You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) 104-254 - সংগ্রামের নোটবুক

১০৪

ঘটনা ও ব্যক্তি

আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বংগীয় প্রাদেশিক মুসঅলিম লীগের এক অংশের নেতা ও কর্মিদের এক কনভেনশনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলের নাম ছিল পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ খান; সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক (টাঙ্গাইল); যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান (জেলে অন্তরীণ), খন্দকার মোশ্তাক আহমেদ; এ কে রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবমুর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এ দলের রয়েছে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, যুব ও মহিলা ফ্রন্ট। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। জন্মলগ্নেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহন করে। পাকিস্তান আমলে গোড়ার দিকে দলের প্রধান দাবির মধ্যে ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, একটি সংবিধান প্রনয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্য বিলোপ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য অন্যান্য দলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

এ নির্বাচনে ২৩৭ টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩ টি আসন (আওয়ামী লীগ ১৪৩) ও মুসলিম লীগ পায় ৯ টি। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রদেশে প্রায় দুই বছর ১৯৫৬-১৯৫৮) ক্ষমতাসীন ছিল এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস (১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর) কোয়ালিশন সরকারের প্রধান অংশীদার ছিল। নানা চাপ ও অসুবিধা সত্ত্বেও এই সরকার গুলো বাঙালিদের ন্যায্য দাবীদাওয়া পূরণের প্রয়াস পেয়েছিল। এগুলোর মধ্যে জাতীয় পরিষদে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনে (১৪ অক্টোবর ১৯৫৬) সোহরাওয়ার্দীর সাফল্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্র বিষয়ে বিরাজমান মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে দলে ভাঙনের ফলে আওয়ামী লীগ কঠিন সংকটে পড়ে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী বেশ কিছুকাল ধরে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমত পোষণ করছিলেন। সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমের বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোরাল সম্পর্ক রক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন আর মওলানা ভাসানী ছিলেন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির

১০৫

সমর্থক। আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলনে (৭-৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭) দলে বিভক্তির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এই ভাঙনের ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়।
জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে (১৯৫৮-১৯৬৯) আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে অগ্রসৈনিকের ভুমিকা পালন করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান দলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। এই কর্মসুচির অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাপ্ত বয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকারের সুযোগ সহ কেন্দ্রে সংসদীয় ফেডারেল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা; ফেডারেল ইউনিট গুলোর হাতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ব্যতীত সকল ক্ষমতা অর্পণ; পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা প্রচলন; কর ও শুল্ক সংগ্রহের জন্য ইউনিটগুলোকে ক্ষমতা প্রদান। আইয়ুব সরকার এ কর্মসূচীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শেখ মুজিবুর সহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮) দায়ের করে। ফলে ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলন শুরু হয় এবং আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে।

গন-আন্দোলন ও আইয়ুব পতনের পটভূমিতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইন সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেয়ে আওয়ামী লিগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। দলটি জাতীয় পরিষদের মোট ৭ মহিলা আসনের এবং প্রাদেশিক পরিষদের মোট ১০ মহিলা আসনের সবগুলোতেই বিজয়ী হয়।

আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভের সুবাদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়ার পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। আওয়ামী লীগ ও দলের নেতা শেখ মুজিব ২ মার্চ (১৯৭১) থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে জনগণ তাতে সর্বাত্মক অংশগ্রহন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমনের ফলে কার্যত পাকিস্তানের অখন্ডতা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

১০৬

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্রবাসী সরকার (মুজিবনগর সরকার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং ৯ মাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ দুই মেয়াদকালে মাত্র সাড়ে আট বছরের জন্য ক্ষমতাসীন ছিল। প্রথম মেয়াদে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬-২০০১ সালে। প্রথমবার আওয়ামী লীগকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনের কথিন সমসযা মোকাবেলা করতে হয়। সারাদেশে লোকের বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছিল।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীগ লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে স্নগবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো এবং বিশ্বের ১৪০ টি দেশের স্বীকৃতি লাভ। নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ছিল আওয়ামী লীগের অপর একটি সাফল্য। নির্বাচনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসন লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে ছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় অব্যবস্থা, অবাধ দুর্নীতি দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জনয একটি বেপরোয়া পদক্ষেপ হিসেবে দেশে জরুরী অবস্থা জারি (১৯৭৪) এবং স্নগবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে একটিমাত্র জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ভিত্তিক রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। বাকশাল পদ্ধতি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। এ ব্যবস্থার সংগে যুক্ত হয়েছিল সরকারি পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য পত্রিকা নিষিদ্ধকরণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সীমিতকরণের মত কঠিন আইন।
এই নেতিবাচক ঘটনাবলির সুযোগে কিছু সামরিক অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তার সঙ্গে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের চার শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ,ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের হত্যার ফলে আওয়ামী লীগের উপর আরেকটি বিপর্যয় নেমে আসে। অধিকন্তু ,সামরিক সরকার কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল প্রবিধানের আওতায় দলটি (১৯৭৬) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দলে একটি ভাঙন দেখা দেয়।

১০৭

বিশ শতকের আশির দশকের শুরুতে অবশ্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুণরায় সংগঠিত হতে থাকে। এ দল ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩৯ টি, ১৯৮৬ সালে ৭৬ টি এবং ১৯৯১ সালে ৮৮ আসন পায়। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে অন্যান্য দলের সহযোগী আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ও অবিরাম আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়মী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন করে, তারপর সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং ক্রমাগত হরতাল আহবান করে। এসব প্রয়াসের ফলে বিএনপি সরকার শেষ পর্যন্ত আওয়ামি লিগের প্রধান দাবী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনয়ন করে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচণে আওয়ামী লীগ ১৪৬ টি আসন লাভ করে এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ তারিখে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের নেতৃত্বাধীন চার দলিয় জোটের নিকট ‘পরাজিত’ হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লীগ সরকার যেসব সাফল্য অর্জন করে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি (১৯৯৬) স্বাক্ষর, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) সম্পাদন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিলাদের সরাসরি অংশগ্রহনের ব্যবস্থাসহ নারীর ক্ষমতায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ।
[১২৯] হারুন-অর-রশীদ

আকাশবানী
ভারতের রাষ্ট্রীয় বেতারের নাম আকাশবানী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশবানী স্বাধীনতাকামী বাঙালী জনগোষ্ঠির কাছে একটি জনপ্রিয় বেতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল দুটিঃ এক. পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বেতার কেন্দ্র, অর্থাৎ রেডিও পাকিস্তান থেকে যা কিছু প্রচার করা হত তার সবই ছিল পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রচারণা। দুই. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর, মুক্তিবাহিনীর সাফল্য এবং বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার পক্ষে যা কিছু কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে তার বেশিরভাগই প্রচারিত হত আকাশবানী থেকে। বিশেষ করে আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রের বাংলা খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন ধরণের সাক্ষাতকার ও কথিকা ছিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ এবং সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক বাঙালী ছিন্নমূল জনগোষ্ঠির কাছে প্রধান আশার বাহন। সে কারনেই আকাশবাণী ব্যাপকভাবে বাঙালী জনগোষ্ঠির কাছে জননন্দিত হয়েছিল।

হারুন হাবীব

১০৮

আগরতলা
আগরতলা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় রাজ্য। রাজন্য শাসিত ছিল স্বাধীন ত্রিপুরা কয়েক শতাব্দী ধরে। বঙ্গ ও বাঙ্গালীর সাথে ত্রিপুরার ছিল ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এমনকি বঙ্গেও যখন সরকারি ভাষা হিসেবে বাঙলার প্রচলন হয়নি তখনো ত্রিপুরার সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। এছাড়াও ত্রিপুরা ছিল স্বাধীন ভারতের স্মৃতিধন্য। ১৯৭৪ সালে বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা চলে যাবার পর ভারতের সাথে অঙ্গীভূত হয় ত্রিপুরা।
ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, ত্রিপুরাকেও ঠিক সেভাবে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজ্যের ৯১৭ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৮৩৯ কিলোমিটার বাংলাদেশের সঙ্গে। বাকি ৫৭ কিলমিটার আসাম ও ২১ কিলোমিটার মিজোরামের সঙ্গে।
আগরতলা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত সমর রাজধানী। ঢাকার খুব কাছে বলে এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ত মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ খবর। আগরতলা ছিল এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের ‘ডেটলাইন’। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এই আগরতলাতেই পত্তন ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের। সেই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।
২৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার বুকে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা নির্বিচারে বাঙালী নিধন শুরু করলে প্রথমত ঢাকা এবং পরে অন্যান্য শহর ও গ্রামগঞ্জ থেকে জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার ভয়ার্ত মানুষ দেশ ত্যাগ করে। পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যা থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিকতবর্তী ভারতীয় মাটিতে আশ্রয় নেয় মানুষ। বাঙালী শরণার্থীদের প্রথম ধাক্কা সামলাতে হয় আগরতলা তথা ত্রিপুরাকে।
এক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে, ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দহন কতটা ভোগ করেছিল। ১৯৭১ সালে এই ক্ষুদ্র রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫.৫৬ লক্ষ। কিন্তু অক্টোবর মাসেই ত্রিপুরায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৩.৪২ লক্ষ। পরের মাসগুলোতে এই সংখ্যা বেড়ে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সমান কিংবা তারও বেশি হয়। আগরতলা ও ত্রিপুরার প্রতিটি স্কুল-কলেজ মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধ ছিল। রাজ্যের প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজ, সরকারি অফিস-আদালত এবং ঘরবাড়িতে পর্যন্ত ঠাঁই করে নিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। বিপদের দিনে সত্যিকার বন্ধু-আত্মীয়ের মত ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষকে আগলে রেখেছিল সেদিন।
আগরতলা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এরপর তারা কলকাতাসহ অন্যান্য জায়গায় পাড়ি জমায়। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কর্মকান্ডেরও অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রাথমিক আশ্রয় পেয়েছিলেন আগরতলা তথা ত্রিপুরায়। ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ে পাহাড়ে গড়ে উঠেছিল শরণার্থী শিবির। মুক্তিবাহিনীর কয়েকডজন প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে উঠেছিল আগরতলা ও রাজ্যের পাহাড়গুলোতে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উদার সাহায্য সহযোগীতায় এই শিবির গুলো থেকেই বাঙালী গেরিলা যোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে আগরতলা যুক্ত হয়েছিল আরেকটি প্রসঙ্গেও। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার প্রবল জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কিছু শীর্ষ বাঙালী সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে শুরু করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। পাকিস্তানীরা অভিযোগ আনে, গোপনে আগরতলাতে গিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন, স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু দেশের মানুষ তথাকথিত সেই ষড়যন্ত্র মামলাকে গ্রহন করেনি। বরং এরপর থেকেই পাকিস্তানবিরোধী গণ-আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।

[১৫১] হারুন হাবীব

আজিজুর রহমান মল্লিক, অধ্যাপক (১৯১৮-১৯৯৭)
ড. আজিজুর রহমান মল্লিক একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং শিক্ষাবিদ। এ আর মল্লিক নামেই তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। ১৯১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৪০ সালে ডকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয় থেকে বিএ সম্মান এবং ১৯৪১ সালে এমএ পাশ করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদযালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সে দ্বায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য বক্তব্য প্রদান করেন। যুদ্ধের সময় ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে আশ্রয় গ্রহনকারী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং সাহিত্যিকদের নিয়ে ‘লিবারেশন কাউন্সিল অফ ইন্টেলিজেন্সিয়া’ নামের একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন জহির রায়হান। তিনি ছিলেন সভাপতি। এই সংগঠনের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্নস্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সঙ্গীত পরিবেশন করান। একই সময় কলকাতায় গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’। এই সংগঠনেরও সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে এই সংগঠন মুক্তিযুদ্ধে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। এই বর্ণনা করেছিলেন যে, তখন একজন মহিলা বলে উঠেছিলেন, আমরা যা শুনলাম এরপর আমাদের আর শোনার কিছু রইলনা। আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব। এভাবে তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে সমর্থন লাভের চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ থেকে ‘৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাসচিব, ভারতে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার এবং বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। হাইকমিশনার থাকা অবস্থায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়, পাকিস্তান থেকে বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমীর ফেলো, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।সংগঠনের মাধ্যমে বই, প্রচারপত্র বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেন এবং তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার অভিযান চালান। কলকাতায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই ছিল পাকিস্তানি সমর্থক। তিনি সেখানে এক সমাবেশে বাঙালীর উপর পাক বাহিনীর অন্যসব নির্যাতনের পাশাপাশি নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতনের কাহিনী এমনভাবে অদিতি রহমান

আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল
INSTRUMENT OF SURRENDER
The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender allPAKISTAN Armed Forces in Bangladesh to Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA,General Officer Commanding in Chief of the Indian and Bangladesh forces in theEastern Theatre. This surrender includes all PAKISTAN land, air and navalforces as also all para-military forces and civil armed forces. These forceswill lay down their arms and surrender at the places where they are currentlylocated to the nearest regular troops under the command of Lieutenant-GeneralJAGJIT SINGH AURORA as soon as this instrument has been signed. Disobedience oforders will be regarded as a breach of the surrender terms and will be dealtwith in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision ofLieutenant General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise
১১১

as to the meaning of interpretation of the surrender terms.
Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with provisions of the GENEVA Convention and guarantees the safety and well-being of all PAKISTAN military and para-military forces who surrender. Protection will be providedto foreign nations, ethnic minorities and personal of West PAKISTAN origin by the forces under the command of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA.

(JAGJIT SINGH AURORA) (AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI)
Lieutenant General Lieutenant General
General Officer Commanding Commander Eastern Command
Martial Law Administrator Zone B and in the Eastern Command Treated
in chief India and Bangladesh forces (Pakistan)
16 December, 1971 16 December, 1971

[১৫৩] সংকলন

আব্দুলকুদ্দুসমাখন (১৯৪৭-১৯৯৪)
আব্দুলকুদ্দুসমাখনছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধাএবংরাজনিতিক।১৯৪৭সালের১জুলাইব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়জন্মগ্রহনকরেন।ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়াসরকারিকলেজএবংঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েশিক্ষালাভকরেন।কলেজজীবনথেকেতিনিসক্রিয়ভাবেরাজনীতিতেজড়িয়েপরেন।সত্তরেরদশকেরশুরুতেপাকিস্তানেরসামরিকশাসনেরবিরুদ্ধেপ্রতিবাদআন্দোলনেগুরুত্বপূর্ণভূমিকাপালনকরেন।১৯৬৬সালেরছয়দফাআন্দোলনেওসক্রিয়ভাবেঅংশগ্রহনকরেন।১৯৭০সালেতিনিঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েকেন্দ্রীয়ছাত্রইউনিয়নের (ডাকসু) সাধারণসম্পাদকছিলেন।
১৯৭১সালের১মার্চস্বাধীনবাংলাছাত্রসংগ্রামপরিষদগঠনেঅগ্রনীভূমিকাপালনকরেন।ছাত্রসংগ্রামপরিষদেরএকজনঅন্যতমনেতাহিসেবেঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েরকলাভবনচত্বরে২মার্চস্বাধীনতারপতাকাউত্তোলনকরেন।৩মার্চতিনিএবংছাত্রসংগ্রামপরিষদেরঅপরাপরনেতানূরেআলমসিদ্দিকী, আসমআব্দুররবওশাহজাহানসিরাজশেখমুজিবুররহমানকেজাতিরজনকবলেঘোষণাকরেন।২৩মার্চপল্টনময়দানেস্বাধীনতারপতাকাউত্তোলনওজয়বাংলাস্বেচ্ছাসেবকদেরপ্যারেডেআনুষ্ঠানিকস্যালুটগ্রহনকরেন।প্যারেডেনেতৃত্বদিয়েতিনিওঅন্যছাত্রনেতারাবঙ্গবন্ধুরবাড়িতেগিয়েস্বাধীনতারপতাকাউত্তোলনকরেন।
পূর্বাঞ্চলীয়সেক্টরেরবীরমুক্তিযোদ্ধামাখনছিলেনমুক্তিযুদ্ধেমুজিববাহিনীরঅন্যতমসংগঠক।১৯৭২সালেতিনিছিলেনআওয়ামীযুবলীগেরপ্রেসিডিয়ামসদস্য।১৯৭৩সালেব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়াথেকেজাতীয়সংসদসদস্যনির্বাচিতহন।

১১২

তিনি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
[৭৩] অদিতি রহমান

আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা (১৮৮০-১৯৭৬)
আব্দুল হামিদ খান একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা। সবার কাছে মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সোচ্চার ছিলেন। আসামের ভাসানচরে বাঙালী কৃষকদের বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। ঐ এলাকার লোক তাঁকে ‘ভাসানী সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে তিনি মওলানা ভাসানী নামেও সমধিক পরিচিতি লাভ করেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার ধনপাড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে ভাসানী জন্মগ্রহন করেন। পিতা হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি।
টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদানের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন এবং তাঁর আহবানে বেশকিছু কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
‘৪৭- পরবর্তী সময়ে তিনি পূর্ববাংলায় আসেন। ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মওলানা ভাসানী।
ভাসানীর নেতৃত্বে এ প্রদেশের দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতিবাদে একটি শোভাযাত্রা সচিবালয় অভিমুখে অগ্রসর হলে ভাসানীসহ অনেক নেতা গ্রেফতার হন। ভাসানী কারাগারের অভ্যন্তরে এর প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ১৯৫০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন ও বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং সভাপতি হন। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নেতৃত্বের
১১৩

প্রশ্নে চীনপন্থী ও সোভিয়েতপন্থী এ দুই শিবিরে বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানও দ্বিখন্ডিত হয়। ভাসানী চীনপন্থী অংশের নেতৃত্ব গ্রহন করেন।
তিনি ১৯৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবের মুক্তির দাবি জানান। ‘৭০ নভেম্বরে প্রলয়ঙ্গরী ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য নির্বাচন বয়কট করেন। পাকিস্তানী শাসকচক্রের কেউই ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য না এলে তিনি বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ওরা আসেনি’ অর্থাৎ তিনি এর মাধ্যমে শাসকচক্রের কাছে এদেশের মানুষের গুরুত্ব কেমন তা বোঝাতে চেয়েছেন। ঢাকায় পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি ‘স্বাধিন পূর্ব পাকিস্তান দাবী’ উত্থাপন করেন। এ জনসভায় তিনি পাক শাসকচক্রকে বলেছিলেন ‘ওয়ালাইকুমসালাম’। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন মেনে না নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছেদ সম্পর্কে এ উক্তি বলেন। তাঁর এ দুটো উক্তিই সেসময় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের বীজ বপনে সহায়তা করে। তিনি শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনকে (৩-২৫ মার্চ) সমর্থন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে গমন করেন এবং ২২ জানুয়ারী ১৯৭২ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী’ চুক্তিওর বিরোধীতা করেন। ফারাক্কা চুক্তিকে তিনি বাংলাদেশের পরিপন্থী বলে মনে করেন এবং ১৫ মে ১৯৭৬ রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে এক মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তিনি আজীবন নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন, তাকে সন্তোষে সমাহিত করা হয়।
[৭৩] মোহাম্মদ সেলিম

আব্দুস সামাদ আজাদ (১৯২৬-২০০৬)
আব্দুস সামাদ আজাদ একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। ১৯২৬ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার বুড়াখালি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মো. শফিকতউল্লাহ। ১৯৪৮ সালে তিনি সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও ইতিহাসে লেখাপড়া করেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪০ সালে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৪-১৯৪৮ সালে তিনি সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। ১৯৫৫-৫৭ সালে আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের

১১৪

রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমান দূত ছিলেন। বিশেষ করে ভ্রাম্যমান দূত হিসেবে বিভিন্ন সংশ্লিষ্টদের কাছে এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের বিষয়টি তুলে ধরেন, যা পাকিস্তানীদের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঙ্ঘত করতে সহায়তা করে। স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
[৭৩] অদিতি রহমান

আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি (১৯২১-১৯৮৭)
মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে আবু সাঈদ চৌধুরী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি একাধারে ছিলেন বিচারপতি, রাষ্ট্রপতি ও বুদ্ধিজীবী। জন্মগ্রহন করেন টাঙ্গাইলের নাগবাড়ি গ্রামে। বাবা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার আব্দুল হামিদ চৌধুরী। পড়াশুনা করেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪০ সালে বিএ পাশ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ও আইন পাশ করেন। পরে লন্ডনের লিঙ্গকনস ইন থেকে বার-এট ল ডিগ্রী লাভ করেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, একই সঙ্গে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৪৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের ব্রিটিশ শাখার সভাপতি হন।
১৯৪৭ সালে কোলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা থেকে ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন, সেইসময় পুর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, শাসনতন্ত্র কমিশনের সদস্য কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য জেনেভায় যান। সেসময় পূর্ববাংলায় অসহযোগ আন্দোলনে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ছাত্র-জনতা নিহত হয়। এরই প্রতিবাদে তিনি উপাচার্যের দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতির জন্য জেনেভা থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ শুনে জেনেভা থেকে লন্ডনে আসেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিরূপে লন্ডনে দপ্তর স্থাপন করেন। পৃথিবীর দেশে দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার, গণহত্যা

১১৫

ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবিরণ তুলে ধরেছেন, স্মপন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শত্রুরা তাঁর জীবনের প্রতি হুমকি দিয়েছেন- তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সর্বক্ষণ তাঁকে নজরে রেখেছে। কিন্তু এই অবচলিত শান্ত ও সাহসী মানুষটির ছিল একটি কথা ‘লন্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে তবু পাকিস্তানের সাথে আপস করে দেশে ফিরব না’।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি এ পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সরকারের আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দ্বায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশাল (কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) দলীয় সরকারের বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু সামরিক বাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যের হাতে নিহত হবার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হলে তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মেজর গেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বৈষম্য প্রতিরোধ ও অধিকার সংরক্ষন কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। স্মরনীয় অবদানের জন্য তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেদেশিকোত্তম উপাধি লাভ করেন। ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
[৭৩] দিলরুবা বেগম

আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (১৯৪৪-১৯৯৫)
জন্ম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে লাভ করেম এমএ ডিগ্রী। চট্টগ্রামে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে সাংবাদিক ছিলেন, এরপর সাংবাদিকতা ত্যাগ করে ১৯৭০ সালে যোগ দেন ফটিকছড়ি কলেজে। ১৯৬৪ সাল থেকেই চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গীতিকার ও কথিকালেখক হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (কালুরঘাট, চটতগ্রাম) যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে সন্ধ্যা ৭.১০ মিনিটেই সেই বেতার থেকে তিনিই প্রথম ঘোষণা করেনঃ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবি বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সংবাদাকারে পাঠ করেন। স্বাধীনতার পর যোগ দেন বাংলাদেশ বেতারে কিন্তু ১৯৭২ সালেই তা ছেড়ে দেন। এরপর গণশিক্ষা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৫ সালে প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী আবুল কাসেম সন্দ্বীপ পরলোক গমন করেন।
[৭৩] রয়া মুনতাসীর

১১৬

আমাদের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন বিশেষ করে ও মার্চ রেস্কোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে মুক্তিকামী বাঙালীর নিকট ‘আমাদের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শ্লোগানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ এই সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই শ্লোগানে তারই প্রতিধ্বনি দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি সভা সমাবেশ, মিছিলে এমনকি প্লাকার্ডে, পোস্টারে, দেয়াল লিখনেও এই শ্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এটি গণ মানুষের শ্লোগানে পরিণত হয়।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

আমার দেশ
‘আমার দেশ’ একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন খাজা আহমদ। পত্রিকাটি মুক্তবাংলার কোন এক অঞ্চলে ‘আমার দেশ’ মুদ্রাণালয় হতে মুদ্রিত ও ‘আমার দেশ’ কার্যালয় হতে খাজা আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। পঁচিশ পয়সা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬, কলামসংখ্যা ৩ ছিল। প্রথমসংখ্যা আগস্ট মাসের দিকে প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধের খবর, হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও মুক্তাঞ্চলের খবরাখবরই বেশি প্রাধান্য পেত এ পত্রিকায়। ১১শ সংখ্যা ১১ নভেম্বর, ১৯৭১ ইং (২৪ কার্তিক, ১৩৭৮ বাং) তারিখে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘শান্তির পারাবত’ এবং প্রথম পাতার সংবাদ শিরোনাম ‘মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনে লিচুবাগান ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন, ১৯ জন খানসেনা ও রাজাকার নিহতঃ ৭৩ জন খান্সেনা ও রাজাকার ধৃতঃ বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারঃ বর্বর পাক বাহিনীর বিমান হামলাঃ পরশুরাম থানা হানাদারমুক্ত’ ইত্যাদি ছিল।
১৯৮ হাসিনা আহমেদ

আর্মি অব বাংলাদেশ
উই আর উইথ ইউ
ARMY OF BANGLADESH WE ARE WITH YOU
এতী একটি সমর্থন্মূলক জনপ্রিয় শ্লোগান। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার সরকার মেহেরপুরের মেহেরপুরের মুজিবনগরে শপথ গ্রহন করে। এই সময় কর্ণেল ওসমানীকে প্রধান করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। প্রবাসী বাঙালীরা এই সেনাবাহিনীকে ব্যাপক সমর্থন দান করে। বিশ্ববাসীর নিকট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরিচিত করা এবং সমর্থন আদায় করার উদ্দেশ্যে প্রবাসীরা তাদের

১১৭

বিভিন্ন মিছিলে ও সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহার করে।
[৩৮] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

আমোদ
‘আমোদ’ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা কুমিল্লা থেকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার নামের নিচে ইংরেজিতে THE AMOD লেখা ছিল। ৩০ অগ্রহায়ন ‘৭৭ বাংলা সংখ্যায় প্রকাশিত কিছু সংবাদ শিরোনাম ‘আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কুমিল্লা সফর ও সভা,’ ‘ক্যান্টনমেন্ট বন্দী শিবির হইতে ৩১ টি পরিবারের মুক্তিলাভ’,’কুমিল্লা সোনামুড়া সড়ক উন্মুক্ত’, ‘ঈদ উদযাপিত’ ইত্যাদি ছিল। এই সংখ্যার মূল্য ২০ পয়সা ছিল। পত্রিকার প্রথম প্রকাশ তারিখ ও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
১৯৯ হাসিনা আহমেদ

আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯)
আলমগীর কবির একজন লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক। জন্ম ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে। তাঁর পিতার নাম আবু সাইয়েদ আহমেদ ও মাতার নাম আমিরুন্নেসা বেগম। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি ১৯৫২ সালে গণিতে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। অনার্স পরীক্ষা দিয়ে তিনি লন্ডনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন। এ সময় বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার ইঙ্গমার বার্গম্যান নির্মিত সেভেন্থ সিল পরপর কয়েকবার দেখে চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতেও যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার তাঁকে গ্রেফতার কোরে জেলে রাখে। জেল থেকে বেরিয়েও একবছর তিনি নজরবন্দী ছিলেন।

দেশে ইংরেজী পত্রিকা ‘দ্য অবজারভার’ এ তার সাংবাদিকতা পেশা শুরুন হয়, পরে যুক্ত হন সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকায়। এ সময় অত্যন্ত কঠোর ও বিশ্লেষণধর্মী চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত হন। পরবর্তীতে “হলিডে’ ছেড়ে ‘এক্সপ্রেস’ নামে একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যগ দিয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। ‘আহমেদ চৌধুরী’ ছদ্মনামে তিনি ইংরেজি খবর ও কথিকা পাঠ করতেন। প্রবাসি সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেন, পাশাপাশি চচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি লিবারেশন

১১৮

ফাইটার্স নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ছাড়াও অন্য কয়েকটি তথ্য চিত্রের চিত্রনাট্য, ধারা বর্ণনা রচনা করেন ও কন্ঠ দেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে ন্তিনি বেশ কটি শিল্পমানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চচ্চিত্র হল ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), ‘সূর্যকন্যা’ (১৯৭৬), ‘সীমানা পেরিয়ে’ (১৯৭৭), ‘রূপালী সৈকতে’ (১৯৭৯), ‘মোহনা’ (১৯৮২), ‘পরিনীতা’ (১৯৮৪) ও ‘মহানায়ক’ (১৯৮৫)। আলমগীর কবিরের কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হল লিবারেশন ফাইটার, কালচার ইন বাংলাদেশ, সুফিয়া, অমূল্য ধন, ভোর হল দোর খোল, আমরা দুজন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, ক্ষণিকাঞ্চন ও চোরা স্রোত। আলমগীর কবির বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। এগুলোর মধ্যে ফিল্ম ইন ইস্ট পাকিস্তান, ফিল্ম ইন বাংলাদেশ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে ও মোহনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ধীরে বহে মেঘনা ও দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১ নামে তাঁর দুটি চিত্রনাট্য আছে। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, ‘উত্তরণ’-এর জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, চলচ্চিত্র সংসদ পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
[৭৩] রিয়াজ আহমেদ

আসাদুজ্জামান খান (১৯১৬-১৯৯২)
একজন রাজনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি ১৯১৬ সালে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ও এমএ করার পর ল ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৫ সালে জিডিশিয়াল সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ১৯৫২ সালে ঢাকা জেলা আদালতে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। ধীরে ধীরে রাজনীতির সংগে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে ময়মনসিঙ্ঘ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে পাটমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের ও জাতিয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২১ জানুয়ারি ১৯৯২ ঢাকায় মৃত্যুবরণ কপ্রেন।
[৭৩] মোহাম্মদ সেলিম

ইউসুফ আলী, অধ্যাপক (১৯২৮-১৯৭৮)
অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৯২৮ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহন করেন। জীবনের গোড়া থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ

১১৯

নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) পদে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার উপর ভিত্তি করে, কলকাতায় প্রবাসী সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র (প্রোক্লেমেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স) রচিত হয়। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুজিবনগরের আম্রকাননে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ওই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং সাংবিধানিক পরিষদের চিফ হুইপ হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌম সর্বোচ্চ সংস্থারূপে নবগঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
প্রবাসী মুজিবনগর সরকারে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব লাভ করেন। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন সরকারে হন শিক্ষামন্ত্রী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে একদল বিপথগামী সৈনিক। সেসময় আওয়ামী লীগেরই একাংশ ওই হতযায় সমর্থন জানায় এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার গঠন কোরে। এতে যোগ দেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং অন্যরা। এসব নেতাই ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ) জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়।
মোশতাক-পরবর্তী জিয়ার সামরিক সরকারের অধীনে গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলী বস্ত্রমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন অধ্যাপক ইউসুফ।
[৭৩] সাজিদ হোসেন

ইনোসেন্ট মিলিয়নস
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ১৯ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ইনোসেন্ট মিলিয়নস (Innocent Millions) কাহিনী ও চিত্রনাট্য ছিল বাবুল চৌধুরীর।
Innocent Millions -এর বিষয় ছিল অসহায় শিশুর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, পাকিস্তানীদের সৃষত বর্বরতা। সাধন রায় ছিলেন এ ছবির চিত্রগ্রাহক। এই ছবির ধারা বর্ণনা, লেখা, কন্ঠ দেয়াএবং অন্যান্য বিষয়ে সর্বাত্মক ও সর্বাক্ষণিক সহযোগিতা প্রদান করেন আলমগীর কবির।
[৭৫] শাহীনা সুলতানা

ইন্দিরা গান্ধী (১৯১৭-১৯৮৪)
তাঁকে বলা হত বাংলাদেশের জন্মবেদনা সহ্য করেছেন তিনি। আর এ বেদনা সহ্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে গিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী

১২০

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকে বাদ দিয়ে কখনোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পন্ন হবেনা। একটি জাতির নতুন দেশের জন্মের সঙ্গে অপর একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর শুধু কূটনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে জড়িয়ে যাওয়া নয়, হৃদয় দিয়ে জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিরল। ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে সে ঘটনাই ঘটেছিল।
বিরল এ মানুষটি ভারতের এক মহান পরিবারের সন্তান। এ পরিবারটির নাম কাউল পরিবার। যার চমৎকারত্তবর্ণনা আছে পিতা জওয়াহেরলাল নেহরুর আত্মজিবনিতে। নেহেরু পরিবারটি রাজনৈতিকভাবে সামনে চলে আসে জওয়াহেরলাল নেহরুর পিতা মতিলাল নেহেরু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর থেকে। এই পরিবারের রাজনৈতিকভাবে তৃতীয় অধযায় শুরু হয়, ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে।

ইন্দিরা গান্ধীর জন্ম ১৯১৭ সালে অর্থাৎ রুশ বিপ্লবের সময়। তেমনি তার রাজনৈতিক জীবনও জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের জাতীয় বিপ্লবের সঙ্গে। আর এ বিপ্লবে তিনি তাঁর পাশে পেয়েছিলেন রুশ জনতাকে। এ যেন ইতিহাসের কাকতালীয় এক মহা যোগাযোগ। নিজ দেশের রাজধানীতে ইন্দিরা গান্ধীর বিচরণ ও ব্যাপ্তি বিশাল এলাকাজুড়ে। কিন্তু সে ইতিহাস তাঁর ও তাঁর দেশের মানুষের। বাংলাদেশের প্রিয় মানুষ ইন্দিরার ইতিহাস ১৯৭১ এর ইতিহাস।
১৯৭১ ছিল ভারতের এ তরুন নেত্রীর জন্য এক কঠিনতম বছর। কারন এ বছর তাঁকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে হয়েছিল দেশের তরুনতম নেতা ও বামপন্থীদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে। সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের এই আদি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত তরুনদের নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর দলের এ সময়ের নির্বাচনে অন্তত সে দেশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একটি শ্লোগানের কথা মনে রাখতে হয়, সেখানে শ্লোগান উঠেছিল, ইন্দিরা-মুজিব যুগ যুগ জিও।
এ নির্বাচনে জিতে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা হন তিনি। বলা যেতে পারে তাঁর সেদিনের ওই নির্বাচনে জয়লাভ ও সংসদীয় দলের নেতা হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ঘটনা। কারন ওই নির্বাচনে ভারতে যদি আদি কংগ্রেস বা রক্ষণশীলরা জয়লাভ করত তাহলে হয়ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে সাহায্য পেয়েছিল সেটা পেত না। কারণ ওই রক্ষণশীলরা ছিল রাজনৈতিকভাবে আমেরিকার সমর্থক। তাই স্বাভাবিকভাবে তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াত না। আমেরিকার মত তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা না করলেও একটা সেক্যুলার দেশ গড়ায় নিঃস্বার্থ ত্যাগ স্বীকার করত না। এজনয বলা যায় ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন মিলে যেমন এক বিরাট

১২১

ঐতিহাসিক দিন তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর সংসদীয় দলের নেতা হওয়াও একটা বড় ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৮ মার্চ মন্ত্রীসভা গঠন করার মাত্র ৯ দিন পর ইন্দিরা গান্ধী পালন করেন বাংলাদেশের সপক্ষে তার ঐতিহাসিক সেরা দ্বায়িত্ব। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার মাত্র ১ দিন পরে অর্থাৎ ২৭ মার্চ সে দেশের পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি সমর্থন করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। তাঁর এ সমর্থনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ওই মূহুর্তে পৃথিবীতে আর একা থাকেনা। মাত্র ২৪ ঘন্টার ভিতর ভারতের মত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ানোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নতুন প্রাণ পায়। এ দ্বশের নেতারা দ্রুত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যার একটি ছিল প্রবাসে সরকারের জন্য একটা আশ্রয়। দেশের ভিতর থেকে যে এ সরকার টিকে থাকতে পারতনা তা নয়। কিন্তু তারপরেও এটা ঠিক, সীমান্তে আশ্রয় পেয়ে সেদিন অনেক সুবিধা হয়েছিল। আর এপ্রিলের ১০ তারিখে বাংলাদেশ সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতাকে অস্বীকার করার কোন পথ নেই।

সরকার গঠন করার পরে ওই সরকারের অধীনে প্রায় এক কোটি মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নেয়। এ বিপুল সংখ্যক শরনার্থীর বোঝা সেদিন ভারত সরকারকে বইতে হয়েছিল। জনসংখ্যার ভারে পীড়িত একটা দেশের জন্যে এ বিপুল শরনার্থীর বোঝা বহন করা সত্যিই কঠিন ছিল। এটা কেবল সম্ভব হয়েছিল ইন্দিরার আন্তরিকতা ও নেতৃত্বের কারণে। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে ভারতের জনগণ সেদিন শরনার্থী ট্যাক্স দিতে রাজি হয়। এ ট্যাক্স তাঁদের ৫ বছরের বেশি সময় ধরে দিতে হয়। ভারতের মানুষের অন্য একটি দেশের জন্য এ আত্মত্যাগে রাজি করানো সম্ভব হয়েছিল কেবল ইন্দিরা গান্ধীর মানবদরদি আহবানের কারণে। এবং বাংলাদেশের সমস্যাকে তিনি ভারতের মানুষের একেবারে হৃদয়ের গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলে তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখ এক ভাষণে বলতে পেরেছিলেন ‘পূর্ব বাংলার সমস্যা ভারতের মানুষের সমস্যা।’
ভারতের মানুষকে তিনি যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছিলেন, তেমনি তিনি একাত্ম করতে সমর্থ হয়েছিলেন সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষকে। আর এ কাজে তিনি আদৌ অগোছালোভাবে এগোননি। তৎকালীন দুই পরাশক্তির বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে। ইন্দিরা গান্ধী তাই আগস্টের ৯ তারিখ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করেন ২০ বছরের শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি। এ চুক্তির ফলে শুধু মানসিকভাবে নয় সামরিকভাবে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী অবস্থানে আসে। যার ফলে আমেরিকা-চীন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা কোরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল,

১২২

তারা অনেকটা হাত গোটাতে বাধ্য হয়।
ইন্দিরার এ কূটনীতির কাছে একের পর এক মার খেয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাএক পর্যায়ে এ মহীয়সী নারীকে ‘দ্যাট উম্যান’ বলে গালি দেয়। জওয়াহেরলাল নেহেরুর মেয়ে, রবীন্দ্রনাথ ও হ্যারল্ড ল্যাস্কির ছাত্রী ইন্দিরা এর উত্তরে বলেন, কারো সম্পর্কে ভাষা ব্যবহার তার শিক্ষা ও পারিবারিক কালচারের বিষয়। পরবর্তীকালে সৈয়দ মুজতবা আলী অবশ্য ইয়াহিয়া খানের পারিবারিক পরিচয় দিয়েছেন। ইয়াহিয়া খান বংশগতভাবে কিজিলবাস। কিজিলবাসরা হচ্ছে রাজদরবারের জল্লাদ। তাই জল্লাদ হিসেবে তার ভাষা ঠিকই ছিল।
বাংলাদেশে পরাজয় যখন ইয়াহিয়ার কাছে ক্রমে পরিষ্কার হতে চলেছে এ সময় ইয়াহিয়া তার বড় অস্ত্রটি হাতে নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপন বিচারে ফাঁসি দেয়ার উদ্যোগ নেন। এ ঘটনা জানতে পেরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম চিঠির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতা কামনা করেন বঙ্গবন্ধুর এ প্রহসনমূলক বিচার বন্ধের জন্য। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে ও তারবার্তা পাঠিয়ে ইয়াহিয়াকে বলেন এ বিচার বন্ধ করতে।
এরপর সময় যত এগিয়ে চলে ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পারেন তার জন্য একটা কঠিন সিদ্ধান ত নেবার সময় এগিয়ে আসছে। আর সেটা হচ্ছে সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এইজন্যে প্রথমেই যে দরকার বিশ্বজনমত সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়না দূরদর্শী ইন্দিরার। তাই তিনি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এই তিনমাসের একটা বড় সময় ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন।

এ সফরে তিনি ২৭ অক্টোবর প্রথমে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সফল সফরের পর গুরুত্বপূর্ণ সফর ছিল ইন্দিরার জন্য ২৪ অক্টোবর থেকে তিন সপ্তাহের ইউরোপ ও আমেরিকা সফর। ইন্দিরা গান্ধীর এ সফর বিশ্ব কূটনৈতিক ইতিহাসের এক মাইলফলক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলার নিপীড়িত মানুষের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার এক ঐতিহাসিক সফর। তাঁর এ সফরের ভেতর দিয়ে বিশ্ব জনমত বাংলার মানুষের পক্ষে একাট্টা হয়ে যায়। অসহায় অ প্রায় একঘরে হয়ে পড়ে পাকিস্তান। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ নেয়া তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক চীন ও মুসলিম বিশ্বের কিছু আমেরিকাপন্থী দেশ

১২৩

ছাড়া সেদিন আর কেউ পাকিস্তানের পক্ষে থাকেনা।
বিশ্ব জনমত হারিয়ে অসহায় পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত হিংসার পথ বেছে নেয়। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ৪ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পূর্বখন্ডে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে যুদ্ধ শুরু করেন।
৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশটির জন্য সেটাই ছিল প্রথম স্বীকৃতি। এরপরে মাত্র ১৪ দিনের যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।
আর এ ১৬ ডিসেম্বর আমেরিকার গ্যালপ পোলের অভিমত অনুসারে বিশ্বের সর্বাধিক প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব হন ইন্দিরা গান্ধী।
এরপর গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে বহু টানাপোড়েন গেছে। তাঁর দেশে জেগে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা। আর তারই ছোবলে নিজ দেহরক্ষীর হাতে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রাণ হারান।
[৭৩] স্বদেশ রায়

ইশতেহার
২৬ মার্চ ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সে সময় নওগাঁর তরুন সংগ্রামীরা প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘ইশ্তেহার’। ইশতেহার মাত্র ২ টি সংখ্যা বের হয়েছিল। প্রথমটি ২৭ মার্চ ও দ্বিতিয় সংখ্যাটি ২৮ মার্চে। ফুল স্কেপ সাইজের এক পৃষ্ঠা সাইক্লোস্টাইল করা এ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে কারোরই নাম ছিলোনা। তবে এর প্রকাশনা কাজের সঙ্গে শফিক খান, মইনুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, আজিজুল হক, আফম আলমগীর, আখতার সিদ্দিকী, জহুরুল ইসলাম ইদুল, খায়রুল আলম প্রমুখ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজধানী ঢাকা পাক হানাদারদের আক্রমনের শিকার হলেও নওগাঁ মুক্ত ছিল প্রায় একমাস যাবত। ২২ এপ্রিল নওগাঁ পাকসেনাদের অধিকারে চলে যায়।
[১০] হাসিনা আহমেদ

ইসলাম পছন্দ অন্যান্য দল ও মুক্তিযুদ্ধ
দ্র. মুক্তিযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলন

১২৪

ইয়াহিয়া খানের, ইয়াহিয়া খানের
পতন হোক, পতন হোক
ইয়াহিয়া খান ছিলেন পাকিস্তানের বর্বর প্রেসিডেন্ট। ইয়াহিয়া খান বাংলায় পোড়ামাটি নীতি গ্রহন করে সমগ্র বাংলাজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাতে থাকে। সমস্ত বাংলার এমন কোন জনপদ ছিলোনা যেখানে ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনী ধ্বংস, ধর্ষণ ও গণহত্যার স্বাক্ষর রাখেনি। এরই প্রতিবাদে প্রবাসী বাঙালীরা ইয়াহিয়া খানের পতনের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশ থেকে উপর্যুক্ত শ্লোগানটি ব্যাপক উচ্চারিত হতে দেখা যেত।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

ইয়াহিয়া’স আর্মি, ইয়াহিয়া’স আর্মি
আউট, আউট
Yahya’s Army, Yahiya’s Army Out, Out
পাকিস্তনি বর্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার সেনাবাহিনী সমগ্র বাংলাজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাতে থাকে। ইয়াহিয়া বাংলায় পোড়ামাটি নীতি গ্রহন করায় সমস্ত শহর বন্দর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে থাকে। সমস্ত বাংলার এমন কোন জনপদ ছিলোনা যেখানে ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনী ধ্বংস, ধর্ষণ ও গণহত্যার স্বাক্ষর রাখেনি। এরই প্রতিবাদে প্রবাসী বাঙালীরা ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশ থেকে উপর্যুক্ত শ্লোগানটি ব্যাপক উচ্চারিত হতে দেখা যেত।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

ইয়ুথ ক্যাম্প
১৯৭১ সালে ভারত সীমান্তের পাহাড়গুলোতে গড়ে উঠেছিল শত শত ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’। এই ক্যাম্পগুলোতে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিত সীমান্ত পাড়ি দেওয়া যুব-তারুন্য। এরা সাময়িকভাবে এসব ‘ইয়ুথ ক্যাম্পে’ অবস্থান করত। এখান থেকেই বাছাই হয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হত পালাক্রমিকভাবে। মুজিবনগর সরকার এই ‘ইয়ুথ ক্যাম্পগুলো’ পরিচালনার ভার ন্যস্ত করেছিল সেদিনকার আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক ও জাতীয় সংসদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে। আমার নিজের সুযোগ হয়েছিল মেঘালয় ও আসাম সীমান্তের একাধিক ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ থেকে আগ্রহী যুব তরুনদের বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করানোর। উল্লেখযোগ্য, এসব ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল ভারতীয় পুলিশ ও তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। তবে এগুলো পরিচালনার

১২৫

সার্বিক কর্তৃত্বভার ছিল বাংলাদেশের (অর্থাৎ সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের) নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে।
[১৫১] হারুন হাবীব

উত্তাল পদ্মা
মুহাম্মদ আবু সাঈদ খান ছিলেন ‘সাপ্তাহিক উত্তাল পদ্মা’র সম্পাদক। রোশেমা বেগম কর্তৃক উত্তাল পদ্মা প্রেস, মুজিবনগর হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকাটি প্থম আত্মপ্রকাশ করে ২৪ নভেম্বর, বুধবার ১৯৭১। বাংলার তারিখ অগ্রহায় ৭, ১৩৭৮ এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬, কলমসংখ্যা ৭, মূল্য ২৫ পয়সা ছিল। প্শিত আলোকচিত্র এবং ছাপা ঝকঝকে। যোগাযোগের ঠিকানা ছিলঃ উত্তাল পদ্মা কার্যালয়, মুজিবনগর, বাংলাদেশ আর ভারে যোগাযোগের ঠিকানা ১১৮ ইলিয়ট রোড, কোলকাতা ১৬। প্রথম পাতায় রাজনৈতিক ভাষ্যকারের ‘স্বাধীনতা ব্যতিরেকে রাজনৈতিক সমাধান কল্পনা করাও মহাপাপ,’ নিজস্ব সংবাদদাতার ‘মুক্তিবাহিনীর বৃহত্তম আক্র, যশোর সেনানিবাস ঘেরাও’, ‘শতাব্দীর সূর্য’ বিশেষ নিবিন্ধকার, নিজস্ব সংবাদদাতার সংবাদ শিরোনামিত্যাদি নিইয়ে খবর প্রকাশিত হয়। দুটি সপাদকীয় ‘মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডো’ ও ‘মড়ার পরে খাঁড়ার ঘা’ প্রকাশ পায়।
[২০০] হাসিনা আহমেদ

উনিশ’শ একাত্ত সালে পাকিস্তান সরকার জারিকৃত সামক আইনবিধি
[এসব সামরিক বিধি বিশেষভাবে প্রোযোজ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী অর্থাৎ বাঙালীদের ক্ষেত্রে।]
১. ১ মার্চঃ সামরিক আইনবিধি ১১০
বলা হয়, “পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ছবি, খবর, অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা প্রকাশ থেকে সংবাদপত্র সমূহকে বারণ করা হচ্ছে। এই আদেশ লঙ্ঘন করা হলে ২৫ নং সামরিক শাসন বিধি প্রযোজ্য হবে। এর সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড।”
২. ১০ মার্চঃ সামরিক আইনবিধি ১১৪
এই বিধিতে বলা হয়ঃ “যে কেহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধনের কাজ বা সশদত্র বাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি বা রাস্তা, জলপথ বা নৌযান ব্যবহার, বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহে বাধা প্রদান যাহা দ্বারা সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষন ব্যাহত হইতে পারে- এই ধরনের কার্যকলাপ আক্রমনাত্মক কাজের সামিল যাহা সংশ্লিষ্ট সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।

১২৬

৩. ১৩ মার্চঃ সামরিক আইনবিধি ১১৫
এই বিধিতে বলা হয়ঃ “যে সকল বেসামরিক কর্মচারীকে প্রতিরক্ষা খাত হইতে বেতন দেওয়া হয়এবং এমইএম কম্বাইন্ড ওয়র্কশপ, অর্ডিন্যান্স ডিপো সি এম এল ও এবং সি এম ডি পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার ন্যায় বিভিন্ন প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে হিসেবেই তাঁহারা নিয়জিত থাকুক না কেন তাহাদের সকলকেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকাল ১০ টার মধ্যে তাহাদের স্ব স্ব বিভাগে কর্তব্যকর্মে যোগদান করিতে হইবে। যদি কেহ উপরোল্লিখিত সময়ে তাহার কর্মস্থলে যোগদান করিতে না পারেন তাহা হইলে তিনি চাকরি হইতে বরখাস্ত হইতে পারেন। এই জাতীয় ব্যক্তিকে ফেরারী গণ্য করা হইবে এবং সেই হেতু একটি সামরিক আদালতে তাহার বিচার করা হইতে পারে। এই আদেশ না মানা হইলে তাহা ২৫ নম্বর সামরিক আইনবিধির আওতায় পড়িবে যাহার ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্দের বিধান রহিয়াছে।
৪. ২৫ মার্চঃ লে. জে. টিক্কা খান কর্তৃক ১৫ টি সামরিক আইনবিধি জারি।
১১৭- পূর্ব পাকিস্তানে সবধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ। কেউ কোন ধরনের জমায়ের বা মিছিলে অংশগ্রহন করতে পারবেনা।
১১৮- যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সেন্সরশিপ ব্যতিরেকে কোন বক্তব্য, পোষ্টার বা লিফলেট প্রকাশ করা যাবেনা।
১১৯- পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃংখলা সম্পর্কিত কোন খবর বা মতামত ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরে প্রতিষ্ঠিত সেন্সরশিপ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে প্রচার করা যাবেনা। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন টেলিপ্রিন্টার, রেডিও ট্রান্সমিটার, ব্যাংকসমূহ কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এর আওতাভুক্ত।
১২০- সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে, পিয়াইএ ব্যতিত, চাকরিরত কর্মচারিদের ২৭ তারিখে সকাল ১০ টায় কর্মস্থলে হাজির হতে বলা হয়। যোগদান করতে ব্যর্থ হলে সামরিক কোর্টে বিচার করে চাকরিচ্যুত করা হবে। প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অনুপস্থিত ব্যক্তির তালিকা পেশ করবেন।
১২১- পুর্ব পাকিস্তানের সমুদয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
১২২- কোন বযক্তি কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবেনা। ডিপ্লোম্যাটিক স্টাফ ছাড়া বাকি সবাই নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেবে। এই নির্দেশ সেনাবাহিনীর জন্য প্রযোজ্য নয়। লাইসেন্স পরীক্ষা

১২৭

করার পর মালিককে তার আগ্নেয়াস্ত্র ফেরত দেওয়া হবে।
১২৪- কোন ব্যক্তি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনি গঠনে মদদ যোগাতে পারবেনা।
১২৫- অন্য কারো ক্ষতি হতে পারে সে জন্য কোন ব্যক্তি লাঠি, লোহার রড, রামদা ইত্যাদি বহন করতে পারবেনা।
১২৬- কারফিউ ভাঙার ৭২ ঘন্টার মধ্যে ৫ জন কিংবা তার বেশি লোকের একত্র সমাবেশ নিষিদ্ধ। শুধু ধর্মীয় কারণের জন্য অনুমতি চাওয়া যেতে পারে।
১২৭- পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, শিল্প কারখানায় মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ।
১২৮- সামরিক কর্তৃপক্ষের পুর্ব অনুমতি ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অথবা বসবাসরত কোন বিদেশী প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কাউকে কোন অস্ত্র দিতে পারবেনা।
১২৯- কোন ব্যক্তি ঘেরাও, জ্বালাও অথবা রাষ্ট্রবিরোধী কোন কাজে ইন্ধন যোগাতে পারবেনা। পুলিশ, ইপিআর কিংবা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থার মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারবেনা।
১৩০- কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার দ্বারা গঠিত সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ যেকোন জায়গায় দোকান, বাড়ি ইত্যাদি অস্ত্র বা প্রচারপত্র, পোষ্টার ইত্যাদি খোঁজার জন্য তল্লাশি করতে পারবেন।
১৩১- সাইক্লোস্টাইল বা রিপ্রডাকশন মেশিনের মালিকদের এই নোটিশ ইস্যু হবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সামরিক সদর দফতরে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এসব আদেশ অমান্যকারীদের ২৫ নম্বর সামরিকবিধি অনুযায়ি বিচার করা হবে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড।
৫. ২৬ মার্চ সামরিক আইনবিধি ১৩২, ১৩৩ ও ১৩৪
টিক্কা খান জারিকৃত এসব বিধি বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রবর্তিত নির্দেশাবলি (Directives) সম্পর্কিত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং ব্যাংক সমূহের কর্মচারিদের যথানিয়মে কাজে যোগদান করা, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ব্যাংকে আওয়ামী লীগের অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা।
৬. ২৯ মার্চ- সামরিক আইনবিধি ৭৬ ও ৭৭
সামরিক আইনের এই দুইটি বিধি জারি করে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয় অ সংবাদপত্রের ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়।
৭. ৭ এপ্রিল- সামরিক আইনবিধি ১৩৭

১২৮

টিক্কা খানের জারিকৃত এই বিধি ছিল অফিসার ও প্রশাসক নিয়োগ সম্পর্কিত।

৮. ১০ এপ্রিল- সামরিক আইনবিধি ৭৮
পাকিস্তানের প্রেওসিডেন্ট কর্তৃক জারিকৃত এই সামরিক আইন বিধিটি ছিল ব্যক্তিবিশেষের রাষ্ট্র সম্পর্কে আচরণ সম্পর্কিত।
৯. ২৭ এপ্রিল- সামরিক আইনবিধি ১৪৮

এই বিধিতে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
১০. ৩ জুন- সামরিক আইনবিধি ১৪৯
টিক্কাখান কর্তৃক জারিকৃত এই সামরিক আইন বিধি ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলাসম্পর্কিত।
[১৪২] সেলিনা হোসেন

উনিশ’শ একাত্তর (১৯৭১) সালের ২৬ মার্চ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণ
আসসালামু আলাইকুম।
এ মাসের ৬ তারিখে আমি জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের নতুন তারিখ ২৫ মার্চ ঘোষণা করেছিলাম। আমার আশা ছিল নির্ধারিত তারিখে অধিবেশন বসার পরিবেশ অনুকূল হবে। কিন্তু ঘটনাবলী সে আশা পূর্ণ করেনি। জাতি গভীর সংকট মোকাবেলা করে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছে এবং পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। ঘটনাবলী খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে এবং যত শীগগির সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অবশ্যই জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এ উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আমার অনেকবার সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৫ মার্চ আমি ঢাকা গমন করি। আপনারা সকলে জানেন যে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনার পর একইভাবে সেখানে আলোচনার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, যাতে সর্বজন গ্রহনযোগ্য বিষয় চিহ্নিত করে একটি সমঝোতায় পৌঁছা যায়।
আমার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনার কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তা সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার আলোচনে একটি পর্যায়ে পৌঁছালে আমি প্রয়োজন মনে করলাম যে, ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা করা উচিত।

১২৯

জেড এ ভুট্টো ২১ মার্চ সেখানে পৌঁছালে তার সাথে আমাদের একাধিক আলোচনা হয়। আপনারা জানেন আওয়ামী লীগের নেতারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানায়। আমাদের আলোচনাকালে তিনি প্রস্তাব করেন যে, অন্তর্বর্তী ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে হবে এবং জাতীয় পরিষদে দুটি কমিটি হবে- একটি কমিটি গঠিত হবে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের দ্বারা ঈবং আর একটি গঠিত হবে পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের নিয়ে।
এই পরিকল্পনায় আইনগত ও অন্যান্য বিষয়ে গুরুতর অনিয়ম থাকা সত্ত্বেও শামতিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থে আমি নীতিগতভাবে একটি শর্তে এ প্রস্তাব গ্রহনের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমি শর্তগুলো শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলাম যে, সকল রাজনৈতিক দলের আমার সাথে এ পরিকল্পনায় ঐকমত্য পোষণ করতে হবে। তারপর আমি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে প্রস্তসবটি নিয়ে আলোচনা করলাম। ঘোষণার কোন আইনগত ভিত্তি থাকবেনা- এ ব্যাপারে তাদের একমত পোষণ করতে দেখলাম। তাতে সামরিক আইনের আবরণও থাকবে না, অন্যদিকে জনগনের ইচ্ছার ভিত্তিতে করা হয়েছে- তাও বলা যাবেনা। ফলে এক শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং নিশ্চিত একটি গোলযোগপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তারা আরো মনে করেন যে, ঘোষণার দ্বারা জাতীয় সংসদকে দুইভাগ করলে তা বিভক্তিকে উৎসাহিত করবে। সুতরাং তারা মরপ্রকাশ করেন যে, যদি অন্তরবর্তীকালে সামরিক আইন প্রতযাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয় তাহলে জাতীয় সংসদ অধিবেশন ডাকতে হবে। অন্তর্বতীকালের জন্য সঠিক শাসনতন্ত্র বিল পাশ করে আনার সম্মতির জন্য পেশ করতে হবে। আমি তাদের মতের সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করেছি এবং তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
আমি নেতাদের তাকে বোঝাতে বলেছি যে, একটি পরিকল্পনা দ্বারা একদিকে আপনি সকল ক্ষমতা- তথা সামরিক আইন তুলে নিতে বলছেন, অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে জনগনের ইচ্ছের দ্বারা তা পূরণে ব্যর্থতার ফলে গোলযোগ সৃষ্টি হবে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং জাতীয় সংসদ থেকে সৃষ্ট ক্ষমতার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থায় তার সম্মতি আদায় করার জন্য চেষ্টা করবেন।
শুরু থেকে শেখ মুজিবের জাতীয় সংসদ কে দুই ভাগ করার প্রস্তাবে রাজনৈতিক নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা উপলব্ধি করেন যে, এ পদক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে যাবে। আমার, ভূট্টো এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনাকালে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান তার নিকট একটি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সেখানে নেতারা শেখ মুজিবের নিকট আলোচনার জন্য

১৩০

গিয়েছিলেন। তারা ২৩ মার্চ বিকেলে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে সংবাদ দেন যা, তার (শেখ মুজিব) পরিকল্পনার কোন পরিবর্তন করতেব তিনি সম্মত নন। তিনি আমার নিকট যা চেয়েছেন তা হল আমি ঘোষণা (Proclamation) দিয়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করি।
শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন হল দেশদ্রোহিতা। তিনি ও তার দল বৈধ কর্তৃপক্ষকে তিন সপ্তাহব্যাপী উপেক্ষা করেছে। তারা পাকিস্তানের পতাকাকে তিরস্কার করেছে এবং ব্জাতির জনকের ছবি কলঙ্কিত করেছে। তারা বিকল্প সরকার পরিচালনার চেষ্টা করেছে। তারা গন্ডগোল, ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
আন্দোলনের ফলে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মিলিয়ন মিলিয়ন বাঙালী ভাই এবং যারা পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপন করেছে তারা জীবনের ভয়ে সে অঞ্চল ত্যাগ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সকল প্রকার তিরস্কার ও টিটকারির শিকার হয়েছে। প্রচন্ড উস্কানি সত্ত্বেও তারা অসম্ভব ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে- এজন্য তাদের আমি প্রশংসা করছি। তাদের শৃঙ্খলাবোধ বাস্তবিক প্রশংসার দাবী রাখে। আমি তাদের জন্য গর্বিত।
কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু আমি পরিস্থিতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি যাতে আমার শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা রুদ্ধ হয়ে না যায়। এ লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে আমি অবৈধ কাজ একের পর এক সহ্য করেছি। একই সময় একটি যুক্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছার জন্য সকল সম্ভাবনাময় পথের সন্ধান করেছি। আমি যে সকল চেষ্টা করেছি তা রাজনৈতিক নেতারা- যেমন মুজিবুর রহমানকে যুক্তি দেখাবার জন্য যা করছে তার উল্লেখ করেছি। আমরা কোন চেষ্টা অবশিষ্ট রাখিনি। কিন্তু তিনি কোন গঠনমূলক কাজে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে তিনি এবং তার অনুসারীরা সসরকারের কর্তৃত্বকে এমনকি ঢাকায় আমার উপস্থিতকালে উপেক্ষা করে আসছেন। তিনি যে ঘোষণার প্রস্তাব করেছেন তা একটি ফাঁদ ছাড়া কিছুই নয়। তিনি জানতেন, যে দলিল লেখা হবে তার কোন মূল্য নেই। তিনি জানতেন যে, সামরিক আইন তুলে নিলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে সেখানে কোন প্রকার শাস্তি ছাড়া তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন। তার একগুঁয়েমি, দুর্দমনীয়তা এবং যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতিতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব এবং তা হল, এই লোকটি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি এদেশের সংহতি ও অখন্ডতাকে আক্রমন করেছেন। তার অপ্রাধের জন্য অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে। ক্ষমতালোভী একদল এবং দেশপ্রেমহীন নেতাদের এদেশকে ধ্বংস করতে এবং ১২০ মিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে দেওয়া যায়না।

১৩১

৬ মার্চ জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্তব্য হল পাকিস্তানের সংহতি, অখন্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমি তাদের দ্বায়িত্ব পালনের এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছি। দেশে বিরাজমান সংক্টময় পরিস্থিতির কারণে আজ আমি সারাদেশে রাজনৈতিক কাজকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হল রাজনৈতিক দল হিসেবে এ দলকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হল। আমি সংবাদপত্র সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছি। এ সকল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই সামরিক বিধি জারি করা হবে।
সর্বশেষে আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে আমার উদ্দেশ্য একইরকম বহাল থাকবে। যখনই পরিবেশ অনুকূলে আসবে তখন এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নব উদ্যোগ গ্রহন করব। আমি আশা করি শীগগির পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। এবং আমরা পুনরায় আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে যাত্রা করতে পারব।
আমি আমার দেশবাসিকে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য অনুরোধ করেছি। এ জন্য পাকিস্তান বিরোধীরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দোষী। দেশের দ্বায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাজ করার জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি। কারণ সেখানে নিরাপত্তা ও যুক্তি নিহিত আছে।
খোদা সহায় হোক, খোদার আশীর্বাদ আপনাদের জন্য-
পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ” [বাংলা অনুবাদ]
[১৩৬] সিরাজউদ্দীন আহমেদ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের পোস্টার
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর গণহত্যা চালায়। তারা বাঙালীর স্বাধীনতার দাবী অস্ত্রের মুখে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু বাঙালীরা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ ছিল দুই ধরনের। ক. সামরিক খ. প্রচারণামূলক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানূভূতি ও সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধির জন্য দুই প্রকারের প্রতিরোধ আন্দোলন চালানো হয়। এই প্রচারণা চালানো হত স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দীপনা মূলক অনুষ্ঠান, রনাঙ্গণে সাফল্যের সংবাদ, গণহটযা, আন্তর্জাতিক সমর্থনের সংবাদ প্রচার ও বিভিন্ন ধরনের

পোষ্টার প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময় কতোগুলো পোষ্টার প্রকাশ হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়না। তবে যতগুলো পোস্টার সংগৃহীত আকারে পাওয়া গেছে সেগুলো তিন ধরনের। ১. বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ

১৩২

থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত, ২. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ৩. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল বিদেশী ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক মুদ্রিত। [বিভিন্ন পোস্টার নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে]
[৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

উপ-নির্বাচন ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইয়াহিয়া সরকারের প্রহসনের মালেক মন্ত্রীসভা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য জাতীয় পরিষদ উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের ৭৮ টি আসনের মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ৫৮ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাকি ২০ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দেয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সদস্যদের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী ৫৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ১৫ জন, পিডিপির ১২ জন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ৭ জন, কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগের ৭ জন, নেজামে ইস্লামীর ৬ জন, পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের ৬ জন ও বাকি ৫ জন পিপিপির সদস্য।
নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার প ১ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার ফলে পাকিস্তান নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করার চেষ্টা করে। নির্বাচন কমিশন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে বলা হয় যুদ্ধের কারণে নির্বাচন কমিশন পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রাদেশিক ও জাতিয় পরিষদের বাকি আসন গুলোতে উপনির্বাচন স্থগিত করেছে। উক্ত নির্বাচন ৭-২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল।
[৭৩] হাবিবা ইসলাম বিভা

এ এইচ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (১৯২৬-১৯৭৫)
জমিদার পরিবারে জন্ম তাঁর। সাল ১৯২৬। বিত্ত বৈভব আর আভিজাত্যের মাঝে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষের সাথে দূরত্ব থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটবেলা থেকে জমিদারবাড়ির এ ছেলেটি ছিল একটু অন্যরকম, পরিবারের আর সবার চেয়ে আলাদা। গরীব দুঃখীর কষ্ট তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। এ দেশের নিপীড়িত, লাঞ্চিত বাঙালীর দুর্দশা তাঁকে অস্থির করে তুলত। কেবলই ভাবতেন কিভাবে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। স্বপ্ন দেখতেন মুক্ত স্বাধীন একটি দেশের। আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু স্বাধীন দেশের মাটিতে খুব বেশিদিন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া হয়নি তাঁর। সশস্ত্র বাহিনীর একদল কাপুরুষের হাতে ১৯৭৫ সনে নিহত হন। তিনি আবুল হাসনাত

১৩৩

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। কামরুজ্জামান নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। জাতীয় চার নেতার একজন তিনি। বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্থপতিদের একজনও বটে। বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর দান অপরিসীম।
বাঙালী জাতীয়তাবোধ সুতীব্র ছিল তাঁর ছাত্রবয়স থেকে। যে কারণে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সস্নাতক এবং ১৯৫৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল পাশ করেন। এরমাঝে ১৯৪২ সালে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি হন তিনি। ১৯৫৬ তে রাজশাহী আদালতে আইন ব্যবসায় যোগ দেনএকইবছর রাজশাহী মিউনিসিপালিটির কমিশনার নির্বাচিত হন।
মানসিকভাবে কামরুজ্জামান ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশিল। বাঙালী সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রগতিশীল রাজনীতি বেছে নেবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে ১৯৫৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। নিজ দলের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রান ব্যক্তি। আর এ করণে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত টানা ৯ বছর রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ এর এপ্রিল মাসে প্রথমবার এবং ১৯৬৫ এর মার্চ মাসে দ্বিতীয়বার রাজশাহী থেকে

মৌলিক গণতন্ত্রের প্রথায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ এবং ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদে সম্মিলিত বিরোধী দলের সম্পাদক হিসেবে গুরুদ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহবায়ক এবং ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
এ সময় আইয়ুব সরকারের নির্যাতন বেড়ে গেলে তার প্রতিবাদে ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবীর সমর্থনে ১৯৬৯ এর ১২ ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলন চলাকালে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট মীমাংসাকল্পে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে অংশগ্রহন করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে রাজশাহী ৬ আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগরে গমন করেন। একইবছরের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। যুদ্ধের ৯ টি মাস স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ এর ২৩ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র, সাহায্য

১৩৪

ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ত্রান ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত বানিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে রাজশাহী ১০ ও রাজশাহী ১১ আসন থেকে জাতিয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ এর ১৮ জানুয়ারি তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছরের ২০ জানুয়ারী কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রীও হন তিনি। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। একই বছরের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর একটি দল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে হত্যা করে। এর ফলে মন্ত্রীত্ব হারান তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কারুজ্জামানকে মন্ত্রী হবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মী কামরুজ্জামান

সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে মোশতাক সরকার তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কারাবন্দী চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মন্সুর আলি এবং কামরুজ্জামান ছিলেন মীরজাফর মোশতাকের আতঙ্কের কারণ। কারন তিনি জানতেন এ চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখলে স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের তাঁবেদার রাষ্ট্র বানানো সম্ভব হবেনা, তিনিও রাষ্টপ্রধান হিসেবে টিকে থাকতে পারবেন না। সে কারণে কারাগারের প্রচলিত নিয়ম উপেক্ষা করে জেলে বন্দী থাকা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেন তার সরকাআরের সঙ্গে হাত মেলানো একদল উচ্চাকাঙ্খী সেনাসদস্যের মাধ্যমে।
[৭৩] অদিতি রহমান

এ. কে. এম. সামসুল হক খান (-১৯৭১)
একেএম শামসুল হকের জন্ম টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার পাকুরিয়া ইউনিয়নের আখতারাইল গ্রামে।

তাঁ পড়াশুনা গ্রামেরই আখতারাইল এস ই স্কুলে আরম্ভ হলেও তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ঢাকার আরমানিটোলা গভমেন্ট স্কুল থেকে। ১৯৫২ সালে তিনি যখন ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেন তখন তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র। তিনি কৃতিত্বের সাথে ১৯৫৮ সালে এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে। তাঁর বিষয় ছিল ভূগোল।
পেশাগত জীবনে তিনি তার দক্ষতার প্রতিফলন দেখিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে। তিনি রাজশাহী গভ. কলেজে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হবার পর সিএসপি হিসেবে তিনি রাজশাহী, হবিগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বানিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব

১৩৫

হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে তাঁর দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশের প্রতি তার দ্বায়িত্ব পালন করা থেকে পিছু হটে যাননি। কুমিল্লার পুলিশ সুপার শহীদ মুন্সি কবিরউদ্দীনের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন সুদৃঢ় প্রতিরোধ।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ শামসুল হককে পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে প্রচন্ড অত্যাচারের পর হত্যা করে।
[৭৩] রয়া মুনতাসীর

এ ক্রাই ফর হেল্প
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বম্বের বাংলাদেশ এইড কমিটি এই বিখ্যাত পোস্টারটি প্রকাশ করে। পোষ্টার টি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃক মানবতা বিবর্জিত ঘৃণ্য কাজ বিশ্বমানবতাকে প্রশ্নের সম্মুখিন করে তলে। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজতর হয়। দুর্দশাগ্রস্ত বাঙালি শরনার্থী ও বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের আবেদনের জন্যেই এই পোস্টার টি প্রকাশ করা হয়। এই পোস্টারটি দেশে ও বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় এই পোস্টারটি মুক্তিযোদ্ধা ও অবরুদ্ধ বাঙালীদের মধ্যে উৎসাহ যোগাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এ স্টেট ইজ বর্ণ
মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানের পরিচালনায় নির্মিত হয় ১৯ মিনিটের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এ স্টেট ইজ বর্ন ( A State is Born)। ছবিটির কাহিনী ও চিত্রনাট্যও তিনি রচনা করেছিলেন। তাঁর A State is Born এর বিষয় ছিল জাতীয় ইতিহাসকে তুলে ধরা অর্থাৎ এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের গঠন ও কর্মকান্ড। ছবিটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন অরুণ রায়। ছবিটির ধারা বর্ণনা, লেখা, কন্ঠ দেওয়া এবং অন্যান্য বিষয়ে সর্বাত্মক ও সার্বক্ষনিক সহযোগিতা প্রদান করেন আলমগীর কবির।
[৭৫] শাহীনা সুলতানা

এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে
৫১ সেন্টিমিটার পরিমাপের ঐতিহাসিক পোস্টারটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালিন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এটি বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান অংকিত একটি প্রতীকধর্মী

১৩৬

পোস্টার। ইংরেজীতে প্রকাশিত পোস্টারটিতে ‘Annihilate these demons’ লিখিত আছে। এই পোস্টারটিতে যে ছবির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় তা মূলত কুখ্যাত গণহত্যাকারী বাঙালীর নিপীড়নকারী, নারী নির্যাতনের হোতা ইয়াহিয়া খানের বিকৃত ছবি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া অপারেশন সার্চলাইট নামে পোড়ামাটিনীতি গ্রহন করে বাঙালীর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। তার হানাদার বাহিনী গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা চালায়। এতে ইয়াহিয়া খানের কুৎসিত মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। শিল্পী কামরুল হাসান বাঙালী তথা বিশ্ব মানবতার সামনে শিল্পীর রং তুলিতে ইয়াহিয়ার কুৎসিত বীভৎস ছবি অংকন করেন। তাঁর এই অঙ্কিত ছবিই পোস্টার আকারে প্রকাশিত হয়। এর ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বে তার কুৎসিত কদাকার মানসিকতার প্রকাশ ঘটে এবং সমগ্র বিশ্বে সে নিন্দিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ছবিতে সাদা ও কালো রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তবে পোস্টারটির ছবিতে কালো ও লাল রঙের ব্যবহারই মুখ্য। কালো রঙ ইয়াহিয়ার দানব প্রকৃতি এবং কুৎসিত মানসিকতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। লাল রং রক্তপিপাসু ইয়াহিয়ার ঠোঁট, জিহবা, চোখ ও কানে ব্যবহার করা হয়েছে। লালরঙের ব্যবহার দেখে মনে হয় এই রক্তপিপাসু জানোয়ার কোন নিষ্পাপ বাঙালীর রক্ত পান করেছে, আর উন্মত্ততা নিয়ে রক্তচক্ষু লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রতিবাদ বা রক্তের বদলা রক্তে নেয়ার ভাষা বোঝাতে লেখা গুলোতে লাল রঙের ব্যবহার হয়েছে। পুরো পোস্টারটির জমিনে সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়েছে শান্তিপ্রিয় বাঙালীকে বোঝানোর জন্য। এই পোস্টার দেশে বিদেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং গোটা বিশ্ব বিবেক ইয়াহিয়াকে ঘৃণার চখে দেখতে থাকে।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এক একটি বাংলা অক্ষর/এক একটি বাঙালীর জীবন
৫০গুণন ৩৫.৫০ সেন্টিমিটার পরিমাপের এই পোস্টারটি বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে ১৯৭১ সালে প্রকাশ করা হয়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি

অংশগ্রহনের জন্য বাঙালী হৃদয়কে আন্দোলিত করার ক্ষেত্রে পোস্টারটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি একবার যখন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সফল হয়েছে ৭১ এ এসেও বাঙালী সফল হবে, তবে আন্দোলনে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া পোষ্টারটিতে আরেকটি বিষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো, যারা আমাদের ভাষার শত্রু তারা আমাদের জীবনের শত্রু, তারাই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের শত্রু। অতএব এই শত্রুরা যদি বিজয়ী হয় তবে আমাদের নিশ্চিত মৃতযু। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের

১৩৭

মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার দীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে এবং এতেই বিজয় আসবে। পোস্টারটিতে লাল ও সবুজ রঙ আমাদের জাতীয় পতাকার রঙের সাথে সাযুজ্য রেখে ব্যবহার করা হয়েছে।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এক নেতার এক দেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ
এই শ্লোগানটি শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ছয়দফা ঘোষণার পর থেকেই জনপ্রিয় হতে থাকে তবে ‘৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে মুক্তিকামী বাঙালীর নিকট এই শ্লোগানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্লোগানে পরিণত হয়। প্রতিটি সভা সমাবেশে, মিছিলে এমনকি প্ল্যাকার্ডে, পোস্টার ও দেয়াললিখনেও এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এটি সেই সময় গণমানুষের শ্লোগানে পরিণত হয়।
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এক রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিট
এক টাকা মূল্যমানের ডাক টিকিটটি মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যবহৃত স্বাধীন বাংলার পতাকার ছবি সংবলিত। ডাক টিকিটটির উপরের অংশে বাংলাতে ‘বাংলা দেশ’ এবং ইংরেজীতে ‘BANGLADESH’ লেখা ছিল। দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা এবং ডানপাশে কোনায় জং.১ লেখা আছে। ডাকটিকিটটিতে বাংলায় বাংলাদেশ শব্দটি বাংলা দেশ এবং ইংরেজীতেও BANGLA DESH দুই শব্দে লেখা আছে। কারণ হিসেবে বলা যায় ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাসে ‘বাংলাদেশ’ নিউজলেটারের প্রতিষ্ঠাতা জনাব তাসাদ্দুক হোসেন মুজিবনগর সরকারের নিকট একটি ইংরেজী বুলেটিন পান সেই বুলেটিনের শীর্ষে BANGLA DESH দুই শব্দে লেখা ছিল। এই কারণে ডাকটিকেটে এই শব্দ দুটি আলাদা ছাপানো হয়। পরে অবশ্য মুজিবনগর সরকার এটি পরিবর্তন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্ত এবং লাল বৃত্তের উপর সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি। নিচে মাঝখানে লেখা FLAG OF INDEPENDENCE এই ছবি ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুইটি। প্রথমত, প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের একপ্টি নিজস্ব পতাকা থাকে, বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন দেশ ডাকটিকেটে দৃশ্যমান তার নিজস্ব পতাকা তারই প্রমান বহন করে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন বাংলার পতাকার সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচিত করানো। মূলত এটি ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। ডাকটিকেটের আন্তর্জাতিক গতিশীলত বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিতি প্রদান ও গ্রহনযোগ্য করে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
[৩৫, ৫০১] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

১৩৮
ঘটনা ও ব্যক্তি
একাত্তরেরমুক্তিযুদ্ধ
পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাত্তর সালের ষোলই মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত বাঙ্গালি নেতাদের সাথে আলোচনার ধাপ্পা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২৫ মার্চ দিনশেষে বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যা অভিযান শুরু করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোও তার অনুসারী হন।পঁচিশে মার্চ মধ্যরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে এবং পরে পাকিস্তান নিয়ে যায়।একই সময়ে পাকিস্তান স্থল,বিমান ও নৌবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙ্গালি জাতির উপরে।এই সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া অথবা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালিদের একটি দাসরাজ্য ও ক্রীতদাস জাতিতে পরিণত করা।কিন্তু বাঙ্গালি রুখে দাঁড়ায়,বাঙ্গালি অস্ত্র ধারণ করে।গ্রেফতারের পুর্বে পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসযোগে স্বাধীনতা ঘোষণার বানী প্রেরণ করেন এবং তা চট্টগ্রাম বেতার থেকে ২৬মার্চ প্রচার করেন জনাব এমএ হান্নান। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ সর্বাগ্রে প্রচার করে ভারতীয় বার্তা সংস্থা ইউএনআই।সংবাদটি ১৯৭১ সালের ২৭মার্চ দিল্লিস্থ statesman পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।Bangladesh documents. Vol.I P 23-284 এ সংকলিত এ সংবাদটি আমরা উদ্ধৃতি করছি,
Bangladesh declares freedom; Raman’s step Follows Army Crackdown; Pakistan’s Eastern wing rechristened the independent state of Bangladesh by Sheikh Mujibur Rahman in a clandestine radio broadcast….. Speaking over “Swadhin Bangla” (Free Bengal) Betar Kendra, Mr. Rahman later proclaimed the birth of an independent Bangladesh. Mr. Rahman said; Pakistan armed Forces suddenly attacked the East Pakistan Rifles base at Peelkhana and Rajarbagh polish station in Dacca at zero hours on March 26.Killing a number of unarmed people. Fierce fighting is going on with East Pakistan Rifles at Dacca people are fighting gallantly with the enemy for the cause of freedomof Bangladesh.Every section of the people of Bangladesh are asked to resist the enemy forces at any cost in every corner of Bangladesh. May Allah bless you and help you in your struggle for the freedom from enemies. Joy Bangla.
একাত্তরে বাঙ্গালির প্রতিরোধ সংগ্রামে তথা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিভিন্নন সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন- চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সেক্টরে মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন রফিক, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল সেক্টরে মেজর সফিউল্লাহ,কুমিল্লা ও সিলেট সেক্টরে মেজর খালেদ মোশাররফ,কুষ্টিয়া ও যশোরে সেক্টর মেজর

১৩৯

ওসমান,ফরিদপু্‌বরিশাল ও পটুয়াখালী সেক্টরে মেজর জলিল,রাজশালী সেক্টরে মেজর আহমদ, সৈয়দপুর ও রংপুর সেক্টরে মেজর নজরুল ও মেজর নওয়াজেশ।মুক্তিযুদ্ধে পুর্বাঞ্চলের সেনাপতিরা ৪ মার্চ ১৯৭১ সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে কর্নেল ওসমানী ও কর্নেল রবের সঙ্গে এক গুরুত্বপুর্ন সভায় মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল সম্পর্কে গুরুত্বপুর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র
চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন সম্পর্কে চট্টগ্রাম বেতারের সংবাদ পাঠক এবং স্বাধীনতার পুর্ব চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মোঃ সুলতান উল আলম লিখিত দৈনিক আজকের কাগজে ২.১১২.৯১ তারিখে প্রকাশিত “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন” শীর্ষক নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি করছি-
এমনকিছুস্মৃতিআছেরক্তঝরায়, অনেকসময়তাআনন্দসৃষ্টিকরে।মনেহয়আমারজীবনেরএকটিপরমসৌভাগ্য,স্বাধিনবাংলাদেশেরআবির্ভাবলগ্নেএকজনমেডিক্যালছাত্রএবংবেতারেরঅনুষ্টানঘোষকহিসেবেস্বাধীনতারপ্রথমবানীপাঠকরারসৌভাগ্যঅর্জনকরেছিলাম।
অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে এমন সময় ২৬ মার্চ দুপুরবেলায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হটাত করে শোনা গেল একটি বলিষ্ট কণ্ঠ। স্বাধীনতার বাণী পাঠ করলেন জনাব আব্দুল হান্নান। মাত্র দুই মিনিটের এই ঘোষণা বাংলাদেশেরআপামরজনসাধারণেরমনেনতুনআশাএবংপ্রেরণারসঞ্চারকরল।বাংলারমানুষশিহরিতহলো।উৎসুকসবাইরেডিওরনবঘোরাচ্ছে।আরোকিছুশোনারজন্যতীব্রআগ্রহ,কিন্তুবিদ্যুৎচমকেরমতোসেইঘোষণাটিআরশোনাগেলনা।একজনবেতারঘোষকহিসাবেআমারনিজেরমনেহলোএখনিবেতারকেন্দ্রেরসাথেযোগাযোগকরাউচিত।রাস্তায়বেরিয়েপড়লাম।পথেজনগণেরদেওয়াব্যারিকেড।চারদিকেআগুনআরধোঁয়ায়আচ্ছন্ন।অনেককষ্টেপৌঁছলামআগ্রাবাদবেতারভবনে।পৌঁছেদেখিসহকর্মীরাউত্তেজিত, নিজেদেরমধ্যেআলাপআলোচনাচলছে, কীকরেবেতারেরমাধ্যমেস্বাধীনতারকথাগুলোপ্রচারকরাযায়।স্বাধীনতারপ্রথমঘোষণাটিস্বাভাবিকভাবেইজনগণকেআশান্বিতকরেছিল।সেছিলস্বাধীনতারজন্যেসংগ্রামেঝাঁপিয়েপড়ারবাণী,আরোস্পষ্টএবংঅর্থবহকরেএকেপ্রচারকরারতাগিদআমরাসবাইঅনুভবকরলাম।আলোচনায়স্থিরহলোআগ্রাবাদবেতারকেন্দ্রটিপাকিস্তানিসেনাবাহিনীরআওতারমধ্যেএবংবেতারপ্রচারশুরুহলেতাদেরদ্বারাআক্রান্তহবারসমুহসম্ভাবনান।সুতরাংগোপনেকোনোএকনিভৃতস্থানথেকেবেতারপ্রচারশুরুকরাহোক,এইকথাটিসবাইমেনেনিলাম।স্থিরহলোকালুরঘাটসম্প্রচারকেন্দ্রকেএকাজেব্যবহারকরাযেতেপারে।এইসম্প্রচারকেন্দ্রটিব্যবহতহতেপারে, এমনধারণা
১৪০

পাকসেনাদেরমনেআসাকঠিন।

প্রশ্নহচ্ছেএইপরিস্থিতিতেওখানেযাওয়াযায়কিকরে।এগিয়েএলেনডঃসৈয়দআনোয়ারউল্লাহ।তিনি একটি পিক আপ ভ্যানের ব্যবস্থা করলেন।তখন সন্ধ্যা হয়। বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ নিলেন অগ্রণী ভূমিকা। আমরা রওনা হলাম কালুরঘাটের দিকে। ডঃ আনোয়ার উল্লাহ নিজেই গাড়ির হুইল ধরলেন। যতদূর মনে পড়ে এই গাড়িতে ছিলেন বেলাল ভাই, অনুষ্টান ঘোষিকা হোসেনে আরা,মরহুম কবি আব্দুস সালাম, আবুল কাশেল সন্দ্বীপ এবং আমি। ব্যারিকেড পেরিয়ে যখন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পৌঁছলাম , তখন আনুমানিক সন্ধ্যা সাতটা। কেন্দ্রের একটি কক্ষে সমবেত হলাম। সবার মধ্যে প্রচন্ড উত্তেজনা,বেতার কেন্দ্রটির কি নাম দেয়া যায়। এই নিয়ে আলোচনা হলো অনেক।সভায় ঠিক হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রই উপযুক্ত নাম।নাম নির্বাচনের ব্যাপারেও অগ্রণী ভূমিকা নিলেন বেলাল ভাই। বেতার প্রচারের স্থানটি সম্পুর্ন গোপন রাখা হবে। প্রচারের একটু আগে হটাত করে হাজির হলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল হান্নান।তিনি প্রথম অধিবেশনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আবার পড়ে শোনাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।অনুষ্টান ঘোষণার জন্য তখন একজন ঘোষকের প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বেতারের মুখ্য ঘোষক জনাব আবদুল ফজল উপস্থিত ছিলেন।তাঁকে ঘোষণা করতে দেয়া যায় কিনা এ নিয়ে আলোচনা হলো।কিন্তু স্থির হলো তাঁর কণ্ঠ অতি পরিচিত,বেতারের গোপনীয়তার জন্য সেই পর্যায়ে তাঁকে ঘোষণা করতে না দেয়াই ভালো।উপস্থিত ঘোষিকা হোসনে আরার প্রসঙ্গও উঠল।যেহেতু এটি একটি বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র,প্রথম ঘোষণা পুরুষ কন্ঠে প্রচার করাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো।বেলাল ভাই তখন আমাকে বললেন, আপত্তি না থাকলে এই প্রথম অধিবেশনের ঘোষণা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব কিনা। আমি সানন্দে রাজি হলাম। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নাম ঘোষণা দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হলো। বুথের মধ্যে অনুষ্টানসূচী নিয়ে প্রবেশ করলাম। মনের মধ্যে প্রচন্ড উত্তেজনা এবং আবেগ।দুরুদুরু বুকে আবেগজড়িত কন্ঠে বেতার মাইক্রোফোনে উচ্চারণ করলামঃ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। নাম ঘোষণাটি উচ্চকন্ঠে আরো দুবার উচ্চারণ করলাম। এভাবেই শুরু হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম ঐতিহাসিক অনুষ্টান।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের এই প্রথম অধিবেশনে একটি গুরুত্বপুর্ন সংবাদ বুলেটিন পাঠ করা হয় এবং সেটি পাঠ করলেন আবুল কাশেন সন্দ্বীপ।বহির্বিশ্বের সাহায্য কামনায় ইংরেজিতে নিউজ বুলেটিনে কণ্ঠ দিলেন তৎকালীন বেতার প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক। বাংলার আপামর জনসাধারণকে যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানি শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান

১৪১

জানালেন চট্টগ্রামের মরমী কবি আব্দুস সালাম, বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে ঘোষণা পাঠ করলেন আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল হান্নান। অনুষ্ঠানে কারিগরি সহায়তা দিলেন বেতার প্রকৌশলী মুসলিম খান, দেলোয়ার হোসেন ও মোহাম্মদ মুসা।সর্বশেষ গণসংগীতের মুর্ছনায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের প্রথম এই ঐতিহাসিক অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বাংলার আনাচে কানাচে তখন ছড়িয়ে গেছে স্বাধীনতার অগ্নিশপথ।
চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা
সশস্থ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে একাত্তরের ২৭মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় অধিবেশনে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়ার ঘোষণা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ঘটনা। একজন বাঙ্গালি মেজরের কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা সেদিন বাঙ্গালিকে তড়িৎ স্পর্শে জাগিয়ে তুলেছিল। বিশ্ব জেনেছিল বাঙ্গালি মরেনি, বাঙ্গালি রুখে দাঁড়িয়েছে। শামসুল হুদা চৌধুরীর “মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর” গ্রন্থে মেজর জিয়ার স্বকন্ঠে টেপ থেকে উদ্ধৃত ইংরেজি ভাষণটির প্রতিলিপি ও তার অনুবাদ দেয়া আছে।
আমাদের মহান নেতা,বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং ঘোষণা করছি যে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই সরকার গঠিত হয়েছে। এতদ্বারা আরো ঘোষণা করা হচ্ছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কর্তৃক প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণের বৈধ সরকার,যা আইনসম্মত এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে গঠিত হয়েছে এবং যা পৃথিবীর সব সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।
কাজেই আমি আমাদের মহান নেতার শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র,বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে বাংলাদেশের বৈধ সরকারের স্বীকৃতি দান এবং পাকিস্তানের দখলদার সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘঠিত ভয়াবহ গণহত্যাকে তাৎক্ষণিক বন্ধ করার উদ্দেশ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা একটি নির্মম তামাশা এবং সত্যের বরখেলাপ মাত্র, যার দ্বারা কারোরই বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
নতুন রাষ্ট্রে পরিচালনার নীতি হবে প্রথম নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয় শান্তি এবং তৃতীয় সবার সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়। আল্লাহ্‌ আমাদের সহায়

১৪২

হোন। জয় বাংলা। ( ইংরেজিতে প্রদত্ত মূল ভাষণ আলাদা ভুক্তিতে দেয়া হয়েছে)
চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ থেকে ৩০ মার্চ যেসব অনুষ্টান প্রচারিত হয় তার টেপ থেকে ধারণকৃত অংশ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রকাশিত ” বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” গ্রন্থের পঞ্চম খন্ডে ছাপা হয়েছে। আমরা ওই অংশের প্রথম ৩ পৃষ্টা উদ্ধৃত করছি, যেখানে মেজর জিয়ার অপর একটি ভাষনের ইংরেজি ও বাংলা প্রতিলিপি রয়েছে।
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১।স্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্র
প্রচারিতঅনুষ্ঠান (অংশ) টেপথেকেউদ্ধৃত ২৬-৩০মার্চ, ১৯৭১

“এবারতোমাদেরবিদায়নিতেহবে, তবেঅক্ষতঅবস্থায়নয়।যেরক্তএতদিনতোমরানিয়েছো, সেরক্তএবারআমরাওনেব।” বলেছেনবাংলারমহানায়কবঙ্গবন্ধুশেখমুজিব।
“বাঙালীরেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশবাহিনী, মুক্তিসেনা- এগিয়েযাও।তোমাদেরসাথেরয়েছেবাংলারবিপ্লবীবীরজনতা।এরাসবাইরক্তদিতেপ্রস্তুত, আজএরারক্তদেবেইএইপ্রতিজ্ঞানিয়েপাকিস্তানীহানাদারদেরওপরএরাআক্রমণচালাবে।” বলেছেনবঙ্গবন্ধুশেখমুজিব।
“পাকসৈন্যদেরখতমকরুন, বাংলাদেশেরস্বাধীনতাকেঅক্ষুণ্ণরাখুন।যেপতাকাএকবারবাংলার– মানুষউড়িয়েছে,শেষরক্তবিন্দুথাকতেওসেইপতাকাকোনোদিনতারাভুলেযাবেনা।” বলেছেনস্বাধীনবাংলারছাত্রসংগ্রামপরিষদেরচারজননেতা।
মনেরাখবেন, শত্রুসৈন্যধ্বংসহওয়ানাপর্যন্তএইযুদ্ধাবস্থাচলবেই।তাইআরাম-আয়েশবিসর্জনদিয়ে, রাতেরঘুমহারামকরেআপনারাআপনাদেরবিজয়েরপথেএগিয়েযান।
পশ্চিমাহানাদারেরাএখনোচিনতেপারেনিবাঙালীরেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশবাহিনীআরমুক্তিসেনাকিজিনিস।তারাভুলেগেছে, এইবাহিনীবিভিন্নযুদ্ধেযেশৌর্যওবীর্যদেখিয়েছেতাতারাএখনোআন্দাজকরতেপারেনি।আমরাদৃঢ়বিশ্বাসরাখি, যেসমস্তহানাদারপাকিস্তানীসৈন্যএখনোরয়েছেতাদেরবাঙালীরানিশ্চিহ্নকরেদেবে।জয়বাংলা।

সংগীতঃজয়, জয়, বাংলারজয়… …।
স্বাধীনতাঅর্জনেরজন্যমরণপণসংগ্রামচলেছে।বাংলারবীরসৈনিক, ইষ্টবেঙ্গলরাইফেলস, ইষ্টপাকিস্তানরাইফেলস, পুলিশবাহিনীএবংএদেশেরপ্রতিটিছাত্র, কৃষক, জনতা, হানাদারপশ্চিমাগুণ্ডাবাহিনীরআক্রমণসাফল্যেরসাথেপ্রতিহতকরেচলেছে।এবংবাংলারবীরসৈনিকদেরআক্রমণেদিশেহারাপশ্চিমাবাহিনীপিছুহটেচলেছেএবংমর্টার, কামানএবংট্যাঙ্কেরসাহায্যেবিভিন্নস্থানে
১৪৩

স্থানেনির্বিচারেগণহত্যাকরেচলেছে।পশ্চিমাহানাদারবাহিনীযখনপ্রতিটিআন্তর্জাতিকনিয়ম-কানুনউপেক্ষাকরেগতকালরাত্রেহাসপাতালেপর্যন্তবোমাবর্ষণকরেছে- বাংলারসাতকোটিমুক্তিপাগলমানুষেরউপরযেভাবেপশ্চিমাহানাদারবাহিনীআক্রমণকরেচলেছে, তারপ্রতিরোধেবাংলারমানুষকেসর্বাত্মকসহায়তাকরাপ্রত্যেকগণতান্ত্রিকরাষ্ট্রেরনৈতিককর্তব্যবলেআমরামনেকরি।তাইবাংলারসাড়েসাতকোটিমানুষআজবিশ্বেরকাছেআহবানজানাচ্ছেতারাযেনবাংলারমুক্তিপাগলজনগণেরসাহায্যার্থেএগিয়েআসেন।আপনাদেরঅবগতিরজন্যআমরাআরওজানাচ্ছিযে, পশ্চিমাহানাদারবাহিনীরমেজরজেনারেলটিক্কাখান- যাকেবাংলারবীরজনতাগর্ভনরহিসাবেমেনেনিতে ………. (অস্পষ্ট) অস্বীকৃতিজানিয়েছিলেন, সেইকুখ্যাতটিক্কাখানকেবাংলারবীরসৈনিকেরাহত্যাকরেছে।বাংলারবীরজনতাপ্রতিটিঅলিতে-গলিতেঅস্ত্রহাতেশত্রু দেরমোকাবিলাকরেচলেছে।বিশ্ববাসী, আপনারাআসুন, বাংলারমানুষকেসর্বাত্মকসহায়তাকরুন।আমরাজানি, ইনশাল্লাহজয়আমাদেরইহবেই।জয়বাংলা।
আপনারাবাংলারপ্রতিটিজনসাধারণকেজানিয়েদিনযেনশত্রুরমোকাবিলায়তারাসর্বাত্মকসাহায্যকরেন।বাংলারবীরসৈনিকেরাযেভাবেশত্রুরমোকাবিলাকরেচলেছে, তাসত্যইপ্রশংসারযোগ্য।আপনারাএগিয়েআসুন।আপনারাকেউশহরথেকেযাবেননা।যেযেরূপভাবেইপারেনবাংলারমুক্তিপাগলমানুষকেসাহায্যকরুন। …… আমাদেরবিভিন্নকেন্দ্রেখাদ্যওযেসবসামগ্রীসংগ্রহকরাআছে, আপনারাযদিপারেন, সেখানেখাদ্যওসামগ্রীজমাদিন।
সঙ্গীতঃ… … …
ঘুমপাড়ানোতোতাপাখীলওবিদায়, লওবিদায়।
I Major Zia of Bengal liberation Army. This is Major Zia, the Leader of Bengal liberation Army, Speaking on the support of Bangabandhu Shekh Mujibur Rahaman’s Liberation movement.
The Pakistan Army consisting mainly of Punjabi traitors are killing the Bengali civilians of all ages and they acted in most ruthless manner. They have not spared the unarmed Bengalis those are chiefly those unarmed Bengalis officers and men of the army navy and air force some of whose families have been killed* The Massacre started on the night of last Thursday when they attacked and started killing the unarmed soldiers. Navy, airmen and civilian population all over swadhin Bangladesh. They have been using American; Russian and Chinese armaments including artillery gun and tank including Russian tank which is presented. Which was so generously given by the Indonesian during the last 1965 war. All these acts uncivilized and cruel.
They had very conceived plan of killing the senior political .civil military leaders of Bengal. The need of the hour is that the important personalities of Bangladesh should so underground and work from there. Voice of America has announced that Beluchistan and Pakhtunistan with North-West Frontier Province has seceded from Pakistan to support the cause of Swadhin Bangladesh.At this moment we have to fight united. By the grace of God,We will capture all Punjabi traitors in matter of one or two days and free Bangladesh of these menaces. Joi Bangla
This is you are listening the taped broadcast my Major Zia of Begal Liberation Army Leader. This broadcast to you from Free Radio Bengal.
আপনারাস্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরঅনুষ্ঠানশুনছেন।এবারআপনাদেরমুক্তি-বাঙালীমুক্তিসেনাবাহিনীরনায়কমেজরজিয়াআপনাদেরকেবাংলায়ভাষণদিচ্ছেন।
আমিশেখমুজিবুররহমানেরঘোষিতস্বাধীনবাংলাপ্রসংগেবলছি।
পাকিস্তানসেনাবাহিনীপ্রধানতপাঞ্জাবীসৈন্যরাবাংলারবেসামরিকমানুষদেরনির্মমভাবেহত্যাকরেছে।তারাঅফিসারএবংনিরস্ত্রসৈন্যদেরহত্যাকরেছে।এমনকিতাদেরপরিবারদেরকেওরেহাইদেয়নি।তাদেরএরকমহত্যাকাণ্ডশুরুহয়েছেগতবৃহস্পতিবারথেকে।সেদিনথেকেতারাবাঙালীসৈন্যদেরনিরস্ত্রকরেএবংসমস্তস্বাধীনবাংলাদেশেরজনগণেরউপরজুলুমচালাতেথাকে।তারাআর্টিলারীকামান, আমেরিকান, রাশিয়ানওচীনাঅস্ত্রশস্ত্রব্যবহারকরে।এছাড়াওতাদেরজুলুমেরভয়াবহসামগ্রীগুলিরমধ্যেইন্দোনেশিয়াআমাদেরকেদিয়েছিলো।দুশমনদেরএসমস্তকাজযেমনবর্বরোচিততেমনিজঘন্য।এইসমস্তবর্বরহানাদারদেরএখনসুপরিকল্পিতমতলবহচ্ছেস্বাধীনবাংলাদেশেরমহানরাজনীতিকনেতাদের, বেসামরিকউচ্চপদস্থকর্মচারীদেরএবংবাংলাদেশেরমুক্তিসেনাদেরহত্যাকরা।এইচরমমুহুর্তেসবচেয়েপ্রয়োজনহচ্ছেস্বাধীনবাংলাদেশেরগুরুত্বপূর্ণব্যক্তিদিগকেআণ্ডারগ্রাউন্ডবাগোপনকাজেচলেযেতেহবেএবংসেখানথেকেদুর্বারআক্রমণগড়েতুলতেহবে।কিছুক্ষণআগেভয়েসঅবআমেরিকাবেতারেবলাহয়েছেযে, স্বাধীনবাংলাদেশেরন্যায়আন্দোলনকেপূর্ণরূপেসমর্থনকরেবেলুচিস্তানএবংসীমান্তপ্রদেশেরপাখতুনিস্তানতথাকথিতপাকিস্তানথেকেবিচ্ছিন্নহয়েছে।এইসময়আমাদেরএকমাত্রলক্ষ্যহচ্ছেসংঘবদ্ধভাবেমহানসংগ্রামগড়েতোলা।আল্লাহরঅনুগ্রহেআমরাপাঞ্জাবীদেশদ্রোহীদেরসম্পূর্ণবিধ্বস্তকরবো।এইপাঞ্জাবীদেশদ্রোহীদেরবিধবস্তকরতেআমাদেরসময়লাগবেমাত্রএকদিনকিংবাদুইদিন।এবংএভাবেস্বাধীনবাংলাদেশকেআমরাশত্রুরকবল

১৪৫
থেকেমুক্তকরবো।জয়বাংলা।
১৯৭১সালের২৬মার্চথেকে৩০মার্চচট্টগ্রামেরস্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরঅনুষ্ঠানবাংলাদেশেরতথবিশ্বেরমানুষকেজানিয়েদিয়েছিলোযে,বাঙালিজাতিরুখেদাঁড়িয়েছে, শুরুহয়েছেপ্রতিরোধ।কিন্তু৩০মার্চপাকিস্তানবিমানবাহিনীবোমাবর্ষণকরেকালুরঘাটট্রান্সমিটারটিধ্বংসকরেদিলেএককিলোওয়াটেরএকটিশর্টওয়েভট্রান্সমিটারএকটিট্রাকেবসিয়েকয়েকজনদুঃসাহসীবেতারকর্মীপ্রায়বিশজনবেঙ্গলরেজিমেন্টেরজওয়ানেরপ্রহরায়দুর্গমপার্বত্যচট্টগ্রামেরসীমান্তথেকেঅনিয়মিতভাবেস্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরঅনুষ্ঠানপ্রচারঅব্যাহতরাখেন।পরবর্তীকালে৫০কিলোওয়াটেরএকটিট্রান্সমিটারেরসাহায্যেমুজিবনগরথেকেস্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরনিয়মিতঅনুষ্ঠানপ্রচারশুরুহয়েছিলো১৯৭১সালের১১ইজৈষ্ঠ (২৫মার্চ) বিদ্রোহীকবিকাজীনজরুলইসলামের৭২তমজন্মদিনথেকে।

স্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরপ্রথমপর্যায়ের,অর্থাৎচট্টগ্রাম, কালুরঘাটএবংভ্রাম্যমাণপর্যায়েরযেসবদুঃসাহসীবেতারকর্মীরপ্রচেষ্টায়এইদুঃসাহসীপ্রয়াসসাফল্যমণ্ডিতহয়েছিলতাঁদেরমধ্যেআরোছিলেনআবদুল্লাআলফারুক,মোস্তফাআনোয়ার,সৈয়দআহমদশাকের,রশিদুলহাসান,আমিনুররহমান,রেজাউলকরিমচৌধুরী, শরফুজ্জামান,কাজীহাবীবউদ্দিনআহমদ, সেকান্দার,হারুনওশুকুরমিয়া।স্বাধীনবাংলাবেতারকেন্দ্রেরপ্রাথমিকপর্যায়েএইবেতারেরঅন্যতমকর্মীমাহমুদহাসানকেপ্রাণদিতেহয়।২৬মার্চএইবেতারকেন্দ্রথেকেইমাহমুদহাসানবিশ্ববাসীরকাছেআবেদনজানিয়েছিলেনবাঙালিজাতিরসাহায্যেএগিয়েআসারজন্যে।দুজনসঙ্গীসহপার্বত্যচট্টগ্রামেরহারবাঙ্কনামকস্থানেতিনিএবংতাঁরসঙ্গীরাবৈরীমিজোদেরহাতেনিহতহন।শহীদমাহমুদহাসানবাংলারস্বাধীনতাসংগ্রামেরপ্রথমশহীদশব্দ-সৈনিক।

মুজিবনগরেস্বাধীনতাসনদঘোষণাওবাংলাদেশসরকারগঠনবাংলাদেশেরকুষ্টিয়াজেলারমেহেরপুরমহকুমারভবেরপাড়াগ্রামে’মুজিবনগরে’ ১৯৭১সালের১৭এপ্রিলদশহাজারমানুষেরবিপুলহর্ষধ্বনিরমধ্যেস্বাধীনতারসনদঘোষণারমধ্যেদিয়েআনুষ্ঠানিকভাবে’গণপ্রজাতন্ত্রীবাংলাদেশ’ রাষ্ট্রঘোষিতহয়এবংপ্রথম’গণপ্রজাতন্ত্রীবাংলাদেশসরকার’ গঠিতহয়।এইঅনুষ্ঠানেপ্রায়৫০জনবিদেশীসাংবাদিকওউপস্থিতছিলেন।এইঅনুষ্ঠানেবঙ্গবন্ধুশেখমুজিবুররহমানওসৈয়দনজরুলইসলামকেবাংলাদেশসরকারেরপ্রেসিডেন্টওভাইসপ্রেসিডেন্টঘোষণাকরাহয়এবংবলাহয়শেখমুজিবুররহমানযদিঅনুপস্থিতথাকেনবাকাজকরতেনাপারেনতাহলেসৈয়দনজরুলইসলামপ্রেসিডেন্টেরসমস্তদায়িত্বপালনকরবেন।মুজিবনগরেরএইঅনুষ্ঠানে

১৪৬

অস্থায়ীভাবেজনাবতাজউদ্দীনআহমদকেপ্রধানমন্ত্রী, জনাবখন্দকারমোশতাকআহমদকেপররাষ্ট্রওআইনমন্ত্রী,জনাবমনসুরআলীকেঅর্থওবাণিজ্যমন্ত্রী, জনাবএএইচএমকামরুজ্জামস্বরাষ্ট্র,যোগাযোগওসাহায্যমন্ত্রীএবংকর্নেলওসমানীকেবাংলাদেশমুক্তিবাহিনীরপ্রধানসেনাপতিঘোষণাকরাহয়।

১৯৭০সালেরসাধারণনির্বাচনেনির্বাচিতবাংলাদেশের১৬৯জনসদস্যেরমধ্যে১৬৭জনছিলেনআওয়ামীলীগদলভুক্ত।সেইনির্বাচিতসদস্যদেরস্বাধীনতাঘোষণাপত্রবাংলাদেশেরস্বাধীনতারআইনগতভিত্তি।

বাংলাদেশসরকারেরপ্রতিআনুগত্যপ্রদর্শনকারীপ্রথমকূটনীতিকদ্বয়নয়াদিল্লিস্থপাকিস্তানদূতাবাসেরপদস্থদুজনকর্মচারীজনাবশাহাবউদ্দিনআহমদওজনাবআমজাদুলহক১৯৭১সালের৬এপ্রিলপাকিস্তানেরসাথেসম্পর্কচ্ছেদকরেবাংলাদেশেরপ্রতিআনুগত্যঘোষণাকরেন।তাঁরাইহলেনবাংলাদেশেরপ্রতিআনুগত্যঘোষণাকারীপ্রথমকূটনীতিবিদ।

১৯৭১সালের১৮এপ্রিলকলকাতাস্থপাকিস্তানেরসহকারীহাইকমিশনারজনাবহোসেনআলীবাংলাদেশসরকারেরপ্রতিঅপরদশজনকর্মকর্তাসহআনুগত্যঘোষণাকরেন।১৯৭১সালে১৮এপ্রিলদুপির১২টায়কলকাতা৯নংসার্কাসএভিনিউতেঅবস্থিতপাকিস্তানমিশনভবনথেকেপাকিস্তানিপতাকানামিয়েফেলাহয়এবংবাংলাদেশেরপতাকাউত্তোলনকরাহয়ওবাংলাদেশেরজাতীয়সঙ্গীত’আমারসোনারবাংলা’ গীতহয়।বিদেশেকলকাতাতেইপ্রথমবাংলাদেশেরদূতাবাসস্থাপিতহয়।পরবর্তীকালেবিভিন্নদেশেঅবস্থিতপাকিস্তানদূতাবাসেঅনেকবাঙালিকূটনীতিবিদক্রমেক্রমেবাংলাদেশসরকারেরপ্রতিআনুগত্যঘোষণাকরেন,কিন্তুকয়েকজনবাঙালিকূটনীতিবিদশেষপর্যন্তপাকিস্তানেরপ্রতিঅনুগতছিলেন,তবেযখনস্বাধীনতারপরবঙ্গবন্ধুসরকারপাকিস্তানেআটকেপড়াবাঙালিদেরবাংলাদেশেফিরিয়েআনেন,তখনতাঁরাফিরেএসেচাকরিতেযোগদানকরেন।

গণহত্যাওশরণার্থীসমস্যা-
১৯৭১সালেরপঁচিশমার্চরাতথেকেনয়মাসধরেবাংলাদেশজুড়েব্যাপকগণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, লুণ্ঠনওনারীনির্যাতনেরফলেবাংলাদেশেরবিভিন্নঅঞ্চলথেকেপ্রাণরক্ষারজন্যলক্ষলক্ষঅসহায়নারী,পুরুষওশিশুচিরপরিচিতভিটেমাটিছেড়েভারতেরপশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা,মেঘালয়, আসামপ্রভৃতিরাজ্যএবংবার্মায়আশ্রয়গ্রহণকরতেথাকে।১৯৭১সালেরডিসেম্বরমাসেশরণার্থীদেরসংখ্যাদাঁড়ায়প্রায়এককোটি।ভারতেরবিভিন্নরাজ্যেআশ্রয়গ্রহণকারীশরণার্থীদেরমোটসংখ্যাছিলো- আসামে৩লক্ষ১৩হাজার,বিহারে৯হাজার,মেঘালয়ে৬লক্ষ৬৮হাজার,ত্রিপুরায়১৪লক্ষ১৩হাজার,পশ্চিমবঙ্গে৭৪লক্ষ৯৩হাজার; মোট৯৮লক্ষ৯৩হাজার।এইশরণার্থীদেরস্থায়ীভাবেভারতে

১৪৭

পুনর্বাসনেরঅপচেষ্টামুক্তিযুদ্ধচলাকালেএকটিপরাশক্তিরমাধ্যমেকরাহয়েছিলো,কিন্তুতাসফলহয়নি।স্বাধীনতারঅল্পকালেরমধ্যেবাংলাদেশসরকারঐবিপুলসংখ্যকশরণার্থীকেবাংলাদেশেফিরিয়েএনেপুনর্বাসনকরান।

পাকিস্তানেবন্দিবঙ্গবন্ধুরবিচার
১৯৭১সালের৩আগস্টপাকিস্তানেরপ্রেসিডেন্টজেনারেলমোহাম্মদইয়াহিয়াখানঘোষণাকরেনযে,পাকিস্তানেরজেলেআটকশেখমুজিবুররহমানেরবিচারকরাহবে।৯আগস্টএকসরকারিপ্রেসনোটেজানানোহয়যে, ‘পাকিস্তানেরবিরুদ্ধেযুদ্ধকরার’ অভিযোগে১১আগস্টথেকেশেখমুজিবুররহমানকেএকবিশেষসামরিকআদালতেবিচারকরাহবে।২৮সেপ্টেম্বরপ্রকাশিতঅপরএকপ্রেসনোটেজানানোহয়যে,৭সেপ্টেম্বরথেকেমিএকেব্রোহীকেবিবাদীপক্ষেরকৌসুলিনিয়োগকরাহয়েছেএবংশেখসাহেবেরবিরুদ্ধে২০জনেরসাক্ষ্যগ্রহণকরাহয়েছে।১৯৭১সালের১৮ডিসেম্বরপাকিস্তানসরকারেরএকজনমুখপাত্রজানানযে,শেখসাহেবেরবিচারশেষহয়েছে,তবেতখনওরায়দেওয়াহয়নি।

সম্মুখসমরেবাঙালি
১৯৭১সালের২৭মার্চথেকে১৬ডিসেম্বরপর্যন্তকর্নেলআতাউলগনিওসমানীরঅধিনায়কত্বেইস্টবেঙ্গলরেজিমেন্ট, ইস্টপাকিস্তানরাইফেলস, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদবাহিনীরসশস্ত্রওপ্রাক্তনসৈনিকএবংস্বেচ্ছাসেবকছাত্রওযুবকদেরসমন্বয়েগঠিত’বাংলাদেশমুক্তিবাহিনী’ বাংলাদেশেরজল,স্থলওআকাশেপাকিস্তানসেনাবাহিনীরসঙ্গেএকরক্তক্ষয়ীসশস্ত্রমরণপণসংগ্রামেলিপ্তহয়।সেমুক্তিসংগ্রামেরসম্পূর্ণইতিহাসবর্ণনাস্বল্পপরিসরেসম্ভবনয়।অতিসংক্ষেপেসেইসংগ্রামেরএকটিরুপরেখাতুলেধরারচেষ্টাকরব।দৈনিকবাংলায়১৯৭২সালের৩থেকে৯ডিসেম্বরপ্রকাশিতহেদায়েতহোসাইনমোরশেদগৃহীতমুক্তিযুদ্ধেরপ্রধানসেনাপতিজেনারেলওসমানীরবিশেষসাক্ষাৎকারথেকেউদ্ধৃতকরছি—-
…. ২৬মার্চথেকেশত্রুকেপ্রতিরোধএবংবাঙালিদমনেশত্রুদেরকার্যক্রমপ্রতিরোধকরতেপ্রথমঝাঁপিয়েপড়েছিলইস্টবেঙ্গলরেজিমেন্টেরবীরবাঙালিসৈনিক,প্রাক্তনইপিআর-এরবীরবাঙালিরাএবংআনসার,মুজাহিদওসশস্ত্রপুলিশবাহিনীরবীরজওয়ানেরা।সঙ্গেসঙ্গেএদেরসাথেএসেযোগদিয়েছিলযুবকওছাত্ররা।

সর্বপ্রথমযুদ্ধহয়নিয়মিতপদ্ধতিতে।আরএইপদ্ধতিতেযুদ্ধচালুথাকেমেমাসপর্যন্ত।শত্রুকেছাউনিতেযথাসম্ভবআবদ্ধরাখাএবংযোগাযোগেরকেন্দ্রসমূহতাকেকব্জাকরতেনাদেয়ারজন্যনিয়মিতবাহিনীরপদ্ধতিতেযুদ্ধকরাহয়েছিল।এজন্যেপদ্ধতিছিলযতবেশিবাধাসৃষ্টিকরাযায়তাসৃষ্টিহবে,

১৪৮

যেসব ন‍্যাচারাল আবসট্রাকল বা প্রতিবন্ধক রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে এবং এর সাথে সাথে শত্রুর প্রান্তভাগে যোগাযোগের পথে আঘাত হানতে হবে । মূলত এই পদ্ধতি ছিল নিয়মিত বাহিনীর পতদ্ধতি । আর সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত বাহিনীর অত্যন্ত বীরত্তের সাথে এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে । এই পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়েছে যথাঃ ভৈরব আগুগঞ্জের যুদ্ধ , এই যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ানের বিরুদ্ধে শত্রুর পুরো দুটি ব্রিগেড নিয়োগ করে । এখানে শত্রূবাহিনীকে চারদিন আটকে রাখা হয় ।তবে একটি বিষয়ে আমি আলোকপাত করতে চাই । নিয়মিত বাহিনীর যেটা স্বাভাবিক কৌশল তা আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার জন্যে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে । আমার ছোট ছোট অংশ অর্থাৎ ছোট ছোট পেট্রল বা ছোট ছোট কোম্পানির প্লাটুনের অংশ দিয়ে শত্রুবাহিনীর তুলনামূলক অধিক সংখ্যক লোককে রুদ্ধ করে রাখি এবং সাথে সাথে শত্রুর ওপর আঘাতও হানতে থাকি । এভাবে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চলে সর্বপ্রথমে যুদ্ধ শুরু হয় ।সে সময় আমি ও আমার অধিনায়কদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে , আমরা কেবল নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে চলতে পারব না । কারন আমাদের সংখ্যা তখন সর্বমোট মাত্র ৫টি ব্যাটালিয়ন । এছাড়া আমাদেরসাথে প্রাত্তন ইপিআর-এর বাঙালি জওয়ানরা ,আনসার , মুজাহিদ , পুলিশ ও যুবকরাও ছিলেন । যুবকদের অন্ত্র দেয়া একটু কঠিন হইয়ে পড়েছিল । আমার ভেতর থেকে যে অন্ত্র গুলো দিয়ে গিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে তাদের তারাতাড়ি মোটামুটি প্রশিক্ষণ দিয়ে দাড় করিয়েছিলাম । আমাদের বিরুধে তখন শত্রুবাহিনীর ছিল তিন-চারটি ডিভিশন । এই তিনটি ডিভিশনকেই নিতম সংখ্যা হিসেবে ধরে নিয়ে আমরা দেখতে পেলাম যে, এদের প্রতিরোধ করা, ধ্বংস করা সোজা নয়, সম্ভব নয় । তাই এপ্রিল মাস নাগাদ এটি আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যা আমাদের একটি গণবাহিনী গড়ে তুলতে হবে । এই গনবাহিনী শত্রুপক্ষের সংখ্যার গরিষ্ঠতা নিউট্রেলাইজ করবে ।কিন্তু এর সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার ছিল যে, বইয়ে লেখা ক্লাসিকাল গেরিলা ওয়ারফেয়ার করে দেশ মুক্ত করতে হলে বহুদিন যুদ্ধ করতে হবে এবং ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে ।এ জন্য আমাদের অনেক নিয়মিত বাহিনীর প্রয়োজন ছিল । তাই প্রয়োজনের কথা আমি মে মাসে শুরুতে সরকারকে লিখিতভাবে জানাই এবং আই ভিত্তিতে মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্যও চাই । তাতে আমার উদ্দেশ্য ছিল (ক) কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ হাজার গেরিলা সমন্বিত বাহিনী (খ) ২৫ হাজারের মতো নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে । এই বাহিনী সত্বর গড়ে তুলতে হবে । কারণ এদিকে গেরিলা পদ্ধতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শত্রুকে নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডো ধরনের রণকৌশল দিয়ে

১৪৯

শক্তিকে বণ্টন করার জন্যে বাধা করতে হবে যাতে তার শক্তি হ্রাস পায় ।এই পদ্ধতিতে আমরা কার্যে পরিণত করি । ক্রমশ গড়ে উঠল একটি বিরাট গনবাহিনী-গেরিলা বাহিনী । জুন মাসের শেষের দিক থেকে গেরিলাদের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয় । প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি বানানো হয় এবং জুন মাসের শেষের দিক থেকে আমাদের গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী অ্যাকশনে নামে । তবে, জুলাই-আগস্ট মাসের আগে পর্যন্ত শত্রুবাহিনী তাদের ওপর গেরিলাবাহিনীর প্রবল চাপ বুঝতে পারেনি ।যদিও শুরু থেকে আমরা কিছু সংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভেতরে পাঠিয়েছিলাম । তারা চট্টগ্রাম বন্দরেও গিয়েছিলাম, ঢাকায়ও এসেছিল । তবে গেরিলাদের শত্রুরা জুলাই মাস থেকেঅনুভব করতে শুরু করে ।ইতিহাসে নৌ-কমান্ডোদের বীরত্বগাথার নজীর নেইআমাদের নৌবাহিনীর ছিল না । আমার কাছে নিয়মিত নৌবাহিনীর বহু আফিসার, ওয়ারেন্ট আফিসার ও নাবিক আসেন । ফ্রান্সের মতো জায়গা থেকে কয়েকজন পাকিস্তানের ডুবোজাহাজ ছেড়ে আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন । আমি তাদের ভিত্তি করে এবং আমদের বড় শক্তি যুবশক্তিকে ব্যবহার করে নৌ-কমান্ডো গঠন করি । এই নৌ-কমান্ডো জলপথে শত্রুর চলাচল ধ্বংস করতে সক্ষম হয় । ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে আমাদের এই নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণ শুরু হয় । তারা যে বীরত্বের কৃতিত্ব দেখিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির নেই। তারা মংলার বহু জাহাজ ডোবায় । তারা শত্রুর জন্যে বিভিনু অন্ত্র অ সামান নিয়ে যেসব জাহাজ আসছিল চট্টগ্রামে সেগুলো ধ্বংস করে। এ জন্যে অত্যন্ত দুঃসাহসের প্রয়োজন ছিল । তারা শত্রুর দুটো বন্দর অচল করে দেয় এবং নদীপথেও তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দেয় ।বাংলাদেশের বৈমানিকরাই প্রথম আঘাত হেনেছেন …আমার কাছে বিমান ছিল না । তবে শেষের দিকে কয়েকটি বিমান নিয়ে আমি ছোটখাটো একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলাম । আমি যে বিমান পেয়েছিলাম তা ছিল দুটো হেলিকপ্টার , একটি অটার এবং আমার যানবাহনস্বরুপ একটি ডাকোটা । সেই অটার ও হেলিকপ্টারগুলোতে মেশিনগান লাগিয়ে যথেষ্ট সজ্জিত করা হলো।আমাদের যেসব বৈমানিক স্থলযুদ্ধে রত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে একটি ছোট বিমানবাহিনী গঠন করা হয় । এই বাহিনীর কৌশল ছিল গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইন্টারডিকশন অর্থাৎ শত্রুর যোগাযোগের পথকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানা । শত্রুর ওপর প্রথম যে বিমান হামলা হয়েছে তা বাংলাদেশের বীর বৈমানিকেরা করেছে । ২৬ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ

১৫০

হয়েছে তাতে যদিও আমাদের কাছে বিমান ছিল না কিন্তু আমরা বিমানঘাঁটিগুলোতে আঘাত হেনেছি । শেষেরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা সিলেট বিমানঘাঁটিতে একটি সি-১৩০ বিমান এর ওপরও অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মেশিনগান চালান । মেশিনগানের গুলিতে যদিও সি-১৩০ বিমানটি পড়ে যায়নি , তবে কোনো রকম ঢুলু ঢুলু করে চলে গিয়ে শমসেরনগরে নেমেছিল এবং পরে অনেক দিন মেরামতিতে ছিল । …৩ থেকে ১৬ দিসেম্বর পর্যন্ত সম্মিলিত বাহিনীর রণনীতি ও রণকৌশল …শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরের আগে শেষ পর্যায়ে শত্রুবাহিনীর ভারতের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ হামলা শুরু করল । পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, ভারতীয়দের যুদ্ধে নামতে হবে । …ভারতীয় বাহিনী তেসরা ডিসেম্বর যুদ্ধে নামে এবং শত্রু আত্মসমপর্ণ না করা পর্যন্ত ১৩ দিন যুদ্ধ করেছিল । অবশ্য এর আগে তাঁরা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল । ভারতীও বাহিনীর যখন যুদ্ধে নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিল তখন আমরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে একটি রণনীতি অবলম্বন করি । যেহেতু ভারতীয়দের কাছে ট্যাক্স, কামান ও বিমান রয়েছে সে জন্যে যেখানে অধিক শক্তিশালী প্রতিরোধ রয়েছে এবং বড় অন্ত্রশক্তি প্রয়োজন সেখানে তাঁরা প্রথম লক্ষ্য দেবেন এবং আমাদের বাহিনী শত্রুকে আউট-ফ্ল্যাংক, অর্থাৎ শত্রুকে দুই পাশ দিয়ে অতিক্রম করে ক্রস কান্ট্রি দিয়ে গিয়ে ব্যূহের পার্শ্বভাগ আক্রমন করবে অথবা ভারতীয়রা সামনের দিকে শত্রুকেঠেকিয়ে রাখবে এবং আমাদের বাহিনীকে আউট-ফ্ল্যাংক করে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে ।…যেসব অঞ্চল কেবল বাংলাদেশ সশন্ত্র বাহিনী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী মুক্ত করেছিলআমাদের বাহিনী সেসব অঞ্চল এভাবে মুক্ত করে তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রামের করেরহাট, হায়াকু, হাটহাজারী অঞ্চল, যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগর অঞ্চল, খুলনা বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কালীগঞ্জ অঞ্চল, ফরিদপুর সদ্র, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ অঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালীঅঞ্চল এবং ঢাকা পৌঁছার শেষ পর্যায়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ভইরব, নরসিংদী-ঢাকা এই ‘এক্সেস অব অ্যাডভ্যান্স’ রয়েছে ।অভ্যন্তর ভাগের গেরিলাদের (গণবাহিনীর) সাথে আমাদের নিয়মিত বাহিনীর আক্রমণের সামঞ্জস্য বিধান ক্রা হতো। নির্দেশ থাকত গেরিলারা অমুক অমুক জায়গায় আক্রমণ ক্রবে, শত্রুর দৃষ্টিকে অন্যদিকে ধাবিত করতে হবে এবং শত্রুর যাতে গোলাবারুদ ও রিইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করবে ।

১৫১

গেরিলারা অমুক জায়গায় অমুক পুলটি উড়াবেন । তবে আমরা ব্ড় বড় পুলে হাত দিইনি । সেই পুলগুলো শত্রুরাই আত্মসমপর্ণের আগে ভেঙেছিল ।মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনী পুরোদস্তর সংগঠিত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে গেরিলা ও নিয়মিত পদ্ধতিতে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে সক্রিয় হয়ে ওঠে । আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা এতই বৃদ্ধি পায় যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশকে দমন করার সর্বপ্রথম সামরিক প্রসার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে । তখন তিনি এই সংঘর্ষকে আন্তর্জাতিকীকরণের উদ্দেশ্যে ভারতকে এই যুদ্ধে লিপ্ত করার জন্যে ভারত এর ওপরে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তের আক্রমন পরিচালনার আদেশ দেন । উদ্দেশ্য , তাহলে জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপের ফলে যুদ্ধবিরতি হবে এবং পাকিস্তান সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে । এই উদ্দেশ্যে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ও রাতে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষোণা ছাড়াই পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকাভারতের আগরতলা , অমৃতসর , পাঠানকোর্ট , শ্রীনগর ,অবস্তিপুর , উত্তরলাই, যোধপুর , আম্বলা এবং আগ্রা বিমান ঘাঁটিসমূহের ওপর আক্রমণ চালায় এবং একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের ভারতের বিরুদ্ধে স্থপথেও যুদ্ধ শুরু করে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে কলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন । ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবণ রামও রাজধানী নয়াদিল্লির বাইরে ছিলেন । তারা অবিলম্বে নয়াদিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি সমগ্র দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত্রির পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেন-
I speak to you at a moment of great peril to our country and our people. Some hours ago, soon after 5.30 p.m. on the 3rd December Pakistan launched full-scale war against us… Today war in Bangladesh has become a war on India……I have no doubt that by the united will of the people, the want on and unprovoked aggression must be met…
ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড ও সর্বাত্মক যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত কমান্ড ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দখলদার পাকিস্তানবাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধেরত বাংলাদেশ সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় নিম্নোক্ত রুটসমূ
১৫২

করে । ভারতীয় নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা মহাসড়কের পথে । চথুর্ত ডিভিশন মেহেরপুরের পাশ দিয়ে কালীগঞ্জ-ঝিনাইদহের দিকে । বিংশতিতম ডিভিশন দিনাজপুরের হিলিকে উত্তরে রেখে পুর্ব দিকে । ষষ্ঠ ডিভিশন তেঁতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁ , পাটগ্রাম থেকে কালিগঞ্জ এবং কোচবিহার থেকে নাগেশ্বরী-কূড়িগ্রাম অভিমুখে । উত্তর মেঘালয় থেকে দুটো বিগ্রেড ঢালু থেকে জামালপুর এবং হালুয়াঘাটের দিকে । পূর্ব দিকে অষ্টম , সাতান্ন এবং তেইশ নং বিগ্রেড সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট , হবিগঞ্জ দিয়ে মউলোভীবাজার এবং আখাউড়া ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ারদিকে অগ্রসর হয় । তেইশ নং ডিভিশন কুমিল্লা ও ময়নামতি পাশ কাটিয়ে দাউদকান্দির দিকে এবং চৌদ্দগ্রাম থেকে লাকশাম ও চাঁদপুরের দিকে এবং আর একটি বাহিনী পূর্ব দিকে বিলোনিয়া থেকে ফেনীর এগিয়ে যায় । বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তপথে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হয় রাজধানী ঢাকা অধিকার এবং পাকিস্তান বাহিনীর পোড়ামাটি নীতির অনুসরনে সর্বাত্মক আক্রমণ থেকে ঢাকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ রক্ষা ।মুক্তিবাহিনীর বিজয়াভিযান১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর অধিনায়কত্বের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর সশস্ত্র সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের জল, স্থল ও আকাশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত ছিল । মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সকাল থেকে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর যোদ্ধারা এক সম্মিলিত পরিকল্পনা অধীনে বাংলাদেশের সকল রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুগপৎ সুসংগঠিত আক্রমণ শুরু করেছিল । মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৭১ সালের ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধে মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তথ্য মুক্তিবাহিনীর বিজয়াভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে প্রথমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম বিমান আক্রমণ শুরু হয় । যুগপৎ ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর সব কটি বিমান ও নৌঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে দেয় । স্থলযুদ্ধে বাংলাদেশের চতুর্দিক থেকে সম্মিলিত মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অভিযান শুরু হয় ঢাকা শহরের দিকএ। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে পূর্ব থেকেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছিল । ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁ, ৫

বীরগঞ্জ, ৭ ভুরুঙ্গামারী, ১০ কান্তনগর ব্রিজের উত্তর অঞ্চল, ১৩ খানসামা, ১৪ চরখাই, নবাবগঞ্জ, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত

১৫৩

হয়। রংপুর ও দিনাজপুর এলাকায় অর্থাৎ ৬ নং সেক্টরে উইং কমান্ডার বাশারের অধিনায়কত্বে সেক্টর বাহিনি ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিবাহিনীর চারটি কোম্পানি অমরখানা থেকে অভিযান শুরু করে, তিনটি কম্পানী চিলাহাটী থেকে ডোমার এবং নীলফামারী, চারটি কোম্পানী পাটগ্রাম থেকে লালমিনিরহাটের দিকে, চারটি কোম্পানী কুড়িগ্রাম হয়ে রংপুরের দিকে এবং চারটি কোম্পানী মোগলহাট থেকে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রাভিযান চালায় এবং মিত্র বাহিনীর সঙ্গে একযোগে পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করার পূর্বেই রংপুর শহর ছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সমগ্র অঞ্চল মুক্ত করে ফেলে।
পদ্মা নদীর দক্ষিণ ও মেঘনা ন্দীর পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টরে ফরিদপুর এবং খুলনাকে মুক্ত করার জন্য দ্বিমুখী অভিযান চালানো হয়দক্ষিন-পশ্চিম এলাকায় আগস্ট মাস থেকে অপারেশনাল কমান্দার ছিলেন মেজর মঞ্জুর। জুলাই মাসে তিনি তিনজন অফিসার সহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন এবং আত নং সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এই এলাকায় ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। পশ্চিমে চৌগাছার উত্তর থেকে পূর্বে মধুমতি নদী পর্যন্ত। চৌগাছা অঞ্চলে সম্মিলিত মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয় ২০ নভেম্বর থেকে, ২৪ নভেম্বর চৌগাছা মুক্ত হয়, ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্মিলিত বাহিনী ঝিকরগাছা মুক্ত করে এবং যশোরের উপর ত্রিমুখী আক্রমন শুরু হয়, ৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। যশোরের পর সম্মিলিত বাহিনী খুলনার দিকে অগ্রসর হয়, খুলনার শিরোমনিতে ঐ এলাকার প্রচন্ডতম যুদ্ধ হয় এবং ৫ দিন লড়াইয়ের পর শিরোমনি মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর সকালে। ইতিমধ্যে ৯ নম্বর সেক্টরের সৈন্যরা ১১ ডিসেম্বর থেকে খুলনার ওপরে আক্রমন শুরু করে, ৭ ডিসেম্বর দ্বিমুখী আক্রমনে সাতক্ষীরা মুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর বরিশাল ও পটুয়াখালিও মক্ত হয়। উত্তরে ৪ ডিসেম্বর দর্শনা এবং ৭ ডিসেম্বর জীবননগর মুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ মুক্ত করার পর সম্মিলিত বাহিনীর একটি দল কুষ্টিয়া ও অপর একটী দল মাগুরার দিকে অগ্রসর হয়। ৮ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত হয়। ৯-১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়াতে রক্তক্ষইয়ী সংঘর্ষ হয়, ১১ ডিসেম্বর কুষ্টীয়া মুক্ত হয়। মেহেরপুর মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর এবং চুয়াডাঙ্গা ৭ ডিসেম্বর।
যমুনা নদীর পূর্বে এবং মেঘনা নদীর পশ্চিমে উত্তর-পূর্ব সেক্তরেও সম্মিলিত বাহিনী আক্রমন শুরু করে ৪ ডিসেম্বর কামালপুর পাকিস্তানী ঘাঁটির ওপরে তীব্র আক্রমনের মধ্যে দিয়ে ঐদিনই কামালপুর মুক্ত হয়। বখলাগঞ্জ মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর, ৯-১২ ডিসেম্বর জামালপুরে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়, জামালপুর মুক্ত করে সম্মিলিত বাহিনী দক্ষিণে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয়। টাঙ্গাইল মুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইলের সংগ্রামে সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীও ছিল। ৩ ডিসেম্বর হালুয়াঘাট থেকে সম্মিলিত বাহিনী দ্রুত ময়মনসিংহের দিকে

১৫৪

অগ্রসর হয় এবং ১১ ডিসেম্বর তা মুক্ত করে। ঢাকার দিকে টাঙ্গাইল থেকে অভিযান সাভার ও টঙ্গী উভয় পাশেই পরিচালিত হয় । ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে কালিয়াকৈর ও টঙ্গী মুক্ত হয় যায় । সম্মিলিত বাহিনীর একটি দল ১৫ ডিসেম্বর সাভারের পথে এবং অপর একটি দল টঙ্গীর পথে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং সমস্ত পাকিস্তানি বাধা বিনষ্ট করে প্রথম দলটি ১৬ ডিসেম্বর মিরপুর সেতুর কাছে এবং দ্বিতীয় দলটি টঙ্গীর রাস্তায় কোটবাজারে এসে অবস্থান গ্রহণ করে । জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সম্মিলিত বাহিনী মিরপুরের পথে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করে ।মেঘনা নদীর উত্তর-পূর্ব সেক্টরে সিলেট অঞ্চলে মক্তিবাহিনীর অভিযানপরিচালিত হয় ।এই অঞ্চলে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে জেড ফোর্স যুদ্ধ করছিল অক্টোবর মাস থেকেই, প্রথম ব্যাটালিয়ন শ্রীমঙ্গলে, তৃতীয় ব্যাটালিয়ন ছাতকে, আর অষ্টম ব্যাটালিন কুলাউড়াতে। তৃতীয় ব্যাটালিয়ন ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি মুক্ত করে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে, তারপর তারা ২৮ নভেম্বরের মধ্যে একে একে ভিট্টিখেল, লুনি , দাউবিখেল গোরা, শিমুলতলা , ছোটখেল মুক্ত করে । ২ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানিরা সমগ্র রাধানগর এলাকা ছেড়ে যায় । ১৬ অক্টোবর অষ্টম ব্যাটলিয়ন সাগরনাল ও ফুলতলা চা বাগান এবং প্রথম ব্যাটালিয়ন খেজুরিচরা চা বাগান মুক্ত করে ফেলে এবং একে একে ধলাই , পেট্রোখেলা চা বাগান অধিকারে আনে, ফলে কুলাউড়া থেকে লাতু পর্যন্ত রেললাইন অকেজো হয়ে পড়ে । ৮ থেকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে প্রথম ব্যাটালিয়ন ফুসকুরি ক্লাব, নুরজাহান, বড়ুয়া, হুসনাবাগ ও রাজঘাট চা বাগান মুক্ত করে । ২০ নভেম্বরের মধ্যে মুক্ত হয়ে যায় বাল্লা ও আটগ্রাম এলাকা এবং ২১নভেম্বরের মধ্যে জকিগঞ্জ পর্যন্ত সমগ্র এলাকাটি । ২৪ নভেম্বর রাতে প্রথম ব্যাটালিয়ন কানাইঘাটের পূর্ব দিকে সুরমা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং শাকিপুর ও গৌরীপুর এলাকা দখল করে নেয় । ১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমলগঞ্জ পর্যন্ত সমগ্র এলাকা শত্রুমুক্ত হয়ে যায় । প্রথম ব্যাটালিয়ন তাদের সিলেট অভিমুখী অগ্রাভিযান শুরু করে ৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে এবং ১৪ ডিসেম্বর ভোরে সিলেট শহর অবরোধ করে তৃতীয় ব্যাটালিয়ন সিলেট শহরের দিকে অগ্রসর হয় ছাতকের দিক থেকে, ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে গোয়াইন, দোহালি বাজার, ৬ ডিসেম্বর ছাতক শহর এবং ৯ ডিসেম্বর চিলিতাবাড়ি মুক্ত করে । তৃতীয় ব্যাটালিয়ন ১০ ডিসেম্বর সালুতিকর বিমানঘাঁটি পর্যন্ত অগ্রসর হয় । ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ ও লামাকাজীও মুক্ত হয় এবং উত্তর – পশ্চিম দিক থেকে তারা সিলেট শহর ঘিরে ফেলে । অন্যদিকে অষ্টম ব্যাটালিয়ন একের পর এক কমলগঞ্জ , শ্রীমঙ্গল , মৌলভীবাজার এবং ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত করে ১৪ ডিসেম্বর রাতে সিলেট শহর অবরোধ করে । পূর্ব দিক থেকে প্রথম ব্যাটালিয়ন, উত্তর ও উত্তর – পশ্চিম দিক থেকে তৃতীয় ব্যাটালিয়ন এবং দক্ষিণ দিক থেকে অষ্টম

১৫৫

ব্যাটালিয়ন সিলেট শহরে প্রবেশ করে। সিলেটের উপকন্ঠে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর সিলেট শহর মুক্ত হয়।
মেঘনা নদীর পূর্ব সেক্টরে সম্মিলিত বাহিনীর যুগপৎ আক্রমন পরিচালিত হয় আখাউড়া, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া, আশুগঞ্জ নরসিংদীতে। মেজর শফিউল্লার অধিনায়কত্বে এস ফোর্স এ অঞ্চলের যুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে। ১ ডিসেম্বর থেকেই এস ফোর্সের তিনটি ব্যাটালিয়ন আখাউড়া এলাকায় আক্রমণ শুরু করেছিল, আজমপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত এলাকা মুক্ত হয় দুইদিনের মধ্যেই। ৪ ডিসেম্বর আখাউড়ায় সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। ৫ ডিসেম্বর আখাউড়া মুক্ত হয়। আখাউড়া থেকে বাংলাদেশ বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী দুটো ভিন্নপথে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়, উজানি শহত থেকে সড়ক ও রেললাইন ধরে ভারতীয় বাহিনী আর ‘সিলেট একসেস’ ধরে এসফোর্স অগ্রসর হতে থাকে। এসফোর্স ২ ডিসেম্বর শাহবাজপুর এবং ৮ ডিসেম্বর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী সরাইল পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে পশ্চাদপসরণ করে পাকবাহিনী যায় আশুগঞ্জে, এসফোর্স সরাইল থেকে সরাসরি আশুগঞ্জের দিকে অভিযান চালায়। ৯ ডিসেম্বর আশুগিঞ্জের যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। এসফোর্সে একাদশ ব্যাটালিয়ন ভৈরব অবরোধ করে এবং বাকি সৈন্যরা লালপুরের কাছে মেঘনা অতিক্রম করে রায়পুরা পৌঁছে যায় সম্মিলিত বাহিনী ১২ ডিসেম্বর নরসিংদি মুক্ত করে তারপর ঢাকার পথে দুটি ভিন্ন ভিন্ন রুটে এগিয়ে চলে এস ফোর্স ও ভারতীয় বাহিনী। ভারতীয় বাহিনী ডেমরার আর এস ফোর্স ভুলতা থেকে মুড়াপাড়ায় , শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ১৩ ডিসেম্বর ডেমরায় নদীর ওপারে পৌঁছে যায় এবং ১৪ ডিসেম্বর নদীর এপারে চলে আসে বালু নদীর পাড়ে। ১৪ ডিসেম্বর এস ফোর্স বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার অদূরে পৌঁছে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ২ টা পর্যন্ত ডেমরায় এস ফোর্সের সঙ্গে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ডেমরায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পনের পরে এস ফোর্সের অধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ ঢাকায় প্রবেশ করেন। তিনি বিমানবন্দরে যান এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর আখাউড়া থেকে ঢাকা অভিযানের সময় ৬ ডিসেম্বর মেজর শফিউল্লাহ ইসলামপুর ব্রিজের কাছে একদল পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে এক হাতাহাতি সংঘর্ষে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পান।
সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর অপর অভিযান চলে সোনামোড়া, ময়নামতি, চান্দিনা, দাউদকান্দি, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, মোজাফফরগঞ্জ, হাজিগঞ্জ ও চাঁদপুর এলাকায়। দ্বিমূখী অভিযানে ৬ ডিসেম্বর ফেনী, ৮ কুমিল্লা, ৯ চাঁদপুর এবং ১০ ডিসেম্বর লাকসাম মুক্ত হয়, সেখান থেকে সম্মিলিত বাহিনী বেলোনিয়ার পথে চট্টগ্রাম যাত্রা করে। চড়ড়্গ্রাম সেক্টরে মুক্তিবাহিনী মেজর রফিকের নেতৃত্বে ৯ ডিসেম্বর শুভপুর

১৫৬

সেতু বরাবর ফেনী নদী অতিক্রম করে, ১০ ডিসেম্বর মিরেরসরাইয়ের পতন হয় । ১১ ডিসেম্বর সীতাকুন্ড মুক্ত হয়, ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী কুমিরায় পৌঁছে যায় এবং ১৪ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে কুমিরা মুক্ত হয়। বঙ্গপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের প্রবেশ এবং চট্টগ্রাম উপকূলে অবতরণের আশঙ্কায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনী অতি দ্রুত চট্টগ্রাম মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় । ভারতের ২৩ ডিভিশনের ৮৩ নং ব্রিগেড লাকসাম থেকে দ্রুত কুমিরায় এসে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় । ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্রবাহিনী ভাটিয়ারী পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে, ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যখন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে তখনো চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৬ মাইল দূরে ভাতিয়ারীতে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। ১৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরনগরীতে প্রবেশ করে । ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ১৫ মি. -এ মুক্তিবাহিনীর ১নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিক সার্কিট হাউসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কুমিরার যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন ।
ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নোয়াখালীর অংশ নিয়ে গঠিত দুই নম্বর সেক্টরে বাংলাদেশ বাহিনীর কে ফোর্স তৎপর ছিল । মেজর খালেদ মোশাররফ কে ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন । কে ফোর্সের মশযে ছিল চতুর্থ, নবম ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং প্রায় ৩৫ হাজার গেরিলা । দুই মাস ধরে যেমন নিয়মিত যুদ্ধ চলছে, তেমন চলছে গেরিলা তৎপরতা তীব্র থেকে তীব্রতর। শালদা নদী, গঙ্গাসাগর, বিলোনিয়া, ফেনী মিয়ারবাজার, চৌদ্দগ্রাম এবং কসবায় নয় মাস ধরে পাকবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘর্ষ চলেছে । কসবা অঞ্চলে ২৩ অক্টোবর এক যুদ্ধে মাথায় শেলের স্পি-ন্টার লেগে মেজর খালেদ মোশাররফ আহত হন এবং কয়েক মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন । কে ফোর্সে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মেজর আবু সালেক চৌধুরী । মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের পরিচালনায় ক্র্যাক গেরিলা র্ফোস ১৯৭১ সালে নয় মাস ঢাকায় অসংখ্য দুঃসাহসী গেরিলা অপারেশন চালিয়াছিল ।
পাকিস্তান বাহিনীর বিপর্যয়ের জন্যে জেনারাল নিয়াজী ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সমস্ত পাকবাহিনীকে ‘পুল ব্যাক’ করে ঢাকার কাছাকাছি পদ্মা-মেঘনার মাঝামাঝি অঞ্চলে চলে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, দক্ষিণে একটি বাহিনী খুলনার কাছে, উত্তরে একটি বাহিনী হিলির কাছে, অন্যদিকে একটি বাহিনী জামালপুরে এবং ময়নামতি ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে দুটি বাহিনী আটকে যায় । যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বাংলাদেশে

১৫৭

যুদ্ধরত পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছে , ৮ ডিসেম্বর থেকে বেতার মারফতে বিভিন্ন ভাষায় তা আকাশবাণীর সমস্ত কেন্দ্র থেকে ক্রমাগত প্রচার করা হতে থাকে । ৯ ডিসেম্বর গভর্নর ডা. মালিকের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী শর্তাধীনে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু জেনারেল নিয়াজী ফরমান আলীর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন । ১৩ দিসেম্বর তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, জেনারেল নিয়াজী সেদিনও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষনা করেন । ১৪ দিসেম্বর গভর্নর ডা. মালিক পরিস্থিতি বিবেচনার জন্যে গভর্নর হাউসে এক উচ্চ পর্যায়ের সভা আহ্বান করেন । ঐ সভা চলাকালে গভর্নর হাউসের ওপর প্রচণ্ড ভারতীয় বিমান হামলা হয় । ফলে ডা. মালিক ও তার মন্ত্রীসভার সব সদস্য পদত্যাগের কথা ঘোষণা করে ঢাকা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের নিরুপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গিয়ে আশ্র্য় গ্রহণ করেন । জেনারেল নিয়াজী তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃসংকল্প এবং তা সম্ভবত বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসরমান মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ভরসায় । কিন্তু ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, সপ্তম নৌবহর বঙ্গপসাগরে প্রবেশ করলেও হস্তক্ষেপ করবে না ।
জেনারেল মানেকশ দিল্লির মার্কিন দূতাবাস এবং আকাশবাণীর মাধ্যমে নিয়াজীকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নেয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেন । ১৬ দিসেম্বর সকাল নয়টার মধ্যে জেনারেল নিয়াজী বেতারে নির্দিষ্ট তরঙ্গ মারফত মিত্রবাহিনীর যোগাযোগ করে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন । ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ২১ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল আরোরা ও বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষ থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন । আত্মসমর্পণের দলিলের প্রথমাংশে ছিলঃ
ঐ দলিলে স্বাক্ষর করেন লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী । আত্মসমর্পণের এই দলিল অনুসারে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযোগী এবং পরিবারবৃন্দ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশের ওপর প্রায় পচিশ বৎসরের পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, তার নয় মাসের অবাধ গণহত্যা, লুণ্ঠন,ব্যাপক নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে যেমন ইউরোপ জুড়ে একদিকে হিটলারের সেনাবাহিনী যুদ্ধ করছিল আর একদিকে গেস্টাপো এস এস ফোর্স ইহুদি নির্মূলে রত ছিল, একাত্তরের যুদ্ধের সময়ও তেমনি একদিকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ করছিল আর অপরদিকে পাকবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালনায় তাদের দোসর ও দালাল রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির

১৫৮

সদস্যরা বাঙালি নিধন এবং সর্বপ্রকার মানবতাবিরধী বর্বর, নৃশংস ও পৈশাচিক কর্মকান্ডে নিযুক্ত ছিল ।
বুদ্ধিজীবী নিধন ও আলবদর
পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চ তাদের সামরিক অভিযান শুরু করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে, সেদিন পাকিস্তানিদের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরটা প্রমুখ বুদ্ধিজীবী । পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী চরম দক্ষিণপস্থী উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট পেস্টাপো আল বদর বাহিনী ঘাতকরা ঢাকা শহরে যুদ্ধ ও কারফিউর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ দিসেম্বরের মধ্যে খুঁজে খুঁজে সেরা বাঙালি অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক,সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের রায়েরবাজার ও মিরপুরে অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকার বধ্যভুমিতে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে । স্বাধীনতার ঊষালপ্লের পূর্ব মূহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানিরা তাদের সামরিক অভিযানের ইতি করে পুনরায় বুদ্ধিজীবী নিধনের মধ্য দিয়ে । এভাবেই স্বাধীনতার বেদিমূলে উৎসর্গীকৃত হলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী,সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়কার ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, চিকিৎসক ড.ফযলে রাব্বী,আলীম চৌধুরী প্রমুখ বহু বুদ্ধিজীবী । এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, পাকিস্তানি সামরিক অফিসারদের আদেশে এ জঘন্য হত্যাকান্ড সম্পন্ন হলেও এ হত্যার পরিকল্পনা ও তালিকা প্রণয়ন, আত্মগোপনকারী বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করা, তাদের ধরে নিয়ে নৃশংস অত্যাচারের মধ্য দিয়ে হত্যা করার কাজটি আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর বাংলাদেশী সদস্য ও নেতাদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছিল । স্বাধীনতার পর হাজার হাজার পাকিস্তানি দালাল গ্রেফতার এবং কিছু কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হলেও প্রথমে সাধারণ ক্ষমতার দৌলতে তাদের অনেকেই মুক্তি পায় এবং পরে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটির বিচারাধীন সদস্যরাও বাংলাদেশে মানবতা বিরুদ্ধে যে ক্ষ্মতাহীন অপরাধ করে তার বিচার হতে রেহাই পেয়ে যায়।
স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!!
১৯৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলা স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল । দীর্ঘ দুইশত চৌদ্দ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পুনরায় বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা হয়ে । অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। পাকিস্তানে বন্দি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর নামে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ দক্ষ নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় । পৃথিবীর মুক্তিযুদ্ধের

১৫৯

ইতিহাসেএমনস্বল্পতমসময়েএমনসফলমুক্তিযুদ্ধেরনজিরখুবকম।বঙ্গবন্ধুরস্বদেশপ্রত্যাবর্তন১৯৭১সালের২৫মার্চরাতেগনহত্যাযজ্ঞশুরুকরারমুহূর্তেপাকসামরিকচক্রবঙ্গবন্ধুশেখমুজিবুররহমানকেগ্রেফতারকরে, পারপরতাকেনিয়েযাওয়াহয়পশ্চিমপাকিস্তানে।পাশ্চিমপাকিস্তানেরকারাগারেমুক্তিযুদ্ধেরনয়মাসকালবঙ্গবন্ধুমৃত্যুরপ্রহরগুনেছেন।পাকসামরিকচক্রসামরিকআদালতেতাঁরবিচারেরপ্রহসনকরেছিল, জেনারেলইয়াহিয়াখানতাঁরফাঁসিরহুকুমদিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুরজেলপ্রকোষ্ঠেরকাছেতাঁরজন্যেএকটিকবরখোঁড়াহয়েছিল,কিন্তুপ্রবলআন্তর্জাতিকচাপেরজন্যেতাঁরপ্রাণরক্ষাপায়।১৯৭১সালের১৬ডিসেম্বররক্তক্ষয়ীযুদ্ধেরমাধ্যমেবাংলাদেশস্বাধীনসার্বভৌমরাষ্ট্রহিসেবেআত্মপ্রকাশকরলেজেনারেলইয়াহিয়াখানেরপতনঘটেএবংআন্তর্জাতিকচাপেপাকিস্তানেরনতুনশাসকজুলফিকারআলীভুট্টোগণপ্রজাতন্ত্রীবাংলাদেশসরকারেররাষ্ট্রপ্রধানশেখমুজিবররহমানকেমুক্তিদানকরতেবাধ্যহন।১৯৭২সালের১০জানুয়ারিঅপরাহ্ণেবঙ্গবন্ধুশেখমুজিবররহমানলন্ডনওদিল্লিহয়েঢাকাফিরেআসেন।বিমানবন্দরথেকেতিনিসোজাচলেআসেনসোহরাওয়ার্দীউদ্যানে।সেখানেবিরাটজনসমুদ্রেরউদ্দেশেঅশ্রুসিক্তকণ্ঠেবঙ্গবন্ধুবলেন, …আমিজানতামনাআবারআপনাদেরমধ্যেফিরেআসতেপারব।আমিওদেরবলেছিলাম, তোমরাআমাকেমারতেচাও, মেরেফেলো।শুধুআমারলাশটাবাংলাদেশেআমারবাঙালিদেরকাছেফিরিয়েদিও…আমারফাঁসিরহুকুমহয়েছিল।জীবনদেওয়ারজন্যপ্রস্তুতহয়েইছিলাম।বলেছিলাম, আমিবাঙালি, আমিমানুষ, আমিমুসলমান, মানুষএকবারইমরে, হাসতেহাসতেমরব,তবুওদেরকাছেক্ষমাচাইবনা।মরারআগেবলেযাব, আমিবাঙ্গালি,বাংলাআমারভাষা, জয়বাংলাবলব,বাংলারমাটিআমারমা।আমিমাথানতকরবনা।…নমঃনমঃনমঃসুন্দরীমমজননীজন্মভূমি।সেইজন্মভূমিরমাটিতেপাদিয়েআমিচোখেরপানিরাখতেপারিনাই।জানতামনা, এইমাটিতেএইজাতিকেএতভালবাসি।পাকিস্তানেরবন্দিশিবিরথেকেবঙ্গবন্ধুরবাংলাদেশেপ্রত্যাবর্তনেরদুইমাসেরমধ্যেইবাংলাদেশেরমুক্তিযুদ্ধেসহায়তাকারীমিত্রবাহিনীভারতীয়স্থল,নৌওবিমানবাহিনীস্বদেশেপ্রত্যাবর্তনকরে।১৯৭২সালের১২মার্চঢাকাস্টেডিয়ামেভারতীয়বাহিনীরআনুষ্ঠানিকবিদায়কুচকাওয়াজহয়।এইকুচকাওয়াজেঅভিবাদনগ্রহণকরেনবঙ্গবন্ধুশেখমুজিবুররহমান।১৯৭২সালের১৩মার্চভারতীয়সশস্ত্রবাহিনীরশেষদলটিরবাংলাদেশথেকেভারতেফিরেযাওয়ারমধ্যেদিয়েবাংলাদেশেরজাতীয়স্বাধীনতাসংগ্রামেরআনুষ্ঠানিকসমাপ্তিঘটে।

১৬০

বাংলাদেশে আত্মসমর্পনকারী ৯০ হাজার পাকিস্তানী সৈনিক ও তাদের সহযোগীরা ভারতে বিভিন্ন বন্দী শিবিরে স্থানান্তরিত হয়, অন্যদিকে পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে হাজার হাজার বাঙালী সরকারি কর্মচারি, সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বেসামরিক অধিবাসী আটকা পড়েন। অনেক বাঙালী আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সাধারন ক্ষমা ঘোষণা এবং ইন্দিরা-ভুট্টোর সিমলা চুক্তির ফলে পাকিস্তানি বন্দীরা স্বদেশে ফিরে যায়েবং প্রায় সকলেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রয়াসে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীরা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সহায়তায় বাংলাদেশে ফিরে আসে। বঙ্গবন্ধু সরকার পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারি অধিকাংশ সরকারি ও সশস্ত্র বাহিনীর ত্রিশ সহস্র কর্মচারীকে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানের অনুমতি দান করেন এবং তারা পুনর্বাসিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহনকারী প্রায় এক কটি শরনার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গঊরব্জনক অধ্যায়। যে বাংলাদেশ যুগ যুগ ধরে শাসিত ও শোষিত হয়েছে যথাক্রমে কর্নাটকী ব্রাক্ষ্মণ, তুর্কি, আফগান বা পাঠান, মোগল, ইংরেজ, পাকিস্তান বা পাঞ্জাবী বহিরাগত দ্বারা, যে বাঙালী ভীতু কাপুরুষ নামে অভিহিত ছিল সেই বাঙালী মাতৃভূমির যুগ যুগান্টের পরাধিনতার লজ্জা ও কলঙ্ক মোচনের জন্য অস্ত্র হাতে ভশত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পরাজিত করেছে পৃথিবীর আধুনিক ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অন্যতম পাঞ্জাবী, পাঠান, বালুচ সৈনিক সমবায়ে গঠিত পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে। বাঙালীর এই মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ নরনারী শিশু আত্মবিসর্জন দিয়েছে, হাজার হাজার অকুতোভয় যোদ্ধা সম্মুখসমরে রণাঙ্গনে প্রান দিয়েছে। দুই লক্ষাধিক মা বোন লাঞ্ছিত হয়েছে পাকিস্তানী পশুদের দ্বারা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দল মত ধর্ম পেশা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যথার্থ অর্থেই ছিল গণযুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন বাংলাদেশের স্থল, জল ও আকাশসীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বাঙালীদের কর্মক্ষেত্রে সমসাধিত ছিল। এ যুদ্ধ রণাঙ্গনের সম্মুখ সমর ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্ত ফ্রন্টে চলছিল। দেশে ও বিদেশে পাকিস্তানের দালাল রাজাকার আলবদর, আল-শামস, শান্তি কমিটি নামধারী মুষ্টিমেয় মীরজাফর ছাড়া দেশে বিদেশে আপামর বাঙালী দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জয়ের কৃতিত্ব কোন একক ব্যক্তি দল বা পেশার প্রাপ্য নয়, এ জয়ের

১৬১
নায়ক ছিল বাংলার কোটি কোটি সাধারন মানুষ, যাদের শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ, তিতিক্ষার ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ত্রিশ কোটি শহীদের রক্তে রক্তাক্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
[১০২] রফিকুল ইসলাম

এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও মুক্তিসেনা, মুক্তিসেনা
এটি একটি উদ্দীপনামূলক শ্লোগান। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানীরা সমস্ত বাংলাজুড়ে বর্বরতা চালাতে থাকে। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে বাংলার গণমানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনী অত্যাচারিত বাঙালীর কাছে আশীর্বাদ পক্ষান্তরে পাকিস্তানী বাহিনির কাছে মুক্তিবাহিনী ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। এই মুক্তিবাহিনীর প্রতি নৈতিক সমর্থন দান, তাদের কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করা ও দেশে-বিদেশে মুক্তিবাহিনীর জন্য সমর্থন বৃদ্ধি করার জন্য প্রবাসীদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
[৩৮] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এনায়েত করিম (১৯২৭-১৯৭৪)
বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ঢাকা জেলার জিঞ্জিরায় ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ও এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে পেশাজীবনের শুরু হলেও বেশিদিন শিক্ষকতায় যুক্ত থাকেননি। ১৯৫৩ সালে পররাষ্ট্র দফতরের চাকরিতে যোগ দেন এবং পরবর্তী দুই দশক কূটনীতিক হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন জনমত কে বাংলাদেশের পক্ষে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে অনেক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। তিনি তখন ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। ৪ আগস্ট ১৯৭১ আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুজিবনগর সরকার তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান কর্মকর্তা নিযুক্ত করে। স্বাধীনতার পর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এর দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে পররাষ্ট্রসচিব থাকাকালে ১৬ ফেব্রুয়ারী তিনি ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।

১৬২
এবারের সংগ্রাম/স্বাধীনতার সংগ্রাম/রক্ত যখন দিয়েছি/রক্ত আরো দেব/
ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল
৭২X৫১ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এবারের সংগ্রাম/স্বাধীনতার সংগ্রাম/রক্ত যখন দিয়েছি/রক্ত আর দেব/ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। বঙবন্ধুর ওইতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের উপর ভিত্তি করে এই পোষ্টার টি প্রকাশিত হয়েছিল। এই পোষ্টারটি মূলত স্বাধীনত সংগ্রামের জন্য বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশস্বরূপ। প্রতিটি ঘরকে স্বাধীনতার জন্য এক একটি দুর্গে পরিণত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের ওপর ভিত্তি করে পোষ্টারটি প্রকাশিত হলেও ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন পোষ্টারটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক বংগবন্ধু গ্রেফতার হলে বাঙালী একরকম নেতৃত্বহীনতার মাঝে পড়ে যায়যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা কিভাবে যুদ্ধ করব, কাদের সাহায্য সহযোগিতা নেব বা কার সাথে যোগাযোগ করব, বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন কিনা, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার কি নির্দেশ ইত্যাদি ছাড়াও স্বাধীনতাবিরোধীদের অপপ্রচার জাতিকে এক সন্দিহান অবস্থায় ফেলে দেয়। এমন এক পরিস্থিতিতে এই পোষ্টার অনেক টা হালবিহিন নৌকায় হালের মত কাজ করে। এই পোষ্টারের মূল বক্তব্য ছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটাই হবে একমাত্র ঘোষণা, আর বাঙালীর একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। এই পোষ্টারটির ছবিতে বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচু করে বাঙালীর প্রতি যে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, এটাকে বাঙালী জাতির কাছে মনে হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু যেন বাঙালীর সামনে উপস্থিত হয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাহস যোগাতে এই পোস্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
এই নপোস্টারটিতে তিনটি রঙের ব্যবহার করা হয়েছে, কালো লাল সাদা। কালো রঞে লেখা হয়েছে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই কথাটির পূর্বে লাল রঙের তিনটি ফোঁটা দেখতে পাওয়া যায়। আমরা যদি নেই লাল ফোটাটিকে রক্তের বিন্দুর সাথে তুলনা করি তবে বলা যায় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন তাদের জন্য শোককে বোঝানোর জন্য কালো রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। ‘রক্ত যখন দিয়েছি/আরো রক্ত দেব/ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ এই প্রতিবাদী কথাগুলোতে লাল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে আরেকটি বিষয় হল, দুর্গ গড়ে তোলার জন্য রক্ত দিতে যেন বাঙালী পিছপা না হয় তারও প্রকাশ এই রঙে পাওয়া যায়। পোষ্টারের পুরো জমিনে সাদা রং ব্যবহার করতে দেখা যায়। এটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার বমাটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব তা বোঝানোর জন্যে

১৬৩

শান্তির প্রতীক সাদা ব্যবহার করা হয়েছে
[৫৭৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বপন

এম আর আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪)
জন্ম ১৯২৯ সালের ৯ আগস্ট বগুড়া জেলার মহাস্থানের অন্তর্গত চিংগাসপুর গ্রামে। পিতা সা’দত আলী আখন্দ। জনাব আখতারের জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুরজীবিকার তাগিদে কখনো তাকে এজি অফিসে সিভিল সাপ্লাই অ্যাকাউন্টস, দুর্নীতি দমন বিভাগ, বীমা কোম্পানীতে চাকরি করতে হয়েছে। কখনো আবার সেজেছেন অভিনেতা, হয়েছেন গৃহশিক্ষক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার, বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সুদূর লন্ডনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাটার। প্রতিটি ভূমিকাতেই অনন্য সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।কখনো হাত দিয়েছেন ছাপাখানা, আটা, চাল, কেরোসিন, সিগারেট, পুরোনো গাড়ি, বাস টড়াকের ব্যবসায়। করেছেন ছাত্র রাজনিতি। ১৯৪৮-১৯৪৯ সালে জেল খেটেছেন।জেল থেকেই স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছেন। অংশগ্রহন করেছেন ভাষা আন্দোলনে, হাসিমুখে বরণ করেছেন বিদেশের মাটিতে সাড়ে তিন বছরের নির্বাসিত জীবন; যখনই যা কিছু করেছেন, সেটাকেই স্বকীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন। সাংবাদিকতা পেশায় নিয়জিত ছিলেন প্রায় দুই যুগের মত। কাজ করেছেন বেশ কিছু দেশি বিদেশী পত্র-পত্রিকা ও বার্তা সংস্থায় বিভিন্ন পদ ও মর্যাদায়। বেশিরভাগ সময় কেটেছে দুর্ধর্ষ রিপোর্টারের ভূমিকায়। সফরসঙ্গী হয়েছেন শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, ভুট্টোর মত রাষ্ট্রনায়ক ও বড় নেতাদের। সাংবাদিক হিসেবে ঘুরেছেন দুই গোলার্ধে অসংখ্য দেশ। দেখেছেন বহু বিচিত্র মানুষ, প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছেন বহু রুদ্ধশ্বাস চাঞ্চল্যকর ঘটনাপ্রবাহের, সাক্ষী ছিলেন বহু ঐতিহাসিক মুহুর্তের। বঙ্গবন্ধুর উষ্ণ সান্নিধ্য ও ভালোবাসা তাঁর জীবিনের এক অবিস্মরনীয় স্মৃতি।
জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জল মুহুর্ত ১৯৭১ এর ১১ ডিসেম্বর সদ্যমুক্ত স্বাধীন যশোরের মাটিতে পদার্পণ করেন এবং ১৯ তারিখে সরাসরি মুজিবনগর থেকে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকা প্রত্যাবর্তন। আর সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম স্থপতি এবং নিয়মিত রণাঙ্গন পরিদর্শন শেষে স্বকন্ঠে বেতারে সাড়া জাগানো ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান প্রচার।
সাধারণ মানুষের মনের কথাকে, সুপ্ত আশা ও স্বপ্নকে তিনি জীবন্ত ও মূর্ত করে তুলে ধরেছিলেন সেদিনের সেই বিপন্ন ও অসহায় কিন্তু বীরত্বব্যঞ্জক মুহুর্তে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে তাঁর এই অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। ২০০৪ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।

১৬৪

এম আর সিদ্দিকী (১৯২৬-১৯৯২)
রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট শিল্পপতি। তিনি ১ মার্চ ১৯২৬ সীতাকুন্ডে জন্মগ্রহন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমকম পাশ করেন। কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও পরে ব্যবসা বানিজ্য ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে কালুরঘাট স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র (২৬ মার্চ ১৯৭১) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ত্রিপুরা সেক্টরে যুবক্যাম্প ও মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্প সংগঠনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে জনমত গঠনের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ছিলেন। এছাড়া জাতিসংঘে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তার অনন্য ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতার পর কিছুকাল বঙ্গবন্ধু সরকারের বানিজ্যমন্ত্রীর দ্বায়িত্বে ছিলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এম এ মালেক, ডা. (-১৯৭৭)
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ‘সবকিছু স্বাভাবিক’ তা প্রমাণের উদ্দেশ্যে ডা. এম এ মালিকের নেতৃত্বে একটি প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করেন ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। মূলত এ সরকার ছিল পুতুল সরকার। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি জনাব বি এ সিদ্দিকী গভর্নরকে শপথ বাক্য পাঠ করান। ডা. এম এ মালিকের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন গভর্নর জনাব সুলতান উদ্দিন আহমদ, আবদুল মোনায়েম খান, খান এ সবুর, গোলাম আযম প্রমুখ। এম এ মালেক এক সময় শ্রমিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্য ছিল বহির্বিশ্বে প্রচার করা যে, বাংলাদেশে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। মন্ত্রীসভা গঠন করা হয় স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ, খেলাফতে আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দল থেকে ব্যক্তিদের নিয়ে। মন্ত্রীসভার উল্লেখযোগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- আবুল কাশেম, নওয়াজেশ আহমেদ, আব্বাস আলী খান, এ এম এ সোলায়মান, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, মুলানা এ কে এম ইউসুফ, মওলানা ইসহাক, শামসুল হক, সামসুদ্দিন আহমেদ, আখতারুদ্দিন আহমদ, মং শু প্রু চৌধুরী, এ এম মোশাররফ হোসেন, মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পরাজিত হবার সাথে সাথে এ মন্ত্রীসভা

১৬৫

পদত্যাগ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা এবং বাঙালী নিধনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার অপরাধে বিশেষ আদালতে ১৯৭২ এ তার বিচার অনুষ্ঠিত হয়। বিচারে তার যাবতজীবন কারাদন্ড হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানম্নত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দালালদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ১৯৭৪ সালে মুক্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর।

এম এ হাই, ডা.
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট রাজনীতিক, সমাজসেবী, সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিওষ্ট সহচর ডা. এম এ হাই পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পিরোজপুর-কাউখালি আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমবঙ্গের শরনার্থী কযাম্প রানাঘাটে দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন পিরোজপুর শহরের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এবং সর্বজন শ্ররদ্ধেয় ব্যক্তি।

এম এ হান্নান
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এম এ হান্নান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন।চিরসংগ্রামী ও সাহসী এই নেতা ১৯৭১ সালে ওশোহো্যগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম জেলায় ৫ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তার একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাটী ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার করতে ধানমন্ডির ৩২ নং সড়কে উপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণার তারবার্তাটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের নিকট পৌঁছালে তিনি নেটি প্রচারের জন্য অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন ও চট্টগ্রামের কালুরঘাট

১৬৬

বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ২৬ মার্চ কালুঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণাটি প্রচারকাজে তাঁকে সহায়তা করেন কালুরঘাট রেডিও অফিসের রাখালচন্দ্র বণিক, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান কাউসার, মোশারফ হোসেন প্রমুখ এমপি ও এমএনএ। মুক্তিযুদ্ধের এই সময় সামরিক বাহিনীর একজন মেজরের এই স্বাধীনতা ঘোষণাটি পাঠ বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে, এই চিন্তা থেকেই এই নেতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ততকালিনবাঙালী মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণার অনুরোধ করেন এবং জিয়াউর রহমান রাজি হন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র বিমান আক্রমন করে ধ্বংস করে দেয়। এম এ হান্নান তখন মুক্তিযোদ্ধা দলসহরামগড় এলাকায় সরে আসেন। পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা রামগড় আক্রমন করলে তারা ভারতের ত্রিপুরা চলে যান। এর অল্প কিছুদিন পরে মুক্তিবাহিনি হরিণা নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। এখানে একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়। জুন মাসে এই যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দ্বায়িত্ব এম এ হান্নানের উপর অর্পিত হয়। একইসাথে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বিষয়াদি এবং সামরিক বাহিনীর লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশমাতৃকার টানে পাণের মায়া ত্যাগ করে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ ও দীর্ঘ্য ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। এই ত্যাগী, সাহসী জননেতার স্বীকৃতির জন্য ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রাম বিমানবন্দর তাঁর নামে ‘এম এ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামকরণ করেন। কিন্তু বিএনপি জামাত জোট সরকার পরবর্তীতে তা বাতিল করে দেয়।
এম মনসুর আলী (১৯১১৭-১৯৭৫)
এম মনসুর আলী। বাংলার এক অগ্নিপুরুষের নাম। সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন না হয়েও যিনি দেশবাসীর কাছে ক্যাপ্টেন মনসুর নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটির ইতিহাসে যাঁর নাম কেবল আষ্টেপৃষ্ঠেই জড়িয়ে নেই দেশপ্রেম, ন্যায়পরায়নতা, আদর্শ আর বিশ্বস্ততার এক জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি।তাঁর কথা এলেই বাংলাদেশের কথা আসে। আসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। আসে তাঁর তিন সহকর্মী জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামরুজ্জামানের কথা। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কান্ডারিই ছিলেন তাঁরা।

১৬৭

১৯১৭ সালে ১৬ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের কুড়িপাড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম তাঁর। পিতা হরফ আলী সরকার এবং মা রওশন আরার প্রিয় মনসুর ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং অধ্যবসায়ী। গান্ধাইল মাইনার স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল তাঁর। হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চবিদ্যালয়ে। ১৯৩৫ সালে বিএল স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৩৭ সালে আইএ পাশ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৪৪ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেনীতে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন।
মনসুর আলীর কর্মজিবন শুরু হয় আইন পেশার মাধ্যমে। ১৯৪৫ সালে তিনি পাবনা বার এ যোগদান করেন। পেশার প্রতি আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে তিনি যোগ দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বারে। পাবনা আইনজীবী সমিতির পরপর তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। আইন পেশায় আত্মনিয়োগের পর থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের পাবনা জেলা শাখার সহসভাপতি। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে মুসলিম লীগ থেকে পৃথকভাবে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রজ্ঞাময় পুরুষ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল যেমন বিস্তৃত তেমনি অর্থবহ।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সব স্থানেই ছিল তাঁর নিজস্বতা, ছিল বিশাল ব্যক্তিত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আচরণ। আপন নৈপুণ্যে সৃষ্ট এই মহীরুহের মত মানুষটি ভাষা আন্দোলন, পাবনার ভুটতা আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহসী ও আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে কেবল জাতীয় নেতা না, বাঙালী জাতির মনে অত্যন্ত সম্মানের আসন গড়েছেন। ১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে পাবনায় নেতৃত্ব প্রদান করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আতাউর রহমান খান যখন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত খাদ্য, আইন এবং রাজস্ব এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় প্রাদেশিক রাজনীতিতে মনসুর আলীর প্রভাব কত বলিষ্ঠ ছিল। এই সময়টাতে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মন্ত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দরদি এবং নিষ্ঠাবান।তবে তাঁর এ মন্ত্রীত্ব দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কারণ ষড়যন্ত্রের

১৬৮

মাধ্যমে জেনারেল (অব.) ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা বাতিল করে দেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইস্কান্দার মির্জার হাত থেকে শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন সেনানয়ক আইয়ুব খান। এ সময় অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য অনেক নেতাসহ মনসুর আলী কারাগারে বন্দি হন। তবে হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমানিত হয়ে ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন।
প্রগতিশীল মানসিকতার উদার এ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আওয়ামী লীগের সুদিন এবং দুর্দিনের সঙ্গী ছিলেন। ১৯৬৩ সালে সহরাওয়ার্দির মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের দুর্দিন শুরু হলে পাবনায় আইয়ুব-মোনেম বিরোধী আন্দোলনে জড়িত হয়ে মনসুর আলী দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব যখন আওয়ামী লীগের সব দ্বায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন তখন শেখ মুজিবের প্রিয় বন্ধু ও সহচর হিসেবে ১৯৬৭ এর ১২ নভেম্বর মনসুর আলী কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ষাটের দশকের শেষ দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা যে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে তার পিছনে মনসুর আলীর অবদান ছিল অসাধারণ। সে কারয়ানেই শেখ মুজিবের কারাবাসজাত অনুপস্থিতিতে যাতা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মনসুর আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে সারা বাংলায় গণ আন্দোলনকে দুর্বার করার জন্য মনসুর আলি নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন। মনসুর আলী যথার্থ অর্থেই ছিলেন একজন জননেতা। জণগনের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করে সকল আন্দোলনেই জণগনকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর নিজের এলাকা কাজীপুরে জণগনের সেবা করে তাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। সে কারণে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যেমন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেও তেমনি জণগনের বিপুল সমর্থন লাভ করেছিলেন তিনি। সত্তর সালে নির্বাচন হয়েছিল ৬ দফার ভিত্তিতে। এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে পাশ করে জাতীয় পরিষদের সাংসদ নির্বাচিত হন। সে সময় সমস্ত পাকিস্তানে রাজনীতির ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় নেমে আসে, সেই বিপর্যয়কে মনসুর আলি একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের ন্যায় মোকাবেলা করেছিলেন।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম লগ্নে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হবার ফলে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তার অন্যতম মন্ত্রী ছিলেন মনসুর আলি।
স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পরেই যাঁদের নেতৃত্ব ছিল তাঁদের মধ্যে এম মনসুর আলী ছিলেন অন্যতম। ১৯৭১ সালে মুজিবঙ্গরে প্রতিষ্ঠিত

১৬৯

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন তিনি এবং ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মনিবেদিত হয়ে কাজ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর ভারত থেকে স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের অর্থ, শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বানিজ্য দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সরকারের পুনর্গঠিত মন্ত্রীসভার যোগাযোগ মন্ত্রী (১২ জানুয়ারি ১৯৭২-৭ জুলাই ১৯৭৪) এবং স্বরাষ্ট্র এবং যোগাযোগ মন্ত্রী (৮ জুলাই ১৯৭৪-২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি সরকার গঠিত হলে মনসুর আলী প্রধানমন্তী নিযুক্ত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিশৃংখল দেশটির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সর্বদলের সমন্বয়ে গঠিত কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বাকশাল গঠিত হলে তিনি তার সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন। তাঁর উপর অর্পিত প্রতিটি দ্বায়িত্ব তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে সোনার বাংলায় পরিণত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা বা উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলার পথ থামিয়ে দেয় এদেশেরই একদল কু-সন্তান। যারা চায়নি এ দেশটি স্বাধীন হোক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই পরাজিত শ্রেনীর ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাকাঙ্খী অফিসার হত্যা করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বন্দী করে মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতাকে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি চাইলে মন্ত্রী হতে পারতেন, প্রধানমন্ত্রীত্বও পেতেন। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক তাঁকে ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহন করতে আহবানও জানিয়েছিল কিন্তু ঘৃণাভরে মোশতাকের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বুলেট কে বুকে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। মোশতাকের এ প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়া মানে মৃত্যুকে বরণ করা একথা তিনি জানতেন।কিন্তু মৃত্যুভয় তাঁকে তাঁর নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মনসুর আলীর মত অসাধারণ বীর মহৎ আদর্শবান নেতার পক্ষেই এমনটি সম্ভব ছিল। তাঁর এ বীরত্ব ও আদর্শের কাছে হেরে মোশতাক সরকার ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় কারাগারের প্রচলিত সব নিয়ম অগ্রাহ্য করে কাপুরুষের মত জেলের ভিতর তিনি এবং আরো তিন নেতাকে হত্যা করে বাঙালী জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় অধ্যাইয়ের সূচনা করে।

ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার
মুক্তিবাহিনীর ক্রোড়পত্র ‘ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার’ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের থেকে এম আর আখতার কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। সচিত্র ক্রোড়পত্রটির কলামসংখ্যা ৩ এবং এর প্রথম প্রকাশ ও অন্যান্য তথ্য জানা

১৭০

যায়নি। তারিখ ছাড়া প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৩৭৮ সংখ্যাটিতে যুদ্ধের আক্রমণ, সাফল্য, অগ্রগতি, শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেশবাসীর প্রতি, মুক্তিবাহিনীর প্রতি ও বিশ্ববাসীর প্রতি কিছু বক্তব্য ছাপা হয়েছে।

ওয়াহিদুল হক (১৯৩৩-২০০৭)
ওয়াহিদুল হক ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ, রবীন্দ্র গবেষক এবং শিল্পী। ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনবাংলা শিল্পীসংস্থার অন্যতম প্রধান উদ্যোগী, প্রবীন লেখক ও সাংবাদিক।
ওয়াহিদুল হকের জন্ম ১৩ মার্চ ১৯৩৩ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ভাওরাল মনোহরীয়া গ্রামে। তাঁর পিতা আবু তাইবুল মাজহারুল হক, সাবেক এম এল এ মাতা মেওরা বেগম।
কেরানীগঞ্জে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে আনন্দ রসে। পড়াশুনা, শিল্প সংস্কৃতিচর্চা প্রভৃতির মধ্যে। এর বাইরে তার পরিচয় ছিল একজন দক্ষ ফুটবলার ও টেনিস খেলোয়ার হিসেবেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার অয়াট চুকিয়ে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিয়েই তাঁর জীবন শুরু। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তিনি এতে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছায়ানট শুধু একটি গান শেখানোর প্রতিষ্ঠানই নয়, মানুষের মধ্যে মুক্ত চিন্তা ছড়িয়ে দেবার কাজ করছে। ছায়ানটই ঢাকার রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখের আয়োজন শুরু করে এবং এখনো করছে। এছাড়া ষাট এর দশকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সূত্রপাত তাঁর হাতে। ব্রতচারী আন্দোলনেও তিনি জড়িত ছিলেন।
এক সময় বাম রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ন্যাপের প্রার্থী হয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে সংসদ নির্বাচন করেন। ১৯৬৫ সালে আজিমপুর এলাকার বিডি মেম্বার নির্বাচিত হন।
একাত্তরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনবাংলা শিল্পী সংস্থার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। গড়ে তোলেন সংগ্রামী শিল্পী পরিষদ। মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও সহযোগিতা করাই ছিল এই পরিষদের কাজ। এই শিল্পী সংস্থা শুধু সাধারন মানুষই নয় মুক্তিযোদ্ধাদেরও মনোবল অটুট রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। পেশায় অর্ধশতকেরও বেশি সময় তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে অবজারভার এর শিফট ইনচার্জ ছিলেন। সে সময় অবজারভার বাঙালীর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম বাহন হয়েছিল। এরপর

১৭১

‘মর্ণিং নিউজ’, ‘ডেইলি স্টার’ এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন। নিউ নেশনে, দৈনিক জনকন্ঠ ও দৈনিক ভোরের কাগজে নির্বাচিত কলাম লিখেছেন।
তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটের তত্ত্বাবধানে বাংলা উচ্চারণ অভিধানের সম্পাদকমন্ডলীর একজন ছিলেন। ওয়াহিদুল হক আজীবন ছিলেন সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সব অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। মুক্তচিন্তা, উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এই পন্ডিত ব্যক্তির দেশের সংগীত ও সাংবাদিকতা সহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান অপরিসীম।
২৭ জানুয়ারি ২০০৭ বাংলাদেশ ডায়বেটিক হাসপাতালে দীর্ঘ ২৩ দিন নানা জটিলতায় মৃত্যুর সংগে লড়ে শেষে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর অপার শক্তি ফুরিয়ে যায়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য মরদেহ দান করে গেছেন।

ওসমানী, মুহাম্মদ আতাউল গনি
দ্র. ষষ্ঠ খন্ড

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
[বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ, যা পাশ্চাত্যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এর উদ্যোক্তা ছিলেন বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবিশঙ্কর। কনসার্টটি কিভাবে অনুষ্ঠিত হল তার বিবিরণ দিয়েছেন রবিশঙ্কর।]
আমি তখন নিউইয়র্ক যাচ্ছি। তখনই শুনলাম গণহত্যার খবর। এর কয়েকমাস পর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে দেখা। জর্জ পশ্চিমা সঙ্গীতের বিখ্যাত মানুষ, গীতিকার এবং সাবেক ‘বিটল’। মানসিকভাবে আমি তখন ভীষণ অস্থির। জর্জ আমার সমস্যাটা জানতে চাইল। তাঁকে বাংলাদেশের নারকীয় অবস্থার কথা বয়ান করলাম। সব শুনে জর্জ খুব কষ্ট পেল। জানতে চাইল, এ বিষয়ে তার করার কিছু নাছে কি না। ভাবলাম, রিলিফ ফান্ড বা অন্য কোথাও কিছু টাকাকড়ি তো আমরা পাঠাতেই পারি। ধরা যাক, অন্তত ২৫ কি ৩০ হাজার ডলার? পাঠানো তো যায়ই। কিন্তু আমি চাইছিলাম অন্য কিছু করতে, আরো অর্থপূর্ণ কিছু। যদি বড় মাপের একটা অনুষ্ঠান করা যায় তাহলে হয়ত আরো বড়ো দর্শক শ্রোতার কাছে যাওয়া যাবে। তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে সচেতনতা।
বড় মনোকষ্টে ছিলাম। ঐ অবস্থাতেই কম্পোজ করলাম দুটো গান, একটি

১৭২

‘জয়বাংলা, জয়বাংলা’, অন্যটি ‘ও ভগবান, খোদাতালা’। দুটো গানই পরে রেকর্ড করা হয়েছিল। যা কিছু করছিলাম সবই কিন্তু তাৎক্ষণিক আবেগের বশে। ঠিক করলাম মঞ্চে একটা মিউজিক্যাল কনসার্ট করব। ব্যাপারটার জন্য জর্জ যেন তৈরি হয়েই ছিল। বলল, তার সামর্থ্য অনুযায়ি সবকিছু সে করবে। ঠিক হলো অনুষ্ঠান করব সবসুদ্ধ দুটো। একটা হবে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের, অন্যটি পশ্চিমা সঙ্গীতের। পশ্চিমা জনপ্রিয় তারকারা সেখানে গান করবেন। এদিকে হাতে সময় ছিল খুবই কম। ঠিক করলাম এই অল্প সময়ের নোটিশে যারা ম্যানেজ করে আসতে পারবেন তাঁরাই অংশ নেবেন এই অনুষ্ঠানে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল পারফর্মাররা অনুষ্ঠানের জন্য কোন টাকাপয়সাও নেবেননা। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জর্জ তার গায়ক বন্ধুবান্ধবদের ফোন করতে শুরু করল। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা প্রথিরযশা ছিলেন, যেমন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন এঁদের সঙ্গে জর্জের যোগাযোগ হলো। মাত্র দিনকয়েকের মধ্যেই সবকিছু ঠিক্টহাক। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে স্কনসার্টের ব্যবস্থা হল। সেখানেই টানা দুয়েক সপ্তাহ কনসার্টের পরিকল্পনা নিলাম। এ উপলক্ষ্যে জর্জ নিজে তো একটা গানই লিখে ফেললঃ ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। আলী আকবর ভাই ও আল্লারাখা ভাইকে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে বাজাতে। এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা।
কী বিশাল সাফল্য! প্রতিদিন টানা দু-দুটো শো হত আমাদের- একটি ম্যাটিনি, অন্যটি সন্ধ্যাবেলায়। প্রতিটি শোতেই হাজার বিশেকেরও বেশি দর্শকের সমাগম হত। কনসার্টের উপর তৈরি ছবি, ডিস্ক ও ক্যাসেট বিক্রির বদৌলতে সন্তোষজনক পরিমান অর্থ সংগৃহীত হল। টাকাকড়ি লেনদেনে সরাসরি আমাদের কোন হাত ছিলোনা। খরচাপাতি বাদ দিয়ে পুরো টাকাটাই ইউনিসেফ পরিচালিত বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাহায্য তহবিলে তুলে দেওয়া হল। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ নামটি রাতারাতি সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল। আর জর্জ হ্যারিসনের সেই গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ তো তক্ষুণি হিট!
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে এই সামান্য কাজটুকু তো অন্তত করতে পেরেছি। শেষ ভাল যার সব ভাল তার!
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ এর ১ নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। যেসব শিল্পী সেখানে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা হচ্ছেনঃ

পন্ডিত রবিশঙ্কর এলান বাটলার
ওস্তাদ আলী আকবর খান জেসি এড ডেভিস
ওস্তাদ আল্লারাখা খান চাক ফিন্ডলে
কমলা চক্রবর্তী মার্লিন গ্রিন
জর্জ হ্যারিসন ইয়ানি গ্রিন
এরিক ক্ল্যাপ্টন জো গ্রিন

১৭৩

বব ডিলান ডলোরেস হল
বিলি প্রেস্টন জিম হর্ণ
লিওন রাসেল জ্যাকি কালসো
রিংগো স্টার জিম কেল্টনার
ক্লাউস ডুরমান ক্লডিয়া লিনিয়ার
ব্যাড ফিঙার লু ম্যাক্রিরি
পিট হ্যাম ওলি মিশেল
টম ইভান ডন নিক্স
জোয়ি মোলান্ড ডন প্রেসটন
মাইক গিবসন কার্ল র‍্যাডলে

কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮)
চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। আসল নাম আবু সরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ‘পটুয়া কামরুল হাসান’ নামেই সবার কাছে পরিচিত। কলকাতায় ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। পিতা মোহাম্মদ হাশিম ছিলেন তিলজালা গোরস্থানের সুপারিনটেন্ডেন্ট।
কামরুল হাসানের শিক্ষাজীবন কাটে কলকাতায়। তিনি কলকাতার মডেল এমই স্কুল (১৯৩০-৩৫) এবং কোলকাতা মাদ্রাসায় (১৯৩৬-৩৭) প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার গভর্ণমেন্ট স্কুল অফ আর্টস-এ ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রজীবনে চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি বয়েজ স্কাউট, শরীরচর্চা, ব্রতচারী আন্দোলন, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুলফৌজ প্রভৃতি কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি শরীরচর্চা প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হন।
১৯৪৭ সালে কামরুল হাসান ঢাকা চলে আসেন এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সাথে ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৪৮) ১৯৬০ সালে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের নকশাকেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে ঐ পদ থেকে অবসর গ্রহন করেন।
ষাটের দশকে বাঙালী জাতিসত্ত্বা বিকাশের আন্দোলনে, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে দারুনভাবে উজ্জীবিত করেছেন। কামরুল হাসান বাংলাদেশের স্বাধীকার ও অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন (১৯৬৯-৭০) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দ্বায়িত্বও পালন

১৭৪

করেন। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপায়ী, হিংস্র মুখমন্ডল সম্বলিত একটি পোস্টার এঁকে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পোস্টারটির শিরোনামঃ ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। ইংরেজীতে ANNIHILATE THESE DEMONS। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার বহু চিত্রকর্ম তিনি এঁকেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে তিনি অনুরূপ আরেকটি স্কেচ আঁকেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামে। কামরুল হাসানের চিত্রকর্মের মধ্যে তার রাজনৈতিক সচেতনতা, অনযায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদী মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাজ সচেতনতাই প্রকাশ পেয়েছে।

খন্দকার মোশতাক আহমদ
খন্দকার মোশতাক আহমদ মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী, স্বাধীনতার পর বিদ্যুত, সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরে বানিজ্যমন্ত্রীর (১৯৭২-১৯৭৫) এবং ১৯৭৫ এ বিতর্কিত ৮৩ দিনের রাষ্ট্রপতি। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার দশপাড়া গ্রামে তার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রী লাভের পর ১৯৪২ সালে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাজনীতিতে যোগদান করেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মোশতাক আহমদ দাউদকান্দি-হোমনা নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসবা ভেঙে দেবার পর (১৯৫৪) তিনি গ্রেফতার হন এবং জেল থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের চীফ হুইপ নিযুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে ৮ টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি এর পুর্ব পাকিস্তান কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান আহুত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন।

১৭৫

১৯৭০ মসালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভায় তিনি বিদ্যুত, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরে বানিজ্যমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব লাভ করেন (১৯৭২-১৯৭৫)। বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে তিনি সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে তিনি এর কার্যনির্বাহি কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে মোশতাক আহমদ নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ‘জয়বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান চালু করেন এবং বাংলাদেশ বেতারের নামকরন করেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’। তার সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীণ আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। অনুমান করা হয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
মশতাক আহমেদ ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। একই বছর তৎকালীন সামরিক সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। সামরিক সরকারের দায়ের করা দুটি দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি পাঁচবছর কারাদন্ড ভোগ করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ The Peoples Republic of Bangladesh দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত নতুন প্রজাতন্ত্র (২৬ মার্চ ১৯৭১, স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রথম সরকার গঠিত হয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘাঁটির কাছে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে, পরবর্তী নাম মুজিবনগর)। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আম্রকাননে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মগ্রহন করে। মুজিবনগর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর ঢাকা মুক্ত হলে মুজিবনগর হতে সরকারি দফতরসমূহ স্থায়ি রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

১৭৬

অনুসারে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্তের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন। কর্ণেল (পরবর্তীতে জেনারেল) মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী প্রধান সেনাপতি এবং কর্ণেল আব্দুর রব চিফ অফ দি স্টাফ নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে বন্দী থাকাকালীন উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দ্বায়িত্ব পালন করেন এবং জনাব তাজউদ্দীন আহমদ কে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। অপর তিনজন মন্ত্রী ছিলেন জনাব মনসুর আলি, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান। মুজিবনগর হত্র সরকারি দফতর ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ মন্ত্রীসভার সদস্যসংখ্যা বর্ধিত হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৯ মাসের বন্দিদশাইথেকে মুক্ত হয়ে (পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তির পর লন্ডন দিল্লী হয়ে) ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকায় পৌঁছে সাময়িকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন।

গ্রেনেড
গ্রেনেড সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। সাইক্লোস্টাইল মেশিনে এবং ঢাকার তরুন ছাত্রকর্মীদের কয়েকজন নটরডেম কলেজ থেকে মেশিনটি উঠিয়ে এনে শহরের কোন এক বাড়িতে এই পত্রিকার কাজ সম্পণ্ণ করতেন। ‘বিচ্ছু’ নামের এই গেরিলা বাহিনি তরুন শক্তি নিজেকে বাজি রেখে যেমন অস্ত্রে লড়েছে, তেমনি কলমেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

চিকিৎসা ব্যবস্থা (বাংলাদেশ হাসপাতাল)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সেক্টর এলাকায় চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং সেক্টর এলাকায় ডাক্তারের নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও সাবসেক্টর এলাকায় প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ থাকে যে প্রত্যেক সাব সেক্টরে একটি ফিল্ড মেডিকেল ইউনিট থাকবে, সেখানে থাকবেন একজন মেডিকেল অফিসার, দুইজন নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং চারজন স্ট্রেচার বাহক। আবার সেক্টর

১৭৭

হেডকোয়ার্টারে থাকবে ৩০-৪০ শয্যার একটি অ্যাডভান্সড ড্রেসিং স্টেশন। এখানে থাকবেন একজন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, ৬ জন নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, ২ জন সুইপার, ৪ জন স্ট্রেচার বাহক, ২ জন ওয়ার্ড বয়। এছাড়া থাকবে দুইটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি জিপ। এছাড়া সেক্টর হেড কোয়ার্টারে থাকবে একটি প্রধান ড্রেসিং স্টেশন; সেখানে কাজ করবেন একজন কমান্ডিং মেডিকেল অফিসার, একজন মেডিকেল স্পেশালিস্ট, ৪ জন মেডিকেল অফিসার, ১ জন কোয়ার্টার মাস্টার, ১৮ জন নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, ১ জন ডিসপেন্সারি, ১০ জন ওয়ার্ডবয়, ১ জন অর্ডারলি কুক, ৩ জন চৌকিদার, ৪ জন কেটারিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, ১ জন টাইপিস্ট, ১ জন ক্লার্ক। এছাড়া থাকবে প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিওক্যাল ইউনিট এবং ৪ টি অ্যাম্বুলেন্স, ২ টি জিপ ও ১ টি দুইটনি ট্রাক।
কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ২ নং সেক্টরের সাব সেক্টর এলাকায় চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েবং কিছু কিছু ফিল্ড হসপিটাল স্থাপিত হয়। আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এছাড়া রোগীর বিশেষ আহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। সেক্টর অধিনায়ক ১৫ দিনে অথবা মাসে একবার হলেও চিকিৎসা কেন্দ্র পরিদর্শন করতেন।
২ নং সেক্টরের উল্লেখযোগ্য হাসপাতালটির নাম ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। মে মাসে এটি আগরতলার সোনামুড়ায় স্থাপিত হয়। জুলাই মাসে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে হাসপাতালটি সীমান্ত এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী এলাকা আগরতলার দারোগাবাগিচায় স্থানান্তরিত হয় এবং আগস্ট মাসে হাসপাতালটি আগরতলার সন্নিকটে শ্রী হাবুল ব্যানার্জীর বাগানে (বিশ্রামগঞ্জ) স্থানান্তরিত এবং প্রসারিত করা হয়। এ হাসপাতালে দুইশ শয্যার স্থান সংকুলান করা হয়।এ সময় এই হাসপাতালে লন্ডনে প্রশিক্ষণরত ডাক্তার জাফরউল্লাহ চোউধুরী, ডাক্তার মবিন ও চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়নরত বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী যোগদান করে হাসপাতালের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হন। তখন থেকে এ হাসপাতালটি বাংলাদেশ হাসপাতাল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় ২ নং সেক্টরের হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যাপক। এখানে বাংলাদেশ হাসপাতালে অধিকসংখ্যক ডাক্তার, সহকারী ও নার্স নিয়োজিত থাকত। এখানে তত্ত্বাবধায়ক ৪ জন, প্রশাসনিক অফিসার ১ জন, সহকারী প্রশাসনিক অফিসার ১ জন, কর্মকর্তা ৩ জন, চিকিৎসক ১৩ জন, সহকারী ২৪ জন কর্তব্যরত থাকেন।

১৭৮

২৬ মার্চ
২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে (২৫ মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাতে) সেদিনকার অবিসংবাদী জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে রাতেই তিনি পাকিস্তান সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। বন্দি করে তাঁকে সেদিনের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বন্দি হবার আগে শেখ মুজিব সাবেক ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস অর্থাৎ ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচার করেন। তৎক্ষণাৎ সাইক্লোস্টাইল হয়ে সেই ঘোষণাটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন, ২৬ মার্চ, দুপুরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর এম এ হান্নান চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রথম সে ঘোষণাটি প্রচার করেন। এরপর ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দান করেন চট্টগ্রামে নিয়োজিত তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ দেয়া ঘোষণাটি সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশন তা প্রচার করে। এই ঐতিহাসিক ঘোষণার ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার ২৬ মার্চ কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে ১৯৭২ সালে রচিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানেও শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি স্থান পায়।

২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিন আজ। এদিন অবরুদ্ধ রাজধানী ঢাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সারাদেশের কর্তৃত্ব প্রায় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বন্দর নগরী চটতগ্রাম সশস্ত্র সংগ্রামের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়। এদিন ন্সকালেই জুলফিকার আলি ভুট্টো সেনাবাহিনী বেষ্টিত হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিজস্ব কক্ষ থেকে বের হয়ে বিমানবন্দরে গমন করেন। তিনি গতরাতের সেনা কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশংসা সূচক মন্তব্য করে বিমানে ওঠার সময় ব্রিগেডিয়ার জাহানজে আরবাব কে বলেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তান কে রক্ষা করা গেছে।’ একইসাথে এদিন পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. যে. টিক্কা খান ১৩২ নং, ১৩৩ নং এবং ১৩৪ নং সামরিক বিধি জারি করেন। এই বিধিতে উল্লেখ ছিল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং ব্যাংকসমূহের কর্মচারিদের যথানিয়মে কাজে যোগদান করা, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা। অর্থাৎ বাঙালীর আন্দোলনকে

১৭৯

অবদমিত করার অপচেষ্টামাত্র।
বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এদিন সকালে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের আদমজি স্কুল থেকে বন্দি অবস্থায় ফ্ল্যাগ দটাফ হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে সেখানে সারাদিন আটকে রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ইংরেজি ও বাংলায় হ্যান্ডবিল আকারে ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামসহ ইপিআর সদরদপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এদিন দুপুর পৌনে দুটার সময় কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে পাঁচ মিনিটের অধিবেশন চালু হওঁয়। বনঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। স্বাধীনতা ঘোষণাবার্তায় ছিলঃ
“বাঙালী ভাই ও বোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা, ইপিআর কেন্দ্রে রাত ১২ টায় পাকিস্তান সৈন্যরা অতর্কিত হামিলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন এবং পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি। তোমরা তোমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাতৃভূমিকে রক্ষা কর। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।”
শেখ মুজিবুর রহমান

‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ পরিচয়ে এ ঘোষণাপত্র পাঠ করে জনাব হান্নান স্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য বিশ্বের মুক্তিকামি জনগণ ও রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহবান জানান্রাত ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাটসহ ট্রান্সমিশন স্টেশন থেকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর নামে প্রথমে বাংলায় এবং পরে ইংরেজীতে স্বাধিনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হওঁয়। এই ঘোষণা পাঠের সাথে সাথে জনাব হান্নান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সেনাবাহিনীর বাঙালী সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আবেদন জানিয়ে একটি বিবৃতি পাঠ করেন। এবং রাত ১০ টায় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ইংরেজিতে একটি আবেদন প্রচার করা হয়। এই আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার ও মুক্তিকামী জনগণকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়। এদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে

১৮০

ভাষণ প্রদান করেন। এতে আওয়ামী লীগের কর্ম তৎপরতা কে দেশদ্রোহিতামূলক আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এদিন থেকে কঠোর প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। ২৫ মার্চ রাত থেকে এদিন পর্যন্ত ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অন্তরীণ করে ব্যাপক তল্লাশী চালানো হয়। এবং এদিন রাত তিনটায় পি আই এর ৭০৭ জেট প্লেনে করে তাঁদের করাচি পাঠানো হয়।
দিনরাত কারফিউ দিয়ে দখলদার পাক সেনারা দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন, বস্তি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাসভবনের ওপর ভারি মেশিনগান ও কামান দাগাতে থাকে। এলাকার পর এলাকা আগুণ দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ও নির্বিচার গুলি চালায়। দুপুরে পাকিরা পুরান ঢাকা আক্রমন করে এবং মধ্যরাত পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তাদের সহযোগিতা করে স্থানীয় বিহারিরা। তারা ‘দি পিপল’, ‘সংবাদ’, ‘ইত্ত্রফাক’, ‘বাংলার বানী’ পত্রিকার অফিস ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ট্যাংকের গোলায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অসংখ্য গণ কবর খুঁড়ে শত শত লাশ মাটিচাপা দিয়ে তার উপর বুল্ডোজার চালিয়ে বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসিয়ে দেয় হাজার হাজার লাশ। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস গণহত্যা।। যা চালিয়েছিল তারা পরবর্তী ২৭০ দিন। এর চূরান্ত পরিনতি হয় ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সূর্য অর্জনের মাধ্যমে।
এখন আমরা যদি মার্চের ১ থেকে ২৫ তারিখের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করি তাহলে দেখি, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ যে সকল ঘোষণা দিয়েছে তা পালিত হয়েছে। অসামরিক প্রশাসন চলেছে সম্পূর্ণরূপে আওয়ামী লীগের নির্দেশে। অন্যান্য দল নিয়মতান্ত্রিক এ আন্দোলনে সংযুক্ত হয়েছে। এমনকি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও সংখ্যাগরিষ্ট দলের প্রধান শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপন করেছে। মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ স্বাধীনতার দাবী নিয়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেন।
এ সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ দল বক্তব্য দিয়ে কিংবা নিশ্চুপ থেকে আওয়ামী লীগ কে সমর্থন দিয়েছে। ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক, প্রশাজীবী (সরকারি, আধাসরকারি), ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শ্রমজীবী, কর্মজীবী তথা সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় মার্চের এই আন্দোলনে। এবং সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফল আমাদের আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

১৮১

জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী
তারিখ ১৪ এপ্রিল ১৯৭১
আল্লহু আকবার
স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের
নির্দেশাবলী
দেশবাসী ভাইবোনেরা,
হানাদার পাকিস্তানি পশুশক্তিকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে হটিয়ে দেয়ার ও বাঙালীকে শোষণমুক্ত করে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার দীপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও নেতৃত্বে গত ১২ এপ্রিল রাত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার পর থেকে মুক্তিসংগ্রাম ঠিক পূর্বের মতই এক সুস্পষ্ট গতিতে চলছে। প্রতিটি বাঙালী আজ নিজ নিজ ঘরে প্রতিরীধের দুর্গ গড়ে তুলে সংকল্পকে দৃঢ় থেকে আরো দৃঢ়তর করে তুলেছে। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী পশু সরকারকে বিনাশ করে বিশ্বের দরবারে আজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে বলে- বাঙালীর যুদ্ধ আজ আরো তীব্রতর; বিশ্বাস আজ অটুট; প্রতিটি বাঙালী আজ সংগ্রাম থেকে অবিচ্ছিন্ন।
বাঙালীর আশা আকাঙ্খার প্রতিফলনে এ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন স্বাধীন বাংলার মহানায়ক বাঙালীর প্রিয় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর সহযোগী হিসেবে রয়েছেন ত্যাগী ও শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীত্বের দ্বায়িত্ব পালন করবেন এবং দেশরক্ষা দপ্তরের দ্বায়িত্বও অতিরিক্তভাবে তাঁর উপর ন্যস্ত। খন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত। স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রী পরিষদে আর যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন জনাব মনসুর আলী, জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
জনযুদ্ধের আশু সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সরকার সম্প্রতি কতগুলো নির্দেশাবলী জারি করেছেন।
পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী ও তাদের ভাড়াটিয়া হানাদার সৈন্যবাহিনী আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের উপর নগ্ন, পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাঙালীর অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙালীর অপরাধ তারা তাদের বাপ-মা, ভাই বোন সন্তান সন্ততিদের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবী জানিয়েছে, বাঙালীর অপরাধ তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছে। বাঙালীর অপরাধ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমত সম্মানের সাথে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙালীর অপরাধ

১৮২

মহান স্রষ্টার নির্দেশমতো অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে সুন্দর ও সুখী সমাজব্যস্থা গড়ে তোলার সংকল্প ঘোষণা করেছে।
মানবতার বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনী দানবীয় শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সহায় আধুনি মরনাস্ত্র আর আমাদের সহায় পরম করুনাময় আল্লাহতালার সাহায্য, বাংলাদেশের জনসাধারণের অটুট মনোবল, মুক্তিলাভের দৃঢ় সংকল্প, শত্রু সংহারের অবিচল প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশের এ সংগ্রামে দল, মত, শেনী, ধর্ম নেই। বাংলার মাটি, পানি, আলো, বাতাসে লালিত পালিত মানুষের আজ একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালী। তাই বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, ধণিক-বনিক, নারী-পুরুষ সকলকেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সহায়তা করতে হবে। মুক্তি সৈনিকের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। বাংলার মাটি থেকে শত্রুকে উৎখাত করার জন্য প্রত্যেকেরই এগিয়ে যেতে হবেো

নির্দেশবলী
১। প্রতিটি শহর/গ্রামে/মহল্লায় এক একজন অধিনায়ক নির্বাচিত করে সমাজ জীবনে শৃখলা রক্ষা করতে হবে; আরও ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে শত্রুর সাথে অসহযোগ প্রতিরোধ সংঘাতের দুর্বার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
২। নিজ নিজ এলাকায় খাদ্য ও ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার হিসাব রাখতে হবে আর চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানো আর সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে।
৩। কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। দৈনন্দিন জীবনে সংযম ও কৃচ্ছ্রতা চালিয়ে যেতে হবে। সর্বপ্রকার বিলাসিতা ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর কল্যানে পারস্পরিক মমত্ববোধে ভ্রাতৃত্বের হাতকে দৃঢ়তর করতে হবে। আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে আত্মনির্ভরশীল বলিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫। শত্রুকে চিনিতে হবে। অবাঙালী বেসামরিক সামরিক শত্রু তো আছেই, তারা কমবেশি চিহ্নিত। মারাত্মক হল ঘরের শত্রু। ধর্মের দোহাই দিয়ে, অখন্ডতার বুলি আউড়িয়ে কালোবাজারি মজুদদারের বেশে শত্রুরা সরলপ্রান বাঙালীর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়েরা দোস্ত হিসেবে মনে ঠাঁই পেতে চায়। একবার ওদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার পাওয়া যাবেনা। এ ধরণের লোককে চিনে রাখতে হবে। বিশ্বাসঘাতকতার পথ ছেড়ে দেয়ার জন্য তাদের বলতে হবে। তবুও যদি তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় না হয় তখন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাদের নাম ঠিকানা জানিয়ে দিতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ দেশদ্রোহীর নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের

১৮৩

ব্যবস্থা করবেন।
৬। গ্রামে গ্রামে রক্ষী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম প্রশিক্ষণ শিবিরে রক্ষী বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহন করবেন।
৭। গ্রাম/শহর অথবা মহল্লার নেতারা নিজেদের মধ্যে নেতা নির্বাচিত করে গ্রাম-গ্রামান্তরে যোগাযোগ ও পন্য বিনিময় ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা রক্কার জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। এর উপরের স্তরে শৃংখলা রক্ষার দ্বায়িত্ব থাকবে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের হাতে।
৮। বাংলাদেশের সকল মুক্ত এলাকায় সরকারি, আধাসরকারি, বেসামরিক কর্মচারিরা স্তরে স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশে কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় জনপ্রতিনিধিরাই ব্যক্তিবিশেষে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করবেন।
৯। সকল সামরিক, আধাসামরিক, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী কর্মচারি অনতিবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন এবং কোন অবস্থাতেই শত্রুর সহযোগিতা করবেন না।
১০। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষভাবে নৌ চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না এবং যতদূর সম্ভব যানবাহনাদি নিয়ে মুক্ত এলাকায় চলে আসবেন।

গুজবে কান দেবেন না। গুজব রটাবেন না। নিজের উপর বিশ্বাস হারাবেন না। মনে রাখবেন, আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দুশমন বাঙালী মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে বাড়িঘর লুট করতে জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদের মিনারে আযান প্রদানকারী মুয়াজ্জিন, মসজিদে-গৃহে নামাযরত মুসল্লি, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন।

স্মরণ করুনঃ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
“অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর”।
বিশ্বাস রাখুনঃ
“আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী”।
জয়বাংলা, শেখ মুজিব
জয়বাংলা।

১৮৪

জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রথম নির্দেশাবলী
তারিখ ১৩ এপ্রিল ১৯৭১
জনসাধারণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ
নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার জনগনের প্রতি এই নির্দেশগুলো জারি করেছেনঃ
১। চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষার জন্যে আহত ব্যক্তিকে ডাক্তার বা কবিরাজের কাছে নিয়ে যান।
২। মুক্তিসংগ্রামের বিশ্বাসঘাতিক দের শাস্তি দিন।
৩। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে জেনে নিন কি করা উচিত।
৪। তরুনরা সকলে ট্রেনিং এর জন্য নিকটতম মুক্তিফৌজ দপ্তরে চলে আসুন-সেখানেই তাঁরা নির্দেশ পাবেন।
৫। প্রত্যেক গ্রামপ্রধান আশেপাশের গ্রাম বা গ্রামগুলোর প্রধানদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন এবং সমস্ত খবরাখবর সম্বন্ধে পরস্পরকে ওয়াকিবহাল রাখুন।
৬। মুক্ত অঞ্চল গুলোর সরকারি কর্মচারিরা আওয়ামী লীগের স্থানীয় সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ নিন।
৭। নদী-পরিবহন ব্যবস্থার সমস্ত কর্মচারি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মেনে চলুন ও রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নির্দেশ উপেক্ষা করুন। ঢাকায় নদী-পরিবহন কর্মীরা দখলদার জঙ্গীবাহিনীর নির্দেশ অমান্য করায় বাংলাদেশ সরকার তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
৮। নিজের এলাকায় মুক্তিফৌজ কমান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী অসামরিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সমস্ত নিয়ম মেনে চলুন।
৯। আপনার এলাকায় সন্দেহজনক লোক ঘোরাফেরা করছে। তাদের সম্বন্ধে সাবধান থাকুন এবং তেমন কোন লোকের খোঁজ পেলেই নিকটতম মুক্তিফৌজ কেন্দ্রে খবর দিন।

জন্মভূমি
‘জন্মভূমি একাত্তরের জানুয়ারীতে প্রথম প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিকীটির সম্পাদক ছিলেন বিয়ানীবাজার থানার মোস্তফা আল্লামা। ঢাকায় পত্রিকার ৫ টি সংখ্যা বের হয়কলকাতায় ‘জন্মভূমি’ পুনঃপ্রকাশ ঘটে ১৬ জুলাই, ১৯৭১। সম্পাদক তার ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পুরোটাই জন্মভূমির প্রকাশনা তৎপরতায় ব্যয় করতেন। সম্পাদক নিজেই ছিলেন সংবাদ সংগ্রহকারী, লেখক, প্রুফ রিডার, সার্কুলেশন ম্যানেজার সবকিছু। ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের বিপ্লবী মুখপত্র’ শ্লোগান সহ প্রকাশিত জন্মভূমির প্রকাশনা যুদ্ধকালীন বাস্তবতার কারণে নিয়মিত ছিলনা।

১৮৫

জন্মভূমি প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের পক্ষেমোস্তফা আল্লামা কর্তৃক রবীন্দ্র এভিনিউ ও মুজিবনগর বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, মুদ্রিত ও সম্পাদিত এবনহ এটি লন্ডন থেকেও প্রকাশিত হত। কলামসংখ্যা ৫ এবং দুই রঙের এ সচিত্র সাপ্তাহিকীটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর এবং উঁচু মানসম্পন্ন। সাধারণত দুই থেকে চার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হত। এর মূল্য ছিল ত্রিশ পয়সা আর লন্ডনে দুই শিলিং। দশম সংখ্যা, ১১ অক্টোবর থেকে রেজিস্টার্ড নম্বর -বিডিএম ১৫ লেখা হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের নানা সংবাদ ও খবরাখবর প্রকাশ করত। ৩০ আগস্ট ষষ্ঠ সংকগ্যার প্রধান সংবাদ স্তম্ভ ছিল ‘বিশ্ববাসী রুখে দাঁড়াও। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর ১৬ তম সংখ্যার প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল’, ‘ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতিঃ ঢাকা দখলই লক্ষ্য’, ‘পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হল’, ‘পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা’ ইত্যাদি ছিল।

জহির রায়হান (১৯৩৫ -১৯৭১)
আসল নাম ছিল জহিরুল্লাহ। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সার জহির রায়হানের বড় ভাইফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে ১৯৩৫ সালে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউটে এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় স্নাতক (সম্মান) দিগ্রী লাভ করেন, অল্প বয়সেই জহির কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তিনি কুরিয়ারের দ্বায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। গপন পার্টিতে তাঁর নাম রাখা হয় রায়হান। পরবর্তী সময়ে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারী যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি তাঁদের একজন। অন্যদের সঙ্গে তাঁকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি আরম্ভ করেন। প্রথম গল্পসংগ্রহ ‘সূর্যগ্রহন’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৬২ সালে। তাঁর লেখা অন্যান্য বই হল – শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী এবং আর কতদিন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য উইকলি এক্সপ্রেস’ প্রকাশের উদ্যোক্তাদের তিনি একজন। এছাড়াও তিনি বেশকিছু সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য তিনি আদমজি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়।
জহির ১৯৫২ সালে ফটোগ্রাফি শিখতে কলকাতা যান এবং প্রথমেশ বড়ুয়া

১৮৬

মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। ১৯৬১ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায়। তারপর একের পর এক তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র- কাজল, কাচের দেয়াল, বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া, আনোয়ারা, সংগ্রাম এবং বাহানা মুক্তি পেতে থাকে। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনকে চিত্রিত হয় প্রতীকী ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’, যার কাহিনীর মধ্যে দিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে উদবুদ্ধ করেন। সেই ছবির আবেদন এখনো অনবদ্য।
‘লেট দেয়ার বি লাইট’ একটি ইংরেজি ছবি নির্মান শুরু করেন, যা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় শেষ করতে পারেননি। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের পর তিনি কলকাতায় যান। সেখান থেকে সামরিক জান্তার গনহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে চিত্রিত করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’, ছবিটি পৃথিবীজুড়ে আড়োলন তোলা এক অনন্য তথ্যচিত্র।
জহির রায়হানের উর্দু ছবি সঙ্গম ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন ছবিই। তাঁর অপর উর্দু ছবি ‘বাহানা’ ছিল সিনেমাস্কোপ। তিনি ‘কাচের দেয়াল’ সিনেমার জন্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে বড়ভাই প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সায়কে হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর দুর্বৃত্তরা তাঁর বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়। ৩০ ডিসেম্বর তিনি খবর পান যে শহীদুল্লাহ ঢাকার মিরপুরে আছেন। মিরপুর যান তিনি। সেখানে অবাঙালিদের দ্বারা আক্রান্ত হন। তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঐ দিনটি জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

জহুর আহমেদ চৌধুরী (১৯১৬-১৯৭৪)
একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম জেলার কাট্টলি গ্রামে ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহন করেন। দীর্ঘ সময়ব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সক্রিয় সদস্য। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্বে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে তাঁর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রেরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিবারেশন কাউন্সিলের পূর্বাঞ্চল শাখার চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব

১৮৭

পালন করেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আওইয়ামী লীগ আমলে মন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১ জুলাই, ১৯৭৪ ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

জয়বাংলা
বিশ শতকের শাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জনতা কেঁপে উঠত এই অসাধারণ স্লোগানে। জয়বাংলা শ্লোগান হয়ে উঠেছিল্পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ও তাদের বঙ্গীয় অনুচরদের জন্য একটি ত্রাস। এ শ্লোগান ছিল বাঙালীর জীবন ও অহংকার। একটি শ্লোগান কোন জাতির কত আপন হতে পারে ‘জয়বাংলা’ তার প্রমান। জয়বাংলা শ্লোগানটি এতটাই আবেদন সৃষ্টি করেছিল যে একে বাদ দিয়ে ষাট দশকের যে কোন সভা সমিতি ছিল অসম্ভব। কোটি কন্ঠে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় এ শ্লোগান মুখরিত করে রাখত, আর বাঙালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যেত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে।
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ‘জয়বাংলা’ ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর রুখে দাঁড়াবার মন্ত্র। পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রবল গণ আন্দোলনের সময় জয়বাংলার বিরুদ্ধে পাকিস্তানপ্রেমী বাঙালী রাজনীতিবিদেরা যেমন বিষোদ্গার করত, একইভাবে এর তীব্র সমালোচনায় নেমেছিল সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা। জয় শব্দটি যদিও পরিশুদ্ধ বাংলা, তবু ওদের কাছে তা ছিল পরিত্যাজ্য। কারন ওটা ওদের কাছে ইসলামি ছিলনা। ওরা যুক্তি দেখাত, জয়বাংলার উচ্চারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ নিয়ে কথা বলার ইঙ্গিত আছে। পাকিস্তান পছন্দ এই শ্রেনীটি আরবি ও উর্দু হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছে। বাঙালীকে ‘মুসলমান’ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা কখনোই জয়বাংলাকে পরাস্ত করতে পারেনি।
জয়বাংলা শ্লোগানের বিরুদ্ধে তৎকালীন মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক বিশ্লেষণে তেমন গুরুত্ব দেয়নি স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ। দিলে এ শ্লোগান একাত্তরের নয়মাসব্যাপী সশস্ত্র গণযুদ্ধে গোটা জাতির হৃদয়ের ডাক হতে পারত না। এ শ্লোগান এমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধারা, এমনকি দেশের সাধারন মানুষ পর্যন্ত একজন অন্যজনকে ‘জয়বাংলা’ বলে সম্ভাষণ করে তাদের দেশপ্রেম প্রকাশ করত। যুদ্ধের ময়দানে ‘জয়বাংলা’ বলে গলাফাটা হুঙ্কার দিয়ে দুঃসাহসী মুক্তিবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। জয়বাংলা রূপান্তরিত হয়েছিল এক কথায় দেশপ্রেমের মূল হাতিয়ারে। এ শ্লোগান ছিল এমন এক জিয়নকাঠি যা বাঙালীকে জীবিত করেছে, পুনর্জীবিত করেছে।
পাকিস্তান বাহিনীর গণহটযা আর নির্যাতন থেকে বাঁচতে মুক্তিযুদ্ধের নয়

১৮৮

মাসে সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতবাসীর কাছে দেশত্যাগী এসব শরনার্থীর পরিচিতি ছিল ‘জয়বাংলার মানুষ’ বলে।
‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের জনক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তখনকার ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। ২ মার্চ, ১৯৭১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বারান্দায় ছাত্রলীগ এবং ডাকসু নেতৃবৃন্দ প্রথমবারের মত যে জাতীয় পতাকাটি তুলেছিলেন তাতে রক্তখচিত গোলাকার পিন্ডের মধ্যে নতুন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা ছিল। সে পতাকার পরিচিতি ছিল ‘জয়বাংলা’র পতাকা। সেই মানচিত্রসমেত পতাকার সাধারণ এবং সরকারি ব্যবহার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস। পরবর্তীকালে সে পতাকা থেকে মানচিত্র সরিয়ে শুধু লাল পিন্ডটাকে রাখা হয়েছে এক নদী রক্তের প্রতীক হিসেবে।আরো এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে জয়বাংলার ভূমিকা আছে। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পত্তন হয়েছিল ভারতীয় শহর আগরতলায়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে (মুজিবনগর) সে সরকার শপথ নিয়েছিল। শুরু হয়েছিল উপমহাদেশের রাজনীতিতে আরেক অধ্যায়। ভারত বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে তখন থেকেই শুরু হয়েছিল পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধ। হাজার হাজার বাঙালী তরুন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। শুরু হয়েছিল পুরো সীমান্তজুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দালালদের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধ।
প্রথম ‘গণপ্রজাতন্তী বাংলাদেশ’এর প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে) সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শুরু থকেই প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে সরকারি মুখপাত্র হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশের চিন্তা করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অধীনে বেশকিছু মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ গঠিত হয়েছিল ইতিমধ্যে। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল মুজিবনপগর সরকারের তথ্য, বেতার ও প্রচার বিভাগ। এর অধীনেই ‘জয়বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা হয়েছিল।

জয়বাংলা (১)
একাত্তরের প্রকাশিত পত্রিকা সমূহ পাক সামরিক বাহিনীর বর্বরতার পাশাপাশি বাংলার মানুষের সংগ্রাম, ত্যাগ ও বীরত্বের ঘটনাসমূহ ধরে রেখেছে। সে সময়ে মুজিবনগর, মুক্তাঞ্চল ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত পত্রিকা প্রকাশের কথা জানা যায়না। একই নামে একাধিক পত্রিকাও বের হয়েছে। ‘জয়বাংলা’ ছিল সে রকমই একটি

১৮৯

পত্রিকা। নওগাঁ, ত্রিপুরা ও আসাম সীমান্ত হতেও আরো তিনটি ‘জয়বাংলা’ নামের পত্রিকা বের হয়েছিল। মুজিবনগর জয়বাংলা প্রেস থেকে যে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকাটি বের হয়েছে তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন মতিন আহমদ চৌধুরী। ‘জয়বাংলা’ এই পত্রিকাটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক নিয়মিত রাজনৈতিক মুখপত্র ছিল। ১১ মে, ১৯৭১ ‘জয়বাংলা’র প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এর রেজিস্টার্ড নম্বর-১ হয় এবং এই পত্রিকাটি সরকারি অনুদানও পেত। পত্রিকাটির মূল্য ২০ পয়সা এবং বসচিত্র সংবাদপত্র ছাপা, ঝকঝকে, ট্যাবলয়েড সাইজ ও কলামসংখ্যা ২-৪ টি ছিল। মোট ৩৪ টি সংখ্যা মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংখ্যা ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছিল। এ সাপ্তাহিক মুখপত্রের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের মর্মবানী উৎসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের ততপরতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা, বিবৃতি, বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমতের সংবাদ ছাড়াও এর শেষ পৃষ্ঠায় যুদ্ধের খবর সংবলিত নিয়মিত কলাম ‘রণাঙ্গণে’ থাকত, ‘জয়বাংলা’র একটি সংখ্যাইয় সমস্ত পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছিল ইয়াহিয়ার মুখের হিংস্র ছবি। যার ক্যাপশন ছিল- ‘এই জানোয়ারটাকে হত্যা করতে হবে’। পত্রিকাটিতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম ছিল ‘যা দেখেছি যা ভাবছি’। একদল দক্ষ সংবাদপত্রকর্মী এ পত্রিকার জন্য কাজ করতেন। এ পত্রিকার রণাঙ্গণ প্রতিনিধি হারুন হাবীব তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জয়বাংলা’য় একদিকে যেমন যুদ্ধের প্রচারধর্মী খবর, সংবাদ, নিবন্ধ আর বিশ্লেষণমুখী প্রবন্ধ ছাপা হত, অন্যদিকে ছাপা হত পাকিস্তানীদের গণহত্যা, নির্যাতন আর দেশ বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের খবর। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতার একটা ভাল ছবি এই একটিমাত্র পত্রিকা থেকে আমরা পেতে পারি। ‘জয়বাংলা’র এই পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অমূল্য তথ্যভান্ডার বলা যেতে পারে। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

জয়বাংলা (২)
‘জয়বাংলা’ পত্রিকাটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক নিয়মিত রাজনৈতিক মুখপত্র ছিল। সম্পাদক গণপরিষদ সদস্য আহমদ রফিক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মতিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন। মুজিবনগর জয়বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে আহমদ রফিক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হত। ১১ মে, ১৯৭১ ‘জয়বাংলা’র প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এর রেজিস্টার্ড নম্বর -১ হয়। পত্রিকাটির মূল্য ২০ পয়সা এবং ৩য় সংখ্যা থেকে মূল্য ২৫ পয়সা হয়। সুন্দর পরিপাটি সচিত্র সংবাদপত্র ছাপা ঝকঝকে, ট্যাবলয়েড

১৯০

সাইজ ও কলামসংখ্যা ২-৪ ছিল। মোট ৩৪ টি সংখ্যা মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংখ্যা ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ আর বাংলায় ৮ পৌষ, ১৩৭৮, শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছিল। যোগাযোগের ঠিকানা, কর্মধ্যক্ষ, সাপ্তাহিক জয়বাংলা, হেড অফিস মুজিবিনগর, বাংলাদেশ অথবা তথ্য, গণসংযোগ ও প্রচার বিভাগ, বাংলাদেশ মিশন, ৯, সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা ১৭ ছিল। এ সাপ্তাহিক মুখপত্রের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের মর্মবানী উৎসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা, বিবৃতি, বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমতের সংবাদ ছাড়াও এর শেষ পৃষ্ঠায় যুদ্ধের খবর সংবলিত নিয়মিত কলাম ‘রণাঙ্গণে’ থাকত, ‘জয়বাংলা’র একটি সংখ্যাইয় সমস্ত পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছিল ইয়াহিয়ার মুখের হিংস্র ছবি। যার ক্যাপশন ছিল- ‘এই জানোয়ারটাকে হত্যা করতে হবে’। পত্রিকাটিতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম ছিল ‘যা দেখেছি যা ভাবছি’। একদল দক্ষ সংবাদপত্রকর্মী এ পত্রিকার জন্য কাজ করতেন। এ পত্রিকার রণাঙ্গণ প্রতিনিধি হারুন হাবীব তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জয়বাংলা’য় একদিকে যেমন যুদ্ধের প্রচারধর্মী খবর, সংবাদ, নিবন্ধ আর বিশ্লেষণমুখী প্রবন্ধ ছাপা হত, অন্যদিকে ছাপা হত পাকিস্তানীদের গণহত্যা, নির্যাতন আর দেশ বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের খবর। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতার একটা ভাল ছবি এই একটিমাত্র পত্রিকা থেকে আমরা পেতে পারি।

জয়বাংলা (৩)
ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের কর্মকর্তা জনাব এমজি হায়দার রহমতউল্লা নাম ধারন করে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রথমে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত, পরে সাপ্তাহিকী হয়। মহকুমা নওগাঁ (রাজশাহী) থেকে প্রকাশিত হতপ্রথম সংখ্যায় পত্রিকার নিচে “পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে ‘জয়বাংলা’ আত্মপ্রকাশ করিতেছে” লেখা ছিল। পত্রিকাটিতে মূলত সম্পাদকীয় এবং জনগণের প্রতি সম্পাদকের আবেদন, নির্দেশ ছাপা হত। তাছাড়া প্রতিটি সংখ্যায় পবিত্র কুরআনের বানী তর্জমাসহ প্রকাশিত হত। দশম সংখ্যার পর থেকে প্রচারিত সংখ্যাগুলোতে কিছু সংবাদ ছাপা হত। ৩য় সংখ্যায় ‘দৈনিক জয়বাংলা’ উল্লিখিত হয়। ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে ‘স্বাধীন বাংলার একমাত্র দৈনিক’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্তসংখ্যা গুলোতে তারিখ লেখার নিচে দেশপ্রেমবধক বানী প্রকাশিত হত। এক-দুই পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এর প্রথম সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সংখ্যা গুলোতে মূল্যের উল্লেখ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ৩০ মার্চ ১৯৭১ থেকে এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং এর প্রকাশনা

১৯১

জুলাই ‘৭১ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মোট ১১ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এটি নওগাঁর দ্বিতীয় পত্রিকা। মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য মুখপত্র এ পত্রিকার সবগুলো সংখ্যা নিয়ে জয়বাংলা প্রকাশনী থেকে মে ১৯৯০ সালে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

জয়বাংলা (৪)
পত্রিকার নামের নিচে ‘স্বাধীন বাংলার স্বাধীন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র’ এবং বন্ধনীতে ‘মুক্তিফৌজ কর্তৃক প্রচারিত’ বাক্য কয়টি লিখিত দেখা যায়। সংগৃহীত একটিমাত্র পত্রিকা ১৪ শ সংখ্যা ১৭ জুলাই ১৯৭১ (৩২ আষাঢ় ১৩৭৮, শনিবার) হতে জানা যায় পত্রিকাটি বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ কর্তৃক স্বাধীনবাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকাটির শুভেচ্ছামূল্য ধরা হয়েছে ২০ পয়সা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ২ ও কলাম সংখ্যা ৪। প্রথম প্রকাশ এবং এর সম্পাদক , পরিচালনা পরিষদ এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি। ১৪ তম সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক ছ্যাঁচড়ামি’ নামে প্রকাশিত হয়। এবং এই সংখ্যারই প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম গুলো ‘মুক্তাঞ্চলসমূহে ভোগ্য পণ্যাদি আসছে’, ‘বাংলাদেশই আমার পরিবার- মেজর খালেদ’, ‘শাহবাজপুরে মুক্তিফৌজের হাতে ৯ জন খান সেনা নিহত’, ‘তছির আলী ধরা পড়েছে’, ‘মুক্তিফৌজের ততপরতা’, ‘যুদ্ধ চলবে’, ‘মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ ইত্যাদি ছিল।

জয়বাংলা (৫)
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল বাসিত এ ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। এটি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। পত্রিকার শিরোনামের নিচে ‘স্বাধীনবাংলার সিলেট জেলার মুখপাত্র’ কথাটি লেখা থাকত। অবশ্য এর আয়ুষ্কাল বেশি ছিলনা, কিছুদিন চলার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

জাগ্রত বাংলা
পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বাঙালী। এখানে সম্পাদক যে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন তা বোঝা যায়। পত্রিকার নামের নিচে ছোট করে ইংরেজিতে বড় হরফে THE JAGRATA BANGLA লেখা থাকত। পত্রিকার কোন সংখ্যাতে ‘মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ আবার কোনটিতে ‘মুক্তিবাহিনীর সাপ্তাহিক মিখপত্র’ লেখা থাকত। হাতে লেখা এবং নবম সংখ্যা পর্যন্ত সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত। পত্রিকাটিতে বেশ কটি প্রচারিত ও প্রকাশিত স্থানের নাম পাওয়া যায়।

১৯২

স্থানগুলো ছিল, যেমন- ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত, ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ভালুকা শাখা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত, ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ভালুকা শাখা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর আজাদনগর থেকে প্রকাশিত, ময়মনসিংহ জেলা ও উত্তর ঢাকার বেসামরিক দপ্তর আজাদনগর থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত। পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন সাইজের বক্সে স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান এবং বানী লেখা প্রকাশ পায়। বক্সে একটি যেমন ছিল, ‘আমাকে রক্ত দাও, বিনিময়ে স্বাধীনতা দেব’। বিভিন্ন বিষয় ও বক্তব্য নিয়ে বেশ কিছু কার্টুন ও স্কেচও পত্রিকা গুলোতে ছিলের শুভেচ্ছা মূল্য ৩০ পয়সা, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬-৮ এবনহ ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে কলামসংখ্যা ২ থেকে ৩ করা হয়। প্রথমসংখ্যা প্রকাশিত হয় ১ জুন, ১৯৭১। ২য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট, রোববার ১৯৭১ আর বাংলায় ১৫ শ্রাবণ ১৩৭৮, ৯ জমাদিউসসানি ১৩৯১। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান উপলক্ষে এর ৮ম সংখ্যাটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পত্রিকার উপরে পবিত্র কুরআন এবং আল হাদীসের বানী দেখা যায়। মূলত পত্রিকাটি ছিলধিনায়ক আফসার উদ্দীন কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। ফলে পত্রিকাটি আফসার ও কাদের বাহিনীর সাফল্যের খবরাখবর বেশি প্রচার করত। ৭ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১ আর এর সম্পাদকীয় ছিল ‘পাক সরকারের জরুরী অবস্থা ঘোষণা।

জাতীয় পতাকা
একটি দেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের গর্বিত প্রতীক অনেকাংশে দেশটির জাতীয় পতাকা বহন করে। ১৯৭১ সালের পর স্বাধীনতার ৩৬ টি বছরের অহংকার বহনকারী লাল, সবুজের প্রতীকবাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
পতাকাবিধি (১২) অনুযায়ী বাংলাদেশের পতাকার রঙ গাঢ় সবুজ এবং তার মাঝে উদীয়মান সূর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে লাল বৃত্তটি। তবে স্বাধীনতার আগে আমাদের পতাকাটি ছিল অন্যরকম। সংগ্রামী ছাত্রনেতারা যে পতাকাটি তৈরি করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার পটভূমি ছিল সবুজ। তার উপর সোনালী রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র। বর্ত্মান পতাকাটি কখন কীভাবে ব্যবহার হবে এবং আকার কি হবে তা সরকার ঠিক করে দিয়েছে।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদে মিলাদুন্নবী বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষ দিনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে সম্মান

১৯৩

প্রদর্শনের সঙ্গে গর্ব ও আনন্দও প্রদর্শিত হয়। কিন্তু কিছু বিশেষ দিনে যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করা হয়।

জাতীয় সঙ্গীত
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন বাংলা বিভক্ত করে তখন সারা বাংলায় এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গান লিখেছিলেন। এই গান প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩১২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ১৯০৫ সাল থেকে এ গানটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয়ে এসেছে সোচ্চারিত কন্ঠে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণের আগে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তমায় ভালবাসি’ সঙ্গীতটি বাজানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে অন্যান্য প্রেরণামূলক গানের সঙ্গে এই সঙ্গীতটি বারবার বাজানো হত। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বালাদেশ সরকার সাংবিধানিকভাবে (অনুচ্ছেদ-১) ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সঙ্গীতটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে গানের প্রথম ১০ লাইনকে কন্ঠ সংঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীত হিসেবে পরিবেশনের বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ সময়ে যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবসসহ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিভিন্ন সময়ে গানটির পরিবেশনা আমাদের প্রেরণা যুগিয়ে এসেছে। এখানে পুরো গানটি উদ্ধৃত হল-

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।।
ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায় হায় রে…
ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো…
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে ন্দীত কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায় হায় রে…
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি।।

১৯৪

জিতেন ঘোষ (১৯০১-১৯৭৬)
একজন লেখক ও রাজনীতিবিদ। তিনি বিক্রমপুরের কুমারভোগ গ্রামে ১৯০১ সালে জন্মগ্রহন করেন। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন কলেজ ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। মূলত তিনি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বস্ত্র, টাকা ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করেন। তিনি লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে জেল থেকে জেলে, গরাদের আড়াল থেকে, এই লেনিনের দেশ, সম্মুখে বিজয় উল্লেখযোগ্য। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

জীবন থেকে নেয়া
১৯৬৬-১৯৬৯ সালের সময়কালক ভিত্তি করে ১৯৭০ সালে জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২) নির্মাণ করেছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। ‘জীবন থেকে নেয়া” নানা কারনে উল্লেখযোগ্য। এই চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মত দেশের সংগ্রামী ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মানুষ্কেই তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রণোদনা জুগিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। এই কারনে এই ছবির নির্মাতা তৎকালীন পাকবাহিনীর সামরিক সরকারের রোষানলে পড়েন। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। রাও নফরমান আলি ফরমান জারি করেন তৎকালীন তথ্য সচিব শফিউল আজম ও এফডিসির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমের কাছে। শুরু হয় তদন্ত। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ১০ এপ্রিল ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘জীবন থেকে নেয়া’।
এই চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হয়-
“একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন”
নির্মাতা এই চলচ্চিত্রের কাহিনীতে যে পরিবারকে তুলে এনেছেন সেই পরিবারটি মূলত একটি দেশ আর কেন্দ্রবিন্দু চাবির গোছা। আর এটিই ছবির মূল বিষয়।
একেবারে বাস্তব জীবন থেকে ছবিটি নির্মাণ করলেন জহির রায়হান। এতে অভিনয় করেছেন খান আতাউর রহমান, সুচন্দা, রাজ্জাক, রওশন জামিল, রোজী

১৯৫

আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, বেবী জামান। ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন খান আতাউর রহমান। চিত্রগ্রহন করেছেন আফজাল চৌধুরী, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাটযকার হচ্ছেন স্বয়ং জহির রায়হান।
বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে এই ছবির নির্মাণকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকজন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল।
ছবিটিতে মূলত তুলে ধরা হয়েছিল রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে সকল অধিকার আদায়ের আহবান। যেমন বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে শ্লোগান ছিল- ‘১১ দফা মানতে হবে’, ‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই’, ‘বাঁচার মত বাঁচতে চাই’ এইসব দৃশ্য বাস্তব ও দেশের সেই সময়কার বিরাজমান রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।
তাছাড়া ছবিটির বিভিন্ন সঙ্গীত যেমন- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, ‘এ তালা ভাঙব আমি কেমন করে’ যা বাঙালী মাত্রকেই আপ্লুত করেছিল। এই সঙ্গীত গুলোও তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে অর্থবহ ছিল। জহির রায়হানের এই ছবিটি দর্শকদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার উদ্রেক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছিল।
জুলফিকার আলী ভুট্টো (১৯২৮-১৯৭৯)জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান ছিলেন। ভুট্টো তার কূট কৌশলের জন্য বাঙালীদের কাছে একটি নিন্দিত নাম।
বাঙালীর ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়ের আন্দোলন দমন ও শোষণ করার প্রক্রিয়া তার কূটবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হত। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কূটবুদ্ধিতে সংসদ অধিবেশন স্থগিত ষোষণা করে শান্তি আলোচনার নামে প্রহসন শুরু করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের কালোরাত্রিতে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূট্টোরও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ লক্ষ করা যায়। জেনারেল নিয়াজী তার- “The betrayal of East pakistan” গ্রন্থে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে ভুট্টোকে দায়ী করেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর যখন পাক সশস্ত্র বাহিনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম প্রহরে শেখ মুজিব কে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ভুট্টো প্রায় সকল পর্যায়েই গঠন্মূলক ভূমিকা রাখা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তিনি সামরিক অভিযান কে এই বলে স্বাগত জানান যে, ‘খোদাকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেল।’ এতে স্বাভাবিকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ভুট্টোর পরামর্শ ব্যতীত সেনাবাহিনী কোন সমাধান খুঁজে

১৯৬

পেত না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনি সমগ্র পূর্ব বাংলায় যে অন্যায় অত্যাচার চালায় তার নেপথ্য নায়ক হল ভুট্টো, বাঙালী এই নিন্দিত নামটি চিরদিন ঘৃণাভরে স্মরণ করবে।

জ্ঞান চক্রবর্তী (১৯০৫-১৯৭৭)
একজন রাজনীতিবিদ। তিনি বিক্রমপুর জেলার দোগাছি গ্রামে ১৯০৫ সালে জন্মগ্রহন করেন। মাত্র বার তের বছর বয়সে ইংরেজ শাসনবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসিতে ভর্তি হন। ঐ বছরই গ্রেপ্তার হওয়ায় আর পড়াশুনা করতে পারেননি। জীবনের দীর্ঘসময় প্রায় ২৫ বছর জেলখানায় বন্দী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন্তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন, ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ, অমর লেনিন, কৃষকনেতা জিতেন ঘোষ। ১১ আগস্ট, ১৯৭৭ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ডাকটিকেট তিন (৩) রুপি মূল্যমানের
বাংলাদেশ লেখাঅন্যান্য ডাকটিকেটের মত তিন রুপি মূল্যমানের টিকিটের উপরের অংশে বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই র মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় জং.৩ লেখা আছে। এর নিচের দিকে ডাকটিকিটটিতে একটি বক্তব্যধর্মী বিশেষ ধরনের ছবির ব্যবহার দেখা যায়। এটি একটি সদ্য বিচ্ছিন্ন শিকলের ছবি। শিকলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি আলাদা অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ডানদিকের বিচ্ছিন্ন অংশটি অনেকটা বাংলাদেশের মানচিত্রের মত দেখতে। এই শিকলের ছবির উপরে লেখা আছে PROCLAMATION OF INDEPENDENT GOVERNMENT অর্থাৎ স্বাধীন সরকারের ঘোষণা। এর নিচে লেখা আছে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণার দিন 10th APRIL ১৯৭১। বাংলার মুক্তিকামী জনগণ পাকিস্তানিদের শোষণের শিকল ছিঁড়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বিপ্লবী সরকার গঠন করে তারই বিমূর্ত প্রকাশ এই ডাকটিকিটটিতে দেখা যায়। এরই মাধ্যমে পাকিস্তান হতে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়া ও বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণার বিষয়টি সমগ্র বিশ্বের জনগণকে জানাতে সমর্থ হয়েছিল। এর ফলে

১৯৭

আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ, বিপ্লবী সরকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশ্বের সমর্থন আদায়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সাহায্য করে।

ডাকটিকেট দশ (১০) পয়সা মূল্যমানের
প্রকাশিত ১০ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটটিতে বাংলাদেশের মানচিত্রের দেখা পাওয়া যায়। অন্যান্য ডাকটিকেটের মত ১০ পয়সা মূল্যমানের টিকিটের উপরের অংশে বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় চ.১০ লেখা আছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গঠনের প্রথম ও প্রধান শর্ত সেই দেশের একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড থাকতে হবে। এই ডাকটিকিটে সদ্য স্বাধীনতা ঘোষিত এই দেশটির নিজস্ব ভূখন্ড আছে এরই প্রচারণা ও বাংলাদেশের মানচিত্রকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করানোই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ডাকটিকিটে ব্যবহৃত মানচিত্রটিকে দুটি রেখা দিয়ে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর পেছনে অবশ্য দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের মোট ৪টি প্রসাসনিক বিভাগ ছিল তা বোঝানোর জন্য। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন বাংলার সমগ্র ডাক অঞ্চলকে ৪ টি জোনে ভাগ করে এর কার্যক্রম চালানো হয়, এই ডাকটিকিটে তারই প্রতিফলন ঘটানো হয়। এই ডাকটিকিটটির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চলের সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দেবার একটি উদ্দেশ্যও পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়।

ডাকটিকিট দশ (১০) রুপি মূল্যমানের
দশ রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি অংকিত একটি ডাক্টিকিট। প্রকাশিত অন্যান্য ডাকটিকেটের মত এর উপরের অংশে বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই র মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় জং.১০ লেখা আছে। এর নিচের ডানদিকে বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি। এই ছবির বামদিকে SUPPORT লেখা, ঠিক এর নিচে আড়াআড়িভাবে BANGLA এবং মানচিত্রের নিচে DESH লেখা আছে। এই ডাকটিকেটের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সরাসরি সমগ্র বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি নব্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন কামনা করেন। ডাকটিকিট সবসময় ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করে বলে সমর্থন আদায়ের জন্য স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার ডাক্টিকিটের সহযোগিতা গ্রহন করে। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে এটি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। ডাকটিকিটটিতে টাকার স্থলে রুপির ব্যবহার

১৯৮

দেখতে পাওয়া যায়। এর কারন হল তখনো বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া মুক্ত এলাকায় পাকিস্তানি মুদ্রা রুপিয়া ও ভারতে রুপির মাধ্যমে বাঙালিরা এই ডাকটিকিট ক্রয় করত। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ, বিপ্লবী প্রবাসী সরকার কর্তৃক ডাকটিকিট প্রকাশ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরও একটি অংশ। এই ডাকটিকিট সেসময় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

ডাকটিকিট দুই (২) রুপি মূল্যমান
দুই রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি হল একটি বক্তব্যধর্মী ডাকটিকিট। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের সাধারন নির্বাচনের বিশদ বিবিরণ এই ডাকটিকিটে চিত্রিত হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাংলার জনগণ ৯৮% ভোটে নির্বাচিত করে, কিন্তু পাকিস্তান শোষক শ্রেনীবাংলার জনগণের রায়কে ভুলুন্ঠিত করে জনগণের উপর অনির্ধারিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়হানাদার পাকিস্তানি ও গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী কিছুসংখ্যক দেশ এটিকে এটিকে দুষ্কৃতকারি কর্তৃক সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী গন্ডগোল বলে প্রচার করতে থাকে। এই অপপ্রচারের যথাযথ জবাব দেওয়া ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই ছিল এই ডাক্টিকিট প্রকাশের মুখ্য উদ্দেশ্য।এর উপরের অংশে অন্যান্য ডাকটিকেটের মত বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় জং.২ লেখা আছে। এর নিচের অংশে একটি ব্যালট বাক্সের ছবি এর দুই পাশে ইংরেজীতে ৯৮ লেখা এবং এর উপর % চিহ্ন। বাক্সের উপর ELECTION 1970 লেখা। এরপরে ব্যালট পেপার ফেলার অংশে এক টুকরা কাগজের ছবি, এর গায়ে VOTE এবং এর নিচের লাইনে RESULT 167 SEAT লেখা আছে। এর পরের লাইনে OUT OF 288 ও সর্বশেষ লাইনে FOR BANGLADESH লেখা রয়েছে। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন পেয়ে জয়লাব করে। এবং ৩১৩ বিশিষ্ট আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন লাভ করে এবং জাতীয় পরিষদের ১৪৪ আসনের মধ্যে ৮৮ টি আসন লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদের সভা না ডেকে আলোচনার নামে কালক্ষেপন করে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলার জনগণের উপর লেলিয়ে দেয়। এই ডাকটিকিটটির মাধ্যমে বিশ্ব জনমতের নিকট পাকিস্তান সরকারকে বর্বর, স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া বিপ্লবী

১৯৯

স্বাধীন বাংলাদেশ যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তারই প্রমাণ বহন করে এই ডাক্টিকিট।

ডাকটিকিট পঞ্চাস (৫০) পয়সা মূল্যমানের
পঞ্চাশ (৫০) পয়সা মূল্যমানের এই ডাকটিকিটের উপরের অংশে অন্যান্য ডাকটিকেটের মত বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় চ.৫০ লেখা আছে। এর নিচের অংশে ছোট করে A NATION OF এর নিচে বড় করে ইংরেজিতে ৭৫ লেখা এবনহ এর নিচের অংশে MILLION PEOPLE লেখা আছে। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে “একটি দেশ তখনই স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য হবে যখন তার নিজস্ব জনসংখ্যা থাকবে।” সেই মতানুযায়ী বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য কেননা তার নিজস্ব জনসংখ্যা আছে যার পরিমাণ ৭ কোটি। এই প্রচারণার লক্ষই ছিল বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তা প্রমাণ করা। এছাড়া এই সাড়ে ৭ কোটি মানুষ যে আজ নিপীড়িত, নির্যাতিত ও গণহত্যার শিকার এর প্রতি বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ ও আন্দোলিত করা। এই দেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করার আবেদন জানানোও এর একটি উদ্দেশ্য ছিল। ডাকটিকিটের গায়ে ছাই রঙের জমিন ও খয়েরি রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। এই ডাকটিকিট টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনমত সংগঠনে সাহায্য করেছিল।

ডাকটিকিট পাঁচ (৫) রুপি মূল্যমানের
পাঁচ রুপি মূল্যমানের ডাকটিকিটটি মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসংবলিত।উদ্দেশ্য।এর উপরের অংশে অন্যান্য ডাকটিকেটের মত বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় Rs.5 লেখা আছে। নিচের অংশে সোনালী জমিনের উপর বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ছবির বাম দিকে সাদা হরফে লেখা SHEIKH MUJIBUR RAHMAN. বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময় পাকিস্তানের অন্ধ কারাগারে বন্দি ছিলেন। এই মহান নেতার মুক্তির জন্য বাংলার জনগণ, আমাদের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল দেশ ও ব্যক্তি সমূহ এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী বিভিন্ন সংগঠন

২০০

ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনকে বিস্বব্যাপী আরো ছড়িয়ে দেওয়া ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতার সাথে বিশ্বের সকলের পরিচিত করাই ছিল এই ডাকটিকিট প্রকাশের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

ডাকটিকিট বিশ (২০) পয়সা মূল্যমানের
বিশ পয়সা মূল্যমানের ডাকটিকিটটির উপরের অংশে অন্যান্য ডাকটিকেটের মত বাংলাতে বাংলা দেশ লেখা ও ইংরেজিতে BANGLA DESH লেখা এবং দুই বাংলাদেশ লেখার মাঝখানে POSTAGE REVENUE লেখা। ডানপাশে কোনায় চ.২০ লেখা আছে। এর নিচের অংশে সবুজ জমিনের উপরে সোনালী ও সাদা রঙের লেখা। প্রথমে সাদা রঙের MASSACRE AT লেখা। এর নিচে সোনালী রঙে লেখা DACCA UNIVERSITY এবং এই লেখার উপর লাল রঙের ছোপ ছোপ। সবচেয়ে নিচে ON 25th 26th MARCH ১৯৭১। এই ছবিটি মূলত হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ও ২৬ মার্চ যে নির্মন গণহত্যা চালানো হয় তার চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান ও তার সহযোগিরা প্রচার করত পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক, শুধু কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী পাকিস্তানের অখন্ডতা নষ্টের চেষ্টা করছে এবং এরা ভারতের দালাল, এখানে গণহত্যা, অত্যাচার এসব কিছু হচ্ছেনা, এগুলো মিথ্যা প্রচারণা- এই মিথ্যা প্রচারণা ও নরপিশাচ পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক কে জাগিয়ে তোলে এবং অনতিবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধের জন্য বিশ্ব জনমত সংগঠিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বের সকল দেশের সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই ডাকটিকিট টিতে এই নকশা প্রকাশ করা হয়।

১. তপ্তহ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার

তাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার এক রাজনীতিবিদ। জাতীয়তাবাদের উগ্রতা তাঁকে স্পর্শ করেনি, বরং নিজেকে লুকিয়ে রেখে কাজ এগিয়ে নেবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ভিতর যা থাকে মানবতাবাদী নিষ্ঠাবান নেতার মধ্যে। সাফল্যের সঙ্গে তিনি নিজের চেয়ে নিজের কাজকে বড় করে তুলতে পেরেছেন। যে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী তার নিজের

২০১

ভূখন্ডকে শত্রুমুক্ত করে একটি স্বাধীন পতাকা ওড়ায় ওই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তাজউদ্দীন আহমদ। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী যেমন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক তেমনি যুদ্ধের পোষাক পরিহিত তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।
বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতা তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে। জীবনের শুরুতেই ছোঁয়া পান বিপ্লবী অবনী গোস্বামীর। তাজউদ্দীন মাইনর স্কুলে পড়ার সময়ই ওই বিপ্লবী বুঝতে পেরেছিলেন এ ছেলের ভিতর দেশপ্রেম আছে। এ কারনে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের বাবাকে বলেছিলেন তার ছেলেকে ভাল কোন ইংরেজি স্কুলে দিতে।
তাজউদ্দীন আহমদের স্কুল জীবনে পড়াশুনা কাপাসিয়া মাইনর স্কুল, কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস স্কুল, ঢাকার মুসলিম স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল। স্কুল জীবনের শুরু থেকে শিক্ষা জীবনের শেষ অবধি তাজউদ্দীন আহমদ অপরিসীম মেধার পরিচয় দেন। দারুন মেধাবী এ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ঠিক সমান্তরালে প্রবাহিত নয়। এর মূল কারণ কিন্টু স্কুল জীবন থেকে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৪ সালে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। কিন্তু তার আগেই তিনি হয়ে ওঠেন মুসলিন লীগের তৎকালীন প্রগতিশীল অংশ আবুল হাশিম গ্রুপের সক্রিয় সমর্থক। ১৯৪৪ সালে যেবার তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন সেবারই তিনি বংগীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ঠিক তেমনিভাবে দেখা যায় ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সে বছরই যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হয়। তিনি তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ম্যাট্রিকুলেশন ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ভিতর তার পড়াশুনায় ছেদ থাকলেও দেখা যায় উভয় ক্ষেত্রে তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। ম্যাট্রিকুলেশনে তিনি দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন ও উচ্চ মাধ্যমিকে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এরপর আবার রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও ১৯৬৬ সালে জেলে বসে এলএলবি পাশ করেন।

১৯৪৬ সালের ৬ এবং ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সৃষ্টির পরে এদেশে প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এ সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। এ সংগঠনের অন্য উদ্যোক্তারা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তসাদ্দুক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়হা, শামসুল হক প্রমুখ।
এর পরে গঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ। যা পরে ১৯৫৫ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগে পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির ও বাঙালি

২০২

জাতিয়তাবাদ বিকাশের অন্যতম সংগঠনে পরিনত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ধাপে ধাপে এ সংগঠনের নেতৃত্বের পথে পাড়ি দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। ৭
১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ অবধি ঢাকা জেলা আওয়ামঈ লীগ ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে এম এল এ নির্বাচিত হন। এরপর তিনি চলে আসেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সমাজকল্যান সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর আসে দেশে প্রথম সামরিক শাসন। এ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। এবং ১৯৬২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রনীত হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গী। লাহোরে ৬ দফা ঘোষণা করার পর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়। ওই আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ গ্রপ্তার হন ১৯৬৬ সালের ৮ মে। এবার গ্রেপ্তার হবার পর তাজউদ্দীন আহমদ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছিলেন ১৯৬৯ এর গণুভ্যত্থান অবধি। এ সময় ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগের আবার কাউন্সিল অধিবেশন হয়। ওই অধিবেশনে জেলে থেকে তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয়বারের মত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এরপর তাজউদ্দীন আহমদ আবার তৃতীয়বারের মত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে। এবারই পাকিস্তানে প্রথম প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ বিপুল ভোটে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
৭০ এর নির্বাচনে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল, নির্বাচনে বিজয়ীরা দেশকে একটা শাসনতন্ত্র দেবে। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পরেই আওয়ামী লীগ শাসন্তন্ত্র প্রণয়ন কমিটি তৈরি করে। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ওই কমিটির অন্যতম সদস্য।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া পাকিস্তান গণপরিষদ আহবান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখে। আর এ সময়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবির রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলনের সময় মূলত দেশের শাসনভার আওয়ামী লীগ তার নিজের হাতে তুলে নেয়। দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সে সময় আওয়ামী লীগের নির্দেশে চলে। ১৯৭১ এর ১ মার্চ

২০৩

থেকে ২৫ মার্চের কালোরাত অবধি এভাবে দেশ পরিচালিত হয়। এ সময়ে আওয়ামী লীগের গেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে প্রতিটি নির্দেশ আসত তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে। আর এ কারনে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর সশস্ত্র আক্রমন করলেও দেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব যোগ্যভাবে গ্রহন করেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর তাই পরবর্তীকালে স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সমর্থক শব্দে পরিনত হয়েছে তেমনি মুক্তিযুধ ও তাজউদ্দীন আহমদ সমর্থক শব্দ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাঙালি জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘষণার কিছুক্ষণের মাঝে তিনি গ্রেপ্তার হন। এই দুঃসময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে তাদের সহযোগিতা আদায় ও সরকার গঠন করতে তাজউদ্দীন আহমদ সময় নেন মাত্র ১৪ দিন। এত দ্রুত এ কাজ করা হয়েছিল বলে সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দাঁড়াতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ দ্রুত সরকার গঠন করে সমগ্র দেশকে ঐ সরকারের আওতায় নিয়ে আসেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালীর উপর পাকিস্তানিদের আক্রমনের পর ২৫ ও ২৬ মার্চ পাক আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর ২৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ অবধি কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায়, কখনোবা মোটরসাইকেলের পিছনে চেপে তিনি সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেন। ৩০ মার্চ তিনি মেহেরপুর সীমান্তে পৌঁছান। এবং ৩০ মার্চ তিনি আর সময় ক্ষেপণ না করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১ এপ্রিল তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় দিল্লীতে পৌঁছান এবং ৪ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধান্মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঞগে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ভারতের নিঃশর্ত সমর্থন আদায় করেন।
৬ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের বেতার ভাষণ তিনি তৈরি করেন। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ১০ এপ্রিল রাতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানম্নত্রী হিসেবে তিনি গাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে প্রধানম্নত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন এবং দেশী বিদেশি শত শত সাংবাদিকের সামনে বাংলাদেশের অবস্থান ও ইয়াহিয়ার গণহত্যার কথা তুলে ধরেন। ২৫ মার্চের পর এটাই ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন।
এরপর বলা যায় তাজউদ্দিন আহমদ একক ও দৃঢ় হাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেনেবং এ কাজে তিনি ভারতের সাথে মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধরত রাজনৈতিক শক্তির উপদলীয় কোন্দল ও ভারতীয় গোয়েন্দা শাখার একটি অংশের সহায়তায় সামরিক এক ব্যক্তির ওয়ার কাউন্সিল

২০৪

করার চেষ্টা তিনি রুখে দেন প্রজ্ঞার সঙ্গে।
সরকার গঠনের সহযোগিতার প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা চাই। এ সহযোগিতা হবে মর্যাদার ও বন্ধুত্বের। ভারত এর বেশি কিছু আশা করলে আমরা আমাদের মাটিতে ফিরে যাব এবং সেখানে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করব। বাংলাদেশ ভারতের মাটিতে বসে নয় মাস কোন চুক্তি করেনি ভারতের সাথে।
যে অসীম দৃঢ়তার সাথে তাজউদ্দীন আহমদ এ কাজ করতে পেরেছিলেন তা কেবল সম্ভব হয়েছিল তার ব্যক্তিত্বের কারনে। ভারতের তৎকালীন রাজনীতিক ও আমলারা আজো সেটা স্বীকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাক্তত্বের কারণে আরো যে কাজগুলো সম্ভব হয়েছিল তা হল রাজনৈতিক উপদলীয় কোন্দল ঠেকানোসহ অন্যান্য। সেদিন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও ছাত্র যুব নেতৃত্বের ভিতর বেশকিছু উপদল কাজ করে। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি তাজউদ্দীন আহমদের কারণে।
এরপর মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি আরেকটি বড় দ্বায়িত্ব সেদিন ছিল বাঙালী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ব জনমত গঠনের কাজ। সে কাজও সেদিন যোগ্যতার সঙ্গে পরিচালিত হয়।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদ সহ দেশে ফেরেন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর তিনি প্রধানম্নত্রী ছিলেন ১০ জানুয়ারি অবধি। ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব নেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক। ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধকালের ষড়যন্ত্রের এক হোতা খন্দকার মোশতাক আহমদ। আর চলতে থাকে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমদকে।

তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স
২৭ মার্চ সকালে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানকারী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ রাতে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সিলেটের শমসেরনগরে অবস্থানকারী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৭ মার্চ বিকেলে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় এসে এই কোম্পানীটি ব্যাটালিয়নের অন্য কোম্পানীর সাথে

২০৫

একত্রিত হয় এবং মেজর খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। ২৮ এবং ২৯ মার্চ জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থানকারী দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করে ময়মনসিংহে মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে একত্রিত হয়। মেজর শফিউল্লাহ ৩০ মার্চ কিশোরগঞ্জের স্টেশন এলাকায় নিজস্ব হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহী সৈনিকদের নিয়ে ঢাকা কযান্টনমেন্ট আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি জঙ্গী বিমান এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্টের প্রতিকূলে ঢাকা অভিযানটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন হবে ভেবে তা থেকে বিরত থাকার জন্য একটি পত্র লিখে মেজর খালেদ মোশাররফ লে. মাহবুব কে একটি ট্রেনের স্পেশাল ইঞ্জিন নিয়ে কিশোরগঞ্জে পাঠান। মেজর খালেদ মোশাররফ দ্বীতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় আসার আমন্ত্রণ জানান। মেজর খালেদ মোশাররফের অনুরোধে ৩১ মার্চ ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় এসে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে একত্রিত হয়। ২৯ মার্চ লে.কর্ণেল সালাহউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা নামের একজন বাঙালী সেনা কর্মকর্তা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া এসে ৪র্থ বেঙ্গলের সাথে যোগ দেন। লে. কর্ণেল এস এম রেজা ছিলেন ঢাকার আর্মি রিক্রুটিং অফিসের কমান্ডিং অফিসার। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংগঠিত হলে ২৭ মার্চ কর্ণেল রেজা হেঁটে ঢাকা থেকে পালিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেন। এস এম রেজাই ছিলেন একমাত্র কর্মরত লে.কর্ণেল, যিনি নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। বাকি সবাই ছিলেন মেজর পদমর্যাদার। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর লে.কর্ণেল এস এম রেজাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন কোন দ্বায়িত্বই দেওয়া হয়নি। অথচ কর্ণেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর পরবর্তী পদটার দাবীদার ছিলেন তিনিই।
সম্ভাব্য পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগান এলাকায় দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টদ্বয়ের একটি তে অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। ২ এপ্রিল কর্ণেল (অব.) এম এ জি ওসমানী এম এন এ তাঁর অতিপ্রিয় গোঁফ কেটে ছদ্মবেশে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা শহরসংলগ্ন মতিনগরে পৌঁছেন। ঐদিনই বিকেলে ভারতের বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে লে. কর্ণেল এস এম রেজা, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে দেখা করে কর্ণেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানকারী মেজর জিয়ার রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন। মেজর জিয়া তাঁকে সাহায্যের জন্য

২০৬

কিছু সৈন্য প্রেরণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও ব্রিগ্রেডিয়ার পান্ডে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গলের বিদ্রোহী উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। লে. কর্ণেল এস এম রেজা বিদ্রোহী বাহিনী গুলোর কার্যক্রম সমন্বিত করা এবং ভারতীয় বিএসএফের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সাহায্যের ব্যাপারে ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোর একটি জরুরী আলোচনা সভার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি সীমান্ত অতিক্রমকারী অনয সামরিক কর্মকর্তাদের ঐ কনফারেন্সে এনে হাজির করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে দ্রুত তেলিয়াপাড়া এলাকা ত্যাগ করেন।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তুমজী, আগরতলা গেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল এবং কর্ণেল ওসমানীকে সঙ্গে নিয়ে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হন। তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে ইতিমধ্যেই লে.কর্ণেল এসএম রেজা মেজর (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নুরুল ইসলাম (শিশু), মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীন সহ আরো কিছুসংখ্যক সেনা অফিসার উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সের লক্ষ ও বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন ৪র্থ বেণহহল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর খালেদ মোশাররফ। কনফারেন্সে আলোচনার বিষয়বস্তু এবং সিদ্ধান্তসমূহ ছিল নিম্নরূপঃ
এক. কনফারেন্সে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাগণ সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিএসএফ এর মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্র-সস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবরাহের সম্ভাবনার কথা জানতে চান। এ ব্যাপারে বিএসএফের ব্রিগেডিয়ার পান্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সীমিত আকারে হালকা অস্ত্র শস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহের আশ্বাস দেন। তিনি শীগিগিরই তাঁর সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানান।

দুই. মুক্তিকামী হাজার হাজার ছাত্র ও যুবকের সামরিক প্রশিক্ষণদানের লক্ষে সীমান্তবর্তী ভারতীয় ভূখন্ড ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এ ব্যাপারে সভায় উপস্থিত আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল ভারতীয় ভূখন্ডে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

তিন. মেজর খালেদ মোশাররফ বিভিন্ন বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিত প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার যুদ্ধরত বিদ্রোহী

২০৭

সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কোথায় কি ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছে, তা নিয়মিত মনিটরিং করার দ্বায়িত্ব নেন। তিনি সীমান্তবর্তী বিএসএফ এর কর্মকর্তাদের বিদ্রোহী বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সাহায্যের নির্দেশ দেবেন বলেও আশ্বাস দেন। উপস্থিত বিদ্রোহী সেনাকর্মকর্তাগণ এ দিনের কনফারেন্সে দেশটিকে চারটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাবার জন্য একজন করে সেনা কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমান কে। বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দ্বায়িত্ব নেন মেজর খালেদ মোশাররফ।বৃহত্তর সিলেট জেলার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার দ্বাতিত্ব দেয়া হয় মেজর সফিউল্লাহকে। বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর ও কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে নায়ার দ্বায়িত্বে থাকেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী।

চার. সভায় ব্রিগ্রেডিয়ারএপান্ডে সকলকে অবহিত করেন যে, চট্টগ্রাম বিদ্রোহে নেতৃত্ব দানকারী মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্তমানে রামগড়ে অবস্থান করছেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম দখলে আনার জন্য জরুরী ভিত্তিতে তাঁর জন্য কিছু সৈন্য পাঠানো দরকার। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, ওইদিনই ক্যাপ্টেন মতিনের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানী রামগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে। ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ওই রাতেই বিএসএফ এর গাড়ি দিয়ে এ দুটি কোম্পানিকে ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড়ে পৌঁছানোর দ্বায়িত্ব নেন। কোম্পানিউ দুটি এদিন সন্ধ্যার পরপরই রামগড়ের উদ্দেশ্যে তেলিয়াপাড়া চা বাগান এলাকা ত্যাগ করে।

পাঁচ. মেজর খালেদ মোশাররফ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সেনা সদস্যদের বিদ্রোহকে আইনানুগ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য সীমান্তে অতিক্রমকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ব্রিগ্রডিয়ার পান্ডে জানান যে, তাঁর জানামতে প্রায় ৭০/৮০ জনের মত এমএনএ এবং এমপিএইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়ে আছেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কর্ণেল (অব.) এমএজি ওসমানী একজন নির্বাচিত এমএনএ বিধায় তাঁকে শীগগিরই সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্য গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের

২০৮

উদ্যোগ নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। কর্ণেল (অব.) ওসমানী এ ব্যাপারে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না বলে জানান। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তুমজী, ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ ব্যাপারে কর্ণেল ওসমানীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বলে জানান।
এদিনের কনফারেন্সে আলোচ্য বিষয়গুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করার জন্য ১০ এপ্রিল একই স্থানে আরেকটি কনফারেন্স অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১০ এপ্রিলের তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সে মেজর শাফায়েত জামিল ছাড়া ৪ এপ্রিলের সভায় উপস্থিতদের সকলেই ছিলেন। এদিন মেজর শাফায়েত জামিল ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহর এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। এদিনের কনফারেন্সে মেজর জিয়াউর রহমান ভারতীয় এলাকা হয়ে রামগড় থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন
১০ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের আলোচ্য বিষয়বস্তু ও সিদ্ধান্তগুলো ছিল এমনঃ

এক. এ দিনের সভায় প্রথমেই কর্ণেল (অব.) এমএজি ওসমানীর নিকট গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ”অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের ব্যাপারে তিনি কতদূর সফলকাম হয়েছেন তা জানাতে অনুরোধ করা হয়। কর্ণেল ওসমানী এ বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রমকারী বেশ কিছু সংখ্যক এমএনএ এবং এমপিএর সাথে আলোচনা করেছেন বলে জানান। অধিকাংশ গণপ্রতিনিধিই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেও তিনি উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন। তাজউদ্দীন আহমদ শীগগির ই একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের ঘোষণা দেবেন বলে কর্ণেল ওসমানীকে আস্বস্ত করেছেন বলেও তিনি সকলকে জানান। উপস্থিত সেনাকর্মকর্তাগণ পুনরায় কর্ণেল ওসমানীকে গণপ্রতিনিধিদের চাপ দিয়ে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠনের ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান। কেননা এ কাজটি করতে দেরি হলে পাকিস্তান সরকার মহান স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামকে নিতান্তই একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সেনা বিদ্রোহ হিসেবে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করবে। কর্ণেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এ ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে উপস্থিত সকলকেই আশ্বস্ত করেন।

দুই. ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধটিকে সমন্বিত অ্যাকশনে রূপ দেওয়া এবং কমান্ড চ্যানেলে আনার লক্ষ্যে এদিন পুরো দেশটিকে ৬ টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ফেনী নদী পর্যন্ত (শুভপুর ব্রিজ) নোয়াখালি জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক দ্বায়ির্ব পড়ে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ এবং ঢাকা জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ

২০৯

পরিচালনার দ্বায়িত্ব পড়ে মেজর খালেদ মোশাররফের উপর। বৃহত্তর সিলেট জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দীনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে নেবার দ্বায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। আর বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও যশোর জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দ্বায়িত্বে রাখা হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে।

তিন. ৬ টি অঞ্চলের কমান্ডারদের তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিত অ্যাকশনে যাবার সিদ্ধান্ত হয়।

চার. সভায় ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তুমজী, বিএসএফ এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার পান্ডে এবং আগরতলা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল জানান যে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার লক্ষ্যে ভারতিয় সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে ইতিমধ্যেই অস্থায়িভাবে বেশকিছু ক্যাম্পও স্থাপন করা হয়েছে। শরণার্থীদের জন্যেও ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিএসএফ এর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীকে বেশকিছু অস্ত্র সস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএসএফ এর সৈন্যরা বিদ্রোহী বাহিনী গঠনের পরপরই ভারতীয় পক্ষ থেকে সাহায্যের পরিমান বাড়বে বলে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে সকলকে অবহিত করেন।

পাঁচ. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির ব্যাপারটিও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ব্যাপারে ভারতীয় প্রচারমাধ্যম গুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে জানানো হয়। তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের ফলেই ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ‘প্রবাসী বাংলাদেশ গঠনের’ ঘোষণা দেন। ঐ ঘোষণারই আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন ঘটে ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মাধ্যমে।

তেলিয়াপাড়া কনফারেন্সের সিদ্ধান্তকে অণুকরণ করেই পরবর্তীকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সশস্ত্র স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করেছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত রচনায় তেলিয়াপাড়া কনফারেন্স একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা
উত্তাল মার্চ মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সময়ে যে সকল শ্লোগান অত্যন্ত

২১০

জনপ্রিয় ছিল ও প্রায়শ শোনা যেত এর মধ্যে অন্যতম ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ , শ্লোগানটি পুরো মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধের সেই উত্তাল দিনে বাঙালীদের বিভিন্ন আন্দোলনে ব্যাপক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও মুছিলে মুক্তিকামী বাঙালীর মুখে মুখে এই শ্লোগানটি উচ্চারিত হত। এটি বাঙালীর প্রাণের বানীতে পরিণত হয়। বিদেশের মাটিতে ভারত, গ্রেটব্রিটেন সহ অন্যান্যা দেশেও বাঙালীদের বিভিন্ন আন্দোলন, মিছিল সমাবেশে এই শ্লোগানটি বহু মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়।

তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব
মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে বাংলার প্রতিটি ঘরে প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে ‘তাওমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ শ্লোগানটি উচ্চারিত হত। বাংলায় এমন কোন সভা সমাবেশ কিংবা মিছিল ছিলনা যেখানে এই শ্লোগানটি উচ্চারিত হতনা। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন এই শ্লোগানই মুক্তিকামী মানুষের সাহস ও উদ্দীপনার একমাত্র বানীতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ছিলেন গণমানুষের নেতা আর পাকিস্তানিদের নিকট মুজিব ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্কের মত। এই কারণে পুরো মুক্তিসংগ্রাম এবং যুদ্ধকালীন সময়েও দেশে বিদেশে অনুষ্ঠিত বাঙালির প্রতিটি সভা সমাবেশে এই শ্লোগানটি গণমানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হত।

তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সেই দিনগুলিতে কোটি বাঙালি উদাত্ত কন্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ শ্লোগান ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে বাংলার আকাশ বাতাস উদ্বেলিত করত। পরবর্তীকালে পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক সমস্ত বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে মুক্তাঞ্চলে ও মুক্তিকামী প্রবাসী বাঙালিরা তাদের মিছিলে সমাবেশে এই শ্লোগানটি ব্যাপক ব্যবহার করত। বাংলার ছাত্র জনতা এই শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। এটা ছিল গণমানুষের প্রাণের বাণী।

ত্রাণ ও বেতার মন্ত্রণালয়
দ্র. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার

২১১

দাবানল
‘দাবানল’ নামক এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির পরিচিত শ্লোগান ‘মুক্তিযোদ্ধা ও সংগ্রামী জনতার মুখপত্র’। এই লাইনটি পত্রিকার নামের উপরে লেখা থাকত। সম্পাদক মো. জিনাত আলী ছিলেন। ত্রিবর্ণ প্রকাশনীর পক্ষে মো. সেলিম কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত এবং মুজিবনগর হতে প্রচারিত। পত্রিকাটির বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশন নং-৭, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬ এবং মূল্য ২৫ পয়সা ছিল। প্রথম প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যার একটি রাজনৈতিক ভাষ্যের শিরোনাম ছিলঃ ‘পাকিস্তানে নয়, বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরবেন’। ৩য় সংখ্যার প্রকাশ ১০ অক্টোবর ১৯৭১ আর বাংলায় ২৩ আশ্বিন, ১৩৭৮, রোববার ছিল। ‘আপোষের বানী আগুণে জ্বালিয়ে দাও’ এই নামে ২য় সংখ্যার সম্পাদকীয় ছিল। ৩য় এবং ৪র্থ সংখ্যার পত্রিকার প্রধান দুটি শিরোনাম ‘দেশবাসীর লাশ আর রক্তের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ অসম্ভব’, ‘চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট-সেনাবাহিনীতে অন্তর্দ্বন্দ্ব-মুক্তিবাহিনির দুর্বার সাফল্যে সুনিশ্চিত পরাজয়ের মুখে খুনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ ছিল। ‘দাবানল’ এর ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২১ মে ১৯৭১।

দি গ্রেটেস্ট কনসার্ট অব দি ডিকেড
১০৪ X ৭০ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোষ্টারটি ১৯৭১ সালের অ্যাপেল রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত। ১৯৭১ সালের ১ কটি বাঙালি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবিরে তারা খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকে। বাঙালির এই নির্মম দুর্দশা দেখে বহু বিদেশী সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। তারা বাঙালি মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করে এবং সাহায্য সহযোগিতা করে। এদের একজন বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন। তিনি বাঙালির দুঃখ দুর্দশা বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরার জন্য ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারে ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। জর্জ হ্যারিসন ও জনপ্রিয় কিছু শিল্পী ঐতিহাসিক এই অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এই চ্যারিটি শো থেকে উপার্জিত সমস্ত অর্থ বাংলাদেশের কল্যানে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জর্জ হ্যারিসনের এই কনসার্টটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। সমগ্র বিশ্বে বাংলা-বাঙালির দুরাবস্থার কথা পাকিস্তানিদের অন্যায়, অত্যাচার, গণহত্যা, নিপীড়নের কথা প্রচারিত হয়। সমস্ত বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সকল সরকারের সমর্থন ছিলনা। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করেছে। এমন পরিস্থিতিতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে কোন

২১২

কোন চ্যারিটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ও তার থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করা তৎকালীন সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

দুর্জয় বাংলা
‘দুর্জয় বাংলা’ সাপ্তাহিকীটি তুষারকান্তি কর সম্পাদনা করতেন। পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকত ‘সংগ্রামী বাংলার কন্ঠস্বর’। এটি ছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণের বিপ্লবী মুখপত্র। সিলেট সুরমা প্রকাশনীর পক্ষ হতে কান্তি কর কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। বিদেশস্থ যোগাযোগের ঠিকানাঃ রফিকুর রহমান, পুরাতন স্টেশন রোড, করিমগঞ্জ। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা নিয়মিত এবং শামসুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর ও দিলওয়ারের কবিতা এতে প্রায়ই ছাপা হত। পত্রিকাটির মূল্য ১০-২৫ পয়সা ছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় মন্তব্য ‘জয় আমাদের হবেই’ প্রকাশিত হয় ৪ নভেম্বর, ১৯৭১।

দুষ্কৃতিকারী
১৯৭১ সালের পাকিস্তানের সামরিক সরকার ও তাদের দালালদের দৃষ্টিতে ‘দুষ্কৃতিকারী’ ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা, যারা জাতির পরাধীনতা ঘোচাতে জীবন বাজি রেখে হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি সরকার, হানাদার সৈন্য ও তাদের এদেশীয় অনুচররা মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করত ‘মিসক্রিয়েট’ বা ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পত্রপরিকায় এদের ‘ইসলামের দুশমন’ ও ‘পাকিস্তানের শত্রু’ বলে প্রচার করা হত। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ‘ভারতের চর’ হিসেবেও, কারণ ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিল, প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় অনুচরদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে বা ধর্মকে রাজনীতির পুঁজি করা। কিন্তু সাধারণ জনগোষ্ঠী ঠিকই তাদের প্রচারণা বুঝতে পেরেছিল। অন্যথায় বাংলাদেশ একচ্ছত্র জনসমর্থনে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে পরিণত হতনা।

দেশবাংলা
সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী কর্তৃক ‘দেশবাংলা’ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বাংলাদেশের জনযুদ্ধের মুখপত্র হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়। সাপ্তাহিকীটি দীপক কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও ‘অগ্নিশিখা’ প্রকাশনীর পক্ষে

২১৩

বিজয়নগর, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানা ছিলঃ দেশবাংলা কার্যালয়, বিজয়নগর, ঢাকা-২, সত্যরঞ্জন দেব, ৩ হায়াত খান লেন, কলকাতা ৯, সফিউল আলম বেবী, প্রযত্নে ঝর্ণা বুক এজেন্সি, হরিগঙ্গা বসাক রোড, আগরতলা। শম্ভু পাল প্রযত্নে কবরী চৌধুরী, গান্ধীনগর, ইস্ট বান্দ্রা, বোম্বাই। পত্রিকাটির মূল্য ২০-৩০ পয়সা, ছাপা ঝকঝকে, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮, কলামসংখ্যা ৫ রাখা হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে এবং ভারতে প্রকাশিত হত। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ২৭ অক্টোবর, ১৯৭১। ২য় প্রকাশনা বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর ১৯৭১ এবং এ সংখ্যার এবং এ সংখ্যার সম্পাদকীয় ছিল ‘অনিবার্য সমাধি’ ও প্রধান সংবাদ শিরোনাম ‘জাতিসংঘের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে, চীন বাংলাদেশের পক্ষ নেবে? ইয়াহিয়া চক্রের আত্মহত্যার দিন সমাগত’। এই পত্রিকা সম্পর্কে ইমামুর রশীদ লিখেছেন ‘পত্রিকাটির দৃষ্টিতে একমাত্র ধর্ম নয়, বরং ভাষা সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক একাত্মতাই জাতীয়তার মৌল ভিত্তিরূপে পরিগণিত ছিল।

নট পেনি, নট গান
টিক্কা ভুট্টো ইয়াহিয়া খান
NOT PENNY, NOT GUN TIKKA BHUTTO YAHYAH KHAN
প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে এই শ্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাআব করে। ‘৭১ এর সেই দিনে বিদেশের মাটিতে বাঙালিদের এই শ্লোগান ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হত। এই শ্লোগানটি বিদেশীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন বিদেশী এই শ্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের সরকারকে হানাদার পাকিস্তানিদের সাহায্য সহযোগিতা থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় শ্লোগানটি প্রবাসী বাঙালিদের কন্ঠে জনপ্রিয় শ্লোগানরূপে উচ্চারিত হতে থাকে। এই সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার ও প্লাকার্ডেও এই শ্লোগানটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

নতুন বাংলা
‘নতুন বাংলা’ এই পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ) সাপ্তাহিক মুখপত্র লেখা হত। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি কর্তৃক বাংলাদেশ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত, যা শেষের পাতার নিচে লেখা থাকত। ৪ পাতা, ৪ কলামসংখ্যার এই পত্রিকার দাম ১০ পয়সা রাখা হয়। প্রথম প্রকাশ ১৯ জুলাই, ১৯৭১ হয় এবং এর

২১৪

১৯ তম সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়?পত্রিকাটিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খবর ছাপানো ছাড়াও অন্যান্য খবরও প্রকাশিত হত। ২৫ নভেম্বর ১৫ শ সংখ্যার প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরোনামগুলো যেমন- ‘অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সুষ্ঠু প্রশাসন চাই’, ‘সারক্ষীরাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত, যশোর ক্যান্টোনমেন্টে হানা, জঙ্গীশাহী কর্তৃক পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা’, ‘আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠেনা’, ‘বাংলাদেশের নেতৃত্বের একাংশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয় কেন?’, ‘লন্ডনপ্রবাসী ন্যাপ কর্মীদের জ্ঞাতব্য’ ছিল। আর এই সংখ্যারই দুটি সম্পাদকীয় হল ‘আঘাতের পর আঘাত হানো’ ও ‘তদন্ত কমিশনের নামে নয়া মার্কিন চক্রান্ট’ বিষয়ে। তাছাড়া বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার একটি আবেদনও এই সংখ্যায় ছাপা হয়।

পঁচিশে ও ছাব্বিশে মার্চের ঢাকা
[একাত্তরে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে সাইমন ড্রিং এর বয়স তখন ২৭ বছর, লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলী টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক। বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খা যেমন তিনি দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন পাকসেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ২৫ ও ২৬ মার্চের ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলিলার চাক্ষুষ বর্ণনা তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে জানান। ঢাকায় এসে তিনি শুনিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিবেদন সংগ্রহের কাহিনী]
পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (শেরাটন)। আমরা জনা চল্লিশেক বিদেশী সাংবাদিক তখন ছিলাম ওই হোটেলে। কড়া হুকুম জারি করলেন ঐ ক্যাপ্টেন- হোটেলের বাইরে যাওয়া চলবেনা কারো। গেলেই গুলি। প্রচ্ছন্ন হুমকি। দিনের বেলা একবার শেখ মুজিবের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। খুব চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। এই নিষেধাজ্ঞার সাথে ঐ দুশ্চিন্তার একটা যোগসূত্র মনে করে আতঙ্কিত হলাম। রাত ৯ টার দিকে খবর পেলাম সেনাবাহিনির একটি কলাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে শহরে প্রবেশ করেছে। কি ঘটছে? জানার জন্য মন ছটফট করলেও উপায় ছিলনা। সৈন্য চলাচলের খবর দিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফোন করলাম শেখ মুজিবের বাসায়। তিনি জানালেন, বোধ হয় ওরা আমাকে ধরতে আসছে। বললাম, আপনি আত্মগোপন করছেন না কেন? স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, আমাকে খুঁজে না পেলে ওরা সারা শহর জ্বালিয়ে দেবে।
রাত ১০ টার দিকে শুনতে পেলাম প্রথম গুলির শব্দ। অসংখ্য, অজস্র। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি করা হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছিল দুই পক্ষের মধ্যে বুঝি

২১৫

লড়াই বেধে গেল। কখনোবা মনে হচ্ছিল বিষয়টা একতরফা। রাত যত বাড়ছিল গলাগুলির শব্দ তত বেশি হচ্ছিল। হোটেল থেকে বেরুতে না পারার অস্থিরতা নিয়ে লাল হয়ে আসা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করছিলাম সংঘাতের ভয়াবহতা। মাঝরাতের দিকে আর থাকতে না পেরে আমরা কয়েকজন উঠে পড়লাম হোটেলের ছাদে।এই শোনা আর দেখা মিলিয়ে একটা প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠানোর চেষ্টা করলাম আমার পত্রিকায়। কিন্তু সম্ভব হলোনা। টেলিফোন লাইন ছিল কাটা। জানতে পারলাম বাইরে কারফিউ দেয়া হয়েছে। দারুন হতাশার মধ্যে ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে জড়ো হলাম সুইমিং পুলের কাছে।
ছাব্বিশে মার্চ সকাল ১০ টায় গেলাম শেরাটনেই অবস্থানরত জুলফিকার আলী ভুতটোর স্যুটে। দেখলাম রাতজাগার ক্লান্তি তার চোখেমুখে। সামনে অ্যাসট্রে বোঝাই সিগারেটের পোড়া টুকরা। বুঝতে চেষ্টা করলাম তিনি কিছু জানেন বা জানতেন কিনা। যাই হোক, কিছুক্ষন পরেই দেখলাম সৈন্যরা ভুট্টোকে হোটেল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। খুব ভীত দেখাচ্ছিল তাকে।
দুপুরের দিকে আবার গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। এবার পুরোন ঢাকার দিক থেকে। তখন বিকেল ৫ টা। জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। জনশূন্য রাস্তা। চারিদিকে অদ্ভুত এক নীরবতা। মাঝে মাঝে হুশাস সামরিক ট্রাক আর জিপের আনাগোনা। এরকম অবস্থার মধ্যে হোটেলে ঢুকলেন সেনাবাহিনির এক মেজর। নাম জানা গেল সালেক সিদ্দিক। তিনি জানালেন, মুজিবের অনুগতরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করায় তাদের সঙ্গে সৈন্যদের লড়াই হয়েছে। পরে বুঝেছিলাম কতবড় মিথ্যাভাষণ ছিল এটা। মেজরের কাছে আমাদের ভাগ্য জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা যদি ঢাকা ত্যাগ না করো তাহলে তোমাদের জন্য এক বিশেষ পার্টির ব্যবস্থা করব। আমি আজও জানিনা ঐ ‘পার্টি’ বলতে মেজর কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। সে সময়ে মেজরের কাছে এমন ভাব করলাম যে ঢাকা ছাড়তে আমি প্রস্তুত। কিন্তু যখন ট্রাকে উঠানোর জন্য সাংবাদিকিদের জড়ো করা হচ্ছিল তখন আমি লুকিয়ে সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশন সিস্টেমের প্যাসেজ ধরে ছাদে আশ্রয় নিলাম। সঙ্গে ছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট। আধঘন্টা পরে যখন নিচে নেমে এলাম তখন হোটেলের রান্নাঘরের বাঙালি কর্মচারীরা আমাদের সবচেয়ে ভালভাবে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হল। আমি আর মাইকেল বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম পাকিস্তান সরকারের সৈন্যদের চালানো হতবাক করে দেবার মত এক ধ্বংসযজ্ঞ। পুরো শহরকে যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান অতি যত্নের সঙ্গে যা আড়াল করে রাখার চেষ্টা করছিল বিশ্ববিবেকের চোখ থেকে। আমরা যে পাক আর্মির কথামত ঢাকা ছাড়িনি কেমন করে তা জেনে গেল তারা। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন-তিনবার হোটেলে হানা দিল ওরা। এক্ষেত্রে

২১৬

পুরো কৃতিত্বই দিতে হয় হোটেলের বাঙালি কর্মীদের। আমরা প্রতিবারই আর্মির চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে থাকতে পারলাম হোটেলের রান্নাঘরেই।
ধ্বংসযজ্ঞের ২০ রোল ছবি তুলেছিল মাইকেল। এর মধ্যে জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে সে ৭ টা রোল পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আমি আমার নোটের কাগজগুলো কোমরের বেল্টে আর মোজার ভিতর লুকিয়ে নিই। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানগামী একটি প্লেনে সিট যোগাড় করতে সমর্থ হই। বিমানবন্দরে নিরাপত্তারক্ষী আমার সঙ্গে বাংলাদেশের চারটি পতাকা দেখে সন্দেহাতুর হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে বিমানবন্দরে কর্মরত ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালেক। নিরাপত্তা বিষয়টি মেজরকে জানাতে উদ্যত হলে আমি দ্রুত তার হাতে ম্যাপ চারটি গছিয়ে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্লেনে চেপে বসি। করাচি বিমানবন্দরে দুই দুইবার আমার মালপত্র এবং ব্যাগেজে তল্লাশি চালানো হয়। রক্ষীরা যখন আমার সব কাপড় চোপড় খুলে দেহ তল্লাশি চালাতে চাইল তখন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে আমার নোটগুলো মোজা থেকে বের করে মেঝেতে বিছানো কার্পেটের তলায় চালান করে দিতে সক্ষঅম হই।

করাচিতে যে কয়েক ঘন্টা ছিলাম কেবলি ছটফট করছিলাম কখন পাকিস্তানের বাইরে যেতে পারব। অবশেষে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় ব্যাংককগামী একটি প্লেনের টিকিট পেতে সক্ষম হলাম। একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল আমার মন থেকে। সে রাতে আমার কাছে শ্যাম্পেনের স্বাদ এত মধুর মনে হল, যেমনটা কখনো হয়নি।

পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন
এইসব পরিস্থিতিতে ঢাকা ও তার চারপাশে অনবরত গোলাবর্ষণ পুর্বাঞ্চলের পাকিস্তানি বাহিনীকে পঙ্গু করে ফেলে। । ১৪ ডিসেম্বর পুর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভবনে গভর্ণর ডা. এ এম মালেকের সাথে লে. জেনারেল নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অন্যদের এক উচ্চ পর্যায়ের জরুরি বৈঠক চলাকালে ওই ভবনের উপর যৌথ বাহিনি বিমান থেকে রকেট-শেল নিক্ষেপ করা হয়। গভর্ণর তখন দ্রুত নিকটবর্তী একটি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন এবং একজন সাংবাদিকের হাত থেকে একটি কলম নিয়ে তড়িঘড়ি করে তাঁর পদত্যাগ পত্র লেখেন। তিনি এরপরই ইয়াহিয়া খানের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং রেডক্রস পতাকাবাহী গাড়িতে করে তাঁর কেবিনেট সদস্যদের নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (শেরাটন) আশ্রয় গ্রহন করেন।

১৫ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ মহাসচিবকে অবহিত করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শত্রুতা পরিহার করতে প্রস্তুত এবং যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে তিনি কিছু সময় প্রার্থনা করেন। সন্ধ্যার সময় অল ইন্ডিয়ান রেডিওতে লে. জে. নিয়াজীর উদ্দেশ্যে জেনারেল মানেকশ-এর একটি বার্তা প্রচারিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘যেহেতু আপনি যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে

২১৭

আপনার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন, আমি আশা করি আপনি বাংলাদেশে আপনার অধীন বাহিনীর প্রতি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির নিদ্দেশ জারি করবেন এবং আপনার অগ্রবর্তী বাহিনী যেখানে স্থান নির্ধারণ করবে সেখানেই তারা তাদের নিকট আত্মসমর্পন করবে।’ এর পাশাপাশি জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পঙ্কারী পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করেন। লে. জে. নিয়াজী জেনারেল মানেকশ কে এ বিষয়ে তার অনুকূল মনোভাব জানান। লে. জে. নিয়াজীর আহবানে সাড়া দিয়ে জেনারেল মানেকশ ঢাকা ও এর আশেপাশে ১৪ ডিসেম্বর বেলা ৫ টা থেকে ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৯ টা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বিমান হামলা স্থগিত রাখার নির্দেশ জারি করেন। মানেকশ নিয়াজীর পক্ষ থেকে পরবর্তী ঘোষণার অপেক্ষায় রইলেন। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৮ টায় লে. জেনারেল নিয়াজী জেনারেল মানেকশ এর উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরতি আরো ছয়ঘন্টা বৃদ্ধি করার এবং আত্মসমর্পনের বিষয়ে নিষ্পত্তি করতে সেনা প্রতিনিধিদের ঢাকায় পাঠানোর আহবান জানান। নিয়াজীর আহবান অনুযায়ী সময় বৃদ্ধি করা হয় এবং যৌথ বাহিনীকেও আক্রমন স্থগিত রাখার নির্দেশ জারি করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা নিয়াজী যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত নির্দেশ তাঁর সকল সংগঠন বরাবর পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কিছু ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন শহর ও নগরের যুদ্ধ অব্যাহত থাকে ঐদিন বিকেল পর্যন্ত। ১৬ ডিসেম্বরের এ সময়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামস্থ ভারতের পুর্বাঞ্চলীয় কমান্ডেড সেনাপ্রধান আত্মসমর্পন দলিলের খসড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিল থেকে প্রস্তুত করেন। এ দলিল নিয়ে ভারতের পুর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ১৬ ডিসেম্বর দুপুর একটায় হেলিকপ্টার নিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরন করেন।

এদিকে আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানের সংবাদ প্রচারিত হলে হাজার হাজার জনতা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দিকে একত্রিত হতে থাকে। ইতিমধ্যে ২, ৩ এবং ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ঢাকা প্রবেশ করে। এস ফোর্সের অধিনায়ক কর্ণেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২ ইস্ট বেঙ্গল ও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন পূর্ব্দিক থেকে ঢাকায় প্রবেশ করে।

আত্মসমর্পনের সার্বিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় জিওসি-ইন-সি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টার নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন এবং এয়ার মার্শাল দিউয়ান, ভাইস অযাডমিরাল কৃষ্ণ, লে. জেনারেল সগত সিং , বাংলাদেশ ফোর্সের চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, দুই নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এটিএম হায়দার এবং কাদের সিদ্দিকী, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অন্যান্য সিনিয়র অফিসার তাঁর সাথে উপস্থিত হন।

২১৮

অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বেলা ৪টা ৩১ মিনিটের সময় রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৯১৫৪৯ জন সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী আত্মসমর্পনের দলিল স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, ২ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং কাদের সিদ্দিকীসহ অন্যান্য সিনিয়র অফিসার তাঁর সাথে উপস্থিত হন। এতে প্রায় ১০ লক্ষ লোক অংশগ্রহন করেন। আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন সার্বভৌম জাতির জন্ম হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ লাভ করে।

পুলিশ সদর দপ্তর আক্রান্ত
একদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয়, অন্যদিকে আর এক কলাম সৈন্য পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগ আক্রমণ করে। ট্যাংক প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে সৈন্যরা ঢুকে ঘুমন্ত পুলিশের ব্যারাক মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এই হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায়নি তবে ধারনা করা হয়, ওই সময়ে সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।
এই অবস্থার মধ্যে অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত ১টার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করছিলেন এবনহ কয়েকজন কাছের লোক ও দেহরক্ষী বাদে অন্যদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটা ট্যাংক, ১টি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাকবোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে মুজিবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলেন, ‘শেখ আপনি বাইরে আসুন’। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে মুজিব বলেন, ‘হ্যাঁ আমি প্রস্তুত, এত গোলাগুলির দরকার ছিলনা, আমাকে ফোন করে দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম।’
অফিসারটি এবার বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, ‘আপনাকে গ্রেফতার করা হল’। ৩জন কাজের লোক, ১জন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ মুজিব কে নিয়ে গেল তারা।

সব দলিলপত্র নিয়ে যাওয়া হল।
শেখ মুজিবকে সেনা সদর দপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেকদল সৈন্য ঢোকে বাড়ির ভিতর। তারা বাড়িতে রক্ষিত দলিলপত্র নিয়ে যায়, চোখের সামনে যা পায় তা ই ভাংচুর করে, বাগানের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের লাল সবুজ হলুদ পতাকা গুলি করে নামিয়ে ফেলে।
রাত ২টা নাগাদ সারা ঢাকা পরিণত হল জ্বলন্ত নগরীতে। সৈন্যরা

২১৯

বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা দখল করে নিল এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের গুলি করে মারতে ও স্বাধীনতার পতাকার বদলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যদিও কোন কোন এলাকায় মাঝে মাঝে ভারী অস্ত্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল তবুও বোঝা যাচ্ছিল যে, যুদ্ধের তীব্রতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টোদিকে অবস্থিত খালি পড়ে থাকা ‘পিপল’ পত্রিকার অফিসে এক প্লাটুন সৈন্য ঢুকে সেটিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং সে অফিসের একমাত্র নৈশ প্রহরীকে গুলি করে হত্যা করে।

সকাল নাগাদ গোলাগুলি প্রায় থেমেই গেল। যত বেলা বাড়তে লাগল শহরজুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা জেঁকে বসল- যেন মৃত নগরী। থেমে থেমে কাকের ডাক আর সশব্দ গাড়ির অস্তিত্ব ছাড়া আর যেন কিছুই ছিলনা। তবে সবচেয়ে খারাপটা তখনো বাকি ছিল। মাঝদুপুর নাগাদ বিনানোটিশেই কয়েক কলাম সৈন্য ঢাকার পুরান অংশে হামলা চালায়। সঙ্কীর্ণ অলিগলিতে প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস সেখানে। পরবর্তী ১১ ঘন্টা ধরে পাক সেনারা এসব এলাকায় যেন বেশ গুছিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাল। মুজিবের সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল ওইসব এলাকা। ইংলিশ রোড, নয়াবাজার, ফ্রেঞ্চ রোড, সিটিবাজার এলাকায় হাজার হাজার লোকের বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়া হল। ফ্রেঞ্চ রোড-নয়া বাজার এলাকার এক বৃদ্ধের ভাষায়, ‘ওরা হঠাত যেন গলির মাথায় উদয় হত আর ওই গলির সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিত।
প্রথমে আসঅত একদল সৈন্য। তাদের অনুসরণ করতে করতে পেট্রোলের টিন হাতে আরেকদল। আগুণ লাগিয়ে দিত। যারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত তাদের গুলি করে মারা হত। আর যারা ভিতরেই থাকত তারা জীবন্ত দগ্ধ হত। ঐদিন বেলা ২টার মধ্যে পুরান ঢাকার ৭০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। আর একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অন্য আরো তিন এলাকায়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময়ে এক টার্গেট থেকে আরেক টার্গেটে হামলা চালায়। পুরান ঢাকায় তারা একটি থানাতেও হামলা চালায়। একটি বাজারের ধ্বংসস্তুপে দেখা হল এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার কনস্টেবল দের লাশ খুজে বেড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে ২৪০ জন ছিল, এ পর্যন্ত ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি- সবাই মৃত।’
পাক্সেনাদের এই অভিযানে সবচেয়ে বর হত্যাকান্ডটি ঘটানো হয় পুরান ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দাদের সৈন্যরা ঘর থেকে বের করে এনে দল বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তারপর জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। রাত ১১ টা পর্যন্ত সৈন্যরা পুরান ঢাকায় অবস্থান করে। সৈন্যরা ফ্লেয়ার ছুঁড়লে বাঙালি ইনফর্মাররা আওয়ামী লীগের শক্ত সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিত, তারপর সৈন্যরা ট্যাঙ্কের গোলায়, রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা স্রেফ পেট্রোল জ্বেলে আগুন ধরিয়ে ওইসব বাড়ি ধ্বংস করে দিত।

২২০

টঙ্গী এবং নারায়ঙ্গঞ্জ ছিল শেখ মুজিবের সমর্থক বাম্পন্থীদের ঘাঁটি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের পাঠানো হয় ঐসব এলাকায়। শহর এলাকায় রোববার সকাল পর্যন্ত গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। তবে বড় ধরনের অভিযান গুলো ২৬ তারিখ তারিখ রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সময় লাগে শুরু হবার পর থেকে ২৪ ঘন্টা।
সৈন্যদের শেষ টার্গেট গুলোর অন্যতম ছিল বাংলা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর অফিস। পাকসেনাদের হামলা শুরু হবার সময় সেখানে ৪০০ সৈন্য আশ্রয় নেয়। ২৬ মার্চ বিকেল ৪টা নাগাদ ৪টি ট্যাংক এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাক ভবন সংলগ্ন রাস্তায়। আর সাড়ে ৪টায় অঈ ভবনটি পরিণত হয় অগ্নিপিন্ডে। শনিবার সকালে ঐ বিল্ডিং এ কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। যত দ্রুত সৈন্যরা শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিল ঠিক ততটা দ্রুতই তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। শনিবার সকালে সকাল ৭ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেবার ঘোষণা দেওয়া হয়। রেডিওর ঘোষণায় সামরিক আইনের বিধানগুলো বারবার বলা হতে থাকে, রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাজার হাজার মানুষের পলায়ন
আসতে আসতে যেন ত্রাস কমে গেল আর ভোজবাজির মত নগরীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এল। বেলা ১০ টা নাগাদ রাস্তাগুলো ভরে উঠল পলায়নপর মানুষের ভিড়ে। যদিও এখানে সেখানে দেখা যাচ্ছিল কালো ধোঁইয়ার রেখা। কেউ গাড়িতে, কেউ রিক্সায়, কেউবা হেঁটে, সবার সঙ্গে লটবহর। ঢাকার মানুষ পালাচ্ছে হাজার হাজার। আর শোনা যাচ্ছিল কখনো কখনো করুন আর্তি- ‘দয়া করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান, আমি বৃদ্ধ, আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বাচ্চাটিকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান।’

সরকারি অফিসগুলো ফাঁকা
শত শত কর্মচারী পালিয়ে যাচ্ছে গ্রামের দিকে। আর যারা শহরেই রয়ে গেছে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব ধ্বংসস্তুপের মাঝে যা একসময় ছিল তাদের বাসস্থান। বোঝাই গাড়িগুলো ছুটছিল। হয় তাতে ছিল গ্রাম মুখী মানুষ অথবা রেডক্রসের পতাকা লাগিয়ে মৃতদেহ অথবা আহতদের বহন করছিল। আর সবকিছুর মাঝখানে মাঝে মাঝেই উদয় হচ্ছিল সৈন্যদের গাড়ি। বিরস বদনে জনতার দিকে বন্দুক তাক করে তাকাচ্ছিল ওরা। জানা গেছে শুক্রবার রাতে যখন তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তখন তারা ধ্বনি দিচ্ছিল নারায়ে তাকবির- যার অর্থ আমরা যুদ্ধে জিতেছি। আর শনিবারে তারা শ্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

২২১

বেশিরভাগ মানুষই পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করছিল। পেট্রোল ছাড়া ওইসময় পাকিস্তানি পতাকাই ছিল বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত পন্য। নিজেদের অনুপস্থিতিতে বাড়িঘর, সম্পদ রক্ষার জন্য তারা যা করছিল তা হল দরজায় তালা দেয়া আর ছাদে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো।
৪টা নাগাদ রাস্তা আবার ফাঁকা হয়ে পড়ল। রাস্তায় সৈন্যরা অবস্থান নিল। আর সারা শহরে যেন নেমে এল সুনসান নীরবতা। কিন্তু অল্প সময় পর গুলির শব্দ নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল। রেডিওতে ঘোষণা করা হল, কেউ ঘরের বাইরে এলেই গুলি করা হবে। কারফিউ পুনরায় আরপিত হওয়ার ২মিনিট পর রাস্তায় বের হবার অপরাধে ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে ছোট্ট একটি বালককে প্রহার করে জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা ক্লাবের একজন গার্ড ক্লাব ভবনের গেট লাগাতে এসে পাকসৈন্যদের গুলিতে মারা যায়। রেসকোর্সের মাঝখানের মন্দিরের আশেপাশের বাসিন্দা একদল হিন্দুকে গুলি করে মারা হয় এই অপরাধে যে তারা খোলা জায়গায় ঘোরাফেরা করছিল।
রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থানকারী সৈন্যরা ছাড়া পুরো রাস্তা ছিল ফাঁকা। একমাত্র ঐ সৈন্যরা ছাড়া আর কারো পক্ষেই বলা সম্ভব ছিলনা আসলে কী ঘটছে। সড়কপথের ভিড় এড়াতে গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য অনেকেই বেছে নিয়েছিল নদীপথ। নৌকার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করতে করতেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল কারফিউ। পরদিন সেখানে দেখা যায় চাপ চাপ রক্তের দাগ।

‘বিশ্বাসঘাতকরা’ অভিযুক্ত
ঢাকা অথবা প্রদেশের অন্য কোথাও সংগঠিত কোন প্রতিবাদের তেমন কোন খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি কোন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারও এধরনের কোন কথা উল্লেখ করেনি। একজন পাঞ্জাবি লেফটেন্যান্টের ভাষায়, ‘এই মানুষগুলো এমনকি চাইলেও আমাদের উপর পালটা আঘাত করতে পারবেনা।’ অন্য আরেক অফিসার বলেন, ‘অবস্থা এখন অনেক ভাল। কেউই একটা শব্দ উচারণ করতে বা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তারা বিশ্বাসঘাতক, আমরা তা নই। আমরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য আল্লাহর নামে লড়াই করছি।’
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পিত এবং পরিচালিত এই অভিযান বাংলার মানুষের সর্বশেষ প্রতিরোধের ক্ষমতা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। শুধু ভারতীয় সরকারের প্রচারযন্ত্র এবং ঢাকার বাইরের কোন এক স্থান থেকে পরিচালিত গোপন বামপ্নথীদের বাংলাদেশ রেডিও ছাড়া কোথাও চলমান যুদ্ধের কোন খবর পাওয়ার উপায় ছিলনা। এমনকি যে ভয়াবহ ক্ষতি পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বপ্নের অবসান ঘটানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সময়ের ব্যবধানে তা শুকিয়ে গেলেও গত সপ্তাহে চালানো রক্ত হিম করা হত্যাকান্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞের যে স্মৃতি তা প্রজন্মান্তরেও ভোলা সম্ভব হবেনা।

২২২

শেখ মুজিবের আন্দলনের ধ্বংসস্তুপ থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসে তা হল এই সত্যবোধ যে, সেনাবাহিনীকে কখনোই আর ছোট করে দেখা যাবেনা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যতই জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার কথা বলুন না কেন, তিনি কখনোই কোন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেননা তা সে বৈধ ভাবেই জেতা হোক বা না হোক।

পাকসেনাদের গণহত্যার গোপন বার্তা
২৫ মার্চের রাতে জল্লাদ টিক্কা খান বাঙালি জাতিকে চিরতরে খতম করার জন্য পাঞ্জাবি হায়েনাদের ছেড়ে দিয়েছিল ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর বুকের উপর। তারা এর সাংকেতিক নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। রাত ১টায় ট্যাংক, কামানসহ সর্বাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে যখন পাকিস্তানি হায়েনার দল গুলিতে, আগুনে, বারুদে ঝলসিয়ে, খাবলে, খুঁড়ে খাচ্ছিল, তখন পাকসেনাদের গোপন বেতারবার্তা সে রাতে ঢাকার অনেকে রেকর্ড করে রাখেন। সে বেতারবার্তা কোডে এ যুগের আইখম্যান লে. জে. টিক্কা খানের নাম ছিল ‘হায়েস্ট কন্ট্রোল’। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কন্ট্রোলরুমে বসে এই গণহত্যাযজ্ঞ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করছিলেন মেজর জেনারেল মিঠঠা, যিনি ছিলেন পাকিস্তান কমান্ডো বাহিনীর প্রধান।

বেতারে গোপন বার্তার অনুবাদ
কন্ট্রোল ডাক দেয়- “হ্যালো ৯৯ হ্যালো। তুমি বেতার চালু রাখ। নাহলে ইউনিট ২৬ এর অন্যদের কথা দুবার করে বলতে হবে। সেজন্য বলছি বেতার বন্ধ করবেনা। এখন বিশেষ কোন নতুন খবর নেই। রিজার্ভ লাইন (পুলিশ লাইন) দখল করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লড়াই চলছে। ওভার।” (বেতারবার্তা শেষ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক হত্যা ও ধ্বংসের ভার ছিল হানাদার পাঞ্জাবি সেনা ইউনিট ৮৮ এর উপর। ইউনিট ৭৭ কন্ট্রোল কে বলে “৮৮ জানাচ্ছে- তার কাজ ভালভাবেই চলছে। কিন্তু ঐ এলাকায় এত বেশি বাড়ি যে তার প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা করে ধ্বংস করতে হচ্ছে। এ যাবত তাদের (হানাদের পাক্সেনাদের) কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে তাদের দিকে (হানাদারদের দিকে) গুলি ছোড়া হচ্ছে। তাদের (ছাত্রদের) হাতে যা অস্ত্রসস্ত্র আছে সবই কাজে লাগাচ্ছে, ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)।
কন্ট্রোল- “৭৭ শুনছ? ৮৮ কে বল তার ‘বড় ভাই’ এখনই যাচ্ছে। আশা

২২৩

করি তাদের দিয়েই বাড়িগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে। অপরদিকে আমার মনে হয় ‘লিয়াকত’ ও ‘একবাল’ এখন শান্ত। আমার অনুমান কি ঠিক? ওভার (বেতারবার্তা শেষ)

৭৭- “চূড়ান্ত খবর পাইনি। তবে ঐ দুটি সম্পর্কে ৮৮ বেশ উতফুল্ল। ওভার। (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “বাহ, বেশ। এখন ছোকরাদের রাস্তাইয় রাস্তায় কারফিউর কথা ঘোষণা করতে বলো। এটা পয়লা নম্বর। দোসরা নম্বর ‘জয়বাংলা পতাকা’ সবখান থেকে নামাতে হবে। যদি কোন বাড়িতে ঐ পতাকা উড়তে দেখা যায়, বাড়ির মালিককে তার জন্য শাস্তি দিতে হবে। কোথাও কোন ‘কালো পতাকা’ থাকবে না। শহরের কোথাও কোন কালো পতাকা দেখামাত্র তার পরিণতি হবে সাংঘাতিক, ভয়াবহ। সকলকে বলে দাও, সকলকে বুঝিয়ে দাও, ওভার (বেতারবার্তা শেষ)।
৭৭- “তোমারকথা শুনলাম। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)।
কন্ট্রোল- “পথের বাধা বিপত্তি সম্পর্কেও বলার আছে। কোথাও ব্যারিকেড তৈরি করতে দেখা গেলে সেখানেই গুলি করে উড়িয়ে দাও। যে এলাকায় ব্যারিকেড হবে সেখানকার অধিবাসীদের দায়ী করা হবে, সে কাজের জন্য তাদেরই শাস্তি দিতে হবে এবং সড়কের দুই পাশে, পুনরায় বলছি সড়কের দুই পাশে যত বাড়ি আছে গুঁড়া করে দাও। সকলকে এ কথা ভাল করে বুঝিয়ে দাও। সারারাত এবং সারাদিন এ ঘোষণা প্রচার কর। ওভার (বেতারবার্তা শেষ)।
৮৮ ইউনিটকে সাহায্য করার জন্য ইকবাল (জহুরুল হক হল) হলের পশ্চিমে রেল লাইনের (এখন নেই) কাছে ৪১ ইউনিট ছিল। কন্ট্রোল থেকে ইউনিট ৪১ কে বলল- “পথে বাধা সৃষ্টি করা মারাত্মক অপরাধযেখানে বাধা ব্যারিকেড দেওয়া হবে তার দুইপাশের সব ঘরবাড়ির লোকদের গুলি করে হত্যা করা হবে। একথা সকলকে পরিস্কারভাবে বলে দাও। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ) ।
৮৮- “ইমাম বলছি। আপনার নির্দেশ দিন। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)।
কন্ট্রোল- “এখুনি জয়বাংলা পতাকা ও কালো পতাকা নামাতে সকল স্থানে হুকুম দাও। এটা না করা হলে তাদের সকলকে গুলি কর। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)।
ইমাম- “হুকুমমতো করছি। ওভার’ (বেতারবার্তা শেষ)।
কন্ট্রোল- “কোন অতিরিক্ত সাহায্য দরকার হলে চাইবে। ‘বক্স্র’রা নির্দেশমতো যাচ্ছে। সকালেই তারা পথের সব বাধা ভাঙতে ও অপ্সারণ করা শুরু করে দেবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)।
৮৮- “ধন্যবাদ। আর কিছু নেই। সব পরিকল্পনা মতো চলছে। ওভার’ (বেতারবার্তা শেষ)।
কন্ট্রোল- “বেশ, তুমি এবার সরে পর। হযালো ৪১, হ্যালো তুমি শুনতে

২২৪

পাচ্ছ? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৪১- “সব শুনতে পাচ্ছি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “রেললাইনের পশ্চিমে ফাঁকা সড়কের উপর সেনা-পাহারা বসিয়েছ তো? ইউনিট ২৬ এবং ৮৮ কে যারা বাধা দিচ্ছে তারা যেন ওপথ দিয়ে পালাতে না পারে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৪১- “সেখানে আমরা ঘন ঘন টহল দিচ্ছি। প্রতিটি মিনিটে দিচ্ছি। সকলে কড়া নজর রাখছি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “উত্তম, আমি নিশ্চিত যে তুমি সব ঠান্ডা করতে পারবে। ২৬ এর লোকেরা ‘ডেইলি পিপলে’র বন্ধুদের অনুসন্ধান করছে। এবার সরে এস। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- ৮৮ এর কাছে জানতে চায় “হায়েস্ট কন্ট্রোল জানতে চায় যে, জগন্নাথ, লিয়াকত ও একবালে কি রকম প্রতিরোধ পেয়েছ? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “প্রথমদিকে জগন্নাথ এবং একবাল থেকে প্রচুর গোলাগুলি এসেছে । ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “তারপর কি হয়েছে? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “আমরা ‘রোমিও রোমিও’ চালু করতেই সব খতম। এখন একবালে যাচ্ছি। সেখান থেকে উত্তম খবর দেব। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “দুশমনরা অটোমেটিক অথবা গ্রেনেড ব্যবহার করছে কিনা জানাবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- দুশমনরা (ছাত্ররা) প্রচুর থ্রি নট থ্রি চালিয়েছে। অটোমেটিক বা অন্য কোন শব্দ পাইনি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে মোতায়েন ইউনিট ২৬ এর কাজ ছিল পুলিশ লাইনে গণহত্যা চালানো, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর সামনে (বর্তমান শেরাটন) ইংরেজি দৈনিক ‘দি পিপল’ ধ্বংস করা এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখল করা।
৯৯- “২৬ কে প্রশ্ন কর- তার খবর কি, দেয়া কাজ শেষ নাকি? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
২৬- “দু হাজার দখল করা হয়েছে। রমনা থানা, কমলাপুর রেল স্টেশন দখল করা হয়েছে। টেলিভিশন ও বেতারকেন্দ্র আমাদের নিয়ন্ত্রণ্র। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “এখান থেকে পুরানা পল্টন এলাকায় আগুন দেখতে পাচ্ছি। আগুনের শিখা হু হু করে উঠছে। হেড অফিস জ্বলছে, না আর কিছু? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
২৬- “এলাকা ‘দু হাজার’ জ্বলছে। আবার বলছি, এলাকা ‘দু হাজার’

২২৫

জ্বলছে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “‘পিপলস ডেইলি’র কি অবস্থা? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
২৬- গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে । আবার বলছি, গুঁড়ো। আমাদের দুজন গুরুতর জখম হয়েছে, তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আঘাত পেয়েছে আরো দুজন, তবে সামান্যই। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে বলা কঠিন। কোথাও কোথাও এখনও আগুণ জ্বলছে। বাকিসব ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এখন তাই এ বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা যায়না। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- পুলিশ লাইনও ধ্বংস করেছ? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
২৬- “এখনই তো বললাম। সেখানে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “বেশ বেশ। এখন সরে এস। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
(এরপর ইউনিট ৫৫ এর কাছ থেকে সিগন্যাল এলো। এই ইউনিটেরও কাজ ছিল সবকিছু লন্ডভন্ড ও ধ্বংস করে ফেলা।)

৫৫- “পথের উপর কিছু ব্যারিকেড রয়েছে, অন্যদের সাহায্যে তা অপসারণ করছি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “উত্তম। ২৬ তোমাদের চায়। ৮৮ এর কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তুমি এখন কোথায়? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৫৫- “খামারবাড়ির দরজার সামনে। এখানকার ব্যারিকেড সব ডিনামাইট বা অন্য কিছুর সাহায্যে ভাঙছি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “তোমাদের ঠেকাবার মত ক্ষমতা হারামজাদাদের (বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষকদের) বুকে নেই। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৫৫- “চারিদিকে আমরা হিংস্র চিতা ছেড়ে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত তারা কেউ সে ঔদ্ধত্য দেখায়নি। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “তোমাদের সাথে বুলডোজার এবং অন্য আগ্নেয়াস্ত্র আছে তো? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৫৫- “আছে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “চমৎকার খেলছ। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
এ পর্যায়ে ৯৯, ২৬ কে বলে “ডেইলী পিপল অফিস থেকে কাউকে ধরতে পেরেছ? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
২৬- “না, আমার সেপাইরা আরো কয়েকজন প্রিয়জনের বাড়ি গেছে। দেখি তারা কি সংবাদ আনে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “আলফা লিমা অফিস দখল করা হয়েছে কিনা? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)

২২৬

২৬- “না সে কাজ প্রত্যুষে করা হবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “বেশ, পরিকল্পনামত এগিয়ে যাও। ছোটখাট যা হবে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
এ পর্যায়ে ৭৭, ২৬ এর উদ্দেশ্যে বলে ‘মারখোরকে জানিয়ে দাও যে, সূর্যোদয়ের পূর্বেই যেন সব মৃতদেহ গুম করে ফেলা হয়। এটা ইমামের হুকুম। ঠিকমতো সবাইকে জানিয়ে দাও। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল ৮৮ কে একই নিদ্দেশ দেয়- “সব লাশ উধাও করে দেবার নিখুঁত ব্যবস্থা কর। কার চোখে না পড়ে যেন। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
এবার বাক্য বিনিময় হয় কন্ট্রোল ও ৯৯ এর মধ্যে- “রাত একটার পর প্রায় আধঘন্টা তোমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিলোনা। টেলিফোন ঘর আর এই ঘরের মধ্যে ইঁদুর মারতে হয়েছে। তখন যা হয়েছিল জানাও। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “বলছি। বেলালের ছোকরারা ‘ধাড়ি পাখিকে’ খাঁচায় বন্দি করেছে। একে একে দখল করা হয়েছে রমনা থানা, কমলাপুর রেল স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ‘ডেইলি পিপল’। এখন অপারেশন চলছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ধানমন্ডিতে। সেখানে প্রিয় কয়েকজনের (তাদুশীল প্রমুখ) সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোলের উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা- “কাদের পাওয়া যাচ্ছেনা? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “তাইজুদ্দীন এবং ভুয়া বাড়িতে নেই। ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটেও মালামাল (অস্ত্রসস্ত্র) নেই অন্যদের খবর কি? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “৪১ কয়েকজন হাতের মুঠোয় বটে, তবে আসল মালেরা আগেই কেটে পড়েছে, সম্ভবত কালকেই। ৪১ অবশ্য সমস্ত এলাকা বেড়াজাল দিয়ে ঘিরেছে যাতে আর কেউ পালাতে না পারে। আশা করি তোমার অতিথিদের (বন্দি) নিয়ে তুমি খুব আনন্দেই আছ। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৯৯- “ভাবছি ওদের কিছু খাবার দেওয়া যায় কিভাবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “সে ভাবনা কেন? এখন ওসব ভাবার দরকার নেই। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
রক্তে ভেসে যাওয়া ঢাকার বুকে ২৫ মার্চের রাতের শেষে ২৬ মার্চের প্রভাত হচ্ছে। কন্ট্রোল তখন সকল ইউনিট কে বলল, “এখন কোথাও জয়বাংলা পতাকা বা কালো পতাকা যদি চোখে পড়ে সে এলাকার লোকদের ভালমত ওষুধ বেটে দাও। ধানমন্ডির প্রত্যেক বাড়ির প্রত্যেক ইট উলটে তল্লাশি চালাও। যাকে খুশি বন্দি কর, খতম কর, ইচ্ছামত চালিয়ে যাও। সব শেষ করে দাও। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)

২২৭

কন্ট্রোল ২৭ মার্চের প্রভাতে ডাকল ৮৮ কে “তোমার কাজকখন শেষ হবে? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “এখন সকাল পৌনে সাতটা। আতটার মধ্যে এখানকার কাজ খতম করব। লাশগুলো জড়ো করে উধাও করার জন্য ঘন্টাখানেক লাগবে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “তুমি শুধু লাশগুলো জড়ো কর। এই ফাঁকে ২৬ কে বলো বাকি ব্যবস্থা করতে। যত তাড়াতাড়ি পারো তোমরা পরবর্তী জায়গা জিঞ্জিরার দিকে এগিয়ে যাও। ক্যাম্পাস এলাকায় দুশমনের আর কেউ কি গুলি ছুড়ছে? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “না। সব খতম। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “হ্যালো ১৬ হ্যালো, তোমার খবর কি? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
১৬- “লাশ গোনা চলছে। আশেপাশে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিনা। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “ঠিক আছে। যা ভাল সেইমত কর। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল ৮৮ কে আবার ডাকে “৮৮, তোমার আরো দ্বায়িত্ব ছিল সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন দখল করা। সেটা হয়েছে? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “হ্যাঁ, দখল করা হয়েছে। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “তবে উত্তম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিকার কত? যা দেখছ তাতে কত আন্দাজ হয়? কত খতম, আহত বা বন্দি? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “মনে হয় শ-তিনেক। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “সর্বোত্তম। তিনশ খতম? না বন্দি? না জখম? ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
৮৮- “আরে না না একেবারে সাফ। খেল খতম। ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
কন্ট্রোল- “উত্তম, উফ, অতি উত্তম! সেটাই সর্বোত্তম সহজ কাজ। চালিয়ে যাও, যথেচ্ছা চালিয়ে যাও! তোমার কাছে কোন কৈফিয়ত চাইবার কেউ নেই। কেউ চাইবেও না। পুনরায় বলছি, যা দেখাচ্ছ জবাব নেই। আবার বলছি- সাবাশ, বড় খোশ-খবর শোনালে হে! ওভার” (বেতারবার্তা শেষ)
গোপন বার্তা বিনিময়ে যে ‘কোড’ নাম ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো ছিল নিম্নরূপঃ

২২৮

কোডনাম আসল পরিচয়
হায়েস্ট কন্ট্রোল জল্লাদ টিক্কা খানের অফিস, (বর্তমান বঙ্গভবন)
চিতা ট্যাংক
বড়ভাই গোলন্দাজ বাহিনী
লিয়াকত জিন্নাহ হল (বর্তমান সূর্যসেন হল)
একবাল ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল)
জগন্নাথ জগন্নাথ হল
ইমাম কমান্ডিং অফিসার
বক্সার বুলডোজার
ডেইলি পিপল দি পিপল
বন্ধু সন্দেহভাজন ব্যক্তি
রোমিও রোমিও রিকোয়েললেস রাইফেল
দু হাজার পুলিশ লাইন
হেড অফিস আওয়ামী লীগ দপ্তর
আলফা লিমা আওয়ামী লীগ
মারখোর অ্যাডজুট্যান্ট
বেলালের ছোকরা কমান্ডো বাহিনী
ধাড়িপাখি শেখ মুজিবুর রহমান

উল্লেখ্য যে, ‘বেলালের ছোকরারা’ সংকেতে যে মেজর বেলাল ও তার কমান্ডো গ্রুপের কথা বলা হয়েছে তারাই ৩২ নং ধানমন্ডির বাসা থেকে ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার করার দ্বায়িত্বে ছিল। সে দ্বায়িত্ব পালনকালে মেজর বেলালের নির্দেশে পাকিস্তানি কমান্ডোরা বাঙালি জাতির জনকের পিঠে ও ঘাড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করেছিল। তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ব্যথায় চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমার সঙ্গে তোমরা দুর্ব্যবহার করছ কেন?” তবু তারা তাঁকে ছাড়েনি, অমানুষিক নির্যাতন করতে করতে ৩২ নং ধানমন্ডির বাসা থেকে তাঁকে বের করে নিয়ে যায়। আর তার ৪ বছর পর সেই ৩২ নং বাসায় পাকিস্তানি সেনাদের ভাড়াটে সেনারা তাঁকে সপরিবারে নির্মনভাবে গুলি করে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় ভাড়াটেরা তঁকে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত দেয়নি। সিমার যেমন কারবালার তীরে হযরত ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারকে মৃত্যুর সময় এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত দেয়নি। ২৫ মার্চের রাতে যে পাক কমান্ডো মেজর বেলাল বঙ্গবন্ধুকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিল তার করুন মৃত্য হয়েছিল সেই একাত্তরেই। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তাড়া খেয়ে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে ঢাকা আসার পথে মেঘনা নদী তাকে ডুবিয়ে মেরেছিল, যে মেঘনার নাম ধরে বঙ্গবন্ধু এ জাতিকে শিখিয়েছিলেন “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”।সে নদীর শত সহস্র বছরের স্বপ্নে লালিত মহামানব কে যে শয়তান আঘাত করেছিল, নদী মেঘনা তার প্রতিশোধ নিয়েছিল।

২২৯
পাকিস্তান, পাকিস্তান
ধ্বংস হউক, ধ্বংস হউক
মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দুইশত বছরের ইংরেজ শোষণের বেড়াজালে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান। মনে করা হয়েছিল এরই মাধ্যমে হয়ত শোষণের অবসান ঘটবে। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটল। বর্বর পাকিস্তানিরা বাঙাকিদের প্রতি শোষণের স্টিম রোলার চালাতে থাকল। বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠল। তারা অনুভব করল এখন তাদের জন্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রয়োজন। এরই পথ বেয়ে এল মুক্তিযুদ্ধতখন এই শ্লোগান হয়ে উঠল বাঙালির প্রাণের দাবী। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শ্লোগানটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।

পাকিস্তানস ম্যান মেড ডিজেস্টার ইন ইস্ট বেঙ্গল
৫০ X ৪৬ সেন্টিমিটার মাপের এই পোস্টারটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এই পোস্টারটি মূলত গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য যে সাহায্য দেওয়া হয় তারই প্রতিবাদস্বরূপ প্রকাশিত হয়। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তান নিরীহ বাঙালি নিধন, নারী নির্যাতন, নানারূপ নির্মন অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকলে বিশ্ববিবেক এর প্রতিবাদ করে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে তার সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখে। এই পোস্টারে তারই প্রতিবাদ করা হয়।
* 75 Million Bangladeshi have seen their elected representatives Killed, Imprisoned or driven in exile.
*Massacres of unarmed civilians by West Pakistans army have forced 6 million to flee to India.
* The population is helpless in the face of speeding starvation and disease.
* The U.S. is continuing military aid to Pakistan.

এই পোস্টারটিতে সবুজ জমিনে লাল সূর্য ও সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। পোস্টারটিতে কালো, লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। কালো রঙ গণহত্যা, শান্তির জন্য সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও সংহতি কমিটি
দ্র. শান্তি কমিটি

২৩০

বাংলাদেশ থেকে অবিরল স্রোতের মত আগত তরুন যুবকদের সামগ্রিকভাবে রণক্ষেত্রের উপযোগী করে প্রস্তুত করাই ছিল যুবশিবিরের প্রধান পরিকল্পনা ও কাজ। যুব শিবিরের ধ্যান ধারণা ডা.হাবিবুর রহমান (ওরফে আবু ইউসুফ) সর্বপ্রথমে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করেছিলেন। সরকার এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে যুব শিবির প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সমগ্র বাংলাদেশের যুবকদের নিয়ে যুবশিবিরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যুবশিবিরের কর্মকান্ড সুসমন্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। এসব ব্যবস্থা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার মুখে সীমান্ত অঞ্চলের যেসব স্থান দিয়ে সকল পর্যায়ের জনগণ, বিশেষত যুব-কিশোর সম্প্রদায় সীমান্ত অতিক্রম করত, সেই সকল স্থানেই অধিকাংশ যুবশিবির স্থাপিত হয়। এসব শিবির অভ্যর্থনা শিবির হিসেবেও গণ্য হত। কারন সীমান্ত পার হয়েই সকলে তাদের নাম লেখাত এসব শিবিরে। অভর্থনা-শিবির প্রকৃত অর্থে উদ্বাস্তুদের মাঝখানের একটি স্থান হিসেবে পরিগণিত হত। সীমান্ত এলাকায় অথবা মুজিবনগরের বিভিন্ন স্থানে দ্বায়িত্ব পালনের জন্য যেতে হলে এসব অভর্থনা শিবিরের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে তা করতে হত। প্রথম দিকে যুব-শিবিরের ব্যবস্থাপনা সঙ্গত কারণে অগোছানো ছিল এবং যুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহী তরুনগণ খুবই ভেঙে পড়েছিল। এমনকি, অনেকেই তাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করতে পারছেনা বলে প্রকাশ্যেই অশ্রু বিসর্জন করত। তাদের আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি এই বলে যে, পাকিস্তান বাহিনী তাদের স্বজনকে হতযা করে চলেছে নির্বিবাদে, আর তারা ঐ জানোয়ারদের নৃশংসতার জবাব দিতে পারছেনা। তারা বলত, ‘আমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই আমাদের অস্ত্র দিন।’ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় শিবিরগুলোর কর্মপরিধি বেশ সীমিত ছিল। এই সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুবশিবিরের কাজ কিন্তু কখনোই থেমে থাকেনি। কোন না কোন ভাবে যুবশিবিরের তরুনদের সচল রাখা হয়েছিল। প্রধানত যেসব যুবশিবিরে প্রাথমিকভাবে কাজকর্ম চালু রাখা হয় সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ
ক. হরিণা শিবিরঃ এখানে ১০০০ জন তরুনকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা ছিল। এই শিবির ঠিক সীমান্ত বরাবর ছিলনা, সীমান্ত থেকে কিছুদূরে ছিল এর অবস্থান। যুবশিবিরের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর মেহতাকে শিবিরে অবস্থানরত তরুনদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমি একসময় অনুরোধ করি। কিন্তু স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এই শিবিরের প্রধান ছিলেন।
খ. ছোটখোলা শিবির (একিনপুর সংলগ্ন)ঃ এই শিবির সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় আরো অভ্যন্তরে সরানোর কথা ভাবা হয়। এই শিবিরে ৪০০ জন তরুনকে

২৩১

প্রশিক্ষণ দেবার সংস্থান ছিল। এই শিবিরের প্রধান মি. খাজা আহমেদ এমএনএ।
গ. রাজানগর যুবশিবিরঃ অধ্যাপক এ হানিফ এমএনএ ছিলেন এর প্রধান। এই শিবিরে ১০০০ জন তরুনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে এই শিবিরের কাজকর্ম পরিচালিত হয়।
ঘ. সোনামুড়া যুবশিবিরঃ সোনামুড়া এলাকায় ৪ টি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে,
১. কাঠালিয়া ২. হাতিমারা ৩. বক্সনগর ৪. মেলাঘর।
মি. জালাজ আহমেদ এমপিএ; এমএ রশীদ এমপিএ; অধ্যাপক এ রৌফ প্রমুখ যথাক্রমে কাঁঠালিয়া, হাতিমারা ও বক্সনগরের শিবিরগুলোর প্রধান ছিলেন। মেঘালয় যুবশিবির সেক্টর-২ এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রথমদিকে এই শিবিরের কোন প্রধান ছিলেন না।
ঙ. উদয়পুর যুবশিবিরঃ স্থানীয় অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. ব্যানার্জির সহযোগিতায় এই শিবিরের কাজকর্ম খুব ই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ক্যাপ্টেন এম আলী এমএনএ এই শিবিরের প্রধান ছিলেন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শিবির স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।
চ. মোহনপুর যুবশিবির; এই শিবিরের প্রধান ছিলেন মি. শরীফুদ্দীন আহমেদ এমপিএ। প্রাথমিক সমস্যা সমাধানে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।
ছ. সিলেট যুবশিবিরঃ সিলেট সেক্টরে ঐসময় তিনটি অভর্থনা শিবির সক্রিয় ছিল। এগুলো পরিচিত ছিলঃ ১. পাথরকান্দি ২. খোয়াই ৩. কৈলাশহর শিবির নামে। এসব শিবিরে যথাক্রমে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মি. আব্দুল মোমেন, মি.মুস্তফা শহীদ এমপিএ, মি. মানিক চৌধুরী এমএনএ শিবির প্রধান হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
উপরোল্লিখিত শিবির ছাড়াও আরো কিছু স্থানে শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। মি তৈমুজ আলীর নেতৃত্বে এসপিএ-এর নেতৃত্বেধর্ম্নগর; মি. দেওয়ান আব্দুল আব্বাস এমএনএ এর নেতৃত্বে নাসিরনগর; মি. গাজী ফজলুর রহমান এমপিএ এর নেতৃত্বে বেলতলি নামক স্থানে এবং আগরতলার কংগ্রেস ভবনে অভ্যর্থনা- শিবির। একইসঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে আগত তরুনদের পাঠানোর কেন্দ্র (transit camp) গড়ে তোলা হয়।
ভয়ানক সংকট্ময় পরিবেশ ও আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে যুবশিবিরের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল শুধু দেশপ্রেমের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমের মনোভাব প্রতিটি বাঙালি তথা শরণার্থীকে আপ্লুত করে রেখেছিল। দেশপ্রেমের মন্ত্রে আবিষ্ট তরুনেরাএসব যুদ্ধশিবিরের কর্মে প্রাণসঞ্চার করে রেখেছিল। কন বাধা, অসুবিধা যুব শিবিরকে কখনো হীনবল করেনি।

২৩২

প্রথমদিকে কিছু অসুবিধা থাকলেও তা দূর হতে বেশি সময় লাগেনি।
আবু ইউসুফ সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যবহার যাই হোক তিনি সত্যি সত্যিইওত্যন্ত মেধাবী এবং সুচিন্তার মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অসীম। আমি বলব যুদ্ধশিবির (Youth Camp) ধারণাটাই তাঁর চিন্তা থেকে এসেছিল। আগরতলায় জহুর আহমেদ চৌধুরী যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে অন্যদের সাথে এক কামরায় বাস করতেনার সারাদিন লিখতেন। একদিন তিনি তাঁর পরিকল্পনাটি একটি সুন্দর লেখা এবং ছকের মাধ্যমে পেশ করলেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকে যে অগণিত ছাত্র জনতা যুব সম্প্রদায় ভারতে প্রবেশ করেছিল তাদের শরণার্থী শিবিরে না পাঠিয়ে ভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় প্রদান এবং তারপর বাছাই করে প্রথমে সাধারণ প্রশিক্ষণ ও শৃংখলার মধ্যে আনয়ন এবং পরে উন্নততর অস্ত্র প্রশিক্ষণ (শ্রেনীবিন্যাস করে) দিয়ে যুদ্ধে প্রেরণ- এই ছিল মূল চিন্তাধারা। সবাই এই পরিকল্পনা লুফে নেন। অতি শীগগিরই কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সংগঠন হিসেবে যুব শিবির (Youth Camp Organization) আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের অবদান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে এর চেয়ারম্যান এবং উইং কমান্ডার মির্জাকে করা হয় মুখ্য পরিচালক। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজাকে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। পূর্বাঞ্চলের যুবশিবির সমূহের প্রধান ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম এমএনএ। যুবশিবিরগুলো যে এভাবে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে মাহবুব আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুর গং তা ভাবতেও পারেন নি সেসময়।
মে-জুন-জুলাই এই তিনমাস এইচ টি ইমাম আগরতলা অফিসের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিশেষ দ্বায়িত্বে কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ, আকবর আলী খান এবং এবং ড. এম এ হাসান (শ্রীমঙ্গল চা গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর)। এছাড়া এ অফিসের প্রশাসনিক অফিসার ছিলেন লতিফ খান (কুমিল্লার) । তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এবং কর্মঠ। পরে বাংলাদেশে ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (TCB) অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ঐ সময় খন্দকার মোশতাক বানিজ্যমন্ত্রি। অ্যাকাউন্টস এবং ক্যাশ দেখাশোনার দ্বায়িত্বে ছিলেন বজলুর রহমান। (এম আর সিদ্দিকী কর্তৃক নিয়োজিত)। এই তিনটি মাস ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে মুক্তিকামী ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, যুবক, শিক্ষক, পেশাজীবী, আবাল্বৃদ্ধবনিতা তখন স্রোতের মত ভারতে চলে আসছিলেন। উত্তর-দক্ষণবঙ্গ থেকে যাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। আর প্রায় ৩০ লক্ষের মত গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। এদের জন্য আশ্রয় শিবিরের ব্যবস্থা, খাদ্য সংগ্রহ ছিল এক বিশাল ব্যাপার। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রচন্ড যুদ্ধ পরিচালনা এবং সেই যুদ্ধের চাহিদা মেটানো। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কে এম শফিউল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী এঁরা সবাই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় চতুর্দিকে অবস্থানরত

২৩৩

পাকবাহিনীর সঙ্গে ঘোরতার যুদ্ধ করতে হচ্ছিল । ওপারে সিলেট সীমান্ত, মাঝখানে কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া তার নিচে নোয়াখালী-ফেনী, দক্ষিণে রামগড়-পার্বত্য চট্রগ্রাম । বাংলাদেশ বাহিনীর নিত্যপ্র্যইয়োজনীয় খবরাখবর ইত্যাদি । আরো প্রইয়োজন ছিল ফিল্ড-হাসপাতাল, সীমান্তের অদূরে চিকিৎসাব্যবস্থা, অ্যামবুলেন্স, পরিবহন, ওয়্যারলেস, পোশাক, তাঁবু এবং আরো কত কী । ভারতীয় মিত্রবাহিনী পেছন থেকে বড় রকম সর্মথন দিচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাও রাখতে হচ্ছিল । মুক্তিবাহিনী গতানুগতিক যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বাধা দেয়ার সাথে নতুন নতুন রণকৌশলে পাকিস্তান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছিল । গেরিলা কায়দায় ওঁত পাতা (Ambush), পেছন থেকে অতর্কিত আক্রমন, শত্রুর যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা ইত্যাদি নানাবিধভাবে পাকিস্তানিদের হয়রান করা হচ্ছিল । এসব কারণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সক্ষম, সাহসী, সেশপ্রেমিক মানুষ । এক কথায় জনবল সংগ্রহ । জনবলের কোনো অভাব ছিল না । বিশেষ করে যুব সম্প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাচ্ছিলেন মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্য । আমাদের সমস্যা ছিল বাছাই করা । বিভিন্ন পয়েন্ট এবং শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছাসেবক অ্যগ্রহ যুবকদের আনতে হতো বিশেষ ক্যাম্পে । সেখানে হতো প্রাথমিক বাছাই এবং তারপর মৌলিক প্রশিক্ষণ । এই ক্যাম্পগুলোকে বলা হতো মৌলিক শিবির ( Basic Camp )- এখানে এদের মনোবল চাঙা করতে বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো । এখান থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে যেতেন সেক্টর কমান্ডাররা । তাঁর কোনো গ্রুপকে অস্ত্র এবং সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং দিয়ে পাঠাতেন নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি বা তাদের সাথে থেকে এসব গ্রুপ যুদ্ধ করতেন; কোনো দলকে শত্রুদের অবস্থান ও অন্যান্য খবরাখবর নিতে দেশের মধ্যে পাঠাতেন, আবার কোনো গ্রুপকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে পাঠাতেন হানা দিতে ( Aemolition ) দেশের অভ্যন্তরে । ঢাকা এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় যে সমস্ত স্কোয়াড পাঠানো হতো ছোট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড এবং নিশ্চিহ্নকরণ ( Demolition ) সরঞ্জাম দিয়ে তাদের অধিকাংশই ছিল খালেদ মোশাররফ এবং সফিঊল্লাহর সেক্টরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত । অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান, অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনা এবং গেরিলাযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী যারা, শুধু তাদেরই পাঠানো হতো দেশের অভ্যন্তরে এবং অভ্যন্ত গভীর অঞ্চলে । এদের পাশাপাশি ভারতীয় বাহিনীও যুবশিবির থেকে বাছাই করে নিয়ে গেরিলাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত । রাজনৈতিক ভাবধারায় বিশেষভাবে উদ্ধুদ্ধ এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে পৃথক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল,যার নাম ছিল মুজিববাহিনী। এদের সংগঠক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি,সিরাজুল আলম খান ,তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর কুদ্দস মাখন,শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ প্রখ্যাত এবং বিপ্লবী

২৩৪

ছাত্রনেতা । মুজিববাহিনীর সাথে অনেক সময় নিয়মিত বাহিনীর সংযোগ এবং সমন্বয় থাকত না । এটি নিয়ে কর্নেল ওসমানীর অনেক অভিযোগ ছিল । [৩২] এইচ টি ইমাম প্রতিনিধি আহমেদ ফরিদউদ্দিনের সম্পাদনায় ‘প্রতিনিধি’ সপ্তাহিকীটি বাংলাদেশের কোনো এক জায়গা হতে প্রকাশিত হতো । পত্রিকার ‘সাপ্তাহিক প্রতিনিধি’ নামের নিচে ‘স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র’ কথাগুলো লেখা হতো । পত্রিকাটি সম্পাদক কর্তৃক রক্তলেখা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত । প্রথম প্রকাশ জানা যায়নি ৩য় সংখ্যার প্রকাশ দেখা যায় ইংরেজিতে ১৫ অক্ট্রোবর, শুক্রবার, ১৯৭১ এবং বাংলায় ২৮ আশ্বীন, ১৩৭৮ । এই সংখ্যার সম্পাদাকীয় ‘নাটকের প্রথম অংক’ ‘ঝড়ো হাওয়ার পৃর্বাভাষ’ এবং প্রথম পাতার সংবাদ শিরোনাম ‘ইয়াহিয়া খান আমার দলে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা করছেন-ভুট্রো’, স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান হতে পারে না-অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল’, ‘লাহোরে গোপন নথিপত্র ঊধাও, প্রত্যেকটি বিমানবন্দরে কড়া পাহারা ও ব্যাপক তল্লাশির ব্যবস্থ’, ‘পাকিস্তানকে সাহায্য বদ্ধ করার জন্য লেবার পার্টির প্রস্তাব’, ‘বিশ্ব বিবেক’, ‘মোনায়েম খান খতম’ ছিল । চার কলামের এই পত্রিকার মুল্য জানা যায়নি । [ ১৫৫, ৪৫৯ ] হাসিনা আহমেদ ফকির শাহা বুদ্দীন ( ১৯২৪-১৯৮৯ ) একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী । জন্মগ্রহণ করেন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার ঘাগুটিয়া গ্রামে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ( অর্নাস ), এমএ এবং এলএলবি পাস করার পর আইন ব্যবসায় যোগ দেন । একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন । ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপৃর্ন ভূমিকা পালন করেন । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনে তাঁর বিরাট অবদান ছিল । তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর ও মাল্যেশিয়া সফর ক্রেন। জাতিসংঘে প্রেরিত মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি দলের তিনি সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন । স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে তিনি ঊল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন । স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় অ্যাট্রর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন । ২৮ নভেম্বর ১৯৮৯ ঢাকায় মৃত্যুবরন করেন [৭৩] মোহাম্মদ সেলিম

২৩৫

ফণিভূষণ মজুমদার (১৯০১-১৯৮১) একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ । তিনি মাদারীপুর জেলার সেনদিয়া গ্রামে ১৯০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন । কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ ও রিপন কলেজ থেকে ল পাস করেন । ইংরেজ শাসনামলে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় নানা সময় জেলে আটক ছিলেন । আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে ছিলেন । ১৯৫৪-এর নির্বাচনে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন । ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া যশোর-ফরিদপুর সেক্টরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন । [৭৩] মোহাম্মদ সেলিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্বাচনী আবেদন আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম । আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আগামী ৭ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে । জনগণের ত্যাগ ও নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফল হচ্ছে এই নির্বাচন । সারা দেশ ও দেশের মানুষের তীব্র সংকট ও দুর্গতি থেকে চিরদিনের মতো মুক্ত করার সুযোগ এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে । দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম আন্দোলনের পথ বেয়ে শত শত দেশপ্রেমিকের আত্মদান,শহীদের তাজা রক্ত আর হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীর অশেষ নির্যাতন ভোগ ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণের সামনে আজ এক মহা সুযোগ উপস্থিত । এই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্বাচনের হবার পর পরই পরিষদ সদস্যরা বা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার গদিতে বসে পড়তে পারবে না । বস্তুত স্বাধীনতার তেইশ বছরের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল দায়িত্ব এবং অধিকার সর্বপ্রথম এবারই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা লাভ করেছে । তাই এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।

২৩৬

আমার দেশবাসী, আমাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরও যদি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিগণ দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়,তাহলে পাকিস্তান বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিরতরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে । কেননা সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও একানায়কত্ববাদের প্রতিভূরা দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার কাজে পদে পদে বাধা দেবে । ভোটাধিকারের নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে সেই মহা সুযোগ ও দায়িত্ব যদি আমরা কুচক্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারি;তাহলে কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা মানুষের দুঃখ মোচন এবং বাংলার মুক্তি সনদ ছয়দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়িত করা যাবে । একমাত্র এই কারণেই আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে । প্রিয় দেশবাসী, কারাগার থেকে বেরিয়ে আমরা জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ এক ব্যক্তি এক ভোটের দাবি তুলেছিলাম;আজ সেটা আদায় হয়েছে । তাই ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ যোগ্যতা ও সুযোগের অধিকারী । এখন বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরা যদি একই দলের কর্মসূচি ও আদর্শের সমর্থক হন অর্থাৎ সকল প্রশ্নে তাঁরা ঐকমত্যে থাকতে পারেন তবে আমরা অতীতে চাপিয়ে দেয়া সকল অবিচার,বৈষম্যমূলক আচারণ আইন-কানুন এবং সম্মিতিত দাবির মুখে দেশের অপর অংশের পরিষদ সদস্যদ্গণ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসনদ ছয়দফা ও ১১ দফা মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন । এর কারণ, পরিষদে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকব আর যদি আমরা বিভক্তি হয়ে যাই এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত,নিপীড়িত ভাগ্যহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিন্টি পিছিয়ে যাবে । আমার ভাইবোনেরা, শেরেবাংলা আজ পরলোকে।হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নেই । যার প্রবীণতার দাবি করছেন তাঁদের অধিকাংশই হয় ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানে এক শ্রেণীর বাঙালি বিদ্বেষীদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে তল্পিবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন;নয়তো নিস্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং

২৩৭

অন্যের সলাপরামর্শে বশীভূত হয়ে কথায় ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন । আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরই কথা বলতে হবে । তাদের চাওয়া ও পাওয়ার সার্থক রূপদানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে । এবং সে কঠিন দায়িত্ব গ্রহণে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত । তার উপযোগী করেই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলা হয়েছে । নিজেদের প্রাণ দিয়েও যদি এদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জীবনকে কন্টকমুক্ত করতে পারি আগামী দিনগুলোকে সকলের জনয সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি এবং দেশবাসীর জন্য যে কল্পনার নকশা এত দিন ধরে মনের পটে এঁকেছিলাম, সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের পথ প্রশান্ত করে দুঃখের বোঝা যদি কিছুটা লাঘব করে যেতে পারি-তাহলে আমাদের সংগ্রাম সার্থক হবে । আমার প্রিয় দেশবাসী, আমি ক্ষমতার প্রত্যাশী নই । কারণ, ক্ষমতার চেয়ে জনতার দাবি আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড় । এখন নির্বাচনের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ ও দাবি আদায়ের দায়িত্ব যদি আমাদের ওপর ন্যস্ত করতে চান তাহলে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে । সে শক্তি হলো পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ । কারণ, এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে অধিকার আদায়ের চাবিকাঠি । তাই আমাদের জীবনের সুদীর্ঘ সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে আমার একটি মাত্র আবেদন, বাংলাদেশের সকল আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিন । সংগ্রামী দেশবাসী, সর্বশেষে,আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনাদের কাছে কয়েকটি কথা পেশ করতে চাই । আপনারা জানেন,১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় আমরা বাঙালিরা কী রূপ বিচ্ছিন্ন,অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়েছিলাম । বিশ্বের সাথে এবং দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে প্রায় আমাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়েছিল । অবরুদ্ধ দ্বীপের ন্যায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কেবল আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এক সীমাহীন অনিশ্চয়তার মুখে দিন কাটাচ্ছিল । তথাকথিত শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রশাসনযন্ত্র বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সেদিনের সেই জরুরি প্রয়োজনের দিনেও আমাদের নাগালের বাইরে ছিল । তাই আমার নিজের জন্যে নয়, বাংলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্যে ১৯৬৬ সালে আমি ছয়দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম । এই দাবি হচ্ছে আমাদের স্বাধিকার,স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়িন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবি; অঞ্চলে অঞ্চলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানের দাবি । এই দাবি তুলতে গিয়ে আমি নির্যাতিত হয়েছি ।

২৩৮

একটার পর একটা মির্থ্যা মামলার জড়িত আমাকে হয়রানি করা হয়েছে । আমার ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছিল । আমার সহর্মীদেরও একই অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে । সেই দুর্দিনে পরম করুণামইয় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরুপ আপনারাই কেবল আমার সাথে কোনো নেতা নয়, কোনো দলপতি নয়, আপনারা-বাংলার বিপ্লবী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিঊ ভেঙে মনু মিয়া, আসাদ, মতিউর, রুস্তম, জহুর, জোহা, আনোয়ারার মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিল । সেদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি, জীবনের কোনো দিন ভুলব না, ভুলতে পারব না । জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই মিথ্যা আগরতলা শড়যন্ত্র মামলার মতো আবার যদি মৃত্যুর পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমি শহীদের পবিত্র রক্তের সাথে বেইমানি করব না । আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুণ্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনো দিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করব । প্রিয় ভাইবোনেরা, বাংলার যে জননী শীশুকে দুধ দিতে দিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় মারা গেল, বাংলার যে শীক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢলে পড়ল, বাংলার যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে জীবন দিল, বাংলার যে ছাত্র স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে রাজপথে রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিল, বাংলার যে সৈনিক কুর্মিটোলার বন্দিশিবিরে অসহায় অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো; বাংলার যে কৃষক ধানক্ষেতের আলের পাশে প্রাণ হারাল-তাদের বিদেহী অমর আত্মা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, ঘরে-ঘরে ঘুরে ফিরেছে এবং অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার দাবি করছে । রক্ত দিয়ে প্রাণ দিয়ে যে আন্দোলন তারা গড়ে তুলেছিলেন,সে আন্দোলন ছয়দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের পরই তাদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। কাজেই আপনারা আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে জয়যুক্ত করে আনুন । আমার দৃঢ় বিশ্বাস,যে জালেমদের ক্ষুরধার নখদস্ত জননী বঙ্গভূমির বক্ষ বিদীর্ণ করে তার হাজারো সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়যুক্ত হব । শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না । ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন ।

২৩৯

জয়বাংলা ।। পাকিস্তান জিন্দাবাদ ।। নিবেদক- আপনাদেরই শেখ মুজিবুর রহমান ১.১২.১৯৭০ [১৫৩] সংকলন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রদত্ত ভাষণ [বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজধানীতে পৌঁছার সাথে সাথে বাংলাদেশের অপেক্ষমাণ লক্ষ লক্ষ মানুষের উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায় । বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং রাষ্ট্রপতির ভবনে যান । এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রথমে ইংরেজিতে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেও শ্রোতাদের অনুরোধে বাংলায় বলেন। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ নয় মাস পর তাদের অবিসংবাদিত নেতার বক্তৃতা শোনার জন্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয় । ১০ জানুয়ারি অপরাহ্ণে বৃটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগ বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন । অতি কষ্টে জাতির জনককে একটি খোলা ট্রাকে করে বিমানবন্দর থেকে সারা পথ প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্য দিয়ে রেসকোর্সে আনা হয় । রেসকোর্সে পৌঁছাতে ট্রাকটির প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে । ১০ জানুয়ারি,১৯৭২ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অংশ বিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত হলো । এখানে উল্লেখ্য,এই ভাষনটি সর্বত্র পরিমার্জিত রূপে সংকলিত হয়েছে । এখানেও তাই দেয়া হলো ।] ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন,যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন,তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই । ভাইয়েরা আমার,লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে । আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে । বাংলাদেশ আজ স্বাধীন বাংলার কৃষক,শ্রমিক,ছাত্র,মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি সালাম । তোমরা আমার সালাম নাও । আমার বাংলা আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে । ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে । আপনারাই জীবন দিয়েছেন,কষ্ট করেছেন। আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল;কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে । বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে,খেয়ে –পরে সুখে থাকব, এটাই ছিল আমার সাধনা । বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী

২৪০

মিসেস ইন্দিরা গাদ্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরে অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা । বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দান ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই । গত ৭ই মার্চ আমি রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দুর্গ গড়ে তোলো’ । আজ আবার বলছি আপনারা এ কথা বজায় রাখুন । আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লা । ‘বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন । একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না । বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন । দেশরূপেই বেঁচে থাকবে । বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই । গত দশ মাসে সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে । বাংলার লাখো লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য মানুষ গৃহহারা । এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই । বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই । বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি-বাংলাকে স্বীকৃতি দিন । আমার সোনার বাংলা ,আমি তোমায় অত্যন্ত ভালোবাসি । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী , রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করেনি । ‘কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি বাঙালি জাতি প্রামান করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে । এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই । আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি-যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে-পূর্ন হবে না । তোমরা,আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্য । তোমরা, রক্ত দিয়েছ । তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও । ভাইয়েরা, তাদের গায়ে হাত দিও না; তারাও আমাদের ভাই । বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালিরা কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে । তাই নয়, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে । কিন্তু ইয়াহিয়া সরকাররে সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে । এদের বিচার হবে । সে ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখুন , ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন । আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুস্লমান । বাঙালিরা একবারই মরতে জানে । তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না তাদের, বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই । কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও । মার্চের সেই রাতে আমাকে ছেড়ে যাবার সময়ে আমার সহকর্মী তাজঊদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যরা কাঁদছিলেন । কিন্তু আমি বলেছি, এখানেই আমি মরতে

২৪১

চাই । তবুও মাথা নত করতে পারব না । আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নির্দেশমতো সংগ্রাম চালিয়ে যাও । তারা সে ওয়াদা পালন করেছে ।
বাংলাদেশ আজ মুক্ত,স্বাধীন । কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন । বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান ।
পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নাই । পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা – আপনারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছেন , অসংখ্য বাঙালি মা-বোনের অসম্মান করেছেন, তবু আমি চাই আপনারা ভালো থাকুন ।
আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারব না । এরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে,এমন গ্রাম নাই যেখানে আগুন দেয় নেই,যেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই । আজ বহু ছাত্র,যুবক,বুদ্ধিজীবী ও সহকর্মীকে আমি দেখছি না । এত বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজির আর নাই। প্রথম মহাযুদ্ধ,দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত বেসামরিক লোক মরে নাই ।
সকালে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয় । বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না । রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ,গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি । তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পন্ডিত মতিলাল নেহেরুর নাতনী । তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি । তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন । আমার সাথে দিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আলাপ হয়েছে । আমি যখনই বলব,ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে । এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর জনতাকে আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই – মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে , কর্মী বাহিনীকে । আমি সালাম জানাই-সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীকে, কৃষককূলকে, বুদ্ধিজীবীদের । বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে । একটি লোকেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া হবে না । সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে ।
আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন, দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলে রাখা যায় কিনা । আমি তখন বলেছিলাম। আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি বলতে চাই-ভুট্টো সাহেব আজ আপনারা সুখে থাকুন । আপনাদের সাথে আর না । মরে যাবে তবু বাঙালি আর স্বাধীন হতে পারে না । আমি আপনাদের মঙ্গল কামনা করি । আমরা

২৪২

স্বাধীন এটা মেনে নিন । আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন ।
গত ২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর হানাদার বাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে । তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছের । হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে । বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছু জানে । বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে । একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল বর্বর পাকবাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করুক ।জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা।
জয়বাংলা ।বাংলাদেশ-ভারত ভাই ভাই।
[৬৭৭] সংকলন

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন্তার ঘোষণা
DECLARATION OF INDEPENDENCE
This may be my last message,from todey Bangladesh is independent . I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with wherever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
[Message embodying Declaration of Independence sent by Bangabandhu Shaikh Mujibur Rahman to Chittagong shortly after midnight of 25th March, i.e early hours of 26th March, 1971 for transmission throughout Bangladesh over the ex-EPR transmitter.]
[১৫৩] সংকল

বঙ্গবাণী
‘বঙ্গবাণী’ স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয় । পত্রিকাটি নওগাঁ (রাজশাহী) থেকে প্রকাশিত । পত্রিকায় অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এম এ জলিল এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে এম হোসেন (খন্দকার মকবুল হোসেন) এবং সহ সম্পাদক এ বি খোন্দকার ছিলেন । নওগাঁসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সফলতার কথা তুলে ধরে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ ও সাহসী করা হতো । এর মূল্য ১৫ পয়সা, কলামসংখ্যা ৩ এবং পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪ ছিল । প্রথম প্রকাশ ২৩ মে, ১৯৭১ এবং বাংলায় ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮, রোববার ছিল । প্রথম সম্পাদকীয় ‘ইতিহাস ভুলিবে না’ লেখা হয় ।
[৪৬০] হাসিনা আহমেদ

২৪৩

বদরুন্নেসা আহমদ(১৯২৭-১৯৭৪) একজন রাজনীতিবিদ । তিনি কলকাতায় ৩ মার্চ,১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এড এবং এম এ ডিগ্রি লাভ করেন । পঞ্চাশের দশক থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন । ১৯৪৫-১৯৫৮ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ সদস্য ছিলেন । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন । ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সদস্য নির্বাচিত হন । বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন । ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ২৫ মার্চ,১৯৭৪ লন্ডনে মৃত্যু বরণ করেন । [৭৩] মোহাম্মদ সেলিম বর্হির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবশেষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে পাকিস্তানি শাসকজান্তা যখন সামরিক বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল তখনই শুরু হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । দেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে ২৫ মার্চের কালরাতে (২৬ মার্চ) শুরু হয় একটি অতুলনীয় জনযুদ্ধ । নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গের ভাষায় ‘লাঠি, বর্শা এবং স্বহস্তনির্মিত রাইফেল নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকের বিমান,বোমা, ট্যাঙ্ক ও ভারী কামানে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে’ (২৮ মার্চ ১৯৭১) । পুলিশ, সীমান্তরক্ষী ও সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সশস্ত্র সদস্যের সম্পৃক্তি এবং জনযুদ্ধে সবিশেষ উৎসাহ সঞ্চার করে । প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয়লাভ করে ও তাদের সহায়তা রচিত হয় অনন্য প্রক্রিয়ায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস । এই মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা বিবেচনা করতে হলে প্রথমেই তৎকালীন বিশ্ব- রাজনীতির কতিপয় মৌলিক দিক নজরে রাখা প্রয়োজন । পৃথিবী তখন দুটি সহ-অবস্থানকারী পরাশক্তি বলয়ে বিভক্ত । পরাশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে বিশ্বের সব সমস্যা – সংকট বিবেচনা করে, ঠিক কোনো নীতিমালার ভিত্তিতে নয় । যদিও ১৯৪৮ সালে বিশ্ব মানবাধিকার মহাসনদ জাতিসংঘে গৃহিত হয় তবু মানবাধিকার নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যাথা ছিল না। মানবাধিকার লঙ্ঘন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে অনুষ্ঠিত হতো । স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব সমন্ধে যে নীতি অনুসরণ করা হতো, তাতে নিজের ভৌগোলিক সীমানার ভেতর সরকারি জুলুম-নির্যাতন বা অন্যায়-অবিচারে বাইরের হস্তক্ষেপ ছিল অচিন্তানীয় । অবশ্য পরাশক্তির


[৪৬০] হাসিনা আহমেদ

২৪৪

গোপন গোয়েন্দা নানাভাবে হস্তক্ষেপ করত, সরকার বদলিয়ে দিত বা সরকারপ্রধানকে হত্যা করত,সরিয়ে দিত । পরাশক্তিরা মোটামুটিভাবে সামরিক শাসক বা শক্তিশালী স্বৈরাশাসককে বেশি পছন্দ করত ও আশাকারা দিত । গণতন্ত্রের পক্ষে,মানবাধিকারের জন্য উপনিবেশবাদের অবসানে যতই বুলি আওড়ানো হতো না কেন এগুলোর তেমন কদর ছিল না । ঊপনিবেশবাদ বা শ্রণী বা বর্ণবেষম্য নিরশনের জন্য আন্তর্জাতিক সনদ থাকলেও তা বাস্তবায়নে অ্যগ্রহ ছিল অতি সামান্য । সর্বাপরি একটি দেশের কোনো অংশের মুল দেশ থেকে বিচ্ছেদের বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থন পেত না । নাইজেরিয়া থেকে বায়ফ্রার ছেদনের আন্দোলন ১৯৬৭ সালে শুরু হয়, কিন্তু তিরিশ মাসের অনেক রক্তক্ষরণ ও ধবংসলীলার পর ১৯৭০ সালে ব্যর্থ হয় । ছেদন-প্রক্রিয়া নিয়ে একরকম জুজুর ভয় যেন বিরাজ করত । যুদ্ধাপরাধের আইন থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে তার বিচার ছিল অচিন্তনীয়, বিচার হলে তা করবে জাতীয় সামরিক বাহিনী বা সরকার । যে কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছিল অকল্পনীয় মাত্র ১৯৭৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন জাতিসংঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ করে অথচ ১৯৪৭ সালেই স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইনে রাষ্ট্রগঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল । দুস্থের সেবায় বা শরণার্থী মোকাবেলায় জাতিসংঘের অবশ্য যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল । কিন্তু শান্তিরক্ষার বিষয়ে দুই পরাশক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে কিছুই করার কোনো অবকাশ জাতিসংঘের ছিল না । মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বের ভূমিকা নিয়ে তেমন বেশি গ্রস্থও রচিত হয়নি । ভারতকে এই বিবেচনা থেকে অবশ্য বাদ রাখা সমীচীন এবং এই প্রবন্ধে ভারতের বিষয়ে কিছুই লেখা হয়নি । যা কিছু লেখালেখি আছে তা আমেরিকা ও ব্রিটেনকে নিয়েই । অধুনা জাপানের ওপর কিছু কাজ হয়েছে এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ আরকাইভস থেকে অনেক দলিল-দস্তাবেজ প্রকাশিত হয়েছে বা গবেষণার জন্য উন্মক্ত হয়েছে । সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনের অবস্থান সম্বন্ধে তেমন নির্ভরশীল বিবরণ খুবই কম আছে । জাতিসংঘের নানা উদ্যোগ সহজেই জানা যায় । কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার ফর্দ লেখার শেষে যোগ করা হয়েছে । বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে বিবেচিত হয় বা প্রভাব ফেলে তা নির্ভর করে কয়েকটি উপাদানের ওপর । যেসব দেশে প্রবাসী বাঙালিরা ছিলেন তারা সংগঠিত হন । এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ব্রতী হন । তারা গণমাধ্যমে প্রভাব ফেলেন এবং রাষ্ট্রনায়ক,বিশেষ করে সেই দেশের জনপ্রতিনিধিদের সচেতন ও সমর্থক করতে প্রচেষ্টা নেন । মনে রাখা ভালো যে ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাঙালি মূলত দুটি দেশেই ছিলেন –আমেরিকা ও ব্রিটেনে। মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল । জাপান,সুইডেন বা অস্ট্রেলিয়ায় ছাত্র ও দু-চারজন কূটনীতিবিদ ছাড়া আর কেউ ছিলেন না । তবে প্রধান দুটি দেশ ছারাও অন্যত্র প্রবাসী ভারতীয়রা

২৪৫

নানা দেশে ছিলেন এবং তারা নিজেরা অথবা বাংলাদেশের প্রবাসীদের নিয়ে এই ধরনের লবি প্রতিষ্ঠা করেন । আরো একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের পক্ষে জনমত প্রভবে সবিশেষ অবদান রাখে । যেসব বিদেশী বিশেষজ্ঞ বা কৃটনীতিবিদ বাংলাদেশে কোনো সময়ে কর্মরত ছিলেন, এমনকি যারা পাকিস্তানে কর্মরত থাকাকালে পৃর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে প্রান্তিকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের পক্ষে মতামত গঠনে সচেষ্ট হন । দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিরস্ত্র মানুষ নিধনে ও সারাদেশের সম্পদ লুন্ঠনে যে ভূমিকা ছিল তার বর্বরতা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আর্কষন করে । ২৫ মার্চে ঢাকায় প্রায় পঁয়ত্রিশজন বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের ২৫ মার্চেই হোটেল ইন্টাকন্টিনেন্টালে গৃহবন্দির মতো করা হয় । তবে দুজন সাংবাদিক – সাইমন ড্রিং এবং একজন ফরাসী আলোকচিত্রী হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে পালাতে সমর্থ হন এবং অতিরিক্ত একদিন বিধ্বস্ত শহরটি প্রদক্ষিণের সুযোগ পান । এসব সাংবাদিককে ২৭ মার্চে বিমানে করাচিতে নিয়ে গিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় । তাঁদের কাগজপত্র, ক্যামেরা বা অন্যান্য সহায়ক যন্ত্র সব বাজেয়াপ্ত করা হয় । তাই প্রথম পদক্ষেপেই পাকিস্তান বিদেশী সাংবাদিকদের বৈরী অবস্থানে ফেলে দেয় । অতঃপর সরকারই সমস্ত সংবাদ সরবরাহ করে এবং তা ছিল সম্পূর্ন বাস্তব্বিবর্জিত ও মিথ্যা । সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন তথ্য-সরবরাহকারী ব্যক্তি বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় বিশ্ব সংবাদমাধ্যম প্রকৃত খবর সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় এবং এই সংবাদ ছিল পাকিস্তানের জন্য খুবই নেতিবাচক । ছয় সপ্তাহ পরে পাকিস্তান সরকার নিজের পছন্দমতো কিছু বিদেশী সাংবাদিককে আমন্ত্রণ করে বিপর্যস্ত এলাকা পরিদর্শনে নিয়ে যায় । এগুলো ছিল নির্ধারিত এলাকায় পরিচলিত পর্যবেক্ষনের সুযোগ প্রদান । কিন্তু এতেও হত্যা, অত্যাচার ও ধবংসযজ্ঞের পরিচয় লুকানো সম্ভব হয়নি । নয়টি মাসে কখনো পাকিস্তানি বর্বরতার কোনো প্রশমন পরিলক্ষিত হয়নি । তারা গ্রামের পর গ্রাম ধবং স করে নির্বিচারে গনহত্যা চালায়, বাঙালি এলিট গোষ্ঠীর অনেক সদস্যকে গুম করে ফেলে অথবা দীর্ঘদিনের জন্যে কারাবন্দি করে এবং ধনী- নির্ধন -নির্বিশেষে সকলের সম্পদ লুট করে । একই সঙ্গে তারা সমর্থ যুবকদের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে দেশত্যাগে বাদ্য করে । নয় মাসে ভারতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা হয় প্রায় এক কোটি, যার সত্তর শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য । সুতরাং সংবাদমাধ্যমকে খোরাক দিতে পাকিস্তান মোটেই কার্পন্য করেনি । অন্যদিকে জুলাই থেকে শূরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান ছিল অতর্কিত ও প্রায়ই সফল । শরণার্থী কেন্দ্রে এক সময়ে কলেরার প্রাদুর্ভাব এবং জনগণের দুর্গতি স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমকে আকৃষ্ট করে । তৃতীয়ত, এই মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন্তার ঘোষণা

২৪৬

জাতিসংঘের মহাসচিব পয়লা এপ্রিলেই মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘবের জন্য ত্রাণ-সাহায্যের প্রস্তাব দেন । পাকিস্তান এই প্রস্তাবে সাড়া দিলে ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তান ত্রাণ কার্যক্রমের (UNEPRO) সূচনা হয় । মুক্তিযুদ্ধকালে এই উদ্যোগ তেমন সাফল্য লাভ করল না । কিন্তু এতে যে অবকাঠামো তৈরি হয় বাংলাদেশ শ্ত্রুমুক্ত হলে তাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম । ২১ ডিসেম্বরে এই উদ্যোগের নাম হয় ত্রাণ কার্যক্রম(UNROD), যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ত্রাণ কার্যক্রম(UNROB) নাম গ্রহণ করে এবং প্রায় দেড় বছর বহাল থাকে । ১৯ মে ভারত সরকার শরণার্থী সমস্যার মোকাবেলার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য চায় । জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা(UNHCR) এ ব্যাপারে সমন্ব্যকারীর ভূমিকা পালন করে এবং বিশ্ব খাদ্য কার্যক্রম (WFP) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (UNICEF) সারা বছর সক্রিয় থাকে । ১ আগস্টেই মহাসচিব উ থান্ট বুঝতে পারেন যে , মুক্তিযুদ্ধের ফলে ‘অবস্থা এমনি যে রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলোতে দুষ্টবৃত্তির সৃষ্টি করেছে’ তার মোকাবেলা করা খুবই দুরূহ । মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম ও ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ কারযক্রম প্রয়োজন হয় । একই সঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংরক্ষণ গণহত্যা প্রতিরোধ , ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান-এমনি ধরনের বিষয় বা জাতিসংঘের দায়িত্বে বর্তে তা সামনে এসে দাঁড়ায় । সর্বোপরি আঞ্চলিক শান্তিহানির সম্ভাবনা সব সমেয়ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নভেম্বরে তা প্রকট হয়ে ওঠে । এই প্রতিটি বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা রাখা সুযোগ ছিল। বিশ্ব রাজনীতির সীমাবদ্ধতার কারণে জাতিসংঘ তেমন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় । তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা ধরণের দূত মিশন পাঠায় । পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীও নানা স্থানে সফর করেন । বাংলাদেশেও সীমিতভাবে দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়া মধ্যপ্রাচ্য,ইউরোপ,আমেরিকায় মিশন পাঠায় । মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহ ও দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাংলাদেশের এসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ ছিল।
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনে খুব কম রাষ্ট্রই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় । দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যে, পরাশক্তির দ্বন্দের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে পারল না, যদিও প্রায় অর্ধশত সদস্য এই বিষয়ে কোনো না কোনো মন্তব্য করেন । জাতিসংঘের আলোচনায় চারটি দেশের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য । লাক্সেমবুর্গের প্রতিনিধি বলেন , ‘যখন আমাদের চোখের সামনে লাখ লাখ লোকের বর্ণানাতীত দুর্দশা দেখতে পাই, ‘যখন দেখি যে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়া তুলে, যখন দেখি যে সভ্য সমাজে

২৪৭

যে মৌলিক অধিকার দুর্বলতম জনের স্বীকৃত তা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে যে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিতাপত্তার নামে এই ধরনের বর্বরতা কি চলতে দেয়া উচিত?’ কানাডার পরারাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল শার্দ প্রশ্ন করেন , ‘যখন একটি অভ্যন্ত রীণ বিবাদ অগণিত দেশকে এত প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলিত করে , তখন তাকে কি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচনা করা সমীচীন? ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক হিউম বলেন , ‘পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের আস্থা সৃষ্টি হবে এবং তাঁরা স্বদেশে থাকবে , দেশোন্নয়নে মনোনিবেশ করবে’। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট রজার্স বলেন , ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়টি পাকিস্তানের জনগন ও সরকারই মোকাবেলা করবে । শান্তিপুর্ণ অবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংযমের প্রয়োজন , আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রয়োজন এবং রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ প্রয়োজন’। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে নির্বিকার থাকে । ৩০ নভেম্বর পাকিস্তান প্রস্তাব করে যে সীমানা পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হোক । কিন্তু কেউ তা বিবেচনায় আগ্রহী ছিলেন না । পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর মার্কিন উদ্যোগে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদ বিবেচনা করে । ভারতকে নিন্দা করে প্রস্তাব নিতে বলে চীন । আমেরিকা তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি দাবি করে ও ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয় । সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে এই প্রস্তাব বানচাল এবং পাকিস্তানের বাংলাদেশ দখলে রাখার উদ্যোগ ব্যাহত হলো । ৬ ডিসেম্বর আমেরিকার আরেক প্রস্তাব সোভিয়েত ভোটোতে নাকচ হলো । যুদ্ধবিরতি নিয়ে কতিপয় সদস্য উৎসাহী ছিলেন কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহারে তাঁদের সমর্থন ছিল না । চীন তার দৃঢ় মতামত থেকে বিচ্যুত না হয়ে এবার ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাল । আবার ১২ ডিসেম্বরে আরেক মার্কিন প্রস্তাবে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো, ১৩ ডিসেম্বর পড়ল সোভিইয়েতের তৃতীয় ভেটো । জেনারেল ইয়াহিয়া পরাজয় বরণ করলে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি হলো, তবে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব পাস করে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগটিকে শক্তিশালী করার সুযোগ নিল । বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর) জাতিসংঘ থেকে অনেক আশা করেছিল । তারা ১৯৭১ সালের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে । এই দলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আর এর সদস্য ছিলেন আরো ষোলজন । তাঁদের মধ্যে ছিলেন সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কতিপয় কূটনীতিবিদ । এই দলের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্বকারীর সঙ্গে লবিং করা এবং জাতিসংঘকে সমস্যা সমাধানে সক্রিয় করা । তাঁরা পাকিস্তান দূতাবাসের রোষনলে পড়েন এবং বিভিন্ন দেশের

২৪৮

প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগে তাঁরা নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হন । এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিনিধিরা সহজে যোগাযোগ করতে দিতেন না । চিলির পররাষ্ট্রন্ত্রীকে ধরার জন্য তাঁদের অর্থমন্ত্রী সুপারিশ করলেন । চিলিতে পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদৃত বাংলাদেশ দলের সদস্যও ছিলেন । তথাপি তাঁর সঙ্গে অনেক কষ্টে ও চালিত করে মোলাকাত পেতে হয় । একমাএ ভারত , সোভিয়েত রাশিয়া আর কতিপয় পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো গোপনে অথবা অনেক পানি ঘোলা করে । এই ছিল তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির রুপ .৬ ডিসেন্বর বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের দাবি ছিল যে , নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বক্তব্য শুনতে হবে । ১২ ডিসেন্বর সে রকম এক সণ্বাবনা ও ছিল, কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্রোর আপত্তিতে তা টিকলো না । পাকিস্তান জাতিসংঘের এক্তি ১৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল প্রেরন করে যাতে প্রথমবারের মতো প্রায় অর্ধেক সদস্য ছিলেন বাঙালি এবং নেতৃত্বও দেন এক বাঙালি মাহমুদ আলী (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের দপ্তরবিহীন মন্ত্রী) পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানও ছিলেন এই প্রতিনিধিদলের সদস্য । তাঁদের একমাত্র কশ্চিম পাকিস্তানি কর্তাদের ও রাষ্ট্রদূত আগা শাহীর তাঁবেদারি । জাতিসংঘ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালে কোনো সংকটেরই মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় । মহাসচিবের মর্যাদা ব্যবহার করে সমঝোতার প্রচেষ্টা নিতেও ব্যর্থ হয় । মানবাধিকার রক্ষা, গণহত্যার বিচার, উপনিবেশবাদের অবসান-এসব তো ছিল সম্পূর্ণভাবে এখতিয়ার-বহির্ভূত পরাশক্তি বিভেদের ছিল এমনি দাপটি। শরণার্থীর বিষয়ে জাতিসংঘ যে অবদান রাখে তার পরিসর ছিল সীমিত । ভারত এই সমস্যা মোকাবেলায় যে অর্থ ব্যয় করে তার এক-চতুর্থাংশের কম মোট সাড়ে ২১ কোটি ডলার জাতিসংঘের মাধ্যমে পাওয়া যায় । পাকিস্তানের সমর্থন আসে মূলত মার্কিন সরকার , চীন সরকার এবং মুসলিম দেশগুলো থেকে । মুসলিম দেশগুলোকে পাকিস্তান বোঝাতে সমর্থ হয় যে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশকে ধ্বংস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং তাতে বাংলাদেশে অমুসলিমরা প্রাধান্য পাবে । মার্কিন সরকার সর্বদাই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থক , অবশ্য পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধহীন উদ্যোগে তারা ভারতকেও সমর্থক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে । ১৯৭২ সালে আমেরিকা বাইশ বছরের বৈরিতা পরিহার করে চীনের বন্ধু ও আমেরিকার সহযোগী পাকিস্তান । জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে রাওয়ালপিন্ডি থেকে পিকিং(বর্তমান বেইজিং) গমন করে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন । তাই জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানকে নাখোশ করার কোনো প্রচেষ্টাই মার্কিন সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না । পরবর্তীকালে সম্ভবত তাদের

২৪৯

বিবেচনায় সোভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় উদ্যোগকে তাঁরা ব্যর্থ করে দিতে মনস্থ করে । তবে অনেকের মতে, নিক্সন-কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবে ভারত ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সহ্য করতে পারতেন না । আমরা দেখব যে মার্কিন নীতি একান্তই কিসিঞ্জার-নিক্সনের নীতি ছিল,তাতে কংগ্রেস,সংবাদমাধ্যম,শিক্ষা পরিমণ্ডল বা সচেতন জনমতের কোনো দামই ছিল না। চীন পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বন্ধু এবং এই বন্ধুতে জনহিত হিত নিয়ে তাদের কোনো ভাবনাই ছিল না । তাই যদিও বাংলাদেশে জনযুদ্ধই সংঘটিত হয় তবু চীন তাতে সমর্থন দিতে বিরত থাকে । তবে চীনে তখন ক্ষমতার লড়াই ছিল তুঙ্গে এবং সে কারণে চীনের পাকিস্তান সমর্থন শুরু কথা ও বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধতা থাকে । কিছু অর্থ সাহায্য ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাকিস্তান চীন থাকে পায়নি । জেনারেল ইয়াহিয়া জান্তার মহাভরসা এবং কিসিঞ্জারের নিশ্চিত বিশ্বাস যে চীন পূর্বাঙ্গনে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলবে, তা একান্তই কুসুমস্বপ্নে পরিণত হয় । তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো দুটো । বাংলেদেশের পৃর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পর চীন জাতিসংঘে ভেটো প্রয়োগ করে বাংলাদেশের পূর্ন জাতিসংঘের সদস্য হওয়া দু বছর বিলন্বিত করে এবং মুসলিম দেশগুলোর, বিশেষ করে আরবদের মধ্যে থেকে মাত্র দুটি দেশ ইরাক ও ইয়েমেন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দেয় । চীন এবং সৌদি আরব সেই স্বীকৃতি দান করে ১৯৭৫ সালে । ব্রিটেন ও আমেরিকার অবস্থান নিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে । অন্যান্য দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব খুবই কম কথায় সারা যায় । যে সব দেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের সামান্য প্রচেষ্টা চলে, সেগুলো ছিল জাপান, ফিলিপাইনস,ইন্দোনেশিয়া, সিঈাপুর, সুইডেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং কানাডা । নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও (তখন বলত সিংহল ) কিছু আলোড়ন সৃষ্টি হয় । জাপানে তখন বাঙালির সংখ্যা পঁচিশের কম । তাঁদের কজন এবং শিক্ষাঙ্গনের কতিপয় দিকপাল এপ্রিলের শুরুতেই বাংলাদেশের জন্যে কাজে নামেন । তাঁরা সংবাদপত্রের দপ্তরে ধারনা দেন, রেডক্রসের কাছে আবেদন করেন, ডায়েট সদস্যদের কাছে যান,সরকাররে কাছে আবেদন করেন । জাপান – বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে ১১ এপ্রিলে এবং তার প্রতিনিধি হন অধ্যাপক সুয়শি – নারা,কিন ইচি টাকেনাকা এবং ইয়াসুআকা নারা । বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন শেখ আহমদ জালাল, ইসকন্দর চৌধুরী,আবদুর রহমান প্রমুখ । তাঁরা দিল্লিতে যান সেপ্টেন্বরে আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ সম্মেলনে । তাঁরা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জন্যে যোগাযোগযন্ত্র পাঠান । তাঁরা রেডক্রসের মাধ্যমে সাহায্য –সহায়তা শরণার্থী কেন্দ্রে পৌঁছে দেন । জাপান সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ত্রাণসাহায্য প্রদান করে । জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও রাখেন । জাপানি সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে ইংরেজি পত্রিকা,সারা নয় মাসই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে । জাপানে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তথ্য সচিব এস এ

২৫০

মাসুদ ও তৃতীয় সচিব কাজী আবদুর রাহিম, নভেম্বরের শুরুতে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন । ইন্দোনেশিয়ায় কতিয় বাঙালি-কামাল, সানাউল্লাহ, শামসুজ্জামান, সিদ্দিক আহমদ, মেজর আবদুল মতিন ‘আমার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন । তাঁরা জনমত গঠনে পত্র – পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনার আশ্রয় নেন। ইন্দোনেশিয়া সরকারীভাবে পাকিস্তানকেই সমর্থন করে, যদিও ভারতকে সংযমের জন্যে উপদেশ দিতে গিয়ে পাকিস্তানকেও সেই উপদেশ বিতরণ করে । ফিলিপাইনের বাঙালি তেমন ছিলেন না , তবে সেখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং পূর্ব এশিয়ায় তিনিই হন বাংলাদেশের প্রতিনিধি । ফিলিপাইনস বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নিরাপত্তা প্রদান করে এবং তাঁর প্রচারণা চালাতে সুযোগ দেয় । ফিলিপাইনস প্রকাশ্যে কোনো অবস্থানই ঘোষণা করেনি । সিঙ্গাপুরে অধ্যাপক মাহফুজুল হক একটি সমিতি গড়ে তোলেন । খ্যাতনামা সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী ছদ্মনামে বাংলাদেশের সমর্থনে পত্রিকায়-সামইয়িকীতে লেখালাখি করেন । সরকারিভাবে সিঙ্গাপুর পাকিস্তানের পক্ষেই অবস্থান নেয় । ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় । হংকংয়ে অস্থায়ী ট্রেড কমিশনার মহিউদ্দিন আহমদ আগস্টেই বাংলাদেশর পক্ষে আনুগত্য পরিবর্তন করেন । হংকংয়ের ব্যবসায়ী মনোভাব মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব মোটেই ছিল বলে মনে হয় না। আফ্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ মোটেই দাগ কাটতে সক্ষম হয়নি । ব্রায়াফ্রার ব্যার্থতায় তখন সকলে মনেই ছিল বেশ নতুন। আফ্রিকায় পাকিস্তান দূতাবাস থেকে কতিপয় বাঙালি কর্মকর্তা আনুগত্য পরিবর্তন করেন, যেমন লাগোসে, তিউনেস অথবা কায়রোতে । তবে তাঁদের সবাইকেই লন্ডনে চলে যেতে হয় । অবশ্য ইরাকে রাষ্ট্রদূত আবদুল ফতেহ আটঘাট বেঁধে কুয়েত হয়ে লন্ডনে এসে ২৯ আগস্টে তার আনুগত্য পরিবর্তনের ঘোষণা দেন । তিনজন রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের কর্মকর্তার আনুগত্য পরিবর্তন পাকিস্তানের ভাবমূর্তির দারুন ক্ষতিসাধন করে । ইরাকের পরে আবদুল মোমিন বুয়েনস আয়ার্স থেকে আনুগত্য পরিবর্তন করে লন্ডনে হাজির ।। ইঊরোপে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা প্রায় সর্বএ জোরেশোরে মাঠে নামেন । সুইডেনে একসময়ের বাঙালি কূটনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক একটি সমিতি গঠনের ঊদ্যোগ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চোধুরী সুইডেনে গেলে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গানার মিরডালের নেতৃত্বে সেখানে অ্যাকশণ বাংলাদেশ কমিটি প্রতিষ্ঠা পায় হল্যান্ডে গবেষক ও লেখিকা ক্রিস্টিন ওয়েস্টগার্ডের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ।ডেনমার্ক, ফিনল্যাণ্ড,নরওয়ে ও পশ্চিম জার্মানিতে তেমন শক্তি সংগঠিত হয় । সুইজারল্যান্ডে নভেম্বরে দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব

২৫১

ওয়ালিউর রহমানকে আনুগত্য পরিবর্তন মানবাধিকার আগ্রাহীদের আরো উৎসাহী করে । ফ্রান্সে একটি শক্তিশালী লবি তৈরি হয় এবং মে মাসে তাঁরা বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান কনসোর্টিয়াম সম্নেলনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জোর প্রচার চালিয়ে সাফল্য অর্জন করে । বাংলাদেশে এক সময়ে গবেষণারত থর্নার যুগল এবং কতিপয় বাঙালি ছাত্র এই সমিতি গড়ে তোলেন । অধ্যাপক রেহমান সোবহান মুজিবনগরের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । এক পর্যায়ে বিখ্যাত আঁদ্রে মার্লো মুক্তিবানীতে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্ততি নিয়ে চমক সৃষ্টি করেন এই সব দেশেই বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিদি হিসেবে ভ্রমণ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের বাণী পৌঁছে দেন সুইডেন ,নরওয়ে , ফিনল্যান্ড ,অস্ট্রিয়া , হল্যান্ড ,বেলজিয়াম ও পোল্যান্ড জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মন্তব্যকালে ত্রান সাহায্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার জোর দেয় ফ্রান্সের পররাষ্ট্রেমন্ত্রী শুমঁ ভালো করে বুঝিয়ে দেন যে শরণার্থী সমস্যার একমাত্র সমাধান বাংলাদেশে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা । তিনি বলেন ,’ এই অন্যায়কে যদি মূলে শোধরানো না যায় তাহলে শরণার্থীর স্রোত বন্ধ হবে না । ’১৪ ডিসেন্বর ফ্রান্স ব্রিটেনের সঙ্গে মিলে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পেশ করে । এই প্রস্তাবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিভক্তি , ভারত – পাকিস্তানের রেষারেষি হ্রাস এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে বন্ধুত্বপৃর্ন অবস্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্য নানা ঊদ্যোগের কথা হয় । দুর্ভাগ্যবশত মার্কিন একগুঁয়েমির জন্য এই পথে এগুনোই গেল না । কানাডায় কতিপয় প্রবাসী বাঙালি – ছিটিয়ে চিলেন । সেখানে ভারতীয় গোষ্ঠী ও বেশ বড় ছিল এবং বাংলাদেশ সন্বন্ধে জ্ঞনীগুনী অনেকে কানাডীয় শীক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞ স্ংস্থার ছিলেন । কানাডায় এপ্রিলেই মণ্ট্রিয়ল , টরেন্টো ও ভানকুভারে বাংলাদেশ সমিতি গঠিত হয় । কানাডার অক্সফাম শরণার্থী কেন্দ্রে ত্রাণকাজে লিপ্ত হয় । কানাডায় প্রথমদিকেই পাকিস্তানি জাহাজের বাঙালি জাহাজিরা জাহাজ ত্যাগ করে রাজনৈতিক আশ্র্য প্রার্থনা করে । কানাডীয় পার্লামেন্টের এক সদস্যদল ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে এবং দুই দেশেই ভ্রমণ করে । তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিবাচক মন্তব্য করে , সাংসদ এম পি ব্রুইন বস্তুত একজন বাংলাদেশ লবিস্টে পরিণত হন । আগস্ট মাসে টরেন্টোতে অক্সফামের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা জোর সমর্থন লাভ করে । জাতিসংঘে কানাডীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জোরালো বক্তব্যের বিষয় আগেই বিবৃত হয়েছে। আমেরিকা প্রবাসী বাঙালির কিছুসংখ্যক বৃহত্তর নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বোস্টন, ডেট্রয়েট,ফিলাডেলফিয়া এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করতেন । ছাত্ররা সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন । ভারতীয়রাও বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করতেন । এছাড়া বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক মার্কিন পরিবারের

২৫২

শিক্ষাঙ্গনে দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রহী একটি বড় গোষ্ঠী ছিল । এঁরা সবাই একেবারে শুরুতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জোর প্রচারণা চালায় । মার্কিন সংবাদমাধ্যমেও এ বিষয়ে ছিল সক্রিয় । নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পরেই নিউইয়র্কে পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকাকে তার সদস্যরা ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা নাম দেয় । এই সমিতির নেতা কাজী সামসুদ্দিন আহমদ ও ডা. খন্দকার আলমগীর স্বাধীনতার দাবি তোলেন মার্চের আগেই এবং মার্চ মাসে সমিতির নাম দেন বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা । সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা আমেরিকায় এর তিরিশটি শাখা প্রতিষ্ঠা পায় । শিকাগোতে ছিলেন বিখ্যাত বাস্তকলাবিদ ও প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান । তিনি জুনে বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ নামে একটি লবি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । শিক্ষাঙ্গনের দিকপালরা শুরুতেই মার্কিন সরকারের ওপর বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন । ২২ এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ইউনিভার্সিটি ইমারজেন্সি সংবাদপত্রে এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশকে সমর্থনের জন্য দাবি তোলে । এতে সাতজন নোবেল লবিয়েট ছাড়াও শত শত শিক্ষক অংশ নেন । নানা সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় । ইংরেজী ও বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশনার নানা উদ্যোগে হতে থাকে । ডিফেন্স লীগের বাংলাদেশ নিউজলেটার ১৭ মে ১৯৭১-এ প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তার শেষ পাক্ষিক নিবেদন ছিল ১৯৭২ – এর ১৭ ফেব্রুয়ারি । বাংলাদেশ মিশনের সাপ্তাহিক বুলেটিন ৩ সেপ্টেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পরে ১৯৭২ সালে ৫ মে তার শেষ সংখ্যা বের হয় । ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গলে স্থাপন করেন মযহারুল হক দম্পতি প্রমুখ । ভেন্ডারবিলটে মুহাম্মদ ইউনূস এই রকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন । সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার । সবচেয়ে এর মূল্য উদ্যোক্তা ছিলেন ডা. উইলিয়াম গ্রিনোর নেতৃত্ব বোস্টন , বাল্টিমোর ও ওয়াশিংটনে কর্মরত বিজ্ঞানী গোষ্ঠী , যারা একসময় ঢাকায় কলেরা গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন । এসব প্রতিষ্ঠান ছিল একদিকে প্রচারে, অন্যদিকে অর্থ সাহায্যদানে নিবাদিত । কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল ওয়াশিংটনে দুতাবাসের বাঙালিদের প্রচেষ্ঠায় ২৯ মার্চে ক্যাপিটাল হিলে বিক্ষোভ অবস্থান । ১২ জুনে নিউইয়র্কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে র‍্যালি হয় অত্যন্ত সার্থক । ১১ জুলাই বাল্টিমোর হার্বারে হয় একটি নৌ-বিক্ষোভ । জোয়ান বায়েজ, ওস্তাদ আলি আকবর খান , পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রমুখ প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী অনেক অনুষ্ঠানের অয়োজন করেন । আগস্টে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনের বিটল দল ও বব ডিয়লান একটি কনসার্ট করেন । নভেম্বরে ওয়াশিংটনে ও নিউইয়র্কে শরণার্থী ক্যাম্পের নকলে ‘সিউয়ার সিটি’ বিক্ষোভ হয় । হার্ভার্ডের অধ্যাপক মেসনসহ জ্ঞানী ব্যক্তিরা

২৫৩

বাংলাদেশের পক্ষে তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরে কংগ্রেস ও অন্যান্য মহলে তা প্রচার করেন । নয় মাস সংবাদমাধ্যমে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার শুরু করে । নানা বিশেষ প্রতিবেদনে টেলিভিশন এই বিষয়ে সোচ্চার থাকে। সবচেয়ে অনুধাবনী বিষয় হলো, মার্কিন সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও কংগ্রেসের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। নির্বাহী বিভাগ ছিল পাকিস্তানের সমর্থনে । কংগ্রেস কিন্তু ছিল একেবারে উলটো অবস্থানে । ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দুই দলের প্রতিনিধিরা, সিনেটররা বাংলাদেশের পক্ষে বলিষ্ঠ মন্তব্য রাখেন এবং নির্বাহী বিভাগকে অনেক উদ্যোগ নিতে বাধ্য করেন, কখনো বিরত করেন । কংগ্রেসে যেসব বিষয়ে নজর দেয়া হয় তা ছিল পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা ও নির্যাতন বন্ধ করার দাবি, পাকিস্তানে সামরিক সরবারহ বন্ধ করা, শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ তহবিল বরাদ্দ করা , বাংলাদেশে নিরপেক্ষভাবে খাদ্য সরবারহ করা , পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করা, শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেয়া , পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্যে উদ্যোগ নেয়া । সিনেটর আর কংগ্রেসম্যানরা ৯ মাসে নেয়া ১ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৯৮টি বিবৃতি দেন,যার মধ্যে মাত্র ১৯ টি ছিল নিক্সনের নীতি বা পাকিস্তানের পক্ষে । কংগ্রেসের উদ্যোগেই পাকিস্তানে সব রকম মার্কিন নৌবাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে রাখে । এখন জানা যাচ্ছে যে,নির্বাহী বিভাগে বিভিন্ন স্তরে নিক্সন-কিসিঞ্জার নীতি মোটেই গ্রহণীয় ছিল না। ৪ আগস্ট ১৯৭১ সালে আমেরিকায় মোট চৌদ্দজন বাঙালি কূটনীতিবিদ একসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে আরো আটজন এই কাজটি করেন । ৪ আগস্টের সম্মিলিত উদ্যোগের ভূমিকা ছিল অনন্য । সারা বিশ্বে এতে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং পাকিস্তানি দখলের অসারতা প্রমাণিত হয় । পরের দিন ওয়াশিংটনে উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা পায়,যার নেতৃত্ব দেন মুজিবনগর থেকে প্রেরিত সাংসদ এম আর সিদ্দিকী । ১৯৭২ – এর ৪ এপ্রিলে আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় । যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিরা ছিলেন নানা শহরে অবস্থিত । বিলেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু হয় ষাটের দশকে । মুক্তিযুদ্ধে ভারতে যদি দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা পায় তবে যুক্তরাজ্যে ছিল তৃতীয় যুদ্ধক্ষেত্র । সেখানে কাকতালীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি আন্দোলনের জন্য একটি বলিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে । সংবাদমাধ্যম ভারত ব্যতিরেকে অন্য কোথাও এত বলিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি । ২৮ মার্চে ট্রাফালগার স্কোয়ারে র‍্যালিও ও জনসভা