃংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা
এছাড়া তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে পরবর্তী সপ্তাহের জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে প্রচার করার দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ পূর্বে তা প্রচার করার সিদ্ধান্ত বেতার মারফত ঘোষণা করলেও শেস মুহুর্তে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় সামরিক বাহিনীর নির্দেশে। ঢঅকা বেতারের কর্মীরা এর প্রতিবাদ¯^রূপ বেতার থেকে বের হয়ে এসে জনসভায় যোগদান করেন। এতে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে যায়য়। ফলে গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। যার ফলৈ পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা কেবতারের কেন্দ্র পুনরায় চালু হয়।
এদিন লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারণ করে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয। তাকে অবশ্য গভর্নর হিসেবেও নিয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু কোনো বিচারপতি তাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি না হওয়ায় তাকে কেবল সামরিক শাসনকর্তা হিসেবেই কাজ করতে হয়। যখন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছিল ঠিক সেই মুহুর্তে লে. জে. টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী ঢাকা পৌঁছেন এবং টিক্কা খান সামরিক শাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডোর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই ঢঅকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা

হস্তান্তরের উদাত্ত আহŸান জানান। তিনি আরো বলেন, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান আজ যে শর্ত দিয়েছৈন তা ন্যায়সঙ্গত, উপযুক্ত, সুষ্ঠু ও বৈধ।
৬ মাচর্ঃ প্রচারিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন। যেখানে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস। গত কয় দিনের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদের বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলি মেনে চলছে। প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদসহ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। তিনি বাংলার সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে বলেন, আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনসাধারণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছৈ। সুপরিকল্পিতভাবে তারা কারফিউ ভঙ্গ ও বুলেটের মোকাবেলা করেছেন এ জন্য আমি জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ ¯ে^চ্ছাসেবকদের অভিনন্দন জানাই। তিনি আরো বলেন, আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে। সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো, অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকবে।

৮ মার্চ, ১৯৭১
সকাল সাড়ে আটটার সময় ঢাকাসহ সকল বেতার কেন্দ্র থেকে একযোগে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ফলে বেতারের প্রতিবাদী বাঙালি কর্মীরা আবার কাজে যোগদান করেন। ৭ মিার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘¯^াধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার প্রেক্ষিতে এদিন সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর আহŸানে মহল্লায়-মহল্লায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষৈ কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এমনকি সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং প্রাইভেট মোটগাড়িতেও কালো পতাকা লাগানো হয়। প্রতিটি মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যঅপারে মহল্লাবাসীর মধ্যে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে সাধারণ মানুষ সকলের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে।
৭ মার্চ সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখকৃত ১২৭ জন নিহত ও ৩৫৮ জনের আহত হওয়ার খবরের প্রতিবাদে এই দিন আওয়ামীল লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি এটাকে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেন। কারণ প্রকৃত নিহত ও আহতের সংখ্যা এর অনেক বেশি ছিল।

তিনি আরো বলেন, আজ বাংলার মানুষ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির এ ধরনের অপচেষ্টা সফল হবে না। সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছৈ বলা হলেও এখনো বিভিন্ন এলাকায় তাদের দেখা যাচ্ছে। তিনি সমস্ত সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার পুনৎদাবি জানান। এদিকে পিডিপি সভাপতি নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের সাথে পরামর্শক্রমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান। একই সাথে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর এক বিবৃতিতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের বঙ্গবন্ধুর দাবির প্রতি সমর্থন জানান ও সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের দায়ী করেন। এদিন আরো অনেকে বাঙালির দাবির পক্ষে মত দিয়ে বিবৃতি দেন। তাদের মদ্যে জাতীয় লীগ প্রধান াতাউর রহমান খান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আজ জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। চরম লক্ষ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে।
ব্রিটিশ ও পশ্চিম জার্মঅনির ১৭৮ জন নাগরিক এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। জেনারেল টিক্কা খানকে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব এদিন দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের একটি সভা এদিন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৪২, বলাকা ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। জেলা শহর থেকে শুরু করে একদম তৃণমূল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সকল শাখার সভাপতিকে আহŸায়ক ও সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং ৯ জন সদস্য অর্থাৎ মোট ১১ জনকে নিয়ে এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়। ছাত্রলীগ প্রদেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানি সংগীত বাজানো এবং উর্দু বই প্রদর্শন বন্ধ রাখা ও সিনেমা কর প্রদান না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদিন বেনামি একটি লিফলেট ছড়ানো হয় যেখানে গেরিলা যুদ্ধে নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ ছিল।
এদিন গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) এম আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ওদিকে বেতার ও টিভি শিল্পীদের একটি প্রতিনিধিদলও বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তাঁর বর্তমান মুক্তি আন্দোলনের অনুকুলে অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্দেশ্যে আগামী ১০ মার্চ থেকে বেতার ও টেলিভিশনে তাঁদের যোগদানের সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। এদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে আরো সাক্ষাৎ করেন সরকারি, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত

সংস্থারকর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নৈর প্রতিনিধিরা। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক অফিসের কাজ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য তাঁদের একদিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন। এদিকে জেনারেল ইয়অহিয়া খান ব্রিগেডিয়ার জিলানীর মাধ্যমে প্রেরিত এক লিীখত বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানকে জানান, ‘আপনি যা দাবি করেছেন, তার চাইতে বেশি কিছু দিতেও আমার আপত্তি নেই।’ আমি অচিরেই ঢাকা আসছি। তিনি অবশ্য অচিরেই ঢাকা এসেছিলেন ও অনেক বেশি কিছু দিয়েছিলেন বাঙালিদের, যার প্রমাণ আমরা পাব ২৫ মার্চ রাত থেকে।

৯ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলন যথারীতি চলতে থাকে। এদিন সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যঅন্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গত ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ৈল বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘¯^াদীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’- এ ছাত্র জনসভার গৃহীত ‘¯^াধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। অপর এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের ¯^াধীনতা আন্দোলনের জন্য ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এদিন ¯^াধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যঅহত রাখার আহŸান জানায়।
দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এদিন অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, ‘নির্বঅচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সংকট মুক্তির একমাত্র পথ।’ এদিন আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ প্রধান মওঃলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টার এক বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারা দেশে সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তবে যে সকল সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েীছলেন বঙ্গবন্ধু সেগুলো খোলা থাকে। বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন এদিন চলাচল করে। দোকান পাট ও হাটবাজার খোলা থাকে। লঞ্চ ও ট্রেন ¯^াভাবিকভাবে চলাচল করে তবে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে এবং আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারবর্গের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের

সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
বিকেলে পল্টন ময়দানে ¯^াধীন বাংলা সমš^য় কমিটি আয়েঅজিত এক বিশাল জনসমাবেশে নব্যাপ প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, শেক মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনো কিছু না করা হলে আমি শেক মুজিবুর রহমানের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করব। তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে শেক মুজিবুর রহমান আপস করতে পারে। খামোখা, কেউ মুজিবকে অবিশ^াস করবেন না। শেক মুজিবকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তাঁকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েীছ। আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি। তাঁদের মধ্যে শেক মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি। তিনি ইয়অহিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ¯^াধীন হবে। পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে না। অখণ্ড রাখবও না। তিনি আরো বলেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভালো চাও তাহলে কালই বাংলার ¯^াধীনতা ¯^ীকার করে নাও। একই মঞ্চে বাংলা জাুতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি ¯^াধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন।
এদিন জাতিসংঘৈর মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘৈর স্টাফ ও তাঁদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘৈর উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। একই সাথে জাপানের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘন্টার জনৎ্য কারফিউ জারি করে। এদিন গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে “খ” অঞ্চলের (বাংলাদেশ) সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক মিানে ঢাকা আসেন। ৬ মার্চ তাকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। আজ অর্থাৎ ৯ মার্চ তার গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা চিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে কোনো বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেতে অ¯^ীকৃতি জানান। ফলে সরকার তাকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে। এদিকে ইসলামাবাদে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে আগামী কয়েক দিনের মদ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে আসবেন।
আন্দোলনের গতি ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মানুষের বাসগৃহে ওড়ানো হয় ¯^াধীন বাংলাদেশের পতাকা। এবং সরকারি ও আধাসরকারি অফিস,

ভবন ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অসহযোগ আন্দোলন ত্যাগ করে গেরিলা যুদ্ধে মাধ্যমে দেশ ¯^াধীন করার আহŸান জানায়।

১০ মার্চ, ১৯৭১
আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদিন সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায। জেল থেকে পালাবার সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুযুদ্ধে ২৭ জন আহত হয়। অন্যদিকে সকালেই বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান তাঁর নিজ বাসভবনের একদল বিদেশী সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকার বৈঠকে মিলিত হন। এসময় তিনি বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোনো মূল্যৈ তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেয়ার পালা শেস করতে চাই। তিনি বলেন, তেইশ বছর ধরে শোষক ও শাসক শ্রেণী বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আজ বাঙালিরা এসব শোষণ ও শাসনের অবসান চাই। সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়।
এদিন সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। পরে ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ¯^াক্ষরিত ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সাথে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়। এই বিবৃতিতে আরো বলঅ হয় যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন ¯^াধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক এদিনও সারা দেশের সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। প্রত্যেক সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানএমনকি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা ওড়ানো হয়। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনে, পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িতেও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলতে দেখা যায়।
নিউইয়র্কে বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে দেশে সামরিক সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ¯^রূপ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও জাতিসংঘ মহাসচিবকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাঁদের পরিবারবর্গের প্রত্যাহারের যে নির্দেশ জাতিসংঘ মহাসচিব দিয়েছিলেন তার প্রেক্ষিতে বলেন, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশীদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছে তার প্রশান মেলে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে। তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই এ ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ যে হুমকি আজ উদ্যত তা গণহত্যার হুমকি। এবং সে হুমকি বাংলার সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে ¯^াক্ষরিত মৌলিক মানবাধিকার অ¯^ীকৃতিরই নামান্তর। এদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ইকে বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুুেদ্ধ গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তাদের সমরসজ্জা অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিনিয়ত সামরিক বাহিনীর লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে।
এদিন ঢাকাতে অীভনেতা গোলাম মোস্তফা ও সুরশিল্পী খান আতার নেতৃত্বে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’- এর ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সিভিল সার্ভিসের ২য় শ্রেণীর কর্মচারীরাও এদিন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এদিন বিকেলে ওয়ালীপন্থী ন্যাপারে উদ্যোগে শোষণমুক্ত এলাকায় এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। আবার ‘লেখক শিল্পী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’- এর ব্যঅনারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোব মিছিল বের করে। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রæপ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন ১১৪ নং সামরিক বিধি ঘোষণা করে।
‘আর দেরি নয়’ এই শিরোনামে এদিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহŸান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। অন্যদিকে ‘দি পিপল’ পত্রিকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমালোচনা করে বলা হয় ‘বাঙালির রক্তপাতের জন্য ভুট্টো দায়ী’। এদিন লাহোরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহŸানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য যে পূর্বশর্ত দিয়েছেন তার নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
১১ মার্চ, ১৯৭১
সমস্ত বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের চরম অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিনও সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি ভবন, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। সমস্ত দেশে বেসরকারি ভবন ও বাসগৃহের শীর্ষৈ ¯^াধীন বিাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ¯^াধীন বাংলার দাবিতে অবিচল

সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী আজও সরকারের সাথে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যঅহত রাখে। হাইকোর্টের বিচারপতি ও সচিবালয়ের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারী অফিস বর্জন অব্যাহত রাখে। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্টেট ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারিতে ¯^াভাবিক লেনদেন হয়। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে এদিন ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ ¯^াভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরীর বিপণি বিতানগুলো খোলা থাকে। এদিন অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকে। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা যায়। এদিন প্রেক্ষাগৃহগুলোতে বাঙলা ছায়াছবি দেখানো হয়। নারায়ণগঞ্জের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে সিনেমা শুরুর আগে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়। এই দিনে সিএসপি ও ইপিসিএম সমিতির পদস্থ বাঙালি সরকারি কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁদের একদিনের বেতন আওয়ামী লীগের তহবিলে প্রদান করেন। ওদিকে বরিশাল ও কুমিল্লায় জেলখানা ভেঙে কয়েদিরা পালিয়ৈ যায়। এ সময় কয়েদি ও কারারক্ষীদের মদ্যে সংঘর্ষে শতাধিক কয়েদি ও কারারক্ষী আহত হয়। পালাবার সময় বরিশোলে ২ জন ও কুমিল্লায় ৩ জন কয়েদি কারারক্ষীর গুলিতে নিহত হয়।
¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এদিন দুটি বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তারা গত ১০ মার্চ ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নং জেটিতে এম এন সোয়াত নামে একটি অস্ত্রবাহী জাহাজ নোঙরের কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা আরো বলেন, বন্দর শ্রমিকরা সেই জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে রাজি না হওয়ায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা তা খালাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং সেই সমস্ত অস্ত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুতকৃত রেল ওয়াগনে ওঠানো হয়। আরো পাঁচটি অস্ত্র ও সৈন্য বাহিনী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা হবে বলে তারা উল্লেখ করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে বাংলার জনগণের জন্য সামনে আরো কত ভয়াবহতা অপেক্ষা করছ্ েছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের জন্য বাংলার জনগণের প্রতি আহŸান জানান। ওদিকে ৩২ হাজার টন গম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে পাঠানো হয় ‘ভিনটেক হরাইজন’ নামক একটি জাহাজে। কিন্তু এদিন এই জাহাজটির গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরের দিকে পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ঢাকাস্থ জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি মি. উলফ এদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মি. উলফ বলেন যে বর্তমান পরিস্থিতি এমন নয় যে, কর্মচারীদের অন্যত্র অপসারণ করতে হবে। মওলানা ভাসানী এদিন টাঙ্গাইলে

বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল ময়দানে আয়েঅজিত এক জনসভায় জনগণকে শেক মুজিবের নেতৃত্বে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহŸান জানান।
ছাত্রলীগ প্রদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয় এবং কেন্দ্রের যে কোনো নির্দেশ সমগ্র প্রদেশে পালিত হতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এদিন ‘¯^াধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহŸান জানায়। অন্যদিকে ন্যাপ (মুজাফফর) বায়তুল মোকাররমে জনসভা করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ক্লাবে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এদিন এক সাধারণ সভার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বিশ^বাসীর সমর্থন কামনা করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আন্দোলনের গতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখার জন্য কতকগুলো নির্দেশ ঘোষণা করেন।

১২ মার্চ, ১৯৭১
বিগত দিনের মতো এদিনও সারা দেশে ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে অসহযোগ আন্দোলন ও ¯^াধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন অব্যঅহত থাকে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সমাবেশ ও শোভাযাত্রা অব্যাহত থাকে দেশব্যাপী। এদিন বগুড়া জেলখানা ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। সরকারি, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কোকাপেপ) এদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এদিন থেকে সারা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা সকল প্রেক্ষাগৃহে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের লেখক, চটুয়া এবং শিল্পীরা এদিন মিছিল করেন এবং আন্দোলন কর্মসূীচতে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিন চট্টগ্রামে অধ্যাপক আবুল ফজলের নেতৃত্বে শিল্পীসমাজ সরকারের অনুগত হয়ে জনগণের বিরোধী ভ‚মিকার জন্য চ্টগ্রাম বেতারের নিন্দা জানায়।
তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে এক বিবৃতি দেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এদিন ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয। এদিন পূর্ব রেলওয়ে কর্মচারী এবং চারু ও কারুশিল্পীরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সংসদের এক জরুরি সভায় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় ও ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মওলানা ভাসানী এদিন ময়মনসিংহে এক জনসভায় পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বাঙালিদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না। অন্যদিকে লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গণ ঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের নির্মম

পরিহাস, দোষ করা হলো লাহোরে কিন্তু বুলেট বর্ষিত হলো ঢাকায়। তিনি আরো বলেন, পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণ সমান অধিকার নিয়ে থাকতে চায়, পশ্চিমাঞ্চলের দাস হিসেবে নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রথম ফ্লাইটে ঢঅকা যাবার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেল নেতা শেক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসুন। লাহোরে ন্যাপের মহাসচিব সি আর আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের বর্তমান সংকটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমলাই দায়ী। জনাব ভুট্টোও এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, শেক মুজিবুর রহমানের চার দফাকে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই বিরোধিতা করতে পারে না। প্রেসিডেন্টের অবিলম্বে শেক মুজিবের দেয়া চার দফা দাবি মেনে নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেণ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহী মিনারে সমাবেশ করে। ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক এদিন ঢাকার মগবাজার মোড়ে প্রতিবাদ সভা করে। এদিন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন তাঁর পাকিস্তানি খেতাব বর্জন করেন। এদিন লাহোরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকসহ ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। এদিকে রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রের খ্যাতনামা বাংলা খবর পাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গাবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে এদিন রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন। আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে খাদ্যবোঝাই চট্টগ্রাম মুখী মার্কিন জাহাজের গতি পরিবর্তন করে করাচি প্রেরণের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানে মুদ্রা পাচারের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ এদিন স্থানীয় কয়েকটি ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এবং ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীল ব্যবহারের জন্য কোনো জ¦ালানি সরবরাহ না করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীদের নির্দেশ দেন।

১৩ মার্চ, ১৯৭১
সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং সামরিক আইন জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল দশটার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেন। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। তবে এই সামরিক নির্দেশ জারির সাথে সাথেই শেক মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, সামরিক সরকারের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই

নতি ¯^ীকার করবে না। তিনি যে কোনো হুমকির মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি সামরিক কর্তৃপযেক্ষর প্রতি উস্কানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহŸান জানিয়ে বলেন, জনগণকে যত ভয় দেখানো হোক না কেন, তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তির বিরুদ্ধে কোনো কিছুরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ক্ষমতা নেই।
এদিনও সারা দেশে সার্থকভাবে পালিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। াবাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে গড়ে উঠেছে সংগ্রাম কমিটি। সকল দেয়ানি ফৌজদারি আদালতসহ সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। একই সাথে এদিনও বাংলার প্রতিটি বাড়িতে, ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। এদিনও ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও এদের পরিবারবগর্ৎসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেস বিমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। ¯^াধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্যে জনসাধারণের প্রতি আহŸান জানান।
মওলানা ভাসানী ভৈরবে এক জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ¯^াধীন। শ্লোগানের প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরো বলেন, কীভাবে মুক্তিসংগ্রামে বুকের রক্ত দিতে হয় তা পূর্ববাংলার মানুষ জানে। বিদেশী বস্ত্র, মদ ও গাঁজা ত্যাগ করার জন্যও তিনি অনুরোধ জানান জনগণকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর আজম খান এদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন। একই সাথে ন্যঅপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এদিন শেক মুজিবের দাবির সঙ্গে একমত পোষন করেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলনের সমর্থনে এদিন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে এক বিশাল মশাল মিছিল বের করে। একই সাথে বাংলা একাডেমী ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকে সমর্থন করে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এদিন থেকে।
লাহোরে এক বৈঠকে এদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সংসদীয় দলগুলো এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৪ দফা সমর্থন করে এবং ২৫ মার্চের আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে কেন্দ্র ও এদেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের আহŸান জানায়। এদিন জমিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলামের নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে কাউন্সিৎল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা এবং সরদার শওকত হায়াত খান, জমিয়াতুল উলেমা-ই-পাকিস্তানের মওলানা শাহ আহমদ নূরানিসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এদিন সাাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে লেটার অব অথরিটির মাধ্যমে ক্ষমতা

হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহŸান জানান। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব কটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে বাংলাদেশে যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যঅহারের দাবি জানান।

১৪ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির শেস দিন ছিল এদিন। এবং আওয়ামী লেিগর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ৩৫টি নির্দেশ ঘোষণা করেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১৫ মার্চ থেকে এগুলো পালনের জন্য জনগণের প্রতি তিনি আহŸান জানান। বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান এদিন রাতে এক বিবৃতির মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন অব্যঅহত রাখার আহŸান জানিয়ে জনগণের উদ্দেশে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, যারা নগ্ন বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল জনগণ চুড়ান্তভাবে তাদের র্পুদস্ত করেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, কৃষক ছাত্রজনতা অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিয়েছৈন যে, আত্মসমর্পন নয়, তারা আত্মত্যাগের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বেসামরিক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার অনুরোধ আপনারা কোনো হুমকির মুখে মাথা নত করবেন না। অসহযোগ চালিয়ে যান। তিনি জারিকৃত ১১৫ নং সামরিক বিধি সম্পর্কে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভ‚ত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা আমাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের ¯^াধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে ¯^াধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার সাথে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই।
এদিন আবার বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামক আরেকটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। একই সাথে ‘ওসান এডুরাস’ নামের আরেকটি সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ চ্টগ্রাম বন্দরের ১০ নং জেটিতে নোঙর করা হয়। এদিকে প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পাটির্৩র নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এদিন এক বিবৃতিতে গত ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিনটেজ হরাইজন’- এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানান।
বরিশালে এক জনসভায় আজ বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের প্রতি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের

আহŸান জানান।
এদিন বিকেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ক্যঅন্টিনে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের আঞ্চলিক শাখাসমূহের কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সন্ধ্যায় ঢাকার লালবাগের বালুরমাঠে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আরেকটি জনসভা হয়। এছাড়া ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে টিভি নাট্যশিল্পীদৈর এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাগ্রতা প্রকাশ করা হয়। অন্যাদিকে বাংলা একাডেমীতে লেখ সংগ্রাম শিবিরের উদ্যোগে একটি লেখ সমাবেশ শেষে শোভাযাত্রা বের করা হয়। বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে এদিন ছাত্র ইউনিয়নৈর (মতিয়া গ্রæপ) নেতৃত্বে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এদিন সন্ধ্যায় পল্টন ময়দানে কথাশিল্পী সম্প্রদায় কবিতা পাঠ ও গণসঙ্গীতের আসর বসায়।
এদিন ঝিনাইদহের কয়েকজন সিএসপি ও পিএসপি কর্মকর্তা শপথ নেন যে, প্রয়োজনে দেশের জন্য তাঁরা অস্ত্র ধারণ করবেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জনাব তৌফিক এলাহী শাহ মো. ফরিদ, কামাল সিদ্দিকী, মাহবুবুর রহমান (এসডিপি ও ) ও অন্য অনেকে। এবং তাঁরা সকলেই ছিলেন মহকুমা প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত। পরবর্তীতে এঁরা সকলেই ¯^াধীনতা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। ¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম কেন্দ্রীয় পরিষদ এদিন ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের জন্য। এদিন জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ প্রতিটি শ্রমিক এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ ও ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে ট্রেনিং প্রদানের নির্দেশ দেন।
ঢাকার সংবাদপত্রগুলো এদিন যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘আর সময় নেই’/ঞরসব রং জঁহহরহম ঙঁঃ. ওদিকে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে সমাবেশ শেষে প্রেস কর্মচারীরা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলে তিনি তাদের ¯^াগত জানিয়ে বলেন, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃক্সখলভাবে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, হিংসাত্মক পন্থায় কোনো আন্দোলন সফল হয় না। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, নিজেদের মুক্তির জন্য বাংলার প্রতিটি গৃহকে এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ সময় ফেডারেশনের সভাপতি এম এ করিম সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতে একটি আবেদনপত্র দেন। সেখানে নেতার যে কোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও ¯^াধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।
ঘটনা ও ব্যক্তি
সালের ১ মার্চ এক আকস্মিক বেতার ভাষণে ঢাকায় ২৫ থেকে নির্ধারিত পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অীধবেশন স্থগিত করার অর্থ ছিল ১৯৭০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের (১৮ বছর এবং তদূর্ধ্ব) ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অকুণ্ঠ বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে না দেয়া, ছয়দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পথ রুদ্ধ করা। বিশ শতকের প্রথম দুটি অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে আর তৃতীয়টি পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের নিগড় থেকে মুক্তির জন্য, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির গণতান্ত্রিক রায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য। পাকিস্তানে বাঙালির অীধকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দমনের জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশে সর্বাত্মক সামরিক অীভযান ও গণহত্যা চালায়। বাঙালি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
[১০২] রফিকুল ইসলাম

অসহযোগ আন্দোলন : ক্রমপঞ্জি
১ মার্চ, ১৯৭১
মূলত ২৮ ফেব্রæয়ারি রাত পর্যন্তও সবাই ধারণা করছিল যে ১ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা পৌঁছাবেন এবং প্রেসিডেন্টের ঢাকা আসার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি সাধারণত নেয়া হয় তাও নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু ১ মার্চ দেখা যায়, যে বিমানে করে ইয়াহিয়ার ঢাকা আসার কথা সে বিমানটি ২ বার উড্ডয়নের বিলম্ব করা সত্তে¡ও শেষ পর্যন্ত করাচি থেকে বিমানটি ঢাকা এসে পৌঁছাল কিন্তু তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এলেন না। ১ মার্চ সকাল থেকেই সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। তখন (ঢাকা) স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এবং কমনওয়েলথ একাদশের মধ্যে ২য় ইনিংসের খেলা চলছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের খসড়া শাসনতন্ত্র বিলের চুড়ান্ত রূপ দিতে দলীয় কার্যালয়ে পূর্ণ বৈঠকে বসেছিল। এই কমিটি তখন পর্যন্ত পয়েলা মার্চকে চুড়ান্ত সময়সীমা ধরে কাজ প্রায় শেস করে এসেছিল। ঠিক এমন সময় খবর আস যে বেলা ১টার দিকে বেতারে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসবে।
সমস্ত কাজ বন্ধ করে সকলে অপেক্ষা করতে লাগল ঘোষণাটির জন্য। বেলা ১টা ৫ মিনিট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়অর বিবৃতি বলে ঘোষণা করা হলো যে আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণে বলেন যে বিগত কয়েক সপ্তাহ আমার

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে কিন্তু এতে রাজনৈতিক নেতারা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি। তিনি আরো বলেন যে কোনো কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল আগামী ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে রাজি হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যটি ছিল মূলত এ রকম- “পাকিস্তান আজ চরম রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন।” যে সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছার পরিবর্তে আমাদের কোন কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক মোকাবিলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষি।ট করেছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ
পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবশেনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সঠিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহŸান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অর্থাৎ তাঁর এই ঘোষণার অর্থ দাঁড়ায় যে জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন এবং এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভেটো ক্ষমতা থাকবে এবং তাদের সাথে আগাম সমঝোতা ছাড়া সংখ্যা গরিষ্ঠরা পরিষদের বৈঠক ডাকতে পারবে না। তার মানে হলো বাঙালিরা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও তাদের অক্ষম করে দেয়া হলো।
একই দিনে আর একটি ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানকে পদচ্যুত করে তার স্থলে “খ” অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. সাহেবজাদাকে নিয়োগ দেন। আহসানের এই আকস্মিক পদচ্যুতিতে এটা আরো স্পষ্ট হলো যে যেহেতু তিনি বাঙালিদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল ছিলেন ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বেশি ভালো সম্পর্ক ছিল তাই তাকে সরিয়ে দেয়া হলো।
ইয়াহিয়ার ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সমস্ত পেশার সকল শ্রেণীর মানুষ দলমত ভুলে নেমে আসে রাস্তায়। ঢঅকা স্টেডিয়ামে যে ক্রিকেট খেলা চলছিল সে ম্যাচ ভণ্ডুল হয়ে যায়, সমস্ত দর্শক খেলা দেখা বাদ দিয়ে রাস্তায় এসে মিছিলে যোগ দেয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ সমস্ত

ঘটনা ও ব্যক্তি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ক্লাস বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সমস্ত ঢাকা মুহুর্তের মধ্যে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। এ সকল মিছিল চারদিক থেকে বায়তুল মোকাররম ও জিন্নাহ এভিনিউয়ের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) দিকে আসতে থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে নির্দেশ লাভের উদ্দেশে পূর্বাণী হোটেলের দিকে যেতে থাকে। কারণ বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে যায় বেলা ৪টার আগেই। পূর্বাণী এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয় এবং “জয়বাংলা” “বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ ¯^াদীন করো”, এ ধরনের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ সকল ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় মিলিত হয় এবং সেখানে ছাত্রলীগ ডাকসু নেতারা বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অবস্থায় পল্টন ময়দানও আরেক জলসমুদ্রে পরিণত হয়।
হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি সদস্যরা বেলা তিনটার মদ্যেই এসে সমবেত হলেন। শেক মুজিবুর রহমান এলেন ৩.২০ মিনিটে। চরম উত্তেজনাকর একটা পরিস্থিতি, বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দেশী-বিদেশী সাংবাদিক। শেষে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। বিকেল ৪.৩০ মিনিটে শেক মুজিবুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য পরিষদ অীধবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করিতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। তাই বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।’ তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোার্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তিনি আরো বলেন যে ৭ মার্চের জনসভায় তিনি যে ৭ মার্চের জনসভায় তিনি আন্দোলনের পূণর্ৎাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু জনগণকে যে কোনো ত্যাগ ¯^ীকারে প্রস্তুত থাকার আহŸান জানান এবং হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহŸান জানান। তিনি তখনো পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পন্থায় শান্তি পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা চালানোর আশা ব্যক্ত করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের পূর্বে তার সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি- এটা তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন যে, তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিন্তানের জনগণকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
আহŸান জানাবেন বলেন উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করলেন। তাঁদের মধ্যে জননেতা মওলানা ভাসানী, নূরুল আমীন, আতাউর রহমান, মোজাফ্ফর আহমদ উল্লেখযোগ্য।
তিনি ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে ¯^াদীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেন। নেতার নির্দেশ পেয়ে নূরে আলিম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এই চারজন এক গোপন বৈঠক করেন এবং বিকেলে ¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এদিন থেকে শুরু হয় বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়।

২ মার্চ, ১৯৭১
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহŸানে ঢাকায় ¯^তঃস্ফ‚ত হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, কলকারখানা, অীফস-আদালত সব স্তব্ধ হয়ে যায়। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ হরতালে অংশ নিয়ে রাজধানীতৈ অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। এদিন ট্রেন ও বিমান চলাচলও বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ লাঠি ও রড হাতে রাজপথে নেমে আসে। এদিন সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কলা ভবনের বটতলায় ডাকসু ও ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ছাত্র-জনতার এক বিশাল সমাবেশ। এই সমাবেশে শিল্পী শিবনারায়ণ দাশের পরিকল্পনা ও অঙ্কনে সবুজ পটভ‚ীমকার ওপর লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলার সোনালি মান চিত্র সংবলিত ¯^াদীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উত্তোলন করেন ডাকসুর তৎকালীন সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। স্মরণকালের ইতিহাসে ঐ বৃহত্তম ছাত্র সভাতে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালনি সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ছাত্রলীগ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও পূর্বতন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ প্রমুখ। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিজ ক্ষমতাবলে প্রদেশগুলোতে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন এবং ১১০ নং সামরিক আইন বিধি জারি করে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। একই সাথে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে., .ে এস জি এম পীরজাদা ইয়াকুব খানকে এদিন গভর্নরের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণের কথা জানান। ঢাকার ফার্মগেটে সকাল ১১টার দিকে আন্দোলনরত জনতার ওপর সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জে ৯ জনের মতো বাঙালি হতাহত হয়।
ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ও আতাউর রহমানের জাতীয় লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে এদিন বিকেলে অনির্ধারিত জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত

ঘটনা ও ব্যক্তি
হয়। সমাবেশ শেষে যখন সন্ধ্যার দিকে শ্রান্ত-ক্লান্ত অভ‚ক্ত জনতা রাজপথ ছেড়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে ঠিক সে সময় আকস্মিকভাবে ভেসে আসে কারফিউ জারির ঘোষণা। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে ৩ মার্চ সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে, যা পরে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুনঃজারি করা হয়। বেতারেরমাধ্যমে কারফিউ জারির এই ঘোষণা শোনার সাথে সাথে সমস্ত এলাকার জনগণ আবার ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। কারফিউ ভঙ্গ করে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে ও মিছিল ¯েøাগানে মুখরিত করে তোলে সমগ্র ঢাকা শহর। শ্লোগানের সাথে ভেসে আসতে থাকে বুলেটের আওয়াজ। সেনাবাহিনী মিছিলকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে, যাতে অসংখ্য বাঙালি হতাহতের ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এবং তিনি সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করে শাসকচক্রের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশে আগুন জ¦ালাবেন না, তাতে আপনারাও রেহাই পাবেন না। তিনি আরো বলেন, লাঠি দিয়ে জনগণকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করবেন না। এদিন সন্দ্যায় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিনি পরবর্তী কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন-
পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। সকল সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালত, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পিআইএ, রেলওয়ে এবং অন্যঅন্য যোগাযোগমাধ্যম, পরিবহন, ব্যক্তি মালিকানা ও সরকারি মিল, ফ্যাক্টরি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট প্রভৃতি হরতালের আওতাভ‚ক্ত। আর অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি পরিবহন হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।
৩ মার্চ বাঙালিদের জন্য শোকদিবস ঘোষণা করা হয়। (এ দিনেই অীধবেশন বসার কথা ছিল)
রেডিও, টেলিভিশণ এবং সংবাদপত্র যদি বাঙালিদের সংবাদ প্রকাশে ব্যর্থ হয় তা হলে কোনো বাঙালি এগুলোতে সহযোগিতা করবেন না।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের মাদ্যমে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্দেীশত হবে।
অসহযোগ আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ এবং শৃক্সখলার সাথে এগিয়ে নিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে আগত জনতার উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। সেখানে তিনি সকলকে সতর্ক থাকার আহŸান জানান, যাতে কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাধে। তিনি আরো বলেন, এখানে বসবাসকারী বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সমান, সবাই আমাদের ভাই। এদিকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ করে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। সেখানে তারা শেখ মুজিবকে সমস্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ¯^াধীন দেশ প্রতিষ্ঠার আহŸান জানান। ঐদিন সন্ধ্যায় করাচিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দেশের সর্বশেস রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার জন্য পিপিপি বাদে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আগামী ৫ দিনের মদ্যে জাতীয় পরিষদের অীধবেশন আহŸানের দাবি জানানো হয়।

৩ মার্চ, ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং সমগ্র বাংলায় প্রথম দিনের মতো সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বেলা ২টা পর্যন্ত হরতালের আহŸান করা হলেও রাজধানীতে মূলত সারা দিনই হরতাল পালিত হয়। এদিন সকালে ২ মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল বের করা হয় এবং হরতাল চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র ববাঙালির ওপর নির্মম গুলিবর্ষণ করে। প্রদেশব্যাপী হরতালে চট্টগ্রাম অচল হয়ে যায়। ঢঅকা ছাড়া সিলেট ও রংপুরেও কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকার কারফিউ- এর মেয়াদ কমিয়ে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্ডন্ত করা হয়। ঢঅকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ মিছিল করে এদিন শহীদ মিনারে জমায়েত হন। এদিন হরতাল চলাকালে সারাদেশে সেনাবাহিনীল গুলিতে শতাধিক বাঙালি শহীদ হন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের ১২ জন নেতার সাথে আলোজচনার জন্য ১০ মাচর্ঃ এক গোলটেবিল বৈঠকের আহŸান করেন ঢঅকায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান এবং বৈবঠক আহŸানকে “ঈৎঁবষ লড়শব” বা নির্দয় তামাশা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বেতারে প্রচারিত এই আমন্ত্রণের পটভ‚ীমতে রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের পাইকারি হারে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি আরো বলেন, যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রয়েছে, কঠোর অস্ত্রের ধ্বনি আমাদের কানের কাছে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে, এ অবস্থায় একটি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো আর বন্দুকের সামনে আমন্ত্রণ

ঘটনা ও ব্যক্তি
জানানো একই কথা। যেখানে শত শত বাঙালির রক্তের দাগ এখনো রাজপথ থেকে শুকায়নি, শত শত বাঙালির লাশ এখনো দাফনের প্রতীক্ষায় এবং মত শত বুলেটবিদ্ধ বাঙালি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছে- সেই পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না।
এদিন বিকেলে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় শেক মুজিবুর রহমান আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং ¯^াধীনতার ইস্তেহার প্রচার করা হয়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের নির্দেশ দেন এবং ৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেন। তিনি তাঁর ভাষণে সর্বঅত্মক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বাংলাদেশের সরাকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদৈর প্রতি নির্দেশ দেন, পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত আপনারা অীফস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখুন। প্রচার মাধ্যমের প্রতি নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, যদি আমাদের বক্তব্য বিবৃতি, আমাদের আন্দোলনের খবর প্রকাশ ও প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় সে নির্দেশ আপনারা লক্সঘন করুন। তিনি আরো বলেন, বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য গুলি খাওয়ার জন্যঃ নয়। তিনি ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গরিব বাঙালির পয়সায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপুরুষের মতো গণহত্যার বদলে, অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আগুণ নিয়ে খেলা করবেন না। যদি করেন পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, সামরিক সরকারের মত যদি পরিবর্তিত না হয় ৭ মাচের্ৎর পূর্বে, তবে ঐ দিন অর্থাৎ ৭ মার্চ ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এবং তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সে সুযোগ আমাকে নাও দেয়া হতে পারে। তাই জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে। তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহŸান জানান সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবার এবং তিনি জনগণের প্রতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আপনারা যে যেখানে থাকুন নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করুন, আন্দোলনকে সংযত রাখুন।
এদিন থেকেই মূলত আওয়ামী লীগ প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ¯^াদীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক ছাত্রসভায় ছাত্র ইউনিয়নৈর তাৎকালীন সভাপতি নূরুল ইসলাম যুক্তফ্রন্ট গঠন করে সংগ্রাম পরিচালনার আহŸান জানান। ভুট্টোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও মতবিরোধ দেখা

মুক্তিযুদ্ধ কোষ প্রথম খণ্ড
দেয়। এদিন পাঞ্জাব পাকিস্তান ফ্রন্টের আহŸায়ক মালিক গোলাম জিলানী পিপলস পার্টির সমালোচনা করে এক বিবৃতিতে একে ‘দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেন এবং একই সাথে তিনি ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানের একক প্রতিনিধিত্ব অ¯^ীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এদিন করাচির এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান সমস্যার একমাত্র সমাধান।

৪ মার্চ, ১৯৭১
বাংলার মুক্তিকামী জনতার অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্থ দিনটি ‘পূর্ণ হরতাল, বিক্ষুবদ্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও ¯^াদীনতার পশপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের ডাকে ঢঅকাসহ সমস্ত বাংলায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হয় জাতীয় পরিষদ অীধবেশন স্থগিত ও গণহত্যার প্রতিবাদে। এদিন ঢাকার কারফিউ তুলে নেয়া হলেও খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবত থাকে। খুলনায় পাকবাহিনীর গুলিতে বহু হতাহত হয়। যশোরে পাকবাহিনীর গুলিতে মিছিলকৃত একজন শহীদ হন, তার নাম চারুবালা ধর। ৩ ও ৪ মার্চ এই দুই দিনে চট্টগ্রামে ১২০ জন বাঙালি নিহত ও ৩৩৫ জন আহন হন। ঢঅকায় ও গত দুই দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। একই সাথে ফরিদপুরে সিটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়, যা ইতিহাসে বৃহত্তর প্রতিবাদ মিছিল ছিল। মোট কথা সমস্ত বাংলার সব শ্রেণীর, পেশার জনগণ বঙ্গবনস্ধুর আহŸানে ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে ¯^াধিকার আন্দোলনে যোগ দেয়।
ঢাকাসহ সারা দেশে গায়েবানা জানাজা ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয় শহীদদের স্মরণে। আওয়ামী ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা হরতাল চলাকালে শান্তিরক্ষার জন্য শহরের রাজপথে টহল দিতে থাকেন। ঢঅকার সাথে জল-স্থল ও বিমানপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের টেলিফোনকর্মীরা পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রাঙ্কল বুক ও টেলিগ্রাম প্রেরণ থেকে বিরত থাকেন। এদিন হরতাল চলাকালে সেনাবাহিনীর প্রহরীদের তেমন টহল দিতে দেখা যায়। তবে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর ব্যঅরাকের বাঙালি জওয়ানরা রাজপথের মিছিলকারীদের সাথে একাগ্রতা প্রকাশ করেন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের মাধ্যমে। এদিন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বেতার ও টেলিভিশনের ২০ জন শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিকে ঢঅকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন শিক্ষক এক যৌথ বিবৃতিতে

তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভারের গণবিরোদী ভ‚ীমকার তীব্র সমালোচনা করেন।
‘ঃঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এদিন থেকে প্রতিদিন আরো দুবার বাংলায় স্থানীয় সংবাদ প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। এদিন অব্যাহতিপ্রাপ্ত গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসান রাতে বিমানে করে করাচি রওনা হন। যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিকদের মাদ্যােম বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানান। অন্যদিকে করাচি প্রেসক্লাসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বৈ ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন এদিন ঢঅকায় এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ ঢঅকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বৈ জাতীয় পরিষদের অীধবেশন ডাকার আহŸান জানান প্রেসিডেন্টের প্রতি। লেদ. জে. টিক্কা খানকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা সম্পর্কিত টেলিফোন সংবাদ জানার পর লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালির ¯^াধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলিম রীগ, আওয়ামলী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আমি আন্দোলন করেছি। কিন্তু ৮৯ বছরের জীবনে এবারের মতো গণজাগরণ ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ কখনো দেখিনি।’ এদিকে যে কোনো মূল্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যঃয় ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান। এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশ জারি করা হয়। ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহŸান জানান লীগপ্রধান। তিনি আরো বলেন, যেসব সরকারি কর্মচারী এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুধু বাঙলাদেশের মধ্যে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙানো যাবে। স্টেটস ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলার বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না। হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার ও সাংবাদিকের গাড়ি, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সাপ্লাই, স্থানীয় টেলিফোন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার টেলিফোন যোগাযোগ, দমকল ও আবর্জনার গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বিশ^বাসী দেখুক, বাংলাদেশের নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বুলেটের মুখেও কী দুর্দান্ত সাহস ও দৃঢ়তার সাথে নিজেদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
এদিন রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গভর্নরের বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুর কাছে কতিপয় প্রস্তাব নিয়ে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে তাঁর লোকেরা কীভাবে মারা

যাচ্ছে তার বর্ণনা দেন ও বঙ্গবন্ধুর দাবি মেনে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং আলোচনার এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে উপস্থিত হন এবং উপস্থিত হয়েই তিনি দৃঢ়কণ্ঠে রাও ফরমান আলীকে উদ্দেশ করে বলেন যে, এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়, তাছাড়া যেখানে ভুট্টো রয়েছৈ। এরপর আলোচনা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি ইবেং এই রাতেই প্রেসিডেন্ট রাও ফলমান আলী খানকে ইসলামাবাদে সাক্ষাতের নির্দেশ দেন।

৫ মার্চ, ১৯৭১
¯^াধিকারকামী জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল, গণজমায়েত ও বজ্র শপথের মধ্য দিয়ে বাঙলার জনগণের মুক্তি আন্দোলনের পঞ্চম দিন অতিবাহিত হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঢঅকার টঙ্গী শিল্প এলাকায় এদিন সকালে হরতাল পালনকালে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় ও ২৫ জন আহত হয়। এতে সমস্ত টঙ্গী এলাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা টঙ্গীর কংক্রিট ব্রিজের পাশের কাঠের ব্রিজটি আগুন দিঃেয় পুড়িয়ে দেয় ও বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদে ঢাকায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার এক বিরাট সমাবের হয় ও নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে রাজধানীতে মিছিল বের করা হয়। এদিন চটপ্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত হয় এবং গত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যোল কলেজ হাসপাতালে আরো ১০ জন আহত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এ হিসাবে চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৮ জন। খুলনা ও রাজশাহীতেও যথাক্রমে ২ জন ও ১ জন নিহত হয়।
জুমার নামাজের পর মসজিদে মসজিদে বিশেস মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায়। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ও পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা ও বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বায়তুল মোকাররম থেকে একটি লাঠি মিছিল বের করে সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে এবং বায়তুল মোকাররমে একটি মিটিং-এ অংশগ্রহণ করে সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করে। একই সাথে খিৗগাঁও ভ‚মি বন্দোবস্ত কমিটি বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে নারায়নগঞ্জে মহিলা, ছাত্র ও শিক্ষকরা মিছিল করেন। ঢাকার লেখক ও শিল্পীবৃন্দ জনহতার সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং শহীদ মিনারে ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে এক সভায় মিলিত হয়ে ¯^াধীনতার শপথ নেন। ঢাকার ৬৫১ পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এদিন সার্বিক পরিস্থিতি, গতিপ্রকৃতি ও শান্তি-শৃক্সখলা রক্ষার

জন্য কন্ট্রোলরুম খোলা হয় এবং একই সাথে প্রতিটি জেলা ও মহকুমায় আওয়ামী ঃলীগের অফিসে কন্ট্রোলরুম ব্যবস্থা চালু করা হয়।
এদিন ঃফরিদপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ¯^াধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন দুপুরে করাচি থেকে ঢাকা আসেন আসগর খান এবং রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এক সাক্ষৎকারে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে শেক মুজিবুর রহমান নিজের সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে তাঁকে যে কোনো মুহুর্তে গ্রেফতার করা হবে কিংবা সেনাবাহিনী বা তার অনুচরেরা তাঁকে হত্যা করবে এবং বিষ্ময়কর হলেও সত্য যে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঠিক সেভাবেই ঘটে যাচ্ছিল। এদিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন যে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা মানবতার বিরুদে্ধু অপরাধ ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধের আহŸান জানান। একই সাথে বঙ্গবন্ধুও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশে নির্বাচন বন্ধের জন্য আহŸান জানান।
পাকিস্তান সামরিক সরকার এদিন সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাঞ্জাবের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জে. টিক্কা খানকে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্তির আদেশ জানান। একই দিনে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক আলোচনায় মিলিত হন এবং আলোচনা শেষে পিপিপির মুখপাত্র আব্দুল হাফিজ পীরজাদা জানান, অধিবেশন স্থগিতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। এ থেকে আরো স্পষ্ট হওয়া যায় যে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে এবং রাও ফরমান আলী পিন্ডিতে এক সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে লিখৈছেন, ‘ইয়াহিয়া খানকে মদের নেশায় ক্রুদ্ধ মনে হলো।- মন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, ঢাকাতে রক্তের খেলা চলছৈ আর ইসলামাবাদে জেনারেল সাহেবরা সুরা সাকী নিয়ে ব্যস্ত। ভুট্টো, ইয়াহিয়া, জেনারেলর হামিদ তিনজনই দেশের পরিস্থিতির কথা ভুলে গিয়ে সুরায় ডুব দিয়েছৈ।’ এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্র কি উন্মত্ত খেলায়ই না মেতে উঠেছিল ১৯৭১ সালের ঐ দিনগুলোতে।

৬ মার্চ, ১৯৭১
জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকা পাঁচ দিনব্যাপী হরতালের আজ শেস দিন। পূর্ণ উদ্যমে পালিন হয় হরতাল, চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। অলি আহাদের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং মুজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাপের এই গণসমাবেশে মুজাফফর আহমদ জনগণকে মুক্তির জন্য যে কোনো

ত্যাগ ¯^ীকারে প্রস্তুত হওয়ার আহŸান জানান। এ ছাড়া ঐ দিন সাংবাদিক ইউনিয়ন, শিক্ষক সমিতি, মহিলা পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রæপ), কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দল, শ্রমিক ইউনিয়ন, গণশিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ¯^জনী ও ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের উদ্যোগে বিক্ষুব্ধ মিছিল এবং বাংলা ন্যাশনাল লীগের উদ্যোগে জনসভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে রাজধানীতে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করা হয় এবং সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক বিরাট মশাল মিছিল বের হয়। টঙ্গীতে সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাজী জাফরের সভাপতিত্বে এদিন শ্রমিক সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। এদিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে বের হয় এক বিরাট মশাল মিছিল। মহিলা আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়েঅজিত কেসন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে বাংলার বিক্ষুব্ধ নারীরা বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন এবং সমাবেশ শেষে এক জঙ্গি মিছিল বের করেন তারা। একই সাথে বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সাংবাদিক জনসমাবেশ।
‘আপসের বাণী আগুনে জ¦ালিয়ে দাও’ শীর্ষক আহŸান জানিয়ে প্রকাশিত হয় লেখক-শিল্পীদের মুখপত্র ‘প্রতিরোধ’- এর দ্বিতীয় সংখ্যা। এবং তাদের শ্লোগান ছিল- পরিষদ বৈঠক বর্জন কর, বাংলাদেশ ¯^াদীন কর। এদিকে সকাল ১১টার দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩৪১ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালানোর সময় পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। এদিন প্রায় চার লক্ষ লোকের এক বিশাল গণবাহিনী যশোরে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনী ভীত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তারা ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। এ সময় বহু পাকিস্তানি সৈন্য জনতার হাতে ধরা পড়ে ও অনেক বিহারি লূটতরাজের সময় জনরোষে নিহত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন আওয়ামী লীগকে সতর্ক করে এক ভাষণ দেন। সেখানে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় আহŸান করেন। এই সাথে লে. জে. টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিয়োগের সরকারি ঘোষণা দেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইয়াহিয়া খানের একটা ভাঁওতাবাজি। তার মুল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেন্য আমদানির জন্য প্রয়োজনয়ি কিছু সময় বৃদ্ধি করা। যার প্রমাণ আমরা পরবর্তী দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দেখতে পাই। রাওয়ালপিন্ডিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিককার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের এই ভাষণকে ¯^াগত জানায়। ইয়াহিয়া খানের এই বেতার ভাষণের পরপরই ঢঅকা ও নারায়ণগঞ্জে ¯^তঃস্ফ‚ুর্তভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। প্রেসিডেন্টের এই ভাষণের অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আওয়ামী লীগৈর কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশ শাখার ওয়ার্কিং

কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক ঘন্টার রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশৈস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলেঅচনা হয়। এদিন লাহোরে বিকেলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাম প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৬ জনকে একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আহুত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি জানান। এদিন সঠিক পরিস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান দলীয় হাইকমান্ড এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওদিকে পল্টন ময়দানে জাতীয় লীগের জনসভায় আতাউর রহমান খান হত্যঅ ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য সামরিক সরকারের প্রতি আহŸান জানান। একই সাথে তিনি জনগণকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহŸান জানান।

৭ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের এই দিনটি বাংলার ইতিহাসে বিশেস স্মরণীয় দিন। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দান, যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। এদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলনের আহŸান জানায়। একই সাথে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমš^য় কমিটি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ¯^াধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহŸান জানায়। ন্যাপ (মুজাফফর) আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে ১৭ দফা গোষণা করেন ও এর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আহŸান জানান। এদিন সরকারি প্রেসনোটে গত ৬ দিনে ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহতের কথা ¯^ীকার করা হয়। তার পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ মিথ্যাচার বলে বাতিল করে দেন। তিনি দাবি করেন যে নিহত ও আহতের সংখ্যা কমিয়ে বলা হয়েছে।
ঢাকার সমস্ত রাজপথ এদিন রেসকোর্সে গিয়ে মেশে। বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে মুক্তির বানী শোনার জন্য সকাল থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে মানুষ দলে দলে হেঁটে, বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হতে থাকে। সমস্ত পেশার, সকল বর্ণের, সকল বয়সের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, বুকে ¯^াধীনতার ¯^প্ন ও কণ্ঠে বিভিন্ন শ্লোগান নিয়ে সমবেত হয় রেসকোর্স ময়দানে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে “জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু” “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ” “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা” “তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব” “ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ ¯^াধীন করো” “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ ¯^াধীন করো”

“হুলিয়ার ঘোষণা, মানি না মানি না” এ ধরনের বিভিন্ন তেজদীপ্ত শ্লোগান। রুদ্ধদ্বার কক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ¯^াধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলোচনার কারণে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় আসতে একটু দেরি হয়। বেলঅ সোয়া তিনটায় তিনি সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাাবি আর তাঁর বৈশিষ্ট্যসূচক কালো কোট পরিহিত অবস্থায় তিনি সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন দশ লক্ষাধিক মুক্তিপাগল বীর বাঙালির উপস্থিতিতে আয়েঅজিত, জনসভায়। চারদিকে উড়ছে সোনার বাংলার মানচিত্রখচিত লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা, সাথে মুহুর্মুহু শ্লোগানের মধ্য দিয়ে শুরু করেন তাঁর ভাষণ। তিনি তাঁর ভাষণে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম ¯^াধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে তিনি ২৫ মার্চের অধিবেশনে যোগ দিতে চারটি শর্তের উল্লেখ করেন। শর্তসমূহ হচ্ছে-
ক. অনতিবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা
খ. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া
গ. সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা
ঘ. সঃংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা
এছাড়া তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে পরবর্তী সপ্তাহের জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে প্রচার করার দাবির প্রেক্ষিতে ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষ পূর্বে তা প্রচার করার সিদ্ধান্ত বেতার মারফত ঘোষণা করলেও শেস মুহুর্তে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় সামরিক বাহিনীর নির্দেশে। ঢঅকা বেতারের কর্মীরা এর প্রতিবাদ¯^রূপ বেতার থেকে বের হয়ে এসে জনসভায় যোগদান করেন। এতে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে যায়য়। ফলে গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। যার ফলৈ পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা কেবতারের কেন্দ্র পুনরায় চালু হয়।
এদিন লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারণ করে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয। তাকে অবশ্য গভর্নর হিসেবেও নিয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু কোনো বিচারপতি তাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি না হওয়ায় তাকে কেবল সামরিক শাসনকর্তা হিসেবেই কাজ করতে হয়। যখন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলছিল ঠিক সেই মুহুর্তে লে. জে. টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী ঢাকা পৌঁছেন এবং টিক্কা খান সামরিক শাসক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডোর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই ঢঅকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা

হস্তান্তরের উদাত্ত আহŸান জানান। তিনি আরো বলেন, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান আজ যে শর্ত দিয়েছৈন তা ন্যায়সঙ্গত, উপযুক্ত, সুষ্ঠু ও বৈধ।
৬ মাচর্ঃ প্রচারিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন। যেখানে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস। গত কয় দিনের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদের বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলি মেনে চলছে। প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদসহ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। তিনি বাংলার সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে বলেন, আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনসাধারণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছৈ। সুপরিকল্পিতভাবে তারা কারফিউ ভঙ্গ ও বুলেটের মোকাবেলা করেছেন এ জন্য আমি জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ ¯ে^চ্ছাসেবকদের অভিনন্দন জানাই। তিনি আরো বলেন, আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে। সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হলো, অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকবে।

৮ মার্চ, ১৯৭১
সকাল সাড়ে আটটার সময় ঢাকাসহ সকল বেতার কেন্দ্র থেকে একযোগে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ফলে বেতারের প্রতিবাদী বাঙালি কর্মীরা আবার কাজে যোগদান করেন। ৭ মিার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ‘¯^াধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার প্রেক্ষিতে এদিন সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর আহŸানে মহল্লায়-মহল্লায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষৈ কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এমনকি সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং প্রাইভেট মোটগাড়িতেও কালো পতাকা লাগানো হয়। প্রতিটি মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যঅপারে মহল্লাবাসীর মধ্যে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে সাধারণ মানুষ সকলের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে।
৭ মার্চ সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখকৃত ১২৭ জন নিহত ও ৩৫৮ জনের আহত হওয়ার খবরের প্রতিবাদে এই দিন আওয়ামীল লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি এটাকে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেন। কারণ প্রকৃত নিহত ও আহতের সংখ্যা এর অনেক বেশি ছিল।

তিনি আরো বলেন, আজ বাংলার মানুষ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ। ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির এ ধরনের অপচেষ্টা সফল হবে না। সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছৈ বলা হলেও এখনো বিভিন্ন এলাকায় তাদের দেখা যাচ্ছে। তিনি সমস্ত সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার পুনৎদাবি জানান। এদিকে পিডিপি সভাপতি নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের সাথে পরামর্শক্রমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান। একই সাথে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর এক বিবৃতিতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের বঙ্গবন্ধুর দাবির প্রতি সমর্থন জানান ও সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের দায়ী করেন। এদিন আরো অনেকে বাঙালির দাবির পক্ষে মত দিয়ে বিবৃতি দেন। তাদের মদ্যে জাতীয় লীগ প্রধান াতাউর রহমান খান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আজ জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। চরম লক্ষ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে।
ব্রিটিশ ও পশ্চিম জার্মঅনির ১৭৮ জন নাগরিক এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। জেনারেল টিক্কা খানকে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব এদিন দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের একটি সভা এদিন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৪২, বলাকা ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। জেলা শহর থেকে শুরু করে একদম তৃণমূল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সকল শাখার সভাপতিকে আহŸায়ক ও সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং ৯ জন সদস্য অর্থাৎ মোট ১১ জনকে নিয়ে এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়। ছাত্রলীগ প্রদেশের সকল প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানি সংগীত বাজানো এবং উর্দু বই প্রদর্শন বন্ধ রাখা ও সিনেমা কর প্রদান না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদিন বেনামি একটি লিফলেট ছড়ানো হয় যেখানে গেরিলা যুদ্ধে নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ ছিল।
এদিন গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) এম আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ওদিকে বেতার ও টিভি শিল্পীদের একটি প্রতিনিধিদলও বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তাঁর বর্তমান মুক্তি আন্দোলনের অনুকুলে অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্দেশ্যে আগামী ১০ মার্চ থেকে বেতার ও টেলিভিশনে তাঁদের যোগদানের সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। এদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে আরো সাক্ষাৎ করেন সরকারি, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত

সংস্থারকর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নৈর প্রতিনিধিরা। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক অফিসের কাজ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধুর আহŸানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য তাঁদের একদিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন। এদিকে জেনারেল ইয়অহিয়া খান ব্রিগেডিয়ার জিলানীর মাধ্যমে প্রেরিত এক লিীখত বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানকে জানান, ‘আপনি যা দাবি করেছেন, তার চাইতে বেশি কিছু দিতেও আমার আপত্তি নেই।’ আমি অচিরেই ঢাকা আসছি। তিনি অবশ্য অচিরেই ঢাকা এসেছিলেন ও অনেক বেশি কিছু দিয়েছিলেন বাঙালিদের, যার প্রমাণ আমরা পাব ২৫ মার্চ রাত থেকে।

৯ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলন যথারীতি চলতে থাকে। এদিন সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যঅন্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গত ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ৈল বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘¯^াদীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’- এ ছাত্র জনসভার গৃহীত ‘¯^াধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। অপর এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের ¯^াধীনতা আন্দোলনের জন্য ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এদিন ¯^াধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যঅহত রাখার আহŸান জানায়।
দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এদিন অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, ‘নির্বঅচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সংকট মুক্তির একমাত্র পথ।’ এদিন আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ প্রধান মওঃলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মধ্যে সর্বশেস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টার এক বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয়সহ সারা দেশে সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তবে যে সকল সরকারি অফিস খুলে রাখার নির্দেশ দিয়েীছলেন বঙ্গবন্ধু সেগুলো খোলা থাকে। বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন এদিন চলাচল করে। দোকান পাট ও হাটবাজার খোলা থাকে। লঞ্চ ও ট্রেন ¯^াভাবিকভাবে চলাচল করে তবে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে এবং আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারবর্গের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের

সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
বিকেলে পল্টন ময়দানে ¯^াধীন বাংলা সমš^য় কমিটি আয়েঅজিত এক বিশাল জনসমাবেশে নব্যাপ প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, শেক মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোনো কিছু না করা হলে আমি শেক মুজিবুর রহমানের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করব। তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে শেক মুজিবুর রহমান আপস করতে পারে। খামোখা, কেউ মুজিবকে অবিশ^াস করবেন না। শেক মুজিবকে আমি খুব ভালো করে চিনি। তাঁকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েীছ। আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি। তাঁদের মধ্যে শেক মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি। তিনি ইয়অহিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ¯^াধীন হবে। পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে না। অখণ্ড রাখবও না। তিনি আরো বলেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভালো চাও তাহলে কালই বাংলার ¯^াধীনতা ¯^ীকার করে নাও। একই মঞ্চে বাংলা জাুতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আপনি ¯^াধীন বাংলার জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন।
এদিন জাতিসংঘৈর মহাসচিব উ থান্ট প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘৈর স্টাফ ও তাঁদের পরিবারবর্গকে প্রত্যাহারের জন্য ঢাকাস্থ জাতিসংঘৈর উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেন। একই সাথে জাপানের পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে অবস্থিত তার দেশের নাগরিকদেরও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং পশ্চিম জার্মান সরকার তার দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামরিক বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ রাত ৯টা থেকে রাজশাহী শহরে ৮ ঘন্টার জনৎ্য কারফিউ জারি করে। এদিন গভীর রাতে ইসলামাবাদে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে “খ” অঞ্চলের (বাংলাদেশ) সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ ৭ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক মিানে ঢাকা আসেন। ৬ মার্চ তাকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। আজ অর্থাৎ ৯ মার্চ তার গভর্নর হিসেবে কার্যভার গ্রহণের কথা চিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে কোনো বিচারপতি নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেতে অ¯^ীকৃতি জানান। ফলে সরকার তাকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে। এদিকে ইসলামাবাদে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে আগামী কয়েক দিনের মদ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে আসবেন।
আন্দোলনের গতি ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মানুষের বাসগৃহে ওড়ানো হয় ¯^াধীন বাংলাদেশের পতাকা। এবং সরকারি ও আধাসরকারি অফিস,

ভবন ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। এদিন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অসহযোগ আন্দোলন ত্যাগ করে গেরিলা যুদ্ধে মাধ্যমে দেশ ¯^াধীন করার আহŸান জানায়।

১০ মার্চ, ১৯৭১
আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদিন সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায। জেল থেকে পালাবার সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুযুদ্ধে ২৭ জন আহত হয়। অন্যদিকে সকালেই বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান তাঁর নিজ বাসভবনের একদল বিদেশী সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকার বৈঠকে মিলিত হন। এসময় তিনি বলেন, সাত কোটি বাঙালি আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যে কোনো মূল্যৈ তারা এই অধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালিরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা এই রক্ত দেয়ার পালা শেস করতে চাই। তিনি বলেন, তেইশ বছর ধরে শোষক ও শাসক শ্রেণী বাংলাদেশকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আজ বাঙালিরা এসব শোষণ ও শাসনের অবসান চাই। সাত কোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়।
এদিন সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। পরে ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ¯^াক্ষরিত ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী সরকারের সাথে সহযোগিতা না করার আবেদন জানানো হয়। এই বিবৃতিতে আরো বলঅ হয় যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন ¯^াধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক এদিনও সারা দেশের সরকারি ও আধাসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। প্রত্যেক সরকারি ও বেসরকারি ভবন, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানএমনকি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, থানা ও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও কালো পতাকা ওড়ানো হয়। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহনে, পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর গাড়িতেও কালো পতাকা লাগিয়ে রাজপথে চলতে দেখা যায়।
নিউইয়র্কে বাঙালি ছাত্ররা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে দেশে সামরিক সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ¯^রূপ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও জাতিসংঘ মহাসচিবকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাঁদের পরিবারবর্গের প্রত্যাহারের যে নির্দেশ জাতিসংঘ মহাসচিব দিয়েছিলেন তার প্রেক্ষিতে বলেন, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশীদের জীবন ও সম্পদ কতটা বিপন্ন করে তুলেছে তার প্রশান মেলে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই নির্দেশে। তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুধাবন করা উচিত কেবল জাতিসংঘের কর্মীদের অপসারণ করলেই এ ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ যে হুমকি আজ উদ্যত তা গণহত্যার হুমকি। এবং সে হুমকি বাংলার সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদে ¯^াক্ষরিত মৌলিক মানবাধিকার অ¯^ীকৃতিরই নামান্তর। এদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ইকে বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন চক্র প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোবৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুুেদ্ধ গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তাদের সমরসজ্জা অব্যাহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিনিয়ত সামরিক বাহিনীর লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে।
এদিন ঢাকাতে অীভনেতা গোলাম মোস্তফা ও সুরশিল্পী খান আতার নেতৃত্বে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’- এর ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সিভিল সার্ভিসের ২য় শ্রেণীর কর্মচারীরাও এদিন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এদিন বিকেলে ওয়ালীপন্থী ন্যাপারে উদ্যোগে শোষণমুক্ত এলাকায় এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। আবার ‘লেখক শিল্পী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’- এর ব্যঅনারে লেখক ও শিল্পীরা ঢাকায় বিক্ষোব মিছিল বের করে। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রæপ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ এদিন ১১৪ নং সামরিক বিধি ঘোষণা করে।
‘আর দেরি নয়’ এই শিরোনামে এদিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহŸান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। অন্যদিকে ‘দি পিপল’ পত্রিকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমালোচনা করে বলা হয় ‘বাঙালির রক্তপাতের জন্য ভুট্টো দায়ী’। এদিন লাহোরে সাবেক পিডিএম প্রধান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের আহŸানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের জন্য যে পূর্বশর্ত দিয়েছেন তার নীতিগতভাবে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
১১ মার্চ, ১৯৭১
সমস্ত বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের চরম অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এদিনও সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি ভবন, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ ও যানবাহনে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। সমস্ত দেশে বেসরকারি ভবন ও বাসগৃহের শীর্ষৈ ¯^াধীন বিাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। ¯^াধীন বাংলার দাবিতে অবিচল

সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী আজও সরকারের সাথে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যঅহত রাখে। হাইকোর্টের বিচারপতি ও সচিবালয়ের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারী অফিস বর্জন অব্যাহত রাখে। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্টেট ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক ও সরকারি ট্রেজারিতে ¯^াভাবিক লেনদেন হয়। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে এদিন ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ ¯^াভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরীর বিপণি বিতানগুলো খোলা থাকে। এদিন অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ছাড়া সড়ক, রেল ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকে। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা যায়। এদিন প্রেক্ষাগৃহগুলোতে বাঙলা ছায়াছবি দেখানো হয়। নারায়ণগঞ্জের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে সিনেমা শুরুর আগে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়। এই দিনে সিএসপি ও ইপিসিএম সমিতির পদস্থ বাঙালি সরকারি কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁদের একদিনের বেতন আওয়ামী লীগের তহবিলে প্রদান করেন। ওদিকে বরিশাল ও কুমিল্লায় জেলখানা ভেঙে কয়েদিরা পালিয়ৈ যায়। এ সময় কয়েদি ও কারারক্ষীদের মদ্যে সংঘর্ষে শতাধিক কয়েদি ও কারারক্ষী আহত হয়। পালাবার সময় বরিশোলে ২ জন ও কুমিল্লায় ৩ জন কয়েদি কারারক্ষীর গুলিতে নিহত হয়।
¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এদিন দুটি বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তারা গত ১০ মার্চ ভোরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নং জেটিতে এম এন সোয়াত নামে একটি অস্ত্রবাহী জাহাজ নোঙরের কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা আরো বলেন, বন্দর শ্রমিকরা সেই জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে রাজি না হওয়ায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা তা খালাসের ব্যবস্থা করা হয় এবং সেই সমস্ত অস্ত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুতকৃত রেল ওয়াগনে ওঠানো হয়। আরো পাঁচটি অস্ত্র ও সৈন্য বাহিনী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা হবে বলে তারা উল্লেখ করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে বাংলার জনগণের জন্য সামনে আরো কত ভয়াবহতা অপেক্ষা করছ্ েছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের জন্য বাংলার জনগণের প্রতি আহŸান জানান। ওদিকে ৩২ হাজার টন গম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে পাঠানো হয় ‘ভিনটেক হরাইজন’ নামক একটি জাহাজে। কিন্তু এদিন এই জাহাজটির গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরের দিকে পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়।
ঢাকাস্থ জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি মি. উলফ এদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মি. উলফ বলেন যে বর্তমান পরিস্থিতি এমন নয় যে, কর্মচারীদের অন্যত্র অপসারণ করতে হবে। মওলানা ভাসানী এদিন টাঙ্গাইলে

বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল ময়দানে আয়েঅজিত এক জনসভায় জনগণকে শেক মুজিবের নেতৃত্বে সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহŸান জানান।
ছাত্রলীগ প্রদেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয় এবং কেন্দ্রের যে কোনো নির্দেশ সমগ্র প্রদেশে পালিত হতে থাকে। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এদিন ‘¯^াধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহŸান জানায়। অন্যদিকে ন্যাপ (মুজাফফর) বায়তুল মোকাররমে জনসভা করে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ক্লাবে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এদিন এক সাধারণ সভার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বিশ^বাসীর সমর্থন কামনা করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আন্দোলনের গতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখার জন্য কতকগুলো নির্দেশ ঘোষণা করেন।

১২ মার্চ, ১৯৭১
বিগত দিনের মতো এদিনও সারা দেশে ¯^তঃস্ফ‚র্তভাবে অসহযোগ আন্দোলন ও ¯^াধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন অব্যঅহত থাকে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সমাবেশ ও শোভাযাত্রা অব্যাহত থাকে দেশব্যাপী। এদিন বগুড়া জেলখানা ভেঙে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। পালানোর সময় কারারক্ষীদের গুলিতে ১ জন কয়েদি নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। সরকারি, আধাসরকারি ও ¯^ায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কোকাপেপ) এদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এদিন থেকে সারা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা সকল প্রেক্ষাগৃহে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের লেখক, চটুয়া এবং শিল্পীরা এদিন মিছিল করেন এবং আন্দোলন কর্মসূীচতে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এদিন চট্টগ্রামে অধ্যাপক আবুল ফজলের নেতৃত্বে শিল্পীসমাজ সরকারের অনুগত হয়ে জনগণের বিরোধী ভ‚মিকার জন্য চ্টগ্রাম বেতারের নিন্দা জানায়।
তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে এক বিবৃতি দেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এদিন ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয। এদিন পূর্ব রেলওয়ে কর্মচারী এবং চারু ও কারুশিল্পীরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সংসদের এক জরুরি সভায় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় ও ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মওলানা ভাসানী এদিন ময়মনসিংহে এক জনসভায় পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বাঙালিদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না। অন্যদিকে লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গণ ঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ভাগ্যের নির্মম

পরিহাস, দোষ করা হলো লাহোরে কিন্তু বুলেট বর্ষিত হলো ঢাকায়। তিনি আরো বলেন, পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণ সমান অধিকার নিয়ে থাকতে চায়, পশ্চিমাঞ্চলের দাস হিসেবে নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রথম ফ্লাইটে ঢঅকা যাবার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেল নেতা শেক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসুন। লাহোরে ন্যাপের মহাসচিব সি আর আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের বর্তমান সংকটের জন্য একচেটিয়া পুঁজিপতি ও আমলাই দায়ী। জনাব ভুট্টোও এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, শেক মুজিবুর রহমানের চার দফাকে কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই বিরোধিতা করতে পারে না। প্রেসিডেন্টের অবিলম্বে শেক মুজিবের দেয়া চার দফা দাবি মেনে নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেণ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহী মিনারে সমাবেশ করে। ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক এদিন ঢাকার মগবাজার মোড়ে প্রতিবাদ সভা করে। এদিন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটে তা হচ্ছে জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহিরুদ্দিন তাঁর পাকিস্তানি খেতাব বর্জন করেন। এদিন লাহোরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকসহ ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায়। এদিকে রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রের খ্যাতনামা বাংলা খবর পাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গাবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে এদিন রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন। আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে খাদ্যবোঝাই চট্টগ্রাম মুখী মার্কিন জাহাজের গতি পরিবর্তন করে করাচি প্রেরণের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানে মুদ্রা পাচারের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ এদিন স্থানীয় কয়েকটি ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এবং ¯^াধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীল ব্যবহারের জন্য কোনো জ¦ালানি সরবরাহ না করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীদের নির্দেশ দেন।

১৩ মার্চ, ১৯৭১
সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং সামরিক আইন জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল দশটার মধ্যে প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেন। এই সামরিক নির্দেশে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। এবং নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। তবে এই সামরিক নির্দেশ জারির সাথে সাথেই শেক মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি প্রদান করেন। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, সামরিক সরকারের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে তারা কিছুতেই

নতি ¯^ীকার করবে না। তিনি যে কোনো হুমকির মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি সামরিক কর্তৃপযেক্ষর প্রতি উস্কানিমূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার আহŸান জানিয়ে বলেন, জনগণকে যত ভয় দেখানো হোক না কেন, তারা তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তির বিরুদ্ধে কোনো কিছুরই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ক্ষমতা নেই।
এদিনও সারা দেশে সার্থকভাবে পালিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। াবাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে গড়ে উঠেছে সংগ্রাম কমিটি। সকল দেয়ানি ফৌজদারি আদালতসহ সমস্ত সরকারি ও আধাসরকারি অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। একই সাথে এদিনও বাংলার প্রতিটি বাড়িতে, ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। এদিনও ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও এদের পরিবারবগর্ৎসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেস বিমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। ¯^াধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্যে জনসাধারণের প্রতি আহŸান জানান।
মওলানা ভাসানী ভৈরবে এক জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ¯^াধীন। শ্লোগানের প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরো বলেন, কীভাবে মুক্তিসংগ্রামে বুকের রক্ত দিতে হয় তা পূর্ববাংলার মানুষ জানে। বিদেশী বস্ত্র, মদ ও গাঁজা ত্যাগ করার জন্যও তিনি অনুরোধ জানান জনগণকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর আজম খান এদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেন। একই সাথে ন্যঅপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান এদিন শেক মুজিবের দাবির সঙ্গে একমত পোষন করেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলনের সমর্থনে এদিন সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে এক বিশাল মশাল মিছিল বের করে। একই সাথে বাংলা একাডেমী ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকে সমর্থন করে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এদিন থেকে।
লাহোরে এক বৈঠকে এদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সংসদীয় দলগুলো এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৪ দফা সমর্থন করে এবং ২৫ মার্চের আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে কেন্দ্র ও এদেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের আহŸান জানায়। এদিন জমিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলামের নেতা মওলানা মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে কাউন্সিৎল লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা এবং সরদার শওকত হায়াত খান, জমিয়াতুল উলেমা-ই-পাকিস্তানের মওলানা শাহ আহমদ নূরানিসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এদিন সাাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে লেটার অব অথরিটির মাধ্যমে ক্ষমতা

হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহŸান জানান। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব কটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনা কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং বিগত এক মাসে বাংলাদেশে যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যঅহারের দাবি জানান।

১৪ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির শেস দিন ছিল এদিন। এবং আওয়ামী লেিগর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ৩৫টি নির্দেশ ঘোষণা করেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১৫ মার্চ থেকে এগুলো পালনের জন্য জনগণের প্রতি তিনি আহŸান জানান। বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান এদিন রাতে এক বিবৃতির মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন অব্যঅহত রাখার আহŸান জানিয়ে জনগণের উদ্দেশে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, যারা নগ্ন বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল জনগণ চুড়ান্তভাবে তাদের র্পুদস্ত করেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারী, কৃষক ছাত্রজনতা অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিয়েছৈন যে, আত্মসমর্পন নয়, তারা আত্মত্যাগের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বেসামরিক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার অনুরোধ আপনারা কোনো হুমকির মুখে মাথা নত করবেন না। অসহযোগ চালিয়ে যান। তিনি জারিকৃত ১১৫ নং সামরিক বিধি সম্পর্কে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভ‚ত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা আমাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের ¯^াধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে ¯^াধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার সাথে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই।
এদিন আবার বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামক আরেকটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। একই সাথে ‘ওসান এডুরাস’ নামের আরেকটি সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ চ্টগ্রাম বন্দরের ১০ নং জেটিতে নোঙর করা হয়। এদিকে প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পাটির্৩র নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এদিন এক বিবৃতিতে গত ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিনটেজ হরাইজন’- এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানান।
বরিশালে এক জনসভায় আজ বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের প্রতি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের

আহŸান জানান।
এদিন বিকেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ক্যঅন্টিনে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের আঞ্চলিক শাখাসমূহের কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সন্ধ্যায় ঢাকার লালবাগের বালুরমাঠে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আরেকটি জনসভা হয়। এছাড়া ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে টিভি নাট্যশিল্পীদৈর এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি একাগ্রতা প্রকাশ করা হয়। অন্যাদিকে বাংলা একাডেমীতে লেখ সংগ্রাম শিবিরের উদ্যোগে একটি লেখ সমাবেশ শেষে শোভাযাত্রা বের করা হয়। বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে এদিন ছাত্র ইউনিয়নৈর (মতিয়া গ্রæপ) নেতৃত্বে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এদিন সন্ধ্যায় পল্টন ময়দানে কথাশিল্পী সম্প্রদায় কবিতা পাঠ ও গণসঙ্গীতের আসর বসায়।
এদিন ঝিনাইদহের কয়েকজন সিএসপি ও পিএসপি কর্মকর্তা শপথ নেন যে, প্রয়োজনে দেশের জন্য তাঁরা অস্ত্র ধারণ করবেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জনাব তৌফিক এলাহী শাহ মো. ফরিদ, কামাল সিদ্দিকী, মাহবুবুর রহমান (এসডিপি ও ) ও অন্য অনেকে। এবং তাঁরা সকলেই ছিলেন মহকুমা প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত। পরবর্তীতে এঁরা সকলেই ¯^াধীনতা যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। ¯^াধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম কেন্দ্রীয় পরিষদ এদিন ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের জন্য। এদিন জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ প্রতিটি শ্রমিক এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ ও ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে ট্রেনিং প্রদানের নির্দেশ দেন।
ঢাকার সংবাদপত্রগুলো এদিন যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘আর সময় নেই ./ Time is Running Out. ওদিকে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে সমাবেশ শেষে প্রেস কর্মচারীরা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলে তিনি তাদের ¯^াগত জানিয়ে বলেন, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃক্সখলভাবে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, হিংসাত্মক পন্থায় কোনো আন্দোলন সফল হয় না। তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, নিজেদের মুক্তির জন্য বাংলার প্রতিটি গৃহকে এক একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ সময় ফেডারেশনের সভাপতি এম এ করিম সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতে একটি আবেদনপত্র দেন। সেখানে নেতার যে কোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও ¯^াধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।

১৫ মার্চ, ১৯৭১
এদিনটি ছিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের চতুর্দশ দিন। এদিনও অফিস-আদালতে পূর্ণ কর্মবিরতি পালন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি ভবনের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকাও উত্তোলন করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ দেশরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের আজ কাজে যোগদানের নির্দেশ দিলেও তারা কর্মস্থলে যোগ দেয়নি। এদিন সকালে বেসামরিক কর্মচারীরা নাখালপাড়ায় একটা সভা করে। এ সভা শেষে তারা রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করেন। একই সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎকরা সমাবেশ শেষে নগরীতে শোভাযাত্রা বের করেন। এদিকে বিকেলে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ও সভাপতিত্বে ঢাকার তোপখানা রোডে মহিলাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বেতার ও টিভি শিল্পীবৃন্দ দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। এবং উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর শিল্পীরা ভ্রাম্যমাণ ট্রাকযোগে গান-সঙ্গীত-পথনাটক পরিবেশন করেন নগরীর বিভিন্ন স্থানে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কঠোর সামরিক প্রহরায় এদিন ঢাকা আসেন, তার সাথে আসেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল খোদাদেদ খান, জেনারেল মির্জা খান, জেনারেল পিরজাদা, জেনারেল ওমর, এম এম আহমেদ, জি ডব্লিউ চৌধুরী প্রমুখ। অর্থাৎ সামরিক চক্রের মূল কর্মকতারা সবাই আসেন। এদিকে নয়া সামরিক বিধি জারির প্রতিবাদে বিকেলে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ছাত্রদের এক জনসভা হয়। এই সভা শেষে ছাত্ররা রাজধানীতে জঙ্গি মিছিল বের করে। এতে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই জনসভায় কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয় বাংলাদেশে কেবল বাংলার সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নির্দেশ জারি করতে পারেন। বাংলাদেশের জনসাধারন একমাত্র তাঁর নির্দশই মানবে, অন্য কারোর নয়। এই প্রস্তাবে অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহবান জানানো হয়।
বাংলাদেশের জনগন আজ বংগবন্ধুর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ- একথা বলেন বাংলা জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান। খুলনার শহীদ হাদিস পার্কের এই জনসভায় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং জাতীয় সরকার গঠনের আহবান জানান। প্রবীন রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম এদিন বলেন, জনাব ভুট্টো পাকিস্তানের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী অন্যথায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। কিন্তু জাতীয় পরিষদে তার স্থান বিরোধী দলের আসনে। অন্যদিকে ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান বলেন, ভুট্টো সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অস্তিত্ব নেই। এদিকে পি আইস বোয়িং এবং পাক বাহিনীর সি ১৩০ বিমানগুলো নিয়মতভাবে সাজসরঞ্জামসহ পাক্সেনাদের ঢাকায় বয়ে আনতে থাকে। ঢাকা বিমানবন্দরটিকে মেশিনগান ও বিমান বিধ্বংসী কামানে সজ্জিত করা হয়। ফলে বিমান বন্দরটি মূলত নিয়মিত বিমান যুদ্ধঘাঁটিতে পরিণত হয়।
এদিন রাতে ঢাকায় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ এক বিবৃতির মাধ্যমে গতদিনের বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের নতুন নির্দেশাবলী সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার আহবান জানিয়েছেন তাতে জনসাধারনের মাঝে নিরঙ্কুশ সাড়া পাওয়া গেছে। জনগনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এদিন বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবেনা। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রয়োজনে মরতে প্রস্তুত, তাই আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবেনা।
১৬ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের ষোলতম দিন আজ। এই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সভা-সমিতি আর শ্লোগানে গ্রাম বাংলা মুখরিত। এদিন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিসেস ফেডারেশন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ব্রতিচারী আন্দোলন, স্টেট ব্যাংক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ, দেশরক্ষা খাতে বেতনভুক্ত বেসামরিক কর্মচারীদের সভা, ঢাকা জেলা সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড, নোয়াখালী এসোসিয়েশন, চামড়া ব্যাবসায়ী সমিতি, তাঁতশিল্প উন্নয়ন সমিতি, মগবাজার সংগ্রাম পরিষদ ও দেশ বিভাগে নিযুক্ত বেসরকারি কর্মচারী সমিতি স্বত:স্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি-আধাসরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন কেবল সেসব ছাড়া সারা বাংলায় অন্য সব অফিস আদালত ও প্রতিষ্ঠানে কর্মচারিদের অসহযোগিতা অব্যাহত থাকে এবং রাজধানী ঢাকায় একমাত্র প্রেসিডেন্ট ভবন ছাড়া সর্বত্র কাল পতাকা ওড়ে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার আলোচনা এদিন সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে শুরু হয় এবং দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে। সকাল পৌনে এগারোটায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হবার সময় সমবেত বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘মহান জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ – এ ধরনের শ্লোগান দিয়ে বিদায় শুভেচ্ছা জানায়। বঙ্গবন্ধু কালো পতাকা শোভিত একটি মাজদা গাড়িতে প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা এবং আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক নৌকা উৎকীর্ণ ছিলো। এ সময় পুলিশের গাড়িগুলোতেও কালো পতাকা উড্ডীন ছিল। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি সদর দরজা পেরিয়ে কালো পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের বারান্দায় এসে পৌঁছালে প্রেসিডেন্ট এসে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে মূল আলোচনা কক্ষে নিয়ে যান।বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রধান ফটকে পৌঁছালে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও আলোকচিত্র শিল্পীরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট এর সাথে আলোচনা করেছি।আরো আলোচনা হবে। এটি দু-এক মিনিটের ব্যাপার নয়। এ জন্য সময়ের দরকার। আলোচনা চলবে।কাল সকালে আমরা আবার বসছি।এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।
দেশব্যাপী গণজাগরণ অব্যাহত থাকে। জয়দেবপুরে জনতার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, ড. জোহা হল, মুন্নুজান হল,যশোর, রংপুর সেনানিবাস এলাকা,খুলনা,চট্টগ্রাম, ঢাকা পিলখানা, ফার্মগেইট,রামপুরা ও কচুক্ষেত এলাকার সামরিক বাহিনী অসহযোগ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। এদিন ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবীরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আইনগত কোন বাধা নেই।চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশীর এবং জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে শিল্পী সমাজ ঢাকায় মিছিল বের করে। কবি আহসান হাবিব এদিন সরকার প্রদত্ত ‘সিতারা-ই-খিদমত’ খেতাব এবং জয়নুল আবেদিন তার ‘তমঘা’ পরিত্যাগ করেন। এদিন ঢাকার সেগুনবাগিচায় মহিলা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীতে ভর্তি,শরীর চর্চা এবং কুচকাওয়াজ মহড়া দেয়া হয়। এএফসি সংবাদ সংস্থার খবর মারফত জানা যায় ভারত সরকার তাদের আকাশসীমার উপর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানগামী সকল বিদেশী বিমানের উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আরো জানা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য নেয়া বন্ধ করার জন্য এই ঘোষণা দেয়া হয়।
১৭ মার্চ, ১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২তম জন্মদিন আজ। এদিন ভোত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মিছিল করে বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। একজন বিদেশী সাংবাদিক তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জানতে চান, আজ ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় কামনা কি? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের মুক্তি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি। আমার জনগণের জন্যই আমার জীবনমৃত্যু। সকাল ১০ টায় শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। এদিন মাত্র আড়াই ঘন্টা বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে অপেক্ষারত দেশী বিদেশী সংবাদদাতাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্তভাবে বলেন যে, আলোচনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এরপর তিনি বলেন, এর বেশি কিছু আপাতত বলার নেই। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছি। তিনি আরো বলেন, আমি যখন আলোচনা করি অবশ্যই আমার দাবীর কথাও বলি।
এদিন চট্টগ্রামে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের পরিবর্তে ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা দিবস’ হিসেবে পালনের আহবান জানান। একইসাথে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের আহবান জানান। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এদিনও বিভিন্ন অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মিছিল সহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। এদিন রাতে ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় মওলানা ভাসানী চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে সরেজমিনে অবহিত হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানোর পরামর্শ দেন। এদিন বিকেলে মোহাম্মদপুরে এক জনসভায় ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য স্থানীয় অবাঙালী নাগরিকদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, আপনারা বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে যান। এদিন সাংবাদিকদের সাথে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আলোচনা হয়। সাংদাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব ঘরই আমার ঘর। এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে বৈঠক সম্পর্কে বলেন, আপনিতো কিছুই বললেন না। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, আমি কি কিছুই বলিনি? আমি কি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি? তিনি দৃঢ়কন্ঠে বলেন, আমাদের আন্দোলন চলছে। মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
১৮ মার্চ, ১৯৭১
এদিন সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঢাকার তেজগাঁও ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। এই দুই স্থানে সৈন্যরা নিরস্ত্র ট্রাকে আরোহীদের নির্মমভাবে প্রহার করে এবং তাদের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। এসব ঘটনায় নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জনগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং শ্রমিকরা মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে এসব ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে রাতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে একটা বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, আমাদের বারবার প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন যে, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সৈন্যরা সম্পূর্ণ বিনা অজুহাতে নিরস্ত্র নিরীহ নিরপরাধ অসামরিক বাসিন্দাদের অপদস্ত, হয়রানি ও নির্যাতন করছে। ঢাকাসহ সারাদেশে সেনাবাহিনীর উস্কানিমূলক আচরণ আর সহ্য করা হবেনা, তা যে কোন মহলেরই হোক না কেন। এর ফলাফলের দ্বায়িত্ব উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে।
গত দিনের মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকের পর পরবর্তী বৈঠকের কোন সময় নির্ধারত না হওয়ায় এদিন জনমনে বিভিন্ন উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়। সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল সহকারে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহা নায়কের প্রতি তাদের অকুন্ঠ সমর্থন জানাতে আসে। এ সময় বঙ্গবন্ধু প্রতিটি মিছিলের প্রতি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সমবেত জনতার শ্লোগান ও করতালির জবাব দেন। তিনি মিছিলকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমরা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে সংগ্রামী দুর্গ গড়ে তোল। যদি তোমাদের উপর আঘাত আসে তা প্রতিহত করে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হেনো। তিনি জনগনকে চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। তিনি প্রতিটি মিছিলের উদ্দেশ্যে সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, দাবি আদায় করতেই হবে। এ জন্য বৈধ, শৃঙ্খলা ও ঐক্য চাই। শান্তিপূর্ণভাবে দাবি আদায় হয়ত ভাল, নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাব। প্রতিদিনের মত এদিনও সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। এবং অফিস আদালতে যাওয়া থেকে বিরত থাকে বাঙালীরা। ঢাকার রাজপথ ছাত্র শিক্ষক জনতার পদচারণায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য দৃপ্ত শপথ নেয়। এদিন আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে বলেন যে, শোষণহীন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রকৃষ্ট সময় আগামি ২৩ মার্চ। অন্যদিকে বিমান বাহিনীর সৈনিকেরা সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ওদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা বাঙালিদের হত্যা চালানোর প্রয়াস বন্ধ করার আহবান জানায়।
এদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সমবেত ব্যাংক কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন প্রয়োজন হলে বাংলাদেশের সমস্ত ব্যাংক জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। বাংলাদেশে কার্যরত ব্যাংকগুলো জাতীয়করনের পর এগুলোর পরিচলনকাজ জনগণ নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি উপস্থিত কিছু বিদেশী সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে উপস্থিত জনতাকে দেখিয়ে বলেন, বন্ধুরা দেখুন, আমার দেশের মানুষ আজ মুক্তির প্রতিজ্ঞায় কী অটল অবিচল। এদিন রাতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় আগামীকাল অর্থাৎ ১৯ মার্চ সকাল ১১ টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তৃতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
১৯ মার্চ, ১৯৭১
অসহযোগ আন্দোলনের এই দিনেও রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি বেসরকারি ভবন ও বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সাথে কর্মবিরতি অব্যাহত থাকে সকল সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ছাত্রছাত্রী ও তরুন তরুনীরা বিভিন্ন রকম কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। অন্যদিকে একদিন বিরতির পর এদিন সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে তৃতীয় কেউ উপস্থিত ছিলেন না। দেড় ঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে ফিরে উপস্থিত দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আগামীকাল সকালে আবার বৈঠক শুরু হবে এবং সেখানে আমার সঙ্গে আমার দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। তিনি আরো বলেন, আজ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আমার দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আলোচনায় মিলিত হবেন। আলোচনার ধারা সম্পর্কে তিনি আশাবাদী কিনা, সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সবসময় ভালোটা আশা করি। তবে সবচেয়ে খারাপ কোনকিছুর জন্যেও আমরা সবসময় তৈরি থাকি। এদিন সন্ধ্যায় উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ ও ডক্টর কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এ আর কর্ণেলিয়াস,লে.জে. পীরজাদা ও কর্ণেল হাসান অংশগ্রহন করেন। তাঁদের এই আলোচনা দুই ঘন্টা স্থায়ী হয়। তাঁরা মূলত ‘টার্মস অফ রেফারেন্স’ অর্থাৎ কী ফর্মুলার ভিত্তিতে আলোচনা হবে তা নির্ণয় করেন।
এদিন ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে জনতা ও শেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী জওয়ানদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ সকালে বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে ৫৭ নং ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহান জাব আরবাব সেনাবাহিনীর একটি দলকে ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে পাঠান। এদিন সকাল ১১ টার দিকে সেনাবাহিনীর ঐ দলটি জয়দেবপুরে পৌঁছেই স্থানীয় আন্দোলনরত জনতার উপর চড়াও হয় ও প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করে। রাজবাড়ির দিকে অগ্রসরগামী সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে জনতার সঙ্গে যোগ দেয় বাঙালী সেনাদল। বাঙালী সেনাদলের নেতৃত্ব দেন লে. কর্ণেল মাসুদুল হোসেন খান ও মেজর শফিউল্ল্যা। সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন তীর-ধনুক, বল্লম-টোটা, দা-কুড়াল, বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে শহরের দিকে ছুটে আসে। জনতা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ব্যারিকেড গড়ে তোলে, যাতে ঘাতকেরা জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে অবস্থানরত বাঙালী সেনাদের নিরস্ত্র করতে না পারে এবং সমরাস্ত্র কারখানা দখল করে সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে ঢাকা যেতে না পারে। বিশেষ করে জনতা জয়দেবপুর রেলগেটের ওপর রেলবগি ও অন্যান্য ভারি জিনিস দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। দুপুর আড়াইটার দিকে উভয়পক্ষ রেলগেটের ওপর মুখোমুখি হয় এবং কোন হুশিয়ারি ছাড়াই বাঙালি জনতার উপর পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার গুলি বর্ষণ করে। প্রত্যুত্তরে জনতাও পাল্টা জবাব দেয়। এভাবে একঘন্টারও বেশি সময় ধরে চলে সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা ফিরে যেতে শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যে চৌরাস্তায় আবার জনতার বাধার সম্মুখীন হয়। এ সময় পাকিস্তানীরা আশেপাশের গ্রামবাসীদের ওপরও হামলা চালায়। সে সময় তাদের হামলার শিকার হয় গ্রামের নারী-শিশু, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই। হামলা শেষে সৈন্যরা ঢাকা ফেরার পথে টঙ্গীর বোর্ড বাজারে আবার জনতার প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। এ সময় তারা নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচার বেয়নেট চার্জ করে। এদিন সন্ধ্যায় জয়দেবপুর এলাকায় সেনাবাহিনী সান্ধ্য আইন জারি করে এবং তাদের খোয়া যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র খোঁজার অযুহাতে ঐ এলাকায় নিরীহ ও নিরপরাধ জনগনের ওপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন চালায় ও অনেককে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে যায়, তাঁরা আর ফিরে আসেনি। তবে বলা যায় গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির বাঙালি কর্মচারীবৃন্দ, জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও আশপাশের গ্রামবাসীগণ, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জওয়ান ও অফিসারগণ এবং টঙ্গী শিল্প এলাকার শ্রমিকবৃন্দ এদিন পাকিস্তানি শেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাকে বলা হয় বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনাপর্ব। এই সংঘর্ষে প্রায় ৫০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী নিহত ও দুই শতাধিক আহত হন।
এদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয় যে, তারা শক্তি প্রয়োগকে ভয় পায়। জনগন যখন রক্ত দিতে তৈরি হয়, তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।” তিনি তার নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণের ঘটনা উদ্দেশ্য ও উস্কানিমূলক। তিনি আরো বলেন যে, সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেওয়া হয়েছে। যদি তাই সত্যি হয়, তাহলে কিভাবে সেনাবাহিনীর লোকেরা জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর গুলি চালাল? প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে এ প্রশ্নের জবাব চান। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা আর কত রক্ত চাও? তিনি আরো বলেন, অস্ত্র আর শক্তি প্রয়োগে তোমরা বাঙালি জাতিকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই তবে যে কোন পরিস্থিতিতে জনগণের সংগ্রাম চলবেই। বাঙালিরা রক্ত দিতে, প্রাণ দিতে শিখেছে, তাদের দাবায় রাখার সাধ্য আর কারো নেই।
জয়দেবপুরের এই ঘটনায় ঢাকা শহর বিক্ষোভের নতুন রূপ ধারণ করে। হাজার হাজার মানুষ দা, ছুরি, বল্লম, বর্শা, লাঠি নিয়ে রাজপথে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এদিন বিকেলে মিছিলকারীরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সমবেত হলে বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের স্বাধীকার অর্জনের জন্য কোন ত্যাগকেই অসাধ্য বলে বিবেচনা করা হবেনা।
এদিন বেশ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ দৌলতানা, মুসলিম লীগ নেতা সর্দার শওকত হায়াত খান ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ প্রমুখ করাচি থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান। ওদিকে করাচিতে পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো বলেন, ক্ষমতার হিস্যা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। এ থেকে তাদের চক্রান্তের আরো স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। এদিন করাচিতে জাতীয় পরিষদের স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যসহ সংখ্যালঘু দলসনূহের পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এদিকে সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে ন্যাপপ্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। তার বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, জেনারেল ইয়াহিয়ার মনে রাখা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের উপর কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার তার নেই।
২০ মার্চ,১৯৭১
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল দশটায় রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘সুগন্ধা’) অনুষ্ঠিত এই আলোচনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সাথে আরো উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে ইয়াহিয়ার সাথে উপস্থিত ছিলেন এ কে ব্রোহি, শরীফুদ্দীন পীরজাদা ও মি. কর্ণেলিয়াস। এই বৈঠক চলে সোয়া দুই ঘন্টা। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে ফিরে উপস্থিত দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আলোচনার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কাল অর্থাৎ ২১ মার্চ আবার বৈঠক হবে। তিনি আরো বলেন, এ মুহুর্তে এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলবনা। সময় এলে আমি অবশ্যই সবকিছু বলব। একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন যে, আলোচনা কতদিন চলবে? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে পারে। আমরা একটা সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। এ সময় অন্য একজন সাংবাদিক জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জয়দেবপুরে গতকাল সেনাবাহিনী যে বর্বর গুলিবর্ষণ করেছে তার প্রতি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে আমাকে কথা দিয়েছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে এই আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে আওয়ামী লীদের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, যদি প্রয়োজন হয় আমরা পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দসহ এক সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।
এদিন করাচিতে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন তিনি লন্ডন পরিকল্পনা মানবেন না। তিনি বলেন, কেবল পাকিস্তান পরিকল্পনাই সবাইকে মানতে হবে। লন্ডন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান, খান আব্দুল ওয়ালী খান ও মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা লন্ডনে বসে একটা পরিকল্পনা করেন যাকে লন্ডন পরিকল্পনা বলা হয়। তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয়দফার ভিত্তিতে প্রনীত হয়। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, তাকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং সে প্রেক্ষিতে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। ঢাকা থেকে সে বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব মিলেছে তাই তিনি আগামীকাল ঢাকা আসবেন ও বৈঠকে যোগদান করবেন বলে জানান। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর, জেনারেল মিঠ্ঠা প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গরূপ দিচ্ছিলেন বলে জানা যায়। একইসাথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানযোগে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে আনা অব্যাহত থাকে। আরো জানা যায় যে, প্রতিদিন ৬ টি থেকে ১৭ টি পর্যন্ত পি আই এ ফ্লাইট, বোয়িং ৭০৭ বিমানযোগে সৈন্য ও রসদ নিয়ে সিংহল হয়ে ঢাকায় এবং অসংখ্য জাহাজ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসছিল। আরো জানা যায় যে, মার্চের শুরুতে যখন আন্দোলন শুরু হয় তখন বাংলাদেশে পাকিস্তান স্থলবাহিনীর শক্তি ছিল মাত্র এক ডিভিশনে সীমাবদ্ধ। অথচ সেই শক্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হয় ও ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও অব্যাহত ছিল। একইসাথে চট্টগ্রাম নৌবাহিনীর শক্তিও বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। এসব প্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই বিমান চলাচল বন্ধের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আহবান জানায়।
রাজধানী ঢাকায় এদিন অসংখ্য সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নৌবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের সমাবেশ। এই সমাবেশে প্রাক্তন নৌসেনারা বাঙালি সৈনিকদের কেবল বাংলাদেশে নিযুক্ত রাখার এবং অবাঙালি সৈন্যদের অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করারও দাবি জানান। তাঁরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্বিক শহযোগিতা করার লক্ষ্যে একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীর কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহবান জানানো হয়। শহীদ মিনারের সমাবেশ শেষে বাঙালি নৌসেনারা কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দানের প্রতিশ্রুতি দেন। এদিন বঙ্গবন্ধু জনগণকে ২৩ মার্চ লাহোর দিবস উপলক্ষে সারা বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি পালনের আহবান জানান। অন্যদিকে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এদিন ঘোষণা দেন যে, ২৩ মার্চ ‘স্বাধীন পূর্ববাংলা’ দিবস হিসেবে পালিত হবে। চট্টগ্রাম সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধারক সরকার গঠনের সুযোগ দিতে ইয়াহিয়া খানকে আহবান জানান।
গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকায় জয়দেবপুরে বলবৎকৃত সান্ধ্য আইন এদিনও বিরামহীনভাবে অব্যাহত থাকে। গতদিন সেনাবাহিনীর গুলিতে আহতদের মধ্যে কয়েকজন হাসপাতালে মারা যান। অন্যদিকে ঢাকায় চারু ও কারুশিল্পীরা ‘স্বা-ধী-ন-তা’ পোষ্টার লিখে বুকে বেঁধে অসহযোগ আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে রাস্তায় নেমে আসেন। এদিন মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর, সৈয়দপুরসহ বেশ কয়েক স্থানে বাঙালি জনতার সাথে বিহারি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাঙ্গা শুরু করে। এসব অপতৎপরতাকে রোধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, যত বাধাই আসুক বাংলার মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম চলবে, আপনারা আন্দোলনে ভাটা পড়তে দেবেন না। তিনি নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধি ও উস্কানিমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাঙালির মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।
২১ মার্চ, ১৯৭১ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের এই দিনে হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত পাদচারণায় বিদ্রোহী বাংলার রাজধানী ঢাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সমস্ত শ্রেনীর সকল পেশার মানুষের সম্মিলিত মিছিলে সমস্ত নগরী যেন মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। মিছিলের পর মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে জমায়েত হতে থাকে। বিভিন্ন সংগঠন এদিন ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। এদিন মগবাজার মহিলা সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত এক মহিলা সমাবেশে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে একটি প্যারামিলিটারি গঠনের আহবান জানানো হয়। এদিকে নারায়নগঞ্জে মহিলারা একটি নৌমিছিল বের করেন। এদিকে সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ লেখক ও শিল্পীরা সাহিত্য ও গণসঙ্গীতের আয়োজন করে। একইসাথে সারাদেশে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ মিছিল শোভাযাত্রা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সকল প্রকার অফিস আদালত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও কালো পতাকা উত্তোলন অব্যাহত থাকে। এদিন বিমান শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের কার্যালয়ে সভা করে। ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে সদরঘাট, বাহাদুরশাহ পার্ক, মৌলভীবাজার ও চকবাজারে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৩২ নম্বরস্থ বাসভবনে বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহীর সাথে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে পঞ্চমদফা বৈঠকের উদ্দেশ্যে। এ সময় তার সাথে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। মুজিব-ইয়াহিয়ার এই বৈঠক দেড় ঘন্টা স্থায়ি হয়। অন্যদিকে এদিন বিকেলে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো দলীয় ১২ জন নেতাসহ ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে। যদিও সেই আলোচনাই ছিল বাঙালি নিধনের জন্য ষড়যন্ত্রের রূপরেখা তৈরির আলোচনা। এ সময় ভুট্টোর সাথে যে সকল পিপিপি নেতা ঢাকা এসেছিলেন তাদের মধ্যে এ এইচ কারদার, মমতাজ ভুট্টো, গোলাম মোস্তাফা জাতোই, হায়াত মোহাম্মদ খান শেরপা, তালেবুল মওলা ও রউফ তাহের উল্লেখযোগ্য। একজন সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ভুট্টোর আগমন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দরে কড়া সেনা প্রহুরা মোতায়ন করা হয়েছিল। কোন সাংবাদিককে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছিলনা।কড়া সামরিক বেষ্টনি দিয়ে ভুট্টোর দলকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালে ( যা বর্তমান হোটেল শেরাটন)নিয়ে যাওয়া হয় ।কিন্তু পথিমধ্যে ভুট্টোবিরোধী শ্লোগান ও বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত রাস্তার দুধারে এমনকি হোটেলের গেটেও হাজার হাজার জনতা ভুট্টো বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।এমনকি হোটেলের লাউঞ্জে প্রবেশের পর সেখানে ও একদল বিক্ষোভাকারী প্ল্যাকার্ডসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।ভুট্টোর হোটেলে প্রবেশের সময় সৈন্যরা হোটেলে কালো পতাকা নামিয়ে ফেলে কিন্তু বিক্ষোভ জনতার প্রচন্ড প্রতিবাদের মুখে তারা পুনরায় হোটেল ভবনে কালো পতাকা তুলতে বাধ্য হয়।সন্ধ্যার দিকে ভুট্টো সেনা প্রহরায় প্রেসিডেন্ট ভবনে যায়।সেখানে দুই ঘন্টা ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভুট্টোর একান্ত বৈঠক অনুষ্টিত হয়।বৈঠক শেষে ভুট্টো হোটেলে ফিরলে উপস্থিত সাংবাদিকরা তার কাছে বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক সংগ্রামের জনৈক সাংবাদিককে বলেন, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে,এ মুহুর্তে আমি এইটুকুই বলতে পারি।তিনি সাংবাদিকদের আর কোন সময় না দিলে লিফটে চড়েন।এ সময় কোন সাংবাদিককে তার সাথে যেতে দেয়া হয়নি।এদিন রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালে ভুট্টো দলীয় শীর্ষ নেতাদের সাথে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। এরপর কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মোমতাজ খান মোহাম্মদ দৌলতানার কক্ষে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন।এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মিয়া মোমতাজ খান মোহাম্মদ দৌলতানা,ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, জমিয়তে উলুমায়ের মহাসচিব মুফতি মাহমুদ,ন্যাপ নেতা গাউস বক্স বেজেঞ্জা, সর্দার শওকত হায়াত খান প্রমুখ।উল্লেখ্য,এদিক সকালে মিয়া মোমতাজ দৌলতানা নুরুল আমীনের সঙ্গে তার বাসভবনে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন।এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে গভীর ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত হতে যাচ্ছে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যখন ভুট্টো ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন তখন জনাব ইয়াহিয়া খান ঢাকা সেনানিবাসে (ইস্টার্ন হেড কোয়ার্টারস) সামরিক প্রস্তুতি পুর্ণাংগ রুপ দিতে ব্যস্ত।তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান,জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা,জেনারেল ওমর,জেনারেল মিঠা প্রমুখকে নিয়ে।অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার এদিন বাংলাদেশে আসা যাওয়ার জন্য পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপের ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে।গত ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জারীকৃত কারফিউ এদিন দুপুর ১২টায় ৬ ঘন্টার জন্য প্রত্যাহার করা হলেও তা পরে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দষ্টকালের জন্য পুনরায় বলবত করা হয়।
ঢাকায় এদিন স্বাধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ আগামি ২৩ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্য বর্জন সপ্তাহ পালনের কর্মসুচী ঘোষণা করে এবং তা স্বার্থক করে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানায়।ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি এদিন বিকেলে চট্টগ্রামের পোলাগাউন্ডে এক বিশাল জনসাভ্য ভাষন দানকালে বলেন, আলোচনায় কোনো ফল হবেনা। যেখানে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশি পর্যন্ত কেউ প্রেসিডেন্টি ইয়াহিয়াকে মানে না ,তখন শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত।তিনি আরো বলেন শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সরে পড়াই হবে ইয়াহিয়ার বুদ্ধিমানের মতো কাজ।তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের উদ্দেশ্যে বলেন,ইসলামের ভাঁওতা দিয়ে আর আমাদের শাসন করো না। আমরা এই দেশকে স্বাধীন করবই।
২২ মার্চ,১৯৭১
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব্র রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ষষ্ট দিনের মতো বৈঠক অনুষ্টিত হয়।এদিন সকালেই রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক চলাকালীন সময়েই প্রেসিডেন্ট ভবনের মুখপাত্র আগামি ২৫ তারিখে পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত জানান সাংবাদিকদের।তিনি আরো বলেন, খুব শিগগিরই প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর এই বৈঠক প্রায় এক ঘন্টা পনের মিনিট স্থায়ী হয়েছিল।অন্যদিনের তুলনায় এদিন প্রেসিডেন্ট ভবন এলাকায় সামরিক প্রহরা আরো জোরদার করা হয়।অন্যদিকে এইখানে বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতার সমাগম ঘটে।উপস্থিত জনতা প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকের অদূরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে ও ভুট্টোর বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে।এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে,বৈঠক শুরুর ও বঙ্গবন্ধু যাওয়ার এক ঘন্টা আগে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন এবং সেখানে তিনি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন।আবার বঙ্গবন্ধু বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পরে ও ভুট্টো এক ঘন্টা সেখানে অবস্থান করেন।এদিক সন্ধ্যায় আবার ও ভুট্টো তার উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে যান ও ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনায় মিলিত হন।এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে,ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠক কিন্তু পুর্ব নির্ধারিত ছিলনা, মানে বঙ্গবন্ধু সে ব্যাপারে কিছুই জানতেন প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
বৈঠক শেষে নিজ বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন,আমরা আন্দোলনে আছি এবং লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন,আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে নির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হয়েছি। জনাব ভুট্টো ও সেখানে ছিলেন। পরবর্তী বৈঠক আবার কখন অনুষ্টিত হবে তা এই মুহুর্তে আমি জানিনা।আগামীকাল অথবা পরশু হতে পারে।তিনি আরো বলেন,আজ অথবা আগামীকাল আমার দলের ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে আর এক দফা বৈঠক হতে পারে।পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি তো আগেই ঘোষণা করেছি আমার দাবী (৪ দফা পূর্বশর্ত) পুরণ নাও হওয়া পর্যন্ত আমরা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে পারিনা।আর সে অনুসারেই প্রেসিডেন্ট পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন।এদিকে পিপিপি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো খুব ব্যস্ততম দিন কাটাতে থাকেন, দলীয় উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক,প্রেসিডেন্ট ভবনে ছোটাছুটি তারপর নৈপথ্যে ষড়যন্ত্র,নীলনকশার অগ্রগতি বিবেচনা ইত্যাদি কারনে সবশেষে এদিন রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ( বর্তমান হোটেল শেরাটন)লাউঞ্জে এক অনির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, আমরা চাই সর্বজনগ্রাহ্য একটি সমঝোতা।জাতিয় পরিষদ অধিবেশন বসার আগে আওয়ামীলীগ ,পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে।কেননা বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী ও একটা পক্ষ।কারন তারা ক্ষমতায় এবং তারাই নির্ধারিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।ভুট্টোর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হতে থাকে যে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তার নীলনকশা সফলতার পথে।এদিকে ধানমন্ডিতে মার্কিন কন্সাল জেনারেলের বাড়িতে বোমা ছোড়ার ঘটনা ঘটে।অন্যদিকে ভুট্টোর অবস্থানকালেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কর্মচারীরা দ্বিতীয় দিনের মতো বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও কালো ব্যাজ ধারন করে কাজ করে।
এদিন ঢাকায় কয়েকটি সংবাদপত্রে বাংলার স্বাধিকার শিরোনামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।ক্রোড়পত্রে শেখ মুজিবুর রহমান সাক্ষরিত একটি বানী ও প্রকাশিত হয়।যার মূলকথা হলো, বাংলাদেশের কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের আজকের সংগ্রাম।আমাদের দাবী ন্যায়সঙ্গত,তাই আমাদের সাফল্যও সুনিশ্চিত।এই ক্রোড়পত্রে আরো যারা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাঁরা হচ্ছেন , অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরি, আধ্যাপক রেহমান সোবহান,নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান।এই ক্রোড়পত্র পরিকল্পনায় ছিলেন বিটপী নামে বিজ্ঞাপনী সংস্থার শ্রী রামেন্দু মজুমদার।এদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্দোলনে সমর্থনকারী লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত এক কবিতা পাঠের আসরে বিশিষ্ট কবি- সাহিত্যিকরা অংশগ্রহণ করেন।ডঃ আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আহসান হাবিব,শামসুর রাহমান,হাসান হাফিজুর রহমান,সৈয়দ শামসুল হক,মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফজল শাহাবুদ্দিন,আলাউদ্দিন আলা আজাদ,দাউদ হায়দার, মেহেরুন্নেসা ও আরো অনেকে। এই অনুষ্ঠানে তাঁরা জয়দেবপুরে গুলিবর্ষনের তীব্র নিন্দা জানান ও শহীদদের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা ¯^াদীনতার দাবি তোলেন। এদিন রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা ও শোভাযাত্রার মদ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোরদের ও পল্টন ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ। মেজর জেনারেল (অব.) এম আই মজিদের সভাপতিত্বে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের এই সভায় বক্তব্য রাখেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী, ফ্লাইট লে. খলিলউল্লাহ, কমডোর জয়নুল আবেদীন, আশরাফ মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আহমদ প্রমুখ। এছাড়া এই সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন কনভেনশন নেতা মেজর (অব.) খাজা হাসান আশকারী, লে. কর্নের ইমাম হোসেন, মেজর আফসারউদ্দিন, মেজর জামাল, ক্যাপ্টেন ইবরাহিম, ক্যাপ্টেন আহসান, কমডোর সাহাবুদ্দিনসহ অনেক সাবেক সামরিক অফিসার। এই সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ¯^াধীনতা অর্জনের জন্য যে অভ‚তপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছে তাতে প্রাক্তন সৈনিকেরা আর প্রাক্তন হিসেবে বসে থাকতে পারে না। তাঁরা আরো ঘোষণা করেন যে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করার জন্য প্রস্তুত। এই সমাবেশ থেকে বিমান, নৌ ও স্থলবাহিনীর সকল অবসপ্রাপ্ত সৈনিককে নিজ নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগ, সংগ্রাম পরিষদ ও ¯ে^চ্ছাসেবকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে আন্দোলনকে সফল করার আহŸান জানানো হয়।

২৩ মার্চ, ১৯৭১
বিক্ষুব্ধ বাংলার ¯^াধীনতা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে ‘পাকিস্তান দিবস’ এদিন বাংলার জনগণ নতুন প্রেক্ষাপটে পালন করে। ¯^াধীনচেতা বীর বাঙালি এদিন নবসূর্যের নবপ্রভাতে নতুন পতাকার দিকনির্দেশনায় অখণ্ড পাকিস্তানের অবসান ঘটায়। এদিন প্রত্যুষে অসহযোগ আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিফ্যাক্টো বাংলাদেশের বেসরকারি প্রশাসনের সদর দফতর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের সময় ‘জয়বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন জানায়। এবং সূর্যাস্তের সময় এই ¯ে^চ্ছাসেবক বাহিনীই আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা নামিয়ে নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক লাহোর দিবস’ হিসেবে পালন করার জন্য জনগণকে আহŸান জানিয়ে এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। এদিন বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি গৃহে, যানবাহনে সকল প্রতিষ্ঠানে ¯^াধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সাথে কালো পতাকা উাত্তোলনও

অব্যাহত থাকে। এদিন ‘পাকিস্তান দিবস’ সত্তে¡ও প্রেসিডেন্ট ভবন, ক্যান্টনমেন্টগুলো ও তেজগাঁও বিমানবন্দর ছাড়া সমগ্র দেশের কোথাও চাঁদতারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা ওড়েনি। এদিন বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করে। এদিন যদিও বঙ্গবন্ধু ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ হিসেবে পালনের আহŸান জানিয়েছিলেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ‘বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট ভবন, হাইকোট ভবন, পরিষদ ভবন, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বেতার ভবন, ঢাকা টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সমস্ত সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে ¯^াধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ¯^াধীন বাংলার পতাকা ওড়ানোর সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে ছাত্র-জনতা তা উপেক্ষা করে। এদিন ঢাকাস্থা ব্রিটিশ হাইকমিশন ও সোভিয়েত কনস্যুলেটে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে ¯^াধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। অন্যদিকে চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে প্রথমে পাকিস্তানি পতাকা তোলা হলেও জনতা তা নামিয়ে ফেলে ¯^াধীন বাংলার পতাকা তোলে। অবশ্য মার্কিন দূতাবাসে এদিন কোনো পতাকাই তোলা হয়নি।
¯^াধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ এদিনটিকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে। এ উপলক্ষে রাজধানীর গণজীবন গণ-আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে পরিণত হয়। ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ¯^াধীন বাংলার পতাকা তোলে, এরপর প্রভাতফেরি বের করে। আন্দোলনে নিহত বীর শহীদদের মাজার জিয়ারতের জন্য আজিমপুর কবরস্থানে যায়, সেকাণ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। এখান থেকে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র-ছাত্রী ও প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের সমš^য়ে গঠিত ‘জয়বাংলা বাহিনীর’ আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া। এারপর সকাল সোয়া ৯টায় হাজার হাজার জনতার করতালি ও ‘জয়বাংলা’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে ¯^াধীন বাংলার পতাকা তোলা হয় ও ‘জয়বাংলা’ বাহিনীর সদস্যরা সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকার প্রতি অভিবাদন জানান। এ সময় রেকর্ডে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাজানো হয়। সম্পূণর্ঃ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পতাকা তোলার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন জয়বাংলা বাহিনীর পক্ষে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। এরপর পাঁচ শতাধিক সদস্যকে নিয়ে জয়বাংলা বাহিনীর নেতারা প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানান। এদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রাৎয় ৭০টি মিছিল আসে বঙ্গবন্ধুর বাভবনে।

মিছিলকারীদের সকলের হাতে ছিল ¯^াধীন বাংলার পতাকা আর তাদের কণ্ঠে ছিল ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘মহান জাতির মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু লও সালাম’ প্রভৃতি শ্লোগান। এদিন বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ, পল্টন ময়দান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিউ মার্কেট থেকে আসাদ গেট এমনকি মিরপুর রোড পর্যন্ত মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায়। সংগ্রামী জনতা ভুট্টোর সামরিক বাহিনীর বিরুুেদ্ধ শ্লোগান দেয় এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি এবং ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের অংশ হিসেবে এদিন আওয়ামী লীগের আলোচকবৃন্দ এবং প্রেসিডেন্ট উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের পক্ষে ছিলেন এম এম আহমদ, এ আর কার্নেলিয়াস, লে. জে. এসজিএম পীরজাদা এবং কর্নেল হাসান। তাঁরা দুই দফা বৈঠকে মিলিত হন। দুপুরে এক ঘন্টার জন্য ও সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টার জন্য। এ সময় আওয়ামী লীগৈর নেতৃবৃন্দ ছয়দফার ভিত্তিতে একটি খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। লে. জে. পীরজাদা শাসনতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো মেনে নেয়া হবে বলে আভাস দেন। একই সাথে প্রেসিডেন্ট ভবনের জনৈক মুখপাত্র বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের পদ্ধতি চলছে। প্রেসিডেন্ট একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে ঘোষণা দিচ্ছেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট সারাদিনই প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে ছিলেন এবং ১১টার দিকে তিনি সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে আলোচনা বৈঠক করেন। তিনি সৈনিকদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। অন্যদিকে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সারাদিনই দরীয় উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করতে দেখা যায়। সকালে তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জেনারেল পীরজাদার সঙ্গেও বৈঠক করেন। তবে এদিনের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নম্বরবিহীন প্লেট লাগানো কালো গাড়িতে করে সু¯^াস্থ্যের অধিকারী একজন ব্যক্তি অত্যন্ত তৎপরতার সাথে ভুট্টোর সাথে দেখা করে। তবে কে সেই ব্যক্তি সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না।
বিকেলে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘু দলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিস্পত্তি হয়ে যাক। এ সময় বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বলেন, আপনারা ভালো কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্য তৈরি থাকুন। এদিন বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহী সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা

হস্তান্তরে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে দাবি করেন। অন্যদিকে এদিন বিকেলে রংপুরের সৈয়দপুরে সেনাবাহিনী ও গ্রামবাসীদের মদ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। সেনাবাহিনী সান্ধ্য আইন জারি করে ও রাত্রে স্থানীয় অবাঙালিদের নিয়ে বাঙালিদের ওপর হামলা, লুটতরাজ, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে। একই সাথে ঢাকার মিরপুরেও বিহারিরা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়।
এদিন বিকেলে ন্যাপ (ভাসানী) পল্টনে ‘¯^াধীন পূর্ববাংলা দিবস’ পালন উপলক্ষে জনসভা করে। এখানে মওলানা ভাসানীর লিখিত ¯^াধীনতার শপথ পাঠ করা হয়। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে এ সমাবেশে মওলানা ভাসানী শারীরিক অসুস্থতার জন্য অনুপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে চট্টগ্রামে অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিকের সভাপতিত্বে প্যারেড গ্রাউন্ডে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক আর আই চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান ও আওয়ামী লীগের জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। এ ছাড়া এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা জাতীয় লীগ, বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, বিমূর্ত সঙ্গীত একাডেমী, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স সমিতি, কৃষক শ্রমিক পার্টি, বাংলা ছাত্রলীগ, ¯^াধীন বাংলাদেশ শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ, বিমান শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠন প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচি পালন করে। ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে ¯^াধীন বাংলাদেশ শ্রমিক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত জনসভায় নেতৃবৃন্দ গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ে তোলার আহŸান জানান।

২৪ মার্চ, ১৯৭১
‘আলোচনা না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’- এ ধরনের শ্লোগান ও মিছিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এদিনের নগরী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এদিনও বিক্ষুব্ধ জঙ্গি মিছিলেন ¯্রােত। আগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনো সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। তিনি জনসাধারণকে যে কোনো পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকার আহŸান জানিয়ে বলেন, আমি চ‚ড়ান্ত সংগ্রামের নির্দেশ দেয়ার জন্য বেঁচে থাকব কিনা জানি না। তবে, ¯^াদীনতা আদায়ের জন্য আপনারা আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। তিনি আরো বলেন, আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সঙ্গে, শহীদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানি করতে পারব না। কিছু লোক আমাদের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছ্ েএদের সম্পর্কে আপনারা হুঁশিয়ার থাকুন। তিনি শাসক গোষ্ঠীর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে তা বরদাশত

করা হবে না। কারো চোখরাঙানির কাছে আমরা মাথা নত করব না। আমাদের দাবি ন্যায্য। আমাদের দাবি মানতে হবে। এদিনও সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস, আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল পালিত হয়। সকল গৃহ, স্থাপনা যানবাহন সবখানে ¯^াধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচক দলের সাথে আওয়ামী লীগের আলোচক দলের মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা হয়। এবং সন্ধ্যায় পুনরায় উভয় পক্ষের মদ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। দুই ঘন্টা স্থায়ী হয় এই বৈঠক। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রের নাম ফেডারেশনের পরিবর্তে কনফেডারেশন অব পাকিস্তান করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তবে সরকার পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়। তারা একে আওয়ামী আলোচকবৃন্দের নীতিগত মৌলিক পরিবর্তন বলে উল্লেখ করেন। সে সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, অন্য সবকিছু অপরিবর্তিত থাকলে শুধু নামের পরিবর্তনকে মৌলিক পরিবর্তন বলা যায় না। সরকারদলীয় প্রতিনিধি বিচারপতি কার্নেলিয়াস তখন ‘কনফেডারেশন’- এর স্থলে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটি সুপারিশ করেন। এ সময় উভয় দলের আলোচকবৃন্দ খসড়া সংবিধানের সব অনুচ্ছেদ ও তফসিলের ওপর দফাওয়ারি আলোচনা শেষ করেন। আলোচনা শেষে লে. জে. পীরজাদা বলেন, আগামী দিন চুক্তি ¯^াক্ষরের সময় নামকরণের বিষয় ঠিক করা হবে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন আগামী দিনের সময়সূচিও ঘোষণা চুড়ান্তকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে টেলিফোনে চুড়ান্ত করা হবে বলে তাঁদের জানানো হয়। যদিও সেই টেলিফোন আর কখনোই আসেনি। সন্দ্যার বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য শেস হয়েছৈ। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তাঁর ঘোষণা দেয়া। তিনি আরো বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সে আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়অমী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়। এদিন রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আওয়ামী লীগ চুড়ান্ত ও দ্ব্যর্থহীনভাবে তার মতামত ব্যক্ত করার পরও সরকার ইচ্ছাকৃত গড়িমসি করে কালক্ষেপণ করছ্ েএর ফলে পরিস্থিতি ক্রমে সংকটতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তাই সরকারকে অবিলম্বে তাদের ঘোষণা জানানোর দাবি জানানো হয় এই বিবৃতিতে। এদিকে ভুট্টো-ইয়াহিয়া নীল নকশা প্রায় সমাপ্তির পথে। শেষ আঁচড়ের কাজ চলতে থাকে ইস্টার্ন সদর দপ্তরে। সেখানে অপারেশন সার্চলাইটের চুড়ান্ত মেকআপ চলে। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও রাও ফরমান আলী দুটি হেলিকপ্টারে করে সব কটি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বিগ্রেড কমান্ডারদের নীল নকশা সম্পর্কে নির্দেশ

করে নতুন পাড়া সেনানিবাসে আনার চেষ্টা করলে ১৭ নং জেটির পাশে ডবলমুরিং রোডের একটি ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে জনতা তাদের পথরোধ করে। রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত জনতা-সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে থাকার পর উপস্থিত হাজার হাজার জনতার ওপর সেনাবাহিনী অতর্কিত গুলি চালায়। এতে কমপক্ষে ২০০ জন শ্রমিক জনতা শহীদ হন। এ সকল ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেয়া হলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। তিনি আরো বলেন, যখন রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে তখন বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর উস্কানিমূলক কার্যক্রমের মাদ্যমে অ¯^াভাবিক ও উত্তেজনাকর অবাঞ্চিত পরিবেশ সৃষ্টির ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ¯^াধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আরো আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরো জোরদার করার জন্য বাংলার আপামর জনগণের প্রতি আহŸান জানান। অন্যদিকে টিভি কেন্দ্রের প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে এদিন সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সাথে সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান। এদিন পশ্চিম পাকিস্তানে আবদুল কাইয়ুম খান, মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, মওলানা মুফতি মাহমুদসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। তাঁদের অনেকেই যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁকে বিদায় জানিয়ে করাচি ফিরে যান। এ সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার দুরভিসন্ধির নীলনকশা আরো স্পষ্ট হতে থাকে। এবং বঙ্গবন্ধু সেটা বুঝতে পেরেই চট্টগ্রামে একটা জরুরি বার্তা পাঠান চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটির কাছে। সংগ্রাম কমিটি তখন রাত ১০টায় জনাব এম আর সিদ্দিকীর বাসায় বৈঠক করছিল। বঙ্গবন্ধু প্রেরিত বার্তাটির মূল বক্তব্য ছিল এ রকম-পশ্চিম পাকিস্তানির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

২৫ মার্চ, ১৯৭১
সারা বাংলায় যথারীতি অসহযোগ পালনের মধ্য দিয়েই দিনের শুরু হয়। জনসাধারণের সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ, কালো পতাকা ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন অব্যাহত থাকে। এদিন মতিঝিলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা সভা ও মিছিল বের করে। বিকেলে কাজী জাফর আহমদের সভাপতিত্বে শ্রমিক ফেডারেশন ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভা ¯^াধীন জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। রাত আটটায় ঢাকা

বিশ^বিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং রাত ৯টার পর ছাত্র-জনতা ঢাকায় ব্যারিকেড রচনা শুরু করে। বস্তুত এাটা কারো বুঝতে বাকি ছিল না যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনরূপ আগ্রহ ইয়াহিয়া, ভুট্টো বা ইয়াহিয়ার জেনারেলদের ছিল না। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিল মূলত তাদের সামরিক প্রস্তুতিকে শক্তিশালী করার জন্যে। এরই ধারাবাহিকতায় পহেলা মার্চের মদ্যেই রংপুর থেকে ট্যাঙ্কবহর ঢাকা আনা হয়, ১ মার্চ থেকে সেনাবাহিনীর পরিবার পরিজনকে জরুরি ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে, এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরাও তাদের পরিবারবর্গকে পশ্চিমে পাঠাতে থাকে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ইয়াহিয়া ১ থেকে ২৫ মার্চ এই সময়ে সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করে। ইয়াহিয়া খান প্রথমে আশা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ¯^াধীনতা ঘোষণা করবেন এবং সে অজুহাতে বাঙালিদের ওপর সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়া যাবে। সেই উদ্দেশেই তিনি লে. জে. ইয়াকুবের স্থলে জেনারেল টিক্কা খানকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শেক মুজিবুর রহমান তাকে সে সুযোগ না দেয়ায় ইয়াহিয়া অন্য পথ গ্রহণ করেন। তিনি ১৬ মার্চ থেকেঢাকায় আলোচনার অভিনয় করতে লাগলেন। এটা ছিল ইয়াহিয়ার ধাপ্পাবাজি ও কৌশলের একটা অংশ মাত্র।
সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো, ইয়াহিয়া এবং প্রেসিডেন্ট ও পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মদ্যে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অথচ এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে শাসনতন্ত্রের খসড়া চুড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা ও অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা থাকলেও প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জে. এসজিএম পীরজাদা সেটি করেননি। অন্যদিকে শেক মুজিবুর রহমান এদিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাদ্যমে প্রশাসন পরিচালনার জারিকৃত ৩৫টি নির্দেশের কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেন। একই সাথে চট্টগ্রামে ‘সোয়াত জাহাজ’- এর ঘটনার এবং সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সমগ্র প্রদেশে হরতাল আহŸান করেন। তিনি আরো বলেন, এসব কিছু ঘটছে যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ¯^য়ং ঢাকাতে উপস্থিত। এদিন বিকেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সেনানিবাসে যান। রাত ৮টায় তিনি করাচি রওনা হন এবং সেই সাথে সেনাদের দিয়ে যান বাঙালি নিধনের ঢালাও লাইসেন্স। রাত নয়টার মদ্যে গোটা ঢাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে ইয়াহিয়ার ঢঅকা ত্যাগের খবর আগেই পৌঁছেছিল। রাত নয়টার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক

ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, আমাকে হয়তো ওরা হত্যা করতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, আমার সমাধির ওপর একদিন ¯^াধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবেই। এদিকে রাত নয়টার পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের ঢাকা ত্যাগের খবর দিলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, আমি আগামীকাল করাচি ফিরে যাব। রাত ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু সত্যাগ্রহী বাংলার উদ্দেশে বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রমের ওপর কিছু নির্দেশ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু অবশ্য পরিস্থিতি অনেক আগে থেকে আঁচ করতে পারেন। যে জন্য দুপুরের পর থেকেই তিনি নেতা-কর্মীদের যার যার এলাকায় চলে যেতে বলেন।
এদিন সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্যরা সশস্ত্র হয়ে বের হতে থাকে। সেনাবাহিনী বিমানবন্দরে যুদ্ধকালীন অবস্থান গ্রহণ করে। এদিকে ইয়াহিয়ার বিমান ঢঅকা কলম্বো হয়ে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে রাত ১১টায়। এ অবতরণের সংবাদ বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালকের মাধ্যমে ঢাকায় বেতারবার্তা পাঠানো হয়। এবং ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টারস থেকে রাত ১২.৩০ মি. ফরমান পাঠানো হলো ঝঙজঞ ঞণঊগঙটঞ ওমনি ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাক সামরিক বাহিনী ট্যাঙ্ক ও ট্রাকসহ নেমে পড়ে বাঙালি নিধনে। ওদিকে রাত সাড়ে দশটার দিকে ২২ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে এবং ঠিক রাত ১২টায় একটি গুলির শব্দ হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র পিলখানার ওপর ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা আক্রমন চলায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডে ১৮ জন গার্ড থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। ৩নং, ৪নং গেটে এবং বিক্ষিপ্তভাবে ইপিআর বাহিনী প্রতিরোধের চেষ্টা করে কিন্তু পাকিদের পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণে তাঁদের সে প্রতিরোধ ভেঙে যায়। এক পর্যায়ে পাকসেনারা কোয়ার্টার গার্ডসহ সমগ্র পিলখানা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। পিলখানার এই আক্রমণের সাথে সাথে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, শাঁখারীবাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয়ে যায় আক্রমণের পালা। এদিকে জানা যায় রাত ১১টার মধ্যে সেনাবাহিনী পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এবং রাত সাড়ে ১১টায় তারা ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসে। আসার সময় ফার্মগেটের মুখে তারা প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। এখানে তারা লাউড স্পিকারে গোটা ঢাকায় কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীকে বাধা দিলে তারা মেশিনগান দিয়ে নির্বিচার গুলি চালায় ও ডিনামাইট দিয়ে ব্যারিকেড উড়িয়ে দিয়ে শহরে প্রবেশ করে ও শুরু করে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। মোট কথা বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলো। ফলে শুরু হলো যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ¯^াধীন রাষ্ট্র।

সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে। আমার এই ঘোষণা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিন। শত্রæর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলূন।’ বঙ্গবন্ধুর ¯^কণ্ঠে এই ঐতিহাসিক ঘোষণা রা ১২টার পর বেতারে একবার শোনা গিয়েছিল। পিলখানা ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর ¯^াদীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাদ্যমে সারা দেশে ম্যাসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। ঐ সময় চট্টগ্রাম উপক‚লে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই ম্যাসেজ গ্রহণ করে। এ সময় চট্টগ্রাম অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর ¯^াধীনতার ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মদ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। রাত একটার দিকে সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো ইউনিট কর্নেল সাঈদ উদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখাানে প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে পাকসেনারা রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। তারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে শেরেবাংলা নগরস্থ সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে তাঁকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বেগম শেক ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেন, ‘আনুমানিক রাত বারোটা সাড়ে বারোটার পর স্পষ্ট মনে আছে, এ সময় আমি বাঘের মতোই ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম, গো অন চার্জ। এমনভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল সমস্ত বাড়িটা বোধ হয় ধসে পড়বে। ওরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উপরে উঠে এলো। বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সামনে। পরে শুনেছি সৈন্যরা সে সময় তাঁকে হত্যা করে ফেলত যদি না কর্নেল হাত দিয়ে আড়াল করত।’ বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাস থেকে নিয়ে গিয়ে আদমজী কলেজের একটি কক্ষে সকাল পর্যন্ত আটকে রাখে। বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের খবর ৫৭ ব্রিগেডের ‘ব্রিগেড মেজর’ মেজর জাফর বেতারের মাধ্যমৈ জানান। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করতে সক্ষম হন কিন্তু ড. কামাল হোসেন গ্রেফতার হন। এভাবে সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ট্যাঙ্ক মর্টারের গোলার আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়। বাঙালি জাতি সবেমাত্র একটি নতুন অন্ধকার রাজ্যে প্রবেশ করে। একই সাথে এই অন্ধকারের মাঝে উপ্ত হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। এবং পরের দিন নব সুর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূীচত হয় বাঙালির নতুন প্রতিজ্ঞার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ। যে ইতিহাাসের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে বাঙালি জাতিকে আরো ২৭১ দিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল।
[৩৪৩] অমিত কুমার বিশ্বাস।