You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ | এইচ. টি. ইমাম (Part 1) - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১
এইচ. টি. ইমাম

প্রথম সংস্করণ প্রণয়নে
কৃতজ্ঞতা

আমার প্রথম গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১। জান্নাতবাসিনী স্ত্রী ইসমাতের স্মৃতি বইটি লেখায় প্রেরণা জুগিয়েছে। ছেলে জামিল; তিন মেয়ে মুনমুন, মিতু ও মুক্তি আমাকে সব সময়েই লেখার তাগিদ দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা আমার সাথেই ছিল। ছােট মেয়ে মুক্তির জন্ম ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি আমার পরিবারের সদস্যদের বিশেষ দরদ রয়েছে।
আমার এবং শহীদ কর্নেল এস. এ. হাইয়ের নাতনী প্রিয়াংকাকে আমেরিকায় তার স্কুল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি রচনা লিখতে বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের কথা নাতনী জানত। সে আমাকে তথ্য দিয়ে সহযােগিতা করতে বললে আমি ঢাকা থেকে ইমেইলে বিভিন্ন ঘটনা লিখে পাঠাতাম। আমার লেখার সূত্রপাত তখনই। তিন জামাতা সাদেক, আশফাক ও হাবিব আমাকে সময়-সময় এই বই লেখায় উৎসাহ দিয়েছে।
এক দশকেরও আগে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং প্রবাসী বিপ্লবী সরকারকে কেন্দ্র করে বই লিখতে অনুরােধ করেছিলেন। তাঁর সেই অনুরােধ আমি ভুলিনি। বই লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে তার নানাবিধ উপদেশ ও পরামর্শে, বিশেষ করে কারিগরি বিষয়ে আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।
গত কয়েক মাস যাবৎ প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন আমার দুই অনুজপ্রতিম সহকর্মী আশফাক-উল-আলম এবং কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। বই লেখার বিভিন্ন দিক, এমনকি বানান ও ভাষা সম্পর্কেও তারা উভয়ে আমাকে সবসময় সহায়তা দিয়েছেন। বইপত্র, আমার পুরােনাে নথি ঘেঁটে গবেষণা করার মতাে কঠিন কাজটিও এঁরা করেছেন। প্রাথমিক সম্পাদনার কাজ আশফাক-উল-আলম করে দিয়েছেন। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই দুই ব্যক্তির প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
বই লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা বিষয়ে শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ সহকর্মী এ.এম.এ. মুহিতের সাথে আলােচনা করে আমি উপকৃত হয়েছি। অনেক তথ্য তিনি আমাকে দিয়েছেন এবং প্রকৃত তথ্য সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ করেছেন। আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর রেহমান সােবহানও মুক্তিযুদ্ধ কালের অনেক না-জানা ঘটনা বলেছেন আমাকে। মুহিত ভাই এবং প্রফেসর সােবহানের দেওয়া তথ্য আমার বইকে সমৃদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মূল সমর-পরিকল্পনাকারী এয়ার ভাইস মার্শাল এ.কে. খন্দকার বীর-উত্তম অনেক বিষয়ে তথ্য দিয়ে, আলােকপাত করে আমাকে সাহায্য করেছেন। লেখার নানা পর্যায়ে বিশিষ্ট কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এবং আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর সাথে আলােচনা করে প্রভূত উপকৃত হয়েছি। সামারিক বাহিনী সদস্য যাদের নাম মনে আছে তারা হলেন মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহ (অব.) বীর-উত্তম, মেজর জেনারেল হারুন আহমেদ চৌধুরী (অব.) বীর-উত্তম, মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূইয়া (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালিকুজ্জামান (অব.), ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামসুদ্দীন আহমেদ (অব.) প্রমুখ। আমার সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুবর মঞ্জুরুল করিম, আ. ন. ম. ইউসুফ, ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ, সৈয়দ রেজাউল হায়াত, ড. সা’দত হুসেইন, ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, এবং আরও অনেকে আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে, আলােচনা করে সাহায্য করেছেন।
নিরলস পরিশ্রম, উৎসাহ আর ধৈর্য সহকারে আমার দুই ব্যক্তিগত সহকারী কমল কুমার দাস এবং আমিনুল ইসলাম (রবি) এই বইটি একাধিকবার টাইপ করেছেন। পাণ্ডুলিপির প্রথম অংশ টাইপে রবির অবদান অনস্বীকার্য। পরে সম্পূর্ণ কাজ করেছে কমল। এরা দুজন মনেপ্রাণে আমার গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন প্রকল্পের অংশীদার। এছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠান পাথমার্ক অ্যাসােসিয়েটস লিমিটেড-এর অন্যান্য সহকর্মী এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেছেন। তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
টাইপকৃত পাণ্ডুলিপিকে গ্রন্থাকারে রূপদান এবং প্রত্যেক পৃষ্ঠার অঙ্গসজ্জার কাজ আগামী প্রকাশনীর কর্মীবৃন্দ যত্নের সঙ্গে করে দেওয়ায় তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। গ্রন্থটি প্রকাশের শেষ পর্যায়ে আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনি নিজেও পরামর্শ প্রদান করে এর সৌষ্ঠব বৃদ্ধিতে সহায়তা করায় তাকে আবার ধন্যবাদ।
গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। গ্রন্থে মুদ্রিত আলােকচিত্র শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক জি এম আবু জাফর সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রাপ্ত।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে আমি সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলাম। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর পেরিয়ে গেল, বয়সও হয়েছে—অনেকের পুরাে নাম মনে করতে পারি না, কোনাে-কোনাে সময় স্মৃতিবিভ্রম হয় ঘটনার তারিখ নির্ণয়ে, কোথায় কাকে দেখেছিলাম মনে পড়লেই তা যথাসাধ্য নির্ভুল করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছি। যেসব গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছি সেইসব গ্রন্থের রচয়িতাদের সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের কথা উল্লেখ করছি: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, এ.এস.এম, সামছুল আরেফিন-কৃত সংকলন-গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, মঈদুল হাসান রচিত মূলধারা ‘৭১ প্রভৃতি।
বইটিকে মুদ্রণ-প্রমাদ ও অসঙ্গতিমুক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও কিছু ক্রটি থেকে গেল। আশা করি, পাঠকবৃন্দ এসব প্রমাদ ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে এ দোষ-ত্রুটি সংশােধন এবং প্রয়ােজনে পাঠকবৃন্দের সুপারিশ ও প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছি।
হােসেন তওফিক ইমাম
এইচ. টি. ইমাম)
ঢাকা
২৪ জানুয়ারি ২০০৪

আমার কথা

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও মহান বিজয় দিবস—শ্রেষ্ঠতম অর্জন এবং স্মরণীয় দিন। আনন্দ, উচ্ছলতা আর পবিত্রতম দিন। নিজের কথা লেখার আগে যে মহান ব্যক্তির কথা বারবার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মহান বিজয় দিবসের সাথে তাঁর নাম মিশে আছে। আমার নিজের কথা লিখতে বসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অতি নিকট থেকে দেখার এবং মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে তাঁর অদৃশ্য শক্তির স্মৃতি চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়।
সুদীর্ঘ ৯ মাস পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পবিত্রভূমিতে তার জনককে ফিরে পায়। সেদিন মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষেই অবিসংবাদিত নেতা এবং জাতির জনক। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে তৎকালীন শাসকচক্রের বৈষম্যমূলক আচরণ ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি সুদীর্ঘ চব্বিশ বৎসর বাংলার স্বাদীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, সােনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন, জাতিকে দেখিয়েছেন মুক্তির পথ। ব্যক্তিগত সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে, কারাগারে দিন কাটিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দিনগুলােতে। মুক্তির স্বপ্ন দেখা, তাকে লালন করা এক কথা; আর জাতির আপন সত্তাকে জাগ্রত করে মুক্তির পথ দেখানাে, দিকনির্দেশনা দিয়ে জাতিকে তার চরম লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া আরেক কথা। কঠিনতম কাজ। পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির খুবই বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই নেতাদের একজন। এটি আমার কোনাে দাবি নয়—গােটা দুনিয়াই তাকে, তার জীবদ্দশায় এই সম্মান দিয়েছিল।
প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অবাঙালি পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সচেষ্ট ছিলাম। তিনি বাঙালি জাতির জন্য যে-ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা ছিল একজন পিতারই ভূমিকা। মায়া-মমতা, কল্যাণ ও মঙ্গল করাই পিতার কাজ। বঙ্গবন্ধুও তাই করেছিলেন। তার ভালােবাসা-স্নেহ ছিল অকৃত্রিম ও দরদমাখা।
১০ জানুয়ারি সেই এক মুহূর্ত সেদিন তাঁকে দেখেছিলাম। বিজয়ী বীর বিমানের দরজা দিয়ে উন্নতশির হেঁটে এলেন; হাত তুলে বাঙালি জাতিকে জানালেন: আমি তােমাদেরই লােক। আমি শিহরিত হয়েছিলাম। আনন্দে-গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। দ্রুত আমাকে উঠতে হয়েছিল হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন সেদিনের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। আমাদের সঙ্গী ছিলেন রুহুল কুদুস সাহেব, নূরুল কাদের। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সােহরাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত সমস্ত পথের পাশে পতাকা-ফেস্টুন আর জাতির জনকের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানাে হয়েছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ যেখান থেকে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, গেরিলাযুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছিলেন জাতিকে; যেখানে বর্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিরানব্বই হাজার সৈনিকসহ সেনাপ্রধান, সেনা-কর্মকর্তা অবনত মস্তকে বাঙালি জাতির আশার প্রতীক নৌকা-আকৃতির মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমানবন্দর থেকে সােহারাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালবেলা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মিন্টো রােডের বাসায় প্রথম অত্যন্ত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পরও তাঁর চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত। যেমন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, তেমনই সুদর্শন। তার চেয়েও তার ব্যক্তিত্ব আরাে বিশাল। প্রথম দেখাতেই কাছে ডেকে নিলেন; জিজ্ঞেস করলেন: কেমন আছ? মনে হল কত দিন থেকে চেনেন। দীর্ঘদিন পর সন্তানকে দেখে পিতা যেমন কুশল জিজ্ঞেস করেন, ঠিক তেমনি। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন দেখে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের লাহাের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের প্রিয় শিক্ষকের দেওয়া সার্থক নেতার সংজ্ঞা মনে পড়ে গেল। তিনিই প্রকৃত নেতা যার আছে ‘Radiating Permeative Virtue’। এটি চীনের মান্ডারিন শাসকদের দেওয়া সংজ্ঞা। ভাবার্থ হল: সার্থক এবং সফল নেতা তাঁর গুণাবলি আশেপাশে সকলের মাঝে বিকিরণ ও অভিস্রবণ করেন। সেই গুণ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। উৎসারিত হয়, বিচ্ছুরিত হয়।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে রক্তঝরা দিনগুলােতে তিনি আমাদের মাঝে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তাঁরই নামে আমরা যুদ্ধ করেছি। তার দেয়া অগ্নিমন্ত্র জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে আমরা এগিয়ে গেছি স্বাধীনতার পথে। তিনি যেন সেদিন প্রতিটি বাঙালির পাশে, মুক্তিযোেদ্ধাদের সর্বদেহমনে। তিনি শক্তি, তিনিই প্রেরণা, আর তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ছিল সংগ্রামী পথের দিকনির্দেশনা।
সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় অত্যন্ত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। অনেক কিছু শিখেছি। কখনও ধমকের স্বরে কথা বলেননি। করেননি তিরস্কার। আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলাম, তাদের স্নেহভরে ‘তুমি’ সম্বােধন করতেন। আমরা বলতে আমি, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, মনােয়ারুল ইসলাম, কাজী হাবিবুল হক, মনসুর আহমেদ, ড. সাত্তার, ড. মশিউর রহমান, ড. ফরাসউদ্দীন এঁরা; সবাই ছিলেন সি.এস.পি.। তাঁর স্নেহধন্য আমরা আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনাে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি সারাক্ষণ। প্রতিটি মুহূর্তে, বিশেষ করে প্রতি বছর বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা দিয়ে স্মরণ করি পিতৃতুল্য মহান নেতাকে। আরাে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদ মুক্তিযােদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় চার মহান নেতা-তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে। আমার প্রয়াত সহধর্মিণী ইসমাৎ ইমাম—যার প্রেরণা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতাম কি না সন্দেহ, তার কথাও মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। গভীরভাবে মনে পড়ছে আমার সহমুক্তিযােদ্ধা এবং সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনদের যারা আমাদের মাঝে আজ আর নেই। – বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক এই গ্রন্থে আমার কথা লিখতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে জাতীয় জীবনে ও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু-একটি কথা লিখতেই হলাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। সাধ্য ছিল, সুযােগ হয়ে ওঠেনি। আমার স্ত্রী ইসমাৎ, ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত তাগিদ দিয়েছে; যেমন দিয়েছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীরা। বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে উৎসাহী; যারা তাদের বিজয়ের, জাতির আত্মত্যাগের কাহিনী জানতে চান—এরকম অনেকেই আমাকে লেখার অনুরােধ করেছেন। আজ লিখব, কাল লিখব করে আর হয়ে ওঠেনি। কোনাে-না-কোনাে ঝামেলা, বিপদ, ঝড়-ঝঞা এসে পড়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম তিন-চার বছর বিরতিহীনভাবে পরিশ্রম করতে হয়েছে। ছিল নানামুখী প্রচণ্ড চাপ। চারদিকে ষড়যন্ত্র সরকার এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে। অত অল্পবয়সে এবং জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও সবচাইতে দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলাম আমি (মন্ত্রিপরিষদ সচিব), নূরুল কাদের (সংস্থাপন), খন্দকার আসাদুজ্জামান (অর্থ ও বাণিজ্য) এবং সামাদ (প্রতিরক্ষা)। একে একে বাকি তিনজনকে অন্যত্র চলে যেতে হল। কেন জানি না, আমি টিকে গেলাম। একটি কারণ সম্ভবত বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আরেকটি কারণ আমার পরিশ্রম, দক্ষতা এবং কাজের মান অন্যান্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এজন্যই হয়তাে আমার স্থলাভিষিক্ত করার মতাে বিকল্প কাউকে বঙ্গবন্ধু খুঁজে পাননি।
প্রথম কয়েক বছর আমাকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে (ব্লাডপ্রেশার রােগ আমার যৌবনকালের সঙ্গী)। ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কারারুদ্ধ। স্বাধীনতাবিরােধী চক্র আমাকে কারান্তরালে প্রেরণ করায় মানসিকভাবে মর্মাহত হই এবং উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। সেইসাথে লেখার ইচ্ছেটাও ফিকে হয়ে গেলেও মনে হয়েছে আর সময় নেই, বড় দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না ভেবেই ২০০৩ সালের শেষার্ধে আমার সংরক্ষণে থাকা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় মূল দলিল-দস্তাবেজের নিদর্শনগুলােসহ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে মনােনিবেশ করি। কারণ এই দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সরকার সম্বন্ধে কিছু না-লেখার জন্য নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে হয়েছে। বিবেকের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছি—কেন লিখিনি এই কথা ভেবে।
আমার সহধর্মিণী প্রায়ই অনুযােগ করতেন, তােমার কাছে শুনে-শুনে আর তথ্য নিয়ে অন্যেরা বই লিখে ফেললেন, তােমার আর লেখা হলাে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Better late, than never অর্থাৎ একেবারে না-করার চাইতে দেরিতে করাও ভালাে। তাই প্রবাদটির কথা স্মরণ করে অনেকটা তৃপ্তি আর আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে শেষ পর্যন্ত লিখতে পেরেছি। সেই সাথে গভীর দুঃখ আর বেদনা এই যে, প্রিয়তমা ইসমাৎ আজ পাশে নেই।
আমার বিরাট গৌরব আর গর্বের কথা যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র সময়, তারপর দেশগঠনের (এবং সরকার সংগঠন) চরম উত্তেজনাপূর্ণ ও কখনাে কখনাে সংকটময় চারটি বৎসর একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে অংশগ্রহণ করেছি; প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। আনন্দের আর পরিতৃপ্তির কথা এই যে, অধিকাংশ ঘটনার দালিলিক প্রমাণ আমার কাছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র সংকলনের সময় কবিসাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান এবং তার অত্যন্ত সুযােগ্য ও অনলস কর্মী আফসান চৌধুরী আমার সাথে অনেক আলােচনা করেছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধনের সময় আলী যাকের, আকু চৌধুরী প্রমুখের অনুরােধে সেখানেও তথ্য এবং কিছু দলিলপত্র দিয়েছি। বি.বি.সি-র আতিকুস সামাদ, আফসান চৌধুরী, ভয়েস অব আমেরিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী এবং বাংলাদেশ টি.ভি-র আবু জাফর সিদ্দিকী বিভিন্ন সময় আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রচার করেছেন।
সুদীর্ঘ দেড় বৎসর কারাবাসের সময় লেখার একটা বড় সুযােগ ছিল। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, আত্মজীবনী ইতিহাস-প্রণয়ন কারাগারে আটক অবস্থায় অথবা নির্বাসনে থাকার সময় সম্পন্ন হয়েছে। জেলে পাঠানাের পর খন্দকার মােশতাক, তাহের ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী গয়রহ আমাকে বিন্দুমাত্র স্বস্তি দেননি। প্রতিদিন বিভিন্ন গােয়েন্দা-সংস্থার অফিসার এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসত। সেজন্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে তৈরি থাকতে যথেষ্ট সময় প্রয়ােজন ছিল।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দ্রুত ঘটে গেল আমাদের তথা সভ্যজগতের জঘন্যতম, নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। আমি থাকতাম ২৬ নম্বর সেলে (যেখানে একসময় বঙ্গবন্ধুও ছিলেন)। পাশেই ভিন্ন আরেক কারাপ্রাচীরের ভেতর ছিল সদ্যনির্মিত নতুন জেল (New jail)। সেখানে ছিলেন আমাদের চার জাতীয় নেতা এবং আবদুস সামাদ আজাদ, বন্ধুবর খন্দকার আসাদুজ্জামান, পুলিশের মাহবুবউদ্দীন (এস.পি.মাহবুব) এবং আরও অনেকে। ৩ নভেম্বর রাতে ঘাতকের উপর্যুপরি গুলিতে চরম নির্মমতার শিকার হলেন আমার আদর্শের চার নেতা। তার আগে জেলগেটে পাগলা-ঘণ্টা (alarm) বেজেই চলে রাতের শেষ প্রহরে। চারদিকে বুটের শব্দ, মানুষের কথা। আমাদের কানের পাশেই যেন গগন বিদীর্ণকারী সাবমেশিনগানের প্রচণ্ড আওয়াজ, কিছু আর্ত-চিৎকার। মনে হল যেন আমাদের প্রাচীরের মধ্যেই পাশের ঘরে প্রচণ্ড গােলাগুলি হচ্ছে। ঐ পরিবেশে কি মাথা ঠিক থাকে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। তবে বুঝতে পারছিলাম সাংঘাতিক কিছু-একটা ঘটানাে হচ্ছে। পাল্টা কোনাে গুলির শব্দ নেই। শুধুই একতরফা গুলির শব্দ, আর তার সাথে তীব্র আর্তনাদ, কান্নার রােল শুনতে পাচ্ছিলাম। বলে রাখি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাঝে মধ্যেই পাগলা-ঘণ্টা বাজত। সেরাতেও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে পাগলা-ঘণ্টা বেজে ওঠে। একটানা বেজেই চলছিল। পাগলা-ঘণ্টা বাজলে আমাদের হতাে হৃদকম্পন। ঐ রাতেও হয়েছিল।
আমাদের ঐ সেলে ঐ সময়ে ছিলেন নূরুদ্দীন আহমেদ (প্রাক্তন বন-সচিব), খায়রুল কবির (জনতা ব্যাংকের), ড. মতিন চৌধুরী (প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর), জাসদের রুহুল আমিন ভূইয়া, মেসবাহউদ্দীন, একরামুল হক, খুলনার The Wave পত্রিকার সম্পাদক (মাহমুদ), সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জয়নাল আবেদীন, শ্রমিক লীগের বিখ্যাত নেতা আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়াজাগানাে সেভেন মার্ডার কেসের চারজন অভিযুক্ত ছাত্রনেতা (রঞ্জু, বিটু, আরও দুজন), আর ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মওলানা খালেক। মান্নান আর খালেক আমাদের মেস চালাতেন।
৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের পর ঘটল ৭ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান সিপাহী বিপ্লব। খন্দকার মােশতাক ইতােমধ্যে ক্ষমতা হারিয়েছেন। বীর সেনানায়ক জেনারেল খালেদ মােশাররফ, মেজর হায়দার প্রমুখ নৃশংসভাবে নিহত হলেন। এর পরপরেই জেল থেকে ছাড়া পেলেন জাসদের নেতৃবৃন্দ। পাল্টে গেল দাবার ছক। ২৬ নম্বর সেলে নতুন অতিথি হলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল, অপর এক সেলে গেলেন মেজর হাফিজউদ্দীন।
এর কিছুদিন পরেই ঘটল আরেক নাটক। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী এবং বিদ্রোহী সিপাহীরা ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ প্রয়াসের পর সকলেই বন্দি হলেন। ২৬ নম্বর সেলে ঘটল আরও অতিথির আগমন—ড. আখলাকুর রহমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন প্রভাষক মােস্তফা সরওয়ার। কর্নেল তাহেরও বন্দি হলেন।
এই ঘটনার কিছুদিন পর আমাদের বেশ কয়েকজনের (আমি, আসাদুজ্জামান, ড. মতিন চৌধুরী, খায়রুল কবির এবং আরও অনেকের) বিরুদ্ধে মার্শাল-ল কোর্টে মামলা দায়ের করা হল। অবশ্য আমাদের জেলে আটক করার বেশ কদিন পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে আমাদের গ্রেপ্তার দেখানাে হয়। অভিযােগ: দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি। ভাগ্যের পরিহাস এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযােগ এনে কারারুদ্ধ করা হলাে তা প্রায় হুবহু ১৯৭১ সালের আগস্টে আনীত পাকিস্তান মার্শাল-ল কোর্টের অভিযােগের অনুরূপ। পাকিস্তান-কর্তৃপক্ষ (টিক্কা খানের সরকার) আমাদের প্রত্যেককে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। দৈনিক Pakistan Observer-এ আমাদের কারাদণ্ডের খবর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। ঠিক ৪ বছর পরও স্বাধীন বাংলায় ফিরে এল টিক্কা খানের প্রেতাত্মা খন্দকার মােশতাক রূপ নিয়ে।
১৯৭৬ সালের গােড়ার দিকে আমি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে একজন বিশেষজ্ঞডাক্তারের পরামর্শে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ছিলাম প্রায় তিন মাস। ফিরে এসে জানতে পারলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের অফিসে বিশেষ সামরিক আদালত দেশদ্রোহিতার দ্রুত মামলা পরিচালনা করে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং দ্রুতগতিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জেলখানার পরিবেশ কেমন যেন থমথমে। নভেম্বরের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, তারপর তাহেরের ফাঁসি এবং অন্যান্য শ্বাসরুদ্ধকর সব ঘটনা আমাদের পূর্বের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা (জেলের অভ্যন্তরে যতটা স্বাভাবিক হতে পারে) এলােমেলাে করে দিয়েছিল। এর পরই শুরু হলাে মার্শাল-ল কোর্টে আমার বিচার—দু-দুটি কেসে।
দুটি কেসেই আমি বেকসুর খালাস হলাম এবং আমাকে সসম্মানে মুক্তিদানের নির্দেশ দিলেন মার্শাল-ল কোর্ট। প্রথম কোর্টের চেয়ারম্যান (উইং কমান্ডার সদরুদ্দীন) পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তিরস্কার করলেন একটি ভিত্তিহীন কেস আনার জন্য। দ্বিতীয় কোর্টের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন জেলা জজ সাহেব। প্রথম কোর্টে আমাকে আটকানাে গেল না। অতএব দ্বিতীয় কোর্ট খালাস দিলেও সরকারের মুখরক্ষার জন্য যেন অন্তত একটি বিরূপ মন্ত ব্য করেন—এ-ধরনের ফিসফাস কথা কোর্টপ্রাঙ্গণে রটে যায়। দ্বিতীয় কোর্টের জজ সাহেব আমার সম্পর্কে যে-রায় দিলেন—কোর্টপ্রাঙ্গণে রায় প্রদানের পূর্বে যে গুজব আমার কানে আসে—প্রায় সে-রকমই একটি রায় প্রদান করা হলাে। আমি মুক্ত হলাম বটে, কিন্তু পেছনে একটা শঙ্কা রয়ে গেল। জজ সাহেব মন্তব্য করলেন: ইমাম সাহেব এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এটি ঠিক হয়নি। অভিযােগ ছিল দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যাংক থেকে ঋণ যে-কেউ নিতে পারেন নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে। সরকারি ক্ষমতায় না-থেকেও নিতে পারেন, থেকেও নিতে পারেন শর্ত পালন করে। যে ঋণ পরিশােধ করা হয়েছে সুদসমেত, ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাে আমি অনুরােধ করেই সুদ মওকুফ করাতে পারতাম। তাও তাে নয়। এসব মামলায় জড়িয়ে আমার ব্যক্তিগত মান-সম্মানের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। আমার অতি কাছের মানুষও আমাকে ভুল বুঝেছেন। তাঁদের কারাে কারাে সঙ্গে আমার দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে।
কারাগার থেকে মুক্ত হলাম বটে, এরশাদ সাহেব পিছু ছাড়লেন না। সরকারের কাছে চাকুরিতে পুনর্বহাল হওয়ার দরখাস্ত করতেই (আমাকে সাময়িক বরখাস্ত অর্থাৎ suspend করা হয়েছিল) সরকার নতুন করে আমার বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল তদন্তের নির্দেশ দিলেন। সাসপেনশনের হুকুম বহাল রইল। বিভাগীয় অসদাচরণের জন্য অভিযােগগুলি সামরিক আদালতের শুধু অনুরূপ নয়, হুবহু এক ও অভিন্ন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট (২৬) থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কারাগার (এবং সামরিক আইনে বিচার); তারপর পুরাে ১৯৭৬ সাল বিভাগীয় তদন্ত ও বিচার। সৌভাগ্যবশত বােরহানউদ্দীন আহমেদ সাহেবকে (১৯৫০ ব্যাচের সি. এস. পি.), যিনি সততা এবং নির্ভীকতার জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন, সরকার তদন্ত কারী অফিসার নিয়ােগ করলেন। সেখানেও দুর্নীতি দমন বিভাগ আগের মতােই তাদের সুদীর্ঘ বক্তব্য বয়ান করল। আমি মাথা উঁচু করে আগের মতােই তাদেরকে নস্যাৎ করলাম। সব শুনে আগের প্রথম মার্শল-ল কোর্টের মতাে বােরহানউদ্দীন সাহেব আমাকে নির্দোষ বলেই ক্ষান্ত হলেন না, পুলিশ এবং সরকারকে তিরস্কার করলেন আমাকে হয়রানি করার জন্য। আমাকে অবিলম্বে চাকুরিতে বহালেরও পরামর্শ দিলেন।
আমি যাতে কোনােক্রমেই ভালাে পদে ফিরে যেতে না পারি তার ষড়যন্ত্র চলতেই থাকল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী শফিউল আজম তখন মন্ত্রিপরিষদ-সচিব। ২৬ আগস্ট ১৯৭৫ (আমি গ্রেপ্তার হবার দিন) থেকেই মােশতাক কর্তৃক নিয়ােজিত। তিনি ইতিমধ্যে নানা টালবাহানা করে, আমরা যারা ইতােপূর্বে সচিব ছিলাম তাদেরকে, একধাপ নিচে নামিয়ে অর্থাৎ পদাবনতি করে অতিরিক্ত সচিবের পদে নিয়ােগ করেছেন। অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত করেও বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তা (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) নিয়ােগ করা হলাে সংস্থাপন বিভাগে। আমাদের সহকর্মী তুখােড় মেধাবী (সি.এস.পি.) মনােয়ারুল ইসলাম (যিনি জীবনে সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, ম্যাট্রিক থেকে সি.এস.পি. পরীক্ষা পর্যন্ত) বঙ্গবন্ধুর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর যুগ্মসচিব ছিলেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে বেশ কয়েকজন অফিসারকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (O.S.D.) করা হল পরপর।
প্রসঙ্গক্রমে আমার বেশ কয়েকটি কথা মনে পড়ছে। স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও প্রতিষ্ঠা এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। এর সরকার ছিল বিপ্লবী সরকার, প্রথম সরকার; কোনাে উত্তরসূরি সরকার নয়। সাবেক পাকিস্তানি বা পূর্বপাকিস্তানি সরকারের সাথে আমাদের কোনাে সম্পর্কই ছিল না। তাদের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আমাদের বহাল করার কোনাে কারণ ছিল না। তবুও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দেশকে দ্রুত এগিয়ে নেবার যুক্তিতে তাদের পুনর্বহাল করা হয়েছিল। এরাই ক্ষমতা দখল করে আমাদের জেলে পুরল, চাকুরিতে পদাবনতি ঘটাল।
দ্বিতীয়ত আমাদের যখন পদাবনতি ঘটিয়ে বা বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়, সে-সময় সেনাবাহিনীতে যারা মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন, তাদের বেলায় তাে পদাবনতির প্রশ্ন ওঠেইনি। তারা তাে দুই ধাপ, তিন ধাপ প্রমােশন পেয়েছিলেন (মেজর থেকে জেনারেল, লেফটেন্যান্ট থেকে কর্নেল ইত্যাদি)। আমি খুবই আশা করেছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমান, যিনি আমাদের সাথে এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ন্যায়বিচার করবেন—মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়াবেন। পরে বুঝলাম স্বৈরাচারী এরশাদ এবং তার দোসরদের কাছে তিনি কত অসহায়—যার চরম মূল্য তাকে দিতে হয়েছে।
তৃতীয়ত এর আগে বঙ্গবন্ধু এমন এক সিদ্ধান্ত নেন যার মূল্য তাঁকে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল বলে আমার মনে হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানি বাঙালি সেনা অফিসার এবং জোয়ানদের কোনােরকম যাচাই-বাছাই না-করে ঢালাওভাবে চাকুরিতে বহাল করেছিলেন। তাদের পদোন্নতিও দিয়েছিলেন। বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেলায়ও তাই। (অবশ্য শফিউল আজমের মতাে পাকিস্তানপ্রেমী দেশদ্রোহীদের চাকুরিতে বহাল করার প্রশ্নই ওঠে না, বঙ্গবন্ধু তা করেনও নি। খুনী মােশতাক এই কর্মটি করেছিলেন।)।
১৯৭৭ সালের শেষদিকে বিভাগীয় তদন্ত থেকে সসম্মানে মুক্ত হবার পর আবার আবেদন করলাম আমাকে সচিব-পদে নিয়ােগের এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমার প্রাপ্য বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদানের বিধি অনুযায়ী আমার এটা অবিলম্বে পাওয়ার কথা। তখন দুয়েকজন সহকর্মীর বিদ্বেষ এবং হীনমন্যতা এত প্রকট ছিল যে তা কোনােদিন ভুলবার নয়। মেজর জেনারেল (অব) নূরুল ইসলাম (শিশু), যিনি শহীদ তাজউদ্দীনের সামরিক সচিব ছিলেন, ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি ঐ সময় বিরাট ক্ষমতাধর ব্যক্তি। রাজনৈতিক দল ভাঙছেন, গড়ছেন। পরবর্তীকালে মন্ত্রীও হলেন। গেলাম তার সাথে দেখা করতে। আমার চাকুরি ফিরে পাবার কথা শুনে তার প্রথম প্রশ্নই হল: আপনি এত টাকা একসাথে পাবেন?’ তার প্রশ্নে ব্যঙ্গাত্মক সুর ধ্বনিত হল।
আইনের বাইরে যেতে না-পেরে অবশেষে আমার সাসপেনশনের আদেশ বাতিল করা হলাে। কিন্তু ও.এস. ডি. পদে রেখেই আমাকে দায়িত্বও দেওয়া হল: প্রজেক্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ প্রশাসনিক স্টাফ কলেজ; যার প্রিন্সিপাল পুলিশের প্রাক্তন অফিসার আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযােগ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু যে-কুমিরকে খাল কেটে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সচিব পদে, রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে সরিয়ে—১৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের সাথে সাথেই দেখা গেল তার আনুগত্য কোথায়। মােশতাক এবং সামরিক বাহিনীর বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট; রাষ্ট্রপতির সচিব থেকে স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল এবং পরে সংস্থাপন-সচিব।
প্রজেক্ট ডিরেক্টর (কিন্তু ও. এস. ডি.) পদটি পাওয়ার আগে কয়েক মাস আমার খুবই কষ্টে গিয়েছে—মানসিক ও দৈহিক। আমাকে কোনাে গাড়ি দেওয়া হয়নি, টেলিফোন ছিল না। একমাত্র সরকারি বাংলােটি ছিল—–আমাকে পূর্বের বরাদ্দকৃত ৩ নম্বর টেনেমেন্ট হাউস, ইস্কাটন গার্ডেন রােড। প্রচণ্ড চাপের মুখে অনেক সময় মনে করেছি পদত্যাগ করব, তারপরেই মনে হয়েছে: আমি তাে কারাে দয়ায় বা করুণায় চাকুরি পাইনি—সরকারে থাকা আমার অধিকার। সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে সি.এস.পি. হয়েছিলাম। আত্মিক তাগিদে স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, সরকার সংগঠন করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি; এদেশ আমার, সরকারও আমাদের। সাময়িকভাবে বহিঃশত্রুর এজেন্ট, দেশদ্রোহী কিছু লােক ক্ষমতা দখল করেছে, সুদিন একদিন আসবেই। যথাসময়ে, আমার পছন্দ মতাে ক্ষণে সরকার থেকে অবসর নেব, এই ছিল সিদ্ধান্ত।
স্টাফ কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করার সময় মনে হলাে: এত ব্যয় করে শুধু স্টাফ কলেজ কেন? মধ্যম সিনিয়রিটি অফিসারদের জন্য নিপা (NIPA) এবং নতুন রিক্রুট (প্রবেশনার)-দের জন্য COTA (Civil Officers Training Academy)-কেও একই জায়গায় (Campus-এ) একটি বড়সড় কমপ্লেক্স করলে কেমন হয়? NIPA (National Institute of Public Administration) এবং COTA-এর দুটোরই স্থান সঙ্কুলান যেমন। হচ্ছিল না, তেমনি এদের অবস্থান ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। নিপাছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতর; কোটাছিল পি.জি. হাসপাতালের পার্শ্বে। আমার প্রস্তাবটি সকলেই মেনে নিলেন। ভালাে সমর্থন পেলাম কোটা-র তৎকালীন অধ্যক্ষ খালেদ শামস্-এর কাছ থেকে। আর পেলাম মুজিবুল হক সাহেবের সমর্থন, তিনি তখন পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য। ঢাকা শহরে স্থানাভাব থাকায় স্থির করলাম সাভারে নিয়ে যাব পরিকল্পিত লােক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স (Public Administration Training Complex), সংক্ষেপে (PATC)। এই প্রকল্পের উদ্ভাবক আমি, প্রকল্প-প্রণয়নকারী আমি এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ও উদ্বোধন আমার দ্বারাই। এটি আমার গর্বের বিষয়। পরে এটার নাম হয় লােক প্রশাসন প্রশিক্ষণ সেন্টার (Public Administration Training Centre)। অবশ্য সাভারে যাবার প্রস্তাব করার পর। প্রবল বাধা এসেছে। সমালােচনা হয়েছে প্রচুর।
এই প্রকল্প প্রণয়ন, সংগঠন, বাস্তবায়ন, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়েছে; করেছি অক্লান্ত পরিশ্রম। ছয়টি বছর ছিলাম প্রকল্প-পরিচালক (এবং অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদায় ও.এস.ডি.)। ঐ সময়টাতে নিজের একটি ভিন্ন জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিলাম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে, ক্ষমতাধরদের দৃষ্টির আড়ালে। নিজেই চেষ্টা করে বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং ইউ.এন.ডি.পি. (UNDP)-কে এই প্রকল্পে আকৃষ্ট করি। তাদের সাহায্য আর সমর্থনে আস্তে আস্তে গড়ে তুলি প্রতিষ্ঠানটি। ঐ সময়টাতে (৬ বছর) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছি ঐসব দেশের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলাে দেখার জন্য; অবশ্য ব্যয়ভার বহন করেছে বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং ইউ.এন.ডি.পি. (UNDP)।
১৯৮৩ সালে পি.এ.টি.সি.-র উদ্বোধন করলেন বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে তখনকার চিফ মার্শাল-ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (CMLA) এবং রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ। ছয় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি তখন ক্লান্ত। যথেষ্ট বয়সও হয়েছে, চাকুরিতেও জ্যেষ্ঠ। তৎকালীন সংস্থাপন-মন্ত্রী মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর সাথে দেখা (অবশ্য এমনিতেও ঘন ঘন দেখা হতাে) করে বললাম যে, আমার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ফিরে আসার সময় অতিক্রান্ত, আমি রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎকার চাই। চৌধুরী সাহেব ব্যবস্থা করে দিলেন।
সেনাভবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অন্য আরেক এরশাদের সাক্ষাৎ পেলাম। অনেক কথা বললাম তাকে। মােদ্দা কথা, সিভিল সার্ভিসে আমার অবস্থান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংগঠনে আমার অবদান এবং ত্যাগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ইত্যাদি। একটি কথা বিশেষ করে মনে করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু এবং তার সুযােগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে আমরাই এদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। শুধু তাই নয়, ঐ ভিত্তির ওপর অট্টালিকাও আমাদেরই নির্মিত। স্বাধীন, সার্বভৌম সরকারের যা যা বৈশিষ্ট্য, যেমন সংবিধান, সরকারের সংগঠন, বিন্যাস, মন্ত্রণালয় বিভক্তি, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যপ্রণালী বিধি (Rules of Business, Rules for the Allocation of Business এবং Rules for the Transaction of Business), অত্যাবশ্যক অঙ্গসংগঠন, যেমন জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল বা NEC, তার কমিটি (EC of NEC), পরিকল্পনা কমিশন; বহিঃসম্পদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশে দূতাবাস স্থাপন, জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা বিধি, জাতীয় প্রতীক ( national emblem) এবং আরও অজস্র কাজ আর প্রতিষ্ঠান গঠন—সবই আমার আমলে এবং আমার চোখের সামনে হয়েছে। এসব এখন যারা সরকার পরিচালনা করছেন এবং তাদের আগে যারা পরিচালনা করেছেন তারা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সরকারের হাতে-গড়া সবকিছু উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিল বলেই সরকার পরিচালনা করতে পারছেন। যেমন রাষ্ট্রপতির শপথ, মন্ত্রীদের শপথ এবং অন্যান্য যে-সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় কাগজপত্র (মনে হয় সামান্য কাজ কিন্তু সময়ে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ) তারা ব্যবহার করেন—সব আমার নিজের এবং আমার সহকর্মীদের পরিশ্রমের ফসল। আজ পর্যন্ত এর কোনােটির দাড়ি-কমাও পরিবর্তন হয়নি।
আমার কথা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সেদিন শুনেছিলেন এরশাদ সাহেব। পরে আমাকে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিরাট নেতা ছিলেন। বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য আপনার এত ঝামেলা যাচ্ছে। আমি দেখব।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। সংস্থাপন মন্ত্রীর কাছে আমি শুনেছিলাম যে PATC উদ্ভাবন এবং সৃষ্টিতে উনি আমার খুবই প্রশংসা করেছিলেন।
১৯৮৪ সালে সড়ক ও সড়ক যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্তির পর আবার প্রচণ্ড চাপ পড়ল। ঐ সময়টাতে সারাদেশে উপজেলা সংযােগকারী সড়ক, বড় বড় সেতু, বিচ্ছিন্ন স্থানগুলিতে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ-বিরাট একটা কর্মযজ্ঞ যেন। অধিকন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজে কাজ দেখতেন, তদারক করতেন, যখন-তখন টেলিফোন করে খবর নিতেন। এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন নতুন প্রকল্প এলাকায় বা নির্মাণ স্থলে। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গে যত বড় সেতু ও সড়ক, বড় বড় জনপথ (highway), বুড়িগঙ্গা সেতু (চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী), মেঘনা-গােমতি (জাপান), মেঘনা (জাপান), শম্ভুগঞ্জ (ময়মনসিংহ-ব্রহ্মপুত্র-চীন), নওয়াবগঞ্জ (মহানন্দা-চীন), গাইবান্ধা (ঘাঘট), দিনাজপুর (কাঞ্চন) ইত্যাদি প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য যােগাযােগব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে ঐ সময় (১৯৮৪-৮৬)। ভােলায় হেলিকপ্টারে আমাকে নিয়ে গেছেন ভােলা-চরফ্যাশন রাস্তা নির্মাণের জন্য। এক বছরের মধ্যে সেটি নির্মিত হলে আবার আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে উদ্বোধন করেছেন। সাথে নাজিউর রহমান মঞ্জু আর মেজর হাফিজউদ্দীন।
যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প আরম্ভ করার যাবতীয় কাজ, যেমন প্রাক-সম্ভাব্যতা (pre feasibility), সম্ভাব্যতা (feasibility), যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষ স্থাপন; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ও অন্যান্য দাতাদের সম্পৃক্তকরণ, প্রকল্প সাহায্য সংগ্রহ, বিশেষজ্ঞ দল (Panel of Experts) নিয়ােগ, দেশের অভ্যন্তরে সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে যমুনা সেতু সেস (cess) আরােপ—এই সমস্ত কাজ আমি করেছি এরশাদ সাহেবের অনুমােদনক্রমে। আমার প্রস্তাবেই সেস (cess) আরােপ করা হয়। যমুনা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে, যার সদস্য-সচিব ছিলাম আমি। বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামাে স্থাপন ও উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট এরশাদের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য।
১৯৮৭ সালে আরম্ভ হল আরেক খেলা। বছরের প্রথমদিকে যমুনা সেতু নির্মাণের যাবতীয় প্রস্তুতি-পর্ব শেষ। বিশ্বব্যাংক তাদের সমীক্ষা শেষ করে লন্ডনের উপকণ্ঠে আলােচনাসভা আহ্বান করে। এই সভার আয়ােজক ছিলেন (Feasibility study-র) মূল ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান RPT (Rendel, Palmer &Tritton) এবং বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ দল এতে অংশ নেয়। এই বিশেষজ্ঞ দলে আমি আমাদের দেশীয় দুইজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও ড. আইনুন নিশাতকে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছি। এঁদের নিয়ে আমি বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিলাম। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল সেতুর স্থান, নির্মাণশৈলী, প্রকৃতি (ডিজাইন), নদী-শাসন, গাইড বাঁধ নির্মাণ, সংযােগ সড়ক (Approach Road) ইত্যাদি বিষয়ে।
আমি যখন লন্ডনে, সেই সময় আমার স্ত্রী সংবাদ দিলেন যে আমাকে পরিকল্পনামন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। দেশে ফিরে ষড়যন্ত্রটা টের পেলাম। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে (যােগাযােগের) এরশাদ সাহেব যখন আমার ওপর নির্ভর করতে আরম্ভ করলেন, আমি আমার যােগ্যতা দিয়ে তার আস্থা অর্জন করলাম, তখনই শুরু হলাে পুরােনাে ফিসফাস, কানকথা। তদুপরি যমুনা সেতু নির্মাণের যারা বিরােধী ছিলেন (দুর্বলতম প্রতিপক্ষ ভেবে) লেগে পড়লেন। আরেক দলের আক্রমণ শুরু হলাে যমুনা সেতু নির্মাণের স্থান নির্বাচন নিয়ে। আমি (এবং বিশেষজ্ঞরা) আগাগােড়া বলে এসেছি যে, স্থান নির্বাচন বিষয়টি সম্পূর্ণ নদী নিয়ন্ত্রণ এবং সেতু নির্মাণ প্রকৌশলের ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলীরা যা বলবেন সেটাই মানতে হবে। রাজনৈতিক বা আঞ্চলিক আবেগ দিয়ে স্থান নির্বাচন করা যায় না। ছয়টি সম্ভাব্য স্থানের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিকভাবে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন সেটি ভূঞাপুর-সিরাজগঞ্জ করিডােরের পক্ষে।
আমাকে যারা পছন্দ করতেন না (আড়ালে আবডালে বাকশালী, মুজিববাদীগাল দিতেন, যার অপর অর্থ মুক্তিযােদ্ধা) তারা একটা সুযােগ পেলেন। যােগাযােগ মন্ত্রী (তখন ড. এম. এ. মতিন) ও আমি দুজনেই সিরাজগঞ্জের, অতএব এটা আমাদেরই কারসাজি। এই একটা ইস্যুতে নির্মাণকাজ পিছিয়ে গেল। আরেকটি বড় বিষয় এই সময়ে পরিষ্কার হতে শুরু করল। যমুনা সেতু নির্মাণ যখন একরকম নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হবে, পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানি আসা-যাওয়া শুরু করল—তাদের সাথে দেশীয় এজেন্টরাও হলেন তৎপর। চারদিকে টানাপড়েন এবং ফিসফাস (whisper) কথাবার্তা। অনেকেরই প্রকৃত রূপ জানতে পারলাম। নেপথ্যের অনেক নায়কের নাম পরে জেনেছি। এরা প্রথমে আমাকে পরিকল্পনামন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করলেন সচিব পদে। সেখানে পদাধিকার বলে আমি ভৌত অবকাঠামাে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশন সদস্য। আর এই দায়িত্ব পালনে আবার যমুনা সেতু প্রকল্পে জড়িয়ে পড়লাম। ফলে নতুন ষড়যন্ত্র আর টেনশন।
অবশেষে ঠিক করলাম, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। মান-সম্মান নিয়ে নিজে বেরিয়ে যাওয়াই ভালাে। চাকুরি যখন ২৭ বছরের বেশি, পেনশন নিয়ে অবসরে যেতে পারি। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি অবসরের (retirement) আবেদন করলাম। আমার আবেদনের সময় জানতে পারলাম সরকার আমাকে রিটায়ার (retire) করিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করছে। সেজন্য আমার ইচ্ছা তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হল। ১৯৮৮ সালে সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। মাঝখানে এক বছর প্রস্তুতিমূলক ছুটি LPR (Leave Preparatory to Retirement)। এই সুদীর্ঘ সময় অখণ্ড অবসর। এটাই ছিল লেখার প্রকৃষ্ট সময়। এটা নষ্ট করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।
সরকারি চাকুরি থেকে বের হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর পরের গােলামি নয়। ১৯৮৮ সালে আমার বয়স ৫০-এর কোঠায়। তখন যথেষ্ট কর্মক্ষম। ১৯৮৯-৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় হলাম বন্ধুবর মােনায়েম সরকারের অনুরােধে। গ্রামেও ঘুরলাম অনেক। ‘৯৩-৯৪ সালে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ কাজ করে দিলাম হানিফের পক্ষে। ১৯৯৬ সালে আবার অনুরােধ। ঐ সময় বেশ কাজ করেছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী আসাফউদ্দৌলা পরিশ্রম করলাম। সময়ও দিলাম অনেকটা। নির্বাচনের পর আমাকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলাে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রহণ করলাম (অনীহার কারণ আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং সরকারি মর্যাদার তুলনায় এই কাজটি নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়েছে)। চাকুরিজীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় আমার এই অনিচ্ছা কিন্তু সঠিক প্রমাণিত হল। যারা আমাকে এই দায়িত্বে বসালেন, তাঁদেরই কেউ কেউ আমার আড়ালে ভিত্তিহীন কথাবার্তা শুরু করলেন। যারা এমন কথাবার্তা বলছিলেন, তারা নিজেদের সৎ নাগরিক মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা তা নন। বন্ধুপ্রতিম ও একই মতাবলম্বী সহকর্মীগণ অনর্থক কুৎসা রটান বটে, কিন্তু এতে তাদের কোনাে লাভ নেই। বরং প্রতিপক্ষকে তারা সুযােগ করে দেন রটনা থেকে ফায়দা লুটতে।
জীবনের শেষপ্রান্তে যখন নিজের সামনেই প্রশ্ন: শেষ করতে পারব তাে? বিরাট একটা তাগিদে আমার এই বই লেখা। দেশ ও জাতির কাছে আমার দেনা পরিশােধ—এটাই বড়াে তাগিদ। ইতিহাসের চরম সংঘাতপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল সময়ে আমি অনেক কিছুরই প্রত্যক্ষদর্শী এবং জিম্মাদার। আমার সমসাময়িক ব্যক্তিরা জানতে চান স্বাধীনতাযুদ্ধের, মুজিবনগরে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ তথ্য আর বিবরণ। আর বর্তমান প্রজন্ম এবং আমাদের উত্তরসূরিদের অবশ্যই জানার অধিকার আছে পূর্ণ ইতিবৃত্ত। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময়ে অনেক অপচেষ্টা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার। মুজিবনগরে গঠিত সরকারের ভাবমূর্তি স্নান করার পরিকল্পনা চলছেই। এই প্রবণতায় বাধা দিতে আমার ক্ষুদ্র চেষ্টায় এই লেখা। একই সাথে আমার জান্নাতবাসিনী স্ত্রী আর আমাদের সন্তানদের বহুদিনের দাবি পূরণ করব বলেই এই বিনম্র প্রয়াস।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: জনযুদ্ধ

জনযুদ্ধ বা People’s war বলতে আমরা যা বুঝি সেই সংজ্ঞাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই একটি অনন্য জনযুদ্ধ ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ এবং অসীম ত্যাগ স্বীকারই তাে জনযুদ্ধের প্রধান উপাদান। আমাদের সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর জন্ম জনগণের মধ্যে, লালনও জনতার আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এত ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে। ভিয়েতনামে আমরা সেটি দেখেছি। হাতেগােনা কয়েকজন দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনা অফিসার ও পুতুল রাজনীতিবিদ ছাড়া কেউই দক্ষিণ ভিয়েতনামী সরকার তথা আমেরিকানদের সমর্থন করেনি। শহরে, গ্রামে, বন্দরে, ধানক্ষেতে, খাল-বিলে, দেশের আনাচে-কানাচে নির্ভয়ে বিচরণ করত ভিয়েতকং গেরিলারা। জনগণের মাঝে ওঁৎ পেতে থাকত, সুযােগ-সুবিধামতাে আকস্মিক হামলা চালাত শত্রুর ওপর। এর পরিণাম কোনাে–কোনাে সময় ভয়াবহ হয়েছে নিরীহ জনগণের জন্য। গ্রামের-পর-গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে, নির্বিচারে গুলি চলেছে গ্রামবাসীদের ওপর, বােমা ফেলে গ্রাম-জঙ্গল ভস্ম করে দিয়েছে আমেরিকান আর দক্ষিণ ভিয়েতনামী তাঁবেদার বাহিনী, মাইলাইয়ের মতাে কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই হত্যাকাণ্ডে নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি। আমাদের এই বাংলার মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে সহস্র মাইলাইয়ের। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছিল “Bangladesh-A Thousand Mai Lai” শিরােনামে। ফিলিস্তিনেও চলছে মানবতাবিরােধী হামলা। বাড়িঘর ধূলিসাৎ করা হচ্ছে, নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নারী-শিশুকে, হাতিয়ার তুলে নিচ্ছে তাই মেয়েরা, মানব-বােমা হয়ে ধ্বংস করছে ইসরাইলীদের। এই যে, জনযুদ্ধের দুই মহােত্তম উদাহরণ, এর চাইতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি কম ছিল ১৯৭১ সালে? এখানেও তাে আবালবৃদ্ধবনিতা এগিয়ে গেছে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সকল স্তরের মানুষ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, বহন করেছে রসদ। প্রয়ােজনবােধে কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে শত্রুর মােকাবিলার জন্য নিজেরাও অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের চারদিকে গড়ে-ওঠা অজস্র আশ্রয়-শিবির পরিণত হয়েছে যুবশিবিরে। সেখান থেকে বের হয়েছে মুক্তিযােদ্ধা। সম্মুখসমর, গেরিলাযুদ্ধ, শত্রুর ওপর আকস্মিক ঝাপিয়ে পড়া, সড়ক-সেতু, বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন, সরবরাহ লাইন গুড়িয়ে দেওয়া, তথ্য সংগ্রহ, গােয়েন্দাগিরি, চিকিৎসাসেবা প্রদান, মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিটে সংযােগ স্থাপন, দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্রভাণ্ডার (arms cache) গড়ে-তােলা—হেন কাজ নেই যা আমাদের বীর জনগণ করেনি। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, শ্রমিক বুদ্ধিজীবী, সকলে এই কাতারে শামিল ছিল—নির্ভয়ে এবং স্বেচ্ছায়।
পরিণামে ভিয়েতনামে যা ঘটেছিল, ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, আমাদের এই বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। সাধারণ মানুষের ওপর, জনগণের ওপর নেমে এসেছে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিকাণ্ড, সাধারণ মানুষকে বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে নিরাশ্রয় করা হয়েছে এদেশে। পাকিস্তানিদের সাথে তাদের এদেশের দোসর রাজাকার, আলবদর, জামায়াত, মুসলিম লীগ নামধারি ইসলামের তথাকথিত ধ্বজাধারী খুনি-লুটেরা বাহিনীও উল্লিখিত দুষ্কর্মে যােগ দেয়।

পৃষ্ঠা: ২
এটা নতুন কিছু নয়। যে-কোনাে দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিদেশি শত্রুর পদলেহনকারী কিছু লােক থাকে। শুধু ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইনে নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনের পদলেহী বিশ্বাসঘাতক কিছু বাঙালি সমগ্র জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছে। বাংলাদেশে বেইমানরা কেমন আছে! তারা স্বাধীনতার শত্রু, জনগণের শত্রু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের বলা হতাে পঞ্চম বাহিনী (Fifth Column)। নরওয়েতে পুতুল প্রধানমন্ত্রী (জার্মানদের তাঁবেদার) কুইসলিং-এর নামানুসারে ষড়যন্ত্রকারীদের গােটা ইউরােপে অত্যন্ত ঘৃণাভরে বলা হতাে কুইসলিং। জনগণের শত্রু বােঝাতে এই ‘গালি’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতাে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই সারা বাংলাদেশে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল জনগণ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নেতৃত্ব এসেছে স্বতস্ফূর্তভাবে। ঐ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক হামলায় সমগ্র জাতি হতচকিত হয়ে যায়। কিন্তু হতাশ হয়নি কেউ। জাতি যাদের কাছে নেতৃত্ব আশা করেছে, তারা সাধ্যমতাে এগিয়ে গিয়েছেন। কোনাে জায়গায় সেনা অফিসার, কোথাও জেলা ও মহকুমা প্রশাসক, অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তা ও কর্মচারী, কোথাও ইপিআর বা পুলিশ অফিসার, কখনও নির্বাচিত এম.এন.এ., এম.পি.এ, কখনও স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা ন্যাপ না হয় অপরাপর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কোনাে-কোনাে স্থানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনাে বুদ্ধিজীবী। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহবান—তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে; ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলােজনগণের মধ্যে দুর্বার প্রতিশােধ স্পৃহা এবং এক অপূর্ব প্রেরণা জুগিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দকে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ান এবং স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে (কমিশনার, ডি. সি., এস.ডি.ও-দের) যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য পৃথকভাবে কোনাে ডাক দিতে হয়নি, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের পর থেকে সমগ্র দেশে একটা সাজ-সাজ রব উঠেছিল। এ স্মৃতি এখন ইতিহাস।
সেনাছাউনি বা সেনানিবাস (cantonment) ছিল, এমন সব স্থানেই অধিকাংশ অফিসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন—অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা তাঁদের করণীয় কাজে আত্মনিয়ােগ করতে। আমরা যারা বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলাম তারা দ্রুত প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে সীমান্ত-অঞ্চলের জেলাগুলিতে যেভাবে প্রকাশ্যে প্রস্তুতি সম্ভব ছিল, ভেতরকার জেলাগুলিতে তা ছিল না। আবার বেশ কয়েক জায়গায় পাকিস্তানি সেনা হাইকমান্ড বাঙালি ইউনিটগুলি (বিশেষ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলিকে) বিক্ষিপ্তভাবে সরিয়ে দিয়ে পরস্পরের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ই.পি.আর-এর ইউনিটেও পশ্চিমা অফিসারদের গােপনে নির্দেশ দিয়েছিল বাঙালি ইউনিটের বর্ডার আউটপোেস্ট (B.O.P.)-গুলাে থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলতে। ঐ তৎপরতা আমাদের বীর অফিসাররা অনেকেই পূর্বাহ্নে আঁচ করেছিলেন এবং তার পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। গাজীপুরে মেজর কে.এম. সফিউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর শাফায়াত জামিল; যশােরে মেজর আবু ওসমান; চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর মীর শওকত আলী; ময়মনসিংহে মেজর নূরুল ইসলাম (শিশু), কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী এবং আরও অনেকে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খােদ ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে যারা ছিলেন বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কিংবা ই.পি.আর.-এর পিলখানায়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, অথবা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অভ্যন্তরে (পাকিস্তান বাহিনী পরিবৃত হয়ে) ই.বি.আর.সি.-তে তাঁদের অবস্থা ছিল সর্বাপেক্ষা নাজুক। পরিণামে যুদ্ধের প্রথম রাতে এদের উপর আকস্মিক হামলা-প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল না। অজস্র হতাহত হয়েছেন; শহীদ হয়েছেন ঐ রাতের আক্রমণে।
আমরা যারা ঢাকা থেকে দূরে ছিলাম, বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে, তাদের অবস্থান সুবিধাজনক ছিল। আর এই কারণেই ঢাকার বাইরে প্রতিরােধ হয়েছে প্রবল। জেলা-মহকুমা শহরগুলিতে শত্রুদের পৌছুতে যেমন দেরি হয়েছে, তেমনই হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি। সেই সময়ে আমরা পুনগঠিত হওয়ার এবং শক্তি সঞ্চয়ের সুযােগ পেয়েছি। জেলাগুলির দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে সক্ষম হব কী অসীম সাহসিকতার সাথে বেসামরিক প্রশাসকগণ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সেনা অফিসার (কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত), ই.পি.আর, পুলিশ সকলকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন প্রতিরােধযুদ্ধে জনতার কাতারে। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, সামরিক অফিসার, পুলিশ, বেসামরিক আমলা একাত্ম হয়ে গেছেন এক লক্ষ্যে: শাসনশােষণ অত্যাচার থেকে মুক্তি চাই।
বেশ কয়েকটা স্থানে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, কলেজে প্রবীণ-নবীন শিক্ষকগণ প্রতিরােধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সংগঠন করেছেন। আবার বেশ কয়েকটি স্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকৌশলী অথবা ডাক্তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. এ. আর. মল্লিক নিজে সংগঠিত করেছেন পুলিশ, ই.পি.আর, ছাত্র-জনতাকে। এক জায়গায় সমবেত করে, প্রয়ােজনীয় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে তাদের চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন। তেমনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানচিত্র লক্ষ্য করলে একটা ধারণা হবে বাংলাদেশের জনযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে। দেশের প্রতিটি নগরে, জেলাশহরে, মহকুমায়, থানায়-থানায়, বড় বড় গঞ্জে-বন্দরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, মেহেরপুর থেকে তামাবিল, কুয়াকাটা থেকে পঞ্চগড় একসাথে জনগণের রােষানল জ্বলে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মার্চের সংগ্রামী দিনগুলিতে। গােটা বাঙালি জাতি ফুঁসে উঠেছিল পশ্চিমাদের নৃশংস আক্রমণের খবর পেয়ে। জাতির ঐ ক্রান্তিলগ্নে আমাদের স্বতস্ফূর্তভাবে গড়ে-ওঠা জনগণের বাহিনী, সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীগুলাে, স্থানীয় প্রশাসন জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এক কাতারে। যুদ্ধ করেছে একসাথে, শহীদও হয়েছে একই আদর্শের জন্য। তখনাে তাে কোনাে ভেদাভেদ ছিল না। জনগণের বিভিন্ন স্তর থেকে নেতৃত্বও এসেছে। স্বতস্ফূর্তভাবে-কখনও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিরা, কখনও সেনা নায়কেরা, আবার কখনও স্থানীয় প্রশাসন বা উপস্থিত স্বনামধন্য কোনাে ব্যক্তি।
এই জনযুদ্ধে সীমান্তবর্তী জেলা বা অঞ্চলগুলিতে স্বাভাবিক ভৌগােলিক অবস্থাগত কারণে একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। পার্শ্ববর্তী ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর সাহায্য এসেছে। প্রয়ােজনে অস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহ করা গেছে সহজে। বিপদে আশ্রয় পাওয়া গেছে, যেখান থেকে আবার নবােদ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় এই সুবিধা ছিল না। উপরন্তু এখানেই শত্রুসেনা সমাবেশ, ভারী অস্ত্র এবং ট্যাংক বহর থাকায় নিরস্ত্র, অসহায় জনগণ মৃত্যু আর ধ্বংসের কবলে পড়েছে বেশি। ঢাকার চতুর্দিকে, যেখানে সামান্যতম সময় ও সুযােগ পেয়েছেন আমাদের সেনা-অফিসার, ই.পি.আর.পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন সেখানেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায়, প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। ঢাকার গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, বরিশাল, বগুড়া—সবখানেই এই জনযুদ্ধের পরিচয় পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত জেলাগুলােতে অতিরিক্ত সুবিধার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল কোনাে কোনাে স্থানে, যেমন রংপুরে সেনানিবাস থাকায় সাধারণ মানুষের তথা জনগণের অসুবিধা হয়েছে বেশি। তার ওপর ওখানে বসবাসরত অবাঙালিদের বিরাট একটা অঞ্চল ছিল সৈয়দপুরে। এরা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরােধিতা করেছে। রাজশাহীতেও পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা-সমাবেশ ছিল। এখানে আমাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যশাের সেনানিবাসে পাকিস্তানিরা অনেকদিন অবরুদ্ধ ছিল। ময়মনসিংহে মেজর নূরুল ইসাম (সফিউল্লাহ্-র ব্যাটালিয়নের এবং তাঁর নির্দেশে) স্থানীয় ই.পি.আর, পুলিশ ও জনতাকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানিদের পর্যদস্ত করেন, কিন্তু যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তাকে। কুমিল্লায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান বাহিনী প্রথমেই আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে। নােয়াখালীতে জনযুদ্ধের চিত্র ছিল ভিন্ন। জেলা প্রশাসক মনযূর-উল-করীমের নেতৃত্বে এবং বেশ কয়েকজন সেনা-অফিসারের সহায়তায় তারা বিরাট প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমগ্র অঞ্চলে শত্রুবাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারেনি মেজর খালেদ মােশাররফের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রখর চিন্তা এবং ক্ষিপ্র তৎপরতার কারণে—যেমনটি করেছিলেন গাজীপুরে মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিক, কুষ্টিয়ায় মেজর আবু ওসমান।
মুক্তিযুদ্ধের বীর-গাথা অজস্র। তেমনই অসংখ্য ঘটনা আছে প্রতিরােধ যুদ্ধের। সেসব কাহিনী অনেকে লিপিবদ্ধ করেছেন, আবার অনেক কথা বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। কিন্তু ইতিহাস সত্য তুলে ধরবে। ইতিহাসের প্রকৃতিই তাই। যেভাবে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হচ্ছে পাকিস্তানি এবং তাদের দোসরদের গণহত্যার বিবরণ, তাতে শুধু করুণা হয় এই ভেবে যে, কুশাসকগণ ও তাদের পারিষদবর্গ ইতিহাস থেকে কোনাে পাঠ গ্রহণ করে না। কারণ তারা এক ধরনের মােহে আচ্ছন্ন থাকে। যখন কোনাে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয়। এ-বিষয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি ও সংবাদপত্র দায়িত্ব পালন করে আসছেন বটে, তবু অনেক করার আছে এখনও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির। সরকারেরও বিশেষ দায়িত্ব আছে।
ওপরে চট্টগ্রামে প্রতিরােধ যুদ্ধের তেমন বর্ণনা দেইনি একটি মাত্র কারণে। সেটি হল স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর চট্টলা পৃথক আলােচনার দাবিদার। জিয়াউর রহমান, মীর শওকত আলী, রফিকুল ইসলাম, খালেকুজ্জামান, হারুন-অর রশিদ, লে. শমসের মুবিন চৌধুরী—এইসব বীর মুক্তিযােদ্ধার সমাবেশ ছিল এখানে। এখানেই আগ্রাবাদ ও কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের পথযাত্রা। এই চট্টগ্রামে ৩ মার্চ জনতার ঢলের ওপর পাকিস্তানি এবং অবাঙালিদের নির্বিচার গােলাগুলি বর্ষণে অগণিত মানুষ হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সফল প্রতিরােধ এবং বড় বড় সংঘর্ষও চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটেছিল। শুভপুর ব্রিজ, কালুরঘাট, মহালছড়ি, রামগড় চা-বাগানে ঘটেছিল বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ যুদ্ধ। এসব প্রতিরােধ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরেই রামগড়ে মেজর জিয়াউর রহমান এবং আমি ইস্টার্ন সেক্টর আর পূর্বাঞ্চল প্রশাসন গড়ে তুলি। বাংলাদেশের আর কোথায়ও এত দীর্ঘদিন শত্রুকে প্রতিরােধ করা যায়নি—২৬ মার্চ থেকে ২ মে পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকের সমাবেশ এখানে ঘটেছিল সর্ববৃহৎ। রামগড় থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শুভপুর ফেনী সেতু রক্ষা করার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে পাঠিয়েছিলেন

পৃষ্ঠা: ৫
একদিকে, আবার অন্যদিকে মহালছড়ি অঞ্চলে যুদ্ধরত মেজর মীর শওকত আলীর সাথে সমন্বয় করতে হয়েছে তাঁকে। এই সম্বনয়-কাজে আমি প্রত্যক্ষভাবে বহুবার জড়িত হয়ে পড়ি। অতি ঘন ঘন মীর শওকত আলী আমার শরণাপন্ন হতেন মেজর জিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ ও পরামর্শের জন্য ওয়ারলেস বা টেলিফোনের মাধ্যমে। আমাদের সাথে আরাে যােগ দেন মেজর শামসুদ্দীন (ই.পি.আর.), ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদির (মহালছড়ি যুদ্ধে শহীদ), ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইঞা প্রমুখ। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম আর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আগে থেকেই ছিলেন আমাদের সাথে।
চতুর্দিকে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী আর স্বেচ্ছাসেবকরা আহত হলে নিয়ে আসা হচ্ছে রামগড় হাসপাতালে ডাক্তার সেরাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। জেলা কাউন্সিলের প্রকৌশলীরা পার্বত্য অঞ্চলের ভেতরে প্রতিরক্ষার জন্য কখনও সেতু নির্মাণ করছেন, কখনও আবার তা ভাংতে হচ্ছে।
এ সময়ে আরাে দু-দল প্রকৌশলীর কথা মনে পড়ে যারা প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। এক দল The Engineers নামক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের, যারা করেরহাট-রামগড় সড়ক সেতুগুলি নির্মাণ করছিলেন, তাঁরাই আবার ঐসব সেতু ধ্বংস করেন পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ করতে। আরেক দল এসেছিলেন সেমুতাং-এর গ্যাস/তেল অনুসন্ধান প্রকল্প থেকে। রাশিয়ার সহযােগিতা ও সাহায্যে পাকিস্তান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কর্পোরেশনের অধীনে প্রকৌশলীদের অধিকাংশ ছিলেন রুশ ও মাত্র কয়েকজন ছিলেন বাঙালি। এখানে বেশ কয়েকজন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। The Engineers-এর প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে ছিলেন মি. দত্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রকৌশলী মাে. তাজুল ইসলাম এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী জ্যোতিবিকাশ চাকমাও এই সময়ে রামগড়ে চলে আসেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পাশাপাশি সাহসিকতার সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
রামগড় চা-বাগানের ম্যানেজার আওয়াল সাহেব তার বাগানের সমস্ত সম্পদ এনে জমা করেছেন আমাদের প্রতিরােধযুদ্ধ জোরদার করতে। ইলেকশন অফিসার আসাদুজ্জামান আর কৃষি ব্যাংকের শাহাবুদ্দীন সংগ্রহ করেছেন অর্থ, অন্যান্য রসদ আর জনবল। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীগণ যে যা পারছেন তাই দিচ্ছেন পশ্চিমদিক থেকে আগত মানুষের ঢলকে আশ্রয় আর খাবার সরবরাহের জন্য। রামগড় থানার দারােগা এবং ও.সি. রামগড়ে সমবেত অবাঙালিদের হাজতে নিরাপদে রাখার দায়িত্বে নিয়ােজিত। একই সাথে পুলিশ প্রশাসন দেখাশুনা করা, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিবাহিনীতে সম্পৃক্ত করে কাজে লাগানাে এবং মােটামুটিভাবে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা—এ-সমস্ত কাজ হাসিমুখে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই করে গেছেন এই ভদ্রলােক। গাজীপুরে, টাংগাইলে, ময়মনসিংহে মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর নূরুল ইসলামের সাথে স্থানীয় প্রশাসন, নেতৃবৃন্দ ও জনগণ কীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা সর্বজনবিদিত।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলাে সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এসবই ছিল বড় দৃষ্টান্ত। এটাই জনযুদ্ধ। চট্টগ্রাম, রামগড়-এর মতাে আরও অজস্র উদাহরণ সারা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল। জানার ইচ্ছা থাকলে, দেখার মতাে দেখলে আমাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ উন্মােচিত হবে।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিকরা পুরােপুরি কাজ বন্ধ রেখে সােয়াতনামক জাহাজ থেকে বিশাল অস্ত্রসম্ভার খালাসে অস্বীকৃতি জানায় এবং পরে বাধা দেয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে প্রাণও বিসর্জন দেয়। সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব, এম. আর. সিদ্দিকী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর মীর শওকত আলীর সাথে যান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারের জন্য।
কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ, ই.পি.আর-এর সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানিদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা চালায় (৩১ মার্চ)।
৫ এপ্রিল যশাের থেকে কুষ্টিয়া অভিমুখে যাবার সময় একটি পুরাে পাকিস্তানি সেনা কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিত্ত হয়। নিহত হয় স্থানীয় কৃষকদের আক্রমণে। তাদের হাতিয়ার ছিল দা, কুড়াল, বল্লম, সড়কি ইত্যাদি।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ বিভিন্ন স্থানে একটা বেতার-বার্তা পাঠান। প্রত্যুত্তরে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি সাড়া পান দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ফেনী থেকে। একইভাবে রাঙামাটি থেকে আমরা ই.পি.আর. এবং পুলিশের বেতার (wireless network) থেকে যেসব নির্দেশ পাঠাচ্ছিলাম, বর্ডার আউটপােস্ট (B.O.P.) এবং থানাগুলিতে তা অনেকে শুনতে পেয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন (রেজাউল হায়াত তাদের মধ্যে অন্যতম)। তবে আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ এই ছিল যে, এই একই বেতার-তরঙ্গ পাকিস্তান সেনাবাহিনীও ব্যবহার করছিল—অতএব ওরাও আমাদের কথাবার্তা শুনছিল (intercept-ও বলা যায়)। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা এবং রাজারবাগে আকস্মিক আক্রমণের সময় পুলিশ/ ই.পি.আর. রেডিওতে উভয় স্থানের বাঙালিদের যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে আদেশ করছিল, আমরা রাঙামাটিতে বসে পুরােপুরি শুনেছিলাম। একই সাথে অবিরাম গােলাগুলির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছিল। এ থেকেই আমরা প্রথম আক্রমণের প্রচণ্ডতা বুঝতে পারি।
মৌলভীবাজার-সিলেট অঞ্চলে মেজর সি.আর.দত্ত শুধুমাত্র ই.পি.আর. এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সমবায়ে দুই কোম্পানির সমতুল্য একটি বাহিনী গঠন করেন। যশাের-কুষ্টিয়া অঞ্চলে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, লে. হাফিজ ও অন্যান্যরা স্থানীয় জনসাধারণের এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছেন পাকিস্তানিদের। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, রাঙামাটি সর্বত্র স্থানীয় প্রশাসন এবং জনসাধারণ যুদ্ধ করেছেন, বিরাট অঞ্চল মুক্ত রেখেছেন। নড়াইলে কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, মাগুরায় ওয়ালিউল ইসলাম, মেহেরপুরে তওফিক এলাহী চৌধুরী, যশােরে অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার (প্রবেশনার) তরুণ সাদত হুসাইন, ঝিনাইদহের এসডিপিও (পুলিশ বিভাগ) মাহবুবউদ্দীন—সবাই জনতার সাথে মিলেমিশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তওফিক এলাহী এবং মাহবুব তাে সরাসরি যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। দুজনেই যুদ্ধে আহত হন। তওফিক যুদ্ধ চলাকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আদেশে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নিয়ােজিত এবং বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। আরেক বীরযােদ্ধা ছিলেন ঐ অঞ্চলের প্রকৌশলী এম.এইচ.সিদ্দিকী (ডাক নাম কমল নামেই খ্যাত)। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর মূল্যবান একটি চোখ হারান। যশাের-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে যুদ্ধের প্রথমদিকে কিংবদন্তি হয়ে যান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তওফিক এলাহী, মাহবুব, কমল সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আসহাবুল হক।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে দিনাজপুর, রংপুর, পার্বতীপুর, বগুড়া সব অঞ্চলে সর্বস্তরের মানুষ নেমে পড়ে সেনাবাহিনী, ই.পি.আর, পুলিশ, প্রশাসনের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এভাবে বাংলাদেশের সর্বপ্রান্তের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করে।
রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ, পাবনা প্রভৃতি এলাকায়ও বীর জনতা পিছিয়ে ছিল না। রাজশাহী পুলিশ লাইনে পুলিশবাহিনীর প্রতিরােধ, রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জে জওয়ান, ই.পি.আর, পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমবায়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে মেজর গিয়াস, ক্যাপ্টেন রশিদ সেনাছাউনি ঘিরে রাখে। পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতারণার শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এখানে শহীদ হন।
নগরবাড়িতে পাকিস্তানিরা যমুনা নদী পারাপারের চেষ্টায় অগ্রসর হওয়ার পথে পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের এবং মেজর নাজমুল হক সংগঠিত ই.পি.আর. পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরােধ করে দাঁড়ায়। এখানকার যুদ্ধেও আমাদের অনেক হতাহত হন।
নাটোরের লালপুরে অবস্থিত নর্থবেঙ্গল সুগার মিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য গাথা হয়ে আছে। সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার অবসরপ্রাপ্ত বিমানবাহিনী অফিসার আনােয়ারুল আজিম স্থানীয় জনসাধারণ, মিলের সকল অফিসার ও শ্রমিক সমন্বয়ে বাহিনী গঠন করেন পাকিস্তানিদের প্রতিরাধের জন্য। তাদের সাথে যােগ দেয় এলাকার সাঁওতাল যুবকেরা তাদের আদ্যিকালের অস্ত্র, তীর-ধনুক নিয়ে। বলাবাহুল্য এই প্রতিরােধ ছিল আত্মঘাতী। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকল মানুষকে গােপালপুর সুগার মিলে হত্যা করা হয়। আজিম সাহেব শহীদ হন। ওখানে কর্মরত আমার বড় ভাই তফাজ্জল ইমাম বহুকষ্টে আমার অন্তঃসত্ত্বা ভাবী এবং তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে ভারত-সীমান্তে উপস্থিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ করে সেনাবাহিনী, ই.পি.আর., পুলিশ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ, প্রশাসন এদের সকলের সমন্বয়ে গঠিত, আমি বলব গণফৌজেরবীরত্বের সম্পূর্ণ, সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস এখনও রচিত হয়নি। আমরা মােটামুটি আমাদের নিজ নিজ এলাকার কাহিনী বর্ণনা করতে পারি। তার সাথে সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবসহ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে শােনা বা উদ্ধৃত ঘটনা আমরা জানতে পারি, লিখতে পারি। বাংলাদেশের ইতিহাস অবিকৃতভাবে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের দ্বারা। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সরকারিভাবে এই ইতিহাস রচনার কাজ অতি অবহেলিত ছিল। ক্ষমতা দখলকারী রাজনৈতিক দলগুলাের দৃষ্টিভঙ্গি দলীয় স্বার্থের উপরে ওঠেনি। এমনকি, রাজনৈতিক নিরপেক্ষ নয়। একমাত্র নিরপেক্ষ ব্যক্তিই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে পারবেন। এসব কাহিনী ও গাথার অবতারণা করার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ব্যাপকতা এবং সকল স্তরের জনগণের সম্পৃক্ততা তুলে ধরা। আশার কথা, ২০০৯ সালে গঠিত সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে প্রয়াসপর হয়েছে। এটিই আমাদের জনযুদ্ধের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরােধযুদ্ধে পাকিস্তানিদের ঠেকানাে গেলেও পরবর্তীতে উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী কামান, ট্যাঙ্ক ইত্যাদির সম্মুখে শুধু বীরত্ব আর সাহসিকতা দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী আর জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়টি মাস বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। একটি কারণ হল: ইতােমধ্যে সমুদ্রপথে আনীত বিভিন্ন জাহাজে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলাে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নেমে পড়েছে। কাজেই সংখ্যায় তারা অধিক ছিল। দ্বিতীয়ত, ওদের ছিল বিমানবাহিনী যারা আমাদের শক্ত অবস্থানগুলােতে অবিরাম বােমা ও গুলিবর্ষণ করেছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য।
ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও আমাদের যােদ্ধারা পিছু হটেছেন সুবিধামতাে নিরাপদ স্থানে, যেখানে তাঁরা শক্তি সঞ্চয় করেছেন। নতুন নতুন রিক্রুট হয়েছে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে, পাওয়া গেছে হাতিয়ার আর গােলাবারুদ। ঐ সময়টাতে, অর্থাৎ এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই মাসে পাকিস্তানিরা সারা বাংলাদেশে হত্যা, ধ্বংস, লুটতরাজ, ধর্ষণ—এক কথায় ব্যাপক গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পৈশাচিক উম্মতায়। আর তখনই অগণিত বাঙালি ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে গিয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারতে। এ সময়ই ছিল বৃহত্তম শরণার্থীর ঢল।
জুলাই থেকে আরম্ভ হল আমাদের পাল্টা আক্রমণ। অগণিত নতুন সেনানী যােগদান করল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর। তখন অস্ত্র এবং অন্যান্য সাহায্য আসতে আরম্ভ হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সুসংহত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য যুবশিবির, প্রশিক্ষণ শিবির। আমাদের সুশৃঙ্খল সেনা-কমান্ড সৃষ্টি হয়েছে—প্রধান সেনাপতি, চিফ অব স্টাফ, উপ-প্রধান চিফ অব স্টাফ এবং সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে চেইন-অব-কমান্ড স্থাপিত হয়েছে। সামরিক পরিকল্পনা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত হচ্ছে। এদেরকে সমর্থন এবং সহযােগিতা করার জন্য বেসামরিক প্রশাসন, আঞ্চলিক প্রশাসন পরিষদ (Zonal Administrative Council), যুবশিবির ইত্যাদি দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে।
আমাদের পাল্টা আঘাত শুধু সম্মুখ সমরে নয়, বস্তুত গােটা দেশে গেরিলা-পদ্ধতিতে চোরাগােপ্তা হামলা চালিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। সুবিধা মতাে অবস্থানে থেকে সম্মুখ সমরেও লিপ্ত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। আমাদের আক্রমণ শুধু সীমান্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানিদের হত্যা করতে শুরু করল। ঢাকা নগরী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী সর্বত্র গেরিলা-আক্রমণে দিশেহারা হয়ে শক্র শুধুমাত্র বড় কয়েকটি সেনানিবাসেই আবদ্ধ হয়ে পড়ল। তাদের আরাধ্য কাজ, অর্থাৎ হত্যা, ধ্বংস, লুটতরাজের পরিকল্পনা সমাধা করার জন্য তারা লেলিয়ে দিল তাদের এদেশীয় দোসরদের।
মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন শক্তি সঞ্চয় করেছে, সংখ্যায় ও গুণে-মানে। নতুন অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের জন্য। সমর-পরিকল্পনা এবং কৌশলও পরিবর্তন করা হয়েছে প্রয়ােজন। মতাে। সাথে সাথেই জনসমর্থন এবং সর্বস্তরের মানুষের যুদ্ধে সম্পৃক্ততা (প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ) বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা মাও সেতুং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি একজন গেরিলা হলাে পানিতে মাছের মতাে বাংলাদেশে সত্য প্রমাণিত করেছে। মাছ যেমন তার স্বাভাবিক আবাসে নির্ভয়ে, বিনা বাধায় চলাফেরা করে—আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা তেমনই দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক শহরে, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-শিক্ষক সকলের আশ্রয়ে, সাহায্যসহায়তায় মূল শিবির (base camp) থেকে দূরে এসে অপারেশন করে ফিরে গেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই অসংখ্য অপারেশন করেছে আমাদের ছেলেরা। শত্রুর শক্তি, অবস্থান, চলাচল, সরবরাহ লাইন— এসব তথ্য সংগ্রহ করে সেক্টর-কমান্ডার ও সেনাকমান্ডারদের দিয়েছে তাদের কৌশল ও আক্রমণে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। আবার প্রয়ােজনে আমাদের নিয়মিত বাহিনী বা সেক্টর ট্রপসদের পাশাপাশি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং হেমায়েতউদ্দীনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতি এদের কখনও বিস্মৃত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় এরা তাঁদের বাহিনী নিয়ে যেভাবে পাকিস্তানিদের ব্যস্ত রেখেছেন এবং পর্যদস্ত করেছেন সেটা আমাদের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাসের বিশেষ অংশ। এঁদের মতাে আরও যারা শত্রুকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকায় ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, তসলিম মােহাম্মদ আজিজ, মানিক (শহীদ), বাকী (শহীদ), ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম (শহীদ), রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র) এবং আরও অনেকে। মির্জাপুরের বাতেনের কথাও উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও যারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মানিকগঞ্জের হালিম-বাহিনী (ক্যাপ্টেন হালিম), ভালুকার আফসার-বাহিনী, রৌমারির আফতাব-বাহিনী, নােয়াখালীর লুঙ্করবাহিনী, যশােরের আকবর-বাহিনী ইত্যাদি। আরও অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন অঞ্চলে সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছে পুরাে নয় মাস। অনেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে শহীদ হয়েছেন। এঁদের সকলের কথা জাতিকে জানানাে আমাদের কর্তব্য। সেটি পালনের দায়িত্ব সরকারের। আমরা যে যতদূর জানি অবশ্যই তা দিয়ে সর্বাত্মকভাবে সরকারের সহায়তা করব। মুক্তিযােদ্ধাদের ইতিবৃত্ত নিয়ে কোনাে রাজনীতি করা সমীচীন নয়। সঠিক তথ্যে তাদের ইতিহাস রচিত হওয়া আবশ্যক। প্রকৃত ইতিহাসবিদগণ এ-কাজে সফল হতে পারেন।
এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়ােজন। দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি-মেরে-থাকা কিছুসংখ্যক দেশদ্রোহী- যারা তথাকথিত রাজাকার বা আলবদর নামে পাকিস্তানিদের ভাড়াটিয়া বলে কুখ্যাত হয়েছিল ঐ সময়, তারা মুক্তিবাহিনীর চলাচলের খবর শত্রুকে দিত। অনেক সময় অত্যাচার করে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খবর নেওয়া হতাে। এই ধরনের অপতৎপরতার ফলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত বা পঙ্গু হয়েছেন। অনেক গ্রাম-গঞ্জ পুড়ে ছারখার হয়েছে। মেয়েরা হয়েছে লাঞ্ছিত। সবরকম ভয়, জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেও জনগণ তাদের মহান দায়িত্ব থেকে পেছপা হয়নি। সেজন্যই আমরা তখন দেখেছি প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য তৎপরতা (action); ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, পাবনা, ভৈরববাজার, দিনাজপুর, খুলনায় এক কথায় দেশের সর্বত্র।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের ব্যাপ্তি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে উপরে যে-বর্ণনা তা আরাে সমৃদ্ধ করতে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরে ও পদে নিয়ােজিত সরকারি, আধা-সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের এবং বিদেশে কর্মরত বা প্রশিক্ষণরত সহকর্মীদের মেধা, ত্যাগ, দেশসেবা, পরিশ্রম সম্পর্কে বিবরণ সংযুক্ত করা সঙ্গত কারণেই আবশ্যক।
আমার নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কথা উল্লেখ করেই উপরে উল্লিখিত প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। আমরা ১৯৬১ ব্যাচের (সালের) প্রাক্তন সি.এস.পি.। ছাত্রজীবনেও আমরা অনেকেই সহপাঠী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (DUCSU) কমনরুম সেক্রেটারি ছিলাম ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষে, ইকনমিকসে এম.এ. (১৯৫৮) পড়ার সময় আ.ন.ম. ইউসুফ ছিলেন ইতিহাসের। নূরুল আমিন খান ইংরেজির। মােহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা পাকিস্তানের উভয় অংশে পরিচিত গায়ক এবং সাঁতারু (কয়েকটি রেকর্ডের অধিকারী)। নূরুল কাদেরকে সবাই চিনত তুখােড় বক্তা, সুদর্শন এবং স্মার্ট ছাত্র বলে। মাসুদ আহমেদ ছিলেন ফজলুল হক হলের টেনিস ক্যাপ্টেন। মােহাম্মদ সিরাজউদ্দীন এবং রফিকুল্লাহ চৌধুরী পরিচিত ছিলেন ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস এবং ভালাে ছাত্র। সৈয়দ শামীম আহসানকে সবাই জানত স্মার্ট এবং প্রতিশ্রুতিময় ছাত্র বলে (ও আমাদের দু- বছরের জুনিয়র বিশ্ববিদ্যালয়ে)। জালালউদ্দীন আহমেদও ছিলেন ইতিহাসের ভালাে ছাত্র এবং সুদর্শন। আরেক সুদর্শন, সপ্রতিভ সহকর্মী (আমাদের ব্যাচের) ছিলেন, নূরুল ইসলাম খান। উনি গণিতশাস্ত্র এবং পদার্থবিজ্ঞানে (Mathematics and Physics) ডাবল অনার্স নিয়ে পাস

পৃষ্ঠা: ১০
করেছিলেন। বিজ্ঞান-অনুষদের ছাত্র বলে কলাভবনে যাতায়াত ছিল কম, তাই তেমন একটা পরিচিত ছিলেন না।
স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা যথাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম (আমি), ফরিদপুর (ইউসুফ), বরিশাল (নূরুল আমিন), পাবনা (নূরুল কাদের), রংপুর (শামীম), টাংগাইল (জালাল), খুলনা (নূরুল ইসলাম) জেলায় ডেপুটি কমিশনার এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। সিরাজউদ্দীন, আসাফউদ্দোলা, মাসুদ-এই তিনজন ছিলেন কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে, ইসলামাবাদে কর্মরত। রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে ১৯৬৯ সালে সামরিক জান্তা বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছিল (সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে)। প্রতিরােধযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে থেকেই যাদের পক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিল তার মধ্যে ছিলাম আমি, নূরুল কাদের খান, ইউসুফ, জালাল প্রমুখ। পরবর্তীকালে আমরা সকলেই তার খেসারত দিয়েছি। আমি আর নূরুল কাদের খান যুদ্ধরত অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর সাথে ক্রমান্বয়ে পশ্চাদপসরণের পর একপর্যায়ে ভারতে চলে যাই। নূরুল আমিনকে মার্চ মাসে প্রাদেশিক সচিবালয়ে উপসচিব পদে বদলি করে আনা হয়। বদলির কারণ কোনাে-এক পাঞ্জাবি অফিসারের সাথে মনােমালিন্য, যা আক্রোশ এবং জিঘাংসার রূপ নেয়। ইউসুফ বেশ কিছুদিন মুক্তিবাহিনীর সাথে থেকে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন সাথে বন্দি হন তার এস.পি. (পুলিশ সুপার) নূরুল মােমেন খান এবং রাজবাড়ির এস.ডি.ও. সৈয়দ রেজাউল হায়াত। বিজয়ের পর ডিসেম্বর মাসে তারা কারামুক্ত হন। জালালউদ্দীন আমাদের সহকর্মী এবং সহপাঠী খন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে টাংগাইলে প্রতিরােধযুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের সাথে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। টাংগাইল থেকে জালাল ও আসাদ যমুনা নদী অতিক্রম করে চলে যান সিরাজগঞ্জে। কাদের সিদ্দিকী বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। সেখানকার এস.ডি.ও. শামসুদ্দীন, পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদেরের সাথে একযােগে দীর্ঘদিন প্রতিরােধ বজায় রাখেন। পরবর্তীতে জালাল ফিরে আসেন টাংগাইলে। শামসুদ্দীন তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের (তার বড় ভায়রা) প্ররােচনায় ঢাকা আসেন এবং বন্দি হন সেনাবাহিনীর হাতে। অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হন তরুণ শামসুদ্দীন এবং পরিশেষে শাহাদাত বরণ করেন। শামসুদ্দীনকে প্ররােচনাদানকারী তাঁর ভায়রা চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম সেদিন হতভাগ্য শামসুদ্দীনকে পাকিস্তানি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত কলঙ্ক হিসেবেই চিহিত হবে।
আমাদের ব্যাচের নূরুল আমিন খানকে, যিনি বরিশাল থেকে বদলি হয়েছিলেন ঢাকায়, ক্যান্টনমেন্টে ডেকে পাঠানাে হয়। প্রথমবার ছাড়া পেলেও দ্বিতীয়বার আর তিনি ফিরে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের আরেক শহীদ নূরুল আমিন খান। তাকে হত্যার আরেকটি কারণ হতে পারে তার শ্যালক (স্ত্রীর ভাই) ক্যাপ্টেন হারুন, যিনি কাপ্তাইয়ে ই.পি.আর. ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন। পশ্চিমাদের গ্রেপ্তার করে তিনি চট্টগ্রাম যান এবং ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ও মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে যােগ দেন। হারুনুর রশিদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল।
আমাদের দুই বন্ধু (আমরা বলি ব্যাচ-মেট) মােহাম্মদ সিরাজউদ্দীন এবং মােহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা ইসলামাবাদ থেকে পালিয়ে বহু কষ্টে যথাক্রমে খাইবার গিরিপথ এবং বেলুচিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছেন। সেখান থেকে কাবুল হয়ে দিল্লি এবং পরিশেষে ঢাকা। সেটা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি অথবা শেষার্ধে।
বন্ধুবর নূরুল কাদের যুদ্ধের সময়েই খানসেনাদের অত্যাচারে প্রতিবাদে নিজে নাম থেকে খানঝেড়ে ফেলেন। হয়ে যান শুধুই নূরুল কাদের, আমাদের ঝিলু ভাই। উনি আর এখন আমাদের মাঝে নেই। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক তার বইয়ের নাম ‘একাত্তর আমার’। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন আমাদের আরেক সহকর্মী নুরুল ইসলাম খান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তার নাম কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে পরিচিত হন নুরুল ইসলাম শামস নামে। নূরুল ইসলামও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
১৯৬১ সালে আমাদের ব্যাচের সকলে বাঙালি সিভিল সার্ভিসের দুর্গ, সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কালাে ব্যাজ লাগিয়ে খালি পায়ে ক্লাস করেছিলাম। একাট্টা থাকার ফলে ডিরেক্টর এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত কোনাে অভিযােগ আনেননি। আমি তিন নূরুলকে—আ-উ-ই যােগ করে যথাক্রমে নাক, ক, আর নিকউপাধি দিয়েছিলাম। আজ তিনজনই জান্নাতবাসী। আমি আজও তাঁদের শূন্যতা প্রকটভাবে অনুভব করি।
রফিকুল্লাহ চাকুরিতে না-থেকেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকায় অপারেশনে আসা গেরিলাদের সাহায্য করতেন। ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু রফিকুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব নিয়ােগ করেন।
আমাদের ব্যাচের বাইরে অন্যান্য সি.এস.পি. দেশপ্রেমিক অফিসার যারা শহীদ হয়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে বলতে গেলে কোনাে তথ্য বা আলােচনাই নেই কোথায়ও। একইভাবে সাবেক ই.পি.সি.এস. (পি.এস.পি. এবং প্রাদেশিক সার্ভিস), প্রকৌশলীবৃন্দ, অন্যান্য কর্মকর্তা যারা দেশমাতৃকার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের নিয়ে আমরা আলােচনা করি না কেন? এঁরা তাে সকলে জনযুদ্ধে শামিল সৈনিক।
অপর সি.এস.পি. শহীদ অফিসার হলেন শামসুল হক খান (কুমিল্লার ডি.সি.)। আমাদের সহপাঠী, চাকুরিতে একবছরের জুনিয়র (১৯৬২)। তিনি ও তার এস.পি. (পুলিশ সার্ভিসের) এঁদের উভয়কে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কুমিল্লার কুখ্যাত কশাই ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির আদেশে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। দুজনকে একই কামরায় আটকিয়ে চরম নির্যাতন করা হয়। পরিশেষে ২৫ মার্চ রাতে উভয়কে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়।
তখনকার তরুণ লেফটেনান্ট ইমামুজ্জামানকে পাশের ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। সাহস, বুদ্ধি এবং আল্লাহর মর্জিতে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান।
সি.এস.পি. শামসুদ্দীন ছাড়াও আরও একজন শামসুদ্দীন দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। কাপ্তাই পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ম্যানেজার বা সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার, যার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২৫ মার্চ রাতে আমার সাথে টেলিফোনে কথা হয় তাঁর। তারপর বেশ কয়দিন তিনি কার্যত কাপ্তাইয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন (ক্যাপ্টেন হারুন চট্টগ্রাম যাত্রা করার পর)। হানাদার বাহিনী কাপ্তাই দখলের পর তাকেই প্রথম হত্যা করে।
রাঙামাটি সদরের এস.ডি.ও. আবদুল আলী এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। সে সময় তিনি মুক্ত-অঞ্চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অমানুষিক নির্যাতন করেও পাকিস্তানিরা তার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কে কোনাে তথ্য আদায় করতে পারেনি। প্রচণ্ড ক্রোধ এবং আক্রোশে পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ, ধরা পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শহীদ আবদুল আলী প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন স্বাধীন বাংলার পক্ষে প্রতিরােধ-সংগ্রামে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের আরেক নায়ক সৈয়দ আবদুস সামাদ, যিনি আমার সাথে ঐ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই পুনর্বাসন প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমি, সামাদ এবং সহকর্মী, সহকারী পুনর্বাসন অফিসার এম. ই. শরিফ (ই.পি.সি.এস.), আবদুল আলী, (এস.ডি.ও. রাঙামাটি সদর) রুহুল আমিন (ম্যাজিস্ট্রেট) আমাদের তৎপরতা আরম্ভ করি। আমাদের সাথে ছিলেন, সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘােষণা করে এস.পি. (পুলিশ সুপার) বজলুর রহমান।
১৯৭১ সালের ১ মার্চে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর থেকেই সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সেই উত্তাল সময়ে মনে হয়েছিল এখনই বুঝি চারদিকে আগুন জ্বলে উঠবে। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিলেন হােটেল পূর্বাণীর চত্বরে। আমি সেদিন ঢাকায় সরকারি কাজে এসেছিলাম। সেই রাতেই রওনা হয়ে পরদিন সকালে চট্টগ্রাম। সেখানেও মনে হলাে গােটা শহর ফুঁসে উঠেছে যেন। ২ এবং ৩ মার্চে শুধু প্রতিবাদ মিছিল আর জনসভা। সম্ভবত ২ মার্চেই অনুষ্ঠিত হলাে লালদিঘির ময়দানে বৃহত্তম জনসভা। ঐদিন বিভিন্ন অবাঙালি কললানির পাশ দিয়ে যাবার সময় মিছিলের ওপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানিরা। তাদের সাথে শাদা পােশাক পরিহিত সৈন্যরাও ছিল। লাঠি, ইট-পাটকেল, গরম পানি এবং বন্দুকের গুলিতে অনেক চট্টগ্রামবাসী অগ্নিদগ্ধ এবং হতাহত হন। ঐ সময়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আর থাকা যাবে না। তারপর এল ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ; শুরু হল অসহযােগ আন্দোলন এবং দেওয়ালে পিঠ-ঠেকে-যাওয়া (point of no return)। তখন থেকে আমরা আওয়ামী লীগের নির্দেশমালাই পালন করেছি। তদুপরি আমাদের পক্ষে ছিল পূর্ব পাকিস্তান সি.এস.পি. অ্যাসােসিয়েশন (C.S.P Association)-এর সিদ্ধান্ত।
এত কিছুর পরেও আমাদের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সহকর্মী সহযােগিতা করেননি। তাঁদের কেউ কেউ দ্বিধান্বিত ছিলেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের বিরােধিতা করেছেন—প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে। এই পটভূমিতে আমরা সকল অফিসার বা সহকর্মীকে আস্থায় নিতে পারিনি। যাদের বিশ্বাস করা যেত পুরােপুরি, তাদেরকেই আমরা বিভিন্ন রকম দায়িত্বে নিয়ােগ করি। উপরে সৈয়দ আবদুস সামাদ, এম. ই. শরিফ, আবদুল আলী (শহীদ) এবং বজলুর রহমান (এস.পি.) প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছি। এ ছাড়াও আমাদের ছােট দলে (core group) ছিলেন কাপ্তাইয়ের প্রকৌশলী শামসুদ্দীন (শহীদ), ড. ফারুক আজিজ খান, তালুকদার (ডি.এস.পি.), রাঙামাটিতে পাবর্ত্য-চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. আলতাফ আলী, জেলা কাউন্সিলের প্রশাসনিক অফিসার বরেন ত্রিপুরা ও প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম। আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখতেন ই.পি.আর. বাহিনীর জে.সি.ও., বেতার কর্মী ও অন্যান্যরা। মাধ্যম ছিলেন রাঙামাটির তরুণ ছাত্রনেতা—সুনীল, দীপঙ্কর, দিদারুল এবং আরও অনেকে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অপারেশনে শহীদ হয় পরবর্তী সময়ে।
ম্যাজিস্ট্রেট শরিফ সাহেবকে নিয়ে সৈয়দ আবদুস সামাদ মার্চের প্রথম দিকেই চলে যান কাপ্তাইয়ে। তাঁদের দায়িত্ব ছিল কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুনের ইউনিট এবং পুলিশের আর্মড ব্যাটালিয়নের (Armed Battalion) সাথে যােগাযােগ করে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্য বরাবর সীমান্ত এলাকায় আমাদের যে সমস্ত সীমান্ত চৌকি (অর্থাৎ বি.ও.পি.) ছিল সেখানে ই.পি.আর.-এর অফিসার (J.C.O. এবং N.C.O.) এবং জওয়ানদের উদ্বুদ্ধ করে আসন্ন সমরের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এতে সামাদ কৃতকার্য হয়েছিলেন, যার ফলাফল আমরা চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধে পেয়েছি। কাপ্তাই এবং বরকল অঞ্চলে তৎপর থাকাকালীন অগ্রসরমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে সামাদ এবং আমাদের অন্যান্য সহকর্মী পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে তারা মিজোরামের আইজলে সমবেত হন। সেখান থেকে তাদেরকে ত্রিপুরা রাজ্যে নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে পূর্বাঞ্চল (Eastern Zone) আঞ্চলিক প্রশাসন পরিষদে প্রশাসক নিযুক্ত হন সামাদ। সেই দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যােগ্যতা ও সাহসিকতার সাথে সামাদ তা পালন করেন। শরিফ কোলকাতায় আমার সাথে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যােগ দেন উপসচিব পদে। সৈয়দ আবদুস সামাদ বাংলাদেশ সরকারের সময় (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন। শরিফ সাহেবকে বিজয়ের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আমার সাথে আরাে যেসব সহকর্মী ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন থানা ম্যাজিস্ট্রেট খান আমীর আলী। তিনি ছিলেন মারিশ্যায় কর্মরত থানা ম্যাজিস্ট্রেট। ২৫ মার্চের পর তিনি অন্যান্যদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তিনি দিঘিলার দিকে অগ্রসর হয়ে পরবর্তীতে মেজর মীর শওকত আলীর (২০১১ সালে প্রয়াত) সাথে ছিলেন। একপর্যায়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পান। ঐ অবস্থাতেই রামগড় এসে আমার সাথে। যােগদান করেন।
আমাদের সি.এস.পি. সহকর্মীদের মধ্যে ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বিশেষ তৎপর ছিলেন বন্ধুবর মনযূর-উল করীম, নােয়াখালীর ডি.সি.। ফেনি থেকে তিনি বেশ কয়েকবার আমার সাথে টেলিফোনে যােগাযােগ করেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ফেনিতে বােমাবর্ষণ করার পর তিনি আর এগিয়ে এসে আমাদের সাথে যােগদান করতে পারেননি। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিছুদিন মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সহযােগিতা করে তিনি মােটামুটি অসহায় ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
আমাদের সাথে যােগদান করেছিলেন এমন দুজন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ ও ফয়েজ আহমেদ, যথাক্রমে রাজশাহীর কমিশনার ও দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার। আরাে যাদের কথা মনে পড়ছে তারা হলেন আবদুল মোেমন, জে.জি. ভৌমিক, বি.বি. বিশ্বাস প্রমুখ। এঁরা ই.পি.সি.এস. কাডারের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় এঁদের সকলকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তারা উল্লেখযােগ্যভাবেই তা পালন করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যারা শহীদ হন তাঁদের কয়েকজনের কথা উপরে উল্লেখ করেছি।
আমাদের পুলিশবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এ-কথা সর্বজনবিদিত। পুলিশবাহিনীর সদস্য এবং অফিসারদের সাহসিকতা এবং ত্যাগ জাতি কখনও ভুলবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের আকস্মিক এবং ঘৃণ্যতম আক্রমণ যুগপৎ শুরু করে পিলখানায়, ই.পি.আর. এবং রাজার বাগ পুলিশ লাইনে গােলাবর্ষণ করে। ২৫ মার্চের কালে রাত্রিতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ভাইয়েরা শহীদ এবং আহত হন। যারা বেঁচে ছিলেন তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। যে-সমস্ত জেলায় ভালাে এবং সুবিধাজনক অবস্থান ছিল সেসব জায়গায় পুলিশ ভাইয়েরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
মুজিবনগরে যারা যােগ দেন তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম ছিলেন এম.এ. খালেক, রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি পরে বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম ডি.জি. এবং স্বরাষ্ট্র-সচিব পদে নিযুক্ত হন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বজলুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রামের এস.পি.। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের কথা কোনােদিন ভুলব না। জাতি তাঁদের কাছে অসীম কৃতজ্ঞ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সকলকে চিনতাম। এখনও তাদের চেহারা আমার চোখে ভাসে।
সর্বপ্রথম যে পুলিশ অফিসারের মুখ আমার মনে পড়ে তিনি হলেন এস.পি. শাহ এম.এ. মজিদ (পি.এস.পি.)। গৌরবর্ণ (একেবারে লাল টকটকে) সুন্দর সুঠাম চেহারা, আমাদের সমবয়সী। চাকুরিতেও একই বছরের। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় আমি নারায়ণগঞ্জের এস.ডি.ও. থাকাকালীন, ১৯৬৪ সালে। উনি এস.ডি.পি.ও.। পরে উনি ফরিদপুরের এস.পি. হন। সেখানে ১৯৬৯-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিষদৃষ্টিতে পড়েন, কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার না-করায় রাতারাতি বদলি হয়ে যান সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে (ভাইস প্রিন্সিপ্যাল), সেখানে অধ্যক্ষ ছিলেন খালেক সাহেব। ১৯৭০ সালে আবার এস.পি., রাজশাহীতে নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়দিনেই রাজশাহী জ্বলে ওঠে প্রতিবাদে। নানারকম ছল-চাতুরী করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পুলিশ লাইনের সেপাইদের নিরস্ত্র করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের লােকজন এবং পরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে বহু পুলিশকে। ঐ সময়ে তারা ধরে নিয়ে যায় শাহ আবদুল মজিদ সাহেব এবং রাজশাহীর রেঞ্জ ডি.আই.জি. মামুন মাহমুদকে। উভয়েই পুলিশ লাইনে উপস্থিত ছিলেন ২৬ মার্চ। পরে সেখান থেকে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। ৩১ মার্চ গ্রেপ্তার হন। আর ফিরে আসেননি। উভয়েই শহীদ হন। মামুন মাহমুদও আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত ভালাে এবং অমায়িক ভদ্রলােক। কবি বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের বড় ছেলে। ছােট ছেলে মাইনুউদ্দীন মাহমুদ (ওরফে মাইনু) আমাদের সহপাঠী, স্কুলজীবন থেকে। পাকিস্তান আমলে পূর্বপাকিস্তান ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবাই বলত মাইনু ভাই। আমাদের মাইনু – ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সবচাইতে দুষ্ট আর হাসিখুশি ছাত্র। দুই ভাইয়ের কেউই আমাদের মাঝে নেই।
ফদিপুরে আমাদের বন্ধু ইউসুফের কথা আগেই বলেছি। তার সাথে কারারুদ্ধ হন তার এস.পি. আমাদের বন্ধু নূরুল মােমেন খান (মিহির)। তিনিও আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমরা একই সাথে ১৯৫৬-৫৭ সালে ডাকসুর সদস্য ছিলাম। শাহ আবদুল মজিদের পি.এস.পি. ব্যাচমেট। ওঁদের সাথে আরও কারাগারে ছিলেন সৈয়দ রেজাউল হায়াত, মাদারিপুরের এস.ডি.ও.। এদের সকলকে পরে ঢাকায় তখনকার সেকেন্ড ক্যাপিটাল শেরেবাংলা নগরে অন্ত রীণ করা হয়। জায়গাটির নামকরণ হয় পি.ও.ডব্লিউ. (Prisoners of War) ক্যাম্প। এর সকলেই সতিকার অর্থে যুদ্ধবন্দি (POW), কেননা তারা ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা। এখানে আরও ছিলেন আইয়ুবুর রহমান (বরিশালের ডি.সি.), রাজবাড়ির এস.ডি.ও. শাহ্ মােহাম্মদ ফরিদ, ডাক ও টেলিযােগাযােগের (Post and Telecommunication) উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী লােকমান হােসেন। প্রচণ্ড নির্যাতনের ফলে লােকমান সাহেব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিজয়ের পরে পরেই তাকে আমরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাই। সুস্থ হয়ে দেশে ফেয়ার পর তাঁকে ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়ােগ করা হয়।
আইয়ুবুর রহমান আমার ছেলেবেলার বন্ধু এবং সহপাঠী। আমরা কোলকাতা পার্কসার্কাস হাই স্কুলে একসাথে পড়তাম পাকিস্তানে চলে আসার পূর্বে। পরে আবার উভয়ে সহপাঠী হই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্স পড়ার সময় এম.এ. ক্লাসে। আইয়ুবুর রহমান অত্যন্ত সৎ, দক্ষ এবং দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ-সচিব ছিলেন। দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। এ.এন.এম. ইউসুফেরও একই রকম সুনাম আছে। তিনি দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন। রেজাউল হায়াতও তাই। তিনি দক্ষতার সঙ্গে ২০০৩ সালেও যােগাযােগ সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। ড. শাহ মােহাম্মদ ফরিদ বিজয়ের পরে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য

পৃষ্ঠা: ১৫
সচিব ছিলেন স্বল্পকালের জন্য। ঐসময় তার ভূমিকা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিল। উনি ২০০৪ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
আমাদের বন্ধু কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (১৯৭১) শহীদ শামসুল হক খানের কথা আগে বলেছি। তারই সাথে একই কামরায় নির্মমভাবে নিহত হন কুমিল্লার এস.পি.। পুলিশের আরেক জনপ্রিয় এবং সিনিয়র অফিসার চট্টগ্রামের এস.পি. শামসুল হক- মুক্তিযুদ্ধে তিনিও শহীদ হন। চট্টগ্রামে শহীদ হন দুজন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী। একজন চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী। আরেকজন পূর্বাঞ্চল রেলের উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী। এঁদের নাম মনে করতে পারছি না।
মুক্তিযুদ্ধে কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এই যুদ্ধেই আমরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েছে। তাও স্থানীয় তাঁবেদারদের ষড়যন্ত্রের ফলে। এই কষ্টের কথা কোনােদিন মুছে যাবার নয়। আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা শুধু তাদের লেখায়ই নয়, অনেকে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মসি ছেড়ে অসি হাতে নিয়েছেন। আমাদের শিল্পীরা শুধু পশ্চিমবাংলায় নয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়, মুক্তিবাহিনীর ঘাটিতে, মুক্তাঞ্চলে গান গেয়ে আবৃত্তি করে যােদ্ধাদের মনােবল চাঙা করেছেন। কবি আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, শিল্পী কামরুল হাসান, শাহাবুদ্দীন, কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, কাদেরী কিবরিয়া, রথীন্দ্রনাথ রায়, তপন ভট্টাচার্য (মাহমুদ), সনজিদা খাতুন, সমর দাস, হাসান ইমাম, রফিকুল আলম; আরও অনেক নামী ও গুণী শিল্পীর অংশগ্রহণে আমাদের জাতীয় জনযুদ্ধ সমৃদ্ধ হয়েছে। শিল্পী কামরুল হাসান তাে আমাদের সবসময় প্রেরণা ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কার্টুন এই জানােয়ারটাকে হত্যা করতে হবেইয়াহিয়া খানের বীভৎস চরিত্র-চিত্র ছিল। বিজয়ের পর বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার অনেক চিরে সাথেই জড়িত ছিলেন তিনি। জাতীয় পতাকার রাষ্ট্রীয় ডিজাইন (সঠিক মাপ ও রং), জাতীয় প্রতীক, জাতীয় ফুল শাপলা ফুল, যা নির্বাচন করেছিলেন কবি সানাউল হক, আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী), জাতীয় পাখি দোয়েল—এগুলাে ছিল শিল্পী কামরুল হাসানের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এই সব কাজই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অমর দেশাত্মবােধক গান এবং এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র আমাদের অবিরাম উজ্জীবিত করেছে। রেখেছে মনােবল তুঙ্গে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ এবং কলাকুশলীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতি এঁদের চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. এ.আর. মল্লিক, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর আলী আহসান, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সােবহান, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর মােশাররফ হােসেন, প্রফেসর খান সরওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যােগ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে গতিশীল করেছেন এঁরা। ড. মযহারুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সদস্য। তিনি লােকসাহিত্য প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জুলাই ১৯৭১ সালের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও অঞ্চলে জনসংযােগ কাজে গমন করেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশ্বের দরবারে আমাদের, বাংলাদেশের, স্বাধীনতাযুদ্ধের যৌক্তিকতা, ন্যায় এবং বৈধতা তুলে ধরেছেন এইসব মহৎ ব্যক্তিত্ব।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণ করি আমাদের আরেক প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর রেহমান সােবহানকে। ড. মাহমুদ আর প্রফেসর রেহমান সােবহান পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য এবং পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানে অর্থনৈতিক শােষণের ওপর নিবিড়ভাবে গবেষণা করতেন। রাজনীতির বাইরে মানুষ হিসেবে তারাই সবচাইতে সরব ছিলেন। রেহমান সােবহান বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা প্রণয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৬ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞের পর ২৭ তারিখে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কারফিউ আদেশ শিথিল করে। ঐ অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি স্ত্রী সালমা এবং দুই ছেলেকে ঢাকার বাসায় রেখে বের হয়ে পড়েন আগরতলার পথে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ড. আনিসুর রহমান। আগরতলাতে তাদের দেখা হয় এম. আর. সিদ্দিকীর সাথে, যিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সহযােগিতায় দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রেহমান সােবহান সাহেবের উদ্দেশ্যও দিল্লিতে যাওয়া, কেননা সেখানে তাঁর পূর্ব-পরিচিত অনেকেই বাস করতেন। সবাই একসাথে দিল্লি যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি আক্রমণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা এবং ভারত ও বিশ্বমানবতার কাছে সাহায্যের আবেদন করা। এই সফর আমাদের সকলের জন্য সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে আসে। দিল্লিতে ড. অমর্ত্য সেন, ড. সুখময় চক্রবর্তী এবং অন্যান্য নামকরা বুদ্ধিজীবী তাে ছিলেনই, উপরন্তু তাদের মাধ্যমে ভারত-সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের সাথেও দেখা করতে পারেন। সংগ্রামের সেই প্রথম পর্যায়ে এপ্রিলের ৭ তারিখের মধ্যেই রেহমান সােবহান ও সিদ্দিকী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে শ্রী পি.এন. ধর ও শ্রী পি. এন. হাকসারের সাথে দীর্ঘ আলােচনার সুযােগ পান। সেখানে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামেরও সাক্ষাৎ পান। ঐ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ এবং ঝানু আমলারা কেউই বাংলাদেশের ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা সম্পর্কে জানতেনই না। অধিকন্তু এদেশের নেতৃবৃন্দ কে কোথায়, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, সৈয়দ নজরুলসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের কী অবস্থা সে সম্বন্ধে তাদের কোনাে ধারণা ছিল না। এই কঠিন অবস্থার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের জন্য রেহমান সােবহানের উপস্থিতি ও পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা তখন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার পরেই প্রয়ােজন মন্ত্রিসভা গঠন ও শপথ গ্রহণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড আরম্ভ করা। এই সময় ভারতীয়রা খবর দিলেন যে পাকিস্ত নি সরকার তাদের প্রবীণ ও ঝানু অর্থনীতিবিদ-আমলা এম.এম. আহমেদকে আমেরিকা পাঠাচ্ছে সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তাজউদ্দীন সাহেবের অনুরােধে রেহমান সােবহান বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে রওনা হয়ে গেলেন আমেরিকায়।
আমেরিকাতে রেহমান সােবহান তাঁর গভীর দেশপ্রেম, মেধা আর বাকচাতুর্য দিয়ে এম.এম. আহমেদ এবং পাকিস্তানি দলের উপস্থাপিত সমস্ত মিথ্যা তথ্য ও ভ্রান্ত যুক্তি খণ্ডনই শুধু করলেন না, যুক্তি তর্ক এবং বাংলাদেশের সঠিক চিত্র তুলে ধরে সকলের মন জয় করলেন। পাকিস্তানের বর্বর আক্রমণের আসল মুখােশ উন্মােচিত করলেন রেহমান সােবহান। বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ তার কথা শুনলেন। সত্যের জয় হলাে। নিউইয়র্ক টাইমস্, ওয়াশিংটন পােস্ট, বাল্টিমাের সান, শিকাগাে ট্রিবিউন (The New York Times, The Washington Post, The Bultimore Sun, The Chicago Tribune) ইত্যাদিন মতাে পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখল বাংলাদেশের ওপর, পাকস্তিানকে ধিক্কার জানিয়ে। আমেরিকান কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস এবং সিনেটের প্রধান নেতারা তার কথা শুনলেন। রেডিও-টিভিতে তাঁকে ডাকা হলাে ঘন ঘন বক্তব্য শােনার জন্য এবং সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য। এর ফলে সিনেটে চার্চ-স্যাক্সবি সংশােধনী (ChurchSaxby Amendment) আনা হলাে পাকিস্তানকে সাহায্যের জন্য কংগ্রেসে উপস্থাপিত বিলে (Aid to Pakistan Bill).
বিশ্বব্যাংকের (The World Bank) প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা প্রফেসর রেহমান সােবহানকে সাক্ষাৎকার দিলেন, যার প্রভাব পড়েছিল বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান নীতির ওপর।
নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের পাকিস্তান প্রীতির কারণে বাংলাদেশের কেউই হােয়াইট হাউস এবং পররাষ্ট্র দপ্তরে (The White House এবং State Department) ঘেষতে পারত না। তা সত্ত্বেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুই নম্বর ব্যক্তি হ্যারল্ড সন্ডার্স (Harold Saunders) রেহমান সােবহানকে সাক্ষাৎকার দান করেন। বিশ্বব্যাংক এবং আমেরিকার এইড দপ্তরে (World Bank এবং US AID) অনেক কর্মকর্তাই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে যা ঘটছিল সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। এইসব সংস্থায় তাই বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল মনােভাবাপন্ন লােকের অভাব ছিল না। রেহমান সােবহানের উপস্থিতি এবং এ.এম.এ. মুহিত ও অন্যান্য বাঙালির গণসংযােগ তৎপরতা আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত জনমত গড়ে তােলে।
রেহমান সােবহান আমেরিকায় যাওয়ার ফলে সকলে তার চাক্ষুষ বর্ণনা শুনলেন। শিহরিত হলেন; ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিরা একত্র হলেন, দূতাবাসে ও অন্যান্য জায়গায় কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সঞ্চার হলাে। রেহমান সােবহান মে মাসে ফিরে এলেন মুজিবনগরে। কিছুদিন পর তাকে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয়।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতি, বর্ণ, ধর্মনির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ। মুসলমান, হিন্দু তাে বটেই, বৌদ্ধ এবং পার্বত্য উপজাতিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। বিখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু আচার্য জ্যোতিপাল মহাথেরাে বিদেশে, বিশেষ করে বৌদ্ধ-প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ত্রিপুরার হরিণার কাছে এক বৌদ্ধবিহারে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ভ্রাম্যমাণ দূত নিয়ােগের কথা জানালে তিনি সানন্দে সম্মত হন। তাঁর অবদান ছিল অনেক।
উপজাতিদের অনেকেই আমাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সহযােগিতা করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন মানিকছড়ির মং রাজা। তিনি সরাসরি মেজর মীর শওকত আলীকে মার্চএপ্রিল মাসে সহযােগিতা করেন। পরবর্তীকালে ভারতে আশ্রয় নেবার পর সরকার তাঁর জন্য বিশেষ ভাতা মঞ্জুর করে। তিনি পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে ঘুরে-ঘুরে উপজাতিদের মধ্যে আমাদের প্রচারকাজ চালাতেন। বরেণ ত্রিপুরার কথা আগেই বলেছি। চাকমাদের একটা বিরাট অংশ আমাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বেশকিছু চাকমাত্রিপুরা যুবক ছিলেন। কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। মেজর রফিক (বীরউত্তম) তাঁর সহযােদ্ধাদের মধ্যে চাকমাদের কথাও উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত ফুটবলার মারির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত বীর মুক্তিযােদ্ধাকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। মীর শওকত আলী তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও প্রসঙ্গ কথা প্রবন্ধে লিখেছেন: মুক্তিযােদ্ধাদের সম্বন্ধে আমার একটা অভিমত আছে। আমার এলাকায়, আমি মনে করি, যত বেসামরিক জনসাধারণ ছিলেন, অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক কিছু ব্যক্তি যারা ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যভিচারে সাহায্য করেছে তারা ব্যতিত আমার সিলেট এলাকায় তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবিহীন মুক্তিবাহিনী বাদে আর যারা ছিলেন সবাই আমার মুক্তিবাহিনী ছিলেন। এমনকি কোনাে-কোনাে রাজাকারও ছদ্মবেশে মুক্তিবাহিনী ছিলেন। কারণ, এরাও সাহায্য করত। রাতে এসে আমাদের খবর দিয়ে দিত, কিংবা আমরা গেলে তারা ইশারায় আমাদের বলে দিত পাকিস্তানি সৈন্য আছে কি না, তাদের অবস্থান কোথায় ইত্যাদি।
পুনরুক্তি করেই বলছি, যারা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে পাকিস্তানিদের সাহায্য করত, এমন কিছু রাজাকার ছাড়া বাকি সবাইকে আমি মনে করি মুক্তিযােদ্ধা(মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, রহীম শাহ সম্পাদিত, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৮৩)।
আরেকটি উদ্ধৃতি জনযুদ্ধঅধ্যায়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম-এর লেখা থেকে উদ্ধৃতিটি এ রকম: বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ।’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘…মুহূর্তে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির ভাগ্যনির্ধারণী রাজনৈতিক চূড়ান্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে ঐ তরুণ। ঐ অচেনা তরুণ আর বাংলার প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে আমি আমার মতাে অনেকেই জড়িয়ে পড়ল মুক্তির মহাআন্দোলনে। ইতিহাসের স্রোতােধারায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হল (আমি তখন সামরিক বাহিনীর অফিসার, ডেপুটেশনে চট্টগ্রাম ইপিআর-এর অ্যাডজুটেন্ট পদে নিয়ােজিত)। ঐসব তরুণ, যুবক, বাংলার মানুষেরা আমাকে চেনে না, জানে না। আমাদের মতাে ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেল তাে দূরের কথা, পাকিস্তানের সিনিয়র জেনারেলদের কয়েকজন ছাড়া আর কারাে নামও সাধারণ মানুষ জানে না জানবার প্রয়ােজনও নেই। কারণ, জনতার এই সংগ্রাম, এই মহান আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে, স্বাধীনতার সংগ্রামে সবসময়ই জনগণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সংগ্রাম করেছে। অতীতে, বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও এর কোনাে ব্যত্যয় ঘটবে না।’ (মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, রহীম শাহ্ সম্পাদিত, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৬২-১৬৩)।
আরাে একটি উদ্ধৃতি জনযুদ্ধবিষয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযােদ্ধা মেজর এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন তাঁর গবেষণামূলক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থাননামক গ্রন্থের ৪৬ সংখ্যক পৃষ্ঠায় লিখেছেন: রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সুস্পষ্ট পূর্বনির্দেশনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক, আধাসামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পক্ষত্যাগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের সহযােগিতায় স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ মতাে করে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এ-ব্যাপারে সহযােগিতায় এগিয়ে আসে।
এই অধ্যায়টি শেষ করার আগে আমার নিজের একটি ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারছি। স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘ কাল ধরে মুজিবনগর সরকারের কৃতিত্ব সম্বন্ধে কোনাে আলােচনা হয় না। যার নেতৃত্বে সবকিছু পরিচালিত হয়েছে তাকে অসম্মান করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে কোনাে কোনাে মহল।
বেসামরিক ব্যক্তি যেমন মানিক, বাকী, রুমী (জাহানারা ইমামের পুত্র), স্বপন চৌধুরী, শামসুদ্দিনসহ ড. জি সি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মনিরুজ্জামান, ধীরেন, দত্ত, যােগেশ চন্দ্র ঘােষ প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদেরও কোনাে স্বীকৃতি নেই। তাদের দেওয়া হয়নি কোনাে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপরে লেখা বইপত্র, আলাপ-আলােচনা সবক্ষেত্রেই ব্যক্তিবিশেষের বীরত্ব আর অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়। উৎসাহের আতিশয্যে কাউকে আমরা আকাশছোঁয়া মর্যাদায় নিয়ে যাই। আবার একই রকম বীরত্ব বা অবদানের জন্য পাশাপাশি আরেকজনের অবদান উল্লেখই করি না। আমার মতবাদের বা আদর্শের ব্যক্তি হলে তিনি সব সমালােচনার উর্ধ্বে। আর ভিন্ন মতাদর্শের হলে মুক্তিযুদ্ধের নায়কও খলনায়ক বনে যান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় যাদের নাম মুখে-মুখে শােনা যেত অসম সাহসিকতা আর বীরত্বের জন্য; সম্মুখ সমরে আর নেতৃত্বে যারা ছিলেন তুলনাহীন-কী স্বচ্ছন্দে আমরা তাদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু সত্যকে তাে চিরদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, কর্মকাণ্ড, মুক্তিবাহিনীর বীরত্বগাথা, পাকিস্ত নিদের নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যা- এসবই দেশে-বিদেশে পত্র-পত্রিকায়, টি.ভি-রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে, বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং সযত্নে সংরক্ষিত হয়ে আছে। ভারতে, ব্রিটেনে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, আরকাইভস ইত্যাদিতে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে (লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে) মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য দলিলপত্র ও তথ্য পাওয়া যাবে। আমরা তাে যে রেকর্ড আমাদের অনুকূলে আসবে না সেটা হয় পরিহার করি, না হয় ফেলে দেই। যাই হােক, ইচ্ছা করলেই তাে ইতিহাস পাল্টানাে যাবে না। যা সত্য তা সবসময়েই সত্য। মিথ্যা, মিথ্যাই।
আরেকটি বিষয় হলাে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সাধারণভাবে বৈরি মনােভাব প্রকট করে তােলা। এই মনােভাবের সৃষ্টি অবশ্য ১৯৭২ সাল থেকেই। জনগণের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গণশত্রুরা তখন থেকেই সক্রিয় ছিল। ভােল পাল্টাতে সময় লাগেনি। আরেক দল ক্ষমাপ্রাপ্ত, বাংলাদেশি পােশাকে জাত পাকিস্তানি, সুযােগ পেলেই আঘাত হেনেছে। পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর বিরাট অংশ ১৯৭৩ সালে ফিরে আসার পর সামগ্রিকভাবে কখনই বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য পােষণ করেনি। বাইরে তারা স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান ছিলেন। এরা নানাভাবে, নানা কৌশলে দুটো জিনিস অর্জন করে। এক, মুক্তিযােদ্ধাদের সম্বন্ধে জনমনে, বিশেষ করে শহরে এবং শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেয় যে মুক্তিযােদ্ধারা (আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ) ভারতে চলে গিয়েছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। তারা যুদ্ধ করেননি; আরাম-আয়েশ করেছেন। দুই, মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে কাজের নয়; এরা লেখাপড়ায় ভালাে নয়; পড়াশুনা জানে না; এদের ভালাে পােস্টিং দিলে কাজ হবে না ইত্যাদি। এরকম এক অপপ্রচারের ফলে সাধারণভাবে মুক্তিযােদ্ধারা সর্বত্র অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দীর্ঘকাল, বলতে গেলে স্বাধীনতার পর অধিকাংশ সময় পর্যন্ত। (অবশ্য ১৯৭২-৭৪ এবং ১৯৯৬-২০০০) সময়কাল এর ব্যতিক্রম)।
সামরিক বাহিনীর ভেতরে চলেছে অন্য আরেক রকম ষড়যন্ত্র। সেটা হলাে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তােলা, Divide and Rule নীতি (বিভাজন করে শাসন করাে)। খুব সূক্ষ্ম এবং সুচতুরভাবে মুক্তিযােদ্ধা সেনা-অফিসারদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বীজ বপন করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্যই উচ্চাভিলাষী ছিলেন; দুয়েকজনের আচরণও ভালাে ছিল না; আবার কয়েকজন অতিবিপ্লবী দেশে অবিলম্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভাের হন। এসব কারণে সামগ্রিক এবং সমষ্টিগতভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের চরম ক্ষতি হয়। সুযােগসন্ধানী এবং স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের সাথে হাত মেলায় স্বার্থান্বেষী মহলের অফিসাররা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে স্বাধীনতার পর যত ষড়যন্ত্রমূলক অভুত্থান হয়েছে তার সবগুলােতেই বলি হয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। নিজেরা হানাহানি করেও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বা বিতাড়িত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়: আমরা মুক্তিযুদ্ধ চাই, মুক্তিযােদ্ধাদের চাই না। দেশের কল্যাণে কাজ করবেন যিনি, তিনিই প্রকৃত সমরবিদ, অন্য কেউ নয়। তার গলায় শােভা পাবে বিজয়মাল্য।
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিক আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই রূঢ় সত্যটি চরম হতাশাব্যঞ্জক এবং বেদনাদায়ক। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বাংলাদেশের মূল সমস্যাও এখানেই।

পৃষ্ঠা: ২০
স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববাসী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল এবং প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে আমি কোনাে পার্থক্য দেখি না। জনযুদ্ধের যে- বৈশিষ্ট্যগুলি সম্বন্ধে আলােচনা করেছি তাতে বাংলাদেশের প্রায় সবাই মুক্তিযােদ্ধা। কিন্তু তার একটি শর্ত আছে। সেটি হলাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিক হতে হবে।
পরিশেষে, জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযােদ্ধার স্বীকৃতি দাবি করা আমার সর্বোচ্চ কর্তব্য বলে মনে করছি। সহ-মুক্তিযােদ্ধা যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাদের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে লিখতেই হবে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে। প্রয়ােজনে আইন করে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুক্তিযােদ্ধা-কর্মকর্তা হিসেবে আমার এই প্রস্তাব সকল মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির দাবি হিসেবে পরিগণিত হােক।

স্বাধীনতা: ইতিহাসের ধারাবাহিকতা

এই বিষয়টিকে ঘিরে ইদানীং বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যারা এর সূত্রপাত করেছেন তারা মুক্তিযুদ্ধ বা এর ঐতিহাসিক সত্যগুলাের সাথে আদৌ কখনও সম্পৃক্ত ছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমার ঘােরতর সন্দেহ আছে। অন্য এক অধ্যায়ে আমি বলেছি যা সত্য, তা সব সময়ই সত্য। শ্বাশ্বত সত্য কয়েক জনের উক্তি বা বক্তব্যে মিথ্যা হয়ে যায় না। কথাটি আরেকটু পরিষ্কার করে বলি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একজনে, এককভাবে কেউ করেননি। এটি ছিল সত্যিকার অর্থে জনযুদ্ধ। সকলের মনে এর স্মৃতি গভীর রেখাপাত করে আছে। যারা ঐ সময় প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, কিন্তু এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায়, তাদের তাে খুব ভালােভাবে মনে আছে কখন কী ঘটেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁরাও সব ঘটনা জানেন। মুক্তিযােদ্ধারা অনেকেই জীবিত আছেন। তাঁদের বক্তব্যও শােনা প্রয়ােজন। সর্বোপরি সেনানায়কেরা, যাদের অবলম্বন করে অমুক্তিযােদ্ধারা এই অপ্রয়ােজনীয় বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন, তাঁরা কবে কী বলেছিলেন তা জানা দরকার। না-দেখে, না-শুনে, অজ্ঞানতাপ্রসূত বক্তব্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের ছােট করা হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা ১৯৭১ সালের সম্পূর্ণ ঘটনাবলি, কাগজপত্র, দলিল সকলের কাছেই রক্ষিত আছে। এর ওপর বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে অনেকে গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেকে বিস্তর লেখালেখি করেছেন।
আমাদের দেশের প্রামাণ্য দলিলপত্র অযত্নে, অবহেলায়, এবং কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বিদেশে সব দলিলপত্রই সযত্নে রক্ষিত আছে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই এগুলাে পাওয়া যাবে। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে তাে খুব ভালােভাবে বিরল সব নথিপত্র রক্ষিত আছে। ভারতে বাংলাদেশের ওপর কাগজপত্র, দলিল, প্রামাচিত্র ভূরিভূরি এন্তার ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া তাদের সরকারি-বেসরকারি সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এগুলাে রক্ষিত আছে।
আজ যদি আমরা দেশে-বিদেশে সযত্নে রক্ষিত, প্রমাণিত ও পরীক্ষিত দলিলপত্র, তথ্য অস্বীকার করে আকস্মিক নতুন বক্তব্য দিতে শুরু করি তাতে কি দুনিয়ার দরবারে জাতি হিসেবে ছােট হয়ে যাই না? সত্যকে ধারণ করে, মুক্তিযােদ্ধাদের অবদান স্বীকার করে, তাদের যথাযােগ্য মর্যাদা দিয়ে (এবং কাউকে হেয় না করে) আমরা তাে সত্য, সুন্দর, সুস্থ বক্তব্য দিতে পারি। আমার সন্দেহ হয়, বর্তমান বিতর্কটি স্বাধীনতার শত্রুদের আরেকটি কূটচাল। তারা অতি সূক্ষ্মভাবে আগের মতােই মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কোনাে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা, যারা কোনাে সময়েই নেতৃস্থানীয় ছিলেন না এবং মুক্তিযুদ্ধের নীতিনির্ধারণী বৃত্তের বাইরে অবস্থান করেছেন, তাঁরাও উৎসাহের আতিশয্যে নিজেদের পায়ে কুড়ােল মারছেন। মুক্তিযােদ্ধার পরিচয়দানকারী এঁরা আদৌ মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন কি না সে-বিষয়ে আমার সংশয় আছে। অপরদিকে এটা আমাদের সেই পুরােনাে পরিচিত সােড়শ বাহিনীর কাজ নয় তাে? দিন, তারিখ, ক্ষণ ঘােষণা নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিলে মুক্তিযুদ্ধই কি বিতর্কিত হয়ে পড়ে না?

পৃষ্ঠা: ২২
বড় দুঃখে আরেকটি বক্তব্য দিতে ইচ্ছা করছে। এদেশ হলাে চাটুকারদার চারণক্ষেত্র। এই চাটুকারদের নিজেদের সম্পর্কে কোনাে ভালাে বক্তব্য থাকে না। এদের কাজ হলাে প্রথমে মনিবের মনের ভাব কৌশলে জেনে নেওয়া। অতঃপর, মনিবের পছন্দ মতাে বক্তব্য দিতে থাকা। আর মনিব যাকে পছন্দ করেন না বা যার সম্বন্ধে কটু কথা বললে মনিব মনেমনে খুশি হবেন, ঐরকম বক্তব্য দেওয়া। মনিব বা তার নেতা-নেত্রীর স্তুতি গাইতে গাইতে এরা দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে একজন আপাত দৃষ্টিতে সত্য-সত্যই দেবতা, আরেকজন দানব বনে যান। আমাদের দেশে তােষামােদের কোনাে সীমা নেই। এই তােষামােদকারীরা সবসময় ক্ষমতার আশেপাশে থাকে অথবা যেতে আগ্রহী। ক্ষমতাধরদের তুষ্টিসাধন করে নিজের স্বার্থ হাসিল করাই এদের প্রধান লক্ষ্য। পরিণামে যার তােষামদ তারা করছে তাদেরই চরম সর্বনাশ করছে। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হবার পর এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়কদের বক্তব্যগুলি বিবেচনা করার আগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। স্বাধীনতা-ঘােষণা কখনও কোনাে দেশে আকস্মিক ঘটনা নয়। দেশের সামগ্রিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি বিচার করতে হয়। দীর্ঘদিনের মানসিক এবং বাস্তব প্রস্তুতির ফলে একটি জাতি তার নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নিয়ে, অধিকার নিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একজন মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি বা সমরনায়ক এলেন, ঘােষণা দিলেন আর তারপরেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, এরকম কখনও ঘটেনি। এমনকি অপর একটি জাতির বা রাষ্ট্রের স্বাধীনতাও আকস্মিকভাবে হরণ করা যায়। না। আক্রমণকারী দেশকে অপর একটি দেশ দখল করার পূর্বে দীর্ঘপ্রস্তুতি নিতে হয়। নিজের জাতিকে, আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশকে তৈরি করে বা তাদের সমর্থন আদায় করে ধীর পদক্ষেপে এগুতে হয়। ইরাকের কথাই ধরা যাক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ সাহেবকে ইরাক-আক্রমণ করার আগে কত পাঁয়তারা আর সমরসজ্জা করতে হয়েছিল। কী পরিশ্রম আর কাঠ-খড় পােড়াতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য। তাও তিনি স্বীকৃতি পাননি। সফল স্বাধীনতা সংগ্রামের অনন্য দৃষ্টান্ত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীন এবং বাংলাদেশ। জর্জ ওয়াশিংটন, হাে চি মিন, সুকর্নো, মহাত্মা গান্ধী, মাওসেতুং এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান—এঁরাই ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং সফল নেতা। তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কেউ তাঁদের বিচ্যুত করতে পারবে না। ইতিহাসের পাতায় তাদের আসন নির্ধারিত হয়ে গেছে।
একটি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অনেক দিনের কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য আর ত্যাগের বিনিময়েই সফল হতে পারে—কখনও আইনানুগভাবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে, কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, কখনও বা কোনাে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে।
ইতিহাসের এই ধারা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনাে ব্যত্যয় নয়। কোনাে একটি জাতির অভ্যুদয় আকষ্মিক হয় না। এজন্য প্রয়ােজন দীর্ঘ প্রস্তুতির। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে এই প্রস্তুতি নিতে হয়। এই যে দীর্ঘ প্রস্তুতির কথা বললাম তার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়ােজন, যে-নেতৃত্ব জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে, লালন করে তা বাস্তবায়নের জন্য ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যান। সেখানে বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুমনির্যাতন নিশ্চিত জেনেও এমন বিরল নেতা নিজেকে কখনও লক্ষ্যচ্যুত করেন না। এমন নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নয়, সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ঐতিহাসিক সত্য। একে বিকৃত করে জাতি লাভবান হবে না। তার সামগ্রিক নেতৃত্ব দিয়ে কখনও জনগণের মাঝ থেকে, কখনও কারান্তরালে থেকে, জাতিকে তার মূল লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একই সাথে আরও অনেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্থান-কাল বুঝে নেতৃত্ব উঠে এসেছে—কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনও জাতিগঠনে, কখনও সরকার পরিচালনায়। এদের কারাে ভূমিকা বা অবস্থান অস্বীকার বা ছােট করার অর্থ জাতি হিসেবে নিজেদের তুচ্ছ করা। প্রত্যেককে যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। সম্মান দিতে হবে, যে স্থান ইতিহাস তাদেরকে দিয়েছে। আপনি, আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেই কেউ ছােট হবেন না, আবার কারাে মর্যাদা বা কীর্তি গগনচুম্বী করতে চাইলেও তা সম্ভব হবে না।
এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে আরাে আলােচনা করার আগে এর প্রেক্ষিত এবং তার সপক্ষে ঐতিহাসিক পটভূমি ও ধারাবাহিকতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করা প্রয়ােজন মনে করি। সাথে-সাথে বিংশ শতাব্দী এবং সমকালীন কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করাও দরকার।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েক বছর আগেই নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রা প্রদেশে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম, অনেক প্রাণহানি ও রক্তপাতের পর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশ্য এর পেছনে তেল-কোম্পানি ও ভাড়াটে সৈন্যদের বড় ভূমিকা ছিল। নাইজেরিয়ার এই ঘটনার পর বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে (Secessionist Movements) বিশ্বব্যাপী একটা সন্দেহের এবং আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। ফলে বৃহৎ শক্তিগুলাে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনকে অবহেলার দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে থাকে। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরােপের কোনাে-কোনাে দেশের প্রাথমিক মনােভাব বেশ বিরূপ ছিল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এর যৌক্তিকতা, ন্যায়নীতি এবং প্রয়ােজন তুলে ধরার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেখাইে প্রধান ভূমিকা পালন করেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যেহেতু আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং যেহেতু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধিকারী রাজনৈতিক দল জনগণের ম্যান্ডেট-এর ভিত্তিতে (অর্থাৎ ৬-দফার ভিত্তিতে) সরকার গঠন বৈধ, আইনগত এবং নীতিগত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়; সেহেতু তাঁদের যিনি অবিসম্বাদিত নেতা, তার ঘােষণাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহির্বিশ্বে সুপরিচিত ছিলেন। সবাই জানত তিনিই নেতা। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ স্বাধীনতা ঘােষণা করলে বৈধতা পাবে না। জিয়াউর রহমান এই সত্য উপলব্ধি করেই তার প্রাথমিক ঘােষণা সংশােধন করে বঙ্গবন্ধুর নামেই স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বলিত বাণী পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চ অপরাহ্বে চট্টগ্রামের নিকট অবস্থিত কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। পৃথিবীর যেসব জাতি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসী তারা স্বাধীন বাংলার সংগ্রামে সহানুভূতিশীল হবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
স্বাধীনতার ঘােষণা একটি মুহূর্তের বা দিনের কোনাে বিষয় নয়। একটি জাতির জীবন-মরণ প্রশ্ন জড়িত থাকে স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে। ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় স্বাধীনতার বীজ রােপিত হলেই তা থেকে বাস্তব রূপ নেয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস সুদীর্ঘ, হঠাৎ কোনাে সংক্ষিপ্ত ঘটনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, এ-কথা আগেই বলেছি। সংক্ষেপে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তুলে ধরা আবশ্যক মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের পূর্ববাংলানামে অভিহিত অঞ্চলের জনগণ অতি প্রাচীনকাল থেকেই তাদের একটি পৃথক সত্তা বজায় রেখেছে। বহিরাগত কোনাে শক্তির আধিপত্য মেনে নেওয়ার ব্যাপারে তারা বরাবর অনীহা প্রকশ করেছে। ইতিহাসই বলে দেয়, বৃটিশ শাসনামলে বঙ্গদেশেই প্রথম জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। পরিণতিতে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বৃটিশ-শাসন অবসানে যেসব আন্দোলন গড়ে ওঠে তার মধ্যে ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব ছিল বাংলার জননেতাদের উল্লেখযােগ্য অবদান। দেশবিভাগের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয়কে ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন জারি করেও যেমন আড়াল করা যায়নি, তেমনি পাকিস্তানি শাসকবর্গের পক্ষে স্বাধিকারের আন্দোলন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৮ সালে সৃষ্ট পাকিস্তানের দুটি অংশের পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, পুঁজিপতি, আমলা ও সামরিক ব্যক্তিবর্গের উপনিবেশবাদী মনােভাব পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাবধারাকে শক্তিশালী করে তোলে। এই অনুভূতি থেকেই পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই। সরকারিভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষিত হওয়ার পূর্বক্ষণে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতির ভাষণে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন:
আপনারা স্বাধীন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনারা স্বাধীনভাবে আপনাদের মন্দিরে বা মসজিদে বা অন্য যে-কোনাে উপাসনালয়ে যেতে পারেন। আপনারা যে-কোনাে ধর্ম, গােত্র বা মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন, রাষ্ট্রের কার্যাবলির সাথে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। …আমরা এই মৌলিক নীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করছি যে, আমরা সকলেই এক রাষ্ট্রের নাগরিক, সমান নাগরিক। … এখন আমি মনে করি আমাদের সামনে এই আদর্শ রাখতে হবে এবং কালক্রমে আপনারা দেখতে পাবেন, হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না; মুসলমান মুসলমান থাকবে না, ধর্মীয় অর্থে নয়, কারণ সেটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিকরূপে।
মি. জিন্নাহ বলেছিলেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে তার ভিত্তি হবে ধর্মনিরেপেক্ষতা। তা না হলে পাকিস্তান টিকে থাকবে না। জিন্নাহর ধারণাই ঠিক ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তার ধারণার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যু ধর্মনিরপেক্ষতার গতিধারা স্তব্ধ করে দেয়। এরূপ এক অবস্থায় ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্ররূপে ঘােষিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের এই শাসনতন্ত্র ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা-দখলের ফলে বাতিল হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের ভিত্তি নস্যাৎ হয়।
পাকিস্তানে ক্ষমতা-দখলের প্রতিযােগিতা শুরু হয়। মি. জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করে লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, গােলাম মােহাম্মদ (বেসামরিক আমলা) শাসনকাজ পরিচালনা করেন। গােলাম মােহাম্মদের রাজনৈতিক কোনাে ভিত্তি ছিল না, ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি আমলা এবং পাঞ্জাবি-প্রভাবিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তােলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহৃত হতে থাকে। আর এ-সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে (পূর্ববাংলাকে) শােষণ করা হয়। পূর্ববাংলার

পৃষ্ঠা: ২৫
জনগণ বঞ্চনা আর শােষণে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ক্ষুদ্ধ মনােভাব সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করতে বাঙালিদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা সম্পর্কে নতুন চেতনা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনের সময়েই গড়ে ওঠে।
এই সময় মুসলিম লীগের বিভক্তি এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী সুসলিম লীগের জন্মের পর আরাে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন যেমন যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল ইত্যাদি গড়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিমশব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগনামে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে আরাে দুটো নিরপেক্ষ দলের জন্ম হয়। পাকিস্তানে কমুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকলেও পূর্ববাংলায় এর গােপন তৎপরতা ছিল। পূর্ববাংলার রাজনীতিতে এসব দলের তৎপরতা ক্ষুন্ন করতে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আইয়ুব খান একনায়কতন্ত্রের সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা চালু করেন। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং শাসনবিভাগকে সকল ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। বাঙালি জনগণ এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং অনুধাবন করে যে, একমাত্র বয়স্থ ভােটাধিকার (adult franchise) ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের (direct election) ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যম ব্যতীত তারা দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবে না।
১৯৬৬ সালের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বে জনগণের একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত হয়। আওয়ামী লীগ প্রণীত ৬-দফা দাবি বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টারূপে পরিগণিত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি ঐতিহাসিক ৬-দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রমাণ করে যে, জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কর্মসূচির পেছনে রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে। এতে সমগ্র বাঙালি জাতি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংলাপের নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন এবং বাঙালি জাতির উপর চরম আঘাত হানতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। অতর্কিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা শুরু করে। রুখে দাঁড়ায় সমগ্র জাতি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর আগে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে) ৭ মার্চ ঘােষণা করলেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঐ ভাষণেই তিনি আহবান জানালেন:… তােমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে…। আবার এ-ও বলেছিলেন: …আমি যদি হুকুম দেবার না পারি …। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতিকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং তার ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রসঙ্গত সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুভূতির কথা উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি তার লেখা একটি জাতির জন্মশীর্ষক প্রবন্ধে একস্থানে লিখেছিলেন: ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলাে। (রুহুল আমিন সম্পাদিত জিয়াউর রহমান স্মারকগ্রন্থ, হীরা বুক মার্ট, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ২৭)। যথার্থ অনুভূতি! নিরস্ত্র বাঙালি-নিধনে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মেজর জিয়াউর রহমানের মতাে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালিকেই প্রতিরােধ-যুদ্ধে তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আহবান, যার যা আছে, তাই নিয়ে, তকালীন মেজর জিয়ার বিবেককে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল সেদিন, পরবর্তীতে তা তার লেখাতেই ফুটে উঠেছে।
জিয়াউর রহমান ছাড়াও সেনাবাহিনীর আরাে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এবং মেজর মীর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমােক্ত সেনা-কর্মকর্তা তাঁর লেখার এক স্থানে বলেছেন: … তাই ওরা ছুটে যায় নেতার কাছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে নির্দেশ চাই।… ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ঘােষণা দিলেন …। (রহীম শাহ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, (রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম রচিত বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ?), জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৭, পৃ. ১৬৩]। দ্বিতীয়ােক্ত সেনা অফিসার লিখেছেন: ‘… কার আহবানে বাঙালি সেদিন পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা? ৭ মার্চ, ‘৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে) কে জাতিকে স্বাধীনতার ডাক শুনিয়েছিলেন? ২৬ মার্চ ‘৭১ সন্ধ্যা হতে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মূল বেতার কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে অবস্থান করে যারা স্বাধীনতার কথা বললেন, বিভিন্ন ঘােষণা প্রচার করলেন, কে তাদের সেদিনের প্রেরণার উৎস ছিল? কার পক্ষে তারা প্রচার করেছিলেন সেসব ঘােষণা, স্বাধীনতার কথা? কাজেই বলুন কে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি? কে বা কারা ঘােষক ছিলেন, সেটা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল না?’ (মীর শওকত আলী রচিত মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও প্রসঙ্গ কথা), পৃ. ৬৯]। একই প্রবন্ধে মীর শওকত আলী বলেছেন: … চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতা ঘােষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলে যে জেনারেল জিয়া করেছেন নাকি আওয়ামী লীগ থেকে করেছেন। আমার জানা মতে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইর কণ্ঠই লােকে প্রথম শুনেছিলেন। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রেরকযন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পাননি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, তাহলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাইর সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ, ৭১ মেজর জিয়ার ঘােষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতাযুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মােড় নেয়। (প্রাগুক্ত, পৃ.৬৯)।
আরাে একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা ৯ নম্বর সেক্টরের খুলনা জেলার সাব-সেকটরের অধিনায়ক সামরিক কর্মকর্তা এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন তার তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থাননামক গ্রন্থের ৪৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: “রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সুস্পষ্ট পূর্বনির্দেশনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক, আধা-সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পক্ষ ত্যাগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের সহযােগিতায় স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ মতাে করে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এ-ব্যাপারে সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। এভাবে প্রতিরােধের ধারাবাহিকতায় সমগ্র জাতি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তথা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে।”
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী চাকমা ব্যতীত বেশির ভাগ উপজাতিও এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, আমি (গ্রন্থকার) নিজেও ২৭ মার্চ বিকেলের দিকে অতি ক্ষীণ স্বরে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হতে শুনেছি। আমার মতাে অনেকেই (এ-মুহূর্তে ক্যাডার কর্মকর্তা রেজাউল হায়াতের নাম মনে পড়ছে) শুনেছিলেন। আমার কানে আজও স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘােষণার কথাগুলাে অনুরণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের অভ্যন্তরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে, সীমান্ত অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামগড় পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌছুতে রাত হয়ে যায়। পথিমধ্যে বিকেলে রেডিওতে একটি কণ্ঠে ইংরেজিতে কিছু শুনতে পাই। প্রথমে কিছুই তেমন বুঝা যাচ্ছিল না। তবে বাংলাদেশশব্দটি শুনে উৎকর্ণ হয়ে উঠি পুরােটা শােনার জন্য ঘােষণায় বলা হচ্ছিল, আই মেজর জিয়াউর রহমান, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান …’। ব্যস, আমাদের জন্য এ ঘােষণাই যথেষ্ট ছিল। তা-ও আবার একজন সেনা-অফিসারের মাধ্যমে। আমার সহযাত্রীসহ সকলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। ভাবলাম, আমরা শুধু একা নই। সাথে রয়েছেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমাদেরই ভাইয়েরা। আর পিছনে ফিরে তাকানাে নয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুনােই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।’
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতাে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশি পত্র-পত্রিকা, রেডিও ইত্যাদিতেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-ঘােষণা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ২৭ মার্চ The Times পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডিং ‘Heavy Fighting as Sheikh Mujibur Rahman Declares East Pakistan Independent’ (শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন, সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে) প্রকাশিত হয়। একই দিনে Financial Times পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘Civil War after East Pakistan Declares Independence’ (পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করায় গৃহযুদ্ধ) শিরােনামের সংবাদে বলা হয়: গতকাল (২৬ মার্চ) শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে একটি রেডিও থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার এ-ঘােষণা প্রচার করা হয়(ভাষান্তরিত)। ২৭ মার্চ The Guardian পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘Heavy Fighting after UDI (Unilateral Declaration of Independence] by East Pakistanশিরােনামে এতদ্সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
প্রসঙ্গত একটা বিষয় সকলের গােচরে আনা প্রয়ােজন মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা প্রকৃতপক্ষে দুটো পর্যায়ে বিবেচ্য। কেননা, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার আসনে বসতে দিল না। ঐতিহাসিক ৬-দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়লাভকারী (নিখিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে) রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বৈধ ছিল। দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে শাসনযন্ত্রের প্রচলিত রীতিনীতি ভঙ্গ করায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ ছিল একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদের বক্তব্য। তাঁর এই অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতা-ঘােষণার বিরুদ্ধে আইনগতভাবে কোনাে অভিযােগ উত্থাপন করা সম্ভব ছিল না। The Daily Telegraph পত্রিকার সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক ঢাকা থেকে লিখেছিলেন: The End of old Pakistan শিরােনামে এক প্রতিবেদন। তিনি লিখেছিলেন On Sunday (7 March) Sheikh Mujib came as near declaring this (independence) as he could without inviting harsh reaction from the Army (10 March 1971)। তার এই ঘােষণার প্রতিধ্বনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকেও প্রচারিত হয়েছে।
হান্নান সাহেব বা জিয়াউর রহমান উভয়েই বঙ্গবন্ধুর ঘােষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতির জন্য এক স্মরণীয় কাজ করেছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণা, হান্নান সাহেব ও জিয়াউর রহমানের ঘােষণাপত্র পাঠ, এসবই ছিল অনানুষ্ঠানিক। স্বাধীনতা ঘােষণার এটি ছিল প্রাথমিক পর্যাগণপ্রজাতন্ত্রীয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যগণ ১০ এপ্রিল বৈধভাবে মুজিবনগরে বংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণের পর উক্ত সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঘােষিত এবং প্রচারিত স্বাধীনতার ঘােষণা অনুমােদন ছিল আনুষ্ঠানিক। এই ঘােষণার শিরােনাম ছিল: ‘The Proclamation of Independence’ উল্লেখ্য, এই ঘােষণার খসড়া অতি দ্রুততার সঙ্গে এক পৃষ্ঠা শাদা কাগজে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম লিখে দিয়ে এক ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় এটিই ছিল মূল ভিত্তি। এই ঘােষণার শেষ অনুচ্ছেদের অব্যবহিত পূর্বের অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ:
We further resolve that this Proclamation of Independence shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.
(দ্রষ্টব্য: হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২, পৃ. ৪)।
কাজেই বলা বাহুল্য যে, বৈধভাবে গঠিত এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘােষণার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। অধিকন্তু প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখের ভাষণে যুদ্ধরত সকল বীর সেনানায়কের বীরত্বের বর্ণনা দেন। এ থেকে প্রমাণিত যে, যুদ্ধরত সকল সেনানায়কসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কর্মরত ছিলেন। সরকারের কোনাে কর্মচারীর স্বাধীনতার ঘােষণা আন্তর্জাতিকভাবে কখনই বৈধ নয়, এ সত্য অনুধাবন করতে পারলে জাতির জন্য তা সম্মানজনক হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশ, কনটেম্পরারি ইভেন্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টসশীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। খন্দকার মােশতাক। আহমেদ এতে ছােট্ট একটি ভূমিকা লেখেন। মুখবন্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখেন যে, This division remains thankful to Mr.Moudud Ahmed, Barrister-at-law for his untiring efforts to arrange these documents. স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গে এই পুস্তিকার ১১৮ পৃষ্ঠায় আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১’ যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলাে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার ঘােষণার তারিখ ২৬ মার্চ উল্লেখ করা হয়েছে। কোনাে নাগরিক সংবিধান-বহির্ভূত কথা বললে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আমি সে-সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে এসব ঘােষণা, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে এবং বিশদভাবে প্রমাণসহ জানি। বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা-ঘােষণা নিয়ে যে ধূমজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানাে হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিকৃতির সামিল ছিল। কারণ পৃথিবীর সর্বত্রই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশেও সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশে সংরক্ষিত তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করা সম্ভব হলেও পৃথিবীর অন্যত্র সংরক্ষিত তথ্য বিকৃত করা অপচেষ্টাকারীদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
স্বাধীনতার ঘােষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ- ১৯৭১ (Laws Continuance Enforcement Order-1971)জারি করেন। এটি ছিল নিম্নরূপ:

আইনের ধারাবাহিকতা ও প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১

মুজিবনগর
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘােষণায় আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়ােজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘােষণাসাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারি, কর্মকর্তাকর্মচারী, বেসামরিক, সামরিক, বিচারবিভাগীয়, কূটনৈতিক যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তারা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
স্বা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি

Laws Continuance Enforcement Order-1971

Mujibnagar,
Dated 10th day of April, 1971
I, Syed Nazrul Islam, the Vice President and Acting President of Bangladesh, in exercise of the powers conferred on me by the Proclamation of Independence dated tenth day of April, 1971 do hereby order that all laws that were in force in Bangladesh on 25 March, shall subject to the Proclamation aforesaid continue to be so in force with such consequential changes as may be necessary on account of the creation of the sovereign independent State of Bangladesh formed by the will of the people of Bangladesh and that all government officials civil, military, judicial and diplomatic who take the oath of allegiance to Bangladesh shall continue in their offices on terms and conditions of service so long enjoyed by them and that all District Judges and District Magistrates, in the territory of Bangladesh and all diplomatic representatives elsewhere shall arrange to administer the oath of allegiance to all government officials within their jurisdiction.
This order shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.
Signed: SYED NAZRUL ISLAM
Acting President

পৃষ্ঠা: ৩০
উপসংহারে বলতে পারি যে, স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে যে-বিতর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে শুরু করা হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর সন্দেহ নেই। কারণ, উপরে বর্ণিত আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১সকল বিতর্ক অবসানে এক অকাট্য দলিল। এ-সত্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে কোনােভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মুখের কথায় সত্যকে উৎখাত করা যায় না, যাবে না। নতুন প্রজন্মকেও এই সত্য অনুধাবন করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্বন্ধে ইতিহাসের পাঠ মেনে নিতে হবে। সত্যকে বিকৃত করে ছােট হওয়া অপেক্ষা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেয়। এতেই জাতির মঙ্গল ও কল্যাণ হবে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্মলগ্ন ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র (Proclamation of Independence) হলাে আমাদের ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ। এই ঘােষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্ ক্ষমতার বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলাে, যে-রাষ্ট্রের নাম হলাে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (People’s Republic) যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলাে মুজিবনগর সরকাররূপে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্ন নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। আমাদের সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি পর্যালােচনা করলেই বােঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন-কাঠামাে।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বল বিশেষ প্রয়ােজন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কেবলই মুজিবনগর সরকার নামে আখ্যায়িত করে (যেহেতু তার প্রধান কার্যালয় ভারতে অবস্থিত ছিল তাই) তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল মেয়াদি সরকারের প্রথম ৩ বৎসর বাদে সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ। স্বাধীনতাবিরােধীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে একে পুতুল সরকার বলে পরিচয় দেওয়ার। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এবং ২০০১ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই স্বাধীনতাবিরােধীচক্র ইতিহাস বিকৃত করে লেখায়, আলােচনায়, টিভি, রেডিও ও সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ছােট করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের সে অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতিহাসকে তাে আর বিকৃত করা যায় না, তবে স্বাধীনতা যারা চায়নি তারা এই অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী তাদের পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস-বিকৃতির কাজে আমাদের মধ্যে মীরজাফরের মতাে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। যারা এই বিশ্বাসঘাতকতায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের নামের তালিকা ইতিহাসের পাতায় ঠিকই অন্ত ভুক্ত হবে। কালের অমােঘ নিয়মই এটা।

বিপ্লবী প্রবাসী সরকার: সমকালীন ইতিহাস
প্রবাসী সরকার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণ প্রদানের জন্য উপরের কথাগুলাে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হলাে। বিংশ শতাব্দীতে এরকম সরকারের অনেক উদাহরণ পাওয়া। যাবে। স্থান ও কালভেদে এদের স্বরূপ এবং চরিত্র বিভিন্নরূপে দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জেনারেল চার্লস দ্য গলের স্বাধীন ফরাসি সরকার (Free French Government) এবং পােল্যান্ডের প্রবাসী সরকার লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। অবশ্য আমাদের সাথে তুলনা করলে আজকের দিনের মাপকাঠিতে এগুলােকে সরকার বলা চলে না। সাম্প্রতিককালের প্রবাসী সরকারগুলাের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে, পি.এল.ও.। দীর্ঘকাল তারা প্রথমে লেবাননের বৈরুতে, জর্দানের আম্মানে এবং সর্বশেষে তিউনিসিয়ার তিউনিসে সদর-দপ্তর স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশই পি.এল.ও.-কে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাদের সাথে যােগাযােগ করেছিল যদিও তাদের নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে কোনাে ভূখণ্ড ছিল না। আফগানিস্তানের মুজাহেদীনদের শুধু স্বীকৃতি নয়, তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য, প্রশিক্ষণ, সহযােগিতা দিয়েছে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি। সুদীর্ঘ দশবছর তাদের সদর-দপ্তর ছিল পাকিস্তানের পেশােয়ারে। সেখানে তারা কী পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, আর্থিক সাহায্য পেয়েছে তা আজ আর কারাে অবিদিত নেই। এ সবকিছুই পাকিস্তানের আই.এস.আই. মারফত গিয়েছে।
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু প্রবাসী সরকারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলাে কম্বােডিয়ার প্রিন্স নরােদম সিহানুকের সরকার, যার সাথে পলপটের খেমুররুজ (যা বিশ্বব্যাপী ধিকৃত এবং নিন্দিত) যুক্ত ছিল। এদের সদর-দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিং-এ অবস্থিত ছিল। কোনােকোনাে সময় এরা থাইল্যান্ডেও অবস্থান করতেন। সিহানুকের স্বাধীন কম্বােডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল যেখানে তারা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সাথে তুলনীয়। অবশ্য স্বাধীন অঞ্চলে নেতৃত্ব, বিদেশে ব্যাপক গণসমর্থন ও সহানুভূতি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, নিজস্ব আয়-ব্যয়, স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকারের ন্যায় কার্যকলাপ এবং সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে সর্বস্তরের জনসাধারণের নজিরবিহীন সমর্থন ও ত্যাগ স্বীকার এবং মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ আমাদের সরকারকে দিয়েছিল একটি বিশেষ পরিচয় যার তুলনা কোনাে প্রবাসী সরকারের সাথেই চলে না।
পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। সেখানকার এস.ডি.পি.ও. মাহবুব আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। মার্চের ৩০ তারিখে পশ্চিমবাংলা সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করে ২ এপ্রিল দিল্লিতে গমন করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
এই মন্ত্রিসভা এবং এমএনএ ও এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসালামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান-কে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ােগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম. এ. জি. ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার আকারে বিশাল না হলেও অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদেরকে যুবশিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি—এ সবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই পাকিস্তান-সমর্থক এবং স্বার্থন্বেষী মহল পুরােনাে পাকিস্তানি কায়দায় অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার শুরু করে দেয়। এদের প্রচার কখনও সূক্ষ্ম, কখনও ভুল; কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই। আর তা হলাে মুজিবনগর সরকার মানেই, ভারত। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী– এদের সদুপদেশ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু দেশবাসীকে সত্যকথা জানাতে হবে। তথাকথিত ভারত-বিরােধী চক্র, যারা অতি প্রাচীন পাকিস্তানি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে ক্রমাগত, তাদের মুখােশ উম্মােচন করতে হবে। এদের প্রকৃত পরিচয় জনগণকে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মকে যাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট নয়; বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার পর অধিকাংশ কাল পর্যন্ত যাদেরকে মিথ্যা, ভ্রান্ত এবং বিকৃত গল্প দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে ও হচ্ছে– জানাতে হবে।
একটি স্বাধীন দেশের সরকারের বৈশিষ্ট্য কী, সে-সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করলেই মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথার্থ চরিত্র ও রূপ পরিষ্কার হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত সংজ্ঞায় গণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতি দুই রকমের হতে পারে:
(ক) রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং (খ) সংসদীয়। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ এবং নির্বাচনী ঘঘাষণা (ম্যানিফেস্টো) অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় নেতার হাতে। তিনি হলেন সরকারপ্রধান। রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান নিজে কোনাে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না, দুয়েকটি বিষয় ব্যতীত (যেমন নির্বাচনের পর তাঁর বিবেচনা অনুযায়ী কোনাে দলনেতাকে সরকার গঠন করতে আহ্বান করবেন)।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণেই বােঝা যায় এটা প্রজাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসম্বাদিত নেতা। তার অনুপস্থিতিতে দলনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। মুজিবনগরে তিনি গঠন করেছিলেন মন্ত্রিসভা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিরূপে। কর্নেল ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীপ্রধান নিযুক্ত হন, অধিকন্তু তাঁকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। আগের অনুচ্ছেদে এ-কথা বলা হয়েছে। এত ছােট আকৃতির মন্ত্রিসভা এবং সরকারি দপ্তর নিয়ে সরকারের কাজকর্ম চালানাে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুপ্রেরণা ছিল।
সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে যেভাবে রাষ্ট্রের শাসনকাজ পরিচালিত হয়ে থাকে তা থেকে যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক অবস্থায় দুটো বিষয়ে ব্যত্যয় করা হলাে। এক, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিটি মন্ত্রিসভা-বৈঠকে উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করতেন। দুই. যেহেতু অধিকাংশ বৈঠকে প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়সমূহ মুখ্য আলােচ্য বিষয় থাকত, তাই কর্নেল ওসমানী প্রায় প্রত্যেক বৈঠকেই যােগদান করতেন।
মূলত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতাে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। খন্দকার মােশতাক আহমেদকে দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর উপর দায়িত্ব ছিল অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহণ। এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে (মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ দ্রষ্টব্য)।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অপর তিন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি এঁরাই ছিলেন সরকার-পরিচালনায়। নীতি-নির্ধারণের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তাদের। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্দেশনায় আমরা, অর্থাৎ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিববৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতাম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধান সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গঠন-কাঠামাে এবং কার্যাবলির দিকে একটু নজর দিলেই বােঝা যাবে কী অসাধারণ নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই সরকার, তাও মাত্র নয় মাস। সময়ে। অবশ্যই এটি সম্ভব হয়েছিল দেশপ্রেম ও গণসমর্থনের কারণে। কোনাে দেশে জনগণের এত বড় অংশকে এমন ব্যাপকভাবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি। এই দেশপ্রেম, ত্যাগ, মুক্তিকামনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে দেশে ও বিদেশে সমর্থনের ব্যবস্থা করে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল আমাদের বিপ্লবী প্রবাসী সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানগণ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাগণ যেভাবে আত্মপ্রচারে নেমে পড়েছিলেন, তার পাশাপাশি তুলনা করুন শহীদ চার নেতার প্রচার-বিমুখতা আর বিনয়।
আগেই বলেছি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল ছিল না, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল। মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও যে-কোনাে সময় যে-কোনাে স্থানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে প্রয়ােজন ও সময়ের তাগিদে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় যেভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়, ঠিক সেইভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং আমরা সকলে কাজ করেছি। সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রুত এবং দৃঢ়। বাস্তবায়ন তদারক ক্ষিপ্র গতিতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আমার বড় দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তদারক এবং পরিবীক্ষণ (monitor) করা। এ সবই করতাম আমরা জাতীয় দায়িত্ববােধ থেকে। এজন্য কারাে তাগিদের প্রয়ােজন হতাে না। যে যেভাবে পারতেন সেভাবেই দায়িত্ব পালন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে, অন্যথায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব; আমরা ন্যায়ের জন্য, সত্যপ্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছিএই বিশ্বাস আমাদের আত্মপ্রত্যয় এবং সাহস জুগিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য একটাই: যুদ্ধে জয়লাভ করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের তাবৎ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। এজন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কালবিলম্বের কোনাে অবকাশ ছিল না।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠন: মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহ
তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। সেই প্রতিবেদন থেকে এখানে উদ্ধৃতি দিলাম। এতে সরকারের কার্যাবলি সম্পর্কে একটা চিত্র পাওয়া যাবে।

পৃষ্ঠা: ৩৫
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিম্নলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত হয়েছিল:
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
৪. মন্ত্রিসভা সচিবালয়
৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ
১১. কৃষি বিভাগ
১২. প্রকৌশল বিভাগ

মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমন:
১. পরিকল্পনা কমিশন
২. শিল্প ও বাণিজ্য বাের্ড
৩. নিয়ন্ত্রণ বাের্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
৫. শরণার্থী কল্যাণ বাের্ড
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে নিম্নলিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গােষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছে। নিম্নবর্ণিত সংগঠনগুলির নাম থেকেই বােঝা যাবে তাদের ভূমিকা কী প্রকৃতির ছিল।

বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন
যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বাের্ড
বাংলাদেশ হাসপাতাল
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
জয় বাংলা পত্রিকা
বাঙলাদেশ বুলেটিন
বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী সংগঠন
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
বঙ্গবন্ধু শিল্পী গােষ্ঠী
বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গােষ্ঠী
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি
বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ
বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন
লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া

সরকারের নিজস্ব ভূখণ্ড: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না। সরকারের সব দপ্তর মুজিবনগরে হলেও দেশের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ এলাকা যুদ্ধ চলাকালে শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বহু এলাকা শত্রুবাহিনী আদৌ দখল করতে পারেনি। সেসব অঞ্চল দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধকালে শত্রুমুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে সরকারের ঘােষণা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা এবং জনগণ সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদান করেছিল। জনগণের আন্তরিক সহযােগিতা বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতিতে বিপুল প্রাণ সঞ্চার করেছিল। রংপুরের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে, উত্তরে, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল, তা মুক্তই রাখা হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। শুধু তাই নয়, ক্রমান্বয়ে সেই মুক্ত-অঞ্চল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা যেখানে একবার উড্ডীন হয়েছে সেখানে আর নামেনি। রৌমারি মুক্ত এলাকার কথা প্রায় সবাই জানেন। সেখানে আমাদের আঞ্চলিক প্রশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। চিলমারী এবং দিনাজপুরের বড় অংশ মুক্ত ছিল। ফেনীবেলােনিয়াতেও মুক্ত-অঞ্চল আমাদের বেসামরিক প্রশাসনের আওতায় ছিল।
‘মুক্তির গান’ ছবি দেখার পর অবিশ্বাসীরা অনেকে হয়তাে সম্বিত ফিরে পেয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার কথা এবং মুক্ত-অঞ্চলের হুবহু বাস্তব বিবরণ আছে মুক্তির গাননামে নির্মিত ভিডিও-সিডিতে। এ থেকে সর্বস্তরের জনসাধারণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়রা ইতিহাস-বিকৃতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারে। এ-কারণে পাকিস্তানের ভক্তরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে ঐ ছবি যেন এদেশে চলতে না পারে। কিন্তু তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সত্য কখনও চাপা থাকে না। তিন দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে বটে, কিন্তু আজ বাংলার মানুষ জানতে পারছে বুঝতে পারছে, তাদের মুজিবনগর সরকার কত শক্তিশালী ছিল।
আমাদের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন মুক্ত-এলাকাগুলােতে অবাধে যাতায়াত করতেন। ঐসব অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নিকটতম আঞ্চলিক প্রশাসনের (zonal council) অধীনে। ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জন্য খাদ্য ও বস্ত্র এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয় সরকারের পরিকল্পনার ভিত্তিতে। আমাদের বীর সেক্টর কমান্ডারররা মুক্ত-অঞ্চল থেকেই অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। গেরিলাদের পাঠানাে হতাে অভ্যন্তরে। সরকারের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কমান্ডারগণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডাররা সার্বক্ষণিকভাবে মুক্ত-অঞ্চলে প্রহরা এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা রাখেন। তারা ঐসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত অসংখ্যা ঘটনার ওপর ভিত্তি করে অনেক প্রামাণ্য চিত্র তৈরি হয়েছে। সেগুলাে দেশে যেমন আছে, বিদেশের মাটিতেও আছে অজস্র ছবি যাতে দেখা যাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শন করছেন, জনসভায় বক্তৃতা করছেন; আর তাদের সাথে আছেন মুক্তিযােদ্ধা সেনানায়কেরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ক্রমাগত অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করেছে মুক্তআঞ্চলভিত্তিক। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্রের কথা মানুষ আজো স্মরণ করে। যুগ-যুগ ধরে এসবই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছেন পুস্তিকা, প্রচারপত্র ইত্যাদি। এর কিছু কিছু দৃষ্টান্ত আমার কাছে এখনও যেমন আছে, তেমনি জাদুঘর প্রভৃতি স্থানেও সংরক্ষিত আছে।
বিদেশি সংবাদমাধ্যম, পত্রপত্রিকার প্রতিনিধিরা মুজিবনগরে এসেই মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে চাইতেন। Time Magazine, Newsweek, Reader’s Digest, London Times, Guardian, New York Times, Washington Post, La Monde, Reuter, AFP, AP সহ আরও অনেক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শন করে ফিরে এসে তাদের প্রতিবেদন ছেপেছেন। এসব প্রত্রপত্রিকা ও জার্নালের কিছু কিছু কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এগুলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। (পরিশিষ্ট-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ এবং ৮ দ্রষ্টব্য)। এসব প্রতিনিধিদের মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনের যাবতীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারই করতেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তাও গ্রহণ করা হতাে।
প্রাসঙ্গিকভাবে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে যে-শক্তিশালী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে-সম্বন্ধে এখানে সংক্ষেপে পরিচয় তুলে ধরা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে মুজিবনগরে গঠিত সরকারের সদর দপ্তর পশ্চিমবাংলার কোলকাতায় অবস্থিত ছিল। সেনাবাহিনীর দপ্তরও একই সঙ্গে ছিল। সরকারের সদর দপ্তরে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যােগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্ববাংলার সরকারি দপ্তর পরিত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন; সরকারের প্রশাসনেও দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পালিয়ে এসে মুজিবনগর সরকারে যােগ দেন। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন। গঠনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের কয়েক জনের নাম নিচে দেওয়া হলাে:

কর্মকর্তাগণের নাম- মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে পদবি
১. মি. খন্দকার আসাদুজ্জামান, সিএসপি- সচিব
(যুগ্ম-সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়)
২. মি. নূরুল কাদের, সিএসপি- সচিব সংস্থান
(পাবনার ডিসি)
৩. মি. এম. এ. সামাদ, সিএসপি- সচিব প্রতিরক্ষা
(সিলেটের ডিসি)
৪. মি. মাহবুবুল আলম চাষী, (প্রাক্তন পি.এফ.এস.)- সচিব পররাষ্ট্র
৫৷ মি. আনােয়ারুল হক খান- সচিব তথ্য
৬. মি. আবদুল খালেক, পি.এস.পি.- সচিব স্বরাষ্ট্র ও ডিজি পুলিশ
(অধ্যক্ষ, পুলিশ একাডেমী, সারদা)
৭. ডা. টি. হােসেন- সচিব স্বাস্থ্য
৮. মি. নূরুদ্দীন আহমেদ- সচিব কৃষি
(প্রধান বন সংরক্ষক)
৯. মি. আবদুল হান্নান চৌধুরী- সচিব আইন
(জেলা জজ, দিনাজপুর)
১০. মি. এমদাদ আলী- প্রধান প্রকৌশলী
১১. মি. জয়গােবিন্দ ভৌমিক- ত্রাণ কমিশনার
১২. মি. রুহুল কুদুস, প্রাক্তন সিএসপি- মহাসচিব
১৩. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ- গণহত্যা ও স্নায়ুযুদ্ধ সেলের দায়িত্বে
১৪. মি. এইচ. টি. ইমাম, সিএসপি- মন্ত্রিপরিষদ সচিব
(ডিসি পার্বত্য চট্টগ্রাম)

এছাড়া মি. আবদুল মান্নান, এম. এন. এ. বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদক পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। যুবশিবির বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম.এন,এ এবং পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা। পরিকল্পনা বাের্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে ভিন্ন অধ্যায়ে।

আঞ্চলিক প্রশাসন
আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়ােজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযােগিতা- এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলােতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এম.এন.এ/এম.পি.এ.-রা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Zonal Administrative Officer) নিয়ােগ করা হয়। সেইসাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বপর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামাে কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক পরিষদ এবং দপ্তরগুলাে থাকার ফলে দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হবার আগেই আমাদের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। সে-কারণে ১৬ ডিসেম্বরেই (কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে তার আগেই) আমাদের নিয়ােজিত সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা স্ব-স্ব পদে যােগদান করে কালবিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।

যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর কর্মসূচি
যুদ্ধে জয় আমাদের নিশ্চিত—এই বিশ্বাস থেকেই আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যাবলি সম্পর্কে অগ্রিম চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকর কর্মসূচি (Plans and Programs) গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। এই আগাম পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল:
ক. পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আইন-শৃঙ্খলা পুনস্থাপন
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণা ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসতে শুরু করে যে, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এবং স্থানীয় জনসাধারণ রাজাকার/শান্তি কমিটি এবং অন্যান্য দেশেদ্রোহীদের অথ্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলি নিচ্ছে। কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে গণআদালত বসিয়ে বিচারও করা হচ্ছিল। যদিও এই গণদুশমনদের নির্মম শাস্তি প্রাপ্য ছিল তাদের জঘন্যতম অপরাধের জন্য (হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ), তবু সরকার মনে করেছেন যে, এই ধরনের বিচার বা স্থানীয় প্রতিশােধ স্বাধীনতা ঘােষণার পরিপন্থি। স্বাধীনতার মূল্যবােধের অন্যতম ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যা করতে হলে বিনাবিচারে অথবা আদালতের বাইরে কোনাে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতা দেওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলা বেতারে তাই আমরা বারবার ঘােষণা করেছি: আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। ভুলে যাবেন না আমাদের যুদ্ধ হলাে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি আর অগ্রগতির জন্য।
খ. বেসামরিক প্রশাসন চালু করে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার ঘােষণা প্রসঙ্গে পূর্বেই বলেছি যে, দেশ মুক্ত হবার আগেই প্রতিটি জেলার জন্য আমরা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ টিম গঠন করেছিলাম, যাতে প্রশাসনে কোনাে শূন্যতা দেখা না দেয়। একদিকে প্রশাসনের অনেকেই গােপনে আমাদের সাহায্য করেছেন, অপরদিকে অনেকে জ্ঞাতসারেই বিরােধিতা করেছেন। আবার অনেকের সম্পর্কে আমাদের কোনাে তথ্য ছিল না। তারা হয়তাে স্বাধীন দেশে জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য নাও হতে পারেন। এই কারণেই আমাদের সম্পূর্ণ নতুন টিম গঠন করতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই প্রতিটি জেলায় স্বাধীন সরকারের জেলা-প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার (এস.পি. নিয়ােগদান ছিল উপরের (ক) ও (খ) এর প্রথম পদক্ষেপ।
গ. ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
মুজিনগরে অবস্থানকালেই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়। এক কোটির ওপর লােক ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অনেক শরণার্থী অসুস্থ, গােলাগুলিতেও আহত। বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গরু, মহিষ, গৃহপালিত জন্তু কিছু নেই। হালের বলদ নেই। সব লুটপাট করেছে পাঞ্জাবি সেনা আর অবাঙালি-রাজাকার-আলবদর-এর সদস্যরা। শুধুমাত্র স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করলেই আশ্রয় মিলবে না, আশ্রয় থাকতে হবে, ঘর তৈরি করতে হবে। তার জন্য প্রয়ােজন ঢেউটিন, কাঠ, খড় ইত্যাদি। গৃহনির্মাণসামগ্রী, হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, কয়েক মাসের খাদ্যসামগ্রী এ সবকিছুর জন্য আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অর্থাৎ মুজিবনগর সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাভাবনা করেছিল।
এই লক্ষ্যে, বিশেষ করে এত বিশাল মানব-সমুদ্র সামাল দিতে যে-আয়ােজন দরকার ছিল, তা আগেই পরিকল্পনা করে খুঁটিনাটি পর্যন্ত ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। পুরাে অক্টোবর, নভেম্বর মাসে আমরা বিভিন্ন টাস্ক ফোর্স (Task Force) গঠন ও দায়িত্ব বণ্টন করে ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথে প্রতিদিন আলােচনা করেছি। কোন্ কোন্ পয়েন্ট দিয়ে শরণার্থীরা ফিরে আসবে; কী ধরনের ও কত সংখ্যক যানবাহন প্রয়ােজন হবে; অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কোন ব্যক্তিদের আগে আনতে হবে; পথে কোথায় এরা বিশ্রাম নেবে; কীরকম খাবার দিতে হবে (শিশু, বয়স্ক, বৃদ্ধ বাছবিচার করে); জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা কোথায় হবে; ডাক্তার ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থাসহ এরকম অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়ােজনীয় জনবল নিয়ােগ করতে হয়েছে। অবশ্য এ-কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সময়ােচিত সাহায্য ও সহযােগিতা না

পৃষ্ঠা: ৪০
পেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এত বড় সমস্যা সমাধান আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না হয়তাে। তাছাড়া আমাদের রাষ্ট্র তখন শিশুরাষ্ট্র। সময়ােচিত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অনেকে মৃত্যুবরণ করতেন।
ঘ. একই সাথে আমাদের আরও একটি সমস্যার অনুরূপ সমাধান করতে হয়েছে। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীরা ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিরাট সংখ্যক অধিবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এদের পুনর্বাসনের দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হয়েছে।
ঙ. উপরের (গ) ও (ঘ) উভয় কাজের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যেসব বিষয় জড়িত ছিল তার মধ্যে গৃহনির্মাণ সামগ্রী (যেমন ঢেউটিন, কাঠ, খড়, সুতলি, দড়ি, পেরেক, ধাতব তার ইত্যাদি) সংগ্রহ, চাষাবাদের উপকরণ (হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, নতুন ফসল ঘরে না-ওঠা পর্যন্ত কয়েক মাসের খাদ্য সামগ্রী) এবং গবাদিপশু সরবরাহ অন্যতম।
চ. দ্রুত চলাচল, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, শরণার্থীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রেরণ-এসব বিষয় নির্ভরশীল ছিল সড়ক ও যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর, যার অধিকাংশ ছিল বিধ্বস্ত। অতএব, পাশাপাশি যে-বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় তা হলাে ভৌত অবকাঠামাে, সড়ক ও সড়ক সেতু সংস্কার ও পুনঃস্থাপন। নদীপথগুলােকেও নৌচলাচলের উপযােগী এবং নিরাপদ করার প্রয়ােজন ছিল। মুজিবনগর সরকার এসব বিষয় দক্ষতার সঙ্গেই মােকাবিলা করেছিলেন।
ছ. শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সকল প্রতিষ্ঠান পুনরায় নিয়মিতভাবে চালু করার জন্য প্রয়ােজন ছিল অতি দ্রুত এগুলাের সংস্কার, শিক্ষক ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা ও চিকিৎসার উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহ। বিজয়ের আগেই সরকার এসব বিষয় দূরদৃষ্টি নিয়ে অনুধাবন করেন এবং স্বাধীন দেশে সরকারের কার্যক্রম সার্বিকভাবে প্রচলন করতে সক্ষম হয়।

উপরে যেসব কর্মসূচি ও সাফল্যের কথা উল্লেখ করলাম তা সামগ্রিকভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করলে তিনটি বিষয় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়; এগুলাে হচ্ছে: (১) আইন ও শৃঙ্খলা এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা; (২) অর্থনীতি পুনর্গঠন; (৩) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। এই সাফল্যের পেছনে যাদের অবদান, চিন্তা-ভাবনা ও শ্রম সব চাইতে বেশি তারা হলেন:
ক. বাঙলার বীর জনগণ (যারা এই বিশাল যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে একে জনযুদ্ধে পরিণত করেছিলেন)।
খ. মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার (যাদের দূরদর্শিতা এবং অগ্রিম পরিকল্পনা অবিশ্বাস্য ছিল)।
গ. ভারত-সরকার ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা (যাদের সাহায্য ও সহযােগিতা এবং ভারতীয় জনসাধারণের সহযােগিতা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার জনগণের ও সাহায্য সংস্থার)।
১০ ডিসেম্বর অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা এক অতি গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তে বলা হয় যে: ভারতের এবং বিদেশের যেসব ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ জমা আছে তা অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের নামে পরিবর্তন করা হলাে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী শত্রুর অধীনে দখলকৃত এলাকায় চাকুরিরত ছিলেন তাদের বিনা-বিচারে শাস্তি দেওয়া হবে না। যে-সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস ছেড়ে দেশের অভ্যন্তরেই আছেন তাদের অবিলম্বে পূর্বের পদে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলাে। ২৫ মার্চের আগে যারা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের পূর্ব-পদে যােগদান করার নির্দেশ দেওয়া হলাে। বর্তমানে যারা এইসব পদ দখল করে আছেন তারা সবাই ও.এস.ডি. হবেন।

অগ্রিম পরিকল্পনা: প্ল্যানিং সেল
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের পেছনে যে-পদক্ষেপটি উল্লেখযােগ্য তা হলাে পূর্ব-পরিকল্পনা প্রণয়ন। বিজয়ের অনেক আগে সরকার (মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত) পরিকল্পনা সেলগঠন করেন। দেশের কয়েকজন বরেণ্য চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক এই সেলের সদস্য নিযুক্ত হন। এঁরা হলেন: (১) ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, (২) ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, (৩) ড. মুশাররফ হােসেন, (৪) ড. স্বদেশ বােস ও (৫) ড. আনিসুজ্জামান। পরবর্তীকালে এই সেলকেই পরিকল্পনা সেল/বাের্ড দুই রকমের পরিকল্পনা হাতে নেন: একটি স্বল্পমেয়াদী (যা মূলত পুনর্বাসন পরিকল্পনা); অপরটি দীর্ঘমেয়াদী (যা হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি)।
পরিকল্পনা সেলের কাজে নানাভাবে সাহায্য ও সহযােগিতা করেন ভারতীয় প্রতিপক্ষ (counterpart)। সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সুখময় চক্রবর্তী কোলকাতায় আসেন। ২৪ তারিখে তাঁরা মিলিত হন। আমাদের পরিকল্পনা সেলের সদস্যদের সাথে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেন। ড. চক্রবর্তীর সাথে ছিলেন মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যুগ্মসচিব মি. রমাচন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযােগিতার বিষয়ে আলােচনা হয়। এই সহযােগিতার বিশেষ তাৎপর্য এই ছিল যে: ভারতীয়দের কাছে পাকিস্তান, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কিত যেসব তথ্য, পত্র-পত্রিকা, বই ইত্যাদি সংরক্ষিত ছিল সেগুলাে তারা আমাদের ব্যবহার করতে দেন। আমাদের প্ল্যানিং সেলের নিজস্ব লাইব্রেরি বা দলিলপত্র কিছুই ছিল না। যার ভিত্তিতে তারা এগুতে পারেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বিশেষজ্ঞ (experts) পাঠিয়ে আমাদের পরিকল্পনায় সাহায্য করেন। পানিসম্পদ, যােগাযােগ ও পরিবহণ, মানব-উন্নয়ন পরিকল্পনা এগুলাে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল। মন্ত্রিপরিষদ-সচিব হিসেবে আমি এইসব আলােচনা ও বৈঠক সমন্বয় করি। বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল আমার।
পরিকল্পনা সেলের পাশাপাশি আমরা সচিব এবং বিভাগীয় প্রধান পর্যায়ে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করি ঢাকায় সরকার স্থানান্তর, আইন ও শৃঙ্খলা, বেসামরিক প্রশাসন, পুনর্বাসন, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন এইসব বিয়য়ের ওপর। বিদেশ থেকে আগত বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা, যেমন জনাব আবুল ফাতেহ, জনাব এম. এ. মােমেন, জনাব আতাউর রহমান প্রমুখ। আমাদের সাথে এই কমিটিতে কাজ করেছিলেন। প্রতিটি কমিটি একটি করে কর্ম-পরিকল্পনা (action programme) প্রস্তুত করেন যা মন্ত্রিসভায় আলােচিত ও গৃহীত হয়। এই কমিটিগুলােরও সমন্বয়কারী ছিলাম আমি। একই সময়ে ভারত-সরকার কোলকাতায় তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলােকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করেন যাতে তারা সংস্থা শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, আইন-শৃঙ্খলা (পুলিশ), বেসামরিক প্রশাসন, যােগাযােগ ইত্যাদির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তারা ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দিনে-রাত্রে আলােচনা করে আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। [বিস্তারিত তথ্যের জন্য ঘটনাবহুল সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১’ অধ্যায় দেখুন]

গণহত্যা সেল
গণহত্যা সেল গঠন ছিল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। বাংলাদেশ হাইকমিশনে এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে ছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে রাষ্ট্রদূত ফাতেহ সাহেব এবং মােমেন সাহেব দায়িত্ব নেন। প্রতিটি অঞ্চলের (zone-এর) কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যেন তথ্য সংগ্রহ করেন, সাক্ষী-সাবুদ প্রস্তুত রাখেন, পরবর্তীকালে আদালতে ব্যবহারের জন্য। দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে-ঘুরে প্রচুর তথ্য, সাক্ষী সংগ্রহ করা হয়। আমাদের মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, আমরা স্বাধীনতার পর এইসব তথ্য ও সাক্ষী-সাবুদ ব্যবহার করে গণহত্যার বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছি। যদি আমরা যথাসময়ে এইসব গণশত্রু এবং দেশদ্রোহীর বিচার করতে পারতাম, তাহলে আর আজ দেশে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানিদের পুনর্বাসন হতাে না। এরা কখনােই হত্যা আর কু-র মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের বিচারের প্রহসন করার সুযােগ পেত না। পাকিস্তানের ভাঙা রেকর্ডও বাজত না।

উপদেষ্টা পরিষদ গঠন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে যুদ্ধ-পরিচালনা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব কয়টি আসনে জয়লাভ করলেও, স্বাধীনতাযুদ্ধে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর), কংগ্রেস ইত্যাদি দলও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা সম্ভব হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, মণি সিং, শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার, পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রায় সব সভা এবং বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ উঠত। বাঙালি জাতির চোখের মণি বঙ্গবন্ধু কোথায়, কীভাবে আছেন তা জানার জন্য সকলের, বিশেষ করে মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে আমি এক উদ্বেগাকুল বন্ধুকে দেখেছি। নেতা বঙ্গবন্ধু সঙ্গে নেই, এ-কথা প্রধানমন্ত্রী একটি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারতেন না। মন্ত্রিসভার সভায় বা অন্য আলােচনায় বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠত। তিনি তার হাতের তালু দিয়ে, কখনও বা রুমাল দিয়ে চোখ দিয়ে গড়িয়ে-পড়া পানি মুছতেন। এ-দৃশ্য আমি প্রায়শই লক্ষ্য করেছি। উপস্থিত সকলেই ভারাক্রান্ত হতেন। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠত।
পাকিস্তানি দস্যুদের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য কতভাবেই-না চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের মন্ত্রিসভার দুটি সভার সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরলেই এ-কথা বুঝা সহজ হবে যে, বঙ্গবন্ধুর জন্য সরকারও কত উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে তারিখে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়। যখন সরকার বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারে যে, পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধু বন্দি আছেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রহসনমূলক বিচার করার আয়ােজন করা হয়েছে তখন উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নেন:
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলাে।
আবার ৫ মে তারিখে সংবাদমাধ্যম, গােয়েন্দা মাধ্যম ও কূটনৈতিক মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উপরের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতা হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সরকারের আন্তরিকতা ও ভালােবাসা ফুটে উঠেছে। সরকারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করা কালে আমার অনুভূতিতে এমন অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটতে আর কখনও দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর বিচার-প্রহসন বন্ধ করার অনুরােধ জানিয়ে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড় কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও প্রচারমাধ্যমেরও সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, ব্রিটেন ইত্যাদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং রেডিওটেলিভিশনের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। একথা তাে সকলেরই জানা যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ-বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ সবই বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতার ফল ছিল।

বৈদেশিক নীতি ও স্বীকৃতি আদায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন? এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করা এবং এর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি এবং সম্ভব হলে স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রতি, বাঙালির প্রতি যে-সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রবাসী সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার ফলেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার যে সে-দেশের একমাত্র বৈধ সরকার, তা অধিকাংশ দেশ ও সরকারের কাছে স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। তার কারণ আমাদের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি এবং পাকিস্তানিদের গণহত্যা। পাকিস্তান ও তার দোসরদের ব্যাপক অপপ্রচার সত্ত্বেও আমাদের সরকারের প্রতি সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল আমাদের প্রবাসী সরকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতিসমূহ এবং কার্যকলাপ। যুদ্ধের সময়ে ও পরবর্তীকালে এই সরকারকে ভারতের পুতুল বা পাপেট সরকার বলে পাকিস্তানি সমর্থকরা অনেক ঢাক-ঢােল পেটালেও তা ধােপে টেকেনি।

সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, শক্তিবৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে-কয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ান ছিল তাদেরকে পাকিস্তানিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন ও শক্তিহীন করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ঐ কঠিন সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আমাদের বাঙালি অধিনায়করা যে যেখানে পেরেছেন সেখানেই প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে। অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিটে যে-সমস্ত বাঙালি অফিসার ও সেনা ছিলেন তারাও হাতিয়ার তুলে নিয়ে সুবিধামতাে স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করেন। এছাড়াও ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে ই.পি.আর., পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীও পিছিয়ে ছিল না। এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাহিনীকে গড়ে-তােলার দায়িত্ব নেন কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী। তাঁকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাহায্য করেন গ্রুপ-ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। কর্নেল রবও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন, কিন্তু তার কোনাে সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সিনিয়র অফিসার, পরবর্তীতে যারা সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন যােগ্যতা এবং বীরত্বের সাথে, তাঁরা প্রথমে বিচ্ছিন্ন থাকলেও অতি সত্বর নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপন করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ সেনা-কমান্ডের নেতৃত্বে চমৎকার শৃঙ্খলার সাথে চেইন অব কমান্ড স্থাপন করেন। পারস্পরিক সমঝােতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আমাদের কমান্ডারবৃন্দ। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর মঞ্জুর, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর সি.আর.দত্ত, মেজর নূরুজ্জামান (অব.), মেজর তাহের, উইং কমান্ডার বশর, মেজর জলিল, ফ্লাইট লেফটেনান্ট হামিদুল্লাহ-এঁদের সকলের নামই করতে হয় একসাথে। এই সেক্টর কমান্ডারদের সাথে অনেক সাব-সেক্টর কমান্ডারও তাঁদের বীরত্ব, সাহস আর দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। এঁদের মধ্যে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাফায়ত জামিল, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মতিন, মেজর মইনুল, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন ভুইঞা, লেফটেনান্ট ইমামুজ্জামান, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, মেজর জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী, মেজর আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এম.এ. গাফফার, মেজর জিয়াউদ্দীন প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এঁদের পাশাপাশি নৌকমান্ডে অফিসারদের কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আরও অনেক, অনেক সেনানায়ক ছিলেন যাদের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয়। এইসব বীরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে সকল সেনানায়কই কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশ এবং পরিকল্পনামতাে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। কেউই কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ/নির্দেশ অমান্য করেননি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যে দু’একজনের শাস্তি হয়েছে তা তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ছিল সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য নিজস্ব অফিসার কোর (corps) তৈরি করা। এই লক্ষে মুক্তিবাহিনী থেকে বাছাই করে প্রথম অফিসার ক্যাডেট নিয়ােগ করা হয়। মুর্তী নামক একটি জায়গায় অস্থায়ী মিলিটারি কলেজ স্থাপন করা হয়। নভেম্বর মাসের কোনাে একসময় প্রথম ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেড (Passing out parade) অনুষ্ঠিত হয়। সালাম গ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমিও সেখানে উপস্থিত থেকে অফিসার ক্যাডেটদের সনদপত্রে (Certificate-এ) দস্তখত করি। ঐ ব্যাচ একাডেমী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। এদের মধ্যে কোনাে-কোনাে ক্যাডেট শাহাদৎ বরণ করেন। আজও ঐ ব্যাচের কোনাে-কোনাে অফিসার (কেউ জেনারেল, কেউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বা কর্নেল) আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি ১৯৭১ সালের কোর্স করেছি। আপনি আমার সনদে দস্তখত করেছিলেন।

পৃষ্ঠা: ৪৫
‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ দিবস ২০০৩ সালে ২১ নভেম্বর পালিত হয়েছে। এই ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। আজও আমরা গর্বের সাথে, আনন্দের সাথে, এবং সাড়ম্বরে এই দিনটি উৎসবের মতাে পালন করি। কারও কি একবারও মনে হয় ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সামরিক বাহিনী সদর দপ্তর (Head Quarter)-দ্বারা; এককভাবে কোনাে ব্যক্তি বা কমান্ডার এর কৃতিত্ব দাবি করেন না। সমষ্টিগতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও), প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার এবং প্রতিরক্ষা সচিব এম.এ. সামাদের নাম উল্লেখ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে।

প্রধানমন্ত্রীর সীমাবদ্ধতা/প্রতিকূলতা
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে যেভাবে হাল ধরে রেখে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে সরকার, মুক্তিবাহিনী ও পরিশেষে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই আলােচনা অনেকেই আজ আর করেন না। স্বাধীনতা-উত্তর কালের এবং আজকের প্রজন্মের জন্য যে সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হওয়া প্রয়ােজন সেটা হলেই আমরা আমাদের নেতৃবৃন্দের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব। বিভিন্ন সময়ে আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেছেন, জানতে চেয়েছেন মন্ত্রিসভার ভিতরের কথা, নেতৃত্বের কথা, অন্তর্দ্বন্দ্বের আর ষড়যন্ত্রের তথ্য। কোনাে কোনাে বিষয় আছে যা অনুক্ত থাকাই ভালাে। আবার অনেক বিষয় আছে যা দীর্ঘকাল কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা যায় না। তাজউদ্দীন সাহেব যেসব প্রতিকূল অবস্থার মােকাবিলা করেছেন এবং তা থেকে সাফল্যের সাথে উত্তরণ করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলে বােধহয় বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
প্রথম সমস্যা ছিল তাজউদ্দীন আহমদের উত্তরাধিকার প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ২৪ তারিখে অন্যত্র নিরাপদ এবং নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে বলেছিলেন, যথাসময়ে নির্দেশ পাঠাবেন এই কথা বলে। ২৫/২৬ মার্চের বিশৃঙ্খল ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে যােগযােগ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্ত নেন ৩০ মার্চ। প্রাথমিক অবস্থায় নেতৃস্থানীয় কেউই তাঁর সাথে ছিলেন না (একমাত্র ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ব্যতীত)। অসীম ধৈর্যের সাথে তিনি একে একে সকলের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন করেন।
সম্মিলিতভাবে তারা সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনতা এবং আইনের প্রয়ােগ সম্পর্কিত ঘােষণার। সংগ্রামের সেই গােড়ার দিকেই তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ করে বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করার একমাত্র উপায় সশস্ত্র সংগ্রাম। এই মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার যেটি চূড়ান্ত লক্ষ্য-ভারত ও অন্যান্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল (অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক) দেশসমূহের সাহায্য ও সহযােগিতা লাভ করা। এই জিনিস অর্জন করতে হলে পূর্বশর্ত একটি সরকার গঠন করা, যা সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য। গ্রহণযােগ্যতা পেতে হলে প্রয়ােজন পূর্ববাংলা থেকে নির্বাচিত সকল (অথবা অধিকাংশ) জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমর্থন। কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের সাথে তাঁকে এটি অর্জন করতে হয় ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণার আগেই। কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধরত সেক্টর কমান্ডাররাও সরকারের পেছনে এসে দাঁড়ান, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পাই প্রধানমন্ত্রীর ১১ এপ্রিলের ভাষণে এবং পরে মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ দুই দফা বৈঠক করেন। সেটিই ছিল ভারত-বাংলাদেশ সহযােগিতার প্রথম ধাপ। তাজউদ্দীন আহমদকে এই বৈঠকের বিষয়ে সাহায্য করেন ভারতীয় বি.এস.এফ.-এর তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান (আই.জি.) গােলক মজুমদার, বি.এস.এফ-এ অধিনায়ক (ডি.জি.) রুস্তমজী। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের (হাই-কমান্ড) সাথে যােগাযােগেও তাঁরাই সহযােগিতা করেন।
এপ্রিলের পরেই নানারকম ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে শুরু করে। খন্দকার মােশতাক ও তার ককেজন সহযাত্রী কখনই তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব মেনে নেননি। উপরন্তু তাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল কীভাবে সরকারের ভিত নড়ানাে যায়। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল অশুভ। পাকিস্তানের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে তাদের উৎসাহ ছিল প্রচণ্ড। শুধু তাই নয়, খন্দকার মােশতাক প্রথম থেকেই বৈদেশিক একটি পরাশক্তির মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের সাথে আপােষ ফর্মুলায় যাবার চেষ্টা করছিলেন। ঐ বৈদেশিক শক্তির কোলকাতাস্থ মিশনের সাথে তাদের গােপন যােগাযােগ ছিল। খন্দকারের বক্তব্য ছিল এই যে, তিনি ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, অতএব তিনি বঙ্গবন্ধুর পর প্রথম নেতা। কামারুজ্জামান মনে করতেন। তিনি সর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, অতএব তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করতে পারেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তাই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেমন করে হন? এই প্রতিকূল মনােভাবের মধ্যেও তাজউদ্দীন আহমদ অচঞ্চল ছিলেন।
বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে দুই দশকেরও বেশি সময় তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী ছিলেন, যাকে বলা হয় ডান হাত। ১৯৬৪ সাল থেকে সকল দলীয় নীতি ও কর্মসূচির অন্যতম মুখ্য প্রণেতা ছিলেন তিনি। এখানে বন্ধুবর মঈদুল হাসানের গ্রন্থ মূলধারা ১৯৭১’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার লােভ সম্বরণ করতে পারছি না। তার বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি একমত। তাজউদ্দীন ছিলেন, দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার-বিমুখ সংগঠক। ৭১-এর মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরেই ছিল সম্ববত তার স্থান। (মঈদুল হাসান; মূলধারা ১৯৭১; ইউ.পি.এল.; ঢাকা, ১৯৯৯; পৃষ্ঠা ৯। অত্যন্ত খাটি ও যথার্থ মূল্যায়ন। মার্চের ঐ দিনগুলিতে আমরা ঢাকায় এবং জেলায় যেসব নির্দেশ পেতাম তা তাে তাজউদ্দীন আহমদই জারি করতেন।
উপদলীয় কোন্দলের যদিও মূল হােতা খন্দকার মােশতাক, তবু অন্যান্য কোনােকোনাে নেতার ভূমিকাও নিতান্ত কম ছিল না। শিলিগুড়িতে ৫-৬ জুলাই অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতা রীতিমতাে নৈরাশ্যজনক ছিল। এতে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হন। যেহেতু স্বাধীনতার প্রশ্নে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি অবিচল থাকেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই আপােষহীন দৃঢ় অবস্থান নেন, সেহেতু সুবিধাবাদীরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। হয়তাে সেটা সাময়িক ও কৌশলগত ছিল, কেননা কোলকাতার বিদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগ শেষ অবধি অব্যাহত ছিল, যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা।
জনপ্রতিনিধিদের সম্মেলন এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সাবেক নিখিল পাকিস্তান কার্যকরী কমিটির পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকবে। এতে করে আপাতত মােশতাক ও কামারুজ্জামানের দাবি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান মজবুত করে, যার প্রতিফলন পরবর্তী সব মন্ত্রিসভার-সভায় আমরা দেখতে পাই। মন্ত্রিসভার-সভায় খােদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করতেন বিধায় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজতর ও দ্রুত হতে থাকে। কামারুজ্জামানের উচ্চাভিলাষ থাকলেও তিনি দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন খুঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি চক্রান্তকারী ছিলেন না। আমার জানামতে তিনি কারও ক্ষতি করেননি। সাবেক পাকিস্তান গণপরিষদে (আইয়ুব আমলে), ১৯৬৫-৬৭-তে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম.এন.এ. কামারুজ্জামান ও মিজান চৌধুরীর বক্তৃতা অ্যাসেমব্লিতে বসে বসে শুনতাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শােষণ আর বঞ্চনার চিত্র তারা তুলে ধরতেন। তবে মিজান চৌধুরীর পরবর্তী কার্যকলাপের সাথে আমার দেখা ও শােনা সেই চৌধুরী সাহেবের কোনাে মিল সেদিন দেখিনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিনতম সময়ে আরেকটি বিশৃঙ্খলা এবং মাঝে মাঝে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতাে মুজিববাহিনীর কার্যকলাপে। বিশেষ করে শেখ মণি কেন জানি না, কিছুতেই মন্ত্রিসভার কর্তৃত্ব মানতে চাইতেন না। আমার সন্দেহ হয় তাঁর এই আচরণের পেছনে অদৃশ্য কোনাে শক্তির হাত থাকতে পারে। খন্দকার মােশতাক কোনাে-কোনাে সময় ইন্ধন জোগাতে পারেন। তবে শেখ মণির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় র(RAW) নামক গােপন প্রতিষ্ঠান। এরাই মুজিববাহিনীকে সংগঠিত করে এবং ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ করে। সমস্যার সৃষ্টি হতাে তখনই যখন মুজিববাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে কমান্ডােরা নিয়মিত বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইত। তাতে সেক্টর কমান্ডাররা ক্ষুব্ধ হতেন, অভিযােগ করতেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর কাছে; তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্তেজিতভাবে এটা উত্থাপন করে দ্রুত প্রতিবিধান চাইতেন। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত-সরকারের কাছে এই বিষয়ে প্রতিকার পাননি। আমার উপস্থিতিইে কর্নেল ওসমানী কয়েকবার অব্যাহতি চেয়েছেন মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করতেন। আরেকটি ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। সেটা অক্টোবর মাসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পূর্ব-রণাঙ্গন পরিদর্শনে গিয়ে আগরতলা সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন। শেখ মণি এবং তাঁর কয়েকজন সহযােগী অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। যৌথ কমান্ড গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হতেই এই বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেটা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই। ভারত-সরকারের পক্ষ থেকে মি.ডি.পি. ধর-কে নীতি-নির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান (মন্ত্রীর মর্যাদায়) নিয়ােগের পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সমন্বয় অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত RAW তখন থেকে মুজিববাহিনীর রাশ টেনে ধরে। এরপর কর্নেল ওসমানীর জন্য, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে বড় কোনাে অসুবিধা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অবশ্য অস্ত্রসম্ভারের সমস্যা আগাগােড়াই ছিল, যা নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে অনেকটা সুরাহা হয়।
ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের দক্ষিণপন্থী কোনাে গ্রুপ আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী চক্রের সাথে হাত মেলায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বদলীয় এক্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এরা ক্রমাগত প্রচারণা চালাতে থাকে। এতে আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রায় বিনষ্ট হতে চলেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা কোনােমতেই সােভিয়েত ব্লকের সমর্থন তাে দূরের কথা ভারতের সক্রিয় এবং প্রত্যক্ষ সাহায্যও পেতাম না, এ-কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং চীন প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছিল। তাদের কুঠনৈতিক দাবাখেলায় পাকিস্তান ছিল শক্ত খুঁটি। পাকিস্তানের সব রকম আবদার তাদের মেনে নিতে হয়েছে এটাই ছিল ১৯৭১ সালের ভূ-রাজনৈতিক (Geo-political) বাস্তবতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত করার নানাবিধ প্রয়ােজন ছিল। সেটা যেমন মিসেস গান্ধী জানতেন, তেমনি উপলব্ধি করতেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেটা অর্জন করতে হলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন যে কত প্রয়ােজন ছিল তা আর নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়ােজন দেখছি না। এ-বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য: সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যায়ে আমি আরও আলােকপাত করেছি।
সােভিয়েত ইউনিয়ন মানেই গােটা সােভিয়েত-ব্লক এবং তার সাথে জোটনিরপেক্ষ ব্লকেরও বেশ কয়েকটি দেশের সমর্থন। সােভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব-ইউরােপের দেশসমূহ, কিউবা, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, যুগােস্লাভিয়া, নেপাল, ভূটান ইত্যাদি দেশ ভারতের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আমাদের সমর্থন করেছে, পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য পরাশক্তির বিপুল পরাক্রমে আমরা ইতিহাস বিস্মৃত হতে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী অশুভ শক্তির উত্থানের ফলে সােভিয়েত-ব্লক- তাে বটেই, অন্যান্য সমর্থনকারী দেশ, বিশেষ করে ভারতের সমর্থন আর সাহায্যের কথা স্মরণই করতে চাই না; কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তাে দূরের কথা।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ, কর্নেল ওসমানী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে ১০ এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা (The Proclamation of Independence) প্রচার করা হয়। উক্ত ঘােষণায় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সঙবিধান রচনার জন্য বিজয়ী সদস্যদের কথা উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশকে সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত স্বাধীনতা-ঘঘাষণাকে অনুমােদন দেওয়া হয়। এই ঘােষণায় আরাে বলা হয় যে, সংবিধান রচিত না-হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হবেন। উক্ত ঘােষণায় নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন যে, যে-কোনাে কারণে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থাকলে উপরাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ববলি পালন এবং কার্যকর করবেন। এভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে অসাধারণ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেই দুঃসময়ে কৃতিত্বের সাথে জাতি এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দেন। রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন। যুদ্ধ-পরিচালনায় তাঁর বিচক্ষণতা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার প্রায় সব সভাতেই সভাপতির আসন অলকৃত করে সরকারের সকল কাজকর্মের সাথে তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করেছিলেন। সে-সময় অসুস্থতা, শারীরিক অসুবিধা কোনাে কিছুই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ও যুদ্ধ-পরিচালনায় তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। অসাধারণ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন। মানুষজনের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল অমায়িক। সদা প্রশান্ত ও মিষ্টভাষী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতকালে কৃতিত্বের সাথে জাতিকে নেতৃত্ব দেন। তিনি সময়-অসময় মানেননি, বারে বারে ছুটে যেতেন রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে। যুদ্ধ-পরিচালনায় তাঁর বিচক্ষণতা দেশে-বিদেশে সকলের প্রশংসা অর্জন করে। জাতি ও দেশের কঠিন সংকটকালে তাঁর দেশপ্রেম, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অন্তহীন কর্মপ্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের জয়কে নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করেছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি মনােনীত হন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিশােরগঞ্জ জেলার যশােদলের সাহেববাড়িতে ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এম.এ. ডিগ্রি নিয়ে তিনি আইনশাস্ত্রেও ডিগ্রি লাভ করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের ট্যাকসেশন সার্ভিসে চাকুরি লাভ করেন। সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সৈয়দ

পৃষ্ঠা: ৫০
নজরুল ইসলাম মাত্র এক বছরের মধ্যে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অধ্যাপনায় (ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে) যােগ দেন। পরে এ-পেশাও তিনি ছেড়ে দেন এবং ময়মনসিংহ বারে আইনব্যবসা শুরু করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করে তিনি রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গেও যুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর কারান্তরালে থাকাকালে তিনি প্রায়শই দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন তার স্বভাবসুলভ গুণে। তাকে দেখলে মনে হতাে এক শান্ত শুভ্র ব্যক্তি সামনে দৃশ্যমান। তার পরনে সব সময়ই দেখা যেত শ্বেতশুভ্র শাদা পােশাক। ইস্তিরির সদ্য ভাজভাঙা শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরার অভ্যাস তার সারাজীবনের। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি আসতেন ঐ পােশাকে এবং দেরিতে। দেরি হওয়ার কারণ ছিল তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও অসুবিধা। স্বাধীনচেতা এই মানুষ ছিলেন আপােষহীন ও দৃঢ় মনােবলসম্পন্ন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেওয়ার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে-মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর (১৯৭৫) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
মুজিবনগরের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণের বিবরণ নিম্নরূপ:
আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বৎসর যাবৎ বাংলার মানুষ, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব অধিকার নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্ত যনি কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করবই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই। আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শােষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তাঁর নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হল তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোনাে শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। আপনারা জেনে রাখুন, গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থবাদী, শিল্পপতি, পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা, ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপােষ নেই, ক্ষমা নেই। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণ-নন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হবেই।

তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তি। রাষ্ট্র ও সরকারের নামকরণ তাঁরই। জাতির কঠিনতম সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি শক্ত করে হাল না ধরলে আমাদের সরকার গঠন করা হতাে না, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ারও কেউ থাকত না। সত্যি কথা বলতে কী, শহীদ তাজউদ্দীনের মতাে খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং সৎ ব্যক্তিত্ব খুব-একটা দেখেছি বলে মনে হয়। অতবড় মাপের নেতা হয়েও কী সহজ, সরল মানুষ ছিলেন তিনি।
আমার মস্তবড় ক্ষোভ আর দুঃখ যে, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের ইতিহাসে যােগ্য কোনাে স্থানই পেলেন না। তার সম্পর্কে আলােচনাও তেমন নেই, মূল্যায়ন তাে দূরের কথা। অসহযােগ আন্দোলনের সময় অর্থাৎ ৭ থেকে ২৫ মার্চ তিনিই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সমস্ত নির্দেশ জারি করতেন। তিনি প্রবাসী বিপ্লবী সরকারপ্রধানই ছিলেন না। শুধু, প্রাণও ছিলেন। বলতে গেলে তিনি ছিলেন সরকারের স্থপতি।
স্বাধীন বাঙলাদেশের মাটিতে ফিরে আসার পরই শুরু হয়ে যায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মানেই তিনি। তাঁকেই সবাই জানত। অতএব সরকারের বিরুদ্ধে যার যা-কিছু বলার, সব ক্ষোভ আর অভিযােগ প্রকাশ মানেই শহীদ তাজইদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বক্তব্য। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার অব্যবহিত পরেই আরম্ভ হয় প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যার মূল লক্ষ্য তাজউদ্দীন। বেশ কয়েকটি ক্যাম্প থেকেই আছে আক্রমণ। প্রথমত, ঘাপটি-মেরে-থাকা পাকিস্তানি এজেন্টরা; দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাবিরােধী মৌলবাদী গ্রুপ; তৃতীয়, অতি বামপন্থী তথাকথিত বিপ্লবীরা (আসলে চীনপন্থী বাংলাদেশ বিরােধী শক্তি); চতুর্থত, উচ্চাভিলাষী সরকারি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যাদের প্রধান কাজই ছিল শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, শহীদ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করা। সবকিছু মিলিয়ে স্বাধীনতার শুভলগ্ন থেকেই শুরু হয় এইসব অশুভ তৎপরতা যার ফলে সরকার-পরিচালনার পাশাপাশি নেতৃবৃন্দকে সময় ব্যয় করতে হতাে অপশত্রুদের প্রতিহত করার কাজে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, তথা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শত্রুদের প্রধান নেতা ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ। মুজিবনগরে থাকতেই তার ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। সে-কারণে তাকে জাতিসংঘের অধিবেশনে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে বিরত করা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ঢাকায় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ এবং পুনর্বিন্যাস করার সময় মােশতাকের পরিবর্তে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একদিকে স্বাধীনতা নস্যাৎকারীদের চক্রান্তে পাকিস্তানের পক্ষে সহযােগিতা প্রদান, অন্যদিকে প্রতিহিংসার আগুন–এই দুটোই তার ষড়যন্ত্র ত্বরান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই তার তৎপরতা শুরু হয়; অনুপ্রবেশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভিতর। অত্যন্ত দ্রুত, বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে মােশতাক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। দিনে-রাতে তাঁদের কান ভারী করতে থাকেন—তাজউদ্দীন এটা করেছে, তাজউদ্দীন সেটা করেছে ইত্যাদি। পাশাপাশি তােষামােদ। এই দুটি কাজে নির্লজ্জ বেহায়া ছিলেন খন্দকার; আর ঠিক তার বিপরীত ছিলেন তাজউদ্দীন। তােষামােদ, পরনিন্দা, পরচর্চা এসব তিনি কখনও করতেন না-পারতেনও না। নীতিগতভাবে চরম ঘৃণা করতেন এসব। অন্যদিকে সুচতুর মােশতাক শুধু নিজে নয়, তার পক্ষের নেতৃবৃন্দ, যারা বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ছিলেন, তাদেরকে দিয়ে, চরম মিথ্যাচার করিয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন দুজনের দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। এর ফল ছিল অতন্ত সুদূরপ্রসারী। আমার ধারণা, খন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের কয়েকজন উদীয়মান এবং উচ্চাভিলাষী নেতাকেও প্রভাবান্বিত করে তার জাল আরও বিস্তৃত করে। এই নেতারাও তাজউদ্দীন-মন্ত্রিসভা ও সরকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকে।
আমি অবশ্যই বলব খন্দকার মােশতাক এবং অনুগামীদের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ এবং ক্ষমতাগ্রহণ। এর সাথে কাজ করেছে তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং নীচ স্বভাব (স্বভাবতই এই ব্যক্তি ছিলেন লােভী এবং হিংসুক)। বেছে বেছেই পাকিস্তান এবং সহযােগী শক্তিরা একে নিয়ােগ করে তাদের বাহনরূপে। খন্দকার মােশতাক একাধিকবার দীর্ঘদিনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন দল-বিরােধী অপতৎপরতা এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পর অনেক হাতে-পায়ে ধরে ফিরে আসেন। এহেন দুষ্কৃতকারীকে কীভবে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এতখানি বিশ্বাসে নিলেন তা আমার বােধগম্য হলাে না। বাকশালের গঠনতন্ত্র ও রূপরেখা প্রণয়নে তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা। বুদ্ধিপরামর্শ দিতে থাকেন অতি-সংগােপনে। তার সাথে যােগ হয় খন্দকারের কুটিলতা আর লােভ। যে-পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা ষড়যন্ত্র কার্যকর করে তা অনেকটা এইরকম:
এক: বঙ্গবন্ধুকে তার ঘনিষ্ঠতম, সবচাইতে ত্যাগী ও বিশ্বস্ত শুভানুধ্যায়ী সহকর্মীদের থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া; দুই: উপরােক্ত লক্ষ্যে এঁদের মধ্যে বিভাজন, অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি করা; তিন: আওয়ামী লীগ এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বীজ বপন, যেমন মুজিবনগর মন্ত্রিসভার প্রধান তিন নেতাকে (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান) প্রথমে তাজউদ্দীন ও পরে একে-অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার ও অবিশ্বাস সৃষ্টি। ঢাকায় এই নেতৃবৃন্দকে বঙ্গবন্ধুর কাছে হেয় প্রতিপন্ন করাও আরেক কাজ। চার: প্রবীণ ও নবীনদের মধ্যে প্রথমে অবিশ্বাস ও সন্দেহ এবং পরে বিভেদ সৃষ্টি; পাঁচ: বঙ্গবন্ধুর পরিবারপরিজনকে মুজিবনগর-নেতৃবৃন্দের পেছনে খেপিয়ে তােলা ছিল আরেক ষড়যন্ত্র; ছয়: সবচাইতে ক্ষতিকর এবং অব্যর্থ অস্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে বােঝানাে যে, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) প্রত্যাবর্তনে যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। যে-কোনাে মানুষ, তা তিনি যতবড় ব্যক্তিত্বই হােন আর বিশাল মনেরই হােন—এই কথাগুলাে কখনও কি সহজভাবে নিতে পারেন? মন্ত্রিপরিষদের সচিব থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যবর্গের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা থাকায় এ-ধরনের কথা শুনতে পেতাম। কিন্তু, কোনাে মন্তব্য করা বা তাদের কথায় কোনাে সায় দেওয়া আমার নীতিতে ছিল না। শুধু নীরবে অবলােকন করেছি। বিবেকের তাড়নায় আজ এসব কথা ব্যক্ত করছি শুধু মনকে হালকা করার জন্য। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল—তিনি মুক্ত হয়ে ফিরে না-আসার অর্থ তার মৃত্যু কামনা। এমন অসম্ভব কামনা শহীদ তাজউদ্দীনের পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য মুক্তিযুদ্ধকালে তাকে আমি অশ্রুবিসর্জন করতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনা উঠলেই তাঁর চোখ ছলছল হয়ে উঠত এ দৃশ্য আমার চোখে এখনও ছবির মতাে ভাসে।
এই বিভেদ আর অবিশ্বাস মােশতাক একা করেননি। তার তাঁবেদারদের নিয়েই করেছেন। দু-একজনের কথা বলা যাক। তাহেরউদ্দীন ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ড. কামাল হােসেনের মতােই তাকে কখনও কখনও বলতেন ‘My blue-eyed boy’। শাহ মােয়াজ্জম হােসেন, তুখােড় ছাত্রনেতা; বঙ্গবন্ধুর কাছের লােক নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ। পৃথক পৃথকভাবে একই বক্তব্য রাখতেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এভাবে এরা একজনের বক্তব্য এবং পরিবেশিত খবর আরেকজন সমর্থন (corroborate) করতেন। পাশাপাশি সুযােগসন্ধানী এবং উচ্চাভিলাষী কিছু আমরা এবং গােয়েন্দাবাহিনীর কর্তাব্যক্তি (যারা পাকিস্তান সরকারকে ভালােভাবেই খেদমত করেছেন একসময়) বঙ্গবন্ধুকে অনেক কথাই পরিবেশন করতেন নেতৃত্বে ফাটল ধরানাের জন্য। আমার সন্দেহ, প্রয়াত জেনারেল ওসমানী এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌদুরীকে এরা সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছিল এ-সময়। বঙ্গবন্ধুর আপনজনের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণিরও একটা ভূমিকা ছিল—মনে হয় না-বুঝে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মণির একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল যার বহিঃপ্রকাশ আমি কয়েকবার দেখেছি (একেবার প্রকাশ্যে আগরতলায়)। মণি ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং প্রচণ্ড রাগী মানুষ। তাকে ক্ষেপানাে খন্দকার মােশতাক গয়রহের বাম হাতের কাজ। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় আরও কয়েকজনের ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা কি স্বচ্ছ ছিল?
এরই পাশাপাশি শহীদ তাজউদ্দীনকে আমি কেমন দেখেছি? কী আমার অভিজ্ঞতা? থিয়েটার রােডের পুরানাে একটি বাড়িতে আমাদের অফিস। তার সামনে মাঠের মাঝখানে বড় একটা পুরােনাে বাড়িতে আমাদের অফিস। তার সামনের মাঠের মাঝখানে বড় পুরােনাে বটগাছ। দালানে বড় বারান্দা পার হলেই মস্তবড় একটা হলঘর। ঐ হলঘরে ঢােকার আগে বারান্দার সাথে দুইদিকে দুটো কক্ষ, মাঝারি মাপের। একপ্রান্ত থেকে উপরে উঠে গিয়েছে। প্রশস্ত সিঁড়ি। বারান্দা থেকে করিডাের দিয়ে ঢুকলে বাঁ-দিকের কামরাটি ব্যবহার করতেন। সচিবরা এবং তাদের সহকারীবৃন্দ। আর ডানদিকের করিডাের দিয়ে গেলে ডান ও বাম উভয় পাশে দুটো মােটামুটি ধরনের ঘর। ডানদিকে কর্নেল ওসমানী ও তার এ.ডি.সি., বাদিকেরটি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য সংরক্ষিত। আমাদের মন্ত্রিসভার সভাও হতাে এই কক্ষটিতে। বড় হলঘর অতিক্রম করে সমুখে এগিয়ে গেলেই হাতের বামদিকে মােটামুটি বড় একটা কক্ষ, সংলগ্ন বাথরুমসহ। এই কক্ষটিতে থাকতেন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সহজ, সরল এই মানুষটি থাকতেনও খুব সাদাসিধেভাবে। কোনাে আড়ম্বর তাে দূরের কথা, কাপড়-চোপড়েও ছিলেন নিতান্ত সাধারণ। আমার যতদূর মনে পড়ে তার দুটো শার্ট আর দুটো ফুলপ্যান্ট ছিল। জামার নিচে গেঞ্জি পরতেন। সাধারণত ঘরের ভিতর লুঙ্গি পরে থাকতেন। নিজের জামা-কাপড়-গেঞ্জি-লুঙ্গি নিজেই ধুয়ে নিতেন।
শহীদ তাজউদ্দীনের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার মােটেই ঘটনাবহুল ছিল না। ফর্সা, বেশ স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ চেহারার, বয়সও তেমন বেশি নয়। আমাকে দেখেই বললেন-ইমাম সাহেব এসেছেন? ভালােই হলাে। কাজকর্ম বুঝে নিন। নূরুল কাদের সাহেব, আসাদুজ্জামান সাহেব আছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করুন। তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে আমাকে প্রথম নিয়ে যান এম. আর. সিদ্দিকী সাহেব। খুব সম্ভবত নূরুল কাদেরও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমার নিয়ােগপত্র (appointment letter) লিখে আনতে বললেন। ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব দিয়ে আমার নিয়ােগপত্রে তাজউদ্দীন সাহেবই দস্তখত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মহােদয়ের স্বাক্ষরিত নিয়ােগপত্র দীর্ঘ সময় পর আর খুঁজে পাইনি।
এমন যে-ব্যক্তি তার উত্থান ছিল চিত্তাকর্ষক ও চমকপ্রদ। গাজীপুর উপজেলার কাপাশিয়ার দরদরিয়ায় ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তারিখে তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকাকালে তিনি আইনবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন ১৯৬৬ সালে। ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় মুক্তি পান। একাত্তরের ১০ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন। আন্দোলনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহযােগী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ত্রিপক্ষীয় আলােচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সে-আলােচনা কীভাবে ব্যর্থ হয় তা এখন সর্বজনবিদিত।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ তারিখ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দেন। তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়া-যশাের হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান নেন। বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধনতা ঘােষণার অব্যবহিত পরেই শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ আত্মনিয়ােগ করেন সরকার-গঠনে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায়। এপ্রিলের সেই প্রথমদিকে, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্বিচার গণহত্যায় মেনে উঠেছে, কারও থাকা-খাওয়া-নিরাপত্তা কিছুই ভালােভাবে বন্দোবস্ত হয়নি, সেই সময়ে শহীদ তাজউদ্দীন ঠাণ্ডা মাথায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তা করেছেন, সমাধানের পথ খুঁজেছেন, অন্যদের উৎসাহিত করেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। (পরিশিষ্ট ৯, ১০ দ্রষ্টব্য।)
তিনি নিজে সৎ ও ভালাে মানুষ ছিলেন, অন্যদেরও তাই মনে করতেন। তার খেসারতও দিয়েছেন। প্রচণ্ড চাপের মুখেও সহজে মেজাজ খারাপ করতেন না। কারও সাথে দুর্ব্যবহরা করতেন না। কথা বললেই বােঝা যেত পারিবারিক ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য আছে তার। তাজউদ্দীন সাহেবের মতাে অত সুন্দর ঝকঝকে পরিষ্কার হাতের লেখা খুব কম দেখেছি। মুক্তোর মতাে। বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই ছিল caligraphy। বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি ব্যাকরণে (grammar)-এ ভালাে দখল ছিল। তাঁর নিজ হাতের লেখা মন্ত্রিসভা-সিদ্ধান্ত এবং নােটগুলি দেখলেই বােঝা যাবে তার ভাষায় দখল এবং পাণ্ডিত্য। (পরিশিষ্ট ১১, ১২ দ্রষ্টব্য।)
একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। পাণ্ডিত্যের কারণেই হােক অথবা কিছুটা বামপন্থী-উদার রাজনৈতিক চেতনা ও বিশ্বাসের কারণেই হােক, তাজউদ্দীন মাঝে মাঝে প্রচণ্ড বাস্তবতার মুখে ভাববাদী, আদর্শবাদী হয়ে পড়তেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্ত

পৃষ্ঠা: ৫৫
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী। প্রকাশ্যে নয়, ঘরােয়াভাবে আমাদের সাথে আলােচনায় লাতিন আমেরিকায় কী ঘটছে, আফ্রিকায় বর্ণবাদী ধনতন্ত্রের পতন কেন অবশ্যম্ভাবী, আমাদেরও সুদিন অবশ্যই আসবে—এরকম কথা বলতেন। তাঁর বিশ্লেষণ যে সঠিক ছিল তার প্রমাণ তাে আমরা পেয়েছি। অন্যান্য জাতির মুক্তিসংগ্রাম থেকে তিনি উৎসাহ আর প্রেরণা পেতেন। আমাদেরও উৎসাহিত করতেন।
শহীদ তাজউদ্দীন আরেকটি বিষয়ে স্পর্শকাতর এবং ভাবপ্রবণ ছিলেন। সেটি বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে। গভীর শ্রদ্ধা ছিল, বড়ভাইয়ের মতাে ভালােবাসতেন। ছিলেন নিত্যসঙ্গী। নেতার কথা মনে পড়লেই চুপ করে থাকতেন, চোখের কোণে পানি টলমল করত। ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররােচনায় আর গােয়েন্দাদের দেয়া ক্রমাগত ভুল ও একপেশে বক্তব্যে একসময় বঙ্গবন্ধু শহীদ তাজউদ্দীনের কাজকর্ম সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তাজউদ্দীনকে নিজে জিজ্ঞাসা না করে অপরের কথায় গুরুত্ব দেওয়ায় তিনি খুবই মর্মাহত হন। তিনি বেশ আবেগপূর্ণ (emotional) এবং ভাবপ্রবণ (sentimental) হয়ে পড়েন। কিন্তু কখনও তাঁকে তাঁর নেতা সম্পর্কে কটু কথা বলতে শুনিনি। আমি এখনও মনে করি যে, ১৯৭৩-৭৪-এ যখন চারদিকে চক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে; সেই সময় তাজউদ্দীনের উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুর মুখােমুখি হওয়া এবং নিঃসঙ্কোচে সব বিষয় আলােচনা করা। কিন্তু তিনি তা না করে নিজেকে খােলসের মধ্যে গুটিয়ে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আজীবন কাজ করেছেন নেতার প্রতি তার আনুগত্য ছিল তুলনাবিহীন। তাঁর অটল বিশ্বাস আর আনুগত্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আস্থা হারানােয় শহীদ তাজউদ্দীন যেন কেমন মিয়মাণ হয়ে পড়েন। একসময় নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শহীদ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানের ছিল অবিচল আস্থা আর আনুগত্য। তা না হলে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে আমি যখন টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কি খন্দকার মােশতাকের আহ্বানে সাড়া দেবেনতারা সকলে একই উত্তর দিলেন: Over my dead body (আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে)। খন্দকারও এ-কথা জানতেন বলেই ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে, রাতের অন্ধকারে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটালেন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সেমন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। সরকারের কাজকর্ম সুশৃঙ্খল করতে তিনি মন্ত্রিসভার-সভায় আলােচনার জন্য বহু বিষয় ঠিক করতেন। আলােচ্যসূচির এসব বিষয় মনে রাখার জন্য তিনি সেগুলি প্রায়ই নােট আকারে লিখে রাখতেন তার ডায়েরিতে। তাঁর নিজ হাতে লেখা এসব নােটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই গ্রন্থে নােটের কিছু কিছু এখানে উল্লেখ করা হলাে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়ােজন যে, এসব তথ্য দ্বিরুক্তি মনে হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে তার স্বহস্তে লিখিত নােট প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ করা হলাে।

নিচের নােটটি (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের স্বহস্তে লেখা) লক্ষ্য করলেই বােঝা যাবে কী অভিনিবেশ সহকারে তিনি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন। গুরুত্ব অনুয়ায়ী ক্রমিক নম্বর দিয়ে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। (পরিশিষ্ট ১৩ দ্রষ্টব্য)
১. ভাসানী ১. স্বীকৃতি
২. রাইস ২. কোলকাতায় লিয়াজোঁ অফিস
৩. মনােবল ৩. ঠিকানা: হাইকমিশন অফিস
৪. যােদ্ধাদের জন্য সরবরাহ ৪. দিল্লিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎকার
৫. বেসামরিক সরবরাহভ ৫. জয়প্রকাশ নারায়ণ
৬. প্রলম্বিত যুদ্ধ ৬. প্রচার সেল-নেতৃত্বে রদবদল শরণার্থী সমস্যা
৭. অস্ত্র ও গােলাগুলি ৭. রেডিও ট্রান্সমিটার সারাক্ষণ ধাক্কা দিতে হবে
৮. অ্যাকাউন্ট
৯. সাহায্য গ্রহণ
১০. মােটর যান- পাওয়া যাচ্ছে না
১১. ঋণ
(১) মি. অজয় মুখার্জিকে চিঠি
নােটের অপর পৃষ্ঠায় লেখা আছে:
১. একটি এলাকা দখলে রাখা
২. পাকিস্তানি মুদ্রা সমান মূল্যে বিনিময়।
এরপর আরেকটি নােট, তাতেও কোনাে তারিখ নেই (পরিশিষ্ট ১৪ দ্রষ্টব্য।) খুব সম্ভবত এপ্রিলের প্রথমেই লেখা। ক্রমিক নম্বর দিয়ে লেখা প্রতিটি বিষয়ের ঐ সময়ে অপরিসীম গুরুত্ব ছিল।
১. স্বীকৃতি
২. সাহায্য
ক. অস্ত্র ও সমরসম্ভার (কক) সমরাস্ত্র ও যন্ত্রপাতি, খাদ্য
খ. গােয়েন্দা সংস্থা
গ. যােগাযােগ – (১) টেলিফোন, বেতার (২) পরিবহণ-যান্ত্রিক, মােটরযান – আকাশে (এরােপ্লেন, হেলিকপ্টার) – নৌপরিবহণ
ঘ. প্রকাশনা ও প্রচার
(১) রেডিও (মিডিয়াম ওয়েভ) (২) ছাপানাের ব্যবস্থা
(৩) পত্রিকা।
ঙ. চিকিৎসা সাহায্য-জনগণের জন্য
চ. খাদ্য, লবণ, কেরােসিন ছ, মুদ্রা জ. মুক্তি অঞ্চল-ময়মনসিংহ, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম পুরােপুরি প্রতিরােধ ও রক্ষা করতে হবে।
– থানা ও মহকুমায় সেনা চৌকি বসাতে হবে।

মন্ত্রিসভার আরাে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় একই দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল তারিখে। এই সভার সিদ্ধান্তগুলােও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজে লিখেছিলেন। (পরিশিষ্ট ১৫ দ্রষ্টব্য।) সভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
জনাব এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান ব্যতীত সকলেই উপস্থিত।
নিম্নলিখিত সদস্যদের তাদের নামের বিপরীতে উল্লেখিত দায়িত্ব দেওয়া হলাে:
১. জনাব এম. এ. সামাদ, এম. এন. এ. – মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক সহকারী।
২. জনাব এ. মান্নান, এম. এন. এ. – প্রচার ও গণমাধ্যম।
৩. জনাব আমীর-উল ইসলাম, এম. এন. এ. – প্রধানমন্ত্রীর সহকারী
একই নােট-শিটে ১৬-৪-৭১ তারিখ লিখে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার নিম্নরূপ সিদ্ধান্তের নােট স্বহস্তে নিখেছেন।
কর্নেল ওসমানি।
১. বিভিন্ন ট্রেজারি থেকে দ্রুত টাকা সংগ্রহ করে নিরাপদ এলাকায় আনতে হবে।
২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন প্রদান-প্রাপ্তব্য।
৩. বেসামরিক কর্মচারিদের বেতন প্রদান
৪. বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহ- লবণ, ভােজ্য তেল, চাল, ম্যাচ, কেরােসিন, পেট্রোল, ডিজেল, মবিল।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে সামগ্রিক সমস্যাগুলাে মােকাবেলা করতেন। তাঁর চিন্তাধারা এবং পরিকল্পনা ছিল পরিষ্কার এবং সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন জাতীয়সমস্যা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে তিনি পর্যালােচনা করতেন। তার কিছু প্রমাণ তাঁর নিজের লেখা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দিকের নােট।
১৩।৪।৭১
১৬।৪।৭১
সভার বিবরণী সংক্ষিপ্ত (Precise to the point) কিন্তু বাস্তব এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উপযােগী করে লেখা।
সম্ভবত ১২ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভা শুরু হয়। আমি তখনও রামগড়ে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাই ছিল প্রধানতম বিষয়। কয়েকদিন পর, ১৭/৭-এ সিদ্ধান্ত হয় যে Defence-এর জন্য সভা নির্ধারিত থাকবে প্রতি রবিবার। অন্যান্য বিষয় সােমবার। অনির্ধারিত সভা ছিল প্রাত্যহিক। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়সমূহ পেশ করা হতাে।
৯ আগস্ট সন্ধ্যা ছয়টায় মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক বসে। তাতে সিদ্ধান্তগুলাে তাজউদ্দীন সাহেব নিজ হাতে লিখেন। সভার আগে তিনি একটি কাগজে উভয় পৃষ্ঠায় বেশকিছু বিষয়বস্তু লেখেন, যা মন্ত্রিসভায় আলােচিত হয়েছিল কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়নি। এটাকে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব এজেন্ডা বলা চলে। এসব বিষয় নিয়ে তিনি তখন বিচলিত ছিলেন। বেশ গাঢ় করে লেখাদৃশ্যত একবার লিখে, তার ওপর আবার কলম ব্যবহার করেছেন। একই বিষয়ে চিন্তা করতে থাকলে আমরা সাধারণত এরকম আন্ডারলাইন করি অথবা লেখার ওপর কলম চালাতে থাকি। ক্রমিক নম্বর ১, ২ এবং ৭ টিক-চিহ্নিত, তার অর্থ আলােচিত এবং গৃহীত। ৩ থেকে ৬ একটি দীর্ঘবন্ধনী (bracket) দিয়ে দেখানাে হয়েছে, অর্থাৎ এই দুটি বিষয় একটি আরেকটির পরিপূরক। (পরিশিষ্ট- ১৬ দ্রষ্টব্য)
৯। ৮।৭১

মন্তব্য
১. যুব শিবির: অভ্যর্থনা শিবিরগুলি বাংলাদেশ সরকার দেখাশুনা করবে। ২. আঞ্চলিক প্রশাসন এবং আঞ্চলিক কাউন্সিল। ৩. প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহ এবং প্রশিক্ষিত (ট্রেনিংপ্রাপ্ত) গেরিলাদের সমস্যাগুলি। ৪. স্নায়ুযুদ্ধ (Psy warfare) সেল। ৫. তথ্য ও বেতারের সমস্যাবলি। ৬. প্রতিরক্ষা বিষয়াবলি-সচিব। ৭. বাসস্থান: এই বাড়িটি হবে প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর। মন্ত্রিপরিষদ এখানে কাজ করবে।
কোনাে সাক্ষাৎকার এখানে হবে না। সচিবালয় অন্য ভবনে স্থানান্তর করতে হবে। উপরে লেখার অপর পৃষ্ঠায় ছােট অক্ষরে আবার কয়েকটি বিষয়। চারটিতে টিক চিহ্ন। দুটো বিষয়ের পাশে একটা দাগ দেওয়া। (পরিশিষ্ট-১৭ দ্রষ্টব্য।)
ক. হাজী নূর বকস খ. শেখ আবদুল আজিজ গ. বাদশাহ ঘ. ফরিদপুর ঙ. ছাত্রবৃন্দ চ. আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ছ. অস্ত্র ও গােলাগুলি সংগ্রহে সংগঠিত বেসরকারি (private pressure groups) চেষ্টা।

৯। ৮।৭১, সন্ধ্যা ৬টা
সকল সদস্য উপস্থিত। প্রধান সেনাপতি এবং প্রফেসর ইউসুফ আলী উপস্থিত।
১। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পােষ্যদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থসাহায্য করবেন ৫,০০,০০০/= টাকা-ত্রাণমন্ত্রী।
২। রাজনৈতিক কর্মী, নেতৃবৃন্দ, এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ. ব্যতীত, শিল্পী, শিক্ষক প্রমুখকে সাহায্য প্রদান = ২,৫০,০০০.০০ + ২,৫০,০০০.০০ আঞ্চলিক কাউন্সিল (Zonal council) কর্তৃক
প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত সিদ্ধান্তে এবং ছােট ছােট নােট থেকে বুঝা যায় যে, তিনি কত বিচক্ষণ ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি দেশের কর্ণধারদের একজন ছিলেন।
দেশ পরিচালনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় মুক্তযুদ্ধকালীন তাঁর প্রদত্ত ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। এমন এক ভাষণ তিনি ২৩ নভেম্বরে দেন। এটি বেতার-ভাষণ ছিল। বক্তৃতায় বাংলার দুর্ধর্ষ দামাল ছেলে মুক্তি সৈন্যদের রণনিপুণতার প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন:
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পর্যালােচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানাদিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে-কথা শক্রমিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে-কোনাে সময়ে যে-কোনাে জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে। মুক্তিবাহিনীর, নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত। মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। সৈন্য, সামগ্রী, মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশাহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখে। এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এখন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গােপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না। বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে।
সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে-ব্যবস্থাই করে থাকুক-না কেন, আর এই উপমহাদেশের জন্য যে-ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপূত হােক-না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই—আর তা হলাে পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প ও সে-স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি, এক বিশ্বশক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।
এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোনাে-কোনাে পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য করার মতাে। মনে হয় মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শােচনীয়। কিন্তু ভারতকে অর্থসাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোনাে রাষ্ট্র উত্থাপন করে তখন আমরা শিউরে না-উঠে পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বতপ্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদের হাতবদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কী উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমন কী নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালিকে সুপরিকল্পিত হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান-সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য-সংগ্রাহক পাঠিয়ে কী ফল তারা লাভ করতে চান, জানি না। তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোনাে ব্যত্যয় হবে না। সে-সংকল্প হলাে দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অঞ ও রক্তের বিনিময়ে যে-স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে-স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরাে আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবনদানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কী মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কী ব্যবহার করি, তার উপর। শত্ৰু-সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজগঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে-যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশি দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং

পৃষ্ঠা: ৬০
অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু-প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের সে ভবিষ্যৎ-রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন, সেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নির্গমনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তাই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানব আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমাদের আহ্বান: মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন। যেসব সরকারি কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহণ করুন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মতাে বলতে চাই: বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশি প্রভুদের পরিণতি একই হবে—আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু। হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সকলে প্রস্তুত থাকুন: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই।
জয় বাংলা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিটি ভাষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে বলতে কখনও ভুলতেন না। উপযুক্ত ভাষণে তার প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী যে-ভাষণ দেন, তাতেও তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে পাকিস্তানি শাসকবর্গকে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিচে এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের বিবরণ তুলে ধরা হলাে:
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যের তােরণে উপনীত হয়েছে।
গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার নিযুক্ত খঅঞ্চলের সামরিক প্রশাসনক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী তার অধীনস্থ পাকিস্তান স্থল, বিমান ও নৌ-বাহিনী, আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন।
পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে-দুঃস্বপ্নের রাত্রি শুরু হয়েছিল, এতদিনে তার অবসান হলাে। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলাে। এত অল্প সময়ে বােধহয় আর কোনাে জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হয়নি। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্যও বােধ হয় আর কোনাে জাতি দেয়নি। আজকের বিজয়, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়-সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন, শ্রদ্ধাপ্লুত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযােদ্ধাদের, যারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন সকলের জন্য। পাকিস্তানের সামরিক-চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখতে। হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এই দুঃসময়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত। আর তাই পাকিস্তানি সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে। পশ্চিম-রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। আর পূর্ব-রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তারা মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুত গতিসম্পন্ন হতে পারল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশার নেতৃত্বে এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নিপুণ রণকৌশলে। এই দুই সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর কাছেও আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবণিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে-বিষয়েও আমরা সচেতন। তাঁদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন। আমাদের সংগ্রামের প্রতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পােল্যান্ড এবং অন্য যেসব দেশ আমাদের ন্যায়-সংগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।
আমরা এ-কথাও ভুলিনি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন।
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনাে শত্রুর কারাগারে। পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি তারা শেষ মুহূর্তেও অন্তত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেবার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এল এক রক্তাল্পত ভূমিতে, এক ধ্বংস্তুপের মধ্যে। জনগণের আশা ও আকাক্ষা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে-তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে। দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুনঃনির্মাণ নয়—নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা দিয়েছি, সেই ঐক্য ও ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম।
জয় বাংলা।

ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী (১৯১৯-১৯৭৫)
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এম. মনসুর আলী অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযােগী হিসেবে তিনি সর্বদা নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপােষহীন।
সিরাজগঞ্জ জেলার কুড়িপাড়ায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মনসুর আলী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে প্রবেশিকা, ১৯৪১ সালে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. এবং এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে পাবনায় আইনব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দক্ষতার সঙ্গে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে-মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ‘৭৫ সনের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রদত্ত তার একটি ভাষণ নিচে উদ্ধৃত হলাে:
গত চার মাস ধরে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতা রক্ষার এক মরণপণ সংগ্রাম করে চলেছি। পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর নগ্ন-আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করেছি নতুন ইতিহাস।
এই সংগ্রামে যেসব স্বাধীনচেতা অকুতােভয় বীরসন্তান শহীদ হয়েছেন তাদেরকে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দেশমাতৃকার এইসব বীর সন্তানের জন্য জাতি গর্বিত। আমাদের মৃত্যুঞ্জয় মুক্তিপণে আমরা সবাই দীক্ষিত।
শক্রর বর্বর আক্রমণে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছেন তাদের আমরা পূর্ণ সহানুভূতি জানাচ্ছি। আর যেসব অগণিত বীরসন্তান মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে হানাদার পশুদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে লড়ে চলেছেন, স্বাধীনতা রক্ষার শপথে যারা রােদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দুর্গম এলাকায় দিনের-পর-দিন বিদ্রি রজনী কাটাচ্ছেন; শেল, গােলা, বেয়নেটের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা শত্রু নিধন করে চলেছেন; তাদেরকে জানাচ্ছি আমরা প্রাণঢালা অভিনন্দন। চরম দুঃখ-কষ্টের মাঝেও বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগাচ্ছেন বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা নেই।
আমাদের এ-সংগ্রাম সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শােষণের ইতিহাস আজ আবার নতুন করে বলার প্রয়ােজন নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এ-কথা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী প্রথম থেকেই পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং কীভাবে এই উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখা যায় সেই ষড়যন্ত্রেই সবসময় লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের উৎপাদিত অর্থকরী ফসল বিদেশে রপ্তানি করে তারা পেয়েছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, এখানকার কাঁচামালে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের শিল্পসংস্থা আর বাংলাদেশে হয়েছে তাদের পণ্যের বাজার মাত্র।
শুধু তাই নয়, বাংলার অগণিত মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে লব্ধ অর্থে তারা গড়ে তুলেছে এক বর্বর সৈন্যবাহিনী। বাংলার স্বার্থকে দমন করাই হচ্ছে সে-সেনাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ। বাঙালি যখনই নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামে এগিয়ে গেছে, এই বর্বর সেনাবাহিনী তখনই তাদের পশুশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে মুক্তিকামী মানুষের উপর। এরই নগ্নরূপ আমরা দেখেছি ১৯৬৮ সালে, ১৯৬৯ এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাঙালির এই অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতেই প্রণীত হয়েছিল ৬-দফা কর্মসূচি। এর ভিত্তিতেই মুক্তির এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শহরে, বন্দরে হাটে, মাঠে, গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র লাখাে জনতা একই রায় দিয়েছিল: ৬-দফা বাঙালির বাঁচার দাবি। ৬দফা আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ। কিন্তু পশ্চিমা সেনাবাহিনী বরদাশত করতে পারল না এই মুক্তি-আন্দোলন। ৬-দফা আন্দোলনের নায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালিকে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে জনগণের কাছে নিজেদের করল হাস্যাস্পদ। জনতার রুদ্ররােষে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। জনতার রায়ে শেখ মুজিব মুক্ত হলেন। আসল ষড়যন্ত্রকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কুখ্যাত আইয়ুব খান উপায়ন্তর না-দেখে গদি ছাড়লেন। শান্তিরক্ষার নামে গদিনশিন হলাে ইয়াহিয়া খান।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করবে বলে ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন দিল। সে-নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৬-দফার পক্ষে তাদের সুস্পষ্ট রায় ঘােষণা করলেন। বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ৬-দফা আন্দোলনের সমর্থনে আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট পেয়ে জয়যুক্ত হলাে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিজয় নজিরবিহীন।
পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদীদের এ বিজয় সইবে কেন? জনতার রায়কে নস্যাৎ করার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠল। চিরাচরিত উপায়ে এবারও তারা তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে নিয়ােগ করল তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলাল পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল। নেমে এল ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত। তারপরেই ইতিহাস একদিকে যেমন বর্বরতার দূরপনেয় কলঙ্কে কালিমাময়, অন্যদিকে তেমনি মুক্তিকামী মানুষের আত্মপ্রত্যয়ে ভাস্বর। পশ্চিম পাকিস্তানি নৃশংসতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কময় অধ্যায়। নাদির শাহ, চেঙ্গিস খান আর হিটলারকেও নৃশংসতায় হার মানিয়েছে নরখাদক ইয়াহিয়া-টিক্কা খান।
ওরা শুধু লাখে লাখে নিরাপরাধ নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সুপরিকল্পিত উপায়ে ওরা আমাদের অর্থনীতিকে করেছে সম্পূর্ণ ধ্বংস।
ওরা আমাদের খাদ্যের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, গৃহস্থের সােনাদানা, গরু-ছাগল লুট করে তাদেরকে পথে বসিয়েছে। এক কথায়। গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই দিয়েছে চুরমার করে।
শহরাঞ্চলে ওরা দোকানপাট ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অবাঙালিদের দিয়ে। দোকানের জিনিসপত্র লুঠ করিয়েছে। অনেক শিল্পসংস্থা জ্বালিয়ে দিয়েছে; যন্ত্রপাতি খুলে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। বাকি যে-কয়েকটি রয়েছে সেগুলােতে বাঙালি কর্মচারীর শতকরা নব্বইজনকে তাড়িয়ে দিয়ে অবাঙালি বসিয়ে দিয়েছে। বাঙালি শ্রমিকরা আজ বেকার, বাঙালির শিল্পের কাঠামাে আজ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, শহরে-বন্দরে বােমা নিক্ষেপ করে ওরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত, সড়ক-সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। হাটে-মাঠের লােককে ভীত-সন্ত্রস্ত করে সাধারণ ব্যবসাবাণিজ্যকে করেছে বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি সংস্থার হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করে অসংখ্য পরিবারকে ঠেলে দিয়েছে অনাহার আর মৃত্যুর মুখে। সবশেষে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে, অধ্যাপক-শিক্ষার্থীদের হত্যা করে, মানসিক সম্পদে আমাদের বিনিয়ােগের পথকে করেছে রুদ্ধ; যার ফলে ভবিষ্যতে আক্রান্ত হতে পারে আমাদের দক্ষতা আর পারদর্শিতা।
কিন্তু বন্ধুগণ, সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা আর কুকর্মের খেসারত পােহাতে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেও। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে-ঘরেও আজ কান্নার রােল পড়েছে; সেখানকার অর্থনীতিও সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল যাওয়া, বন্ধ হবার ফলে তাদের রপ্তানি-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাজার হারিয়ে ফেলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব-উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যগুলােই গুদামে পচতে শুরু করেছে। নতুন উৎপাদনের সুযােগ-সম্ভাবনা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে বহু শিল্প-কারখানা ইতমধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাকি অনেকগুলােয় প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বেকারদের অভিশাপ নেমে আসছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে।
তার উপর রয়েছে সমর-পরিচালনা বিরাট ব্যয়ভার। বাংলাদেশে সমরাভিযান অব্যাহত রাখতে ইসলামাবাদ সরকারকে প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে গড়ে এক-কোটি টাকা। মুক্তিবাহিনী গেরিলার হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে আর ডিভিশনের-পর-ডিভিশন সৈন্য পাচার করছে বাংলাদেশে। ফলে খরচের পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে প্রতিদিন। অথচ আয়ের সাধারণ পথ দিন-দিন বন্ধ হয়ে আসছে। ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
তাই ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে প্রায়ই জোর করে নতুন ট্যাক্সের নামে টাকা-পয়সা লুট করে চলেছে। কতিপয় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়ে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে বিষময়। তাই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে ধরনা দিয়েছিল ইসলামাবাদ সরকারের বিশেষ দূত। কিন্তু তাতেও বিশেষ সাড়া মেলেনি। অগত্যা উন্নয়ন-পরিকল্পনাকে শিকেয় তুলতে হয়েছে। হতাশায় ভেঙে পড়েছে ইয়াহিয়া-সরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করায় আমরা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সাথে সাথে আমি এ-কথা সুস্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই—পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আজ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সুতরাং বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোনাে অধিকারই ইসলামাবাদ-সরকারের নেই। একমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে।
ইয়াহিয়া-সরকারকে সাহায্য করার মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না।
ভারত-সরকার ও জনসাধারণ নানারূপ অসুবিধার মধ্যে লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী বাঙালিকে বাঁচানাের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা এজন্য তাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর আরাে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র বিভিন্ন রকম সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদেরকেও আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেহেতু বাংলাদেশের বেশকিছু এলাকা এখনও শক্রকবলিত রয়েছে তাই এ-মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হচ্ছে না। তবু সীমিত পরিসরে আমরা যে-কয়েকটি অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছি তা হচ্ছে এই-
১. এই মুক্তিসংগ্রামে যে-সমস্ত বাঙালি সন্তান জীবন দিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার তাদের পরিবারবর্গের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছে তাদের পরিবারকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার সমূহ-চেষ্টা করে যাবে।
২. শত্ররা আমাদের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়েছে। মুক্ত-এলাকায় এই বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। মুক্ত-এলাকায় সরকার এ-ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

পৃষ্ঠা: ৬৫
৩. যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রণয়নে যে-কথাটি আমরা সবসময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে:চরম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এই মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এবং সেই ফল থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হন তার যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মােট কথা, সমগ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
যেসব দুস্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙালিদের বাড়িঘর জোর করে দখল করেছে; ধন-সম্পত্তি লুঠ করেছে; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তার ধন-সম্পত্তি অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে নিঃস্ব মানুষের বাঁচার অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুদের সহায়তায় জোর করে কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোনাে অধিকার নেই।
জানি আপনারা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জানি এ-মুহূর্তে আপনাদের এই অর্থনৈতিক সংকট নিরসন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও আপনাদের কাছে অনুরােধ: বিপদে ধৈর্যচ্যুত হবেন না। আজ আমরা এক অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন। একমাত্র চরম ত্যাগতিতিক্ষার শপথেই আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে-কর্তব্য রয়েছে সেগুলাে সম্পর্কে আপনাদের আবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়ােজন বােধ করছি।
১. যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোনাে বিদেশি সরকারের এ-ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এ-কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
২. শত্রুরা সুপরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যাভাব সৃষ্টি করেছে। লাখাে লাখাে বাঙালিকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে।
এমতাবস্থায় প্রতিটি গ্রামকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। গ্রামবাসী ভায়েরা আমার, খাদ্য উৎপাদনে আপনাদের যথাশক্তি নিয়ােগ করুন। শক্রকবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখুন। কারণ এ ফসল বিক্রি করে শত্রু হাতিয়ার কিনবে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য।
গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর দিয়ে গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলুন। গ্রামে গ্রামে কুটিরশিল্প গড়ে তুলুন। পরস্পর সহযােগিতার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচার পথ বেছে নিন। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও অন্যান্য ফসল ইয়াহিয়া-সরকার নানারূপ ভয়ভীতির মাধ্যমে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য মারণাস্ত্র কিনছে। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই বাণিজ্য বাের্ড গঠন করেছে। এইবাের্ড বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল বিদেশের বাজারে বিক্রির সমূহ-ব্যবস্থা করবে। আমাদের ভাইয়েরা যাতে তাদের উৎপন্ন ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য বাের্ডের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি।
সর্বশেষে নাগরিক ভাইদের কাছে আমার একান্ত অনুরােধ, আপনারা শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযােগিতা চালিয়ে যান। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন। কারখানার উৎপাদন বন্ধ করুন। শত্রুকে সদাসর্বত্র নাজেহাল করে তার অর্থনৈতিক কাঠামাে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিন।
মনে রাখবেন, আপনাদের অসহযােগিতায় শত্রুর তথা পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিমধ্যে প্রায় ভেঙে পড়েছে। আপনাদের পরিপূর্ণ অসহযােগিতায় অচিরে তা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আপনাদের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
এখানে একটি কথা আপনদের মনে করিয়ে দিতে চাই। এ-কথা সত্যি যে, শত্রুকবলিত এলাকায় আমাদের মুক্তিবাহিনী পুল, সেতু উড়িয়ে দিয়ে সড়ক-যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। প্রয়ােজনে রাস্তাঘাট কেটে শত্রুর পরিবহণ-ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিচ্ছে। এতে আমাদের অর্থনীতিতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনাে উপায় নেই।
শত্রুনিধনই আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। নিজেদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেও আমাদের এ কর্তব্য সমাধান করতে হবে। দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি হানাদার সৈন্যও উপস্থিত থাকবে ততক্ষণ আমরা শনিধন-পর্ব চালিয়ে যাব। সামনে যত বাধাই আসুক না কেন। অবশ্য দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হলে আমরা প্রথমেই এসব রাস্তাঘাট পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করবাে। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এসবের পুনঃনির্মাণে বেশি সময় লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসের আজ এক চরম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হতে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে যারা পশুশক্তির বলে বঞ্চিত করতে চাইছে তাদের সাথে আমাদের কোনাে আপােষ নেই। রক্তভেজা পথে এগিয়ে চলেছে বাঙালির মুক্তি-কাফেলা। কালের দেয়ালে পড়ছে রক্তের ছাপ। রক্তের আঁখরে লেখা নবযুগের ইতিহাস।
লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ বাঙালিকে হত্যা করে ইয়াহিয়া-টিক্কা যে পাপ করেছে, ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের জবাবদিহি করতে হবে। ইতিহাসে অমােঘ দণ্ড এড়ানাের উপায় কারাে নেই। সাম্রাজ্যবাদের দিন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর সব দেশেই মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভূত হয়েছে। সবক্ষেত্রে এ-কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে অস্ত্রপ্রয়ােগে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম স্তব্ধ করা যায় না।
বাঙালির এ-মুক্তিসংগ্রামকেও তাই বুলেট-বেয়নেট, শেলগােলায় স্তব্ধ করা যাবে না। রক্তে যখন মাতম জেগেছে, পদ্মা-মেঘনায় বান ডেকেছে, তখন তাকে রুখতে পারে এমন সাধ্যি কারাে নেই।
মর্জি খােদা। জয় আমাদের সুনিশ্চিত এবং সেদিন বেশি দূরে নয়। জয় বাংলা।

এ. এইচ.এম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫)
বর্তমান নাটোর জেলার অন্তর্গত বাগাতিপাড়ার মালঞ্চা গ্রামে ১৯২৩ সালের ২৬ জুন তারিখে এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল হামিদ ও মাতা বেগম। জেবুন্নিসার ঐকান্তিক ইচ্ছায় তিনি তাঁর বাল্যজীবন রাজশাহী ও চট্টগ্রাম স্কুলে কাটান। কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং রাজশাহী আইন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৫৬ সাল থেকে রাজশাহী জজকোর্টে আইনব্যবসা শুরু করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি দুবার জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
কামারুজ্জামান ছিলেন বনেদি পীর-পরিবারের মানুষ। তাদের জমিদারিও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্বে ছিলেন। কামারুজ্জামান ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, সীমান্ত এলাকা, শরণার্থী শিবিরে গিয়ে দিনরাত খাটতেন।
তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন রুচিবান কৌতুকপ্রিয় প্রিয়ভাষী মানুষ। তার ব্যক্তিগত সংস্কৃতি উঁচু দরের ছিল। তিনি উন্মুক্ত এবং বিদ্বেষহীন মনের অধিকারী ছিলেন। নিস্পাপ মনের এই মানুষ দায়িত্ব পালনে সুদক্ষ কর্মী ছিলেন। কামারুজ্জামানের সব স্বভাবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ও দৃষ্টি-আকর্ষণীয় ছিল তার অনবরত পান-চিবানাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের তিনি স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। দায়িত্ব পালনে তিনি যে ত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কঠিন প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ছিল প্রশ্নাতীত।
মুক্তিযুদ্ধের সামরিক দিকেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি তার দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধে জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করেছে।
স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৩ সনের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবতীতে ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও এম. মনসুর আলীসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
মুজিবনগরে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে তিনিও দেশবাসী, মুক্তিযােদ্ধা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বহু জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তার ভাষণের বিবরণ প্রতিবেদনরূপে তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ থেকে এরূপ একটি প্রতিবেদন নিচে উদ্ধৃত হল:
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু দানব বলে অভিহিত করেছেন।
সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত দ্বিতীয় দফা ভাওতাবাজি সম্পর্কে মন্তব্য করতে বললে জনাব জামান উপরােক্ত মত ব্যক্ত করেন। জনাব জামান বলেন, ইয়াহিয়া খানের মতাে এত বড় মিথ্যাবাদী, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক দুনিয়ার বুকে দুটি জন্মায়নি। তার কথায় বাংলাদেশের মানুষ তাে দূরের কথা, বহির্বিশ্বের কোনাে মানুষও বিশ্বাস স্থাপন করবে না। ইয়াহিয়া নিজেকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু বলে প্রমাণ করেছে। জনাব কামারুজ্জামান বলেন, শেখ মুজিবের সাথে আলােচনায় ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের সমস্ত দাবি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ এক ঘােষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তার বদলে ইয়াহিয়া ঐ রাতে বাঙালিদের উপর লেলিয়ে দেয় তার বর্বর সৈন্যবাহিনীকে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার জঙ্গীচক্রের নেই। শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি লােক আমাদের সমর্থন করেছেন। আমাদের বিচার করার ক্ষমতা কেউ জঙ্গীচক্রকে দেয়নি। তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধহীন ক্ষমতামত্ত দানব। আওয়ামী লীগ আলােচনা ভেঙে দেয়নি। এখন যখন যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন আমাদের পবিত্রভূমি থেকে হানাদান বিতাড়িত না-করা পর্যন্ত আমরা তা চালিয়ে যাব। নির্যাতিত মানবের পাশে যারাই এসে দাঁড়াবেন তারাই মহৎ। তাদেরকে আমরা বন্ধু বলে মনে করব।

জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী
মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীর নাম অতি নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়ােগদানের কথা ঘােষণা করেন ১৭ এপ্রিল। এই আনুষ্ঠানিক নিয়ােগ লাভের আগে থেকেই তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠন করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অনৈতিক আক্রমণের আগে এই বাঙালি সামরিক অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণকারী কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করায় এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুঁজতে থাকায় তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্তে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণকে একত্র করার সময় তাকেও পান। অন্যান্য নেতার সঙ্গে তাকেও নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা নির্ধারণকল্পে আলােচনা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রশাসন-ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সারাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ তাদের করণীয় সম্বন্ধে আলােচনা করেন। রাতদিন অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে নেতৃবৃন্দ আলাপ-আলােচনা করেন। তার আগে তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমীর-উলইসলাম দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশের মানুষকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিন্ন কোনাে দেশ সরাসরি সাহায্যে এগিয়ে আসবে না,এ-কথা নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন। তাই, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত সদস্যগণকে (যাদেরকেই তখন কাছে পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে আলােচনা করেছেন। কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী, এম.এন.এ. বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত এই গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
১৭ এপ্রিলে তাকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘােষণা করা হলেও কার্যত তিনি ১২ এপ্রিল থেকে ঐ পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আনুষ্ঠানিক নিয়ােগ লাভের আগেই তিনি মুক্তিবাহিনী সংগঠন গড়ে তােলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৮ম ব্যাটালিয়ন এবং সাবেক ই.পি.আর.-এর উইংসমূহ স্বতন্ত্রভাবে পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘােরতর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সমরবিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে যােগ দেয় পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে যােগ দেয় পূর্ববাংলায় কর্মরত পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা, ওয়ারেন্ট কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদস্থ সদস্য। ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানি ডুবােজাহাজ পরিত্যাগকারী নৌবাহিনীর বাঙালি ওয়ারেন্ট কর্মকর্তা ও অন্যান্যপদস্থ নাবিকসহ নৌবাহিনীর অনেক সদস্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এছাড়া, দেশের তরুণ ছাত্র, কৃষক-তনয়, শ্রমিকরা এসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ই.পি.আর.-এর সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে যােগ দেয়। কর্নেল (অব) ওসমানীর নির্দেশনায় এসব তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এপ্রিল মাসেই তিনি এক বিশাল গেরিলা বাহিনী এবং নৌকমান্ড গঠনসহ নিয়মিত বাহিনীর সম্প্রসারণ ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জুন মাসের শেষদিক থেকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য গেরিলা বাহিনীকে রণক্ষেত্রে পাঠানাে শুরু হয়। বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে কিছু বিলম্ব হওয়ায় তিনি বিমান বাহিনীর উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে স্থলবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। স্থলযুদ্ধেও এঁরা সকলেই কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
সংগঠিত গেরিলা বাহিনী পরিচিতি লাভ করে গণবাহিনী নামে। বেসামরিক তরুণদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হওয়ায় ওসমানী এমন নামকরণ করেছিলেন। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর সম্মিলিত পরিচয় ছিল মুক্তিবাহিনী নামে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরা বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেয়। ঝড়, বৃষ্টি, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মুক্তিযােদ্ধারা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মরণপণ লড়াই করেছে।
প্রসঙ্গত একটি কথা বলতেই হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন সেক্টর-কমান্ডারদের সাথে স্বশরীরে আলােচনার জন্য তাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন সকলের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া এবং মনােভাব ফুটে ওঠে তা অনির্বচনীয় ও অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। সকলেই সেদিন আবার দেশকে শত্রুমুক্ত করতে নবপ্রেরণায় শপথ গ্রহণ করে।
কর্নেল (অব) ওসমানী ছিলেন একজন বাঙালি সামরিক অফিসার। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে তার মতাে একজন সামরিক ব্যক্তিকে পাওয়া গৌরবের বিষয়। তার সম্বন্ধে জেনারেল মীর শওকত আলীর মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেছিলেন: ওসমানী ভারতীয় জেনারেলদের সমকক্ষ ছিলেন, এবং কারাে কারাে সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল অরােরা যিনি ইস্টার্ন কমান্ডের (ভারতীয় বাহিনীর) সি.ইন.সি. ছিলেন, তার চাইতেও ওসমানী সিনিয়র। ছিলেন এবং খুব সম্ভবত জেনারেল মানেকশ (ভারতীয় বাহিনীর তৎকালীন প্রধান সেনাপতি) থেকে জুনিয়র ছিলেন। তিনি যদি না-থাকতেন, আমার মনে হয় না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছেন, সেভাবে সাহায্য করতেন। কারণ আমরা অনেক জুনিয়র ছিলাম। আমরা ছিলাম মেজর, আর তারা ছিলেন জেনারেল, লে. জেনারেল।
ওসমানী যখন বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। কিন্তু বয়স তাঁকে হার মানাতে পারেনি। রণাঙ্গনের কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা থেকে তিনি পিছু হটেননি। যে-কোনাে বিশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তিনি জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করেন।

পৃষ্ঠা: ৭০
মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার তারিখ এবং তারপরও আরাে কয়েকদিন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সেসব সিদ্ধান্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় বিশেষ অবদান রাখবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব সিদ্ধান্ত, সরকারি আদেশনির্দেশ, চিঠিপত্রের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউই বিশেষভাবে আলােকপাত করেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার পর আজ তিনটি দশক পার হয়ে গেল, অথচ স্বাধীনতা অর্জনের পটভূমিতে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র সঠিকভাবে কেউ তুলে ধরেননি। নানান ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস লক্ষ্য করছি। আমি লেখক বা ইতিহাসবিদ নই। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে দায়িত্ব পালনকালে আমি সকল সরকারি কাজকর্ম প্রত্যক্ষ যেমন করেছি, তেমনি মন্ত্রিসভার সকল প্রকার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছি। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামাের বিবরণ পরিশিষ্ট ১৮-তে দেয়া হলাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনায় আমি অসংখ্য সহকর্মী ও সহযােগীসহ ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিলাম বলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অবক্ষয় দেখে খুবই পীড়িতবােধ করি। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে যেভাবে কাজ করেছি তা কি সবই অসার হয়ে যাবে? এই আশঙ্কা আর প্রশ্ন আমাকে আমার অন্তর থেকে একটা তাগিদ দেয়। এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাে বটেই, গবেষক এবং ইতিহাস-লেখকদের জন্য কিছু উপাদান রেখে যাওয়া আবশ্যক। কিন্তু কীভাবে তা উপস্থাপন করব! আগেই বলেছি, আমি লেখক নই, সরকারি আমলা ছিলাম মাত্র। তবু যেভাবেই হােক, ইতিহাস-বিকৃতির অপপ্রয়াস থেকে জাতিকে সতর্ক করতেই হবে।
বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে প্রবাসে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যেসব কর্মকাণ্ড ও প্রয়াস চালিয়েছিলেন আমি তার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার স্বাক্ষরে সরকারের বহু আদেশ-নির্দেশ জারি করা হতাে। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণ আমাকে ছায়ার মতাে থাকতে হতাে। তাঁর মৌখিক, লিখিত, সব নির্দেশ আমি পালন করতাম। তিনি নিজে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি সংরক্ষণ করতেন। আমি নির্দিষ্টভাবে কোনাে ডায়েরি সংরক্ষণ না-করলেও হাতে সার্বক্ষণিকভাবে একটা ডায়েরি থাকত। তাতে আমি বিভিন্ন নােট, টেলিফোন নম্বর ও অন্যান্য টুকিটাকি বিষয় লিখে রাখতাম এবং আমার দাপ্তরিক কাজে তা কাজে লাগাতাম। আজ এসব আমার নিকট খুবই মূল্যবান প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এসব তথ্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। আমার এসব তথ্য সবই প্রাথমিক উৎস হিসেবে পরিগণিত হবে, কারণ আমি কোনাে শােনা-কথা (hearsay) লিপিবদ্ধ করিনি।
আমার তথ্যগুলােকে প্রাথমিক (primary) বলার কারণ এই যে, আমার ডায়েরির পৃষ্ঠা, সরকারি আদেশ-নির্দেশের মূল কপি, মন্ত্রিপরিষদের সভার কার্যবিবরণী ও, সিদ্ধান্তের মূল খসড়া (draft.) এবং অন্যান্য দলিলপত্রের মূল কাগজপত্রের সমুদয় বিষয় আমি উল্লেখ করেছি। মনগড়া কোনাে বিষয় অথবা স্মৃতি থেকে কোনাে কিছু বলার আমার প্রয়ােজন নেই।
পাঠক, লেখক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের জন্য চিত্তাকর্ষক খবর এই যে, আমি সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে আনীন থাকায় খসড়া (draft) পযায়ের, এমনকি দাপ্তরিক চিঠিপত্রের মূল আদেশ-নির্দেশের কপিও আমার কাছে থাকা খুবই স্বাভাবিক। অবশ্য আমার স্বাক্ষরিত এসব অফিস আদেশ-নির্দেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংরক্ষিত আছে। কারণ, এসব চিঠিপত্র অথবা অফিস-আদেশ অবগতি অথবা প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হতাে। সংশ্লিষ্ট সেসব দপ্তরে খোঁজ করলেও আমার নিকট সংরক্ষিত চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজের অনুরূপ কপি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। আমার আশঙ্কা, দেশ যে-পথে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে প্রকৃত তথ্য-সম্বলিত দলিল-দস্তাবেজ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা! তবে, আশার কথা এবং বাস্তবতা এই যে, এসব তথ্য দেশ-বিদেশের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। কাজেই, আমার মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশে এসব তথ্য বিকৃত করা সম্ভব হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তথ্যভাণ্ডার থেকে তা কখনই সরানাে যাবে না অথবা বিকৃতভাবে তা বলা যাবে না। এরকম একটি মনােবল নিয়েই আমি এই গ্রন্থের বর্তমান অধ্যায়ে মন্ত্রিসভার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলােচনা করছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় পাক-হানাদার বাহিনী কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইটের মুহূর্ত থেকে। পাকিস্তান-বাহিনীর অতর্কিত ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডে বাঙালি জাতি গর্জে ওঠে এবং প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সরকার গঠিত হয়। এ-সম্বন্ধে আরাে বিস্তারিত আমি অন্যত্র আলােচনা করব। এখানে শুধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা প্রসঙ্গেই বলি।
এখন হয়তাে অনেকেরই মনে নেই যে, আমাদের সরকারে প্রথম যে-নামকরণ করা হয় তাতে আঞ্চলিকভাবে শব্দের সামান্য তফাৎ ছিল। পূর্বাঞ্চলে প্রথম কয়েকদিন আমরা কেউ কেউ গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার বলতাম এবং চিঠিপত্র ও অফিস আদেশ ইত্যাদিতে তা উল্লেখ করা হতাে। গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার শিরােনামে লেটারহেড ছাপানাে হয়েছিল (পরিশিষ্ট-১৯ দ্রষ্টব্য)। পরে গণপ্রজাতান্ত্রিক শব্দ সংশােধন করে গণপ্রজাতন্ত্রী ব্যবহার শুরু হয় যা আজ পর্যন্ত বহাল আছে। ইংরেজি Government of the People’s Republic of Bangladesh-কে বাংলায় ভাষান্তর করার সময় গণপ্রজাতন্ত্রীর জায়গায় গণপ্রজাতান্ত্রিককরা হয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের তারিখের (১৬ ডিসেম্বর) পর আরাে ৪ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগরে মন্ত্রিসভার যেসব সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেসব সভায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়েছিল তার কিছু-কিছু অংশের বিবরণ নিচে দেওয়া হলাে। যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা এবং আত্মসমর্পণের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ এসব তথ্যে পাওয়া যাবে।

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রিত বেতার-কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে প্রচারিত হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার থেকে প্রকাশিত Contemporary Events And Documents’ শীর্ষক পুস্তিকায় উল্লিখিত ১০ এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতার ঘােষণা (The Proclamation of Independence) এবং আইনের ধারাবাহিকতা এবং প্রয়ােগ আদেশ—১৯৭১’ (The Laws Continuance Enforcement Order 1971) আনুষ্ঠানিকভাবে পরবর্তী পর্যায়ে প্রচারিত হওয়ার পর মন্ত্রিসভার বহু গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার উল্লেখযােগ্য সিদ্ধান্তগুলােই শুধু এখানে বিধৃত হলাে।
যেহেতু স্বাধীনতা ঘােষণা (The Proclamation of Independence) ১০ এপ্রিলেই হলাে, তাই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের জন্য ১৭ এপ্রিল নির্ধারণ করলেন। অবশ্য এর সাথে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত ছিল। মন্ত্রিসভার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ এপ্রিল। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ভাষণ দেন ১১ এপ্রিল। (পরিশিষ্ট-২০ দ্রষ্টব্য)। অবশ্য এটা ছিল অনানুষ্ঠানিক। নিরাপত্তার খাতিরে এবং গােপনীয়তা রক্ষার জন্য কোথায় সভা অনুষ্ঠিত হলাে তা কাউকে জানানাে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানসের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কেন দেশকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলাে তার আনুপূর্ব বর্ণনা দেন। কোন্ কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ চলছে তার বিবরণও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দস্যুদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের নিকট থেকে অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। যুদ্ধের সময় শত্রুকে সহযােগিতা না-করার আহ্বান জানিয়ে সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি নিয়ে দেশবাসীকে যুদ্ধে নিয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন।
আমি অনেক পরে মুজিবনগর গিয়েছিলাম (জুন) বিধায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন নিজেই প্রথম দুইমাসের সভাগুলির কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করেন তার নিজ হাতের লেখায়। কাউকে টাইপও করতে দেননি, যদি গােপনীয়তা রক্ষা করা না যায় তাই। দুইমাসের বেশি সময় যতগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয় তার সবগুলির কার্যবিবরণী (minutes) এবং সিদ্ধান্ত (decisions). এবং বেশ কিছুর টেকা (note) শহীদ তাজউদ্দীন আমার হাতে তুলে দেন আমি মুজিবনগর যাবার পরেই। চমৎকার হাতের লেখা—পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন। কি ইংরেজি, কি বাংলা দুটোই চমৎকার লিখতেন। অন্যান্য আওয়ামী নেতৃবৃন্দের মতাে জনসভায় অতটা অনলবর্ষী আবেগময় বক্তৃতা দিতে পারতেন না। ভাষা এবং লেখার পরিচ্ছন্নতার ওপর খুব গুরুত্ব দিতেন। তার হাতের লেখা রেকর্ড, নথি, সব আমি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম এই গ্রন্থ ২০০৪ সালে যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন পর্যন্ত। স্বাধীনতার ৩২ বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ায় আর গােপনীয়তার প্রয়ােজন নেই। এখন জনগণের এবং বর্তমান প্রজন্মের এগুলাে জানা উচিত। তাই কিছু কিছু অংশ টাইপ করে নিচে তুলে ধরা হলাে।

প্রথম সভা: ১২ এপ্রিল, ১৯৭১
আলােচ্যসূচি অতি সংক্ষেপে ক্রমিক নম্বর দিয়ে। প্রথমে লেখা ১., ২., ৩., ৪.; পরে আবার ১.থেকে ১০.; মাঝে ৮. নেই। নিচে দাগ দিয় আবার ১.।

কী ছিল আলােচ্যসূচি?
১. সরকারের দপ্তর স্থাপন (Set up Seat of Govt.)/স্থান নির্ধারণ
২. সচিবালয় প্রতিষ্ঠা-মহাসচিব (Secy. Gen.)
৩. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় (Cabinet Secretariat)।
৪. পুলিশের মহাপরিদর্শক (I.G.P.)। ১. প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ, যুদ্ধের সরবরাহ। স্বরাষ্ট্র (Defence, War, War Supply, Interior) ২. পররাষ্ট্র (Foreign Affairs) ৩. অর্থ (Finance) খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং বেসামরিক সরবরাহ (Food, Relief & Rehabilitation and Civil Supply) ৫. বাণিজ্য ও শিল্প (Commerce &Industries) ৬. সাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার (Health and Local Govt.) ৭. যোগাযোগ (Communications) ৯. তথ্য (Information) ১০. পূর্ত (ভবন, মহাসড়ক (Buildings, Highways)

১. কর্নেল ওসমানীর পদের মান (Posting of Col. Osmani)
এরপর প্রতিটি সভার কর্মসূচি, সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর নােটের বাংলা অনুবাদ ক্রমিক অনুসারে নিচে দেওয়া হলাে। উপরের নােটে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন কীভাবে করা হবে তার একটা রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীর মনে ছিল। এছাড়াও সরকার যাতে দ্রুত দায়িত্ব গ্রহণ এবং কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারেন সেজন্য সর্বপ্রথম স্থান নির্বাচন ও সচিবালয় স্থাপন বিশেষ গুরুত্ব পায়। ১৮ এপ্রিলের বৈঠকে বিষয়গুলি চূড়ান্তভাবে স্থির করা হয়। নিচে এগুলাে উল্লেখ করা হলাে।

১৩/৪/১৯৭১
১৩ এপ্রিলের সভার বিষয়গুলি ছিল:
১. সাহায্য
ক. সামরিক খ. বেসামরিক জনগণের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ গ. অর্থ ঘ. নােট ছাপানাে
২. রাজনৈতিক
জনগণের মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা। আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরকে পূরণ করতে হবে অবিলম্বে।
৩. সামরিক সংগঠন
ক. নিয়মিত সামরিক বাহিনী খ. কর্মীবাহিনীকে উদ্বুদ্ধকরণ ৫টি ক্যাম্প স্থাপন প্রশিক্ষক নিয়ােগ (কারিগরী অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং উপকরণ সরবরাহ)।

১৪/৪/১৯৭১
১৪ এপ্রিলের লেখায় শহীদ তাজউদ্দীন স্বহস্তে স্পষ্ট লিখেছেন:
১. মন্ত্রিসভার সদস্য অথবা মন্ত্রিসভা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যতিরেকে কোনাে ব্যক্তি ভারত সরকার, কোনাে রাজ্য সরকার অথবা কোনাে বিদেশি সরকার অথবা কোনােরূপ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংবাদমাধ্যমের সাথে যােগাযােগ করবেন না এবং ভারতে অবস্থানরত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজ পরিচয় গােপন করে চলবেন।

পরিশিষ্ট ১১-তে প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা নােট দেখুন। তাঁর মূল ইংরেজি লেখা এত সুন্দর, এত সাবলীলভাবে লিখেছিলেন যে ভাবাই যায় না। এই লেখা দেখে বুঝেছিলাম যে এত লােক থাকতে বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলনের সময় কেন তাজউদ্দীন সাহেবকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নির্দেশাবলির মুসাবিদা প্রস্তুত এবং দৈনিক প্রেসনােট জারি করতে। নিচে মূল ইংরেজি লেখার বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলাে।
২. ক্যাবিনেট কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে কোনাে আওয়ামী লীগ নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি বা অন্য কোনাে ব্যক্তি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করবে না। ৩. সরকার কর্তৃক নতুন নােট অথবা মুদ্রা না-ছাড়া পর্যন্ত দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে। বাংলাদেশে মুদ্রা প্রস্তুত ও ছাপানাের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে পুরােনাে পাকিস্তানি নােটের ওপর বাংলাদেশের ছাপ দেওয়া হবে। ৪. প্রাক্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকরূপে কাজ করবে। ৫. ভারত এবং অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে সরকার পরিচালনার জরুরি এবং তাৎক্ষণিক ব্যয় নির্বাহে ঋণ পাওয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকার মতাে প্রয়ােজন হবে। ৬. বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্য সরবরাহ, লবণ, কেরােসিন, ভােজ্য তেল, দেয়াশলাই ইত্যাদি অতি জরুরিভাবে সংগ্রহ করতে হবে। ভারত-সরকারের সাহায্যে এই খাদ্যদ্রব্য বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল পর্যন্ত পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহের বিশেষ পথ খুলতে হবে। ৭. দৈনন্দিন এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি ন্যায্যভাবে বিতরণের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ৮. মুক্ত-অঞ্চলের জনগণের জন্য ওষুধ সরবরাহ, মহামারী রােগসমূহের জন্য টীকা, রােগবীজনাশক ওষুধ এবং অস্ত্রোপচার-এর যন্ত্রপাতির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা এবং বেসামরিক জনগণের জন্য সীমান্ত বরাবর সহায়ক (auxiliary) হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। ৯. নেতৃত্বদানের প্রশিক্ষণ (Leadership Training) এবং নির্দেশাবলি দিতে হবে। ক. উদীয়মান প্রতিশ্রুতিশীল ই.পি.আর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধস্তন অফিসার ও জোয়ানদের খ. প্রাক্তন সামরিক বাহিনী সদস্যদের; গ. আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডারদের; ঘ. রাজনৈতিক বিশ্বাসে বলীয়ান যুবকদল এবং ইউ.ও.টি.সি সদস্যদের। নেতাদের জন্য জরুরি অপারেশনের প্রশিক্ষণ পৃথকভাবে ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা হবে ক্রমান্বয়ে। ১০. সীমান্ত এলাকার যত কাছে সম্ভব সহজে যােগাযােগযােগ্য কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে দেশ থেকে আগত প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করতে হবে।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম

পৃষ্ঠা: ৭৫
১৫/8/১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু বিষয় লিপিবদ্ধ করেন ক্রমানুসারে। এগুলাে তাঁর কাজের তালিকা। লিখেছেন এইভাবে: (পরিশিষ্ট ২১ দ্রষ্টব্য)।
১. ক. বেসামরিক কর্মকর্তা এবং খ. পুলিশের সাথে যােগাযােগ স্থাপন। ২. টিপু, কমল হাসান। ৩. নূতন দিল্লির সাথে রাজনৈতিক সংযােগ। ৪. পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে যােগাযােগ রাখা। ৫. আইনগত সাহায্য, সচিবালয় গঠন, সহকারীবৃন্দ। ৬. প্রেস ব্রিফিং-এর কাজ এমনভাবে সমন্বয় করা যেন তারা শুধুমাত্র সরকারি ভাষ্য প্রচারের ব্যাপারে সহযােগিতা করেন। ৭. বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা বা ব্যক্তি বাংলাদেশকে যে সাহায় করবেন তা সরকারের অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে (?)। ৮. প্রশিক্ষণ ক্যাম্প কবে (?) ৯. লন্ডনে ভাবী। ১০. ওসমানী+আরেকজন, মি. সিদ্দিকী। ১১. মেজর ওসমান+এস.ডি.ও.+এস.ডি.পি.ও.। ১২. হাসান আলীর সাথে সংযােগ করতে হবে–১৮ এপ্রিলে সাক্ষাৎকার। ১৩. টেপ রেকর্ড।
ওপরের ক্রমিক (২)-এ যাঁদের নাম লেখা হয়েছে তারা সুবিদ আলী টিপু, এম.পি.এ. (ঢাকা) এবং ইঞ্জিনিয়ার কমল হাসান সিদ্দিকী, যিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে একটি চোখ হারিয়েছিলেন। ক্রমিক (৭) ও (৮)-এ প্রশ্নবােধক চিহ্ন দিয়েছিলেন, খুব সম্ভবত তার এবিষয়ে সন্দেহ ছিল। লন্ডনে ভাবী, এটা কি বেগম মুজিব-কে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা বুঝিয়েছেন? সম্ভবত, তাই হবে, আমার অনুমান। হাসান আলী কে তা জানতে পারিনি। টেপ রেকর্ডতাঁর বক্তব্য বা ভাষণ রেকর্ড করার জন্য।
সংক্ষিপ্ত বাক্যে তাঁর এসব নােট খুবই প্রণিধানযােগ্য। এই নােট সম্পর্কে গবেষকগণ তাদের পদ্ধতিতে হয়তাে আরাে বিস্তারিত জানাতে পারবেন, আশা করি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আমারই উপর আস্থা রেখে এসব ব্যক্তিগত নােট আমার নিকট হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন এসব নােট নিরাপদ স্থানে আস্থাভাজনের নিকট সংরক্ষণ করা জরুরি!

১৬/৪/১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর এই নােটটি ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগের দিন। শুধু আলােচনার জন্য কয়েকটি বিষয় লেখা রয়েছে। (পরিশিষ্ট ২২ দ্রষ্টব্য)।
১. জনাব মালেক উকিল ২. বক্তব্য পাঠ ৩. পােষাক ৪. নিরাপত্তার ব্যবস্থা- আমাদের নিজস্ব। বন্ধুদের যেন দেখা না পাওয়া যায়। ৫. অনুষ্ঠানটি যেন সাজানাে মনে না হয়। সাংবাদিকদের সাথে যােগাযোেগ।

১৭/৪/১৯৭১
একই তারিখে প্রধানমন্ত্রী ডায়েরির পাতায় নিচের বিষয়গুলাে লিখেছেন। (আগেই উল্লেখিত ১৫ সংখ্যক পরিশিষ্টের শেষাংশ দ্রষ্টব্য)।

কর্নেল ওসমানী
১. বিভিন্ন সরকারি ট্রেজারি থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে আনয়ন।
২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন।
৩. বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন।
৪. দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ-লবণ, ভােজ্য তেল, চাল, দেয়াশলাই।
৫. সরবরাহ লাইন সংরক্ষণ (Line of Supply)
চট্টগ্রাম জেলা – রামগড়-সাবরুম
নোয়াখালী – পরশুরাম-বেলােনিয়া
কুমিল্লা- সিংগাইরবিল, কসবা, কমলসাগর
সিলেট- কৈলাশহর, তেলিয়াপাড়া, সূত্রনগর-ধর্মনগর
ময়মনসিংহ – তােরা
খুলনা- বনগাঁও, বশিরহাট
যশাের – বেনাপােল
উত্তরবঙ্গের জেলাসমূহ – বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, গােলকগঞ্জ
৬. আমাদের উৎপাদিত ফসল/দ্রব্যাদির বিক্রয়—চা, পাট, মাছ, কাগজ, শুটকি মাছ, চামড়া।
৭. বিভিন্ন সংস্থা/সংগঠন কর্তৃক ভারতে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে যেতে হবে।
৮. ভারত থেকে ১০ কোটি রুপির ব্যবস্থা।
৯. মুদ্রা—পাকিস্তানি মুদ্রা/কারেন্সি (currency) ভারতীয় মুদ্রায় বদলানাে (exchage) এবং আমাদের নিজস্ব currency-র তারল্য বজায় রাখা।
১০. কূটনৈতিক আলােচনা
ক. ড.এ.আর. মল্লিক খ. মি.এ.কে.খান গ. ড. এস. মুরশেদ ঘ. ড. এ. করিম ঙ. মাহবুব আলম
১১. Care (কেয়ার) লন্ডন আর্থিক এবং পণ্য সাহায্য
১২. এক লক্ষ রুপীর একটি ইমপ্রেস্ট ফান্ড জরুরিভাবে সচিবালয় স্থাপনের জন্য।
১৩. এস. আলমকে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়ােগ।
১৪. শর্টওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার চালুমিডিয়াম ওয়েভের পরিবর্তে একটি।
১৫. সরবরাহ ব্যবস্থা বা লাইন অবশ্যই চালু রাখতে হবে।
১৬. আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।
উপরের এসব প্রসঙ্গ (points) প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য এবং সুপারিশ লিপিবদ্ধ করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভায় যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বিবরণ নিজেই লিখেছিলেন। তাঁর স্বহস্তে লেখা সিদ্ধান্ত সমূহের বিবরণ নিচে দেওয়া হলাে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই গ্রন্থের ১২ সংখ্যক পরিশিষ্ট দেখা যেতে পারে।
১. মন্ত্রণালয় বণ্টন:
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ-প্রধানমন্ত্রী
ক. প্রতিরক্ষা। খ. তথ্য ও বেতার এবং টেলিযােগাযােগ। গ. অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। ঘ. শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সামাজিক উন্নয়ন। ঙ. সংস্থাপন এবং প্রশাসন। চ. অন্য সকল বিষয় যা কোনাে মন্ত্রীকে বণ্টন করা হয় নাই।
খন্দকার মােশতাক আহমেদ
ক. পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খ. আইন ও সংসদ বিষয়াবলি।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী
ক. অর্থ ও রাজস্ব। খ. বাণিজ্য ও শিল্প। গ. যােগাযােগ।
জনাব.এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান
ক. স্বরাষ্ট্র। খ. সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন। গ. কৃষি।
২. বেসামরিক কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারের অবস্থা অনুযায়ী নিচের হারে বেতন দেওয়া হবে:
ক. চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী–পূর্ণ বেতন খ. দ্বিতীয় শ্রেণী: শতকরা ২০(%) হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৪০০/= প্রতি মাসে গ. প্রথম শ্রেণী: শতকরা ২৫ (%) হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৫০০/= প্রতি মাসে
(স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম)।
৩. জনাব এম.আর. সিদ্দিকীকে পূর্বাঞ্চলের কর্মচারীদের বেতন বিতরণের ক্ষমতা দেয়া হলাে। তিনি ঐ অঞ্চলে রক্ষিত বাংলাদেশের অর্থ থেকে বেতন দেবেন। আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে যে জনাব এম.আর. সিদ্দিকী বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে সাহায্য করবেন।
৪. ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বৈঠক অতি সত্বর আয়ােজন করতে স্থানীয় সংযােগকারীকে অনুরােধ করা হবে।
৫. সিদ্ধান্ত হলাে যে-প্রধান সেনাপতি সাহায্যকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বিভিন্ন কার্যকর ভূমিকায় নিয়ােগের জন্য বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক (মণি), সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাককে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে ক্ষমতা দেওয়া হলাে।
৬. জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তিকে সচল ক’রে রাজনৈতিক প্রতিরােধের দায়িত্ব দেওয়া হলাে।
৭. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যাংক এবং ট্রেজারিতে গচ্ছিত অর্থ যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে সেজন্য প্রধান সেনাপতির পরিকল্পনা অনুমােদন করা হলাে। দুজন অফিসারের সমন্বয়ে একটি বাের্ড গঠন করা হলাে যারা এই অর্থ সংগ্রহ করে যথােপযুক্ত রশিদ রেখে নিরাপদ এলাকার বন্ধুদের নিকট গচ্ছিত রাখবেন।
৮. সমন্বয়কারীর সাথে বন্দোবস্ত অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী মহােদয়ের ব্যক্তিগত নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
শপথ গ্রহণের ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এই মন্ত্রিসভার বৈঠক শুধু সুদুরপ্রসারী নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। দপ্তর বণ্টনের সাথে সাথে যুব মুক্তিবাহিনী গঠন; বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট স্থাপন, মিজান চৌধুরী ও সিদ্দিকী সাহেবকে বিশেষ দায়িত্ব প্রদান, সরকারি কর্মচারীদের বেতনের হার নির্ধারণ ও প্রদান-এইসব সিদ্ধান্ত শুধু মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নয়, পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, রাজনৈতিক সংগঠন ও ঘটনাবলির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ক. হাজী নূর বকস খ. শেখ আবদুল আজিজ গ. বাদশাহ ঘ. ফরিদপুর ঙ. ছাত্রবৃন্দ চ. আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ছ. অস্ত্র ও গােলাগুলি সংগ্রহে সংগঠিত বেসরকারি (private pressure groups) চেষ্টা।

১৮/8/১৯৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সভায় চারজন মন্ত্রীর দপ্তর বণ্টনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিম্নলিখিতভাবে মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে এসব বিষয় সভা-অনুষ্ঠানের আগেই তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। পূর্ববর্তী পৃষ্ঠায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। নিচে মন্ত্রিসভার সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত হিসেবেও একই বিষয় উল্লেখ করা হলাে এইজন্য যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবসর মুহূর্তে যেসব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে লিখতেন তাই-ই তিনি মন্ত্রিসভার সভায় নিয়মিতকরণ করে নিতেন সরকারি ভিত্তি দেওয়ার জন্য। তার এই কার্যপ্রণালী থেকে একজন দক্ষ ও প্রাজ্ঞ প্রশাসকের চিত্র ফুটে উঠেছে। মন্ত্রিসভার বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সভার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপভাবে অবহিত করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ২৩ দ্রষ্টব্য):

মি, তাজউদ্দীন আহমদ-প্রধানমন্ত্রী
ক. প্রতিরক্ষা খ. তথ্য, বেতার ও যােগাযােগ গ. অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। ঘ. শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ ঙ. যেসব বিষয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিসভার অন্য কোনাে সদস্যকে প্রদান করা হয়নি।
মি. খন্দকার মােশতাক আহমেদ
ক. পররাষ্ট্র বিষয় খ. আইন ও সংসদ বিষয়
মি. এম. মনসুর আলী
ক. অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব খ. বাণিজ্য ও শিল্প।
গ. পরিবহণ
মি. এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান
ক. অভ্যন্তরীণ খ. সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন গ. কৃষি

এদিনের সভায় অন্যান্য যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলির মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এঁদের বেতনাদি শত্রু-অধিকৃত বাংলাদেশ ট্রেজারি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা মেটানাের সুপারিশ করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কীভাবে ও কী পরিমাণ মাসিক বেতন হবে তার হার নির্ধারিত হয়।
মি.এম.আর. সিদ্দিকীকে বাংলাদেশের পূর্ব সেক্টরে সংগৃহীত অর্থে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রদানের কর্তৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিকন্তু, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে তাঁকে দায়িত্ব পালনের অনুরােধ জানানাে হয়। ঐদিনের আর-একটি সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অতি দ্রুত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি বৈঠকের আয়ােজনের বিষয়ে স্থানীয় যােগাযােগ-রক্ষাকারীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ছাত্র ও যুবশক্তিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সহায়তাকারীকর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় কমান্ডার-ইন চিফ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক (মণি), সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক এতদবিষয়ে প্রয়ােজনীয় কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের তৎপরতা জোরদার ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য মি.মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব প্রদান করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অপর এক সিদ্ধান্তে শক্রর হস্তগত হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ব্যাংক ও ট্রেজারির ভাণ্ডার থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহের জন্য কমান্ডার-ইন-চিফের প্রণীত পরিকল্পনা অনুমােদিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীর দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত বাের্ড এই অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে তা নিরাপদ এলাকায় বন্ধুদের নিকট যথােপযুক্ত রশিদ রেখে গচ্ছিত রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পৃষ্ঠা: ৮০
অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নামে ব্যাংকের হিসাব খােলার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। ত্রাণ তৎপরতা সুসমন্বিত ও প্রবহমাণ করার লক্ষ্যে একটি রিলিফ কমিটি নিম্নলিখিভাবে গঠনের সুপারিশ গৃহীত হয়:
১. ত্রাণ মন্ত্রী- চেয়ারম্যান (পদাধিকার বলে)
২. অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী- সচিব
৩. আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী- সদস্য
৪. মি.এ. সামাদ- সদস্য
৫. মি. সােহরাব হােসেন- সদস্য
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সাধারণত তহবিল থেকে পৃথক একটি রিলিফ-হিসাব খােলা হবে যার নাম হবে, বাংলাদেশ সাহায্য তহবিল (Bangladesh Relief Fund) এবং কমিটির চেয়ারম্যান ও সচিব যৌথভাবে অথবা পৃথকভাবে এই হিসাব পরিচালনা করবেন।

২৩/৪/১৯৭১: (পরিশিষ্ট ২৪)
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
১. মি.এম.এ. সামাদ, এম.এন.এ- কে মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়েছে।
২. মি.এ.মান্নান, এম.এন.এ.- কে জনসংযােগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে এবং
৩. মি. আমীর-উল-ইসলাম, এম.এন.এ.-কে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়েছে।
জনাব আবদুস সামাদ আজাদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে পূর্ব-ইউরােপ স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার করেছেন। নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ করে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ (World Peace) এবং শ্রমিক ও বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সাথে তার বিশেষ সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
জনাব এম. এ. মান্নান প্রচারের পুরাে দায়িত্বই নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয়বাংলা পত্রিকা এবং বিভিন্ন পােস্টার, লিফলেট, পত্র-পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব ছিল তাঁর। দপ্তর ছিল বালিগঞ্জ সংলগ্ন পার্ক সার্কাসের বালু হক্কক লেনে।
জনাব আমীর-উল-ইসলাম (ব্যারিস্টার), তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী ছিলেন। তিনি অধিকাংশ সময় নিজেকে রহমত আলী বলে পরিচয় দিতেন। হয়তাে তার এমন কতকগুলি দায়িত্ব ছিল যার জন্য ভিন্ন নামে পরিচয় দিতে হতাে। তবে তিনি- যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহকারী এটা আমরা মন্ত্রিসভার বিভাগের সকল কর্মকর্তাকর্মচারীসহ সরকারের অন্যান্য সকলেই জানতাম।
জনাব আজাদ এবং আমীর-উল ইসলাম প্রায়ই বাইরে থাকতেন। আজাদ সাহেব বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করেই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভাকে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য বিষয়ের বিবরণ (briefing) প্রদান করতেন। আবার কোনাে কোনাে সময় প্রধানমন্ত্রী অথবা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বিশেষ বার্তা বহন করতেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের নিকট।
উপরােক্ত তিন ব্যক্তিই ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান। সামাদ আজাদ সাহেব পররাষ্ট্র মন্ত্রী (পরে কৃষি), মান্নান সাহেব তথ্য (পরে স্বাস্থ্য) এবং আমীর-উল-ইসলাম সাহেব প্রতিমন্ত্রী হন।

২৯/৪/১৯৭১
উপযুক্ত তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ (পরিশিষ্ট ২৫)। ২৯ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভা দু-দফায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিচে উক্ত দুটি সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর স্বহস্তে লেখা তার ডায়েরির পাতার টোকাও (notes) উল্লেখ করা হলাে।

(প্রথম দফা সিদ্ধান্ত)
১. বাংলাদেশ টাকার আমানত (deposit) আদায় (collect) করে তা স্থানীয় মুদ্রায় অবিলম্বে বিনিময় (exchange) করতে হবে।
২. শান্তি-আলােচনায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মি. সামাদকে নির্বাচিত করা হলাে। তাঁকে অপর একজন প্রতিনিধি সহায়তা প্রদান করবেন।
৩. প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. নাহার ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগসূত্র (liaison) রক্ষা করবেন।
৪. সশস্ত্র বাহিনী প্রসঙ্গে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কমান্ডার-ইন-চিফ মুজিবনগরে উপস্থিত সকল কর্মকর্তার একটি বিবরণী প্রস্তুত করবেন। সশস্ত্রবাহিনীর কর্তৃত্ব (command) একক নিয়ন্ত্রণ ও কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ বাহিনীতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের সময় যথােপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
৫. তথ্য ও বেতারে একটি তিন-সদস্যবিশিষ্ট কমিটি নিয়ােগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মি. এম. এ. মান্নান এমএনএ-র নাম কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল নির্বাচিত সদস্য এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য প্রত্যেকে মাসিক ১৫০/= টাকা হারে ভরণপােষণের (maintenance) জন্য পাবেন। সদস্যগণকে এই মর্মে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, তারা যেন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন এবং তাঁদের, বিশেষ করে সদস্যগণের নিজ এলাকার মানুষের দুর্গতি লাঘবে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা নেন।
৭. মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেন যে, অতি জরুরি পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে রাজস্ব তহবিল থেকে অগ্রিম প্রদান করা যেতে পারে।

(দ্বিতীয় দফা সিদ্ধান্ত)
১. রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার অর্থ যােগান দিতে মি. মহসিনের নামে হিসাব খােলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ত্রাণ-তহবিলের একটি অংশ এতদুদ্দেশ্যে প্রদান করতে মি. মহসিন মন্ত্রিসভার নিকট হিসাব পেশ করবেন।
২. স্টকহােমে ১৩-১৬ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় শান্তি-আলােচনায় মি. সামাদ প্রতিনিধিদ্ব করবেন। একজন সহায়তাকারী (aide) নির্বাচন করতে হবে, মি.এ. ইসলামকে ছাড়া যায় কি না বিবেচনা করতে হবে।
৩. স্বীকৃতির বিষয়ে মি. নাহারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করা উচিত। অন্যান্য রাজনৈতিক যােগাযােগ স্থাপন করা উচিত।
৪. কমান্ডার-ইন-চিফের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। যেসব কর্মকর্তা উপস্থিত হয়েছেন তাদের সকলকে একসূত্রে আনা প্রয়ােজন এবং কঠোরভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কাকে এবং কিভাবে প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন করা হয়েছে?
৫. প্রচার ও বেতারের জন্য গঠিত তিন-সদস্যবিশিষ্ট কমিটির চেয়ারম্যান হবেন মি. মান্নান।
৬. নির্বাচিত সদস্য এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যগণ ভরণপােষণের জন্য প্রতি মাসে ১৫০/= টাকা পাবেন (সীমান্ত-সংলগ্ন সদস্যগণ)।
৭. মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে পরিশােধযােগ্য (repayable) ঋণ(loans) বাংলাদেশ সরকার দিতে পারবেন।
৮. বাংলাদেশ টাকার আমানত আদায় এবং তা ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করতে হবে।
৯. বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নিয়োেগ অনুমােদিত হলাে।

শুধু ওপরে তারিখ এবং নিচে ক্রমিক নম্বর দিয়ে বিষয়বস্তু এবং সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা আছে, প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা: ১ থেকে ১২। মাঝখানে ১০ নম্বরের হদিস পাইনি। ক্রমিক নম্বর ১১ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় পৃথকভাবে আলােচনা করেন। কিন্তু এটি ২ বার একটু রদবদল করে লেখা। ১ নম্বর-এর পাশে ক্রসচিহ্ন। হয়তাে অনুমােদিত হয়নি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর আছে তিন বার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে।
১. জনাব মােহসিনের নামে একটি একাউন্ট খুলতে হবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগান দেওয়ার জন্য। ত্রাণ-তহবিলের একটি অংশ এজন্য দেওয়া হবে। জনাব মােহসিন মন্ত্রিসভায় তার হিসাব উপস্থাপন করবেন।
২. স্টকহােমে ১৩ থেকে ১৬ মে তারিখে অনুষ্ঠিতব্য শান্তি পরিষদ (World Peace) কনফারেন্সে জনাব সামাদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাঁর সাথে একজন সহকারী থাকবেন। জনাব ইসলামকে পাঠানাে যায় কিনা।
৩. প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকৃতির বিষয়ে মি.নাহারের* সাথে দেখা করবেন। অন্যান্য রাজনৈতিক যােগাযােগ করতে হবে।
৪. প্রধান সেনাপতির সাথে যােগাযােগ করতে হবে। অফিসারদের** তালিকা প্রণয়ন করা প্রয়ােজন। এক (unified) কমান্ডের অধীনে সকলকে আনতে হবে – সমন্বিত অর্থাৎ এই কমান্ডে কঠোরভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। প্রশিক্ষণার্থী কারা এবং কিভাবে তাদের বাছাই করা হয়েছে?
৫. প্রচার ও বেতার-এর জন্য জনাব মান্নানকে সভাপতি করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হলাে।
৬. নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের জন্য মাসিক ১৫০/= টাকা (রুপি) ভাতা নির্ধারণ করা হলাে। সদস্যদের সীমান্ত এলাকায় থাকতে হবে।
৭. সরকারের তহবিল থেকে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিশােধযােগ্য ঋণ মঞ্জুর করা যেতে পারে।
৮. বালাদেশের গচ্ছিত অর্থ সংগ্রহ করে ভারতীয় মুদ্রায় বিনিময় করতে হবে।
…………………………………..
* মি. নাহার ভারত-সরকারের সাথে যােগসূত্র বা লিয়াজো ছিলেন।
** এখানে খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধকালীন নিয়ােগপ্রাপ্ত প্রথম শর্ট কমিশনের অফিসার বা রিক্রুটদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই ব্যাচে ১৯৭১ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রভূত শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন। কয়েকজন শহীদও হন। শিলিগুড়ি (জলপাইগুড়ি, কাছে মূর্তি নামক স্থানে প্রশিক্ষণ-শিবির ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এদের পাসিং আউট কুচকাওয়াজ-এ সালাম নেন ও সার্টিফিকেট এবং পদক দেন। আমার ব্যক্তিগত বিরাট একটা তৃপ্তির বিষয় এই যে, ঐ ব্যাচের অর্থাৎ স্বাধীন বাংলার প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের সার্টিফিকেট সরকারের পক্ষে আমি দস্তখত করেছিলাম। “Unified”chain of command-এর বিষয়টি কর্নেল ওসমানীর বিশেষ উদ্বেগের কারণ ছিল বিধায় মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্তটি নেন। মুজিববাহিনীর সদস্যরা কিছুতেই তাঁর কমান্ডে না আসাতে প্রভূত সমস্যা হচ্ছিল।
…………………………………………..

৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ সমন্বয় ও সঠিক খাতে ব্যয়ের জন্য একটি রিলিফ কমিটি গঠন করা হলাে, যার সদস্য নিম্নরূপ:
ক. ত্রাণ মন্ত্রী – চেয়ারম্যান (পদাধিকার বলে) খ, অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী – সচিব গ. আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী – সদস্য ঘ. মি.এ. সামাদ – সদস্য ঙ. মি. সােহরাব হােসেন – সদস্য
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সাধারণত তহবিল থেকে পৃথক একটি রিলিফ-হিসাব খােলা হবে যার নাম হবে, বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিল (Bangladesh Relief Fund)’ এবং কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি যৌথ অথবা এককভাবে এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবেন।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম

২৯/৪/৭১
১১। কর্নেল আতাউল গনি ওসামানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি (Commander-in-Chief) পদে নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
১২। লে. কর্নেল আবদুর রবের বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম

২৯/৪/৭১
খুব সম্ভবত উপরের ১১ ও ১২ ক্রমিক নম্বরে উল্লেখিত সিদ্ধান্তদ্বয়ের গুরুত্বের কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঐদিনের (২৯/৪/৭১) সিদ্ধান্তে দুইবার স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুব ঘন ঘন মন্ত্রিসভার সভা অনুষ্ঠিত হতাে। এপ্রিল মাসের মতাে মে (১৯৭১) মাসেও এমন অনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রধানমন্ত্রী গােপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে নিজ হাতেই লিখতেন। উল্লেখ্য, উপরের ৯ সংখ্যক সিদ্ধান্ত পূর্বে ১৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় গৃহীত হয়েছিল।
সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় মন্ত্রিসভার সভার সকল সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। এবং ঐতিহাসিক এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অপরিসীম। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সব কটি মন্ত্রণালয় তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। মন্ত্রিসভা ২ মে এবং ৫ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভা দুটিতে বঙ্গবন্ধুর বন্দিদশা সম্বন্ধে উদ্বেগ এবং তার মুক্তির জন্য ব্যবস্থাগ্রহণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তগুলি ছিল নিম্নরূপ।

২/৫/১৯৭১
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে (পরিশিষ্ট ২৬)।

৫/৫/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ৫ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু অবস্থান সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে আরাে একটি সিদ্ধান্ত (পরিশিষ্ট ২৭ দ্রষ্টব্য) গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তটি ছিল নিম্নরূপ:
মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ২ মে তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় নেওয়া হয়েছিল। সরকারের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে ডা. টি. হােসেনকে নিয়ােগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ছাড়াও ৫ মে তারিখের সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
ক. তহবিল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অগ্রিম ঋণসমূহ অনতিবিলম্বে অর্থমন্ত্রির হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। জমাদানকারীর নাগরিকত্ব নিয়ে এবং এক্ষণে তহবিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই।
খ. দিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও অর্থমন্ত্রী মহােদয় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরসমূহ তদারক করবেন।
গ. মন্ত্রিবৃন্দের বাসস্থান স্থানান্তরের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থমন্ত্রীকে ক্ষমতাপ্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে। এতদুদ্দেশ্যে তাঁকে অপরপক্ষে কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যােগাযোেগ করতে অনুরােধ জানানাে হয়।
ঘ. প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিকালে মুজিবনগরে উপস্তিত মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে ৬ জন আওয়ামী লীগ সেক্টর লিডার নির্বাচিত করার ক্ষমতা অর্পণ করা হলাে।
এসব সিদ্ধান্তের কথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবদের সরকারের মেমাে মারফত জানিয়ে দেওয়া হয়।

১৬/৫/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ১৬ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় সকল সদস্যই উপস্থিত ছিলেন।
১. দিল্লি সফরের ওপর প্রতিবেদন। ২. প্রধান সেনাপতির নানাবিধ সমস্যা। ৩. প্রধান সেনাপতি কর্তৃক উপস্থাপিত বীরত্বের পুরস্কার প্রস্তাবনা অনুমােদিত। ৪. ইতিমধ্যে যুদ্ধে শহীদ যােদ্ধা এবং ভবিষ্যতেও যারা শহীদ হতে পারেন তাঁদের পরিবার/ পােষ্যদের দেখাশুনার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। এদের বিধবা স্ত্রী অথবা পােষ্যদের পেনশন ভাতা দেওয়া হবে।
অতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত গােপনীয় বিধায় এভাবে লিখিত হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি মন্ত্রিসভার সভা ঘন ঘন অনুষ্ঠিত হতাে। এসব সভায় কী কী বিষয় আলােচিত হবে তার সূচি প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে লিখে ঠিক করতেন। নিচে একটি সভার

পৃষ্ঠা: ৮৫
আলােচ্যসূচি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হলাে। পরিশিষ্ট অংশে প্রধানমন্ত্রীর হাতে লেখা সূচি দেখা যেতে পারে।
একটি আলােচ্যসূচি এবং ব্যক্তিগত নােট:
১. শেখ সাহেব ২. এম. আলম এবং টি. ঠাকুর – রিলিফ ৩. জেনারেলদের সভা সন্ধ্যা ৬টায় ৪. দিল্লি যাত্রা ৫. পররাষ্ট্রমন্ত্রী যােগাযােগ করবেন ৬. ডা. টি. হােসেন বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল

২২/৬/১৯৭১
জুন মাসের ২২ তারিখ সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ (পরিশিষ্ট ২৮ দ্রষ্টব্য):
সকল মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি উপস্থিত
১. শত্রুকে মােকাবিলার জন্য সশস্ত্র ব্যক্তিদের নিয়ােগের চেষ্টা। ২. বিভিন্ন সরকারি দপ্তর কর্তৃক পরস্পরবিরােধী আদেশ জারি; মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রতিরক্ষা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ৩. দায়িত্বপ্রাপ্ত এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ.-গণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থীদের ছাঁটাই বাছাইয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে করছেন না। এতে করে শত্রুদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ৪. যুবশিবির সংস্থা মাত্র একটি মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে; ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ এই চেষ্টা করবেন না যাতে সঙ্গতি নষ্ট হয়। পােষাক এবং হেলমেটের সমস্যা।
ক. যুব শিবির পরিকল্পনা/ছক অনুমােদন করা হলাে।
ঐদিন সন্ধ্যা ৬টায় পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা হয়। কিন্তু অনিবার্য কারণে তা অনুষ্ঠিত না-হওয়ায় কোনাে আলােচনা হয় নাইমন্তব্য নােট করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার কাজকর্ম করতে গিয়ে এসব বিষয়ও সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ-সম্বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না অথবা হচ্ছে কি-না তা মনে রাখতে এমন ধরনের নােট লিখে রাখা হতাে।

২৩/৬/১৯৭১
২৩-৬-৭১ তারিখ সকাল ১০টায় এবং ২৪-৬-৭১ তারিখ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত। এই সভায় সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। (পরিশিষ্ট ২৯ দ্রষ্টব্য)।
ক. পরিবর্তিত আকারে যুবশিবির প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমােদিত। খ. এম.এন.এ এবং এম.পি.এ.- দের চলাফেরা এবং ছােটখাটো ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসে
৫০/=রুপি মঞ্জুর করা হলাে।

২৪/৬/১৯৭১ সকাল ১০টা
ক. পাঁচটি অঞ্চল (Zones) নিয়ে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ (Zonal Administrative Council) ব্যবস্থা অনুমােদন করা হলাে। প্রতিটি জোনে অবস্থানরত নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদ মন্ত্রিসভার নীতি ও নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করবেন। পরিষদ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে এবং আঞ্চলিক প্রশাসক এই পরিষদের সদস্য-সচিবরূপে কাজ করবেন।
খ. প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ তহবিল: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম –অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ২. তাজউদ্দীন আহমদ – প্রধানমন্ত্রী। ৩. খন্দকার মােশতাক আহমেদ – পররাষ্ট্র মন্ত্রী ৪. মি. ফণি ভূষণ মজুমদার, এম.পি.এ ৫. মি. এম.আর. সিদ্দিকী, এম. এন.এ

১৭/৭/১৯৭১ বিকেল ৫.৩০টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩০ দ্রষ্টব্য)
সকল সদস্য ও প্রধান সেনাপতি উপস্থিত।
(জনাব মনসুর)
১. প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্যান্য বিষয় আলােচনার জন্য মন্ত্রীসভার বৈঠক হবে প্রতি সােমবার। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বিষয়াদি আলােচনার জন্য শুক্রবার নির্ধারিত হলাে।
২. ১০ থেকে ১৫ জুলাইতে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সভার প্রেক্ষিতে প্রধান সেনাপতি বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করলেন।
৩. (৭) বেতার-প্রচার
সংবাদ
প্রচারকাজ ছবি (ফিল্ম) লিখিত
সরকারি বিজ্ঞপ্তি
৪. (৬) আঞ্চলিক প্রশাসন কাঠামাে। ৮টি অঞ্চল (zone) অনুমােদন করা হলাে। তবে প্রয়ােজনবােধে আগরতলা অঞ্চলকে খণ্ডিত করা যাবে।
৫. (৫) যানবাহন-ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি সরকারি কাজে ব্যবহৃত হলে ভাড়া দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে।
৬. (৪) স্থগিত
৭ (৩) অনুমােদিত
৮. (৯) ব্যবসা/বাণিজ্য উন্নয়ন বাের্ড উপদেষ্টা কমিটি।
৯. (৮) দুটি বিষয় স্থগিত।

১৮/৭/১৯৭১, রাত ১০.৩০ টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩১ দ্রষ্টব্য)
৮. ক. অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রফেসর রেহমান সােবহানকে বিশেষ দূত নিয়ােগ করা হলাে। খ. জনাব এম. আর. সিদ্দিকী-যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত যদুর মনে পড়ে আগের দিনের, অর্থাৎ ১৭/৭/৭১ তারিখের সভার স্থগিত বিষয়াদি ১৮/৭/৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় নিস্পত্তি করা হয়।

২৯/৭/১৯৭১ সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩২ দ্রষ্টব্য)
সকলেই উপস্থিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী বিশেষভাবে আমন্ত্রিত।
প্রফেসর ইউসুফ আলী ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং যুবশিবিরের উপর তাঁর প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেন।
১. যুবশিবির। বিশেষ সময়(zero hour) কি কিছু ক্যাম্প বন্ধ করার জন্য?
২. এখান থেকে ত্রাণসামগ্রী বণ্টন করা হবে না। আঞ্চলিক পরিষদ (zonal council) বিশেষ ক্ষেত্রে উপযুক্ততা বিচার করবেন।
৩. War on Want প্রকল্পের শিবির সম্পর্কে আলােচনা মন্ত্রিসভার পরবর্তী বৈঠকে হবে।

অন্যান্য বিষয়:
১. অবিলম্বে কর্মচারী নিয়ােগ। ২. ৩০/৬/৭১ পর্যন্ত বেতন প্রদান। ৩. সচিবালয় প্রতিষ্ঠা- বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সহকারী। ৪. কর্মচারীদের আবাসনের জন্য একটি পৃথক বাড়ি।

২৯/৭/১৯৭১
(পরিশিষ্ট ৩৩ দ্রষ্টব্য)
১. জীবনধারণ ভাতা
ক. সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী খ. শিক্ষক গ. পেনশন
২. মুক্ত এলাকায় প্রশাসনযন্ত্র স্থাপন যথা, তেতুলিয়া, রৌমারি সমস্যা পর্যালােচনা করে সমাধান খুজতে হবে।
৩. তদন্ত কমিশনে ব্যক্তি নিয়ােগ ক. জনাব হান্নান। খ. মি. ভৌমিক গ. মি. বড়য়া-সদস্য সচিব
৪. অফিসের স্থান-সমগ্র ভবন।
৫. এখানে বসবাসকারীদের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা
৬. বেতারের লােকদের জন্য বাসস্থান
৭. ছাত্রলীগ-অর্থ
৮. আওয়ামী লীগ-অর্থ
(আঞ্চলিক অফিসের জন্য সাময়িক বাজেট)

এখানে ত্রাণ দেওয়া হবে না
রবিবার সকাল ৯টায় সি.আই.টি. রােডে সভা।*
………………………….
উপরের আলােচনা ২৯/৭/৭১ তারিখের স্থগিত সভার, যা পরে অর্থাৎ রবিবার বিবেচনা করা হয়।
…………………………

১. সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যুক্ত সি. অ, অ. (সিভিল অ্যাফেয়ার্স উপদেষ্টাদের) জন্য সম্ভাব্য ব্যয়। ২. এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ. দের পরিবারবর্গ ৩. বিচারপতি চৌধুরী।* ৪. যুদ্ধ তহবিল হিসাব- যথােপযুক্ত নাম দিতে হবে। ৫. দাপ্তরিক লিয়াজে

৯/৮/১৯৭১ সন্ধ্যা ৬টা
সকল সদস্য উপস্থিত। প্রধান সেনাপতি এবং প্রফেসর ইউসুফ আলী উপস্থিত।
১। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পােষ্যদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থসাহায্য করবেন ৫,০০,০০০/=টাকা-ত্রাণমন্ত্রী।
২। রাজনৈতিক কর্মী, নেতৃবৃন্দ, এম.এন.এ এবং এম.পি.এ. ব্যতীত, শিল্পী, শিক্ষক প্রমুখকে সাহায্য প্রদান=২,৫০,০০০/- +২,৫০,০০০/=- আঞ্চলিক পরিষদ (zonal council)

১৩/০৮/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সচিব হিসেবে আমি একটি গােপনীয় সিদ্ধান্ত সকল সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের নিকট প্রেরণ করি (পরিশিষ্ট ৩৪ দ্রষ্টব্য)। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারের সকল সচিবকে সমম্বয় ও ব্রিফিংয়ের উদ্দেশ্যে সপ্তাহে অন্তত একদিন আন্ত-বিভাগীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই সাপ্তাহিক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম যে, সাপ্তাহিক এই বৈঠক প্রতি সােমবার সকাল ৯.০০টায় অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে একই তারিখে ১৮(৬) ক্যাব সংখ্যক এক গােপনীয় ও জরুরি পত্র দিয়ে সকল সচিবকে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে তাদের কার্যপত্র (Working paper) পাঠানাের অনুরােধ জানিয়েছিলাম (পরিশিষ্ট ৩৫ দ্রষ্টব্য)।

১৬/৮/১৯৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৬/৯/৭১ তারিখে ১৩৫(২৫ক্যাব সংখ্যক একটি অফিসআদেশ জারি করে। আমার স্বাক্ষরে এই আদেশ মি.এ. হান্নান চৌধুরীর নিকট প্রেরিত হয়। এই আদেশে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল থেকে আনীত সম্পদ ও অর্থের পরিমাণ তদন্ত করে দেখার জন্য একটি কমিশন নিয়ােগ করার কথা উল্লেখ করা হয়। কমিশনে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন:
১. মি. এ. হান্নান চৌধুরী – চেয়ারম্যান ২. মি. জে. জি. ভৌমিক – সদস্য ৩. মি. বড়য়া- সদস্য-সচিব।
কমিশনের দায়-দায়িত্ব ও কাজের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ঐ আদেশ যত শীঘ্র সম্ভব কমিশনকে প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৩৬ দ্রষ্টব্য)।
…………………………
* বিচারপতি চৌধুরী মানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যিনি তখন লন্ডনে বসবাস করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচিছলেন।
…………………………

২১/৮/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সচিব হিসেবে আমার অফিস থেকে ১৬/৮/১৯৭১ তারিখে প্রেরিত ২১(৬) ক্যাব সংখ্যক স্মারকের উপর প্রধানমন্ত্রীর আদেশ সম্বন্ধে সকল সচিবকে অবহিতকরণ ও তাদের প্রয়ােজনীয় দিক-নির্দেশনা লাভের জন্য ২১/৮/১৯৭১ তারিখের ৩১(৬) ক্যাব সংখ্যক স্মারক প্রেরণ করা হয়।

২৩/৮/১৯৭১
আলােচ্যসূচিতে যাওয়ার পূর্বে মন্ত্রিসভার কমান্ডার-ইন-চিফকে মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে প্রতিবেদন প্রদানের আহ্বান জানালে তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন (পরিশিষ্ট ৩৭ দ্রষ্টব্য):
ক. মুক্তিবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে কিছু উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। হতাহতের আনুপাতিক হার ৬: ১০০। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, চালনা ও সুনামগঞ্জে আমাদের বাহিনী কয়েকটি হামলায় শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বােঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রচালিত লঞ্চ এবং বার্জ আমাদের বাহিনী দখল করে নিয়েছে। কমান্ডার ইন চিফের মতে এসব সাফল্য উৎসাহজনক হলেও আমাদের প্রত্যাশা আরাে বেশি। মুক্তিবাহিনী আরাে ভালাে করবে বলে সি-ইন-সি তাঁর মনােভাব ব্যক্ত করেন।
২. আমাদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভারের পতি সি-ইন-সি উপস্থিত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক শৈথিল্যের জন্য শত্রুরা বহু মূল্যবান দলিলপত্র বিনষ্ট করে ফেলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ অসুবিধা থেকে পরিত্রাণের জন্য বর্তমান ভবনকে অবিলম্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তর করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। বলা হয় যে বেসামরিক সচিবালয় একটি নতুন ভবনে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গ. যুবশিবির ও মুক্তিবাহিনীর সমস্যা সম্বন্ধে আলােচনা হয়। আলােচনায় বলা হয় যে, যেসব কর্মকর্তাকে অনুপ্রেরণা প্রদান ও নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না। এতে শিবিরগুলিতে অনিবার্যভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
ঘ. যুক্তরাজ্যে সংগৃহীত অর্থ অপব্যবহার সম্বন্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হয়। বলা হয় যে, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালি বিশেষত সিলেটিদের সমর্থন নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করা হচ্ছে। শত্রুদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতি-ব্যবস্থা (counter-measures)
গ্রহণের জন্য মন্ত্রিসভাকে অনুরােধ জানানাে হয়।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সূচনা-বক্তব্য এবং সি-এই-সি.-র প্রতিবেদন পেশের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সি-ইন-সি অন্যত্র জরুরি কাজে প্রস্থান করেন। তারা উভয়ে ফিরে আসার পর সভার কাজ পুনরায় আরম্ভ হয়। উক্ত সভায় আরাে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় মুক্তিবাহিনীর অসুবিধা সম্বন্ধে কথা হয়। যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কিত প্রতিবেদন, অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম এবং অন্যান্য অসুবিধার প্রতি মন্ত্রিসভার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
সভায় এই অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার (Host govt.) কিছু অসুবিধার কারণে তাদের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পৌছাতে পারেননি। যেভাবে নির্দেশাবলি উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছার কথা সেভাবে তা

পৃষ্ঠা: ৯০
যাচ্ছে না। বন্ধু-সরকারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধে মন্ত্রিসভা অবহিত আছেন এবং বন্ধুসরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যথােপযুক্ত পর্যায়ে এসব সমস্যা নিয়ে আলােচনা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এই সভায় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন প্রয়ােজনীয়তার কথাও উপস্থাপন করা হয়।
মন্ত্রিসভার ২৫ আগষ্ট ১৯৭১ সালে যে-সভা অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সভায় বিভিন্ন সিন্ধান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার এবং জয় বাংলা পত্রিকা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ অর্থ, পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিবর্গ এবং প্রতিরক্ষা-সচিব। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত অধ্যাপক খােরশেদ আলম এম.এন. এ সভায় বিবেচনার জন্য তার প্রতিবেদন পেশ করেন। তথ্য ও বেতার কমিটির আহ্বায়ক এ.মান্নান এম.এন.এ আর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
উভয় প্রতিবেদন সম্পর্কে এবং আরাে অন্যান্য বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।

সিদ্ধান্ত
ক. নবগঠিত বিভাগ/অধিদপ্তরের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে ১১,৬৮৮/৫৩ রুপি বরাদ্দের জন্য সাধারণ প্রশাসন বিভাগের (G.A.Deptt.) সুপারিশ অনুমােদিত হলাে।
খ. নবসৃষ্ট ৪টি অঞ্চলের (zones) দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে আনুমানিক হিসাব ২৮,৪০০/০০ রুপির বাজেট অনুমােদন করা হলাে।
গ. বাংলাদেশেরে জনগণের ভালােবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে কবি নজরুল ইসলামকে মাসিক ৩৫০/০০ রুপি ভাতা মঞ্জুর করা হলাে। কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শয্যাশায়ী কবিকে প্রথম মাসের ভাতা ব্যক্তিগতভাবে পৌছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপরে বর্ণিত সিদ্ধান্তগুলির দুইটি ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয় ছিল। প্রথমত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা প্রশ্নে সরকারের তথা সমগ্র বাঙালি জাতির গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত বাঙালি জাতির গৌরব জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানাে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে এবং নজরুলের গানে-কবিতায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আমাদের সাথে প্রায়ই আলােচনা করতেন প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি তখনও ব্যাপক প্রচলিত হয়নি। শহীদ তাজউদ্দীন তাঁকে ডাকতেন মুজিব ভাই বলে। সরকারি বা আনুষ্ঠানিক সভায় শেখ সাহেব। মে মাসেই সরকার নিশ্চিত হন যে তিনি পাকিস্তানি কারাগারে। এই সময় তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পায়। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন যাতে ভারত-সরকার নিজে এবং অন্যান্য সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর এ-বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেন।

২৩/৮/১৯৭১
সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। নিম্নলিখিত সচিববৃন্দ উপস্থিত ছিলেন:
সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়
সচিব, সাধারণ প্রশাসন
সচিব, মন্ত্রিসভার বিভাগ
সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বিগত কয়েক সপ্তাহের প্রতিবেদন পেশ করেন এবং আলােচনা শেষে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৩৮ দ্রষ্টব্য)।

২৩/৮/১৯৭১
২০ জুলাই তারিখের আমার অফিসের অফিস-আদেশের কথা উল্লেখ করে পূর্ব-অঞ্চলের আয়-ব্যয় ও হিসাব সংক্রান্ত বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ২৩/৮/৭১ তারিখের ৩৮(৩)/ক্যাব সংখ্যক পত্র অর্থমন্ত্রী মহােদয়, অর্থসচিব ও প্রতিরক্ষা সচিবের নিকট প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৩৯ দ্রষ্টব্য)।
ব্যয়ের কিছু নীতিমালা এবং বিভিন্ন সেক্টরের আনুমনিক ব্যয়ের হিসাব (budget) সম্বন্ধে পত্রে উল্লেখ করেছিলাম। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ২৮/৭/৭১ তারিখে আমি পূর্বঅঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে এবং ২৩/৮/৭১ তারিখে মন্ত্রিসভার-সচিব হিসেবে মন্ত্রিসভার বিভাগে যােগদানের পূর্বের অফিস-আদেশের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে এই পত্র প্রেরণ করেছিলাম।

২৪/৮/৭১
মন্ত্রিসভার মুলতবি সভায় পররাষ্ট্র-সচিব জুলাই ও আগস্ট ১৯৭১ মাসের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে শান্তি ও সহযােগিতার জন্য ভারত-রাশিয়া চুক্তির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র-বিষয়ক আরাে বহু বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়। বাংলাদেশ বাহিনী এবং যুবশিবিরের জন্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিষয়ও আলােচনায় স্থান পায়। (পরিশিষ্ট ৪০ দ্রষ্টব্য)।

২৫/৮/৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার মুলতবি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রতিরক্ষা-সচিবও এতে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত অধ্যাপক খােরশেদ আলম এম.এন. এ ঢাকা জেলার শিবপুর, মনােহরি, রায়পুরা ইত্যাদি স্থানের কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার বর্ণনা দেন। মুক্তিবাহিনীর নামে পরিচালিত কিছু লােকের অপতৎপরতা কীভাবে মােকাবিলা করা যায়, সে-সম্বন্ধে আলােচনা হয়। অন্যান্য আরাে বিষয়ে আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (পরিশিষ্ট ৪১ দ্রষ্টব্য):
১. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ নবসৃষ্ট বিভাগ/অধিদপ্তরের উপনিমিত্ত (contingent) ব্যয় মেটানাের জন্য ১১,৬৮৮/৩৩ রুপি বরাদ্দের প্রস্তাব অনুমােদিত হয়।
২. চারটি নতুন অঞ্চলের (zones) জন্য প্রণীত ২৮,৪০০/= রুপির বাজেট অনুমােদিত হয়।
৩. বাংলাদেশের জনগণের ভালােবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্য প্রতি মাসে ৩৫০/= রুপি ভাতা মঞ্জুর করা হয়।

২৮/৮/৭১
কমান্ডার ইন চিফ কর্তৃক পেশকৃত বীরত্ব খেতাব প্রদান স্কিম অনুমােদন সংক্রান্ত একটি চিঠি ২৮-৮-১৯৭১ তারিখের ৫৪৪/ক্যাব সংখ্যক স্মারকে প্রতিরক্ষা সচিবের নিকটও প্রেরিত হয় (পরিশিষ্ট ৪২ দ্রষ্টব্য)।

১/১৯/১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আলােচনার জন্য সভায় একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। মি.ডি.পি. ধরের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্যগণের আলােচনা অনুমােদন ছাড়াও অর্থ-সচিব ও বাণিজ্য-বাের্ডের চেয়ারম্যান আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে ভারতের স্টেট ট্রেনিং করপােরেশনের সঙ্গে আলােচনাক্রমে অনতিবিলম্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্ল্যানিং সেলের পুনঃনামকরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদকে প্ল্যানিং বাের্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে কোনাে ঘােষণা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। [তাঁর পরিবারের আটকে পড়া সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঐরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল— লেখক] (পরিশিষ্ট ৪৩ দ্রষ্টব্য)।

৪/৯/১৯৭১
স্মারক-সংখ্যাবিহীন প্রধানমন্ত্রীর ৪ সেপ্টেম্বরের দুইটি আদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হিসেবে আমি ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের সংখ্যাবিহীন স্মারকে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরণ করি। একটি আদেশে মি. আবদুল খালেককে স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব পদে নিয়ােগ দান করা হয় এবং অপর আদেশে তাকে ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করতে বলা হয় (পরিশিষ্ট ৪৪ দ্রষ্টব্য)।

৬/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সরকারর শিক্ষা-উপদেষ্টা হিসেবে ড.এ.আর. মল্লিককে নিযুক্তি দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সাবেক পাকিস্তান সার্ভিস-কে এখন থেকে বাংলাদেশ সার্ভিসনামে অভিহিত করা হবে। পুলিশ অফিসারদের ব্যাজ ইত্যাদিতে চাঁদ-তারার পরিবর্তে নৌকা প্রতীক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এজন্য নতুন ডিজাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (পরিশিষ্ট ৪৫ দ্রষ্টব্য)।

৭/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠেয় সভার চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব আলম, প্রতিরক্ষা-সচিব এ. সামাদ এবং ওএসডি আনােয়ারুল করিম চৌধুরীকে দেওয়া হয়। সভার আলােচ্যসূচি ছিল পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা বিষয়ক, বিদেশ প্রত্যাগত প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদন ও মুক্তিবাহিনীর কল্যাণ বিষয়ক। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অফিসকক্ষে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সভা অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৪৬ দ্রষ্টব্য)।

১০/৯/১৯৭১ ও ১১/৯/১৯৭১
এই দুই দিনের মন্ত্রিসভা-সভায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মি. আবদুস সামাদ আজাদের মৌখিক প্রতিবেদন সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ধৈর্যের সঙ্গে শােনেন। বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রশাসন-ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয় আলােচিত হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মন্ত্রিপরিষদ-সচিব সাধারণ প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে আলােচনাপূর্বক এই সম্পকে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করে বিবেচনার জন্য পরবর্তী সভায় পেশ করবেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদানের জন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য পররাষ্ট্র সচিব কয়েক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করলে মন্ত্রিসভা তা বিবেচনা করে। (পরিশিষ্ট ৪৭ দ্রষ্টব্য)।

১৩/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় বাংলাদেশের পাট বাজারজাত করার বিষয়ে বাের্ড অব ট্রেডের চেয়ারম্যান পূর্বে-প্রণীত একটি পরিকল্পনার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। মন্ত্রিসভা অর্থ-মন্ত্রণালয়ের পেশকৃত পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক দেখে কিছু কিছু বিষয়ে মন্তব্য দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রীকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় একই সভায় আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলােচনা হয়। বিশেষ আমন্ত্রণে উত্তর পূর্ব অঞ্চল-১-এর দেওয়ান ফরিদ গাজী এম.এন.এ এবং মতিউর রহমান এম.এন.এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অঞ্চলের জন্য ৫০০০/=রুপি বরাদ্দ করা ছাড়াও অভ্যর্থনা শিবিরে কর্মরত কর্মকর্তাগণকে বাছাই করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুবশিবিরের বাের্ড অব কন্ট্রোলের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সভায় আঞ্চলিক পরিষদে ভাইস-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টির কথা ওঠে। (পরিশিষ্ট ৪৮ দ্রষ্টব্য)।

১৪/৯/১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২৩ আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত আন্তসচিব সভার সিদ্ধান্তে সপ্তাহান্তে সরকারের প্রত্যেক বিভাগকে প্রতিবেদন প্রদান এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষে প্রতি সােমবার সকাল ৯টায় সভা অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানানাে হয়।

২০/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ক. দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-১ এর সদর দপ্তর সাবরুম থেকে উদয়পুরে স্থানান্তর করা হবে;
খ. বিদ্যমান পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চল ভেঙে পশ্চিম অঞ্চল-১ এবং পশ্চিম অঞ্চল-২ নামে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-১ ও দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল ২ নামে পুনর্গঠিত হবে।
বর্তমানে গঠিত অঞ্চলগুলি নিম্নরূপ হবে:
১. পশ্চিম-অঞ্চল-১: দিনাজপুর, বগুড়া (বালুরঘাটে সদর দপ্তর)
২. পশ্চি-অঞ্চল-২ : রাজশাহী (মালদহে সদর দফতর)
৩. দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-১: পাবনা ও কুষ্টিয়া (কৃষ্ণনগরে সদর দপ্তর)
৪. দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-২: যশাের ও ফরিদপুর (বনগাঁয়ে সদর দপ্তর)
এছাড়া মন্ত্রিসভার সভায় ২ম শ্রেণী ২য় শ্রেণীর পদে নিয়ােগ সরকারের অনুমােদিত সাংগঠনিক কাঠামাে অনুযায়ী করার বিষয়ে পুনর্বার নিশ্চিত করা হয়। প্রতিরক্ষা সচিব এ. সামাদকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব-প্রতিরক্ষা-সচিবকে সময়-সময় তাকে সহযােগিতা করবেন মর্মে মন্ত্রিসভার সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয় (পরিশিষ্ট ৪৯ দ্রষ্টব্য)।

১/১০/১৯৭১
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্বেই মন্ত্রিসভা সদস্যগণের নিকট সারসংক্ষেপ বিতরণ করেছিলেন। সভায় তিনি একটি বিবৃতি উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে সামান্য আলােচনার পর নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
ক. পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বিবৃতির খসড়া মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে ২রা অক্টোবর সকালের মধ্যে বিতরণ করবেন।
খ. মন্ত্রিসভা ২রা অক্টোবর সাড়ে ৬টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বাসায় মিলিত হয়ে উক্ত খসড়া সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে।
এর আগে মি. রফিকুদ্দিন ভূইয়া এম.এন.এ.-র বক্তব্য সদস্যগণ শােনেন। যুদ্ধরত বাহিনীর জন্য উলের পােশাক, কম্বল, ওষুধ, পরিবহণ এবং খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে আলােকপাত করা হয় এ সম্বন্ধে মন্ত্রিসভা কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

৫/১০/১৯৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার সভায় অভিমত প্রকাশ করে বলেন যে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্যবর্গের কর্মসূচি সম্পর্কে আলােচনার জন্য সকল একান্ত-সচিবকে আহ্বান জানাবেন। প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কে প্রাথমিক আলােচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এ সম্বন্ধে আরাে যাচাই করা প্রয়ােজন। প্রতিরক্ষা সচিব কর্তৃক পেশকৃত বক্তব্য পর্যালােচনা করে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ জানানাে হয়। আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভা আপাতত কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। মন্ত্রিসভা মি.এ. আলমের পদত্যাগপত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত স্বাস্থ্যসচিব তাঁর দপ্তর সম্পর্কিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তাঁকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বলা হয়। উক্ত সভায় আহত মুক্তিযােদ্ধ, গেরিলা এবং শহীদ পরিবারের বিষয়ে আলােচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রী চা উৎপাদকদের সমস্যার বিষয় উত্থাপন করলে তাকে নির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদানের জন্য বলা হয়।

৭/১০/১৯৭১
আহত মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের পুনর্বাসন সম্পর্কিত বিষয়ে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাছাড়া, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের কার্যপ্রণালী সুনিয়ন্ত্রিত করার বিষয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ও.এস.ডি. মি. আনােয়ারুল হক খানকে এই দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৫০ দ্রষ্টব্য)।

২০/১০/১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এই প্রতিবেদনে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ

পৃষ্ঠা: ৯৫
সম্বন্ধে সংক্ষেপে তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার চিত্র এই প্রতিবেদনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিস্ময়করভাবে আমরা হাতে-গােনা কিছু মানুষ (নেতা-কর্মী, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সাবেক পূর্ববাংলার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, কৃষক-শ্রমিক নেতা-কর্মী প্রমুখ)। প্রতিবেদনে উল্লিখিত কাজ সম্পন্ন করেছিলাম। ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মি.ডি.পি. ধর এবং প্ল্যানিং কমিশনের ড.এস. চক্রবর্তীর সাথে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্ল্যানিং কমিশনের বহু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সহযােগিতা ও পারস্পরিক সাহায্য প্রদান সম্বন্ধেও তাঁদের সঙ্গে আমাদের আলােচনা হয়। (পরিশিষ্ট ৫১ দ্রষ্টব্য)।

২৩/১০/১৯৭১
উপজাতীয় যেসব কর্মচারী আমার সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন আমাদের যুদ্ধ বিষয়ক কাজে তাদের সেবা প্রতিরক্ষা-সচিবের প্রয়ােজন হলে আমরা তাদের নিযুক্ত করতে পারি মর্মে আমার দপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৫২ দ্রষ্টব্য)।

৩০/১০/১৯৭১
এদিনের সভায় বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুদ্ধরত সৈনিকদের ভাতা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বিশেষ উল্লেখযােগ্য। নভেম্বর ‘৭১ মাস থেকে উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সিদ্ধান্তের কপি প্রতিরক্ষা সচিবের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৫৩ দ্রষ্টব্য)।

১/১১/১৯৭১
মন্ত্রিসভার এই সভায় ৭টি বিষয়ে আলােচনা হয়। এসবই ছিল নীতিনির্ধারণী বিষয়ক। আলােচনায় প্রশাসনিক সাংগঠনিক কাঠামাে, আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মচারী নিয়ােগ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ-দের যাতায়াত ও মহার্ঘ ভাতা (T.A. &D.A.), কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা ও সুপারিশ গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৫৪ দ্রষ্টব্য)।

৮/১১/১৯৭১
আমার বিভাগের ২৯-১০-১৯৭১ তারিখের ইউ.ও.২৮৬ সংখ্যক পত্র মারফত বাংলাদেশ সরকার ও মন্ত্রিসভার ব্যবহারের জন্য যানবাহন সংগ্রহ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর অবগতির জন্য প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৫৫ দ্রষ্টব্য)।

১১/১১/১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলসমূহের বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্য ছাড়াও, মন্ত্রিপরিষদ-সচিবও সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে সি.ইন.সি. মি. ফতেহ, প্রতিরক্ষা-সচিব সভায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সমস্যাবলি নিয়ে আলােচনা হয়। (পরিশিষ্ট ৫৬ দ্রষ্টব্য)।

১৪/১১/১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অর্থসচিব মি.কে.এ. জামানকে লিখিত পত্রে ১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের বাজেট সম্পর্কে জানানাে হয়। পত্রে বলা হয় যে, ১৫ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিসভার সভায় আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্বে যে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে তা হলাে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ এজেন্সির অর্থ বরাদ্দের সঠিক প্রতিফলন যেন বাজেটে থাকে। (পরিশিষ্ট ৫৭ দ্রষ্টব্য)।

২২/১১/১৯৭১
অক্টোবর ‘৭১ থেকে ৩১ ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ের বাজেট বিষয়ে মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনা হয়। সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিশেষ আমন্ত্রণে সি.ইন.সি, মি. ফতেহ ও প্রতিরক্ষা-সচিবও সভায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আলােচনা হয়। কতিপয় মন্তব্যসহ বাজেট অনুমােদিত হয়। তবে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কয়েকটি সমস্যার কথা আলােচনায় আসে।সমস্যা পরীক্ষা করে দেখে রিপাের্ট দেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত উপ-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
সচিব, প্রতিরক্ষা
সচিব, স্বরাষ্ট্র
সচিব, মন্ত্রিপরিষদ
সচিব, অর্থ
সচিব, সাধারণ বিভাগ
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সি-ইন-সি, প্ল্যানিং বাের্ডকেও উপ-কমিটির সঙ্গে যুক্ত করা হবে।

২৪/১১/১৯৭১
২২ নভেম্বর তারিখের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ নভেম্বর বিকেল ৪.০০টায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠানের বিষয় জানিয়ে পত্র লেখা হয়। (পরিশিষ্ট ৫৮ দ্রষ্টব্য)।

৩০/১১/১৯৭১ বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২-১২-৭১ তারিখে ৪১৫ (২)/ক্যাব সংখ্যক অতি গােপনীয় পত্র মারফত প্রতিরক্ষ-সচিব ও সাধারণ প্রশাসন সচিবকে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরসমূহ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরােধ জানায়। (পরিশিষ্ট ৫৯ দ্রষ্টব্য)।
প্রায় একই সময় মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সভায় কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে (৫)/ক্যাব সংখ্যক স্মারক সংশ্লিষ্ট সকল সদস্যের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬০ দ্রষ্টব্য)।

১/১২/১৯৭১
মুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে সম্পর্কে সচিব-উপ কমিটিতে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যপত্র তৈরির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট ৪১৩ (৬)/ক্যাব সংখ্যক স্মারক মারফত জানানাে হয়। (পরিশিষ্ট ৬১ দ্রষ্টব্য)।

৬/১২/১৯৭১
মি. রুহুল কুদ্সকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী মহাসচিব নিয়ােগ সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরিত হয়। সাধারণ প্রশাসনের সচিবকে অস্থায়ী মহাসচিবএর অফিস-কক্ষ ও তার সহকারী নিয়ােগের ব্যবস্থা করতে ৭ ডিসেম্বর তারিখে অনুরােধ জানানাে হয়। (পরিশিষ্ট ৬২ দ্রষ্টব্য)।

১০/১২/১৯৭১
ভারত এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে পরিচালিত সরকারের তহবিলের নাম পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা হয়। (পরিশিষ্ট ৬৩ দ্রষ্টব্য)।

১১/১২/১৯৭১
দখলীকৃত বাংলাদেশে কর্মরত সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা প্রচারের জন্য তথ্যসচিবকে ১১ ডিসেম্বর তারিখে লিখিত ৪৪৬/ক্যাব সংখ্যক স্মারক প্রণিধানযােগ্য। এই চিঠির কপি অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক, সচিব কমিটির চেয়ারম্যান, পুলিশ মহাপরিদর্শক, অর্থসচিব, সাধারণ প্রশাসন বিভাগ সচিবের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬৪ দ্রষ্টব্য)।

১৫/১২/১৯৭১
১৩ ডিসেম্বর তারিখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তা নিয়ােগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (পরিশিষ্ট ৬৫ দ্রষ্টব্য)। এ ছাড়া দালালদের বিচার ও সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের আনুগত্য যাচাই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ১৫ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬৬ দ্রষ্টব্য।)

১৬/১২/১৯৭১
প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থ সচিববৃন্দকে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে লেখা ৪৬৯(৫)/ক্যাব সংখ্যক স্মারকে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভা-সভার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় (পরিশিষ্ট ৬৭ দ্রষ্টব্য)। ১৮ ডিসেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলােচ্যসূচিতে গণবাহিনীর সদস্যগণকে জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তকরণ ও সরকারি কর্মচারীদের পুনঃদায়িত্ব বণ্টন প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানিয়ে ১৬-১২-৭১ তারিখে ৪৭২(৩)/ক্যাব সংখ্যক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রিসভা ১০ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। (পরিশিষ্ট ৬৮ দ্রষ্টব্য)।

সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক যে বিভাগ প্রথম কার্যক্রম শুরু করে তা হলাে সাধারণ প্রশাসন বা General Administration (GA)Department। এই নামকরণটি হয়েছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের Services and General Administration Department (S &GAD) এর অনুকরণে। কাজের সুবিধার জন্য এটি আর পরিবর্তন করা হয়নি তবে এটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুরূপ আরেকটি বিভাগই ছিল। এই বিভাগের সচিব ছিলেন নূরুল কাদের।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিবর্গের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যে কয়জন বাঙালি মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন নূরুল কাদের তাদের অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের আরম্ভ থেকেই নূরুল কাদের তার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের সাথে সাথে আমার মতাে যেসব বাঙালি জেলাপ্রশাসক ও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা, বিশেষ করে সাবেক সি.এস.পি., ই.পি.সি.এস. এবং পুলিশ সার্ভিসের সদস্য রুখে দাঁড়ান, নূরুল কাদের ছিলেন তাঁদের অন্যতম। দীর্ঘ ২ সপ্তাহের মতাে সময় শত্রুকে প্রতিহত করার পর তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ১৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর দপ্তর কৃষ্ণনগরে পৌঁছান। সেখানে তখন ছিলেন মাগুরার এস.ডি.ও. ওয়ালিউল ইসলাম এবং আরও কতিপয় কর্মকর্তা।
মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২ এপ্রিল তারিখে যে বৈঠকে মিলিত হন তার অন্যতম আলােচ্য বিষয় ছিল সরকারের দপ্তর স্থাপন। কবে, কখন, কীভাবে এই প্রশাসনিক দপ্তর কাজ শুরু করবে এটি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বড় একটা চিন্তার কারণ ছিল। তখনও তিনি পরিষ্কারভাবে জানতেন না, কোন কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যাবে, কে বা কারা তাকে সরকারের প্রশাসনিক যন্ত্র সংগঠনে সাহায্য করবেন। নীতিগতভাবে ঐদিনই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সাধারণ সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং বেসামরিক কর্মকতাদের সংগঠিত করে সচিবালয় চালু করা হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই বিভাগগুলির দায়িত্বে থাকবেন এটাও স্থির করা হয়। ঐ দুঃসময়ে ন্যূনতম কত ভাতা প্রদান করলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনধারণ করতে পারবেন সেটাও আলােচিত হয়।
১৮ এপ্রিল তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয়। সভায় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করে প্রধানমন্ত্রী সংস্থাপন ও সাধারণ প্রশাসন নিজের অধীনে রাখেন। সরকারি কোষাগারের তৎকালীন অবস্থা বিচার করে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতনের হার নির্ধারিত হয়:
ক. চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী: পূর্ণ বেতন।
খ. দ্বিতীয় শ্রেণী ২০% কম, কিন্তু প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৪০০/- রুপি।
গ. প্রথম শ্রেণী ২৫% কম, কিন্তু প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫০০/- রুপি।
থিয়েটার বাের্ডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) যে বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, সেটিই আপাতত সরকারের প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়। বন্ধুবর নূরুল কাদেরকে এই দপ্তর স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নূরুর কাদের ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিযুক্ত প্রথম সচিব। ঐ কঠিন দায়িত্ব সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন নূরুল কাদের। সেদিন তার সহযােদ্ধা ছিলেন ওয়ালিউল ইসলাম (সি.এস.পি., মাগুরার এস.ডি.ও.), কামালউদ্দীন (ই.পি.সি.এস.এস.ডি.ও., নাটোর), মতিউর রহমান (ই.পি.সি.এস.), আবদুর রশিদ (ওয়াপদার তৎকালীন কর্মকর্তা) এবং আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। কোনাে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম-সচিবের বালাই ছিল না তখন। আমরা যারা সচিব নিযুক্ত হয়েছিলাম তাদের অধিকাংশের চাকুরির জ্যেষ্ঠতা সে সময় ১০ থেকে ১২ বছর। প্রবীণ যারা ছিলেন তারা কেউই প্রশাসনিক সার্ভিসের ছিলেন না। পরের দিকে অবশ্য ফরেন সার্ভিসের বেশ কয়েকজনকে সচিবের মর্যাদা দিয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়ােগ করা হয়।
সাধারণ প্রশাসন বা জি.এ.বিভাগে যাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল তাঁরা হলেন:
১. ওয়ালিউল ইসলাম, উপ-সচিব
২. কামালউদ্দীন আহমেদ, উপ-সচিব
৩. মতিউর রহমান, সহকারী সচিব
৪. দীপক কুমার চৌধুরী, সহকারী সচিব
৫. অজিত কুমার ভাদুড়ী, সহকারী সচিব
৬. নরেশচন্দ্র রায়, সহকারী সচিব
৭. মােহাম্মদ হেদায়েতউল্লাহ, সহকারী সচিব
৮. আল-আমীন চৌধুরী, সহকারী সচিব
৯. শাহ্ মতিউর রহমান, সহকারী সচিব
১০. ইঞ্জিনিয়ার কামাল সিদ্দিকী, ট্রান্সপাের্ট অফিসার
১১. আবদুর রশিদ, প্রশাসনিক অধকর্তা
উপরের ক্রমিক নম্বর ৩, ৪, ৬ এবং ৮-এর কর্মকর্তারা ছিলেন প্রাক্তন ই.পি.সি.এস.। অজিত কুমার ছিলেন পুলিশের এবং আল আমীন তৎকালীন পাকিস্তান অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের। আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে কামালউদ্দীন, ওয়ালিউল ইসলাম, মতিউর রহমান আর রশিদের কথা। এঁরা সকলেই অত্যন্ত তৎপর ছিলেন এবং প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। রশিদ ছিলেন ওয়াপদার কর্মচারী। তাকে দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তার (Administrative Officer) দায়িত্ব। মূলত তার কাজ ছিল বাড়িঘর, জিনিসপত্র এবং প্রয়ােজনে জনবল সরবরাহ করা। সারাক্ষণ দৌড়ের উপরেই থাকতেন। ইঞ্জিনিয়ার কামাল সিদ্দিকীকে আমরা ডাকতাম কমল বলে। তার দায়িত্বের নাম যাই থাকুক, কাজ করতেন চারদিকেই।
সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ মিশনে (ইতিপূর্বে পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিসে) আমাদের একজন প্রটোকল অফিসার বসতেন; তিনি ছিলেন সাধারণ প্রশাসনের কর্মকর্তা। তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আসা সমস্ত সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীকে অভ্যর্থনা করা। যারা সরকারের কাজ করতে চাইতেন তাঁদের প্রত্যেককে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করে শপথ-নামা দস্তখত করতে হতাে। একই সাথে তাদের সত্যিকারের পরিচয়, কোথায় কাজ করতেন, কী ধরনের কাজ করতেন ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ দাখিল করতে হতাে। এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি খুব কঠিন ছিল। কাজটি যিনি করতেন তিনি একজন ই.পি.সি.এস. কর্মকর্তা। নাম মনে নেই।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। যুদ্ধরত একটি বিপ্লবী প্রবাসী সরকারের কাজের কোনাে নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। প্রধানতম দায়িত্ব ছিল যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং সে যুদ্ধে সফলতা অর্জনের জন্য যা যা করা প্রয়ােজন সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য ঐ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে আইন ছিল একটি: স্বাধীনতার ঘােষণাআর আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষা আদেশ (Proclamation of Independence এবং Laws Continuance Enforcement Order 1971)। আইনের ধারাবাহিকতা আদেশ দিলেই তাে হলাে না, কোন কোন আইন বলবৎ থাকবে, কোনটি সংশােধন করতে হবে, কোনটি আমূল পরিবর্তন প্রয়ােজন এসব তাে আমরা জানতাম না। আইনের বই দেখার সময় তখন কোথায়? বিশেষ করে সরকারি কার্যবিধি বলতে তাে কিছু ছিল না, যা আমরা অনুসরণ করতে পারি।
স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের সংবিধানে বর্ণিত উপায় ও পন্থায় সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হয়। সেখানে সাধারণত বলা থাকে যে, এই বিষয়ে সরকার বিধি (Rules) প্রণয়ন করবে এবং সেই সব রুলস অনুসরণ করে সরকার পরিচালিত হবে। এক বলা হয় কার্যপ্রণালী বিধি বা (Rules of Business)। এই কার্যপ্রণালী বিধিতে দুটো ভাগ থাকে: