তীব্রভাবে গণ-সংযোগ অভিযান অব্যাহত রাখতে থাকেন। শেখ মুজিব যেখানেই সভাসমিতি অনুষ্ঠান উপলক্ষে গমন করেন সেখানেই বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন। এইভাবে জনগণ পাকিস্তানী শাসকচক্রের এবং তাদের এজেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্ট মিথ্যা শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বুঝে উঠতে থাকে। যেকোন ধরনের ‘শাসনতন্ত্র’ হোক না কেন—তা’ যে কেবল নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিরাই তৈরী করতে পারেন—এ কথা জনগণ ক্রমে উপলবিদ্ধ করল।
৬-দফা ভিত্তিক নির্বাচনী অভিযান ও জনগণের প্রতিক্রিয়া
সেই সংগে শেখ মুজিব বাংলাদেশের বাঁচার প্রশ্নে ৬-দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্য ম্যাণ্ডেট হিসেবে কেন এ নির্বাচনকে নিয়েছেন তাও জনগণ উপলদ্ধি করতে পারছিল। এ সবের ফলেই পত্র-পত্রিকা মারফত উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক প্রমুখ সকল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ৬-দফার পক্ষে যেমন মতামত রাখছিলেন, তেমনি প্রাক্তন মুসলিম লীগ ভাসানী ন্যাপ ও ওয়ালী ন্যাপের বহু রাজনৈতিক কর্মী ও নেতারা আওয়ামী লীগে যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করছিলেন। এদের মধ্যে ডঃ কামাল হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য। জনসাধারণের মনোভাব সম্পর্কে ১লা মে তারিখে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে জনৈক ভাষ্যকার লেখেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানে গণ-জাগরণ দেখা দিয়েছে। সবাই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। নিজেদের সত্যিকার প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে যাতে দেশের পর্বত প্রমাণ আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা হয় এবং দেশের সব অংশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই ব্যাপারে তাঁরা ঐক্যমতে পৌঁছার চেষ্টা করছেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১লা মে, ১৯৭০]
নির্বাচনে কায়েমী স্বার্থবাদীদের নতুন স্ট্রাটেজী
এই সমস্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ট দলগুলোও শেখ মুজিব এবং ৬-দফার বিরুদ্ধে নতুন করে প্রচারণা চালাতে শুরু করে। তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একই নিবন্ধে ভাষ্যকার বলেছেন, “……পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থের ধারক-বাহক রাজনৈতিক দলগুলো এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পদলেহনকারী দলটি নতুন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৩
স্ট্রাটেজী নিয়ে মাঠে নেমেছে। আইয়ুব খান বাঙালী স্বার্থের রক্ষাকবচ ছয়-দফার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলেন অস্ত্রের ভাষা, আর ঐ কোটারী মহলটি বাঙালী স্বার্থের বিপক্ষে ব্যবহার করছেন পাকিস্তান ও ইসলাম ধ্বংসের কাল্পনিক অভিযোগ। এই দলের ক্ষুদ্রকায় মৌলভী ফরিদ আহমদ থেকে শুরু ক’রে বিশালদেহী কাইয়ুম খান ও ফজলুল কাদের চৌধুরী পর্যন্ত যা যা বলেন তাতে মনে হয় যে, দেশে দুটোই সমস্যা আছে, এক পাকিস্তানকে রক্ষা করা, দুই ইসলামকে রক্ষা করা।”
উপরিউক্ত নিবন্ধের সমর্থনে আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া হ’লঃ “পশ্চিম পাকিস্তান পি. ডি. পি. প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান বলেন যে, আগামী সাধারণ নির্বাচন আদর্শের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে। এদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে, না ইসলাম বিরোধী একনায়কত্ববাদী শক্তি কায়েম হবে আগামী নির্বাচনে জনগণকে তাই সাব্যস্ত করতে হবে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১২ই মে, ১৯৭০]
পাকিস্তানী শাসক-শোষকগোষ্ঠীর এজেন্ট দলগুলোর মনোভাব মূলতঃ একই খাতে প্রবাহিত। আজ নয়, বিগত দুটো দশক যাবত। এবারেও কোন ব্যতিক্রম ঘটে নি।
কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রচারণার জবাবে শেখ মুজিব
এই সব প্রচারণার জবাবে ১০ই মে, ’৭০ তারিখে ঢাকা শহরে জিন্দাবাহার, পুরানা মোগলটুলী, সিদ্দিক বাজার, দেওয়ান বাজার ও নবাবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে বংশাল স্কোয়ারে আয়োজিত কর্মী-জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বৃটিশ সরকারের দুইশত বছর এবং বিগত বাইশ বছরের বাঙালী নির্যাতনের ইতিহাস বর্ণনা করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই শোষণ ও বঞ্চনার অবসান এবং বাংলার মানুষকে অর্থনৈতিক দাসত্বের জিঞ্জির হইতে মুক্ত করার জন্যই আমার সংগ্রাম—তার জন্য প্রণীত হইয়াছে ছয়-দফা দাবী। তিনি বলেন, ৬-দফা দাবীতে পশ্চিম পাকিস্তানের কাহারও বিরুদ্ধে কিছু বলা হয় নাই-কাহারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করাও ইহার উদ্দেশ্য নয়। ছয়-দফার মূল বক্তব্য হইতেছে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে বাংলার সম্পদ বাঙালীরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৪
ভোগ করিবে। ব্যবসায়ের নামে লুটতরাজ ও শোষণ চলিবে না। এই কারণেই শোষক ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছে এবং ৬-দফার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাইবার জন্য ‘ভাড়াটিয়া আলেম ও সংহতি দরদীদের মাঠে নামাইয়া দেওয়া হইয়াছে। মওলানা মওদুদী, নসরুল্লাহ, কাইয়ুম খান প্রমুখের তীব্র সমালোচনা করিয়া শেখ সাহেব বলেন, বাংলার মানুষের দাবী-দাওয়া বানচালই তাহাদের উদ্দেশ্য। ‘সংহতি ও ইসলামের’ অর্থ কি বাংলার মানুষের কলিজা ছিড়িয়া খাওয়া?”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই মে, ১৯৭০]
এদিকে মওলানা ভাসানী সমর্থক ছাত্র সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো নির্বাচন বিরোধী বক্তব্য দিতেই থাকেন। ভাসানীর ন্যাপ দলীয় সংগঠনের এই সব বিভ্রান্তির সূত্রপাত আরম্ভ হয়েছিল ৭ই অক্টোবর, ১৯৬৯ সালে পাকশীতে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানে।
দলীয় কিছু কর্মী এই সভায় ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ এই শ্লোগান দিয়েছিল। এর পর অবশ্য মওলান ভাসানী এই বলে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, তিনি নির্বাচনের বিরুদ্ধে নন, বরং নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দাবী করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকে ভাসানী সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচন বিরোধী একাধিক উপদলের সৃষ্টি হয়। এরই ফলশ্রুতি স্বরূপ পরবর্তী কালে মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ও বিপ্লবী বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন এই দুই দলে বিভক্ত হয়। এঁরা নিজেদেরকে মাওসেতুং-এর অনুসারী বলে ঘোষণা করেন ও আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু (Dacca University Central Student’s Union = DACSU) নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তসহ দেশের সাধারণ নির্বাচন বয়কটেরও সিদ্ধান্ত নেন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই মে, ১৯৭০]
এই সময় ঢাকা ও খুলনায় নির্বাচন বিরোধী অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা ‘বোমাবাজী’ আরম্ভ করে। ৫ই মে (’৭০) তারিখে ঢাকার পাকিস্তান কাউন্সিলে একজন অজ্ঞাতনামা যুবক ‘মলোটভ ককটেল’ নিক্ষেপ করে।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই মে, ১৯৭০]
১০ই মে ১৯৬৯ তারিখে খুলনায় হাতবোমা বিস্ফোরণে দুইজন বালিকা আহত হয়।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই মে, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৫
এই দিনই ঢাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে এ্যাসিড-বালব নিক্ষিপ্ত হবার ফলে কয়েকজন আহত হয়।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই মে, ১৯৭০]
এই ভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে ৬টি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মারা যায়।
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১২ই মে, ১৯৭০]
শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি
এমনি উপায়ে নির্বাচন বিরোধীরা সন্ত্রাসবাদী কায়দায় নির্বাচন সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস পায়। এ সম্পর্কে ৮ই মে ১৯৭০ তারিখে ঢাকার এক জনসভায় শেখ মুজিব জনগণকে হুঁশিয়ার ক’রে দিয়ে বলেনঃ “বাংলার স্বায়ত্তশাসনসহ জনগণের দাবী-দাওয়া বানচালের উদ্দেশ্যে চারিদিকে যে ষড়যন্ত্র চলিতেছে, নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত এবং বোমা নিক্ষেপ এই ষড়যন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আরও বলেন, আমেরিকা, চীন বা রাশিয়ার আদর্শ নয়—এ দেশের মাটি হইতে উদ্ভূত আদর্শের পতাকা সমুন্নত রাখা এবং বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি দিয়া এই ষড়যন্ত্র রুখিয়া দাঁড়ানোই আজ দেশবাসীর সামগ্রিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই মে, ১৯৭০]
হতাশ রাজনীতিবিদদের শেখ মুজিব সম্পর্কে সংশয়
এ সময় জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত এদেশের হতাশ রাজনৈতিক নেতারা, যেমন আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ, সর্বত্র ৬-দফা ও শেখ মুজিবের সমালোচনা ক’রে তাঁকে সংগ্রামবিমুখ বলে হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ সম্পর্কে হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা দৈনিক পূর্বদেশ-এ লেখা হয়ঃ “অন্যদিকে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় ৫-দফা মূলনীতি মেনে নেবার পর ছয়-দফার প্রতিশ্রুতি যে ভুয়া প্রতিশ্রুতিরই নামান্তর হবে, সে কথা এমনকি আওয়ামী লীগের পুরনো কর্মীরাও উপলদ্ধি করতে পারছেন। … … একইভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে নির্বাচনের পূর্বেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি মীমাংসার পক্ষপাতী, সেখানে আওয়ামী লীগ এটিকেও নির্বাচনী ইস্যু
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৬
হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজেদের ক্ষমতার রাজনীতিকেই কার্যকরী করতে চেয়েছে। কিন্তু হালে পাঁচ-দফাকেও নির্বাচনী বৈতরণী পারের অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ ক’রে সম্ভবতঃ আওয়ামী লীগ সকল গোমর অবশেষে ফাঁস ক’রে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আওয়ামী লীগের মতো একটি বিপুল জনসমর্থিত রাজনৈতিক দলের এই কৌশল অবলম্বনের কারণ কি? দলীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের ব্যর্থতা।”
[ উপসম্পাদকীয়, দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ই মে, ১৯৭০]
এই বুদ্ধিজীবী নিবন্ধকার বাংলাদেশের হতাশ ও পরিত্যক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরই সহযাত্রী ছিলেন কিনা জানি না। কেননা বুদ্ধিজীবীদের নানান চেহারা, নানান ভঙ্গী। তা’ না হ’লে উক্ত লেখকের স্মরণ থাকা উচিত ছিল যে, ঊনসত্তর সালে গণ-আন্দোলনের পর আইয়ুবের গোলটেবিলে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ৬-দফা ও ১১-দফা দাবী নিয়ে শেখ মুজিব নিদারুণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। নেতৃত্বের ঐক্য নয়, ৬-দফা ও ১১-দফা আদায়ের জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধতার একমাত্র প্রয়োজন ছিল এ কথা এদেশীয় হতাশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষে যেমন, কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর পক্ষেও তেমনি উপলদ্ধি করা সম্ভব ছিল না।
শেখ মুজিবের ঘোষণাঃ ভোটের দ্বারা, না হয় সংগ্রামের মাধ্যমে
আবার ৬-দফার পক্ষে জনগণের ‘ম্যাণ্ডেট’ পেলেও ষড়যন্ত্র যে শেষ হবে না একথাও শেখ মুজিব ভালভাবেই বুঝেছিলেন। তাই শুধু হতাশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বা কিছুসংখ্যক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বুদ্ধিজীবীদের সংশয় দূর করার জন্যই শুধু নয়, বরং জনগণকে সজাগ করার জন্যই ঢাকা শহরের এক জনসমাবেশে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেনঃ
‘ভোটের দ্বারা করতে দেওয়া না হ’লে সংগ্রামের মাধ্যমে দাবী আদায় করবে। বঙ্গবন্ধু কঠোর ভাষায় বলেনঃ “দেশের সকল এলাকার শোষিত বঞ্চিত মানুষ আমার ভাই। আমি চাই সকলের জন্য ইনসাফ। তিনি বলেন যে, বল্গাহীন শোষণ ও বঞ্চনার ফলে বাংলার গণমানুষের হাড়মাংসে দাগ লাগিয়া গিয়াছে, আজ তারা সর্বশান্ত। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ক্ষমতায় যাই বা না যাই, বাংলার মানুষকে আর শোষণ করিতে দিব না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই মে, ১৯৭০)
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন ও ফলাফল
১৭ই মে (১৯৭০) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ছাত্রলীগ, ‘ডাকসু’ সহ ৮টি হলের মধ্যে ৬টিতে বিজয়ী হয়। আ. স. ম. আবদুর রব এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন যথাক্রমে ডাকসুর সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়িত তথা বাংলাদেশের ভাগ্য নির্মাণে এই নির্বাচনের ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে একদিকে তোফায়েল আহমদ ও নূরে আলম সিদ্দিকী অন্যদিকে আ. স. ম. আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং শাজাহান সিরাজ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, আমাদের ইতিহাসে তা’ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। এই নির্বাচনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা হয়েছিলঃ “আগামী অক্টোবরের ভাগ্য নির্ধারণী সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নে গতকাল অনুষ্ঠিত সংগ্রামী বাংলার গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল ছাত্র সংসদসমূহের নির্বাচনে বাংলার স্বাধিকার অর্জন সংগ্রামের অগ্রদূত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক বিপুল বিজয় সূচিত হইয়াছে। …. শোষিত বঞ্চিত বাঙালীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছাত্রলীগ ইতিপূর্বে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪২টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ১৩২টিতে জয়লাভ করিয়া বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে ছাত্রলীগের এই অবিস্মরণীয় বিজয় আসলে এই সংগ্রামী সংগঠনের সকল সংগ্রাম ও প্রেরণার উৎস বাংলার মাটি ও মানুষ এবং বাংলার স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামেরই বিজয়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ই মে, ১৯৭০]
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন
৪ঠা জুন তারিখে প্রতিশ্রুত নির্বাচনকে সামনে রেখে মতিঝিল ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউন্সিলরদের প্রতি নিজ দলের ভূমিকা বিশ্লেষণ ক’রে বলেন যে, দাবী আদায়ের জন্য যারা প্রাণ দিল তাদের রক্তের ডাক যেন কেউ ভুলে না যায়। ‘মন্ত্রী, এম. এন. এ. বা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৮
এম. পি. এ. হওয়ার খায়েশে যদি কেউ আওয়ামী লীগে থাকিয়া থাকেন, তবে এখনো সময় আছে, সসম্মানে তাঁহারা আওয়ামী লীগ ত্যাগ করিয়া অন্য দলে যোগ দিতে পারেন।’ এই অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও বিশিষ্ট কয়েকজন নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন।
জুনের ৬ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নয়া কর্মকর্তা নির্বাচিত করা হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ হলেনঃ
সহ-সভাপতিঃ কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ, মাষ্টার খান গুল ও জনাব বরকত আলী সালমী বার-এ্যাট-ল;
যুগ্ম সম্পাদকঃ জনাব মোহাম্মদ খান বহসানী ও জনাব মোহাম্মদ শামসুল হক;
সাংগঠনিক সম্পাদকঃ সৈয়দ খলিল আহমদ তিরমিজী;
প্রচার সম্পাদকঃ জনাব আবদুল মান্নান;
শ্রম সম্পাদকঃ মালিক ফররুখশিয়ার আওয়াল;
সমাজ সেবা ও সংস্কৃতি সম্পাদকঃ জনাব জি. মোস্তফা সারোয়ার;
দফতর সম্পাদকঃ জনাব শফিউল আলম;
কৃষি সম্পাদকঃ সৈয়দ এমদাদ মোহাম্মদ শাহ;
কোষাধ্যক্ষঃ অধ্যাপক হামিদুর রহমান এবং
মহিলা সম্পাদিকাঃ বেগম নূরজাহান মোর্শেদ।
এই অনুষ্ঠানে “একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদারী, জায়গীরদারী, সরদারীর বিলোপ সাধন করিয়া গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় সমুন্নত করার কল্যাণময় প্রতিশ্রুতি বিবৃত করিয়া নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচী ঘোষণা করে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই জুন, ১৯৭০]
উক্ত অধিবেশনে নবনির্বাচিত সভাপতি হিসেবে ভাষণদান প্রসঙ্গে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, “আমরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৮৯
মধ্য দিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত এবং শহীদের রক্তের মর্যাদা সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণ করিতেছি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই জুন, ১৯৭০]
পরদিন বিক্ষুদ্ধ ৭ই জুন, ঐতিহাসিক ৭ই জুন, মনু মিয়ার রক্তে রাঙানো শ্রমিকের দিন, মেহনতী মানুষের দিন ৭ই জুন। এক অর্থে ৬-দফার দিনও এই ৭ই জুন। ১৯৬৬ সালের এই রক্তঝরা দিনটিকে বঙ্গবন্ধু বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তখন রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এবারে তিনি রেসকোর্সে ‘নয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী উত্তাল জনসমুদ্রে’ দাঁড়িয়ে শহীদদের স্মৃতি তর্পণ ক’রে পুনরায় ঘোষণা করলেন–জেল-জুলুম, বেইমানী আর বে-ইনসাফীর যুগের যদি অবসান চান তা’ হ’লে নির্বাচনের মাধ্যমে এবার ধোঁকাবাজ ও মীরজাফরদের খতম করুন। জুন মাসের ১৮ তারিখে শেখ মুজিব আবার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বের হন। এ পর্যায়ে তিনি উত্তর বঙ্গ সফর করেন। ২০শে জুন তিনি রংপুর জেলার নাগেশ্বরী ও ২১শে জুন কুড়িগ্রামে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। রংপুর যাবার পথে তিস্তামুখঘাট ও গাইবান্ধাতেও তিনি স্বল্পকালের জন্য ভাষণ দান করেন।
গভর্নর আহসানের সাথে সাক্ষাৎ
২২শে জুন তারিখে দলবলসহ তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দলীয় বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হ’লেও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের প্রয়োজনীয়তা তাঁরা অনুভব করলেন। এই উদ্দেশ্যে কতিপয় বিশিষ্ট দলীয়কর্মী সহকারে শেখ মুজিব জুন মাসের ২৬ তারিখে প্রাদেশিক গভর্নর এস. এম. আহসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নে আস্থার মনোভাব ও শুভেচ্ছা নিদর্শনস্বরূপ রাজবন্দী, সামরিক আইনে বিচারাধীন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ জানান।
বঙ্গবন্ধুর পশ্চিম পাকিস্তান গমন
এবারে তাঁর দৃষ্টি পশ্চিমমুখী। কেননা তিনি জানেন, পূর্ব বাংলার মত নির্যাতিত জনগণ সেখানেও রয়েছে; কিন্তু তাদের পক্ষ হয়ে কথা
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯০
বলবে কে? ১৯৬৯ সালে যখন শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে গমন করেছিলেন, তখনও এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। সে সময় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমিই পশ্চিমী ভাইদের হয়ে কথা বলব।’ আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতিলগ্নেও তিনি একই আশ্বাস দেবার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন।
২৭শে জুন (১৯৭০), করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বললেন, “দেশের উভয় অংশের দরিদ্র মানুষের হক আদায়ই আমার লক্ষ্য।” সেদিনই করাচীর মাটিতে পা দিয়ে সাংবাদিকদের নিকট বলেছিলেন যে, পাকিস্তান বাইশ পরিবারের, না বারো কোটি মানুষের এবার সে প্রশ্নেরই চূড়ান্ত মীমাংসা হবে।
পশ্চিমী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বাঙালীদের সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের মনে যে একটি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি ক’রে দিয়েছিল—এ বিষয়ে শেখ মুজিব সচেতন ছিলেন। আর সেই জন্যই ২৮শে জুন করাচীর ‘নিশতার পার্কে’ আয়োজিত একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “বাঙালীরা দুশমন তো বটেই, তবে আপনাদের নয়–শোষকদেরঃ দুই অঞ্চলের এই অভিন্ন দুশমনদের উৎখাতে তাই বাঙালীরা আজ সঙ্কল্পবদ্ধ।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯শে জুন, ১৯৭০]
করাচীর নিশতার পার্কে জনসভা
সেদিন নিশতার পার্কে করাচীর রাজনৈতিক জীবনের সর্বকালের বৃহত্তম জনসমাগম ঘটেছিল। ইত্তেফাক লিখেছেনঃ “গত ৭ই জুন ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের যে অবিস্মরণীয় জনসমুদ্রের কাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী মহলে রূপকথার মতই শোনাইয়াছে, অদ্য স্থানীয় নিশতার পার্কে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হয়। শেখ মুজিব উক্ত সভায় আরো বলেছিলেন যে, বাঙালীদের উর্দু ভাষার প্রতি কোন ঘৃণা-বিদ্বেষ নাই-বিদ্বেষ আছে শোষকের কণ্ঠের বিরুদ্ধে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯শে জুন, ১৯৭০]
পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকালে শেখ মুজিব ২৯শে জুন সোহরাওয়ার্দী একাডেমী আয়োজিত একটি সেমিনার উদ্বোধন করেন। পরদিন অর্থাৎ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯১
৩০শে জুন, নওয়াবশাহে যান। সেখানে পৌঁছলে বিপুল জনতা উর্দু ও বাংলা ভাষায় লিখিত পোস্টার ও ব্যানার হাতে শেখ মুজিবকে নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে স্টেশন থেকে সার্কিট হাউজে গমন করেন। বিকালে আয়োজিত এক জনসভায় যেকোন মূল্যে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের কথা বঙ্গবন্ধু আবার দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন। পরদিন কোয়েটায় পৌঁছলে সেখানেও তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়। কোয়েটার জনসভায় বক্তৃতা দানের পর জুলাইয়ের ৩ তারিখে শেখ মুজিব লাহোরে গমন করেন।
শুককুরে জনসভা
সেদিন তিনি শুককুরে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সিন্ধু, পূর্ব পাকিস্তান ও অন্যান্য স্থানে ধৃত ছাত্রদের মুক্তি দানের জন্য প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে আইনজীবীদের প্রদত্ত এক সম্বর্ধনা সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে, তাঁর দল আগামী নির্বাচনে কোন জায়গীরদার বা পুঁজিপতিকে নির্বাচিত হতে দেবে না। সেদিন তিনি সাংবাদিকদেরকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, কাইয়ুম খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা যে স্বাধিকার আদায়ের বিরুদ্ধাচরণ করছেন তার জবাব পাবেন ৫ই অক্টোবরে (৫ই অক্টোবর নির্বাচনের দিন ধার্য হয়েছিল, পরে পরিবর্তিত হয়ে ৭ই ডিসেম্বর ধার্য করা হয়)।
লাহোরে জনসভা
জুলাই মাসের ৫ তারিখে লাহোরের গুলবাগে এক বিরাট জনসভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। সভা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে না পারে তার জন্য জামাতপন্থী গুণ্ডারা গোলযোগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সচেতন জনগণ তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ ক’রে দেয়। এই গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ ক’রে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেনঃ “পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ভিক্ষা করিতে আসি নাই——ভোট সংগ্রহ করিতেও আসি নাই; আসিয়াছি পশ্চিম পাকিস্তানের আপামর মানুষের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী ভাইদের অকৃত্রিম শুভেচ্ছার বাণী পৌঁছাইয়া দিতে। এ ব্যাপারে যারা বাধ সাধিতে চান তাঁহাদিগকে আমরা চিনি। অতএব, যদি কেহ মনে করিয়া থাকেন যে, গুটিকয় ভাড়াটিয়া পাঠাইয়া আওয়ামী লীগের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯২
সভায় গোলযোগ সৃষ্টি করিয়া অথবা অন্যবিধ চক্রান্তের মাধ্যমে আমার বা আমার দলের কণ্ঠ স্তব্ধ করিতে পারিবেন, তাহারা আহাম্মকের স্বর্গেই বসবাস করিতেছেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই জুলাই, ১৯৭০]
ঢাকা প্রত্যাবর্তন
সেদিন শেখ মুজিব একটি হোটেলে পাঞ্জাব ছাত্রলীগের এক সমাবেশেও ভাষণ দেন। পরদিন অর্থাৎ ৬ই জুলাই তিনি করাচী হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে তাঁকে অবিস্মরণীয় সম্বর্ধনা জানানো হয়। ঢাকার মাটিতে পা দেওয়ার প্রায় আড়াই ঘন্টা পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানের সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, “পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চিত জনগণ সমস্ত শাসনের অভিশাপ হইতে মুক্তিলাভের জন্য দুর্বার বেগে সংগ্রামের পথে আগাইয়া চলিয়াছে এবং এই গতি অব্যাহত থাকিলে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাত হইতে নেতৃত্ব ছিনাইয়া আনিতে সক্ষম হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই জুলাই, ১৯৭০]
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিব ৯ই জুলাই ও ১১ই জুলাই তারিখে যথাক্রমে ঢাকার কাওরান বাজার ও ধুপখোলা ময়দানে পরপর দুটো জনসভায় বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় তিনি যে সব সরকারী কর্মচারী নির্বাচন বানচালের জন্য ধর্মঘটের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এবং জনসাধারণকে এ বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকতে নির্দেশ দেন।
দক্ষিণ বঙ্গে নির্বাচনী প্রচারাভিযান
এরপর শেখ মুজিব জুলাই মাসের ১৪ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত আবার দক্ষিণ বঙ্গে নির্বাচন প্রচারাভিযান উপলক্ষে ঝটিকা সফর করেন। তিনি ১৪ই জুলাই ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জে, ১৫ই জুলাই গলাচিপায় ও বরগুনায়, ১৮ই জুলাই মুলাদী ও কালাইয়াতে, ১৯শে জুলাই চাখারসহ কয়েকটি ছোটছোট জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে জুলাইয়ের ২০ তারিখে ঢাকায় ফিরে আসেন।
এদিকে জুলাই-এর শেষ সপ্তাহে পূর্ব বাংলার সর্বত্র বন্যা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটে। বন্যাপ্লাবিত অঞ্চল থেকে বন্যাদুর্গতদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৩
উদ্ধারকার্য ও সাহায্য সামগ্রী প্রেরণের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। প্রদেশের সর্বত্র বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে শেখ মুজিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বন্যাদুর্গতদের জন্য সরকারী তৎপরতা এবং সাহায্যকে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল বলে অভিযোগ করেন।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা আগস্ট, ১৯৭০]
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বন্যাদুর্গতদের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মাত্র ২০ লক্ষ টাকা সাহায্য বরাদ্দ করেছিলেন। প্রেসিডেন্টের এই সামান্য সাহায্যের উপর অভিমত প্রকাশ ক’রে শেখ মুজিব বলেন, “যেখানে অগণিত বন্যার্তের দুর্দশা লাঘবের জন্য কোটি কোটি টাকার দরকার, সেখানে এত অল্প টাকায় আমাদের প্রয়োজন মিটতে পারে না।”
শেখ মুজিবের বন্যা দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন
সফরের শুরুতেই তিনি ২রা আগস্ট ঢাকা শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে তিনি দলবলসহ ঢাকার বাইরে ব্যাপকভাবে বন্যাদুর্গত এলাকা সফর করেন। ৫ই আগস্ট সিরাজগঞ্জের চৌহালী, ৬ই আগস্ট মেঘাই, ৯ই এবং ১০ই আগস্ট চট্টগ্রাম, ২১শে আগস্ট টাঙ্গাইল প্রভৃতি বন্যা উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করার সময় তিনি অসহায় জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে সাহায্যের জন্য সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান। এ সময় শেখ মুজিব বিভিন্ন জনসমাবেশে ভাষণ দান করেন। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলা ও মহকুমার বিভিন্ন বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলসমূহে শেখ মুজিবের বিভিন্ন ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে একদিকে এদেশের বন্যা সমস্যা সমাধান ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের অতীতের অক্ষমতা, বর্তমানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাহায্য দানের ব্যর্থতার সমালোচনা ক’রে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানিয়েছেন, অপরদিকে দেশের নির্বাচন বানচালের জন্য শাসক শ্রেণীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী কুচক্রী মহলের স্বরূপ উদঘাটন ক’রে জনসাধারণকে সর্তক থাকার আহ্বান জানিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৪
আওয়ামী লীগের তৎপরতাঃ প্রতিবাদ দিবস
এদিকে দলগতভাবেও আওয়ামী লীগ প্রদেশের বন্যার্তদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এবং ব্যবস্থাপনায় একমাত্র ঢাকা শহরেই ৯০টি সাহায্য শিবির খোলা হয়। প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যার্তদের প্রতি সরকারের পর্যাপ্ত সাহায্য দানের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ৯ই আগস্ট প্রদেশব্যাপী ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করে। একই সঙ্গে জাতীয় শ্রমিক লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বিভিন্ন রাজনৈতিক বন্দী, কারাগারে আটক বিভিন্ন মামলার আসামী হিসেবে অভিযুক্ত অসংখ্য ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের আশু মুক্তি এবং দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানিয়ে ঐ দিন প্রদেশব্যাপী জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করে।
প্রতিবাদ দিবসে শেখ মুজিব
সেদিন আওয়ামী লীগের ঘোষিত প্রতিবাদ দিবসে শেখ মুজিব চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউণ্ডে এক বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণ দান করেন। এই ভাষণে তিনি কারাগারে আটক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র, শ্রমিক ও কর্মীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ক’রে অবিলম্বে মুক্তি দানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
এ সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনের জন্য পূর্ব বাংলায় সফর করছিলেন। কায়েমী স্বার্থবাদী ধিকৃত রাজনীতিবিদরা তখন ‘মওকা’ পেয়ে বন্যার অজুহাতে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার জন্য তাঁকে উস্কানি দেয়া শুরু করলেন। শেখ মুজিব এ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি ইয়াহিয়ার মনোভাব সম্বন্ধে ভালোভাবেই ওয়াকিফহাল থেকেছেন। আর সেই জন্য উক্ত প্রতিবাদ দিবসে সে সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ ক’রে বলেন, “বন্যার অজুহাতে তারিখ পিছাইবার জন্য দেশের সাধারণ নির্বাচন বানচালের কোন চক্রান্ত বরদাশত করিতে আওয়ামী লীগ রাজী নহে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই আগষ্ট, ১৯৭০]
নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন
কিন্তু এতদসত্ত্বেও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সঙ্গে যোগসাজস ক’রে ১৯৭০ সালের ১৫ই আগষ্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেন। ঘোষণায় ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৫
এবং ১৯শে ডিসেম্বর অথবা তারো আগে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়। অথচ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এর আগে ২৮শে এপ্রিল এক বেতার ভাষণে জোরের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনের তারিখ অপরিবর্তিত থাকবে।
কায়েমী স্বার্থবাদীদের অভিনন্দন
কায়েমী স্বার্থবাদীদের সঙ্গে চক্রান্ত করেই যে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার ঘোষণা করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। কেননা, প্রেসিডেন্টের ঘোষণার সাথে সাথে সেই সব তথাকথিত নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্তটিকে প্রাজ্ঞজনোচিত বলে মন্তব্য করেন। জনাব নূরুল আমীন, মাহমুদ আলী, কাউন্সিল লীগ নেতা খাজা খয়েরুদ্দিন, জামাত নেতা মওলানা মওদুদী, অধ্যাপক গোলাম আজম, নেজামে ইসলামের ফরিদ আহমদ, জাতীয় লীগের ফেরদৌস কোরেশী, জামাতে ওলামায়ে ইসলাম নেতা পীর মোহসেন উদ্দীন আহমদ (দুদু মিয়া), জনাব কাইয়ুম খান সেদিনই প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রতি অভিনন্দন জানান।
নির্বাচন বানচাল সম্পর্কে শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি
কিন্তু শেখ মুজিব এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি। তিনি জানতেন যে, এমন একটি পরিস্থিতি হবেই। কায়েমী স্বার্থবাদীরা যে কোন অজুহাত তুলেই হোক, নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করবেই। তবু নির্বাচনের জন্য যখন একটি তারিখ নির্দিষ্ট ক’রে দেয়া হয়েছে, তখন আপাততঃ ভালোয় ভালোয় কাজটা সম্পন্ন হতে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেই জন্যই তিনি ২০শে আগস্ট টঙ্গীতে তাঁর সংক্ষিপ্ত সফরকালে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, নির্বাচন পিছানোয় আওয়ামী লীগের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু ডিসেম্বরেও যদি নির্দিষ্ট তারিখে নির্বাচন হতে দেয়া না হয়, তা’ হ’লে তিনি সারা দেশে এক দুর্বার গণ-আন্দোলন শুরু ক’রে দেবেন বলে ঘোষণা করেন।
১লা সেপ্টেম্বর (১৯৭০) কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা কালে বঙ্গবন্ধু গণ-দুশমনদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক ক’রে দিয়ে বলেন, “বন্যার দরুন নয়—গণ-দুশমনদের পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্তের দরুনই নির্বাচনের তারিখ পিছাইয়া গিয়াছে।” সেদিন
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৬
তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেন যে, শোষক ও গণদুশমনদের চক্রান্ত ব্যর্থ ক’রে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার জনগণকে সবসময় বৃহত্তর সংগ্রাম ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “………এইবার আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, নির্বাচন হোক আর না হোক, আমরা আমাদের দাবী আদায় করিবই করিব এবং দাবী আদায়ের সংগ্রামে আমরা আর শহীদ হইব না, আমরা গাজী হইব।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭০]
নির্বাচনী সম্ভাবনাকে বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা করা হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি মুসলমান ভাইদেরকেও সতর্ক ক’রে দেন।
ঢাকার নবাবগঞ্জে ২২শে সেপ্টেম্বরে ভাষণ দিতে গিয়েও তিনি অনুরূপ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। সেদিন চক্রান্তকারীদেরকে হুঁশিয়ার ক’রে দিয়ে বলেন, “তোমরা মনে রেখ, বাংলার মানুষ আজ আর ঘুমাইয়া নাই। বাংলার মানুষ রক্ত দিতে শিখিয়াছে—যত চক্রান্তই কর, বাংলার মানুষকে আর তোমরা দাবাইয়া রাখিতে পারিবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭০]
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদের প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করেছিল। আসন সংখ্যার তুলনায় এত আবেদনপত্র পড়েছিল যে, প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডকে রীতিমত বিব্রত হয়ে পড়তে হয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর উভয় আসনের প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিব পুরাতন ঢাকার একটি এবং নতুন ঢাকার টঙ্গী ও তেজগাঁও এলাকা— এই দুটো জাতীয় পরিষদ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের সাথে সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তাঁদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। ভাসানী ন্যাপ বহুদিন থেকেই ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে নির্বাচনের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৭
আসছিল। ভোটের আগে ভাত চাই এই দাবী উত্থাপন ক’রে মওলানা ভাসানী একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার সে পুস্তিকা বাজেয়াপ্ত করেন। মওলানা ভাসানী নিজেও বার বার বিপ্লবের হুমকি দিতে থাকেন। হাতিয়ার হিসেবে তিনি একটি বিপ্লবী দলও গঠন করেছিলেন—আগেই বলা হয়েছে, এরা ‘লালটুপি বাহিনী’ নামে পরিচিত। তাঁর সমর্থক সন্ত্রাসবাদীরা যে কিরূপে নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সে কথাও বলেছি।
অতিবিপ্লবীদের সম্পর্কে শেখ মুজিব
শেখ মুজিব বার বার এই অতিবিপ্লবীদেরকে হুঁশিয়ার ক’রে দিয়েছেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পঞ্চমবার্ষিকী সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে শেখ মুজিব বাংলার জাগ্রত ছাত্র সমাজকে সতর্ক করে দেন যে, “একশ্রেণীর অতিবিপ্লবী দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সহিত হাত মিলাইয়া নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রহিয়াছে” (২রা অক্টোবর)।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা অক্টোবর, ১৯৭০]
নির্বাচন প্রশ্নে ভাসানী ন্যাপ
ঐ একই দিনে মওলানা ভাসানী রেসকোর্স ময়দানে লালটুপি বাহিনীর এক বিরাট সমাবেশে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, বিপ্লব ও সংগ্রাম ছাড়া দাবী আদায় হয় না। তাঁর দলীয় কর্মীরা সে দিন বক্তৃতার সময় মুহুর্মুহু ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’ ধ্বনি দিতে থাকেন। পরদিন পিকিং ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের সদস্য জনাব এম. এ. জলিলের বাসভবনের সম্মুখে বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের (পিকিংপন্থী ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান) কর্মীদের উদ্দেশে যখন ভাসানী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখনও কর্মীগণ ‘নির্বাচন নির্বাচন, বর্জন বর্জন’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ভাসানী ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া কোন গত্যন্তর খুঁজে পায় নি। কেননা, নির্বাচন বর্জনের শ্লোগান দিয়ে তাঁদের পক্ষে জনগণকে নির্বাচনবিমুখ করা সম্ভব হয় নি। বরং অতিবিপ্লবীদের কার্যকলাপে জনমনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা’ বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছে। নির্বাচনী কমিশনের নিকট প্রার্থীপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবেদনের সময় যতই ঘনিয়ে এসেছে, ভাসানীপন্থীরা ততই
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৮
দোদুল্যমান হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় দ্বিধান্বিতচিত্তে ৪ঠা অকটোবর ঢাকায় ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু মওলানা সাহেব উক্ত বৈঠকে উপস্থিত থাকেননি। অক্টোবরের ১১ তারিখে এই দল মনোনীত প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করেন।
ইসলাম পছন্দ ঐক্যজোট
এদিকে জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও পি. ডি. পি. এক হয়ে ইসলাম-পছন্দ ঐক্যজোট গঠন করেন। এঁদের সবারই ধারণা জন্মেছিল যে, একজোট হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে আওয়ামী লীগ বোধকরি হালে পানি পাবে না। পরে অবশ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে গিয়ে এই ঐক্যজোট ভেঙ্গে যায়। ঐক্যজোট না ভাঙিলেও অবস্থার বিশেষ হেরফের হ’ত না। পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবের পার্শ্বে বিকল্প কোন নেতার কথা ভাবতেই পারেন নি। ইতিমধ্যে নির্বাচনী কমিশন আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রতীক হিসেবে নৌকা বরাদ্দ করেন। দেশের ১৯টি রাজনৈতিক দলের প্রতীক সম্পর্কে ইসলামাবাদ থেকে ৮ই অক্টোবর এই মর্মে এক ঘোষণা জারী করা হয়। দলভিত্তিক নির্বাচনী প্রতীকসমূহ নিম্নে প্রদত্ত হ’লঃ
১। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ—নৌকা।
২। পি. ডি. পি. —ছাতা।
৩। জামাতে ইসলামী—দাড়িপাল্লা।
৪। পিপলস্ পার্টি —তরবারি।
৫। কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ—ব্যাঘ্র।
৬। কনভেনশন মুসলিম লীগ—বাইসাইকেল।
৭। ভাসানী ন্যাপ—ধানের শীষ।
৮। ওয়ালী ন্যাপ—কুঁড়েঘর।
৯। কাউন্সিল মুসলিম লীগ—হ্যারিকেন।
১০। জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম—খেজুর গাছ।
১১। কৃষক শ্রমিক পার্টি—হুকা।
১২। পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ—লাঙ্গল।
১৩। পাকিস্তান মসিহী লীগ—চশমা।
পৃষ্ঠা নং ~ ৫৯৯
১৪। জামাতে আলিয়া মোজাহেদিন—পাগড়ী।
১৫। খাকছার তাহরিক—বেলচা।
১৬। মারকাজী জমিয়তে আহলে হাদিস পাকিস্তান—গোলাপ ফুল।
১৭। মারকাজী জমিয়তে উলেমায়ে পাকিস্তান—চাবি।
১৮। সিন্ধু যুক্তফ্রন্ট—ছড়ি।
১৯। নিখিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম—বই
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে প্রার্থী মনোনয়ন
নির্বাচনী কমিশন কর্তৃক দলভিত্তিক প্রতীক ঘোষিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য লাভের জন্য বিভিন্ন দলের যথাক্রমে ৮৭০ জন ও ২১২১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন পত্র দাখিল করেন। দলীয় প্রার্থী প্রার্থী মনোনয়ন দানের পর শেখ মুজিব তাঁর প্রার্থীদেরকে জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য আবার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ঝটিকা সফর শুরু করেন। রাতদিন অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি জনগণের আরো কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। ৬ই অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুলিয়ারচর, ৭ই অক্টোবর সিলেটের আজমীরীগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার ইতনা, ৮ই অক্টোবর সিলেটের দিরাই প্রভৃতি কয়েকটি জায়গায় জনসভায় বক্তৃতা ক’রে অক্টোবরের ১০ তারিখে ঢাকা ফিরে এসে আবার ১৪ অক্টোবর ঢাকার অদূরে ধামরাই, ১৭ই অক্টোবর ধোলাইখাল ও ঢাকার কাঁঠাল বাগান, ১৮ই অক্টোবর কালিগঞ্জ, ২০শে অক্টোবর ডুমরীসহ ঢাকার কয়েকটি জনসভায় তিনি বক্তৃতা দেন। কোনরূপ বিশ্রাম না নিয়েই তিনি আবার উত্তর বঙ্গে চলে যান। সেখানে ২২ তারিখে দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ, ২৩ তারিখে রংপুর জেলার সৈয়দপুর, নীলফামারি, ডোমার প্রভৃতি স্থানে বিরাট জনসভায় তাঁর অগ্নিবর্ষী ভাষণ দান করেন। ইতিমধ্যে ঢাকাসহ প্রদেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে অকস্মাৎ এক অস্বাভাবিক ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ায় তিনি উত্তর বঙ্গে কয়েকটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচী বাতিল ক’রে দিয়ে ২৬শে অক্টোবর ঢাকায় ফিরে আসেন।
নেতৃবৃন্দকে বেতার টেলিভিশনের মাধ্যমে জনগণের নিকট তাঁদের আদর্শ উপস্থাপনের সুযোগ
এসময় সরকার একটি মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ম্যানিফেস্টো’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০০
জনগণের সম্মুখে প্রচারের সুযোগ দেবার জন্য ‘বেতার এবং টেলিভিশনে’ বক্তৃতা দানের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের এই প্রচেষ্টা সর্বত্রই অভিনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, অনেক নেতাই দেশের অতিদরদী সেজে এমনভাবে ভাষণ দেয়া শুরু করলেন, যা অনেকেরই বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিল। নেতৃবৃন্দের সবাই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের দিকেই অধিক দৃষ্টি আরোপ করলেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা এ. এস. এম. সুলায়মান লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানালেন। এমনকি জামাতে ইসলাম ও পি. ডি. পি’র নেতৃবৃন্দও তাঁদের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপন করেন।
শেখ মুজিবের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ
যা হোক এখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আরো কয়েকজনের ভাষণ উল্লেখ করছি। এ থেকে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক তৎপরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য এবং তুলনামূলকভাবে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, এসব সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা লাভ করা যাবে। প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্মরণ করি। ১৯৭০ সালের ২৮শে অক্টোবর তিনি এই ভাষণদান করেন। তিনি বলেনঃ
“প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,
আসসালামু আলায়কুম!
জনগণের মুক্তির জন্য যে সব বীর শহীদান রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন যে সব বীর সন্তান, তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা ক’রে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। স্বৈরাচারী শাসনের অত্যাচার, নির্যাতন উপেক্ষা ক’রে নিজেদের জীবন দিয়ে তাঁরা আন্দোলনের পর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। অগণিত মানুষ সর্বপ্রকার নিষ্পেষণের মুখেও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সেই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত আন্দোলন গত বছরের ঐতিহাসিক গণ-অভুত্থানে পরিণত হয়েছিল। সেই একটানা আন্দোলন জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। বস্তুতঃ আমি আজ জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আপনাদের কাছে আমার বক্তব্য পেশের যে সুযোগ পেয়েছি, তাকেও জনগণের সংগ্রামের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০১
প্রাথমিক বিজয় বলে বিবেচনা করা যায়। কারণ, আজ পর্যন্ত এ সুযোগ ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া ছিল।
আমাদের সংগ্রাম চলবেই। কারণ, আমাদের মূল লক্ষ্যে এখনো আমরা পৌঁছিনি। জনগণকে ক্ষমতা অর্জন করতেই হবে। মানুষের উপর মানুষের শোষণ, অঞ্চলের উপর অঞ্চলের শোষণের অবসান ঘটাতে হবে। যে শক্তিশালী চক্র গত বাইশ বছর পাকিস্তানি শাসন করেছে, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তারা সম্ভাব্য সকল রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এরা সেইসব গোষ্ঠী—যারা সাধারণ নির্বাচন বানচালের সক্রিয় ষড়যন্ত্র করছেন। এমনকি নির্বাচনের পরেও তারা শোষণের অবসান ঘটানোর প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য সক্রিয় থাকবে। এজন্য প্রয়োজন হ’লে তারা তাদের বিপুল সম্পদ নিয়জিত করবে। তাদের অর্থ আছে, প্রভাব আছে, জনসাধারণের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষ আপোষহীনভাবে সাফল্যের সাথে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং শেষ পর্যন্ত জনতার জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ এ প্রতিশ্রুতি দিতে পারে যে, তারা জনগণের পাশে পাশেই থাকবে। স্বৈরাচারী ও শোষকগোষ্ঠীর মোকাবেলার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিবে। কোন জাতি কোন দিনই আত্মাহুতি না দিয়ে মুক্তি ও ন্যায়বিচার পায় নি। তাই আজ আওয়ামী লীগ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে জানিয়ে দিতে চায় যে, পাকিস্তানের জনগণকে সাথে নিয়ে তাদের মোকাবেলা আওয়ামী লীগ অবশ্যই করবে। গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা হ’লে আওয়ামী লীগ সব শক্তি দিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগের জন্ম। আর সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের বিকাশ। তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল সমগ্র দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সে হীন চেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই আমাদের মহান নেতা মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রাম
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০২
শুরু করি। আমাদের সে সংগ্রাম আজও শেষ হয় নি। ক্ষমতাসীনচক্র সংগ্রামী আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য হামলার পর হামলা চালিয়েছে। আঘাতের পর আঘাত হেনেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের একের পর এক কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তাঁরা তাঁদের জীবনের সম্ভাবনাময় দিনগুলো কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। সর্বপ্রকারের নির্যাতন, নিপীড়নকে আমরা পরাভূত করেছি। বিজয়ী হয়েছি। এ বিজয়ই আমাদেরকে গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তিসমূহের মোকাবেলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। যে সঙ্কট আজ জাতিকে গ্রাস করতে চলেছে, সে সঙ্কটের অবসান ঘটাতে হবে। আজকে জাতীয় সঙ্কটের প্রথম কারণ, দেশবাসী রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দ্বিতীয়, জনগণের এক বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কবলে পতিত। তৃতীয়, অঞ্চলে অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্যে সীমাহীন অবিচারের উপলদ্ধি জন্মেছে। প্রধানতঃ এগুলোই বাঙালীদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলিত মানুষদেরও আজ একই উপলদ্ধি। আওয়ামী লীগের ‘ম্যানিফেস্টো’তে এসব মৌলিক সমস্যা সমাধানের একটা সুস্পষ্ট পথনির্দেশ করা হয়েছে। দেশে প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সেই গণতন্ত্রে মানুষের সকল মৌলিক স্বাধীনতা শাসনতান্ত্রিকভাবে নিশ্চিত করা হবে। আমাদের ম্যানিফেস্টোতে রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু বিকাশের রূপরেখা নির্দেশ করা হয়েছে। সংবাদপত্র ও শিক্ষার পূর্ণ স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী। সমাজে ক্যান্সারের মত যে দুর্নীতি বিদ্যমান তাকে নির্মূল করতে আমরা দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। জাতীয় শিল্প সম্পদের শতকরা ৬০ ভাগের অধিক আজ দু’ডজন পরিবার করায়ত্ত করেছে। ব্যাঙ্কিং সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদের শতকরা ৭৫ ভাগ এ দু’ডজন পরিবারের কুক্ষিগত। ব্যাঙ্কের লগ্নীকৃত অর্থের শতকরা ৮২ ভাগ আজ মোট জমাকারীদের মাত্র শতকরা ৩ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশে যে কর প্রথা কায়েম রয়েছে তা’ বিশ্বের সবচাইতে পশ্চাৎমুখী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৩
ব্যবস্থা। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যখন প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৬ ভাগ আদায় করা হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ২ ভাগ অর্থ আদায় হয়। অপর পক্ষে লবণের মত অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির উপরেও নিপীড়নমূলক পরোক্ষ কর বসানো হয়েছে। সংরক্ষিত বাজার, ট্যাক্স হলিডে, বোনাস ভাউচারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে সাবসিডি প্রদান এবং কৃত্রিমভাবে নিম্নহারে বিদেশী মুদ্রার ঋণ অর্থবরাদ্দ প্রভৃতি ব্যবস্থা একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথার সুযোগ ক’রে দিয়েছে।
ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সীমান্ত প্রভুরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী রয়েছেন। তাঁরা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। তাঁদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটেছে, কেবলমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমশক্তির এক-পঞ্চমাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ আজ বেকার। জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধির সম্পূর্ণ চাপ এসে পড়েছে শিল্প-শ্রমিক ও মেহনতি সম্প্রদায়ের উপর। মুদ্রা-মুজরী যা বেড়েছে তার তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। জীবনযাত্রার সীমাহীন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ স্কুল-কলেজের শিক্ষক, স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারী, বিশেষ ক’রে চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা আজ হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করছেন।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, গত বাইশ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতের মোট ব্যয়ের মাত্র ১৫ শ’ কোটি টাকার মত (মোট ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশ মাত্র) বাংলাদেশে খরচ করা হয়েছে, অথচ এর পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হয়েছে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশী। দেশের সর্বমোট উন্নয়ন ব্যয় খাতে বাংলাদেশে মোট ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশী। গত ২২ বছরে পশ্চিম পাকিস্তান মাত্র ১৩ শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। কিন্তু ৩ হাজার কোটি টাকার বিদেশী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৪
দ্রব্য তারা আমদানী করেছে। বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে তিনগুণ বেশী বিদেশী দ্রব্য আমদানী করা হয়েছে। নিজস্ব বিদেশী মুদ্রা আয়ের চাইতেও পশ্চিম পাকিস্তান বাড়তি দু’হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিদেশী দ্রব্য আমদানী করতে পেরেছে, তার কারণ বাংলাদেশের অর্জিত পাঁচশ’ কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে কুক্ষিগত হয়েছে। তার উপরেও সর্বপ্রকার বিদেশী সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তান ব্যবহার করেছে। সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রের পরিসংখ্যানও ঠিক একই রকমের মর্মান্তিক। স্বাধীনতার বাইশ বছর গত হয়েছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীতে বাঙালীর সংখ্যা আজও মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ। দেশরক্ষা সার্ভিসে বাঙালীর সংখ্যা মাত্র ১০ ভাগেরও কম। সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ প্রকট বৈষম্যের ফলে বাংলার অর্থনীতি আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে। বাংলার বেশীর ভাগ গ্রামাঞ্চলে দুর্ভিক্ষজনিত অবস্থা বিরাজ করছে। জনগণকে শুধুমাত্র অনাহারের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য ১৭ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানী করতে হচ্ছে। দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে তার শিকারে পরিণত হয়ে চলেছে বাংলার অসহায় মানুষ।
পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশী। পশ্চিম পাকিস্তানে যে ক্ষেত্রে মোটা চাউলের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোটা চাউলের দাম গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম প্রতিমণ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা’ ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম মাত্র আড়াই টাকা, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি সের তেলের দাম পাঁচ টাকা। করাচীতে যে সোনার দাম প্রতি ভরি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা, ঢাকায় সে সোনার মূল্য প্রতি ভরি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। তারপরেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলায় সোনা আনার ব্যাপারে কাস্টমস-এর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। গত বাইশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের অর্থনীতির যে কাঠামো গড়ে তুলেছেন এসব অবিচার তারই পুঞ্জীভূত ফলশ্রুতি। এ অবিচার দূর করার সাধ্য কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। এ সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে চতুর্থ পাঁচসালা পরিকল্পনায়। কেন্দ্রীয় সরকার যত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৫
বড় শক্তিশালীই হোক না কেন, অতীতের অন্যায় অবিচার দূরীকরণে সে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, চতুর্থ পরিকল্পনায় ব্যয়-বরাদ্দে সে ব্যর্থতার স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচী, যে কর্মসূচীতে আছে ন্যায়বিচারের পথনির্দেশ, সে কর্মসূচী আঞ্চলিক অন্যায় অবিচারের বাস্তব সমাধানের পথনির্দেশ করেছে। কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রে যেখানে বাংলার প্রতিনিধিত্ব মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ এবং দেশে যে ধরনের শাসনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে, তাতে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাছ থেকে সুবিচার আশা করা যায় না। বাংলাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা বৃহত্তর ব্যয় বরাদ্দ আদায়ের চেষ্টা করলে আঞ্চলিক উত্তেজনাই বৃদ্ধি পাবে এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ফেভারেল সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। এ অবস্থায় সমস্যাসমূহের একমাত্র সমাধান হতে পারে শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস ক’রে এবং ফেডারেশনের ইউনিটগুলিকে আওয়ামী লীগের ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ক’রে। প্রস্তাবিত এ স্বায়ত্তশাসনকে পুরোপুরি কার্যকরী করার জন্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষমতাও অবশ্যই নিতে হবে। এজন্যই মুদ্রা-ব্যবস্থা ও অর্থনীতি এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উপর ফেডারেশনের ইউনিটগুলির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দানের ব্যাপারে আমরা সব সময়ই গুরুত্ব দিচ্ছি। এ কারণে আমরা মনে করি যে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও ঋণসমূহের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার ক্ষমতাও ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলোর হাতে অর্পণ করা উচিত। এভাবে আমরা কেন্দ্রকে সন্দেহ, সংশয় ও বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগের আওতার উর্ধ্বে রাখতে চাই। ফেডারেশনের ইউনিটগুলিকে অর্থনৈতিক ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান, ফেডারেশন সরকারকে পররাষ্ট্র বিষয়, দেশরক্ষা বিষয় ও নিরাপত্তামূলক শর্ত সাপেক্ষে মুদ্রা ব্যবস্থার দায়িত্ব দিয়ে একটা ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্যমূলক ফেডারেল রাষ্ট্র কায়েম হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের ফেডারেল সরকার পরিকল্পনায় নিখিল পাকিস্তানি সার্ভিস ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা হবে এবং ফেডারেল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সকল অঞ্চল থেকে ফেডারেল চাকুরীতে লোক নিয়োগ করা হবে। আমরা আরো বিশ্বাস
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৬
করি যে, ফেডারেশনের ইউনিটগুলি যদি মিলিশিয়া অথবা প্যারা মিলিটারী বাহিনী গঠন করে, তবে তারা কার্যকরীভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সাহায্য করাতে সক্ষম হবে। আমাদের প্রস্তাবিত ফেডারেল পরিকল্পনা সংশয় ও বিরোধের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানের নিশ্চয়তা বিধান করবে। যে অঞ্চলের মানুষ অপর অঞ্চলকে উপনিবেশ বা বাজার হিসাবে ব্যবহার করতে চান, বোধগম্য কারণেই তারা আমাদের এ প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পরিকল্পনা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের পূর্ণ সমর্থন পাবে। আমাদের বিশ্বাস, শাসনতান্ত্রিক এ কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন মিটানোর জন্য দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দেশবাসীর কঠোর পরিশ্রম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী তখনই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবেন যখন ত্যাগ স্বীকারের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সকল শ্রেণী ও সকল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করার আশ্বাস আমরা দিতে পারবো। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশ নিশ্চিত করার জন্যে অর্থনৈতিক কাঠামোতে অবশ্যই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানীগুলো সহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সাধিত হবে সরকারী অর্থাৎ জনগণের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন। বেসরকারী পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথার সম্পূর্ণভাবে বিলোপ সাধন করতে হবে। কর ব্যবস্থাকে সত্যিকারের গণমুখী করতে হবে। সৌখিন দ্রব্যাদির ব্যাপারে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে সমর্থন ক’রে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। এ সমর্থনের জন্যে কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামাল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৭
সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁতীদের ন্যায্যমূল্যে সুতা ও রং সরবরাহ করতে হবে। তাদের জন্য অবশ্যই বাজারজাতকরণ ও ঋণদানের সুবিধা ক’রে দিতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে এ সব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প-সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এযাবৎ বাংলার সোনালী আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া-বেপারীরা পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেছে। পাটের মান, উৎপাদনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাটের গবেষণার উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাটসম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। তুলার প্রতিও একই ধরনের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেজন্য আমরা মনে করি, তুলা ব্যবসাও জাতীয়করণ করা অত্যাবশ্যক, তুলার মান ও উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সরকারগুলো আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল চা, ইক্ষু ও তামাকের উৎপাদনের ব্যাপারেও যথেষ্ঠ অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। এর ফলে এসব অর্থকরী ফসল উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি-ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জায়গীরদারী, জমিদারী, সর্দারী প্রথার অবশ্যই বিলুপ্ত সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ ক’রে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারী খাস জমি ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বন্টন করতে হবে। কৃষি-ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৮
ভূমি রাজস্বের চাপে নিষ্পিষ্ট কৃষককুলের ঋণভার লাঘবের জন্যে অবিলম্বে আমরা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেছি। আমরা বর্তমান ভূমি রাজস্ব প্রথাও তুলে দেবার কথা ভাবছি।
প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক তৎপরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের বন-সম্পদ, ফলের চাষ, গো-সম্পদ, হাঁস-মুরগীর চাষ, দুধখামার, সর্বোপরি মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। পানি-সম্পদ সম্পর্কে গবেষণা এবং নৌ-প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্যে অবিলম্বে একটি নৌ-গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক মৌল ভিত্তির যে প্রথম তিনটি স্তর সেগুলোকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। বন্যানিয়ন্ত্রণকে অবশ্যই প্রথম কর্তব্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে একটা সুসংহত ও সুষ্ঠু বন্যানিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা আশু প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তানে জলবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দ্রুতগতিতে দূরীভূত করতে হবে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বিজলী সরবরাহ করতে না পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধিত হতে পারে না। একটি সম্প্রসারিত কর্মসূচী বাস্তবায়িত ক’রে গ্রামে গ্রামে বিজলী সরবরাহ করতে হবে। এর দ্বারা পল্লী অঞ্চলে ক্ষুদ্রায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। পাঁচ বছরে আমরা বাংলাদেশে পঁচিশ শ’ কিলোওয়াট বিজলী উৎপাদন করতে চাই। রূপপুর আণবিক শক্তি এবং জামালগঞ্জের কয়লা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়িত করতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস অবিলম্বে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে হবে। তৃতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ ক’রে উত্তর বঙ্গের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিব। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে সিন্ধুনদের উপর এবং বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলীর উপরেও সেতু নির্মাণ করতে হবে। আভ্যন্তরীণ নৌ ও সামুদ্রিক বন্দরের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সড়ক ও রেল ব্যবস্থার উপরও আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছি। সুষ্ঠু সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের মত আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬০৯
প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও অধিক নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকেরও বেশী শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল বিশেষ ক’রে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দুর করতে হবে। পাঁচবছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটা ‘ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণীর জন্যে খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চ শিক্ষার জন্যে মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ও উর্দু যাতে ইংরেজীর স্থান দখল করতে পারে সে ব্যাপারে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ও উন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে।
নাগরিক জীবনের সমস্যাবলীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব নিম্ন আয়ের লোকজন অমানুষিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছেন। তথাকথিত ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টগুলি বিত্তবানদের জন্যে বিলাসবহুল আবাসিক এলাকা নির্মাণে ব্যস্ত। আর এদিকে বাস্তুহারা ও বিত্তহীনদের দল এতটুকু আশ্রয়ের সন্ধানে মাথাকুটে ফিরছে। ভবিষ্যৎ নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অল্প খরচে শহরে বাসগৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা প্রয়োজন। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এক করুণ পরিবেশ বিদ্যমান। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ সামান্যতম চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। প্রতি ইউনিয়নে একটি ক’রে পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র এবং প্রতি থানা সদরে একটি ক’রে হাসপাতাল অবিলম্বে স্থাপন করা প্রয়োজন। চিকিৎসা গ্রাজুয়েটদের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস প্রবর্তনের প্রয়োজন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১০
পল্লী এলাকার জন্য বিপুলসংখ্যক প্যারা মেডিকেল পার্সনালদর ট্রেনিং দেয়া দরকার।
গণ-আন্দোলন যেমন, শিল্প শ্রমিকরা তেমনি অর্থনীতি ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ক’রে থাকেন। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, যৌথ দর কষাকষি এবং ধর্মঘটের ব্যাপারে তাদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের নিজেদের এবং সন্তানদের জন্যে বেঁচে থাকার মত মজুরী, বাসগৃহ, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার খর্বকারী সকল শ্রম-আইন বাতিল করতে হবে। শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের ন্যায্য হিস্যা দানের মাধ্যমেই তাদের কাছ থেকে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। সমাজের চাহিদা মেটাতে হলে অর্থনীতির সকল খাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
অর্থনীতির সর্বত্র মজুরী-কাঠামোর ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির গ্রাস থেকে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারী ও অল্প উপার্জনশীল ব্যক্তিদের বাঁচাবার জন্যে দ্রব্যমুল্যে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ক’রে আসছি। সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সর্বক্ষেত্রেই পাবে। উপজাতীয় এলাকা যাতে অন্যান্য এলাকার সাথে পুরোপুরি সংযোজিত হতে পারে, তারা যাতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অপর নাগরিকদের মতই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, এ জন্যে উপজাতীয় এলাকা উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকূলীয় দ্বীপসমূহ এবং উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাসকারীরা যাতে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সে জন্যে তাদের সম্পদের সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
জাতীয় জীবনের সাথে মোহাজেরদের একাত্ম হয়ে যাওয়া উচিত। এর ফলে স্থানীয় জনগণের সাথে মিলেমিশে সর্বক্ষেত্রে তারা স্থানীয় জনগণের মতই সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১১
৬-দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী ইসলামকে বিপন্ন ক’রে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে—সে মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্যে আমি শেষ বারের মত আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোন কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এ শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কোরান ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামী নীতির পরিপন্থী কোন আইন এদেশে পাশ হতে বা চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে না। পররাষ্ট্র নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোন মতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না। এ জন্যে আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন এবং জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির অনুসরণ করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই সিয়াটো, সেন্টো ও অন্যান্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবী জানিয়ে এসেছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোন জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতীত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে—সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।
কারোর প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব-এ নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের, বিশেষ ক’রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত, এর মধ্যে আমাদের জনগণের বৃহত্তম স্বার্থ নিহিত রয়েছে। সে জন্যে প্রতিবেশীদের মধ্যে বর্তমান বিরোধসমূহের নিষ্পত্তির উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করি। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব মোতাবেক কাশ্মীর সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করছি।
ফারাক্কা বাঁধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে ভয় ও স্থায়ী সর্বনাশ করা হচ্ছে অনতিবিলম্বে সে সর্বনাশের মোকাবিলা করতে হবে। কালবিলম্ব না ক’রে এ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১২
দেশবাসী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হলেই এসব কর্মসূচী ও নীতিমালার বাস্তবায়ন সম্ভবপর। আগামী নির্বাচনে জাতীয় মৌলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ ক’রে ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোটরূপে আমরা গ্রহণ করেছি। একমাত্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশকে একটা শাসনতন্ত্র দিতে পারে—যে শাসনতন্ত্র জনগণের একত্রে বসবাসের স্থায়ী ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে। এ কারণেই আমরা বার বার উল্লেখ করেছি যে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র রচনার ক্ষমতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আইনগত কাঠামো আদেশের বিধিনিষেধ সম্পর্কিত ধারাসমূহ বাতিলের জন্যে পুনরায় প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
রাজনৈতিক কারণে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-শ্রমিকের বিরুদ্ধে ও বিগত গণ-অভুত্থানকালীন দায়েরকৃত মামলা, গ্রেফতারকারী পরোয়ানা ও দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করা হ’লে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দীকেও মুক্তি দিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের গুরুভার বহন করা কোন প্রকারেই উচিত নয়। রাজনীতিতেও সশস্ত্র বাহিনীর জড়িয়ে পড়া একেবারেই অনুচিত। উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত পেশাদার সৈনিকদের জাতীয় সীমানা রক্ষার গুরুদায়িত্ব এককভাবে পালন করা বাঞ্ছনীয়। পরিশেষে আমি বলতে চাই, জাতি হিসাবে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে, আমরা সাফল্যের সাথে তার মোকাবেলা করবোই।
প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। যাদের নিয়ে পাকিস্তান গঠিত, তারা শুধুমাত্র একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মধ্যেই একত্রে বসবাস করতে পারে।
গণতন্ত্র ধ্বংসের যে-কোন উদ্যোগ পরিণতিতে পাকিস্তানকেই ধ্বংস করবে। আমাদের ৬-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে ফেডারেশনের ইউনিটসমূহকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর ক’রে অঞ্চলে অঞ্চলে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এই ধরনের ফেডারেল গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে সামাজিক বিপ্লবের সূচনার জন্যে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৩
আওয়ামী লীগ এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আওয়ামী লীগ দেশবাসীর যে সমর্থন ও আস্থার অধিকারী হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি যে, ইনশাল্লাহ আমরা সাফল্যের সাথে এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। পাকিস্তান জিন্দবাদ।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৯শে অক্টোবর, ১৯৭০]
মাওলানা ভাসানীর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মওলানা ভাসানী নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দাবী আদায় সম্ভব নয়—সংগ্রামের মাধ্যমে তা’ করতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মত বদলান এবং ভাষণ দেন। ৫ই নভেম্বর তাঁর ভাষণ টেলিভিশন ও বেতারে প্রচার করা হয়। তাঁর ভাষণের পুরো বিবরণ তুলে দেয়া হ’লঃ “আগামী সাধারণ নির্বাচনের একমাত্র উদ্দেশ্যঃ পাকিস্তানের সকল শ্রেণীর, সকল অঞ্চলের—পাঞ্জাবী হোক, সিন্ধি হোক, বেলুচী হোক অথবা বাঙালী হোক—সকল শ্রেণীর গ্রহণযোগ্য একটি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের উদ্দেশ্যে একটি সুন্দর প্রগতিশীল শাসনতন্ত্র রচনা করা। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দৈনন্দিন কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে—তার মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তাদের জন্যে আঞ্চলিক—পূর্ণ আঞ্চলিক—স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। আমি আশা করি, আগামী শাসনতন্ত্রে আঞ্চলিক—পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা যথাযথরূপে গৃহীত হবে। তৎসঙ্গে শতকরা ৮৫ জন কৃষক ও ১০ জন শ্রমিক—৯৫ জন নিপীড়িত নির্যাতিত অভুক্ত অনাহারক্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য সংখ্যানুপাতে আইনসভায় আসন সংখ্যা নির্ধারিত হবে। পূর্ব বাংলার ভয়াবহ সমস্যা বন্যা প্রতিরোধের জন্য কালবিলম্ব না ক’রে এখন হতে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। সেন্টো, সিটো, পাক-আমেরিকান চুক্তি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে বাতিল করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা মজহাবের উন্নতির জন্য সরকারকে বিশেষভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। পাকিস্তানের সংহতি যাতে বিনাশ না হয়—’ভাগ কর এবং শাসন কর’ পরিত্যাগ করার জন্য, পরিহার করার জন্য, বিদেশী শত্রুদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। পাকিস্তান শুধু পাকিস্থানের নাগরিকদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৪
জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয় নি—পাকিস্তানের এমন একটি সুন্দর, এমন একটি প্রগতিশীল শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে—সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে—যে সরকারের প্রতি সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষ আকৃষ্ট হবে। সূর্যের আলোর মত ইসলামী আদর্শ। ইসলাম শুধু মুসলমানের কল্যাণের জন্য আসে নি। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মজলুম মানুষের জন্য আল্লাহর অপূর্ব দান ইসলাম। ইসলামের প্রতি লক্ষ্য রেখে হযরত ওমরের আদর্শ অনুসরণ ক’রে—সাহাবা একরামদের আদর্শ অনুসরণ ক’রে এমন একটি শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে যা শুধু পাকিস্তানের জন্য মঙ্গলকর হবে না, সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মজলুম মানুষের মুক্তি আনয়ন করতে সক্ষম হবে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র যারা রচনা করবেন, তাঁরা যদি নিজেরাই চরিত্রবান না হন—মদখোর, ঘুষখোর, চোরাকারবারী, অত্যাচারী, স্বৈরাচারী সদস্য নির্বাচিত হ’লে ঘুষের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণয়ন করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না। তাই আমি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট সর্বপ্রথমেই অনুরোধ জানিয়েছিলাম, সমস্ত রাজনৈতিক দল, সংখ্যালঘু দলসমূহ, ছাত্র, মজদুর ফেডারেশন, সকল শ্রেণীর নেতৃবর্গকে একত্র ক’রে— পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের কল্যাণের জন্য কিরূপ শাসনতন্ত্র হওয়া উচিত—সকলের আলোচনার মাধ্যমে প্রেমপ্রীতি ভালবাসার সঙ্গে আলোচনা ক’রে ইত্তেফাক, এত্তেহাদের ভিতর দিয়ে অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণ করতে হবে। পরবর্তীকালে পরিষদ সভায় আনুষ্ঠনিকভাবে শাসনতন্ত্র গ্রহণ করলেই চলবে। এখন নির্বাচন আমাদের সামনে প্রায় আগত।
আমি আশা করি, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি না ক’রে, গোলাগুলি না ছুড়ে, মারামারি না ক’রে শান্তিপূর্ণভাবে যাতে নির্বাচন সমাধা হয় তজ্জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন, এই-ই আমার অনুরোধ। আমি আশা করি, সাধারণ মানুষ যেন দুর্নীতিপরায়ণ না হয়— আগামী নির্বাচনে যেন কোন ব্যক্তি টাকার মোহে অথবা কোন বস্তুর মোহে কাউকে ভোট না দেন। ভোট বিক্রি ক’রে খেলে সারাজীবন অতিবাহিত হবে না, কিন্তু যে দেশের মানুষ ভোট বিক্রি ক’রে খায়—ভোটের বিনিময়ে ঘুষ গ্রহণ করে, তাদের মত হতভাগ্য আর পৃথিবীতে কেউই নেই। শেষ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৫
সম্বল আমাদের কৃষক মজুর গরীব ভাইদের নিকট আমার বিশেষ আরজ, ভোটের মাধ্যমে যেন কেউ কোন ঘুষ দিতে চাইলেও তা’ গ্রহণ না করে। আমরা সর্বহারা—আপনারা সর্বহারা, পেটে ভাত নেই, পরণে কাপড় নেই, রোগে ঔষধ নেই, লেখাপড়া শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, তবুও আমরা বেঁচে আছি। আগামী নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে ঘুষের বিনিময়ে যদি ভোট দেয়া হয়, শেষ সম্বল চরিত্রটুকুও যদি হারিয়ে ফেলেন, তবে ভবিষ্যতে আপনাদের মুক্তির আর কোন উপায় থাকবে না। যে জাতির চরিত্র নেই, যে সম্প্রদায়ের চরিত্র নেই—তার উন্নতি কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না।
সরকারের উচিত ছিল পাবলিসিটি জারিয়াতে বিনা বেতনে প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন ক’রে এবং অন্যান্য উপায়ে প্রচার কার্যের দ্বারা ও সাধারণ মানুষকে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া—ভোট কেন দিতে হয়, ভোটের উপকারিতা কি, ভোট কিরূপ মানুষকে দিতে হবে, চরিত্রহারা মানুষকে ভোট দিলে তার পরিণাম ফল কি হবে ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব মোটেই কোন সরকার আজ পর্যন্ত পালন করে নাই। আমি আশা করি, যে সমস্ত রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছেন, প্রত্যেকেই ইসলামের পবিত্র আদর্শ অনুযায়ী চরিত্রবান মানুষকে ভোট দানের ব্যবস্থা করবেন। চরিত্রহারা মানুষ, যে ব্যক্তি স্বার্থপর, মদখোর, চোরাকারবারী, ঘুষখোর অথবা আত্মগরিমায় মত্ত—এই শ্রেণীর প্রতিনিধিদের দ্বারা পাকিস্তানের কল্যাণ কখনই হবে না। জনসাধারণের মুক্তি কখনও আসবে না। একমাত্র সমাজতন্ত্র ছাড়া পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষ, নিপীড়িত মানুষ, মজলুম মানুষের সামাজিক মুক্তি, আর্থিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি কোন কালেই আনা সম্ভবপর হবে না। ইহা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আমি আশা করি, সরকার এবং দেশের অন্যান্য ব্যক্তিরা যখন বার বার ঘোষণা করছেন আগামী নির্বাচনের দ্বারা শিক্ষার সমস্যা, ভাত-কাপড়ের সমস্যা, ভয়াবহ বন্যা প্রতিরোধের সমস্যা, উভয় পাকিস্তানের সংহতি বৃদ্ধি পাবে, পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণ হবে, পাকিস্তানের উভয় অংশের ভিতর প্রীতি ও ভালবাসা দৃঢ়তর হবে, পাকিস্তান বিদেশী শত্রুর কবল হতে সতর্ক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৬
হবে—পাকিস্তান একটি আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তাই আমি অপেক্ষা করতে চাই যে, যদি তা’ সম্ভবপর হয়, যদি রাজনৈতিক নেতাদের কথা এবং কাজ একই হয়, তা’ হ’লে সর্বপ্রথম আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাবো। আমি আশা করি, আগামীতে যারা বারসারে একতেদার অর্থাৎ শাসনকর্তারূপে নির্বাচিত হবেন, তাঁরা যদি এই সমস্ত দূর করতে না পারেন, তা’ হ’লে পুনরায় দেশবাসীর বিক্ষোভ আরও দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
কৃষক-শ্রমিকদের, সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে যার ফলে পুনরায় মিলিটারী ডাকতে হবে। আমি আশা করি যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুনঃ পুনঃ যেন মিলিটারী সৈন্যকে শাসন ব্যবস্থায় আনয়ন করতে না হয়—সৈন্যদের দায়িত্ব দেশরক্ষা করা। পাকিস্তানের সৈন্যরা শুধু পাকিস্তানের গৌরব নয়, সারা পৃথিবীর, বিশেষ ক’রে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার গৌরব; সংখ্যায় কম হলেও ১৯৬৫ সালে যে সাহস-বিক্রমের সাথে যুদ্ধ ক’রে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও আজাদী রক্ষা করেছেন, সেজন্য পাকিস্তানের জনসাধারণ চিরকাল তাঁদেরকে স্মরণ করবে এবং ধন্যবাদ দিতে থাকবে। এই সম্পদকে কোনক্রমেই নষ্ট হতে দেয়া উচিত নয়। সৈন্যদের কাজ দেশরক্ষার জন্য দৈনন্দিন শক্তি বৃদ্ধি করা এবং উচ্চ সামরিক শিক্ষা লাভ করা, তা’ না ক’রে যদি তারা পুনঃ পুনঃ দেশের সাধারণ ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা’ হ’লে আমাদের এই সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাতে বিদেশী শত্রুদের লাভ হবে। আমি আশা করি যেন আর ভবিষ্যতে কখনও সামরিক বাহিনীকে ডাকতে না হয়—সিভিল জনসাধারণের শাসন চিরকাল যাতে অক্ষুন্ন থাকে তজ্জন্য সকল শ্রেণীর মানুষ এবং সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ চেষ্টা করবেন—ইহাই আমার আন্তরিক আশা। তা’ না হ’লে আজ দুনিয়ার সমস্ত গরীব একত্র হয়ে শুধু মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি, সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট এবং সামন্তবাদীদের শাসন কিছুতেই তারা গ্রহণ করবে না। বাঁচতে হয় মানুষের মত বাঁচতে হবে, তা’ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি একান্ত আশা করি যে, পাকিস্তানের সংহতি বৃদ্ধি পাবে যদি কৃষক-শ্রমিকদের, যাঁরা সংখ্যায় ৯৫ জন, তাঁদের সকল দাবী মেনে নেওয়া হয়, তাঁদের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করা হয়। যদি দেশ হতে দুর্নীতি এবং চোরাকারবারী, টাউটগিরী, শরাবখুরী,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৭
জুয়াড়ীদের বিতাড়িত করা হয়, অথবা ধ্বংস করা হয়, তা’ হ’লেই পাকিস্তানের কল্যাণ হবে। পাকিস্তান যদিও ছোট দেশ, তবু গত যুদ্ধের সময় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, যে জাতির ভিতর ঈমান থাকে, দেশপ্রেম থাকে—সে জাতিকে দমন করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সমস্ত আমেরিকার শক্তি রাশিয়ার শক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও আমার দেশের জনসাধারণ ও মোজাহিদ সৈন্যবাহিনী আত্মত্যাগের দ্বারা যে অপূর্ব গৌরব সাধন করেছে, সে জন্য আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৬ই নভেম্বর, ১৯৭০]
আতাউর রহমান খানের বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ
পাকিস্তান জাতীয় লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান দেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৭ই নভেম্বর, ১৯৭০, তাঁর দলের কর্মসূচী বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যেমে জনগণের নিকট তুলে ধরেন। জনাব খান বলেনঃ …“আমাদের জাতীয় অগ্রগতির জন্য স্থায়ী শান্তি অপরিহার্য, তবে সে শান্তি হবে প্রকৃত ও সৃজনশীল—বাহ্যিক মেকী বা ভয়প্রসূত শান্তি নয়। আমাদের দল এও বিশ্বাস ক’রে যে, গোটা সমাজ-জীবনে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন হচ্ছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি শাসন-ব্যবস্থা, যাতে একদিকে থাকবে প্রয়োজনীয় সকল রাজনৈতিক অধিকারের সুযোগ, অপরদিকে থাকবে আপামর মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। এছাড়া বামপন্থী, উগ্র দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসীবাদের প্রবক্তারা নানা কৌশলে ও নানা শ্লোগানের সাহায্যে পাকিস্তানে নিজ নিজ প্যাটার্নের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার যে অশুভ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তার মুখোমুখি দাড়িয়ে গণতন্ত্র অর্থাৎ জনগণের শাসনকে রাহুমুক্ত করার জন্য অন্য কোন পন্থা আছে বলে আমার দল মনে করে না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭০]
উক্ত ভাষণে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কতিপয় দলের ভ্রান্ত ধারণার তিনি প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে, যারা সমাজতন্ত্রের অর্থ করেছে নাস্তিকতা, তাদের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁর মতে, ইসলাম পাকিস্তানের বিশেষ কোন শ্রেণীর বা গোষ্ঠীর মনোপলি নয়। একদল
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৮
আলেম আরেক দল আলেমকে কাফের বলে ঘোষণা ক’রে ফেলছেন— এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তাঁর দলের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে জনাব খান বলেন যে, এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ হচ্ছে মূলনীতিসমূহ এবং দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে কর্মধারাসমূহ বা পলিসি। তিনি বলেন যে, তাঁর দলের মূলনীতি হচ্ছে ৮টি। একটি পরিপূর্ণ উদারনৈতিক ও শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টির কাজে তাঁর দল নিবেদিত রয়েছে এবং বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছতে তাঁর দল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মানবেতিহাসের বৃহত্তম প্রাকৃতিক দুর্যোগ
এইভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কর্তৃক একদিকে যেমন বেতার ও টেলিভিশনের সাহায্যে, অপরদিকে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা দানের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা যখন জোরালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো— ঠিক সেই সময় বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে এল এক করুণ মুহূর্ত—এক বিষণ্ণ কাল। ১২ই নভেম্বর, ১৯৭০, এক ভয়াবহ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ মানুষের জীবনাবসান ঘটলো এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি সাধন হ’ল। মানবেতিহাসে এরূপ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুব কমই সংঘঠিত হয়েছে। শুধু বাংলার মানুষই নয়, বিশ্ববাসী জানেন যে, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটলো, তার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তানি সরকারের ক্ষমাহীন উদাসীনতা বিশেষভাবে দায়ী ছিল। সরকার সদিচ্ছা নিয়ে উদ্যোগী হ’লে লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাব ছিল অচিন্তনীয়-প্রায়। স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব বাংলাকে চিরদিন কলোনী হিসেবে দেখে এসেছে। এদেশের মানুষের জীবনের মূল্য সম্বন্ধে সরকারী আমলা ও সরকার-সংশ্লিষ্ট অপর ব্যক্তিগণ কোন দিনও সচেতন ছিলেন না। তাই মার্কিন সরকারের আবহাওয়া দফতর এই ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে (৫ই নভেম্বর) তাঁদের আবহাওয়া উপগ্রহ মারফত প্রান্ত সংকেতের ভিত্তিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদেরকে এই মহাবিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক ক’রে দেয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাতে কান দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। যদি এ বিষয়ে পূর্ব
পৃষ্ঠা নং ~ ৬১৯
থেকেই জনগণকে সতর্ক ক’রে দেয়া হত এবং জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ’ত, তা’ হ’লে হয়তো লাখো লাখো লোককে এমন করুণভাবে অতর্কিতে ঘূর্ণি ও গোর্কীর শিকার হয়ে মরতে হ’ত না। লণ্ডনের ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকা এ বিষয়ে সরাসরি পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করেছিলেন। তাঁরা স্পষ্ট বলেছেন, পাকিস্তান বেতার কর্তৃপক্ষ মার্কিন আবহাওয়া দফতর থেকে সংকেত পেয়ে উপকূলীয় ও দ্বীপাঞ্চলের জনসাধারণকে নিরাপদ স্থানে চলে যাবার সতর্কবাণী প্রচারের অনুমতি চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে—কিন্ত তা’ পান নি।
১২ই নভেম্বরের এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেও অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে হ্যারিকেন নামীয় সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে পটুয়াখালী, চালনা বন্দর প্রভৃতি উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ থেকে রাজধানী ঢাকা এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২১শে অক্টোবর চট্টগ্রাম আবহাওয়া দফতর কর্তৃক সর্বপ্রথম এই ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। অক্টোবরের ২৩ তারিখে এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রথম বারের মতো সংঘটিত হয়। পরদিন প্রকাশিত সংবাদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়ঃ “বিগত কিছু কালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মহাবিপদ সংকেতের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া গতকাল (শুক্রবার) রাত্রে প্রদেশের, বিশেষ করিয়া উপকূল অঞ্চলের কোথায় কি ঘটিয়া গিয়াছে—সর্বদিক দিয়া রাজধানী ঢাকায় একরূপ বিচ্ছিন্ন অবস্থার দরুন তাহার কোন কিছুরই সঠিক সংবাদ পাওয়া সম্ভব হয় নাই। ভাসা ভাসাভাবে যেটুকু জানা গিয়াছে বা আঁচ করা যাইতেছে, তাহাতে মনে হয়, হ্যারিকেন নামীয় সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে পটুয়াখালীতে তো বটেই, চালনা বন্দরসহ খুলনার দক্ষিণাঞ্চলেও প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হইয়াছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে অক্টোবর, ১৯৭০]
আগেই বলা হয়েছে, এ সময় শেখ মুজিব উত্তর বঙ্গে তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ব্যাপৃত ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ পেয়ে তাঁর সমস্ত কর্মসূচী বাতিল ক’রে দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন এবং এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ও পরে গভর্নর এস. এম. আহসান
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২০
ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা পরিদর্শন ক’রে ঢাকায় ফিরে এলে ২৯শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ ক’রে দুর্গত এলাকায় পর্যাপ্ত খাদ্য, নগদ অর্থ সাহায্য প্রেরণ, গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান এবং চাষীদের সকল খাজনা মওকুফের জন্য গভর্নরের প্রতি আহ্বান জানান। এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় আড়াই শতাধিক লোক নিহত হয় এবং লক্ষ লক্ষ প্রাণী আশ্রয়চ্যুত হয়ে পড়ে।
১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বিবরণ
এর কয়েকদিন পর ৯ই নভেম্বর চট্টগ্রাম আবহাওয়া দফতর থেকে আবার ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করা হয়। ১১ই নভেম্বর এই আশঙ্কা তীব্রভাবে প্রকাশ পায়। পরদিন সত্যি সত্যি এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় তীব্র আঘাত হানে। ১২ই নভেম্বর সন্ধ্যার পর পরই হ্যারিকেন নামক এই প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যায়। ঐদিন মধ্যরাত্রির পর ঢাকার সঙ্গে খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার হ্যারিকেন কবলিত এলাকাসমূহের সর্বপ্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মহাবিপর্যয়ের বিবরণ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকলে বাংলার মানুষ হতবাক হয়ে যায় ও শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। ১৪ই নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্ৰসমূহ উপকূলীয় অঞ্চলের মহাপ্রলয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে জানায় যে, ১৫০ মাইল বেগে প্রবাহিত হ্যারিকেন নামীয় এই প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ ফুট জলোচ্ছ্বাস তীব্রবেগে প্রবাহিত হবার ফলে বহু লোকালয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং খুলনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূল অঞ্চলে এক তুলনাবিহীন প্রলয়কাণ্ড ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাবার ফলে দুর্যোগের তিন দিন পরেও সঠিক বিবরণ জানা সম্ভব হয় নি। তবে বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যাদির মারফত এই মহাপ্রলয়ের খবর যতই আসতে থাকে, ধ্বংসলীলার চিত্র ততই পরিস্ফুট হতে থাকে।
ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাকের অভিমত
১২ই নভেম্বর রাত্রির ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক জানানঃ “সেই দুর্যোগময় রাত্রে উন্মত্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২১
দৈত্যরাজির তাথৈ-তাথৈ নৃত্যে প্রলয় বিষাণ বাজাইয়া সামনে যা কিছু পড়িয়াছে, দুমড়াইয়া, মুচড়াইয়া, ভাঙ্গিয়া, ভাসাইয়া দিয়া ধ্বংসের সেই অপদেবতা সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এক সময় বিদায় নিয়াছে, কিন্তু খুলনা হতে কক্সবাজার পর্যন্ত সুবিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলের সর্বত্র ছড়াইয়া আছে মৃত্যু আর ধ্বংসের বিভীষিকাময় স্বাক্ষর—বাংলার উপকূলে নামিয়া আসিয়াছে মৃত্যুর স্তব্ধতা।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই নভেম্বর, ১৯৭০]
দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার মন্তব্য
শতাব্দীর প্রচণ্ডতম নজিরবিহীন এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সর্বগ্রাসী তাণ্ডব সম্পর্কে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকা ‘বাংলার মানুষ কাঁদো’ এই শিরোনামে এক হৃদয়বিদারক বিবরণে লিখেনঃ
“পূর্ব-বাংলা, তুমি কাঁদো। কাঁদো বাংলার মানুষ। এখন কান্না ছাড়া আর তোমার জন্য কি বাকী আছে বলো? খড়কুটোর মত যারা নোনা পানির টানে সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, তাঁদের জন্যে কাঁদো। লাখো মানুষের গলিত শব ছড়িয়ে আছে জনপদে, পানিতে কচুরীপানার মত ভাসছে অচেনা শবের মিছিল তাঁদের জন্যে কাঁদো, বাংলা—কাঁদো।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ই নভেম্বর, ১৯৭০]
দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদকীয়
১৫ই ডিসেম্বরে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ “এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে যাহারা প্রাণ হারাইয়াছেন, তাঁহাদের জন্য শোক প্রকাশ করার মত ভাষা আমাদের জানা নাই। এই মুহূর্তে আমরা সকলেই শোকাভিভূত। যাহারা আজ আত্মীয়হারা, গৃহহারা তাহাদের আমরা আমাদের আন্তরিক সমবেদনা জানাইতেছি, আজিকার এই দুর্যোগ জাতীয় দুর্যোগরূপেই বিবেচিত হবে। এই শোক জাতীয় শোক রূপেই অনুভূত হইবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ই নভেম্বর, ১৯৭০]
এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী এবং চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল এবং হাতিয়া, ভোলা, রামগতি, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী প্রভৃতি দ্বীপসমূহ দলিত মথিত হয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২২
একটি বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। হাতিয়া, ভোলা, রামগতি, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চলের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আণবিক বোমা বিধ্বস্ত হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞকেও ছাড়িয়ে যায়।
বিধ্বস্ত হাতিয়া
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের রাত্রির পর নোয়াখালী জেলার উপকূলের কোলাহলময় হাতিয়া দ্বীপটিতে ভয়াবহ নীরবতা নেমে আসে। দৈর্ঘ্যে ৪২ মাইল এবং প্রস্থে ৭ মাইল আয়তন বিশিষ্ট হাতিয়া সে ভয়াল রাতে ২০ থেকে ৩০ ফুট পানির নীচে চলে যায়। ফলে হাজার হাজার নর-নারী-শিশুর মৃত্যু ঘটে, হাজার হাজার মানুষ ও প্রাণী ভেসে যায়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাবার জন্য হাতিয়ার চার দিকে দৈর্ঘ্যে ৮২ মাইল ব্যাপী ১৪ ফুট উঁচু বেড়ী-বাঁধ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস ১৪ ফুট উঁচু বেড়ী-বাঁধ ডিঙিয়ে সে ভয়াল রাতে হাতিয়াকে গ্রাস করে। ১৩ই নভেম্বর গভীর রাতে প্রাপ্ত খবরে পূর্বদেশ জানানঃ “হাতিয়ার জনসংখ্যার কমপক্ষে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয়েছে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৪ই নভেম্বর, ১৯৭০]
বেসরকারী সূত্র থেকে প্রাপ্ত খবরে পূর্বদেশ পত্রিকায় আশঙ্কা প্রকাশ ক’রে বলা হয় যে, ১ লাখ ৭৯ হাজার জন-অধ্যুষিত এই দ্বীপের “প্রায় ৯০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৪ই নভেম্বর, ১৯৭০]
পটুয়াখালী ও ভোলা
এই মহাপ্রলয়ের ভয়াল ছোবলে পটুয়াখালী জেলার ১৩টি দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞের ফলে কলকোলাহল মুখরিত ভোলা দ্বীপ নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। পুলিশ টেলিকম্যুনিকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে বিধ্বস্ত ভোলার সংবাদ প্রথমে আসে ১৫ই নভেম্বর। জনৈক নিজস্ব সংবাদদাতার প্রেরিত সংবাদের বরাত দিয়ে পূর্বদেশ পত্রিকায় খবর দেয়া হয়ঃ “বৃহস্পতিবারের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সর্বনাশা জলোচ্ছ্বাসে বরিশাল উপকূলের জনবহুল দ্বীপ ভোলায় প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে। তিরিশ ফুট উঁচু প্লাবনের বিষাক্ত ফণা বিস্তার ক’রে রাক্ষুশী বঙ্গোপসাগর ভোলার সষুপ্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৩
মানুষগুলোকে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিয়ে গেছে। ভোলা থানার পূর্বাংশ, দৌলতখান ও তজমুদ্দী থানায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ লোক নেই।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ই নভেম্বর, ১৯৭০]
পটুয়াখালী এবং ভোলায় মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ বলে দৈনিক পাকিস্তান-এ ২১শে নভেম্বর প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়ঃ “কেবলমাত্র ভোলাতেই ২লক্ষ লোকের প্রাণহানী ঘটে বলে বেসরকারী সূত্রে প্রাপ্ত খবরে উল্লেখ করা হয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে নভেম্বর, ১৯৭০]
সে ভয়াল রাতে বঙ্গোপসাগরের হিংস্র জলোচ্ছ্বাসে নোয়াখালী জেলার রামগতি দ্বীপের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল “মৃত মানব সন্তানের বিরান জনপদে পরিণত হয়।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ই নভেম্বর, ১৯৭০]
সরকারী সূত্রে রামগতি দ্বীপে মৃতের সংখ্যা একুশ শত বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু রামগতি দ্বীপের চরকাদিরা ইউনিয়নের জনৈক চেয়ারম্যানের নিকট থেকে প্রাপ্ত খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বদেশ জানানঃ “একটি একটি ক’রে গুণে এখন পর্যন্ত দশ হাজার মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এখনো কত মানুষ মরে হেজে পানির তলায় রয়েছে তার সীমা সংখ্যা নেই। প্রাথমিক হিসেব অনুযায়ী কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ই নভেম্বর, ১৯৭০]
সন্দ্বীপ
চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে সব চাইতে ক্ষতির সম্মুখীন হয় সন্দ্বীপ। ১৬ ফুট উঁচু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রায় দু’লাখ জন-অধ্যুষিত সমগ্র সন্দ্বীপকে গ্রাস করে। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা কর্তৃক (১৫ই নভেম্বর) প্রেরিত সংবাদে সন্দ্বীপে ১৫ হাজার লোক মারা গেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সন্দ্বীপস্থ সংবাদদাতার প্রেরিত সংবাদের উল্লেখ করে পূর্বদেশ পত্রিকা জানানঃ “সন্দ্বীপে পাঁচ হাজারের অধিক লোক মারা গেছে এবং প্রায় দশ সহস্রাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৭ই নভেম্বর, ১৯৭০]
চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ দ্বীপ ছাড়াও কুতুবদিয়া, মহেশখালী, রামু উখিয়া, টেকনাফ প্রভৃতি অঞ্চল সর্বগ্রাসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৪
শেখ মুজিবের সাংবাদিক সম্মেলন
খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২ হাজার ৩৩৮ বর্গমাইলব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলের ৬ শতাধিক দ্বীপে প্রায় ৮ লাখ লোক মারা গেছে বলে ১৯৭০ সালের ১৯শে নভেম্বরের দৈনিক পাকিস্তান-এ খবর প্রকাশিত হয়। এই সময় ৯ দিনব্যাপী ঘূর্ণিবাত্যা ও জলোচ্ছ্বাস উপদ্রুত সমগ্র এলাকা সফর শেষে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বেদনার্ত হৃদয়ে বলেনঃ “সেই সর্বনাশা বৃহস্পতিবারের কালরাতে ঘূর্ণিঝড় আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৭শে নভেম্বর, ১৯৭০]
খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের উল্লেখিত প্রায় দশ লক্ষ আদম সন্তানের জীবনাবসান ছাড়াও অগণিত গবাদিপশু ভেসে যায়। সমস্ত উপকূলীয় অঞ্চলের ফসল বিনষ্ট হয়।
সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাবার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের ওয়াপদা নির্মিত বিস্তীর্ণ বেড়ীবাঁধ বহু এলাকায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই বাঁধ কোন কোন এলাকায় ভেঙে পড়ে, আবার কোথাও কোথাও ফাটলের সৃষ্টি হয়ে মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রায় তিনশো কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এ. আই. ডি-র সহযোগিতায় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় এই বাঁধ নির্মিত হয়েছিল।
বি. বি. সি’র মন্তব্য
২১শে নভেম্বর বি.বি.সি. সান্ধ্য অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক বুলেটিনে “দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের এই সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবলীলাকে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করে।” শেখ মুজিব এই সময় নির্বাচনী প্রচারণায় খুলনায় জনসংযোগে ব্যস্ত ছিলেন। ১৭ই নভেম্বর তিনি তাঁর সমস্ত কার্যক্রম বাতিল ক’রে দিয়ে উদ্বেগাকুল হৃদয়ে দুর্গত এলাকায় চলে গেলেন এবং ক্রমাগত ৯ দিন যাবৎ বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা ও নোয়াখালী জেলার ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি তাঁর দলের এবং ছাত্রলীগের সকল কর্মীকে সর্বশক্তি দিয়ে জনসেবার উদ্দেশ্যে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে নির্দেশ দিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৫
বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি সকাতর অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন যাবতীয় সাহায্য-সামগ্রী দ্রুত দুর্গত এলাকায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
দুর্গত মানুষের সেবার জন্য বিদেশ থেকে যথেষ্ট সাহায্য-সামগ্রী পাকিস্তানে পৌঁছে। কিন্তু তা’ যথাযথ কাজে লাগাতে সরকার উদাসীনতার পরিচয় দেন। একদিকে মানুষ যখন অন্ন চাই, বস্ত্র চাই বলে হাহাকার করছে, ঠিক এই সময়ে সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট কর্মচারী ও সাহায্য বন্টনকারীরা রিলিফ-সামগ্রী আত্মসাৎ-এ ব্যস্ত থাকে। এ নিয়ে সে সময় পত্র-পত্রিকায় অনেক অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে তার সদুত্তর পাওয়া যায় নি।
এই ঘটনার তিন বছর পরে জনৈক সুধী সাংবাদিক ‘স্পষ্টভাষী’ এই। ছদ্মনামে ইত্তেফাকের ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ শিরোনামে যে সব কথা বলেছেন তা’ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। [ দ্রষ্টব্যঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই নভেম্বর, ১৯৭৩]
ঘূর্ণিদুর্গত মানুষের সেবার জন্য সরকার সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। বিদেশী সৈন্যও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু কতিপয় রাজনীতিবিদ এ নিয়ে বেশ হৈ চৈ শুরু ক’রে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ঢাকায় এসে হেলিকপ্টারে চেপে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের নিকট সেবা-কার্যের তৎপরতার প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ হয়ে পড়েন। এর পশ্চাতে তাঁর একটি মানসিক কারণ ছিল। কয়েকদিন পূর্বে এই প্রলয়কাণ্ডের পরেই ইয়াহিয়া চীন থেকে ফেরার পথে ঢাকায় অবতরণ করেন এবং এ দেশের জনগণ সম্পর্কে কোন খোঁজ-খবর নেবার প্রয়োজনবোধ না করেই পরবর্তী বিমানে তিনি পশ্চিমে চলে যান। দীর্ঘদিন কোন মন্ত্রী পাঠিয়ে খোঁজ নেবার প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন নি। এই দুর্বলতা ঢাকবার জন্যই তিনি সোচ্চার হয়ে দেশবাসীকে ও বিশ্ববাসীকে জানাতে চাইলেন যে, আসলে তিনি বা তাঁর সরকার চুপ ক’রে নেই—সেবা-কার্য যথাযথ ভাবেই চলছে। কিন্তু জনগণ তাঁর নির্মম উদাসীনতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
দুর্গত এলাকা সফরঃ সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব
শেখ মুজিবও বিধ্বস্ত এলাকা সফর শেষে ২৬শে নভেম্বর জনাকীর্ণ এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। প্রায় ৭৫ জন বিদেশী ও অনুরূপ দেশীয় সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ঢাকা আওয়ামী লীগ অফিসে আয়োজিত উক্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৬
সম্মেলনে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার বিবরণ দিয়ে সংবাদপত্রগুলোতে লেখা হ’লঃ “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত প্রদান থেকে শুরু ক’রে রিলিফ কার্যক্রম পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড়জনিত পরিস্থিতি সংক্রান্তি দায়িত্ব পালনে সরকারের অবহেলা ও সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ করেন।”
এ. পি. পি. পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, ন’দিনব্যাপী উপদ্রুত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, “বিপর্যয়ের ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি ব্যাপকভাবে উদ্ধার ও রিলিফ কার্য শুরু হ’ত, তা’ হ’লে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেয়েও অনাহার ও চিকিৎসার অভাবে যে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হ’ত। তিনি বলেন, নৌ-বাহিনী যদি অবিলম্বে উপদ্রুত এলাকায় যেত, তা’ হ’লে তারা সাগরে ভেসে যাওয়া হাজার হাজার লোককে বাঁচাতে পারতো।
শেখ মুজিব বলেন, এ ধরনের রিলিফ ও উদ্ধার কার্য শুরু করতে ব্যর্থ হওয়া ক্ষমাহীন অপরাধ। আওয়ামী লীগ প্রধান আরো বলেন, এই নিষ্ঠুর অবহেলার কাহিনী এখানেই শেষ নয়। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, তিনি যে সমস্ত উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছেন, সে সমস্ত স্থানে ঘূর্ণিঝড়ের দশদিন পরেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এক কণা রিলিফও পৌঁছেনি। তিনি বলেন, উপদ্রুত জনগণ গাছের শিকড় খেয়ে প্রাণ ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাপক আকারে আমাশয় দেখা দিয়েছে এবং মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, প্রদেশের জনগণ উচ্চৈস্বরে প্রতিবাদ জানানোর পরই রিলিফের কাজ শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন কিছু তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু হেলিকপ্টারও চোখে পড়ে। বিমান থেকে সাহায্যদ্রব্য নিক্ষেপের যে কার্যক্রম ইতিপূর্বে কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল এখন তা’ শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
উপদ্রুত জনগণের জন্য রিলিফ দ্রব্যের পরিমাণ সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে রিলিফ দ্ৰব্য না আসলে রিলিফ দ্রব্যের পরিমাণ নিতান্তই অপ্রতুল হ’ত। তিনি বলেন, বাংলাদশের উপদ্রুত জনগণের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৭
প্রাণ রক্ষার বিষয়টি কেবল বিশ্ববাসীর দয়ার উপর নির্ভর করছে। এটা আমাদের সরকারের জন্য দুঃখজনক দুর্নামস্বরূপ।
আওয়ামী লীগ প্রধান দুঃখ প্রকাশ করেন যে, ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত জনগণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের দশদিন সময় লেগেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের তুলনা করেন।
কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাদের বিষয় উল্লেখ ক’রে শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য আমি তাদেরকেই দায়ী করছি। এর পরিণামে আমরা আজ সহজেই সব রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকারে পরিণত হচ্ছি। আমাদের দশ লাখ লোক মারা গেছে, আর উপদ্রুত এলাকায় তিরিশ লাখ লোক মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তিনি বলেন, বিপর্যয়ের দু’দিন পূর্বে তথ্য সরবরাহ করা সত্ত্বেও উপদ্রুত জনগণকে আংশিক নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া দূরে থাকুক, সুষ্ঠুভাবে তাদের কোন হুঁশিয়ারি সঙ্কেতও দেয়া হয় নি।
শেখ মুজিব উপদ্রুত এলাকায় খাবার পানির সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় রাজনৈতিক নেতার নামোল্লেখ ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, জাতীয় সংহতির প্রবক্তা ও ইসলামের স্বনির্বাচিত ধ্বজাধারী মওলানা মওদুদী, খান আবদুল কাইয়ুম খান, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ—তাঁরা আজ কোথায়? উপদ্রুত জনগণের প্রতি সহানুভূতি জানানোর উদ্দেশ্যে একদিনের জন্যও তাঁরা বাংলাদেশে আসার সময় পান নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, এটা ভাগ্যের পরিহাস যে, পশ্চিম পাকিস্তানে যখন খুব ভাল শস্য ফলেছে তখন আমাদের কাছে প্রথম খাদ্যশস্যের চালান এসেছে বিদেশ থেকে। যখন পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রয়েছে, তখন পটুয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের লাশ কবর দিতে হচ্ছে বৃটিশ মেরিনদের। তিনি এটাকে আমাদের জন্য লজ্জাকর বলে উল্লেখ করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, রিলিফ কার্যের জন্য বিদেশী সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে। তিনি বলেন, তাদের কাজ শেষ হ’লে তারা ফিরে যাবেন বলে আমরা আশা করি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৮
শেখ মুজিব অভিযোগ করেন যে, রিলিফ দ্রব্যের সুষ্ঠু বণ্টনে নোয়াখালীতে জেলা কর্তৃপক্ষ অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন যে, একজন ছাত্রনেতা রিলিফ কাজের জন্য পরিবহন দেওয়ার অনু্রোধ জানাবার জন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর নিকট গেলে ঝগড়ার সৃষ্টি হয় এবং পরিণামে ছাত্রনেতাটিকে চড় মারা হয়। এর পর ছাত্রদের গ্রেফতার ও হয়রানী চলতে থাকে বলে তিনি জানান।
উপদ্রুত ব্যক্তিদের সব রকম রিলিফ প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, কয়েকদিন দেরী করলে রিলিফ নেওয়ার জন্য সেখানে কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।
শেখ মুজিব বলেন যে, দেশে জনগণের সরকার থাকলে সুষ্ঠু রিলিফ কাজের জন্য হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা সম্ভব হ’ত এবং জনগণের সরকারের কাছে জবাবদিহির ভয়ে আমলারাও এরূপ উদাসীন থাকতে পারতেন না।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য দায়ী আমলাদের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, জনগণের সরকার ক্ষমতায় গেলে তারা প্রয়োজন হ’লে এ সমস্ত আমলার বিচার করবেন।
জনগণকে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য উপদ্রুত এলাকায় ব্যাপক ভিত্তিতে বাধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় থেকে জনগণকে রক্ষা করতে পারে এমন আশ্রয়স্থল নির্মাণ ও উন্নততর হুঁশিয়ারি সঙ্কেত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন যে, উপদ্রুত এলাকায় বেঁচে থাকা জনগণকে সমবায়ের ভিত্তিতে সংগঠিত ক’রে নতুন জীবন গড়ে তোলার জন্য তাদের সব রকম কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
শেখ মুজিব বলেন, আমরা স্বায়ত্তশাসন অর্জনে সক্ষম হলেই কেবল তা’ সম্ভব হবে। আমরা আজ এই সংকল্প করছি যে, উপকূলীয় এলাকার আমাদের ভাইদের উপর যা ঘটেছে, ভবিষ্যতে তা’ আর ঘটতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক বিপর্যয় বাংলাদেশের সাতকোটি মানুষের করুণ অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অবর্ণনীয় বলে উল্লেখ ক’রে আওয়ামী
পৃষ্ঠা নং ~ ৬২৯
লীগ প্রধান বলেন যে, পটুয়াখালী, ভোলা ও নোয়াখালীর অনেক স্থানেই মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগের বেশী রক্ষা পায় নি। তিনি বলেন যে, বেঁচে যারা আছেন তাঁরাও আজ সম্পূর্ণ নিঃস্ব। আহতদের ক্ষতস্থানগুলোতে পচন ধরেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ মুজিব বলেন যে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও প্রাণহানির সংখ্যা নিরূপণের জন্য কোন উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালানো হয় নি। তিনি বলেন যে, দুর্গত এলাকায় রিলিফ-কার্য পরিচালনাকারী বহুসংখ্যক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী পরিবহনের অভাবে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
শেখ মুজিব বলেন যে, তথাকথিত দুর্গম এলাকায় রিলিফ দ্রব্য পৌছানোর জন্য সরকার বিশেষ কোন চেষ্টাই করেন নি। তিনি বলেন যে, একটা ছোট ভাঙ্গা লঞ্চে ক’রে তিনি উপদ্রুত এলাকায় প্রায় সবখানেই যখন যেতে পেরেছেন, তখন বিপর্যয়ের দশ দিন পরেও উপদ্রুত এলাকায় রিলিফ না পৌঁছানোর কোন যুক্তি নেই।
শেখ মুজিব বলেন যে, বিশ্বের যে সমস্ত দেশ এই বিপদের দিনে দুর্গতদের সাহায্য দিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থাকা সত্ত্বেও রিলিফ কাজের জন্য আমাদের যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অন্যান্য রাষ্ট্রের হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেখ মুজিব বলেন যে, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ব্যক্তি ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান উপদ্রুতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করলেও আমাদের জনগণের রক্ত শোষণ ক’রে ধনী হওয়া ২২-পরিবারের কেউ উল্লেখযোগ্য সাহায্য দেয় নি।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বস্ত্র মিলগুলো বাংলাদেশকে প্রধান বাজার হিসেবে ব্যবহার করলেও তারা নিহতদের জন্য এক গজ কাফনের কাপড়ও দেয় নি।
তিনি প্রশ্ন করেন, এজন্যই কি আমরা গত দু’দশক যাবৎ আমাদের সম্পদের শতকরা ৭২ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করেছি। এ জন্যই কি আমরা আমাদের বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ দেশরক্ষা খাতে ব্যয় করেছি? এ জন্যই কি বাংলাদেশের পাটচাষীদের অনাহারের বিনিময়ে করাচী ও লায়ালপুরের পুঁজিপতিদের সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছে?
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩০
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সংগ্রাম ক’রে বেঁচে আছি। আজ স্বাধীনতার ২৩ বছর পর বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা পর্যন্ত প্রণীত হয় নি। দশ বছর আগে এমনি ঘূর্ণিঝড় হলেও, দশ বছর পর সেই একই এলাকার লোক ঘূর্ণিঝড়ে আরো হাজারগুণ বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন যে, ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল নির্মাণের জন্য গত দশ বছরেও ২০ কোটি টাকা পাওয়া গেল না। অথচ ইসলামাবাদে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণের জন্য দু’শো কোটি টাকারও বেশী পাওয়া গেছে। শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বেই পশ্চিম পাকিস্তানে ‘মঙ্গলা’ ও ‘তারবেলা বাঁধ নির্মাণের জন্য শত কোটি ডলার মঞ্জুর করা সম্ভব হয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৭শে নভেম্বর, ১৯৭০]
লক্ষ লক্ষ লোকের অকাল মৃত্যুতে মানব দরদী আর এক নেতা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় উপদ্রুত অঞ্চলে পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে পতেঙ্গার কাছে তাঁর জাহাজ আটকে রাখা হয়েছিল। সরকারী আমলাদের এই ষড়যন্ত্রে গণমনে তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সরকারী আমলারা ভাসানী সাহেবের পথরোধ করতে পারে নি। উপদ্রুত অঞ্চল থেকে ফিরে এসে ১৯৭০ সালের ২৩শে নভেম্বর পল্টনের এক জনসভায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর এই ভাষণ নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এতে যেমন সমগ্র পরিস্থিতির একটি চিত্র পাওয়া যাবে, তেমনি এই ঘটনাকে মওলানা ভাসানী যে কিভাবে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, তারও প্রমাণ মিলবে। তিনি পল্টনে এসেই নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর দ্বিধান্বিত মনোভাব ব্যক্ত করলেন। তাঁর সেই দরদমাখা ভাষণটি পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত হ’লঃ
“মওলানা ভাসানী মানব-ইতিহাসের বৃহত্তম দুর্যোগে বিধ্বস্ত পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের সহায়-সম্বলহীন লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষের সাহায্য ও পুনর্বাসনে সর্বশক্তি ও সম্পদ নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য প্রতিটি বাঙালীর প্রতি আকুল আবেদন জানান।
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিরান বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল এলাকা সফর শেষে গতকাল পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩১
বক্তৃতাকালে মওলানা ভাসানী বলেন, বাঙালীর জীবনে আজ মহা দুঃখের দিন। আমাদের জীবনে নেমে এসেছে মহা দুর্যোগ। বিধ্বস্ত, বিরান, উন্মুক্ত আকাশের নীচে আমাদের অগণিত মা-বোন উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে। বিরান জনপদে কোথায়ও কাপড় নেই, এই শীতের দিনে ধনী-গরীব কারও মাথা গোঁজার ঘর নেই।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মওলানা ভাসানী বলেন, হজরত নূহের জামানার পর এতবড় প্রলয় কাণ্ড মানুষের ইতিহাসে ঘটে নি। পূর্ব বাংলার উপকূলের ১০ থেকে ১২ লক্ষ নর-নারী ও শিশু এই দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু মহা ধ্বংসযজ্ঞের ১০ দিন পরও প্রায় ৪ লক্ষ লাশ পড়ে আছে—এদের দাফনের কোন ব্যবস্থা নেই। গলিত লাশ ও মরা পশুর লাশের দুর্গন্ধের মধ্যে যারা এখনও আর্তনাদ করছে, আল্লাহর কুদরতেই তারা বেঁচে আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৪শে নভেম্বর, ১৯৭০]
দক্ষিণ বাংলার ঘূর্ণিঝড়ের সুযোগ গ্রহণ করলেন গণ-সমর্থন-বিচ্যুত রাজনীতিবিদগণ। এঁদের মধ্যে মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, আতাউর রহমান খান, ওয়ালী খান, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ প্রমুখ একবাক্যে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবী জানালেন। এই সমস্ত রাজনীতিবিদ গণস্বার্থের উর্ধ্বে স্থাপন করলেন দলীয় স্বার্থ। জনগণ হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করলে যে দেশের কোন সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়—নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে জনগণের সমবেত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগও যে ততই বিলম্বিত হবে, এই সত্যটিকে তাঁরা দলীয় স্বার্থে চাপা দিয়ে বসলেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যে বিশ্লেষণ প্রদান করলেন এবং যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন তা’ নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বললেন, “জনগণকে অবশ্যই সর্বময় ক্ষমতা অর্জন করিতে হইবে। নির্বাচন হয় ভালো, আর যদি তা’ না হয়—জাগ্রত জনগণের আত্মশক্তিতেই উহা আদায় করিতে হইবে।” নির্বাচন স্থগিত রাখা হ’লে তিনি কি করবেন, জানতে চাওয়া হলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে তিনি তাঁর দলীয় সদস্যদের সাথে আলোচনা করবেন। তবে কোন কিছুকেই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না বলেও তিনি জানান।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩২
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এখনো এক ষড়যন্ত্র চলছে। আমলাতন্ত্রী, কায়েমী স্বার্থবাদী, ক্ষমতাসীন মহল আর সেই পুরানো চক্রই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু তারা জানেনা, নির্বাচন নিয়ে যদি কোন খেলা শুরু হয়, তা’ হ’লে তা’ আগুন নিয়ে খেলারই সামিল হবে।
তিনি বলেন, যে সব রাজনৈতিক নেতা নির্বাচন স্থগিত রাখার কথা বলছেন, তাঁরা আসলে নিজেদের নেতৃত্ব রক্ষার জন্যে সামরিক সরকারকেই স্থায়ী করতে চায়। সাতই ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’লে এসব নেতা আর তাঁদের দলের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এমনকি তাঁদের বিবৃতি দানের অধিকারও নস্যাৎ হয়ে যাবে। খারাপ ছাত্রেরা যেমন পরীক্ষা পিছানোর দাবী তোলে, এ-সব নেতাও তেমনি নির্বাচন পিছানোর ধুয়া তুলেছেন।”
নির্বাচনের মাধ্যেমে ৬-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায় করা সম্ভব হবে কি না জানতে চাওয়া হ’লে শেখ মুজিব বলেন, “জনগণ যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দেয় তা’ হ’লে তা’ আদায় হবেই—আমি এই নির্বাচনকে ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ব্যাপারে গণভোট বলেই মনে করি।” শেখ মুজিবুর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি এবং সমস্ত রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারেরও দাবী জানান।
৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবী পূরণ না হ’লে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আন্দোলন করবেন কি না জানতে চাওয়া হ’লে শেখ সাহেব বলেন, “আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানিয়েছি, স্বাধীনতার নয়। আমরা পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে চাই। তারা যদি তা’ মেনে না নেয়, তা’ হ’লে জনগণই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাঙালীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের লাখো লাখো ভাইকে বিসর্জন দিয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তির জন্য আমরা আরো দশ লাখ প্রাণ বিসর্জন দিতে পারব।”
আরো দশ লাখ লোকের প্রাণ দেওয়ার কথা বলতে তিনি দৈহিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা বোঝাতে চেয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হ’লে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, “আমি এখনই তা’ বলছি না—ভবিষ্যৎই তা’ বলবে। আমার দল একটি গঠনতান্ত্রিক দল। আমরা নিয়মতান্ত্রিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৩
অন্দোলনই শুরু করবো। কিন্তু তারা যদি অনিয়মতান্ত্রিক পথ বেছে নেয়, তা’ হ’লে জনগণ তাদের নিজেদের পথই অনুসরণ করবে।”
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, “আমরা এখন নিশ্চিত যে, প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে ৬-দফা আর ১১-দফার ভিত্তিতে আমাদের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতেই হবে। আমাদের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের প্রাথমিক ক্ষমতা থাকতেই হবে। সরকার যথাযথভাবে সাহায্য দানের কাজ পরিচালনা করতে না পারায় এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, আমাদের শাসনের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে, আমাদেরই নিতে হবে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত—কি ভাবে আমাদের সম্পদ ব্যবহৃত হবে, তাও ঠিক করতে হবে আমাদেরই—কোথা থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, কি ভাবে সে অর্থ ব্যবহার করা হবে তাও আমরাই ঠিক করবো। পশ্চিম পাকিস্তানী আমলা, পুঁজিপতি আর সামন্তবাদী স্বার্থের স্বেচ্ছাচারী শাসনের দুর্ভোগ আমরা আর পোহাব না।
শেখ মুজিবুর রহমান আরো বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক, কিংবা নির্বাচন ব্যর্থ হ’লে জাগ্রত জনতার শক্তির মাধ্যমেই হোক, ক্ষমতা জনগণকে জয় করতেই হবে। শক্তিশালী কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা জনগণের যথেষ্ট হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের দাবীকে আর অস্বীকার করা যাবে না। জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করা যায় বলে যারা মনে করেন, তাঁরা সর্তক হোন-বাংলাদেশ আজ জেগেছে। নির্বাচন যদি বানচাল করা না হয় তা’ হ’লে নির্বাচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার রায় জানিয়ে দেবে। আর নির্বাচন যদি বানচাল হয়, ঝড়ে নিহত দশ লাখ লোকের কাছে ঋণী বাংলাদেশের জনগণ তা’ হ’লে, আমরা যাতে মুক্ত জনতা হিসেবে বাঁচতে পারি এবং বাংলাদেশ যাতে নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করতে পারে, তার জন্যে প্রয়োজন হ’লে আরো দশ লাখ প্রাণ বিসর্জন দেবে।
আওয়ামী লীগ প্রধান আরো বলেন, বর্তমানের অভিজ্ঞতায় প্রতিটি বাঙালী হাড়ে হাড়ে এই মৌলিক সত্যটিই উপলদ্ধি করেছে যে, এযাবৎ আমাদের একটি উপনিবেশ, একটি বাজার হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। একটা স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের জন্মগত অধিকার থেকেও আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। সমস্ত কিছুর সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে রাওয়ালপিণ্ডি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৪
আর ইসলামাবাদে। সমস্ত ক্ষমতাই ন্যস্ত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার আর তার আমলাদের হাতে।”
একজন বিদেশী সাংবাদিক পাকিস্তানের অস্তিত্বের চেয়ে ‘বাংলার’ টিকে থাকাকেই তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, “আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা পাকিস্তানী, সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করা যেতে পারে না।”
দেশের ঐক্য সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সবার স্বার্থকে স্বীকৃতি দিলেই ঐক্য হতে পারে, তারা যদি আমাদের স্বার্থকে অবহেলা বা উপেক্ষা করে, আমাদের যদি একটি কলোনী আর একটি বাজার হিসেবে ব্যবহার করে তা’ হ’লে আর ঐক্য থাকে কি করে? আমরা মনে করি, আমাদের একটি বাজার হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৭শে নভেম্বর, ১৯৭০]
ওয়ালী ন্যাপের সিদ্ধান্ত
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে রিক্ত ও নিঃস্ব জনগণকে বাঁচাবার জন্যে মোজাফফর আহমদ দেশের জনগণের নিকট আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, দেশের এই সঙ্কটজনক অবস্থায় নির্বাচনের কথা চিন্তাই করা যায় না। কারণ যেখানে লাখ লাখ লোক অকালে এই মহাভয় ঘূর্ণিঝড়ের শিকারে পরিণত হয়েছে যেখানে অসংখ্য লোক অনাহারে, রোগে, শোকে মৃত্যুপথযাত্রী, সেখানে এই আর্তের সেবাই প্রধানতম মানব-ধর্ম। তাই তিনি তাঁর পার্টির প্রধান হিসেবে সরকারের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিলেন যেন এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। ১৯৭০ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি এবং সৈয়দ আলতাফ হোসেন তাঁদের দলের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। বিবৃতিতে জনাব মোজাফফর আহমদ বলেনঃ “গত ১২ই নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব বাংলার দশ লাখ নরনারী-শিশুর মৃত্যু ও ২৫/৩০ লাখ মানুষের মরণোন্মুখ অবস্থার দরুন নির্বাচন কিছুদিন পিছাইয়া, এখন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলির সমস্ত শক্তি পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষকে রক্ষা করিবার জন্য ন্যাপের পক্ষ হইতে আমরা পূর্বে আহ্বান জানাইয়াছিলাম। কিন্তু সরকার তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়া নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন। এই অযৌক্তিক ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৫
অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। এখনও লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, চিকিৎসাহীন হইয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছে—এখনও তাহাদের নিকট রিলিফ পৌঁছে নাই। এমনকি, সরকার রিলিফের জন্য বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী সৈন্যবাহিনীকেও আহ্বান করিয়া আনিয়াছেন। তাই বর্তমান পরিস্থিতি কোন মতেই জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ ও সময় হিসাবে বিবেচিত হইতে পারে না। অথচ এই অবস্থাতেও সরকার ৭ই ডিসেম্বর তারিখেই নির্বাচন দেশবাসীর ঘাড়ে চাপাইয়া দিতেছেন। ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, মহাপ্রলয় বিধ্বস্ত এলাকাগুলির জাতীয় পরিষদে ৯টি আসনে নির্বাচন স্থগিত রাখা হইয়াছে। এই নির্বাচনগুলি অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হইতে পারিবে না বলিয়া প্রেসিডেন্ট নিজেই বলিয়াছেন। ইহা সত্ত্বেও কোন যুক্তিতে ও কি উদ্দেশ্যে সরকার ৭ই ডিসেম্বর তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়াছেন তাহা হৃদয়ঙ্গম করা দুষ্কর।
অতএব, আমরা পুনরায় দাবী করিতেছি যে, যেহেতু পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গত জনগণকে রক্ষা করিবার কাজকে এখনই অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন এবং যেহেতু এখন নির্বাচন হইলে বিধ্বস্ত এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদকে বেকার বসিয়া থাকিতে হইবে—সেহেতু অন্ততঃ পূর্ব বাংলার নির্বাচন ৭ই ডিসেম্বরে না করিয়া পরে সকল আসনে একই সঙ্গে করা হউক। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের আবেদনে সাড়া দিবেন। যদি আমাদের এই আবেদন অগ্রাহ্য করিয়া সরকার মহাপ্রলয়ে—পূর্ব বাংলার জনগণের এই বিপর্যয়ের সময়ে—সেই বিপর্যয়ের মাত্র তিন সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহা হইলে সরকারের গণবিরোধী চরিত্রই আবার জনগণের সামনে ফুটিয়া উঠিবে। যে সকল দল নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী তুলিয়া গণবিরোধী সরকারের ঐ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত লইতে সাহায্য করিয়াছে তাহারাও যে পূর্ব বাংলার লাখ লাখ দুর্গত মানুষকে রক্ষা করার চাইতে মন্ত্রিত্বের গদিকে বড় মনে করে তাহাও তাহাদেরই দাবী হইতে জনগণের নিকট পরিষ্কার হইয়াছে।”
[ দৈনিক সংবাদ, ৩০শে নভেম্বর, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৬
মানবেতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব বাংলার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো এবং এই পরিস্থিতিকে যে আন্তরিকতা নিয়ে মোকাবিলা করবার প্রয়োজন ছিল, পূর্বেই বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের তা’ ছিল না। প্রাকৃতিক শক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু জনশক্তিকে উপেক্ষা করার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকার তা’ অনুধাবনে ব্যর্থ হ’ল। সরকারী এই নিদারুণ ব্যর্থতাকে সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু ৬-দফার স্বপক্ষে ব্যবহার করলেন। তিনি ব্যাপকভাবে গণসংযোগ স্থাপন ক’রে প্রত্যেকটি জেলা-শহরে এবং অধিকাংশ মহকুমা-শহরে জনসভার আয়োজন ক’রে অগ্নিবর্ষী ভাষণ দিয়ে জনমত গঠন করলেন। তাঁর প্রত্যেকটি সভায় রেকর্ডসংখ্যক জনসমাগম ঘটতে লাগলো। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় অন্য দলগুলো সাংঘাতিকভাবে স্নায়বিক দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করলো।
এই সাথে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ৬-দফার অন্যতম বিষয় দুই প্রদেশের আঞ্চলিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হ’ল। আওয়ামী লীগ প্রচারিত বৈষম্যের একটি ছক এখানে তুলে ধরা যায়ঃ
সোনার বাংলা শ্মশান কেন?
বৈষম্য বিষয় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান
রাজস্ব খাতে ব্যায় ১৫০০ কোটি টাকা ৫০০০ কোটি টাকা
উন্নয়ন খাতে ব্যায় ৩০০০ কোটি টাকা ৬০০০ কোটি টাকা
বৈদেশিক সাহায্য শতকরা ২০ ভাগ শতকরা ৮০ ভাগ
বৈদেশিক দ্রব্য আমদানী শতকরা ২৫ ভাগ শতকরা ৭৫ ভাগ
কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরী শতকরা ১৫ ভাগ শতকরা ৮৫ ভাগ
সামরিক বিভাগে চাকুরী শতকরা ১০ ভাগ শতকরা ৯০ ভাগ
চাউল মণপ্রতি ৫০ টাকা ২৫ টাকা
আটা মণপ্রতি ৩০ টাকা ১৫ টাকা
সরিষার তৈল সেরপ্রতি ৫ টাকা ২.৫০ টাকা
স্বর্ণ প্রতি ভরি ১৭০ টাকা ১৩৫ টাকা
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই সব বৈষম্যমূলক তালিকা জনগণের মধ্যে অপূর্ব আলোড়ন ও সাড়া সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৭
কায়েমী স্বার্থবাদীদের অনাচার, অত্যাচারের চিত্র এবং শোষণের ফলে উদ্ভূত বৈষম্য সম্পর্কে জনগণকে সজাগ ক’রে তুলতে আওয়ামী লীগ যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে তা’ সর্বত্র অভিনন্দিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ঠিক এমনভাবে কার্যক্রম নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়। তাদের কোন কোন দলের উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল না একথা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু যে সব দলের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল সেই দলগুলোও পূর্ব বাংলার স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তা’ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এমন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, অপর দল বা দলীয় নেতৃবৃন্দ সেই জনপ্রিয়তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বারবার পশ্চাদগামী হয়েছেন আর জনগণের নিকট থেকে ব্যর্থতার গ্লানি সঞ্চয় করেছেন।
আওয়ামী লীগ, বিশেষ ক’রে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ইয়াহিয়া সরকার এবং তিনি নিজে এতদিনে একটি ধারণা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। সে কারণেই অপর দলসমূহ বা নেতৃবৃন্দ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাত তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবী বারবার উত্থাপন করলেও ইয়াহিয়া খান নির্বাচন পিছিয়ে দিতে সাহস পান নি। কেননা, শেখ মুজিব কঠোর ভাষায় সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন যে, নির্বাচন পিছিয়ে দিলে তার পরিণাম সবার জন্যই অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠবে। অবশেষে স্থির হ’ল যে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ই ও ১৭ই ডিসেম্বর যথানিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দুর্গত এলাকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০টি আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী।
নির্বাচন প্রাক্কালে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ
এই অত্যাসন্ন জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে যেন আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় এ সম্পর্কে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক ভাষণদান করেন। উক্ত ভাষণে তিনি বলেনঃ “…… নির্বাচন অনুষ্ঠিত হউক ইহাই সরকারের কাম্য। কাজেই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কোন কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হইবে না।”
প্রেসিডেন্ট শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাতে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে তার নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে নির্বাচনে বিজয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৮
লাভের পর বিনয় এবং পরাজয়ের পর ধৈর্য ও সমঝোতা প্রদর্শনের জন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেনঃ “যেন আসন্ন নির্বাচনে তাঁরা আইনের সীমায় থাকেন এবং তাঁদের নিজস্ব প্রার্থীর পক্ষে প্রচারকার্য চালাইবার সময় সংশ্লিষ্ট বিধির শর্তের কথা সর্বদা স্মরণ রাখেন। তিনি আরও জানান যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছা সরকারের নাই।
…. …. …. ….
তিনি তাঁর ভাষণে আরও বলেনঃ “বর্তমান পর্যায়ে আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এ সকল নির্বাচন আইনগত কাঠামো আদেশ ও সামরিক শাসনের সার্বিক আওতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন হচ্ছে আমাদের পরিকল্পনার শুধুমাত্র প্রথম পর্যায়। পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং শেষ পর্যায়ে হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর। এই শেষ পর্যায় সমাপ্ত হওয়ার এবং সামরিক শাসন তুলে নেয়ার পর সার্বভৌম ক্ষমতা জাতীয় পরিষদের হাতে চলে যাবে।
আমি নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ, বিশেষ ক’রে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের নিকট সুপারিশ করতে চাই যে, তাঁদের নির্বাচন এবং জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যকার সময়ে তাঁরা ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের প্রধান প্রধান বিধান সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছার জন্য একত্রে মিলিত হতে পারেন। এর জন্য গ্রহণ-বর্জনের সহনশীল মনোভাব, পারস্পরিক আস্থা এবং আমাদের ইতিহাসে এই সন্ধিক্ষণের চরম গুরুত্ব সম্পর্কে উপলদ্ধির প্রয়োজন হবে। পাঁচটি মূলনীতির উপর যে শাসনতন্ত্র রচিত হবে এ কথা ইয়াহিয়া বিশেষ জোরের সাথে ঘোষণা করেন। আরও বলেছিলেন যে, যদি শাসনতন্ত্রই এই নিয়মের বহিভূর্ত হয়, তবে ধরে নিতে হবে যে, দেশে সামরিক শাসনই বলবৎ আছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭০]
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার শাসনতন্ত্র রচনার বিষয়টি ঘোষণার পর অনেক রাজনৈতিক দলই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ৬-দফার ভিত্তিভূমিতে স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান ছিলেন। নির্বাচনী প্রচার অভিযানে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৩৯
তিনি জনসাধারণকে তাঁর ৬-দফার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
শাসনতন্ত্র বিষয়ে প্রেসিডেন্টের একনিষ্ঠ মনোভাব যেমন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিচলিত করেছিল, তেমনি জনসাধারণও উপলব্ধি করেছিল যে, এ আর কিছুই নয়, ক্ষমতা হস্তান্তর না করার অজুহাত মাত্র। আর এর পরিণাম এক অশুভ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করছে। দেশের জনগণ একটি কথাই বুঝতে পারেন যে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশের শুভাশুভ বিচার ক’রে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ক’রে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সে নিয়মের বহির্ভূত কাজ হতে যাচ্ছে দেখে অনেকেই বিস্মিত ও হতবাক না হয়ে পারলেন না। যা হোক, এ বিষয়কে কেন্দ্র ক’রে প্রথমদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল সত্যি, কিন্তু ক্রমশঃ তা’ নিস্তেজ হয়ে গেল। কেননা সবার মনে নির্বাচনের প্রশ্নই তখন বড় ছিল। সবাই ধারণা করছেন, নির্বাচন হয়ে গেলে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি একসাথে বসলে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার অবসান ঘটবেই। সে কারণেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য প্রতিনিধি ঠিক ক’রে প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। যদি সেই মুহূর্তে শাসনতন্ত্রের আইন কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলতে থাকত এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করত তবে অবস্থা নিশ্চয়ই জটিলতার পথে মোড় নিত। যে ভয়াবহ পরিস্থিতি একাত্তরের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল, তা’ আরো পূর্বেই ঘটতে পারতো।
নির্বাচনী শ্লোগান
যা হোক, পূর্ব-বাংলার জনসাধারণ আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে শোষণ থেকে মুক্তি কামনা করেছিল। সে কারণেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের পূর্বে শাসকগোষ্ঠীর সাক্ষাৎ মোকাবেলায় নামা যুক্তিযুক্ত মনে করেন নি। অবশ্য কিছু কিছু দল উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তখন সংগ্রামী মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকেন। তাঁদের শ্লোগানে তা’ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। যেমন— ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর,—বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা, —ঢাকা ঢাকা’, ‘পদ্মা যদি মেকং নয়, এস পদ্মা মেকং করি, এইখানেতেই ভিয়েৎনাম লড়ি’ ইত্যাদি। কিন্তু এই সব পোস্টার, শ্লোগান, হ্যাণ্ডবিল প্রভৃতি দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪০
করা সম্ভব হয় নি।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
অতি সংগ্রামী ও অতি বিপ্লবীদের এটাই দোষ যে, তাঁরা সময় বুঝে চলতে শিখেন নাই এবং জনগণের সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপনে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। বর্তমানেও তাঁদের ব্যর্থতার মূল উৎস এখানেই নিহিত আছে। যা হোক, এমনি পরিবেশের মধ্যে ৭ই ডিসেম্বর (১৯৭০) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন প্রভাতী সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় কলামে এই দিনটির গুরুত্বের কথা জোর দিয়ে ঘোষণা ক’রে যে সব কথা লিখিত হয় তা’ বিশেষভাবে স্মরণযোগ্যঃ
অবশেষে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের নির্ধারিত দিবসটি সমুপস্থিত। ইহার পথে বাধা-বিপত্তি অনেক আসিয়াছে, দ্বিধা-সংশয় অনেক জাগিয়াছে, অনেক হুমকি ও উস্কানি প্রদত্ত হইয়াছে। বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখার জন্য প্রেসিডেন্টের উপরও প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হইয়াছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান ও গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ গণতন্ত্র বিরোধী মহল, ‘গণতন্ত্রবাদী’ বলিয়া পরিচয় প্রদানকারী কতিপয় বিশেষ মহল, কোন কোন অতি প্রগতিবাদী মহল এবং ধর্ম ব্যবসায়ী মহল যেন ঐক্যজোট গঠন করতঃ একটা বছর ধরিয়া কাঁদা ছড়াইয়াছে। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, শেখ মুজিব যদি নির্বাচনের দাবীতে অনড় অটল না থাকিতেন, তবে হয়ত ৫ই অক্টোবরের পথেই ৭ই ডিসেম্বরও অতিক্রান্ত হইত, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইত না। জনগণের মৌলিক অধিকারটি প্রতিষ্ঠিত হইবার সুযোগ পাইত না। আর এবার নির্বাচন না হইলে এই দুর্ভাগা দেশে কবে নির্বাচন হইত, উহা আদৌ হইতে পারিত কিনা, সামরিক শাসন কত দিন দীর্ঘায়িত হইত, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর ঘাত-প্রতিঘাতে রাষ্ট্রতরী কোন দিকে ধাবিত হইত এবং জাতীয় সংহতি অখণ্ডতার দশা কি দাঁড়াইত কে বলিতে পারে? তবে একটা জিনিস নিঃসংশয়েই বলা যায় যে, আজিকার এই নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন না হইলে রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলই কাঁপিয়া উঠিত এবং জাতির গোটা ভবিষ্যতই এক মারাত্মক অনিশ্চয়তায় নিক্ষিপ্ত হইত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪১
… …ভোটের ক্ষমতাই জনগণের ক্ষমতা। এবং সেই ক্ষমতাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। মহাপরীক্ষার এই দিনটিতে প্রতিটি দেশপ্রাণ নাগরিক বঞ্চিত-বিশীর্ণ পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের শাশ্বত দাবী সম্মুখে রাখিয়া এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ চিন্তা হৃদয়ে ধারণ করিয়া নিজেদের সেই ক্ষমতা ও অধিকার প্রয়োগ করিবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রতীতি লইয়াই আজিকার এই মঙ্গল প্রভাতকে আমরা অভিনন্দন জানাই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, সম্পাদকীয়, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
নির্বাচনী ফলাফলঃ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়
জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমেই তাঁদের সুনিশ্চিত রায় জানিয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দুটো মাত্র আসন ছাড়া সবগুলো আসনেই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। আওয়ামী লীগ যে দুটো আসন লাভ করতে পারে নি, সে দুটো আসনের একটিতে পি. ডি. পি. প্রধান নূরুল আমীন এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদে নির্বাচন চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হ’লে নির্বাচনের যে ফলাফল পাওয়া যায় তাতে জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭, পিপলস পাটি ৮৮, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৯, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৭, জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-ইসলাম (হাজারভি গ্রুপ) ৭, মারকাজি-জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-ইসলাম (থানভি গ্রুপ) ৭, জামাতে ইসলাম ৪, ন্যাপ (ওয়ালীপন্থী) ৭, পি.ডি.পি. ১, নির্দল প্রার্থীরা ১৪ ও কনভেনশন মুসলিম লীগ ২টি আসন লাভ করে। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ যে ঐতিহাসিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তার তুলনা বিশ্বের নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল।
অতঃপর ১৯৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায় যে, মোট ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮, পি.ডি.পি. ২, ন্যাপ (ওয়ালীপন্থী) ১, নেজামে ইসলাম ১, জামাতে ইসলাম ১ ও নির্দলীয় প্রার্থীরা ৭টি আসন লাভ করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয় শুধু ঐতিহাসিক বিজয়-গৌরবকেই প্রতিষ্ঠা করে না—তুলনামূলকভাবে প্রতিপক্ষের প্রার্থিগণ, এমন কি নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত এত কম সংখ্যক ভোট লাভ করেন যে, অনেকেরই জামানতের টাকা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪২
আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান চারটি কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং উল্লেখযোগ্য যে, প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়ে তিনি জয়লাভ করেন। অথচ তাঁকে পরাজিত করবার জন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী প্রধান নেতারাও তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ওয়াহিদুজ্জামান বঙ্গবন্ধুকে চ্যালেঞ্জ দান করেছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ক’রে বলেছিলেন যে, “আপনার বিরুদ্ধে আমার দলের একজন সাধারণ কর্মী-প্রার্থীই যথেষ্ট।” তাঁর এই উক্তি বাস্তবে যে কত সত্য ছিল তা’ আমরা সবাই অবগত আছি। আওয়ামী লীগের এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের পশ্চাতে যার একক প্রভাব ঐন্দ্রজালিক প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রকৃতপক্ষে এদেশের মানুষ কোন প্রার্থীর গুণ বিচার ক’রে ভোট দেন নি। বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় এবং দেশনিবেদিত ব্যক্তিত্বই জনগণকে তাঁর সমর্থনের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই ভোট দান করেন—তাঁর দলের প্রতীক নৌকায় ভোট দিয়েছেন, সর্বক্ষেত্রে প্রার্থীকে নয়।
আওয়ামী লীগের বিজয়লাভে জনগণের প্রতি শেখ মুজিবের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন
৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ৯ই ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেনঃ “আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করিয়াছে। তাহারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়া তাহাদের এই রায় প্রদানের অধিকার অর্জন করিয়াছে আর সেই অবিরাম সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষ জীবন উৎসর্গ করিয়াছে এবং অগণিত মানুষ বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া নিপীড়ন সহ্য করিয়াছে। জনগণের সংগ্রামকে উহার প্রথম বিরাট বিজয়ে মণ্ডিত করার জন্য আমরা সর্বশক্তিমান আল্লার নিকট কৃতজ্ঞ। আমরা আমাদের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সালাম জানাইতেছি যাহারা নির্মম নিপীড়নের মুখেও এই কারণে সংগ্রাম করিয়া গিয়াছে যে, একদিন যেন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতায় বসবাস করিতে পারি। আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের বিজয়। আমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৩
আমাদের জনগণ, আমাদের ছাত্র, আমাদের শ্রমিক ও কৃষকদের ভালবাসায় অভিভূত হইয়াছি। তাহারা ইহা যথার্থভাবেই ব্যক্ত করিয়াছে যে, আওয়ামী লীগ তাহাদেরই পার্টি। আমরা নিশ্চিত যে, তাহারা ১৭ই ডিসেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও ইহা করিবে। আমাদের দলীয় কর্মী, যাহারা দারুণ বৈষয়িক অসুবিধা সত্ত্বেও অবিরাম কাজ করিয়াছে, তাহারা নিজেদেরকে যথার্থ পুরস্কৃত মনে করিয়াছে। যে সাধারণ নির্বাচন সর্বোপরি ৬-দফা/১১-দফা ভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের এক গণভোট, সেই নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে একটি পরিষ্কার রায় প্রদানের ব্যাপারে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে জনসাধারণ ঐক্য ও শৃঙ্খলার যে পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছে, উহা হইল তাহাদের পুরস্কার।
যাহা হউক, আমাদের লক্ষ্য এখনও সম্মুখে বিদ্যমান, এই লক্ষ্য বাস্তুবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। ৬-দফা ফর্মুলাভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং উহার পূর্ণ বাস্তবায়ন করিতে হইবে এবং প্রকৃতির ধ্বংসলীলা ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাত হইতে বাংলাদেশ ও উহার মেহনতী জনতাকে অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে। হাজার সমস্যার মধ্যে ক্ষুধা, বেকারত্ব, রোগ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও নিরক্ষরতার সমস্যা আশু সমাধানের তাগিদ দিতেছে। ঘূর্ণিদুর্গত উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে যে দশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়াছে এবং যে তিরিশ লক্ষ লোক টিকিয়া থাকার সংগ্রাম করিতেছে, উহাই আমাদের স্মরণ করাইয়া দেয় যে, অতীতে কিরূপ শোষণ ও অবহেলা চলিয়াছে এবং সম্মুখে আমাদের দায়িত্ব কত বিরাট।
আমরা মনে করি যে, কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা হইতে আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করার শপথ হইবে জনগণ ও আমাদের জন্য উপযুক্তভাবে জনতার এই বিজয় উদযাপন করা। পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রথম ইশারাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা তাহাদের বাঙালী ভাইদের অন্তরের অন্তঃস্থলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমাদেরকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জাগ্রত জনতাকে আহ্বান জানাইতেছি। আমাদের পক্ষ হইতে আমরা তাহাদেরকে ভূস্বামী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৪
হইতে মুক্তির সংগ্রামে আমাদের সমর্থন প্রদানের নিশ্চয়তা দিতেছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, একমাত্র জনগণের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা আমাদের সম্মুখের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করিতে পারি। আমরা এই সত্য হইতে আমাদের আশা ও শক্তি সঞ্চয় করি যে, আমাদের জনগণ তাহাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতি তাহাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। একমাত্র জনগণের ঐক্যের উপরই সমাজকে পুনর্গঠন এবং অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে অবিচার দূর করার কার্যকরী কর্মসূচীর ভিত্তি দাঁড়াইতে পারে। কাজেই আমরা সকলের প্রতি অতীতের মতানৈক্য ও বিদ্বেষ পরিহার করার আবেদন জানাইতেছি, যাহাতে আমাদের লক্ষ লক্ষ মেহনতী জনতার মুক্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হইতে পারি। জয় বাংলা। জয় পাকিস্তান।”
[ দৈনিক সংবাদ, ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভাসানীর প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে মাওলানা ভাসানীর হৃদয়ে নানাবিধ চেতনার উদয় হয়েছিল। সেদিনই এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া দেশবাসীকে জানিয়ে দেন। পত্রিকায় এরূপ খবর প্রকাশ পায়ঃ
“লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানীদের রায় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী গতকাল বুধবার দাবী জানিয়েছেন। ‘মওলানা সাহেব গতকাল বিকেলে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই দাবী জানান। তিনি বলেন, দেশে যে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল তার জয় কোন ব্যক্তি, পার্টি বা দফার জয় নয়, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যই জনগণ ভোট দিয়েছে। গত তেইশ বছর যাবৎ পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর যে শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন চলেছে তা’ থেকে মুক্তিলাভের আশায় জনগণ দিয়েছে ভোট। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এই নির্বাচনকে ৬-দফা ও ১১-দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায়ের গণভোট বলে ঘোষণা করেছিলেন।” সে সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হ’লে মওলানা তাঁর উপরিউক্ত দাবী জানান। তিনি বলেন,—“যাই হোক না কেন, জনগণ একে স্বাধীন
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৫
পূর্ব পাকিস্তানের জন্য গণভোট হিসেবেই গ্রহণ করেছে। এ সম্পর্কে যদি কোন বিতর্ক হয় তবে আবার গণভোট হোক।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
মওলানা ভাসানীর বক্তব্য সম্পর্কে বিশেষ মন্তব্যের প্রয়োজন করে না। তিনি কোথাও ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ব্যবহার করেন নি, তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। এর অর্থ কি, একমাত্র তিনিই জানেন।
মোজাফফর ন্যাপের প্রশংসনীয় মনোভাব
নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবেই। পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নেয়াই গণতন্ত্রের মহান শিক্ষা। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এই সহনশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি একটি বিবৃতিতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেনঃ “জনগণের স্বার্থে এগার দফা ও নির্বাচনে প্রদত্ত ওয়াদাসমূহ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের গৃহীত কার্যক্রমকে সফল করার জন্য রিকুইজিশনপন্থী পূর্বপাকিস্তান ন্যাপ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা ও সমর্থন দান করবে। দলের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন গতকাল শনিবার এক যুক্ত বিবৃতিতে একথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের দলের পরাজয়ের উল্লেখ করে বিবৃতেতে তাঁরা বলেন যে, তাঁদের দল নির্বাচনকে দেশবাসীর সামগ্রিক সংগ্রামের একটি অংশ হিসাবেই বিবেচনা করছে। জনগণের দাবী এখনও আদায় হয় নি এবং তাদের সামনে রয়েছে বহু সমস্যা। একমাত্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমেই জনগণ আকাঙিক্ষত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও অর্থনৈতিক দাবীসমূহ আদায় করতে পারে। জনগণের স্বার্থে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মুক্তি আন্দোলন তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান রিকুইজিশনপন্থী ন্যাপের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে বলে তাঁরা ঘোষণা করেন।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি ১১ই ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেনঃ “এই প্রথম বারের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৬
মতো পাকিস্তানের জনগণ প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অবাধ সুযোগ পেয়েছে। উত্তেজনা ছিল অত্যন্ত প্রবল, কিন্তু জাতি যে সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিতে গেছে, নির্বাচনের সময় সবাই যে সুশৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিয়েছে তা’ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় আর তাই তা’ সর্ব মহলের প্রশংসাও লাভ করেছে। এতে জাতির রাজনৈতিক সচেতনতারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পরিকল্পনা সামরিক সরকারের রয়েছে, নির্বাচন হচ্ছে তার প্রথম পর্যায় মাত্র। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এই জন্যই নব নির্বাচিত প্রার্থীদের আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, জনগণ তাঁদের ভোট দিয়ে তাঁদের উপর বিরাট আস্থা স্থাপন করেছে। দেয়া নেয়া ও সহনশীলতার ভিত্তিতে এখনই তাঁরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে যান, জাতি এখন তাঁদের কাছে তাই চাচ্ছে। জাতি তাঁদের উপর যে আস্থা স্থাপন করেছে তাঁরা তা’ রক্ষা করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হোক, এটাই আমার কামনা।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১২ই ডিসেম্বর, ১৯৭০]
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো
নির্বাচনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশের বিবেকবান মানুষদের একের পর এক তাঁর বক্তব্য প্রতিবক্তব্যের দ্বারা পীড়ন করতে থাকেন। লাহোরে এক জনসভায় পিপলস পার্টির প্রধান ভুট্টো বলেন, “তাঁর দলের সহযোগিতা ছাড়া কোন কেন্দ্রীয় সরকারই কাজ চালাতে পারবে না। তিনি আরো বলেন যে, জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলে বসে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তিনি যদি ক্ষমতায় না যান তা’ হ’লে জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করার কেউ থাকবে না এবং ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের জন্য কাজ করা সম্ভব নয়। … …সর্বোপরি তিনি বলেন যে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুই হ’ল পাকিস্তানের ক্ষমতার উৎস এবং কেন্দ্রস্থল আর এই দুই প্রদেশেই তাঁর দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতা রয়েছে; অতএব তাঁকে ক্ষমতায় যেতেই হবে।”
[ মুক্তি সংগ্রাম, প্রথম পর্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃঃ ১৬২-১৬৩]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৭
ভুট্টোর অমৃত উক্তির প্রতিবাদে সেদিন আওয়ামী লীগের গণনির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুখর হয়ে ওঠেন। ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৭০ সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক সুচিন্তিত বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, “ভুট্টোর দলের সহযোগিতা ছাড়া দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করা সম্ভব হবে না—এই উক্তি ঠিক নয় এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধুও আর ক্ষমতার উৎস থাকার আশা পোষণ করতে পারে না। এই ধরনের ক্ষমতার উৎসের বিরুদ্ধেই জনগণ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তিনি বলেন যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে এবং এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলেই শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ও কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের বেশ ভাল সুযোগ আওয়ামী লীগের রয়েছে। আওয়ামী লীগ তা’ অন্য পার্টির সাহায্য নিয়েও করতে পারে, না নিয়েও করতে পারে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অন্য কোন পার্টির সাহায্য নিবে কিনা, তা’ নির্ভর করে কোন দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচী সমর্থন করে কিনা তার উপর। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, পাকিস্তানের জনগণ অতীতকে পরিহার করেছে এবং তারা এক উজ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করতে চায়। তিনি বলেন, শাসনতন্ত্র ও সরকার গঠনে জনতার রায় আওয়ামী লীগই পেয়েছে এবং আওয়ামী লীগ নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন।”
[ মুক্তি সংগ্রাম, প্রথম পর্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃঃ ১৬৩-১৬৪]
এর পরপরই জনাব ভুট্টো আর এর ধরনের কথা বলতে শুরু করেন। ২১শে ডিসেম্বর লাহোরে এক সম্বর্ধনা সভায় তিনি বলেন, “গত ২৩ বছর ধরে যদি পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে তার ন্যায্য অধিকার না পেয়ে থাকে, তবে তার দ্বারা এই বুঝায় না যে, পরবর্তী ২৩ বছর পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে। তিনি বলেন, অতীতে পূর্ব পাকিস্তান যদি ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্বের দাবী জানিয়ে থেকে থাকে তা’ হ’লে সে একই ন্যায়বিচার বোধ থেকেই উভয় অংশের যৌথ দায়িত্বে দেশ পরিচালনা করতে হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৭০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৮
পরদিন ২২শে ডিসেম্বর আর একটি সভায় তিনি বলেন, “জাতির সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হ’ল জাতীয় সংহতির সীমায় থেকে স্বায়তশাসনের পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন করা। তিনি আরও বলেন যে, … … শাসনতন্ত্র প্রণয়ন আর শাসন পরিচালনায় দেশের সবারই অংশ গ্রহণ অপরিহার্য। এক প্রদেশ যদি অন্য সব প্রদেশের উপর শাসনতন্ত্র আর সরকার চাপিয়ে দিতে চায় তা’ হ’লে তা’ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৭০]
জনাব ভুট্টোর এলোমেলো ভাষণ থেকে এইটুকু উপলদ্ধি করা যায় যে, তিনি ঐ গদীতে বসতে চান যে গদীতে আইয়ুব খান বসে গিয়েছেন আর বর্তমানে বসে রয়েছেন ইয়াহিয়া খান। গদীর মোহ তাঁকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছে যে, তাতে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। ভুট্টোর প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতা লাভ করা, কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধি অনুসারে তাঁর পক্ষে বিরোধী দল গঠন করা ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের অশুভ শক্তির প্রতিভূ হিসেবে গায়ের জোরে সবকিছু অর্জন করবার প্রবণতা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন না। সুতরাং, বাক-কলহে তিনি প্রথম অবতীর্ণ হলেন সামনে একটি রক্তক্ষয়ী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার ক’রে। এদিকে ভুট্টো-মুজিব বিরোধ যাতে আরও তীব্র হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কার্যতঃ অন্যরূপ কারণে ও মৌখিকভাবে দু’দলের নেতৃবৃন্দকেই এ বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য উপদেশ দিলেন।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র গ্রণয়নের প্রশ্নে অটল ও অচল হয়ে রইলেন। তাঁর পশ্চাতে সাড়ে সাত কোটি মানুষ দণ্ডায়মান; অন্যদিকে ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে বিভিন্ন জায়গায় জনসভায় বক্তৃতা দিতে থাকেন। পূর্ব বাংলার এমন একটি অবস্থায় ভুট্টো তাঁর রং বদলাতে বাধ্য হন। তিনি ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান না। সুতরাং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়ে তিনি শেখ মুজিবকে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দান করেন। ২৭শে ডিসেম্বর তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৪৯
বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করেন এবং আওয়ামী লীগকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
পরদিন প্রকাশিত সংবাদপত্রে বলা হয়ঃ “শেখ মুজিব ৬-দফার ব্যাপারে অনড় থেকে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে হাত দিলে তাঁর দলের ভূমিকা কি হবে প্রশ্ন করা হ’লে তিনি বলেন, শাসনতান্ত্রিক অচল অবস্থা সৃষ্টির চাইতে তাঁর দল সরে দাঁড়াবে এবং আওয়ামী লীগকে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ দেবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, এর পরিণতির জন্য তিনি দায়ী হবেন না। জনাব ভুট্টো শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে সমঝোতা ও ৬-দফার ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়।
শেখ মুজিবের প্রশংসা ক’রে তিনি বলেন যে, কর্মসূচীর ভিত্তিতে জনগণ তাঁকে ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছেন—সেই কর্মসুচী থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে সামান্যতম বিচ্যুত হওয়া সম্ভব নয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৭০]
জনাব ভুট্টো দাবার চাল বদলাবার তালে ব্যস্ত ছিলেন। কি ভাবে সারা পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হওয়া যায়—সেই চিন্তায় তিনি বিভোর। ২৮শে ডিসেম্বর জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং দীর্ঘ সময়কাল পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে গোপনে আলাপ হয়। এর ভিতরে যে একটা ষড়যন্ত্র লুকিয়ে ছিল ধীরে ধীরে তা’ পূর্ব বাংলার মানুষের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। ইয়াহিয়া ও তাঁর সঙ্গীরা ভুট্টোর সাথে গোপন পরামর্শের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে থাকলেন। এই সব কাজকর্মে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ডাকবার ব্যাপারে ইয়াহিয়া অস্বাভাবিক নীরবতা অবলম্বন করতে থাকলেন। এই নীরবতা সবার মনেই সংশয়ের উদ্দ্যেক করতে থাকে। এর পশ্চাতে যে কি এক গোপন রহস্য ছিল পরবর্তী কালে তা’ ঘটনার মাধ্যমেই উদঘাটিত হয়েছে।
যা হোক অবশেষে সরকারের নীরবতা ভঙ্গ হ’ল। ৩০শে ডিসেম্বর সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হ’ল যে, জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে এবং উল্লেখযোগ্য যে, কোন তারিখে এই অধিবেশন বসতে যাচ্ছে তার সঠিক কোন সংবাদ পরিবেশন করা হ’ল না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫০
আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ দিবস উদযাপন
১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী তারিখে আওয়ামী লীগ ‘শপথ দিবস’ উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। দু’দিন পূর্ব থেকেই সভামঞ্চ তৈরী করার কাজ শুরু হয়েছিল। প্রায় ১২০ ফুট দীর্ঘ নৌকাকৃতির এই মঞ্চের তিনটি অংশের মাঝেরটিতে আসন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। আর তার পাশের দুটো ভাগে স্থান করা হয়েছিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের জন্য। এ ছাড়া সাংবাদিক, মহিলা ও বিদেশী কূটনৈতিক মিশনের সদস্যদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। দলপতি শেখ মুজিবুর রহমান শপথ-অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি হাত ঊর্ধ্বে তুলে নিম্মোক্ত শপথ পাঠ করেন এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যগণ তা’ উচ্চারণ করেনঃ “আমরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি, পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার নামে; আমরা শপথ গ্রহণ করিতেছি সেই সব বীর শহীদের ও সংগ্রামী মানুষের নামে, যাহারা আত্মহুতি দিয়া ও চরম নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করিয়া আজ আমাদের প্রাথমিক বিজয়ের সূচনা করিয়াছেন; আমরা শপথ গ্রহণ করিতেছি এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মেহনতী মানুষ তথা সর্ব শ্রেণীর জনসাধারণের নামেঃ জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এই দেশের আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ও নেতৃত্বের প্রতি যে বিপুল সমর্থন ও অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করিয়াছেন, উহার মর্যাদা রক্ষাকল্পে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করিব।
ছয়-দফা ও এগার-দফা কর্মসূচীর উপর প্রদত্ত সুষ্পষ্ট গণরায়ের প্রতি অমর একনিষ্ঠরূপে বিশ্বস্ত থাকিব এবং শাসনতন্ত্রে ও বাস্তব প্রয়োগে ৬-দফা কর্মসূচী ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও ১১-দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটাইতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিব। আওয়ামী লীগের নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য, ও কর্মসূচীর প্রতি অবিচল আনুগত্য জ্ঞাপন পূর্বক আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, অঞ্চলে-অঞ্চলে ও মানুষে-মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫১
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসান ঘটাইয়া শোষণমুক্ত এক সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়িবার এবং অন্যায় অবিচার বিদূরীত করিয়া সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব; জনগণ অনুমোদিত আমাদের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসী যে কোন মহল ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে যে কোনরূপ ত্যাগ স্বীকার করতঃ আপোষহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকিব। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা। জয় পাকিস্তান।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১]
এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৫১ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং ২৬৮ জন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবের ডান পার্শ্বে জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ এবং বামপাশে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ দাঁড়িয়ে শপথ গ্রহণ করেন। প্রত্যেকের বাম হাতে ছিল শপথনামা এবং ডান হাত শপথের ভঙ্গীতে উত্থিত ছিল।
এই দিনের ঘটনাবলী সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছেনঃ “সে এক নয়া ইতিহাস-ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীর রেসকোর্স ময়দানে গতকাল (রবিবার) এক নয়া ইতিহাস সৃষ্টি হইয়াছে। সে ইতিহাস নির্বাচন বিজয়ী বীর নেতা এবং ডিসেম্বরের নিঃশব্দ বিপ্লবের নায়ক-জনতার মিলনের ইতিহাস; বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এবং জননন্দিত স্বাধিকার সৈনিকদের জনতার দরবারে শপথ গ্রহণের ইতিহাস। বন্দুকের নল নয়, জনগণই সকল শক্তির উৎস, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। আর তাই দেশবরেণ্য গণনায়ক, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মুক্তি আন্দোলনের সিপাহসালার শেখ মুজিব তাঁর সূর্য-সৈনিকদের লইয়া হাজির হইয়াছেন জনতার আদালতে উচ্চারণ করিয়াছেন অগ্নি শপথ, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যাইতে দেব না’ ‘তোমাদের ম্যাণ্ডেট আর ভালবাসার অমর্যাদা হইতে দিবনা’। প্রত্যুত্তরে সংগ্রামী বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি ডিসেম্বরের দুই-দফা ব্যালটের রায়ের পর গতকাল আবার হাত তুলিয়া শ্লোগান দিয়া জানাইয়া দিয়াছে—নেতা আমাদের বঙ্গবন্ধু, নির্ভয়ে তুমি আগাইয়া চলো , আমরা আছি পিছনে।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫২
রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রকে উদ্দেশ্য করিয়া বক্তৃতার এক পর্যায়ে শেখ সাহেব আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “ভাইয়েরা আমার, মনে রাখবেন, নির্বাচনে বিজয়ের অর্থই অধিকার আদায় নয়, এ বিজয় নস্যাৎ-এর ষড়যন্ত্র চলিতেছে। এই ষড়যন্ত্রের কবলে পড়িয়া আমি যদি চিরতরে আপনাদের ছাড়িয়া যাই, আমার মৃত্যুর পর বঞ্চিতা দেশ-মাতৃকা আর গরীব-দুঃখী মানুষের মুখের দিকে চাহিয়া আপনারা কি পারিবেন আন্দোলন করিয়া দাবী আদায় করিতে?” বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো লক্ষ লক্ষ হস্ত ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়—ধ্বনি ওঠে দিগন্ত কাঁপাইয়া, —‘পারিব’ ‘পারিব’। আর বীর প্রসবিনী বাংলার মানুষের এই দীপ্ত শপথবাণী নেতার মুখে সঞ্চারিত করে অনাবিল স্বস্তির আভাস। সুকঠিন স্বাধিকার সংগ্রামের প্রাথমিক বিজয় শেষে বাংলার মানচিত্র, বাংলার-আকাশ-বাতাস আলোকে সাক্ষী রাখিয়া নেতা ও জনতার শপথ ও আস্থা, ভালবাসা বিনিময়ের সেই দুর্লভ ক্ষণটিতে শীতের শান্তি-সূর্য রেণু-রেণু হইয়া ছড়াইয়া পড়িতেছিল রেসকোর্স ময়দানে—যেন বিধাতার আশীর্বাদ।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিবুর রহমান শপথ অনুষ্ঠানে আবার দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র রচিত হবে এবং ১১-দফায় যে সব দাবী-দাওয়া সন্নিবেশিত রয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়িত হবে। তাঁদের এই পরিকল্পনাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। তিনি আরো বলেন যে, আওয়ামী লীগ দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। শেষ কথা, জনতার দরবারে আওয়ামী লীগ যে-সব ওয়াদা করেছে তা’ অবশ্যই পালন করবে। যদি জনগণ-নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে প্রতিনিধিত্ব করতে না দিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র চালানো হয়—তবে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালানোর জন্য তিনি এক উদাত্ত আহ্বান জানান। গণতান্ত্রিক বিজয়কে সুসংহত করার স্বার্থে দেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ ক’রে শেখ মুজিব সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালালদের বাড়াবাড়ি দমনের জন্য দেশবাসীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “ইউনিয়নে ইউনিয়নে, মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগ গঠন করুন এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৩
রাতের অন্ধকারে যারা ছোরা মারে, তাহাদের খতম করার জন্য প্রস্তুত হন।” রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে সেই সব বিপ্লবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “চোরের মত রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করিয়া বিপ্লব হয় না। বিপ্লব চোরের কাজ নয়।” শেখ মুজিব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, জৈন ভাইয়েরা শুনিয়া রাখুন, আপনারাও পাকিস্তানের সমান নাগরিক। আপনাদের উপর এ যাবত ক্ষেত্রবিশেষ অত্যাচার হইয়াছে, আমি জানি। আজ আমি এই আশ্বাস দিতেছি—আর আপনাদের উপর অত্যাচার হইবেনা।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিব চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাক্সবন্দী ক’রে রাখার জন্যও আহ্বান জানান। পরদিন রমনা ময়দানে ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রধান অতিথির ভাষণদান প্রসঙ্গে অতি বিপ্লবীদের কাপুরুষোচিত কার্যকলাপের সমালোচনা ক’রে পুনরায় বঙ্গবন্ধু বলেন, “অতি বিপ্লবী কয়েকটা শ্লোগান বা রাতের অন্ধকারে আকস্মিকভাবে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার শিভালরির মধ্য দিয়া বিপ্লব হয় না। বিপ্লবের উদ্ভব ঘটে দেশের মাটি হইতে এবং বিপ্লব উন্মেষের একটা নির্ধারিত কালও রয়েছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
তিনি বলেন, “বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দিলে সে ডাক আমিই দেব। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, আমিও কম বিপ্লবী নই। যদি ৬-দফা আদায়ের সংগ্রামকে ষড়যন্ত্র করিয়া ব্যর্থ করিয়া দেওয়া হয়, তবে কয় দফা দিতে হয় তাহাও আমার জানা আছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিব ছাত্র ও দেশবাসীকে সতর্ক ক’রে দিয়ে বলেন যে, আপনারা ভুলিয়া যাইবেন না যে, ষড়যন্ত্রকারীরা শক্তিশালী—তাহাদের শক্তি আছে, অস্ত্র আছে, এজেন্ট রাখার ক্ষমতা আছে। আপনারা মনে করিবেন না যে, নির্বাচনে জিতিয়াছেন বলিয়া তাহারা সহজে আপনাদের হাতে ক্ষমতা ছাড়িয়া দিবে আর একথাও ভাবিবেন না যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে তাহারা হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৪
ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জনগণের প্রতি শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারি
শেখ মুজিব যে কতখানি দূরদর্শী ছিলেন এই ভাষণের মধ্যেই তা’ ফুটে উঠেছে। আমরা জানি পরবর্তীকালে তাঁর এই আশঙ্কা কিভাবে সত্যে পরিণত হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানকে তিনি ভালোভাবেই চিনেছিলেন। তিনি জানতেন, নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ভাঁওতা দিলেও ভিতরে একটা বিরাট ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হচ্ছে। বহু বছরের সাধনা লব্ধ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা সম্পর্কে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাই তাঁকে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ক’রে দিয়েছে। সেইজন্য তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতা অর্জন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন নি। তাঁর মতে নির্বাচনের এই বিজয়ে ‘বাঙালী সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে’ মাত্র। তিনি বলেন, “নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়া আমরা শুধু এক পা আগাইয়াছি শাসনতন্ত্র রচনা করিলে দুই পা আগাইব, সরকার গঠন করিলে তিন পা আগাইব, আর মানুষের কল্যাণ করিতে শুরু করিলে আমরা চার পা আগাইব।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
বাঙালী জাতির ইতিহাস লেখার আহ্বান
ছাত্রলীগ আয়োজিত এই সম্মেলনে শেখ মুজিব নতুন করে বাঙালীর ইতিহাস লেখার জন্য দেশের শিক্ষাবিদদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি গঠনে সেই জাতির নিজস্ব ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ ক’রে তিনি বলেন, “বাংলার যে ছেলে তাহার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানিতে না পারে, তবে সেই ছেলে সত্যিকারের বাঙালী হইতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে বাংলার মানুষ যে সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং বীরত্বের পরিচয় দিয়াছে বাংলার ছেলেদের সেই ইতিহাস পাঠ করিতে হইবে। এই ইতিহাস পাঠ করিয়া যেন বাংলার ভবিষ্যৎ বংশধরগণ তাহাদের গৌরবময় অতীতের পরিচয় পাইয়া গর্ব অনুভব করিতে এবং উন্নত মস্তকে দাঁড়াইতে পারে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাসের কথা উল্লেখ ক’রে সেই সব সূর্য-সৈনিকদের বীরত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৫
গাথা ভিত্তিক ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ইংরেজ ভারতবর্ষ দখলের সময় বাংলার মুসলমান ও বাঙালী শাসনকর্তা সিরাজউদ্দৌলার হাত হইতে ক্ষমতা কাড়িয়া নিয়াছিল, কিন্তু সেদিন পাঞ্জাব ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কোন মুসলমান শাসকের হাত হইতে ইংরেজ ক্ষমতা নেয় নাই—নিয়াছিল অমুসলিম শাসনকর্তা রণজিৎ সিংহের হাত হইতে।
পরবর্তীকালে বংলার ব্যারাকপুর হইতেই সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হইয়াছিল। সেদিন বাংলায় বেঈমানী করার কোন লোক পাওয়া যায় নাই বরং নেতাদের সঙ্গে দেশের লোকেরাই বেঈমানী করিয়াছিল।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিবের প্রাণনাশের চেষ্টা
প্রতিক্রিয়াশীলচক্র নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নিশ্চল হয়ে থাকে নি। এবার শেষ অস্ত্র হিসেবে তারা শেখ মুজিবের প্রাণনাশের চেষ্টায় লিপ্ত হ’ল। ওদের ধারণা, শেখ মুজিবকে হত্যা করলেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সহায়তা হবে। এটাকে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণও বলা যেতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তারা গোলাম মোস্তফা ওরফে কবির নামে এক যুবককে ৭ই জানুয়ারীর দিবাগত রাত্রে শেখ মুজিবের বাসভবনে পাঠিয়ে দেয়। এই সংবাদের উল্লেখ ক’রে দৈনিক ইত্তেফাকে বলা হয়ঃ “গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের উপর হামলার চেষ্টা করার অভিযোগে গোলাম মোস্তফা ওরফে কবির নামে একজন যুবককে আটক করিয়া পুলিশে সোপর্দ করা হইয়াছে বলিয়া গতকাল (শুক্রবার) আওয়ামী লীগের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক স্বাক্ষরিত এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হইয়াছে যে, গত বৃহস্পতিবার রাত্রে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গোপনীয় কথা বলার অছিলায় তাঁহার (শেখ মুজিবর) বাসভবনে বলপূর্বক ঢোকার সময় যুবককে ধরিয়া ফেলা হয়। তাহার নিকট ধারালো ছোরা লুকানো ছিল। তাহাকে ধরিয়া ফেলার পর সে বলে যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার বাসনা লইয়াই সে সেখানে গিয়াছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৬
সে আরো প্রকাশ করে যে, একটি সুসংগঠিত দল এই কাজের জন্য তাহাকে নিযুক্ত করে। উক্ত দলটি আওয়ামী লীগ প্রধানের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাইবার জন্য তাহাকে শিক্ষা ও নির্দেশাদি দেয়। তাহার বক্তব্য হইতে আরো প্রকাশ পায় যে, আওয়ামী লীগ প্রধানের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাইবার জন্য বিভিন্ন স্থানে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সুসংবদ্ধ দল সুযোগের প্রতীক্ষায় আছে……।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
শেখ মুজিবের জীবনের ওপর হামলার চেষ্টার চাঞ্চল্যকর সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকা ও প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যুগপৎ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং এই ধরনের আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন।
মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী
এদিকে ৯ই জানুয়ারী, ১৯৭১ মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করলেন। উক্ত সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন যে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান স্থাপনের সংগ্রামে তিনি তাঁর শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দান ক’রে যাবেন। মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী নানাদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। নির্বাচনের পূর্বেও যখন নির্বাচনে তাঁর ও তদীয় সমর্থকদের ভরাডুবি হবার সম্ভাবনা তিনি দেখেছিলেন তখন পল্টনের একটি সভায় আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ সোলায়মান ও মোহসেন উদ্দিন প্রমুখকে নিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলা নয়, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ডাক দিয়েছিলেন। আবার এ কথাও সত্য যে, পশ্চিম পাকিস্থানের করাচীতে গিয়ে তিনি কিছুদিন পূর্বে ঠিক উল্টো সুরে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, “রোজকেয়ামত-তক পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে—পাকিস্তানকে দ্বিধাবিভক্ত করবার সাধ্য কারো নেই।’ আইয়ুব খানের সময় তিনি খান সাহেবকে মাঝে মাঝে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কখনো এক জাতীয় সাম্যবাদ,কখনো অন্য জাতীয় সাম্যবাদ এবং সর্বশেষে ইসলামী সাম্যবাদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৭
কিন্তু ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারী টাঙ্গাইলের সন্তোষে তিনি যে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দান ক’রে যাবার ওয়াদা প্রদান করেন তার উদ্দেশ্য ভিন্নরূপ ছিল। নির্বাচনের পর যখন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করবার ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশবাসী উদগ্রীব দৃষ্টিতে প্রতীক্ষিত, তখন এই হস্তান্তর যাতে না হতে পারে, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ শ্লোগান সেই উদ্দেশ্যেই উচ্চারিত হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে একথা বলবার ধৃষ্টতা আমার নেই যে, তিনি কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবেই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবী জানিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি যে সমস্ত ব্যক্তির সাথে হাত মিলিয়ে এই শ্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁদের কেউ কেউ ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে কাজ করেছেন। মওলানা ভাসানী ইয়াহিয়ার প্ররোচনায় এমন একটি অবিমৃষ্যকারী শ্লোগান শুরু করবেন, এ কথা বিশ্বাস করা অসম্ভব ছিল—তাঁর সম্পর্কে এমন অনুমানও ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, সারাজীবন তিনি শ্লোগানসর্বস্ব রাজনীতি ক’রে এসেছেন সুতরাং এক শ্লোগান থেকে আরেক শ্লোগানে যাতায়াত তাঁর পক্ষে একটি অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। তাছাড়া, পূর্বেই বলেছি, সময়োচিত যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে তিনি সারা জীবন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এর একটি কারণ, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তিনি কোনদিন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন নি।
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে বন্ধু খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস কয়েকটি মূল্যবান কথা বলেছেন—এখানে তা’ স্মরণ করা যায়ঃ “ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানীও উত্থাপন করেছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্ন। বাঙালী জাতীয়তাবাদ যখন নির্বাচন প্রাক্কালে সমগ্র দেশে গর্জন ক’রে ওঠে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে, সেই ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসেই উত্থাপিত হয় মওলানা ভাসানীর কণ্ঠে স্বাধীনতার দাবী। কিন্তু মওলানা ভাসানীর দাবী স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ নয়, জয় বাংলা নয়, তাঁর দাবী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। তাঁর দাবী সংগ্রামের দাবী নয়, সংগ্রাম ক’রে স্বাধীনতা অর্জন নয়। তাঁর দাবী ছিল তালাকের দাবী। ভাবখানা এরূপ যে, সাক্ষী সাবুদের সম্মুখে যথারীতি উচ্চকণ্ঠে তিনবার—এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক—ঘোষণা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৮
শেষে পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে খোরপোষ ছাড়াই পরিত্যাগ। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন যে, স্বাধীন ‘বাংলাদেশের’ পরিবর্তে স্বাধীন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ দাবী এবং সংগ্রামের বদলে তালাক প্রার্থনার মূলে তাঁর যে শুধু সাম্প্রদায়িক মনেরই পরিচয় বেরিয়ে এসেছে তাই নয়, সেই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে একটি গভীর চক্রান্তের আভাস।”
তালাকের দাবী উত্থিত হয় পল্টনের জনসভায়। উক্ত সভায় উদ্যোক্তা ছিলেন ভাসানীপন্থী ‘ন্যাপ’, আতাউর রহমান খানপন্থী ‘জাতীয় লীগ’, মোহাম্মদ সোলায়মানপন্থী ‘কৃষক শ্রমিক দল’ এবং পীর মোহসেন উদ্দীন ওরফে পীর দুদুমিয়াপন্থী ‘জমিয়াতুল ওলামায়ে ইসলাম’। স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ নয় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান এবং সংগ্রামে নয়, তালাকের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা—মওলানা ভাসানীর উপরোক্ত বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আর যারা সভায় বক্তৃতা করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন পীর দুদুমিয়া, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান ও মোহাম্মদ সোলায়মান।
বলাবাহুল্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর মওলানা ভাসানী আশ্রয় গ্রহণ করেন ভারতে, খান আতাউর রহমান আটক হন কুর্মিটোলা বন্দী শিবিরে, মোহাম্মদ সোলায়মান হানাদার সরকারের মন্ত্রীত্ব দখল করেন এবং শাহ আজিজুর রহমান গমন করেন জাতিসংঘে ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজীদের গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে। আর টিক্কা খানের শান্তি কমিটির অন্যতম সংগঠকরূপে পীর দুদুমিয়া গ্রহণ করেন হানাদার বাহিনীর দালালী। জানা যায় যে, তিনি সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বসবাসকালে উক্ত এলাকার কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে ধরিয়ে দিতে তিনি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংযাগিতা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও উক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ঘরে ফিরে আসেন নি। তাঁদের পাগলপ্রায় মাতাপিতা আজো সন্তানদের আগমন-প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছেন—বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। আজো তাঁরা রাতের বেলায় পাখির পাখা ঝাপটায়, গাছের পাতা পড়ার শব্দে কিংবা দিনের বেলায় বাতাসে দরজা নড়ার সামান্য আওয়াজে ছুটে বেরিয়ে আসেন ঘরের বাইরে—‘বুঝি সোনার মাণিকেরা তাঁদের ফিরে এলো।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৫৯
এই হ’ল স্বাধীন বাংলাদেশ বিরোধী ও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবীদারদের প্রকৃত স্বরূপ। ইতিহাস বড়োই নিষ্ঠুর—কাউকেও ক্ষমা করেনা। সময় এলে সকলের প্রকৃত চরিত্র নগ্ন করেই দেখায়।
কাজেই মওলানা ভাসানীর তালাকের দাবীর বিরুদ্ধে চারিদিকে ধিক্কার ওঠে। সে ধিক্কারের বাণী উত্থিত হয় আওয়ামী লীগের বজ্রকণ্ঠে। সে ধিক্কারের ধ্বনি ওঠে ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকেও। কমিউনিস্ট পার্টি তখনও বেআইনী সংগঠন—কাজেই তাঁদের প্রকাশ্য বিবৃতি ও বক্তৃতা কেউ ছাপাতে পারেন নি। কিন্তু তাঁদের ধিক্কারের সে ভাষা পৌঁছে যায় সংগ্রামী জনগণের কাছে।”
জনাব ইলিয়াস আরো বলেছেনঃ “মওলানা ভাসানী একাকী হয়ে পড়েন অনেক আগেই। পাকিস্তানের রাজনীতি, বিশেষ ক’রে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর ‘কথিত’ ঘনিষ্ঠতার সংবাদে ন্যাপের প্রকৃত নেতা ও কর্মীবৃন্দ তাঁকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। চীনের মাও চক্র জাতীয় স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সংগ্রামী দেশের ন্যায় বাংলাদেশেরও জাতীয় স্বাধীনতার বিরোধী। মাওবাদীদের সঙ্গে মওলানা ভাসানীও বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করায় সমগ্র দেশের আন্দোলনের স্রোত থেকে তিনি হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মাওবাদীরা বিভ্রান্ত হলেও তাঁরা এককালের কমিউনিস্ট। তাঁদের কেউ কেউ কাগজে কলমে অসাম্প্রদায়িক, কিন্তু ব্যক্তিগত ও ব্যবহারিক জীবনে ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। তাঁদের সোহবতের গুণ কিনা বলা যায় না, তবে এককালের অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবাদী মওলানা ভাসানীও হয়ে পড়েন সাম্প্রদায়িক ঘেঁষা। কমিউনিস্ট বিরোধী তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ। এমতাবস্থায় কি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, কি শ্রেণী-সংগ্রামের রাজনীতি, কি আওয়ামী লীগ ন্যাপের রাজনীতি, কি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি—মওলানা ভাসানীর সাংগঠনিক স্থান কোথায়? এদেশের রাজনীতিতে ভাসানীর অবদান অপরিমিত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬০
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন অহেতুক চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয় এবং নগদ অর্থ, অস্ত্রপাতি ও খাদ্যের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি বিষিয়ে তুলবার ষড়যন্ত্র করে, সাম্রাজ্যবাদ যখন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের গতিরোধ করার উদ্দেশ্যে গোপনে বারবার চক্রান্ত করে, ১৯৫৪ সালের তদানীন্তন পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণের বিজয়কে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কর্তৃপক্ষকেও যখন প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে দেখা যায়, তখন একমাত্র মওলানা ভাসানী ছাড়া আর কোন নেতাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিশ্বের দরবারে দরবারে প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারণ করতে। পাকিস্তানের মওলানা ভাসানীই একমাত্র গণতান্ত্রিক নেতা, যিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তির মধ্যেই নিহিত আছে পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত মুক্তি। পাকিস্তানের মওলানা ভাসানীই একমাত্র গণতান্ত্রিক নেতা যিনি বরাবরই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী, একচেটিয়া পুঁজিবাদ বিরোধী এবং চিন্তায় ও কর্মে অসাম্প্রদায়িক। এ কারণে তাঁকে অনেকবার ভারত ও কমিউনিস্টদের দালালরূপে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। অথচ সামরিক শাসনের কারাগার থেকে চার বছর পর বেরিয়ে আসার পরই লক্ষ্য করা গেলে যে, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণার বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাঁর সেই মৌলিক পরিবর্তন দেশপ্রেমিকদেরকে যেমন করেছে বেদনার্ত, তেমনি দিনে দিনে তিনিও হয়ে পড়েছেন একাকী। প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী দলগুলি থেকে সরিয়ে এনে তাঁর এরূপ একাকীত্ব অবস্থার পশ্চাতে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং পাকিস্তানের স্বৈরাতন্ত্রী শাসকদের নায়ক আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্র ছিলনা, সে কথা জোর করে বলা যায় না।
আজ দেখে বড়ই দুঃখ লাগে যে, তিনি রাজনীতির নেশায় শেষ পর্যন্ত জামাতে ইসলামী, পি. ডি. পি., মুসলিম লীগ, জাতীয় লীগ—এমনকি বাংলাদেশের শতচ্ছিন্ন মাওবাদীদের যে অংশকেই হাতের নাগালে পাচ্ছেন, তাঁদেরকে ধরেই কোকিল সেজে কাকের বাসায় ডিম পাড়ার তালে রয়েছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬১
তিনি জানেন সেগুলো তাঁর নিজের দল নয়, তাঁরা কেউ তাঁর আপনজনও নন। তাঁদের পরস্পরবিরোধী নীতির সঙ্গে কোন মিল নেই তাঁর। তবুও রাজনীতির নেশা। এসব তাঁর ভ্রান্ত রাজনীতির পরিণতি।”
[ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৯-২৩১]
যাহোক, মওলানা ভাসানী ও আরো কতিপয় নেতার স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী যে নিঃসন্দেহে সময়োচিত ছিল না, তা’ বলাই বাহুল্য। শেখ মুজিব যখন ৬-দফা দাবীর ভিত্তিতে জনগণের নিকট থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা প্রাপ্তির অধিকার অর্জন করেছেন, তখন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবীর ধূয়া তোলা প্রতিক্রিয়াসম্পন্ন মনোভাবেরই পরিচায়ক। মওলানা ভাসানী ৬-দফা দাবীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার গন্ধ পেয়ে এক সময় তার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। আতাউর রহমান খানও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবীকে ৬-দফা দাবীর কাছাকাছি বা তার পরিপূরক বলে মন্তব্য করেছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের মনোভাব পরিষ্কার থাকলে তাঁরা নিঃসন্দেহে অসময়ে এই অযাচিত দাবী করতেন না। তা’ ছাড়া শেখ মুজিব যেখানে ক্ষমতা-হস্তান্তর সম্পর্কেই বারবার সন্দেহ প্রকাশ করছেন, সেখানে তাঁরা যে ভূমিকা পালন করছেন, তা’ অত্যন্ত লজ্জাকর।
সন্তোষে আয়োজিত উক্ত জাতীয় সভায় মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক ক’রে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ ও জাতীয় ভাসানী ন্যাপের ৫ জন ক’রে প্রতিনিধির সমবায়ে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ন্যাশনাল লীগের মেসার্স আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, আমেনা বেগম এবং ন্যাপের মশিউর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুল জব্বার প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত হন।
এ সময় শেখ মুজিব বাত্যা-উপদ্রুত অঞ্চল সফর করছিলেন। ৭ই জানুয়ারী লঞ্চযোগে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং এই পর্যায়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জেলার দুর্গত-অঞ্চলসমূহ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন কালে তিনি বিভিন্ন জনসমাবেশে ভাষণও দেন। ভাষণে তিনি দেশবাসীকে ক্ষমতা হস্তান্তরের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ ক’রে দেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬২
মুজিব-ইয়াহিয়া সাক্ষাৎকার
১১ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসেছিলেন শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এ সাক্ষাৎ পূর্বেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে বিমান বন্দরে সাংবাদিকগণ তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট বাহ্যিক দৃষ্টিতে খোলা মনেই তাঁদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। সাংবাদিকদের সাথে প্রেসিডেন্টের আলাপের সংবাদ পরিবেশন ক’রে সংবাদপত্রে যা লেখা হয়, তা’ নিম্নরূপঃ
“প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অব্যবহিত পরেই জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃঢ়সংকল্প পুনরায় ঘোষণা করেন। সাধারণ নির্বাচনের পর এই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের পর প্রেসিডেন্ট আল্লার কাছে শুকরিয়া প্রকাশ ক’রে বলেন যে, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য আমি জাতিকে মোবারকবাদ জানাই। জনসাধারণ বিশ্বের দরবারে আদর্শ স্থাপন করেছে এবং অত্যন্ত পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।
এই বছরের শেষ নাগাদ ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হ’লে প্রেসিডেন্ট বলেন, এত দীর্ঘ সময় কেন? যদিও আইনগত কাঠামোতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ১২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা রয়েছে। তবু আমি আশা করি, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন দশ দিনেই সম্ভব। তিনি বলেন, এটা নির্ভর করে সদস্যদের উপর। তিনি এল. এফ. ও’র ব্যাপারে এখনও অটল রয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হ’লে প্রেসিডেন্ট বলেন, যদি আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করবোনা বলে মত পাল্টাই তবে আর এল. এফ. ও. থাকে না।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের তারিখ সম্পর্কে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি। যখন সিদ্ধান্ত নেব তখন আপনাদের জানাবো।
শেখ মুজিব ও জনাব ভুট্টোর সাথে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের সম্ভাবনার কথা তিনি অস্বীকার করেন।
ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর বৈঠক কখন হবে তা’ ঠিক করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা সময় ঠিক ক’রে নেব। আমি ব্যস্ত মানুষ, তিনিও (শেখ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৩
মুজিব) ব্যস্ত মানুষ। যখনই আমার ও তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে তখনই আমরা মিলিত হবো।
মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবী সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিক প্রেসিডেন্টের মত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এব্যাপারে মওলানা ভাসানীকে প্রশ্ন করুন। আমি একজন মুসলমান ও পাকিস্তানী, বিরাট সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, একক সংখাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ যদি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে তা’ যদি পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে কি তিনি সেই শাসনতন্ত্রে মঞ্জুরী দেবেন? প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি অনুমান নির্ভর প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমার ধারণা সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে বিস্তারিত বলেছি। এ ধরনের কোন অবস্থা যখন হবে তখন কি করা হবে না হবে, তখন বলব।
প্রেসিডেন্টকে রাজবন্দীদের ক্ষমা প্রদর্শনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হ’লে প্রেসিডেন্ট বলেন, যারা আন্দোলনজনিত কাজের জন্য জেলে আটক হয়েছিল তাদের সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমা প্রদর্শন ক’রে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু আমি অপহরণকারী, খুনি প্রভৃতিদের ছেড়ে দিতে পারি না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১২ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় তিন দিন ছিলেন। এই তিন দিনের মধ্যে শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দুই-দফা বৈঠক বসে। ১২ই ও ১৩ই জানুয়ারী এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিনের আলোচনায় শেখ মুজির একাই উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের দু’জনের আলাপ-আলোচনা তাঁদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে প্রায় ১১০ মিনিটকাল স্থায়ী আলোচনার শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন যে, আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং জাতীয় সমস্যাবলী নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ সাহেবের দ্বিতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ১৩ই জানুয়ারী। এ আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ক্যাপ্টেন মনসুর, সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানও উপস্থিত ছিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৪
প্রেসিডেন্টের সাথে শেখ সাহেবের দ্বিতীয় দফা বৈঠক তিন ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। শেখ মুজিব ও তাঁর দলের পূর্বোক্ত ৫ জন নেতা সকাল সাড়ে দশটায় প্রেসিডেন্ট ভবনে গমন করেন। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয় তিনি অপেক্ষমান সাংবাদিকদের নিজ বাসভবনে নিয়ে যান। ধানমণ্ডী বাসভবনে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের সম্ভাব্য তারিখ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। ঢাকায় তিন দিন অবস্থানের পর প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগের পূর্ব মুহুর্তে বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের বলেন যে, শেখ মুজিবের সাথে তাঁর আলোচনা সাফল্যজনক হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানই দেশের ভাবী প্ৰধানমন্ত্রী। বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্টের সাথে সাংবাদিকদের যে আলোচনা হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়ে পত্রিকায় লেখা হয়ঃ
“প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান গতকাল (বৃহস্পতিবার) ঢাকায় বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁহার আলোচনা সন্তোষজনক হইয়াছে। তিনি বলেন, শীঘ্রই দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গঠিত হইবে এবং শেখ সাহেব দেশের প্রধানমন্ত্রী হইতে যাইতেছেন। … …
শেখ সাহেবকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করিয়া প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যাহা বলিয়াছেন, তাহা সর্বৈব সঠিক।
…. …. …. ….
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কখন ডাকা হইবে জানিতে চাহিলে প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ডাকার ব্যাপারে অনেক কিছু ফ্যাকড়া আছে এবং সেগুলো সম্পর্কে আমি শেখ সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করিয়াছি। … …
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করিবেন কিনা জিজ্ঞাসা করিলে প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি জনাব ভুট্টোর এলাকা সিন্ধুতে পাখী শিকার করিতে যাইতেছি, তিনি যদি সেখানে থাকেন তবে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিব।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই জানুয়ারী, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৫
অতঃপর প্রেসিডেন্ট পাখী শিকারের উদ্দেশ্যে লারকানা যাত্রা করেন। মহেঞ্জোদারো বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা কালে বলেন যে, শেখ মুজিবকে আমার খেয়াল-খুশীমত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় নি। পার্লামেন্টারী শাসন-ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয় এবং এ অর্থেই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৭ই জানুয়ারী ভুট্টোর বাসভবন ‘আল মুরতজা’য় ভুট্টোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য যে, তাঁদের এই আলোচনা তাঁদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে চীফ অব স্টাফ আবদুল হামিদ খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদাও সময় সময় এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। যা হোক, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার আলাপ-আলোচনা বহির্জগতে প্রকাশের পথ পায় নি। তবে লারকানা ত্যাগের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সাথে প্রেসিডেন্টের যে আলোচনা হয়েছিল তা’ এইরূপঃ
“বিমানে উঠার আগে সাংবাদিকদের সাথে বলেন যে, জনাব ভুট্টোর সাথে তাঁর ফলপ্রসু মত বিনিময় হয়েছে—তাঁর শিকারও হয়েছে চিত্তাকর্ষক।
প্রেসিডেন্ট বলেন, সত্য বলতে কি, আমি তাঁর সাথে কোন ব্যাপারে আপোষ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করি নি। পরস্পর আপোষ আলোচনার দায়িত্ব তাঁর ও শেখ মুজিবুর রহমানের। আর এক জায়গায় আমি তৃতীয় সূত্র বলেই এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছি। আমি কিছু করতে পারি কিনা, সেই চেষ্টাই করছি। তিনি (জনাব ভুট্টো) শীগগিরই মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। … …
জনাব ভুট্টোকে দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, শেখ মুজিব ও তিনি দুই প্রধান নেতা এবং তাঁদেরই প্রথম একমত হতে হবে। মুজিব ভুট্টোর সাথে আলোচনা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বর্তমানে এটা নাজুক অবস্থায় আছে এ সম্পর্কে তিনি বেশী কিছু বলতে চান না। আগে এই দুই নেতা বৈঠকে মিলিত হোন। তারপর তাঁরা কি করতে চান, সেটা আপনাদের মতো আমিও তাঁদের কাছ থেকে জানতে চাই।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৯শে জানুয়ারী, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৬
ক্ষমতা হস্তান্তরের পেছনে যে একটা ষড়যন্ত্র চলছিল, তা’ দিন দিন স্পষ্ট হতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ধূর্তের মতো প্রথমে ভুট্টোর পরিকল্পনাটকু আত্মস্থ করে পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসেছিলেন এবং শেখ সাহেবের মনোভাব জানা হয়ে গেলেই পাখী শিকারের নাম ক’রে জনাব ভুট্টোর সাথে দীর্ঘ আলোচনায় অংশ নেন। লক্ষ্য করবার বিষয় যে, ভুট্টোর সাথে আলোচনায় ইয়াহিয়া খানকে আবদুল হামিদ খান ও পীরজাদাকে সঙ্গে রাখতে হয়েছে। পাকিস্তানের পরবর্তী ইতিহাসে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এই ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, প্রেসিডেন্ট বাইরে নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তিনি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সঙ্গে যোগসাজসে লিপ্ত ছিলেন।
যা হোক, আওয়ামী লীগ ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার সুপারিশ করেন। তাঁরা গণতন্ত্র ও বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রথমে একটি শাসনতন্ত্র রচনার পর সরকার গঠনের কথা উল্লেখ করেন। এ সংবাদ পরিবেশন ক’রে বলা হয়ঃ
“নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনতন্ত্র প্রণীত হইবার আগে দেশে নয়া সরকার গঠিত হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। দেশের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনগণ নিঃশব্দ ব্যালটের বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলার ‘স্বাধিকারের স্বপক্ষে যে দ্ব্যর্থহীন রায় ঘোষণা করিয়াছে, উহার সফল বাস্তবায়ন ঘটাইয়া একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে ভিন্নভাবে সরকার গঠন করিয়া গদি দখলের কথা আওয়ামী লীগ চিন্তাও করিতে পারে না। তাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির পরমতম আস্থাভাজন এবং আশা-আকাক্ষার মুখপাত্র আওয়ামী লীগ আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি পরামর্শ প্রদান করিয়াছেন। ইহার আগে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই তথ্য জানা গিয়াছে। … …”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২২শে জানুয়ারী, ১৯৭১]
উল্লেখযোগ্য যে, এ সময় কোন কোন পত্ৰিকা ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হইবে’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৭
সঙ্গীত শিল্পী সমাজ কর্তৃক শেখ মুজিবের সম্বর্ধনা
পূর্ব বাংলার সঙ্গীত-শিল্পী সমাজ ২৪শে জানুয়ারী তারিখে দেশবরেণ্য গণ-নায়ক শেখ মুজিবকে এক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে আয়োজিত এই সম্বর্ধনা সভায় শিল্প-শিল্পী ও নিজস্ব সংস্কৃতির রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত ক’রে বঙ্গবন্ধু বলেনঃ
“বাংলার মাটিতে ‘ভাড়াটিয়া তাহজিব তমদ্দুন’ আমদানীর দিন শেষ হইয়া গিয়াছে। বাংলার মানুষকে, বাংলার নিজস্ব সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিকাশকে আর দাবাইয়া রাখা যাইবে না। ছয় দফা কর্মসূচী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকারের মতই বাঙালীর সাংস্কৃতিক মুক্তিরও নিশ্চয়তা প্রদান করিবে। আর জাতীয় সঙ্গীত ও ললিতকলা একাডেমী বাংলার মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হইবে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতসেবীদের উদ্দেশে আমি বলিতে চাই, বাংলার মাটি ও মানুষকে বাঙালীর আশা-আকাঙ্খাকে ভিত্তি করিয়া নিজস্ব সাহিত্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরুন। ভয় নাই—বাংলার সাত কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫শে জানুয়ারী, ১৯৭১]
জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকায় আগমন
এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো উপলদ্ধি করলেন যে, শেখ মুজিবের সাথে আপোষ না ক’রে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হবে না। শেখ মুজিবও ইতিমধ্যে ভুট্টোর ক্ষমতার প্রতি দুর্বলতাকে শান্ত করবার চেষ্টা করলেন। তিনি জানালেন যে, ক্ষমতায় গেলে তিনি ভুট্টোর প্রতি সুবিচার করবেন। অতঃপর ভুট্টো সদলবলে ঢাকা আগমন করলেন। উদ্দেশ্য, বঙ্গবন্ধুর সাথে মোলাকাত। শেখ মুজিবের সাথে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ব্যাপারে এবং জাতীয় সমস্যাবলী সমাধানের জন্য জনাব ভুট্টো কিছুসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে ২৭শে জানুয়ারী ঢাকায় এসে পৌঁছলেন। ঢাকায় পৌঁছেই জনাব ভুট্টো বলেন যে, দু’পক্ষের একটা সমঝোতার সৃষ্টিকল্পেই তিনি ঢাকায় এসেছেন। এ সম্পর্কে একটি দৈনিকে সম্পাদকীয় লেখা হয়ঃ “ ……… নির্বাচনের পর হইতেই জনাব ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সহিত সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আগমনের আকাক্ষা প্রকাশ করিতেছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘শেখ সাহেব নির্বাচনে সর্বাপেক্ষা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৮
গৌরবময় বিজয় অর্জন করিয়াছেন। তিনি জনগণের জন্য বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছেন। আমি তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁহার সহিত আমার কোন মতবৈষম্য নাই। তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য একবার কেন, প্রয়োজন হইলে আমি দশবার ঢাকা যাইব। জনাব ভুট্টোর পূর্বেকার কোন কোন উক্তি জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়া থাকিলেও তাঁহার এই সব সাম্প্রতিক আবেগপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক উক্তি বিভ্রান্তিকর নয় বলিয়াই অনেকে মনে করেন। ঢাকা রওয়ানা হইবার ৪ দিন পূর্বে স্বীয় বাসভবনে সাংবাদিকদের সহিত আলোচনা প্রসঙ্গে জনাব ভুট্টো তাঁহার এই সফরকে ‘এ মিশন অব আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং’ বা সমঝোতার উদ্দেশ্যে সফর বলিয়া অভিহিত করেন।
তিনি একথাও বলিয়াছিলেন যে, ‘প্রয়োজন হইলে আমি সরিয়া দাঁড়াইতেও রাজী আছি, কিন্তু আওয়ামী লীগের পথে আমি কোন ক্রমেই বাধা হইয়া দাঁড়াইতে চাই না।’ জনাব ভুট্টোর এই সমঝোতার মনোভাব প্রশংসার দাবী রাখে। পূর্ব পাকিস্তানে তথা সারা দেশে মানুষ তাই আজ তাঁহার এই ‘সমঝোতার মিশনের’ পরিপূর্ণ সাফল্য কামনা করে। ……”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৭১]
বঙ্গবন্ধু যথার্থ আন্তরিকতার সাথে জনাব ভুট্টোকে অভ্যর্থনা জানালেন। ২৭শে ও ২৮শে জানুয়ারী দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু আলোচনার ফলাফল অপ্রকাশিত থাকে। আলোচনার ফাঁকে একদিন বঙ্গবন্ধু জনাব ভুট্টোকে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ করলেন। অতঃপর ঘুর্ণিবিধ্বস্ত অধিবাসীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর জন্য ভুট্টো একদিন হেলিকপ্টারযোগে ঘূর্ণিবিধ্বস্ত এলাকার ওপর দিয়ে ঘুরে এলেন। আলোচনাচক্র কয়েকবার অনুষ্ঠিত হ’ল। কিন্তু আলোচনার শেষ ফল খুব সন্তোষজনক হয়েছিল, একথা বলা যায় না। আলোচনা একরূপ অমীমাংসিত রেখেই ভুট্টো দলবল সহ পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি বলে গেলেন যে, আলোচনা আরও চলতে পারে—আলোচনার দরজা বন্ধ নয়।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ই ফেব্রুয়ারীর মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জন্য যে দাবী জানিয়েছিলেন তার প্রত্যুত্তরে ভুট্টো জানান যে, ঐ তারিখে অধিবেশন ডাকলে সময়ের ব্যবধানের দিক থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৬৯
খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে অধিবেশন ডাকাই তাঁর মতে সমীচীন বলে জনাব ভুট্টো উল্লেখ করেন। বলাই বাহুল্য, নানা ছল-চাতুরীতে সময় অতিবাহিত করা এবং এই সময়ের মধ্যে আঘাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করাই ভুট্টো ও তাঁর পশ্চিমা দোসরদের উদ্দেশ্য ছিল।
ভারতীয় বিমান ‘গঙ্গা’ হাইজ্যাক
এদিকে কাশ্মিরী মুক্তিযোদ্ধা বলে কথিত দুই তরুণ ভারতের ‘গঙ্গা’ নামক একখানি বিমানকে ‘হাইজ্যাক’ ক’রে লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণে বাধ্য করে। ঘটনাটি ঘটে ৩০শে জানুয়ারী তারিখে। হাইজ্যাকারদের সাথে বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদিও ছিল; বিমানটি লাহোরে অবতরণ কালে বিমানের যাত্রীদের চলে যেতে দেয়া হয়। বিমানে ৪ জন বৈমানিকসহ ৩২ জন যাত্রী ছিলেন। কিন্তু উক্ত দুই তরুণ বিমানটি ছেড়ে যেতে সম্মত হয় নি। তারা ভারতের নিকট দাবী জানাতে লাগলো যে, তাদের দলের যে সব কর্মীকে ভারত বন্দী ক’রে রেখেছেন, তাদেরকে মুক্তি না দিলে বিমানটি ফেরৎ দেয়া হবে না এবং যে কোন মুহূর্তে তা’ উড়িয়ে দেয়া হবে। ভারত সরকার সরাসরি এ দাবী অস্বীকার করেন এবং পাকিস্তান সরকারের নিকট থেকে বিমানটি দাবী করেন। এর ফলে ‘হাইজ্যাকার’ দু’জন ২রা ফেব্রুয়ারী তারিখে বিমানটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এটা যে পাকিস্তানেরই কূটনৈতিক চাল এ সম্বন্ধে ভারতের কোন সন্দেহই ছিল না। পাকিস্তানের এই ঘৃণ্য মনোভাবের প্রতিবাদ হিসেবে ভারত সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভারতীয় আকাশ-সীমার ওপর দিয়ে প্রথমে সামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ক’রে দেন এবং পাকিস্তান সরকারের নিকট বিমানটির ক্ষতিপূরণ দাবী করেন। পাকিস্তান সরকার এ দাবী মানতে অস্বীকার করলে ভারত সরকার ভারতীয় আকাশ-সীমার ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী বিমান চলাচনও বন্ধ ক’রে দেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও সরকার প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা বলে কথিত তরুণ দু’জনের কার্যকলাপে খুব উৎসাহ প্রদান ক’রে চলেন এবং বিশ্বের কাছে কাশ্মীরের প্রতি তাদের দাবী যে কতখানি ন্যায়সঙ্গত তা’ ‘সপ্রমাণ’ ক’রে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারতের প্রতিশোধমূলক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে তাঁরা প্রায় চুপসে গেলেন। অতঃপর এদের কেউ কেউ প্রমাণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭০
করতে উঠেপড়ে লাগলেন যে, তরুণ দু’জন আসলে ভারতেরই এজেন্ট। পরবর্তীকালে তারা এই তরুণ দু’জন বন্দী ক’রে আসামীর কাঠগড়াতেও দাঁড় করিয়েছিলেন।
ভারতের নেতৃবৃন্দের ন্যায় শেখ মুজিবও বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা পাকিস্তান সরকারের ঘৃণ্য কারসাজি। তিনি এই ঘটনার পশ্চাতে একটি অশুভ ইঙ্গিত দেখতে পেলেন। পাকিস্তানের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যখনই জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় উপস্থিত হয়েছে তখনই একটি ঘটনার সৃষ্টি ক’রে তা’ বানচালের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সুতরাং তিনি জোরালো ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করলেন। ৩রা ফেব্রুয়ারী এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব এই ঘটনা তদন্ত করার দাবী জানান। তিনি আরও বললেন যে, শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দেওয়ার জন্য কায়েমী স্বার্থবাদীরা যদি এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে, তা’ প্রতিরোধের জন্য জনগণকে সম্পূর্ণ প্রস্তত থাকতে হবে। এই ঘটনাকে কেউ যাতে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করতে না পারে, তার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি পুনরায় সরকারকে আহ্বান জানান।
এদিকে পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মত জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোও হাইজ্যাকারদের কার্যকলাপের প্রশংসায় মেতে উঠলেন। একই দিনে লাহোর থেকে করাচী যাওয়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকদের নিকট তিনি বললেনঃ “কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। দু’জন কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধাই ভারতীয় বিমানটি উড়িয়ে দিয়েছে। অতএব, এর জন্য পাকিস্তান সরকার বা পাকিস্তানী জনগণকে দায়ী করা যায় না।”
তিনি আরও বলেছিলেন যে, “কাশ্মীরী কমাণ্ডো দু’জনকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় দানের কোন প্রশ্ন ওঠে না। কেন না তারা ভারতীয় নাগরিক নয়। আর কাশ্মীরী হিসেবে পাকিস্তানে বসবাস করবারও তাদের অধিকার রয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
পাকিস্তানের ঘৃণ্য কারসাজীর বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭১
পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের বিবৃতির নিন্দা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি। অবশ্যই এতে বঙ্গবন্ধুর এবং বঙ্গবন্ধুর পশ্চাতে দণ্ডায়মান সাড়ে সাত কোটি মানুষের কিছু এসে যায় না।
যা হোক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এহেন পরিস্থিতির ভেতরেও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার সঠিক তারিখ নির্ধারণ ও কতিপয় জরুরী বিষয়ে আলোচনার জন্য শেখ মুজিবকে তাঁর দলবলসহ ইসলামাবাদে আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রেসিডেন্টের জবাবে বলেন যে, তাঁর দলের মন্তব্য প্রেসিডেন্টের নিকট ব্যক্ত করা হয়েছে। এখন তাঁর নতুন ক’রে আর কিছু বলার নেই।
ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা
ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন যে, মুজিব তাঁর দলবলসহ ইসলামাবাদে গেলে ৬-দফা সম্পর্কে একটি আপোষ সম্ভব হোত। কিন্তু ৬-দফা কোন আপোষের ব্যাপার নয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে রায় দিয়েছে তার সম্পর্কে কোন আপোষ চলতে পারে না। সে কারণেই মুজিব এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এতে মুজিবের দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক পরিপক্কতাই প্রমাণিত হয়েছে। এবারেও ইয়াহিয়ার আর একটি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া নির্বাচনের পর এইরূপ অনেক জাল বিস্তার করেছিলেন। অবশেষে সেই জালে তিনি নিজেই আবদ্ধ হয়েছেন। যাহোক, বেগতিক দেখে ১৩ই ফেব্রুয়ারী ইয়াহিয়া খান ঘোষণায় জানালেন যে, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে ৩রা মার্চ বুধবার সকাল ন’টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া
প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পর বিশেষতঃ আতাউর রহমান খান ও মোজাফফর আহমদ প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানান। ১৫ই ফেব্রুয়ারী ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের এক যৌথ বৈঠকে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। উক্ত বৈঠকে জনগণের অধিকার ও আশা-আকাঙ্খা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭২
পূরণের উদ্দেশ্যে কোন কর্মপন্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর অর্পণ করা হয়। উক্ত সভায় প্রদত্ত শেখ মুজিবের বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে পরদিন দৈনিক পাকিস্তান লিখেছেনঃ “আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল সোমবার বলেন, তাঁর দল ছয়-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সে প্রশ্নে কোন ব্যক্তি বা দল তাঁদের বাধা দিতে পারবে না।
তিনি মনে করেন, ৬-দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হ’লে দেশের সব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের উপকার হবে। তিনি আরও বলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে ছয়-দফা কর্মসূচীকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তাঁরা যদি ছয়-দফা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেন তবেই আমরা একসঙ্গে ভাইয়ের মত বসবাস করতে পারি। … …
শেখ সাহেব বলেন, ছয়-দফা আগে আওয়ামী লীগের সম্পত্তি ছিল। কিন্তু এখন এটা জনগণের সম্পত্তি, এর পরিবর্তন বা পরিবর্জন করা তাঁর বা আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হ’লেও আমরা সবার সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব কামনা করি।
তিনি বলেন যে, গণতান্ত্রিক দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইচ্ছাই সবাই মেনে নেয়। কিন্তু পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি গত ২৩ বছর দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তার জের এখনও শেষ হয় নি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অযথা বিলম্ব করার জন্য নানাভাবে এখনও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।
তিনি ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণই তাঁদের দিয়েছে, কারোর কাছ থেকে ভিক্ষা ক’রে আনতে হয় নি।
শেখ সাহেব বলেন, তাঁরা গণতন্ত্রে এবং আইন-শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। কিন্তু কেউ যদি মনে ক’রে থাকেন তিনি আমাদের অন্য কিছু গ্রহণ করাতে পারবেন, তবে তিনি ভুল করেছেন। আমরা কামানের গুলীর মুখেও ছয়-দফার ভিত্তিতে ছাড়া শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবো না। তিনি দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী ও ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশে কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৩
ক’রে বলেন যে, জনগণের এই বিপুল সাফল্যের পরও তারা যেভাবে তা’ বানচালের চেষ্টা করেছেন সেটা আগুন নিয়ে খেলারই সমতুল্য। তিনি সবরকম ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটিত ক’রে ফেলার জন্য জনগণকে ও দলীয় কর্মীকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভূমিকার প্রশংসা ক’রে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, এখনও পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন ক’রে এসেছেন। তিনি বলেন যে, জনসাধারণ ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবী আদায় করলেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আগমনেই জনগণের ভোটাধিকার স্বীকার ক’রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে—এক ইউনিট বাতিল করা হয়েছে।
শেখ সাহেব ষড়যন্ত্রকারীদের কথায় কর্ণপাত না ক’রে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক যত শীঘ্র সম্ভব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস ক’রে, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ক’রে সবাই তাঁর দলকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র করছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে।
শেখ সাহেব বলেন, ৬-দফার প্রশ্নে তাঁর এবং তাঁর দলের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য এক শ্রেণীর আমলা ও একচেটিয়া স্বার্থবাদী মহল পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে বলে তিনি খবর পেয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণের লুপ্ত অধিকার আদায় করা। তারপর সম্ভব হ’লে ক্ষমতায় যাওয়া।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা উল্লেখ ক’রে তিনি বলেন যে, পিপলস পার্টির নেতা জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো বৈঠকের পর জানান যে, তিনি (ভুট্টো) আলোচনায় খুশীও নন, অখুশী হন নি। শেখ সাহেব তুমুল হাস্যরোলের মধ্যে বলেন, আমিও তাঁর সঙ্গে আলোচনা ক’রে সুখী বা অসুখী কোনটাই হই নি। তিনি জনাব ভুট্টোকে বলেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে। তিনি কাউন্সিল নেতা শওকত হায়াত খান, মওলানা নূরানী, বেলুচিস্তানের নওয়াব বুগতি ও বাহাওয়ালপুরের প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথাও উল্লেখ করেন
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৪
এবং বলেন যে, প্রয়োজন হ’লে তিনি অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গেও আলাপ আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে ৬-দফার ব্যাপারে কি আলোচনা করবো? তাঁরা কি এত দিনেও ৬-দফা কর্মসূচী বুঝতে পারেন নি? নাকি তাঁরা ৬-দফা বুঝতে চান না। তিনি বলেন, এ সব নেতারা একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন যে, চাবিকাঠি এখন আমাদের হাতে এসে গেছে। আমরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ নেতা বলেন যে, তাঁর দল কোনদিন পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারিত সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলেন নি। বরং তাঁরা জানিয়ে এসেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাঁরা সর্বদা সংগ্রাম ক’রে যাবেন। তিনি বলেন যে, অত্যাচারী, শোষক, জনস্বার্থবিরোধী আমলা এবং শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁরা আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদ এবং অন্যান্য যে সব শহীদ জনগণের দাবী আদায়ের সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন, তাদের নামে শপথ ক’রে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন যে, তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সমস্যাবলী সম্পর্কে তাঁকে কোন কিছু জানানো প্রয়োজন মনে করেন নি।
সম্প্রতি ইসলামাবাদে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের আহ্বান ক’রে লাহোরে ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বশেষ যে খবরাখবর জানানো হয়েছে তার প্রতি ইঙ্গিত ক’রে শেখ সাহেব বলেন যে, এই ব্যাপারে তাঁকে কিছুই জানানো হয় নি। পররাষ্ট্র দফতরের একজন অফিসার পাঠিয়েও বর্তমান সরকার তাঁকে কিছু জানানো প্রয়োজন মনে করেন নি। তিনি প্রশ্ন করেন, আপনারা সরকার পরিচালনা করছেন ঠিকই কিন্তু কার প্রতিনিধি আপনারা?”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ভুট্টোর যোগদানে অস্বীকার
সে দিনই পিপলস পার্টি প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো পেশোয়ারে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৫
পরিপ্রেক্ষিতে হুমকি প্রদান ক’রে বলেন যে, আওয়ামী লীগ ৬-দফার প্রশ্নে আপোষ না করলে তাঁর দল ৩রা মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেন না। ভুট্টোর এই হুমকি প্রদান প্রসঙ্গে এ. পি. পি-র বরাত দিয়ে দৈনিক পাকিস্তান এক সংবাদে লিখেছেনঃ “পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ বলেন যে, আওয়ামী লীগের ৬-দফার ব্যাপারে আপোষ বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তাঁর দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না। … …
তিনি বলেন যে, দেশের প্রয়োজনোপযোগী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ৬-দফার যতটুকু জানা সম্ভব তাঁর দল ততটুকু করেছে। কিন্তু এখন তো শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তাঁদের ঢাকা যেতে হচ্ছে না, যেতে হচ্ছে প্রণীত শাসনতন্ত্র গ্রহণ করার জন্য। জনাব ভুট্টো বলেন, আমাকে যদি এটুকু বলা হয় যে, আপোষ ও পুনর্বিন্যাসের অবকাশ রয়েছে, তা’ হ’লে আজই ঢাকা যেতে আমি তৈরী রয়েছি। পাকিস্তান গড়ে তোলার কোন উদ্দেশ্য যদি থেকে থাকে তা’ হ’লে আজই আমরা পরিষদে যেতে রাজী আছি। তিনি জানান যে, তাঁর দল একটি দফা বাদে ছাত্রদের ১১-দফা মেনে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের ৬-দফার প্রকৃত ফেডারেশন ও গণবাহিনী গঠন সম্পর্কিত দফা দুটিও তাঁরা মেনে নিয়েছেন। ৬-দফার বাকি দফাগুলোর প্রশ্নে তিনি জানান যে, সেগুলোর ব্যাপারে কোন একটি আপোষ মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব হতে পারে। কর আরোপের ক্ষমতা সংক্রান্ত দফাটি সম্পর্কে মীমাংসা হওয়ার আশা খুব কম। এমনকি এ-ব্যাপারেও তিনি একেবারে নিরাশ নন।
পিপলস পার্টির প্রধান বলেন যে, তাঁরা ঢালের শেষ পর্যন্ত গেছেন, এর বেশী এগুলে তাঁদের খাদে পড়তে হবে। জনাব ভুট্টো আরো বলেন যে, তিনি সব সময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার অবসানের কথা বলেছেন। এগুলোই দেশের মৌল সমস্যা। কিন্তু বর্তমানে শাসনতন্ত্র প্রণয়নই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শাসনতন্ত্র প্রণীত না হ’লে ঈপ্সিত সংস্কার করা যাবে না। তাই তিনি জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রতিই অখণ্ড মনোযোগ দিচ্ছেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৬
তিনি জানান যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক, তাঁর দল তাই চায়। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে তাঁদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাঁরা সেখানকার সম্পদ জনসাধারণের কল্যাণে লাগাতে পারবে। পিপলস পার্টি বিরোধী দল হয়ে থাকবে, না কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকারে শরিক হবে, তা’ বড় কথা নয়—দলের বৃহত্তর স্বার্থেই তাঁরা সত্বর ক্ষমতা হস্তান্তর কামনা করেছে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, নির্বাচনী প্রচার কালে তাঁর দল ৬-দফা সম্পর্কে কোন নীতি গ্রহণ করে নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বহু নেতা ৬-দফার তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, আজ সেই সব সমালোচনাকারীরাই ৬-দফার প্রশংসাকারী সেজেছে। এরা এতদিন ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রবক্তা। আর পিপলস পার্টি বলে আসছে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কার্যোপযোগী হতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের জন্য পিপলস পার্টির রয়েছে বিরাট শ্রদ্ধা। পূর্ব পাকিস্তানীরা শাসিত হয়েছে, তাদের ক্ষোভের কারণ আছে। পিপলস পার্টির ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়েছে, দেশে একটা অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক কাঠামো আছে। সেই কাঠামোর মূলোচ্ছেদ করতে হবে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, ৬-দফায় যতটুকু এগুনো সম্ভব তাঁর দল ততটুকু এগুনোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে বলে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, ৬-দফা সম্পর্কে তিনি তাঁর নিজের দল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের সাথে আলোচনা করেছেন। তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৬-দফার বিরোধী, আর কিছু সংখ্যক আছে যারা ৬-দফা মেনে নেবার কথা বলেছেন। আগামী ২০শে ও ২১শে ফেব্রুয়ারী করাচীতে তাঁর দলের যে বৈঠক হবে তাতে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, তিনি আশা করেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে আসলে ৬-দফা সম্পর্কে আরো আলোচনা করা যাবে। শেখ মুজিব মনে করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান পরিবেশ তাঁর সফরের পক্ষে অনুকূল নয়। আওয়ামী লীগের মধ্যে আদান-প্রদানের মনোভাব আছে কিনা তা’ তিনি জানেন না। শেখ মুজিবের পক্ষে যদি
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৭
এখানে আসা সমীচীন না হয়, তা’ হ’লে ভারতের সাথে পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ঢাকা যাওয়া আরো বেশী কঠিন। ভারত সম্পর্কে পিপলস পার্টির নীতি অত্যন্ত পরিষ্কার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বারবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিচ্ছেন। এ অবস্থায় জনসাধারণের পাশে থাকা তাঁর দায়িত্ব।
জনাব ভুট্টো বলেন, “আমার জীবন আমি বিপন্ন করতে পারি কি আমি তো একা নই, দলের ৮৩ জন নেতার প্রশ্নও জড়িত। ভারতের শত্রুতা এবং ৬-দফা না মানার ফলে ঢাকায় তাঁদের অবস্থা হবে ডবল জিম্মীর শামিল। তিনি তাদের সেই অবস্থায় ফেলতে পারেন না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
ভুট্টোর এই ঘোষণায় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড অসন্তোষ দেখা দেয়। ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান জানান যে, ভুট্টোর এই সিদ্ধান্তের ফলে গণমনে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা সম্পর্কে প্রবল সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন যে, তাঁর দল পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবে।
অধিবেশনে যোগদানে কাইয়ুম খানের অস্বীকৃতি
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নেতা মুসলিম লীগের কাইয়ুম খান ভুট্টোর সাথে হাত মেলালেন। নির্বাচনে তাঁর দল পূর্ব বাংলায় একটি আসনও পায় নি; পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি চরম ভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন। সামান্য ক’জন পরিষদ সদস্য তাঁর দলের মূলধন। ক্ষমতায় যাওয়া তাঁর পক্ষে কোন ক্রমেই সম্ভব নয়, আর সম্ভব নয় বলেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টিকে বানচাল ক’রে দেবার জন্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন। ভুট্টোকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন, আর সে ভরসাতেই তিনি ভিড়ে গেলেন ভুট্টোর দলে—মাণিকে মাণিক চেনে।
১৬ই ডিসেম্বর তাঁরা উভয়েই আলোচনায় মিলিত হওয়ার পর অকস্মাৎ ভুট্টো ঘোষণা করেন, একটা তৈরী শাসনতন্ত্রে কেবল স্বাক্ষর দানের জন্য তিনি ৩রা মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে যোগদান করতে রাজী নন। তিনি হুমকি প্রদর্শন করে বলেন যে, যদি পশ্চিম পাকিস্থান থেকে কেউ যায়, তা’ হ’লে তিনি পেশোয়ার হতে খাইবার পর্যন্ত আগুন জ্বালিয়ে দেবেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৮
ভুট্টোর হুমকির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
ফেব্রুয়ারীর ১৭ তারিখে ওয়ালী ন্যাপের নির্বাচিত সদস্যগণ জাতীয় পরিষদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই দিন বেলুচ নেতা আকবর খান বুগতি শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের পর মন্তব্য করেন যে, অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে ভুট্টোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের দু’ অংশকে আলাদা করার উদ্দেশ্য নিয়েই গ্রহণ করা হয়েছে। পরের দিন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল নূর খান এবং সিন্ধি নেতা জি. এম. সৈয়দ শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদিকে ঠিক সেই দিনই অকস্মাৎ ঢাকায় জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার অফিসে একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে।
শেখ মুজিব দলীয় পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত করা হয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭১) ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারী পার্টির এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সহকারী নেতারূপে নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। জাতীয় পার্লামেন্টারী পার্টির অন্যান্য কর্মকর্তা হচ্ছেনঃ পার্টির সেক্রেটারী জনাব এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান ও চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এছাড়াও হুইপ নির্বাচিত হন কুষ্টিয়ার জনাব আমিরুল ইসলাম ও জনাব এম. এ. মান্নান।
ঐ দিন বিকেলে একই স্থানে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের বৈঠকে পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। উভয় বৈঠকেই শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন।
১৮ই ফেব্রুয়ারী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জরুরী আমন্ত্রণে করাচী থেকে রাওয়ালপিণ্ডি যান। সেদিন জনাব ভুট্টো করাচীতে এক দলীয় কর্মী সমাবেশে সদম্ভে ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া দেশে তিনি কোন চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করেন না।
পরদিন অর্থাৎ ফেব্রুয়ারীর ১৯ তারিখে পিণ্ডিতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ৫ ঘন্টাব্যাপী এক গোপন আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনা শেষে হোটেলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৭৯
ফিরে এসে জনাব ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন যে, তাঁর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ‘অনড় ও অপরিবর্তনীয়’ রয়েছে।
শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সমঝোতা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হ’লে জবাবে তিনি বলেন, “দরজা বন্ধ করিয়া দেই নাই। আলাপ-আলোচনার জন্য দরজা খোলা রাখার নীতিতেই আমরা বিশ্বাস করি। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা গ্রহণের অবকাশ রহিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২০শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু জানতে চাওয়া হ’লে তিনি বলেন যে, “প্রেসিডেন্টের সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় স্বার্থ এবং জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।”
একই দিনে কাউন্সিল লীগ নেতা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল নূর খানও শেখ মুজিবের সঙ্গে দেড় ঘন্টা কাল ধরে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে নূর খান মন্তব্য করেন যে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় পরিষদে উত্তম শাসনতন্ত্র রচিত হতে পারে।
পাকিস্তানের এই সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই এলো ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। অন্যান্য বৎসরের চেয়ে অধিকতর তাৎপর্যের সঙ্গে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপিত হ’ল।
বাংলা একাডেমীতে শেখ মুজিবের ঘোষণা
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন করার সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান একুশে উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী ১৫ই ফেব্রুয়ারী থেকে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মসূচী গ্রহণ করে। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সে দিন তিনি বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে, “যে দিন থেকে তাঁর দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, সেদিন থেকেই অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু হবে। যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ এতদিন শুধু মুখে মুখে প্রচলিত ছিল কিন্তু আজ এটা বাস্তব সত্য এবং নিঃসন্দেহে বাঙালী আজ একটি জাতির নাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮০
একাডেমীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ ক’রে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এই সেই ভবন, যার অভ্যন্তর থেকে বাংলা ভাষা-সংগ্রামীদের গুলী করার আদেশ দেয়া হয়েছিল—এতে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকতেন। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, এই ভবনেই বাংলা একাডেমী স্থাপন করবো; সে প্রতিজ্ঞা আমাদের সফল হয়েছে। কিন্তু গণ-দুশমনদের জঘন্য চেষ্টায় এই একাডেমী তেমন কিছু করতে পারে নি। বার বার লোক বদল ক’রে এখানে বাংলার প্রকৃত চর্চাকে রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলেছে। বাংলাকে ইসলামী করণের চেষ্টা চলেছে—আরবী আর রোমান হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছে আর এই একাডেমীর জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র তিন লক্ষ। দুষ্কৃতিকারীরা জানতো, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হ’লে এর সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয় প্রথম। তিনি প্রশ্ন করেন, যারা এসব করেন, তাঁরা কারা?’ তারাও কি আপনার আমার মত এই বাংলার মাটিতে জন্ম গ্রহণ করে নি?”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
শহীদ মিনারে শেখ মুজিব
২১শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ক’রে শপথ-বাণী উচ্চারণ ক’রে বলেন, “বাঙালীকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারো নেই। যারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধিকারের দাবী বানচালের জন্য বাঙালীকে ভিখারী বানিয়ে ক্রীতদাস করে রাখছে, তাদের উদ্দেশ্য যে কোন মূল্যে ব্যর্থ ক’রে দেয়া হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
সেদিন তিনি অশ্রু ভারাকান্ত কণ্ঠে বলেন, “ভাইরা আমার, বোনেরা আমার—সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়তো আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানিনা আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো! তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাংলার সকল মানুষকে ডেকে বলছি—চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হোন বাংলার মানুষ যেন শোষিত না হয়, বঞ্চিত না হয়, লাঞ্ছিত-অপমানিত না হয়। দেখবেন শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। যতদিন বাংলার আকাশ, বাতাস, মাঠ, নদী থাকবে, ততদিন শহীদরা অমর হয়ে থাকবে। বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফিরছে; বাঙালী তোমরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮১
কাপুরুষ হইও না, চরম ত্যাগের বিনিময়ে হ’লেও স্বাধিকার আদায় কর। বাংলার মানুষের প্রতি আমার আহ্বান—প্রস্তুত হোন স্বাধিকার আমরা আদায় করবই।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
পিপলস পার্টির ৫-দফা ফর্মুলা
ফেব্রুয়ারীর ২১ তারিখেই পিপলস পার্টির জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ভুট্টো সাহেবকে প্রয়োজন বোধে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদান করেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য তারা ৫-দফার একটি ফর্মুলাও প্রণয়ন করেন। এই ৫-দফা ফর্মুলা হ’লঃ
“(১) ফেডারেল সরকার বলতে যা বোঝায় সত্যিকার সেই ধরনের একটা ফেডারেল সরকার গঠন।
(২) প্রতিটি অঙ্গ ইউনিট যাতে সমান প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে এবং তাদের নীতি ও পরিকল্পনার ব্যাপারে সমন্বয় সাধন করতে পারে তজ্জন্য কেন্দ্রে একটা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন-পরিষদ গঠন। তবে উচ্চ-পরিষদ বা সমন্বয় সাধন সংস্থাকে লর্ড সভার মত হতে হবে এমন কথা নেই।
(৩) আন্তঃ-আঞ্চলিক ও আন্তর-প্রাদেশিক শোষণ বন্ধ কল্পে মুদ্রা ও কর ধার্যের ব্যাপারে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে হবে।
(৪) সর্বাধিক কর্মক্ষমতা অথচ একটা কার্যকর কেন্দ্রের জন্য ফেডারেল সরকারের ব্যয় নির্বাহের নিমিত্ত রাজস্ব আদায়ে ফেডারেল সরকারকে ক্ষমতা প্রদান।
(৫) বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিদেশী সাহায্য বিষয় ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে থাকবে এবং শাসনতন্ত্রে প্রদেশসমূহের মধ্যে পাকিস্তানী নাগরিকদের তথা চাকরী-বাকরী ও বিভিন্ন পণ্যের অবাধ চলাচলের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
২২শে ফেব্রুয়ারী ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন। তিনি প্রাদেশিক গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসকদের সঙ্গে
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮২
বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন। ঐদিন কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে ঘোলাটে হতে শুরু করল। শেখ সাহেবের কাছে জঙ্গী শাহীর মনোভাব আর অস্পষ্ট রইল না।
শেখ মুজিবের সাংবাদিক সম্মেলন
২৪শে ফেব্রুয়ারী তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, “জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং তাঁদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরকে ‘সাবোট্যাজ’ করার উদ্দেশ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি বলেন যে, দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের কথা স্মরণ ক’রে আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা পালন করেছে। কারণ আওয়ামী লীগ তীব্র বিরোধের দ্বারা রাজনৈতিক আবহাওয়া বিষাক্ত করতে চায় নি।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
বঙ্গবন্ধু বলেন, “অহেতুক দেরী করে পরিশেষে ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের নোটিশ দেওয়া হ’লো। তখন মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যে, ষড়যন্ত্রকারী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী শক্তি জয়ী হয়েছে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
তিনি বলেন, “পাকিস্তানে যখনই জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছে তখনই এই কৃষ্ণ শক্তি, ষড়যন্ত্রকারী শক্তি সক্রীয় হয়ে ওঠে। এই গণবিরোধী শক্তি, ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত ক’রে ১৯৫৫ সালে আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী করে এবং তারপর প্রতিটি গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য হস্তক্ষেপ করে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২০শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
তিনি বলেন যে, “জনাব ভুট্টো এবং পিপলস পার্টি হঠাৎ ক’রে মনোযোগ আকর্ষণকারী ভাবভঙ্গী ও মত প্রদান শুরু করেন। এতে জাতীয় পরিষদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি ক’রে শাসনতান্ত্রিক কার্যপ্রণালী নস্যাৎ করার প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৩
তিনি জনগণের বিজয় সাবোট্যাজ করার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য পাকিস্তানের নির্যাতিত জনগণ এবং বাংলাদেশের নির্যাতিত জনতার প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু পিপলস পার্টির বর্তমান বক্তব্য প্রসঙ্গে পি. পি. পি-র জেনারেল সেক্রেটারী জনাব জে. এম. রহিমের লিখিত অভিমত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “জনাব রহিম স্বীকার করেছেন যে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তব অবস্থার শিকার হয়ে পূর্ব পাকিস্তান সত্যই একটি উপনিবেশ (কলোনী) হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা’ সত্ত্বেও ৬-দফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কয়েকটি মৌলিক আপত্তি সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, এগুলো অর্থাৎ কায়েমী স্বার্থবাদীদের কার্যক্রম বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক অবস্থাকে চিরস্থায়ী করার হিসেবী-পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন যে, “কেন্দ্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য থাকলে বাঙালীকে শোষণ সম্ভব হত না। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের হাতে মুদ্রা ও বাণিজ্য রাখার চাপ দেওয়ার পরিষ্কার অর্থ জাতীয় সংহতির স্বার্থ নয়, বাংলাদেশকে ঔপনিবেশিক শোষণ করার উদ্দেশ্যে শোষকের প্রধান যন্ত্র কেন্দ্রের হাতে রাখা।”
তিনি আরো বিশ্লেষণ করেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির উপর ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন চাপিয়ে দেওয়ার কোন অভিপ্রায় আওয়ামী লীগের নেই। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলি বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন না চান এবং তারা নিজেরাই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করেন, তা’ হ’লে আওয়ামী লীগের কিছু বলার নেই। তবে এ ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব রয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলি যদি নিজেরা বিষয়টি মীমাংসা করতে না পারেন, তা’ হ’লে আওয়ামী লীগ সে দায়িত্ব পালন করবে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১]
আহসান-মুজিব সাক্ষাৎকার
২৬শে ফেব্রুয়ারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস. এম. আহসান শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে ৩০ মিনিট ব্যাপী এক আলোচনায় মিলিত হন। ইয়াহিয়ার কাছ থেকে শেখ সাহেবের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে এসেছেন বলে গভর্নর মন্তব্য করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৪
আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্র বিবেচনা
পরদিন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী বৈঠকে ৬-দফা ভিত্তিক দলীয় খসড়া শাসনতন্ত্রটি বিবেচনা করা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টারী পার্টির আর এক বৈঠকে জাতীয় পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনে সাতজন মহিলা প্রার্থীকে মনোনয়ন দান করা হয়। ২৮শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি কর্তৃক প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে শেখ মুজিবকে এক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সবর্ধনার জবাবদান কালে বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, “তাঁর দল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তবে সে সমাজতন্ত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, বরং নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পন্থায় আস্তে আস্তে বিবর্তনের মাধ্যমে সে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যাবে’ বলে তাঁর দল বিশ্বাস করে।”
ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা
আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত সুপারিশ মেনে নেয়া হবে। “……আওয়ামী লীগ প্রধান পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের ঢাকায় এসে দেশের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে যোগদানের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, শাসনতন্ত্র রচনার জন্য জনগণ তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। কাজেই শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সবার পক্ষেই পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করা উচিত। শেখ মুজিব আশা প্রকাশ করেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের নির্ধারিত সময়ে পরিষদে দিনরাত আলোচনার মধ্যে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, যদি একজন সদস্যও সুষ্ঠু ও ন্যায্য সুপারিশ করেন তা’ মেনে নেয়া হবে।
জাতীয় পরিষদকে কসাইখানা এবং পূর্ব বাংলায় এসে ‘জিম্মী’ হওয়া সম্পর্কে জনাব ভুট্টোর উক্তিকে শেখ মুজিব বাঙালীদের প্রতি অপমানজনক বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, তিনি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এই প্রসঙ্গে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ না দেয়া সম্পর্কে জনাব ভুট্টোর হুমকির কথা উল্লেখ ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, বাংলাদেশ বলে যদি তিনি মাত্র ৮৩ জন সদস্য নিয়ে আসতে না চান, তা’ হ’লে আওয়ামী লীগ ১৬০ জন সদস্য নিয়ে বলতে পারে ‘আমরাও যাব না।’
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৫
শেখ মুজিব জিজ্ঞেস করেন তা’ হ’লে কি হবে? শেখ মুজিব এই প্রসঙ্গে আরো বলেন যে, এতদিন ধরে বাঙালীরা সামান্য ২শো টাকার পারমিট থেকে শুরু ক’রে সব কাজে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছে, কোন দিন আপত্তি করে নি।
পূর্বাহ্নে আশ্বাস দান সম্পর্কিত জনাব ভুট্টোর দাবীর কথা উল্লেখ ক’রে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, তিনি কোন আশ্বাস দিতে পারেন না। কারণ ৬-দফা বর্তমানে জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।
শেখ মুজিব সম্বর্ধনা সভায় বলেন যে, ৬-দফা শুধু বাংলার মানুষের জন্যে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত সাধারণ মানুষের জন্যও। তিনি বলেন, তা’ সত্ত্বেও ৬-দফা সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের আপত্তির কারণ হচ্ছে, এতদিন কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে তাঁরা ভোগ করেছেন। এখন তাঁদের সেই দিন ফুরিয়ে বাঙালীদের পালা এসেছে।
তাই তিনি অভিযোগ করেন যে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ডিকটেটরশীপের (একনায়কত্ব) কথা বলেছেন, তাঁরাই সংখ্যালঘিষ্ঠের ডিকটেটরশীপ করছেন।
শেখ মুজিব আরও বলেন যে, সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বড় শিল্পপতিরা বাংলাদেশের ছোট ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের গ্রাস ক’রে ফেলেছে। তিনি বলেন, ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানী এই সব বড় শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে ছোট ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের গ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। তিনি পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ব্যাঙ্ক ও বীমা কোম্পানী জাতীয়করণ করে তা’ দুঃখী মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। কারণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা না হ’লে সাধারণ মানুষের কোন উন্নতি হবে না। তিনি বলেন, তবে এই সমাজতন্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠা করা হবে। … …”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১লা মার্চ, ১৯৭১]
ভুট্টো কর্তৃক পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের দাবী
সে দিনই লাহোরে এক জনসমাবেশে জনাব ভুট্টো বক্তৃতা দান কালে নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৬
দাবী জানান। এ সংবাদ পরিবেশন ক’রে দৈনিক পূর্বদেশ লিখেছেনঃ “পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ এখানে ঘোষণা করেন যে, জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ স্থগিত করা অথবা ১২০ দিন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় সীমা তুলে দেয়া হ’লে তিনি ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে রাজী আছেন। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় তাঁর দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকা যাবে না।
আজ বিকালে মিনা-এ-পাকিস্তানের কাছে ঐতিহাসিক ইকবাল পার্কে এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করছিলেন। জনাব ভুট্টো হুমকি প্রদর্শন ক’রে বলেন যে, তাঁর দলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হ’লে তিনি খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত আন্দোলন শুরু করবেন।
তিনি আরো ঘোষণা করেন যে, আগামী ২রা মার্চ জাতীয় পরিষদের মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে তাঁর দল ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’লে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করা হবে। এই প্রসঙ্গে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সেদিন যদি একটি দোকানও খোলা থাকে তা’ হ’লে তিনি মনে করবেন যে ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা কালে তিনি ৬-দফার কয়েক দফা মেনেছেন। তিনি কার্যকরী কেন্দ্রসহ ফেডারেশন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনেছেন। তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, মুদ্রা ও কর-এর ক্ষেত্রে সমঝোতায় আসা যেতে পারে। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য কেন্দ্রের বহির্ভূত করা হ’লে তা’ তাঁর দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কেন্দ্র বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে না।
পিপলস পার্টি প্রধান বলেন, তিনি পাকিস্তানকে নামেমাত্র চান না। তিনি পাকিস্তানকে এমন একটি শক্তিশালী এশীয় দেশ হিসেবে দেখতে চান যে, ভারতীয় আক্রমণ নস্যাৎ ক’রে দিতে সক্ষম হবে। জনাব ভুট্টো
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৭
বলেন, দেশকে একটি কার্যকরী শাসনতন্ত্র দিতে প্রয়োজন হলে তাঁর দল পরিষদে পাঁচ সাত বছর থাকতেও রাজী আছে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, দেশের প্রথম গণপরিষদ সাত বছরেও একটি শাসনতন্ত্র দিতে পারে নি। দ্বিতীয় পরিষদ শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তিন বছর সময় নিয়েছে। তিনি বলেন, তা’ হ’লে বর্তমান জটিল সমস্যায় জাতীয় পরিষদের কাছ থেকে কি ক’রে ১২০ দিনে একটি কার্যকরী শাসনতন্ত্র আশা করা যায়?
জনসমাবেশে ভুট্টো বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ৬-দফার বিরুদ্ধে তাদের রায় দিয়েছেন তা’ নির্বাচনের ফলাফল থেকেই প্রতীয়মান হয়। ৬-দফার পক্ষে সমর্থন দানের জন্য যারা এখান থেকে নির্বাচন প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। পিপলস পার্টি প্রধান আওয়ামীলীগের ৬-দফার ব্যাখ্যা ক’রে বলেন যে, তিনি এমন একটি কেন্দ্র চান যা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করবে। তিনি বলেন, তিনি প্রমাণ ক’রে দিতে পারেন ৬-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হ’লে পাকিস্তানের গোড়া কেটে যাবে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১লা মার্চ, ১৯৭১]
ফারল্যাণ্ড-মুজিব সাক্ষাৎকার
অধিবেশনের দিন ঘনিয়ে এলো। বাংলার মানুষ উদ্বেগ সঙ্কুল আগ্রহে সময় গণনা করতে লাগলো। আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাকিস্তানে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু সংখ্যক কূটনীতিকও ঢাকায় আসেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ জোসেফ ফারল্যান্ড ২৮শে ফেব্রুয়ারীতে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
ইয়াহিয়ার ঘোষণাঃ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত
পরদিন ১লা মার্চ ১৯৭১ সাল। অকস্মাৎ বেলা ১টা ৫ মিনিটে পাকিস্তান বেতারে পঠিত এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত থাকবে। পাকিস্তানের দু-অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দিয়েছে তার অবসানের অবকাশ সৃষ্টির জন্যই নাকি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরিস্থিতির উন্নতি হলেই তিনি পুনরায় সে পরিষদ ডাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৮
ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ এইরূপঃ
“আজ পাকিস্তান চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন। তাই বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমাদের বর্তমান বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্য আমি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাই সে সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করার প্রয়োজন বোধ করছি। তবে তা’ করার আগে আমার উপর দেশের শাসনভার অর্পিত হওয়ার দিন থেকে শুরু ক’রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আমি যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি সে সবের পুনরুল্লেখ করতে চাই। জাতির প্রতি প্রদত্ত আমার প্রথম ভাষণেই আমি সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছিলাম। তখন থেকেই এই লক্ষ্য অর্জনের পথে আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছি। দেশে সামরিক আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আমি রাজনৈতিক দলসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করি নি, বরং ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে পূর্ণ রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অনুমতি দিয়েছি।
অতঃপর ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে যথারীতি আইনগত কাঠামো আদেশ ঘোষণা করা হয়। এই আদেশের অধীনেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ এবং ভোটের তালিকা প্রণয়ন সহ অন্যান্য সকল কাজও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়।
দীর্ঘ ও আয়াসসাধ্য নির্বাচনী অভিযান এমনভাবে শেষ হয় যাকে আমরা গর্বের সঙ্গে বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সর্বাধিক শান্তিপূর্ণ ও সুসংগঠিত সাধারণ নির্বাচন বলে দাবী করতে পারি। আপনারা জানেন, ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত হয়। নির্বাচনের ঠিক আগে ১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে প্রদত্ত আমার ভাষণে আমি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, নির্বাচন এবং জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁরা যদি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হন এবং আমাদের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের প্রধান প্রধান বিষয়গুলোর উপর সাধারণভাবে ঐক্যমতে পৌঁছান, তবে তা’ তাঁদের জন্য ফলপ্রসূ হবে। ঐ সময়ে আমি এটাও আভাস দিয়েছিলাম যে, এ সব বৈঠকের সাফল্যের জন্য একটা দেয়া-নেয়ার মনোভাব, পারস্পরিক আস্থা এবং আমাদের ইতিহাসের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৮৯
এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময়ের যথাযথ উপলব্ধির দরকার হবে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এ ধরনের মত বিনিময়ের বিরাট গুরুত্ব উপলদ্ধি ক’রেই আমি তাঁদের মত বিনিময়ের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়ে কর্মপদ্ধতি সহজ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। এ জন্যই আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩রা মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম।
বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সহিত বলতে হচ্ছে যে, ঐক্যমতে পৌঁছিবার পরিবর্তে আমাদের কোন কোন নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক মোকাবিলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এতে সমগ্র জাতির উপর একটি বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পাটি এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া, ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল ক’রে তুলেছে। অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোন তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমি বার বার উল্লেখ করেছি যে, শাসনতন্ত্র কোন সাধারণ আইন নয়, বরং এটা হচ্ছে একত্রে বসবাস করার একটি চুক্তি বিশেষ। অতএব, একটি সুষ্ঠু ও কার্যকরী শাসনতন্ত্রের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের পর্যাপ্ত অংশীদারত্ববোধ থাকা প্রয়োজন।
এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়েই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। অবশ্য এ সকল সমস্যার বাস্তব দিকসমূহ আপনাদের লক্ষ্য করতে হবে। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, এত অধিক সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিনিধি পরিষদে যোগদান করছেন না যে, এ অবস্থায় আমরা যদি ৩রা মার্চ
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯০
জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে যাই তবে পরিষদটাই ভেঙ্গে পড়তে পারে এবং সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে সকল প্রচেষ্টার কথা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, তা’ সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
সুতরাং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত সমঝোতায় উপনীত হবার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আরো কিছু সময় দেওয়া উচিত। এ সময় দেওয়ার পর আমি একান্তভাবে আশা করি যে, তাঁরা একে কাজে লাগাবেন এবং সমস্যার একটি সমাধান বের করবেন। আমি পাকিস্তানী জনগণকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, ইতিপূর্বে বর্ণিত পরিস্থিতি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পক্ষে সহায়ক হওয়ার সাথে সাথেই আমি অনতিবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে কোনরূপ ইতস্ততঃ করবো না। আমার দিক থেকে আমি দেশবাসীকে আশ্বাস দিতে চাই যে, আমাদের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের কাজে আমি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সহায়তা করার জন্য আমার ক্ষমতার আওতায় যা কিছু সম্ভব সবই করবো এবং তা’ নিষ্ঠার সাথে করবো যেমন এ যাবৎ ক’রে এসেছি।
পরিশেষে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি, তিনি যেন আমাদের জাতির পিতার নির্দেশিত ঈমান, ঐক্য ও শৃঙ্খলার পথে পরিচালিত করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আমার দেশবাসীর কাছে আবেদন এই যে, আমাদের জীবনে এই সংকটময় মুহূর্তে তারা যেন পূর্ণ সংযমের পরিচয় দেন।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২রা মার্চ, ১৯৭১]
ইয়াহিয়া যে আসলে পাকিস্তানের চিরন্তন কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির জীবন্ত প্রতিভু এ কথা পূর্বে বলা হয়েছে। নির্বাচনের পর পরিষদের বৈঠক ডাকতে সুদীর্ঘ গড়িমসি, মূলনীতির দাম্ভিক ঘোষণা, সংবিধান সংক্রান্ত হুমকি, মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি ইত্যাদি কার্যের এক জঘন্য নায়ক এই ইয়াহিয়া। সুতরাং, একটি বড় অজুহাতের সুযোগ নিয়ে জাতীয় পরিষদের বৈঠক বসবার আসন্নকালে ১লা মার্চে এই বৈঠক স্থগিত ঘোষণা ক’রে ইয়াহিয়া এক জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার সূত্রপাত করলেন। এই বিশ্বাসঘাতকতা থেকেই জল্লাদ ইয়াহিয়া ধীরে ধীরে বাঙালীর রক্তপানের পথে এগিয়ে যেতে লাগলেন। রক্তপিপাসু জল্লাদ বিশ্বের নিষ্ঠুরতম গণহত্যায়
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯১
তাঁর দোসরদের নিয়ে আত্মনিয়োগ করলেন। ১লা মার্চের পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত সেই পথেই গড়িয়ে গেছে। সুতরাং, এই দিনটি ইয়াহিয়ার ঘোষণার জন্য এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ার জন্য বিখ্যাত হয়ে রইল।
সংবাদপত্রের প্রতিক্রিয়া
দৈনিক পাকিস্তান এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেনঃ
“প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল (সোমবার) এক বিশেষ বিবৃতিতে ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বৃহৎ দল অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং সেই সঙ্গে অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সঙ্কল্প প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে বলিয়া প্রেসিডেন্ট তাঁহার বিবৃতিতে বলেন। এই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতীয় কার্যকলাপের দরুন উদ্ভূত উত্তেজনাকর ও জটিল পরিস্থিতির কথা।
প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা জনসাধারণের নিকট অপ্রত্যাশিত মনে হইয়াছে। এই ঘটনা জনসাধারণের পক্ষে হতাশাব্যঞ্জক সন্দেহ নাই। জনসাধারণ গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য উন্মুখ হইয়াছিলেন। তাই সকলেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের প্রতি। ঠিক এই মুহূর্তে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো হুমকি দিলেন যে, তাঁহার দলের অংশ গ্রহণ ব্যতীত যদি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তাঁহার দল পশ্চিম পাকিস্তানে এক ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু করিবে। তিনি একটি অত্যন্ত কৌতুকপ্রদ শর্ত আরোপ করিতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করিলেন না। জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত রাখা হইলে অথবা ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শর্ত বাতিল করা হইলে তাঁহার দল পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিতে প্রস্তুত রহিয়াছে বলিয়া তিনি শর্ত আরোপ করেন। এই শর্ত যে একটি প্রবল চাপ তাহা অর্বাচীন বালকেরও বোধগম্য। বস্তুতঃ জনাব ভুট্টোর জেদের জন্যেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হইল। জনাব ভুট্টোর বর্তমান রাজনৈতিক কার্যক্রম যদি পাকিস্তানকে কোন বিপর্যয়ের
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯২
মুখে ঠেলিয়া দেয় তবে সে জন্য শুধুমাত্র তিনিই দায়ী থাকিবেন। ইতিহাস তাঁহাকে কোনদিন ক্ষমা করিবে না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২রা মার্চ, ১৯৭১]
ঐদিন আর এক ঘোষণায় প্রাদেশিক গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসানকে পদচ্যুত করা হয় এবং তাঁর স্থলে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেঃ সাহেবজাদাকে নিয়োগ করা হয়। জনাব আহসানকে পদচ্যুত করার পিছনে কোন কারণ না দর্শান হ’লেও এ বিষয়ে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা যে, জনাব আহসান বাঙালীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং শেখ সাহেবের সাথে তাঁর বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল বিধায় তাঁর অপসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য সফল করতে হ’লে জনাব আহসানের মত সহৃদয় ব্যক্তিকে গভর্নর পদে রেখে তা’ সম্ভব নয়। তাই তাঁকে সরিয়ে সামরিক বাহিনীর একজন পদস্থ অফিসারের উপর নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পণ করা হয়।
নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে বঙ্গবন্ধু বলে আসছেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র চলছে। ছদ্মবেশী ইয়াহিয়ার প্রকৃত রূপকে আর তাঁর চিনতে বাকী নেই। তাই জনগণকে আসন্ন বিপদের মোকাবিলার জন্য বারবার তিনি প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
বিক্ষুদ্ধ রাজধানী
বেতারে ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। সে দিনের প্রতিবাদমুখর রাজধানীর বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছেনঃ
“বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের মাত্র দুইদিন পূর্বে গতকাল (সোমবার) বেলা ১-০৫ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করিয়া পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্টের বিবৃতি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা প্রচণ্ড ক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। প্রেসিডেন্টের এই বিবৃতি প্রচারে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ বিক্ষোভে দাবানলের মত ছড়াইয়া পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের সকল দোকানপাট
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৩
বন্ধ হয়ে যায়। সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কল-কারখানার শ্রমিক এবং আদালতের আইনজীবিগণ রাস্তায় নামিয়া আসেন। গোটা শহর বিগত ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ন্যায় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। শিল্প এলাকা, কল-কারখানা, অফিস-আদালত এবং বিভিন্ন মহল্লা হইতে অসংখ্য স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বাহির হয়।
ঢাকা ক্লাবের সদস্যগণও স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বাহির করেন। রাজধানীতে টাউন সার্ভিস বাসও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মিছিলকারীদের চোখে-মুখে ক্ষোভানল পরিলক্ষিত হইতেছিল। বজ্রকণ্ঠে তাঁহারা সেদিন প্রকম্পিত করিয়া ভুট্টো ও শোষণ বিরোধী শ্লোগান দান করেন। এই সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে বি. সি. সি. পি. টিম এবং ইন্টারন্যাশনাল একাদশ টিমের মধ্যে অনুষ্ঠানরত খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাঙ্গিয়া যায়।
স্টেডিয়াম হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত বহির্গত ক্রীড়ামোদীগণও রণপ্রস্তুত সৈনিকের ন্যায় লাঠি-সোটাসহ মিছিলে সামিল হইয়া যান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মিছিলগুলি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ হইতে নির্দেশ লাভের উদ্দেশ্যে মতিঝিলস্থ হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। বেলা ৩টার দিকে হোটেল পূর্বাণীর সম্মুখভাগ লোকে লোকারণ্য হইয়া যায়।
উল্লেখযোগ্য যে, বেলা সাড়ে তিনটায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বৈঠক শুরু হইবার পূর্বেই পূর্বাণী হোটেল এলাকায় তিল ধারণের ঠাই থাকে না। এ সময় মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন ভবনের ছাদে দাঁড়াইয়া হাজার হাজার মানুষ শেখ সাহেবের নির্দেশ লাভের আশায় প্রতীক্ষা করিতে থাকেন। বৈঠক শেষে সংগ্রামের কর্মসূচী ঘোষণা না করা পর্যন্ত জনতা পূর্বাণী হোটেল এলাকায় দাঁড়াইয়া থাকেন।
ইতিমধ্যে পল্টন ময়দান এক স্বতঃস্ফূর্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ সময় রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লা এবং শহরতলী এলাকা হইতে একের পর এক মিছিল পল্টনের দিকে আসিতে থাকে। পল্টনের স্বতঃস্ফূর্ত জনসমুদ্রের উদ্দেশে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী,
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৪
সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ. শ. ম. আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন, আটষট্টি-উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব তোফায়েল আহমদ, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব আবদুল মান্নান প্রমুখ ভাষণ দান করেন।
এই বিশাল জনসমুদ্র জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত কর্মসূচীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। বিশাল জনসমুদ্র জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য বজ্রশপথ গ্রহণ করেন।
.. … ইহার পূর্বে ঢাকা বারের আইনজীবিগণ মিছিল করিয়া বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমবেত হন। তাঁহারা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শাহ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠান করেন। …”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা মার্চ, ১৯৭১]
সংবাদে বলা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার জাগ্রত শ্রমিক-মজুর-ছাত্র-জনতা দলে দলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ লাভের জন্য হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হয়। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর দলের নির্বাচিত সদস্যদের সাথে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বা তাঁর দলীয় কেউ জানতেন না যে, ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণে পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করেছেন। খবরটি জানবার সাথে সাথে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পূর্বাণী হোটেলের সামনে তখন জনসমুদ্র।
বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলন
বঙ্গবন্ধু তাঁর পার্টির কাজ সংক্ষিপ্তভাবে শেষ ক’রে হোটেল পূর্বাণীতে আকস্মিকভাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান ক’রে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানান। সেদিন বিকেল সাড়ে চারটায় আহূত এই সাংবাদিক সম্মেলনে মুজিবের ভাষণ তুলে ধরতে গিয়ে ইত্তেফাক লিখেছেনঃ “ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলেনঃ শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করিতে পারি না। ইহার দ্বারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৫
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো এবং জনাব কাইয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজী ছিলেন।
গতকাল (সোমবার) বিকালে পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগ পার্টির সংক্ষিপ্ত সভাশেষে আকস্মিকভাবে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় এবং আগামীকাল (বুধবার) ৩রা মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান।
সর্বাত্মক হরতাল পালনের পরবর্তী কর্মসূচী হিসাবে আগামী ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে। শেখ মুজিব বলেন, এই জনসভায় তিনি পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করিবেন।
হিংসাত্মক পথে নয়
জনগণকে যে-কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকিতে আহ্বান জানাইয়া শেখ মুজিব হিংসাত্মক পন্থা গ্রহণ হইতে বিরত থাকিতে পরামর্শ দেন। শেখ মুজিব বলেনঃ আমরা গণতান্ত্রিক দল এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাসী এবং আমরা শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাইয়া যাইব।
আমার সহিত আলোচনা হয় নাই
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার পূর্বে তাঁহার সঙ্গে কোন অলোচনা করা হইয়াছে কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেনঃ আমার সহিত আলোচনা হয় নাই।
ওদেরকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে বলি।
পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা চাইবেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের জনগণকেও চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আহ্বান জানাইবেন। তাঁহারা রুখিয়া দাঁড়াইবেন কি-না, তাহা তাঁহাদের উপরই নির্ভর করে।
অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করিব
অপরাপর রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করিবেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন যে, পরিষদ অধিবেশন স্থগিত
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৬
রাখার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন।
নিজ দলের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করার আশঙ্কা করেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেনঃ আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করিতে প্রস্তুত। জনগণ আমার সঙ্গে আছেন। আমরা ভালই আশা করি এবং চরম অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি।
নূতন দিনের নূতন শপথ
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন যে, তিনি ৭ই মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচী ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি বলেনঃ আমার দল আমাকে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা দিয়াছে। তিনি বলেন যে, পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যগণ গতকাল ৩রা জানুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে যে শপথ গ্রহণ করেছিলেন উহারই পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন।
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেনঃ ৩রা জানুয়ারী আওয়ামী লীগ সদস্যগণ ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার শপথ নিয়াছিলেন?
জবাবে শেখ মুজিব বলেনঃ আজ সদস্যগণ পাকিস্তানের জনগণের মুক্তির শপথ নিয়াছেন।
ওঁরা এ দেশেরই সন্তান
বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালীদের কি হইবে এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেনঃ তাঁহারা এই মাটিরই সন্তান। তাঁহাদিগকে এখানকার জনগণের সাথে মিশিয়া যাইতে হইবে।
শেখ মুজিব বলেনঃ আমরা গণতান্ত্রিক দল। আমরা গণতান্ত্রিক অহিংস অসহযোগ নীতি অনুসরণ করিব। আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হইয়াছি এবং শাসনতন্ত্র তৈরী করার জন্য আমরা তাদের নিকট দায়ী রহিয়াছি।
জনাব ভুট্টোর বিবৃতির উল্লেখ করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, জনাব ভুট্টো আইন ও শৃঙ্খলা নিজের হাতে গ্রহণের হুমকি দিয়াছেন। শেখ মুজিব বলেনঃ আমরা সকলের সহযোগিতা চাহিয়াছিলাম। আমরা ৬-দফা ব্যাখ্যা করিতে চাহিয়াছিলাম। গণতন্ত্রের বিধান হইতেছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গ্রহণ করতে হইবে এবং আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৭
ভুট্টো একই নিয়মে
ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, যখন গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হইয়াছিল, জনাব ভুট্টো উহাতে যোগ দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে তিনি নির্বাচন পিছাইবার দাবী তুলিয়াছিলেন এবং এক্ষণে পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবী তুলিয়াছেন।
এ কথার জবাব কি?
শেখ মুজিব বলেনঃ সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসাবে আমি ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করিতে বলিয়াছিলাম। সংখ্যালঘিষ্ঠের নেতা জনাব ভুট্টো মার্চের প্রথম সপ্তাহে আহ্বান করিতে বলিয়াছিলেন। আমি উহার বিরোধিতা করিয়াছিলাম। আবার জনাব ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত রাখিতে প্রস্তাব করেন এবং আমি উহার বিরোধিতা করি।
শেখ মুজিব প্রশ্ন করেনঃ ইহা কি সত্য নয় যে, গণতান্ত্রিক রীতি ভঙ্গ করা হইয়াছে? এই সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২রা মার্চ, ১৯৭১]
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা
বঙ্গবন্ধু উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী ঐ দিন রাতেই আতাউর রহমান খান ও মোজাফফর আহমদের সাথে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনায় মিলিত হন। পরদিন ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হয়। প্রদেশের সংবাদপত্রগুলো বিক্ষুদ্ধ বাংলার সচিত্র সংবাদ ফলাও ক’রে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে সাহেবজাদা ইয়াকুব সামরিক প্রশাসকের দ্বায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথে প্রথমে ভীতি প্রদর্শন ক’রে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেন। এই মর্মে তিনি এক সামরিক আদেশ জারী করেন—তাতে বলা হয় “পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ছবি, খবর ও অভিমত, বিবৃতি, মন্তব্য প্রভৃতি মুদ্রণ বা প্রকাশ থেকে সংবাদপত্ৰসমূহকে বারণ করা হচ্ছে। এই আদেশ লঙ্ঘন করা হ’লে ২৫ নম্বর সামরিক শাসন বিধি প্রযোজ্য হবে। এর সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২রা মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৮
২রা মার্চের হরতাল
কিন্তু তা’ সত্ত্বেও প্রদেশের দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর পত্রিকা জনগণের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সোচ্চারে সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ২রা মার্চ হরতালের বিবরণ দিয়ে পূর্বদেশ লিখেছেনঃ বিক্ষুব্ধ পূর্ব বাংলা। পথে পথে মিছিলের প্রতিরোধ। জনতার হরতাল ঐক্যকে দুর্জয় শপথে বলবান ক’রে বেঁধেছে। সূর্য-করের শাণিত উত্তাপে জীবনের রেণুকণা দিয়ে সারাটা তল্লাট ছেয়ে দিয়েছে। আগুনের হলকায় ওরা মানবিকতার পতাকা উড়িয়েছে। স্ফুলিঙ্গকে আলিঙ্গন ক’রে সংগ্রামের যে মশাল দাউ দাউ করে জ্বলছে, তারই প্রতিচ্ছবি বিম্বিত হয়েছে জনতার অগুণতি মিছিলে, মিছিলের বলিষ্ঠ মুখে মুখে, শপথদৃপ্ত মানুষের অগ্নিগর্ভ চোখে।
মিছিলের গর্জনে মুখরিত উত্তপ্ত মহানগরীর মহল্লায় মহল্লায় গড়েছে মানুষের ঐক্যফ্রন্ট। সোচ্চার কোটি কণ্ঠ নিঃসীমের নীলাম্বর ভেদ ক’রে যেন মানব প্রাণকে জাগিয়ে দিয়েছে প্রতিরোধের দুর্বার প্রবল প্রাণ-বন্যায়।
তাইতো মিছিলের রক্তিম মুখমণ্ডলে জীবনের প্রতিষ্ঠার শত আকাঙক্ষার প্রতিফলন। ওরা ফেটে পড়েছে বিপুল গর্জনে বায়তুল মোকাররমের চত্বরে, পল্টনের বিশাল অঙ্গনে। আন্দোলনের দুর্জ্ঞেয় প্রাকার গড়ে ওরা গর্জে উঠেছে জনতার দারুণ রুদ্র রোষকে দমনের বিরুদ্ধে।
গতকাল শহরে হরতাল ছিল। কারখানার চিমনিতে ধোঁয়া ওঠেনি, ঘোরেনি রেলের চাকা, বিমান ডানা মেলেনি শূন্যে। কর্মবহুল এই রাজধানী নীরব ছিল, রাস্তা ছিল—যানবাহন ছিল না একেবারে। অথচ মানুষগুলো সরব আর ওদের মিলিত পদভারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল নির্বাক, অসাড় ঐ কালো পীচঢালা রাজপথ। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বটতলায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বলিষ্ঠ বাহু তুলে ওরা শপথ নিয়েছে গতকাল—বাংলার স্বাধিকার, ওদের দাবী অস্থিমজ্জায়।
বাংলার মুখ আমি দেখেছি, রাত্রির কুটিল অন্ধকারকে ভেদ ক’রে আকাশটাকে চমকে দিয়ে ত্রাসিত মাটির বুক কাঁপিয়ে অন্ধকার ঘেরা শহরে মানুষ আর মানুষ রাজধানীর রাজপথ উচ্চকিত ক’রে তুললো গগনবিদারী শ্লোগানে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৬৯৯
রাস্তায়, গলিতে মানুষের যেন ঢল নেমেছিল। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যে কোন মূল্যে চালিয়ে যাওয়ার, সংগ্রামকে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে এগিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যে কোন মূল্য প্রদান করতে ইস্পাত-দৃঢ়তা নিয়ে জনতা বিক্ষুদ্ধ উর্মিমালার মত জন-তটে যেন আছড়ে পড়ছিল। জঙ্গী জনতার বিরামহীন ছোট বড় শোভাযাত্রা বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো মধ্য ফাগুনের খরতাপ উপেক্ষা ক’রে অন্যদেরও শপথের অগ্নিতে উজ্জীবিত ক’রে তোলে।
শুধু ঢাকায় গতকাল সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ডাক ছাড়াই প্রদেশের বেশ কয়েকটি শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সর্বত্রই জীবনযাত্রাকে অচল ক’রে দিয়ে অধিকার-সচেতন মানুষ বিক্ষোভে আর মিছিলে, শ্লোগানে আর সরোষে প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা শহরের শত হাজার সড়ক, গলিপথ আর রাজপথ গতকাল রবারের চাকার যানবাহনের ঘর্ষণ পায় নি। কোন বিমান ঢাকা আসে নি, ঢাকা থেকে যেতে পারে নি। কোন ট্রেন ঢাকা আসেনি, ঢাকা থেকে ছাড়ে নি। কোন দোকান খোলা ছিল না, কাঁচা বাজার বসে নি, চা আর ঔষধের দোকানও বন্ধ ছিল। অফিস বসে নি, সরকারী কর্মচারীরা দফতরে যায় নি, ব্যাঙ্ক ছিল বন্ধ। বন্ধ ছিল সরকারী ও বেসরকারী সব ক্রিয়াকর্ম। বিস্তীর্ণ এলাকার কারখানার চাকা বন্ধ ছিল, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উড়ে নি। কিন্তু জনতার মিছিল স্তদ্ধ ছিল না। স্তব্ধ ছিল না জনতার কণ্ঠ। বিদ্যুৎ থেকে যেন শক্তি সঞ্চয় ক’রে লাখো জনতা বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বানচাল করার বিরুদ্ধে ধ্বনি তোলে। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর সৃষ্টির শপথ নেয়। জনতার একটি অংশ জিন্নাহ এভিন্যু, বায়তুল মোকাররম, নবাবপুর, সদরঘাট এলাকার কয়েকটি দোকানে আক্রমণ চালায়। কেউ কেউ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। বায়তুল মোকাররমের একটি অস্ত্রের দোকানে আক্রমণ চালিয়েও কিছুসংখ্যক লোক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যায়।
লুণ্ঠন এবং অন্যান্য সমাজবিরোধী কাজ হতে বিরত থাকার জন্য আওয়ামী লীগ কর্মীরা গতকাল জীপে ক’রে শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ ক’রে জনগণের কাছে আবেদন জানান। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০০
মুজিবের নামে এ আবেদন জানানো হয়। বেশ কিছু এলাকার দোকান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজনকে জনতা পাকড়াও করে।
একশ্রেণীর ক্রদ্ধ জনতা অসংখ্য ইংরেজী সাইন বোর্ড ভেঙ্গে ফেলে এবং জিন্নাহ এভেন্যু এলাকায় একটি গাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ ঘর ছেড়ে, বাড়ী ছেড়ে, স্ত্রী আর কচি সন্তানদের মায়ার বাঁধন ছেড়ে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষোভ, বিক্ষোভ ধ্বনিতে রাজপথ, জনপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এমন বিক্ষোভ ঢাকার মুক রাজপথ ঊনসত্তরে দেখেছে আর একাত্তর সালে দেখলো। ঊনসত্তরের সংগ্রামের চাইতে একাত্তর সালের সংগ্রামের তাপ যেন আরও বেশী লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ়তায় যেন আরও বলিষ্ঠ বলীয়ান।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৩রা মার্চ, ১৯৭১]
শেখ মুজিবের আহ্বানে আহূত এই ধর্মঘট বানচালের জন্য সামরিক সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কারফিউ জারী ক’রে সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয় মিছিলে যোগদানকারী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। কিন্তু জনতা সে কারফিউ মানে নি। ফলে তাদের ওপর চালানো হ’ল নির্বিচারে গুলী। সেদিন ঢাকায় গুলীতে দু’জন নিহত ও প্রচুর আহত হয়।
ঐদিন বিকেলে শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলী বর্ষণের কঠোর নিন্দা ক’রে শক্তির দ্বারা জনগণের মোকাবিলা করিতে ইচ্ছুক ‘মহলকে’ হুঁশিয়ার ক’রে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে আগুন জ্বালাইবেন না। যদি জ্বালান, সে দাবানল হইতে আপনারাও রেহাই পাইবেন না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা মার্চ, ১৯৭১]
জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ
বিবৃতিতে শেখ মুজিব সুশৃঙ্খলভাবে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দান করেন। তাঁর নির্দেশ সমূহ তুলে ধরে পরদিন ইত্তেফাক ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’ শিরোনামায় লিখেছেনঃ “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রমান গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জনগণের উদ্দেশে বলেন, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন এবং যাতে লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মত অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তৎপ্রতি কড়া নজর রাখার জন্য আমি জনগণের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০১
জনগণকে বিশেষ করিয়া ভাড়াটিয়া উস্কানীদাতাদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকিতে হইবে। জনগণের উদ্দেশে তিনি আরো বলেনঃ মনে রাখিতে হইবে, যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, যে ভাষাতেই কথা বলুক, বাংলার প্রতিটি বাসিন্দাই আমাদের দৃষ্টিতে বাঙালী। তাদের জান-মাল-ইজ্জত আমাদের কাছে পবিত্র আমানত এবং উহা অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে।
জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ
* ৩রা মার্চ হইতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা হইতে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন। সরকারী অফিসসমূহ, সেক্রেটারীয়েট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য কোর্ট-কাছারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পি-আই-এ, রেলওয়ে ও অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম—যানবাহন, কলকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার সহ সর্বত্র এই হরতাল পালন করিতে হইবে। শুধু এম্বুলেন্স (হাসপাতালের গাড়ী), সাংবাদিকদের গাড়ী, হাসপাতাল, ঔষধের দোকান, বিজলী ও পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে হরতালের নির্দেশ প্রযোজ্য হইবে না।
* আজ ৩রা মার্চ, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। এই দিনটিকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসাবে পালন করিতে হইবে। এই উপলক্ষে আমি (শেখ মুজিব) পল্টন ময়দান হইতে ছাত্রলীগের জনসভার অব্যবহিত পরেই একটি গণমিছিলের নেতৃত্ব দান করিব।
* রেডিও, টেলিভিশন, বা সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করিতে দেওয়া না হইলে এই সব প্রতিষ্ঠানের বাঙালী কর্মচারীদের বাংলাদেশের ৭কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টাকে নাকচ করিয়া দিতে হইবে।
* আগামী ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণ দান করিব। সেখানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করিব।
* জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, সংগ্রাম সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাইতে হইবে। উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০২
ক্ষুণ্ন করিবে এবং গণবিরোধী শক্তি ও তাদের ভাড়াটিয়া চরদের স্বার্থোদ্ধার করিবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৩রা মার্চ, ১৯৭১]
রিকুইজিশন ন্যাপের প্রতিবাদ সভা
রিকুইজিশনপন্থী ন্যাপের উদ্যোগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে সেদিন পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান ক’রে জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থার দাবী জানান হয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে আহূত এই জনসভায় স্পষ্টভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার পেছনে এক বিরাট চক্রান্ত রয়েছে এবং সে চক্রান্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতও সক্রিয় রয়েছে।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৩রা মার্চ, ১৯৭১]
জাতীয় লীগের প্রতিবাদ সভা
একই দিনে বায়তুল মোকাররমের সামনে জাতীয় লীগের উদ্যোগেও এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। “সভায় সুসংহত গণ-আন্দোলন শুরু করার জন্য আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ, ওয়ালী ন্যাপ ও ন্যাশনাল লীগের মধ্যে সমন্বয় সাধন ক’রে কর্মপন্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।”
ঢাকায় ছাত্র-সমাজ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন
ঐদিন ঢাকার ছাত্র-সমাজ একটি দুঃসাহসিক কাজ করে—যা ইতিহাসের পাতায় ভৌগোলিক সীমারেখার পটভূমিকা বদলিয়ে দিয়েছে। সেদিন সংগ্রামী ছাত্র-সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দুর্জয় শপথ গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত এই পতাকাই বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় পতাকা হিসেবে উড্ডীন হয়েছিল। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু জল্লাদের বধ্যভূমি হতে মুক্তি পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হবার পর সে মানচিত্র পরিহার করা হয়। সেদিন ছাত্র-সমাজ যে দুঃসাহসিক কার্য-কলাপের পরিচয় দিয়েছিল তার বিবরণ দিতে গিয়ে দৈনিক পাকিস্তান লিখেছেনঃ “গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৩
কলাভবনের সামনে স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্রসভায় বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। ……. এই সভা বটতলায় হবার কথা থাকলেও বিপুল জনসমাগম হওয়াতে সভামঞ্চ কলাভবনের শেডে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল থেকেই লাঠি-রড সজ্জিত ছোট বড় মিছিল বটতলায় এসে জড়ো হতে থাকে। বেলা দশটার পরই বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন এলাকা ছাত্র-ছাত্রীর দৃপ্ত পদধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে। সভাস্থলে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এই সময় শেডের ওপর মঞ্চ থেকে মাইকে অবিরামভাবে শ্লোগান হতে থাকে। ১০-৪৫ মিনিটের সময় ‘ডাকসু’র সহ-সভাপতি আ. শ. ম. আবদুর রব মঞ্চে এসে হাতে মাইক নিয়ে সভার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শ্লোগানে রত উত্তেজিত ছাত্ররা তখন আবদুর রবের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে শৃঙ্খলার সাথে স্লোগান দেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী সভা শুরু করার সাথে সাথেই সমবেত ছাত্রদের হাত তুলে শপথ পাঠ করান। সমবেত ছাত্ররা শপথ নেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ ক’রে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন। তাঁরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমেরও শপথ গ্রহণ করেন।
জনাব শাজাহান সিরাজ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বাইশ বছর ধরে আমরা আন্দোলন করেছি। দেশে যথারীতি নির্বাচনও হয়েছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনও হতে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন আন্দোলনের ধারা পাল্টাতে হবে। তিনি কিছুদিন আগে রেসকোর্সে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি ক’রে বলেন, আমাদের সকলকে এক একজন সৈনিক হতে হবে। সভায় সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্তের মাঝে পূর্ব বাংলার মানচিত্র আঁকা একটি পতাকা উত্তোলন করা হয়।
‘ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় শাহজাহান সিরাজের বক্তব্যকেই দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানান। তিনি স্বাধিকার আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যাবারও আবেদন জানান।
১২-২৫ মিনিটের সময় প্রাক্তন ছাত্রনেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমদ মঞ্চে আসেন এবং শ্লোগানমুখর ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করেন। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৪
সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। আর এক প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করার শপথ নেয়া হয়। সভাশেষে লাঠি, রড ও বাঁশসহ এক বিরাট জঙ্গী মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দসহ প্রাক্তন ‘ডাকসু’ সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ এই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। শোভাযাত্রাটি বায়তুল মোকাররমের দিকে এসে শেষ হয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৩রা মার্চ, ১৯৭১]
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনঃ শেখ মুজিব ও মহাত্মা গান্ধী
পরদিন ৩রা মার্চ। ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনার সূচনার দিন আজ। এই দিন বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
ভারত উপমহাদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের জন্ম দান করেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর গান্ধীজী দক্ষিণ-আফ্রিকা থেকে ভারতে আসেন এবং যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন তিনি আফ্রিকার অধিকার-বিহীন ভারতীয়দের জন্য শুরু করেছিলেন, ভারতে তিনি তাঁর সূত্রপাত করেন। প্রথমে বিহারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চম্পারণের নীল চাষীদের সংগ্রামে, ১৯১৭ সালে১ দ্বিতীয়বার গুজরাটে, নিঃস্ব চাষীদের রাজস্ব বন্ধের আন্দোলনে২। দু’বারই ব্রিটিশ সরকারকে এই আন্দোলনের সামনে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। অতঃপর কংগ্রেস আন্দোলনে সত্যাগ্রহ আন্দোলন একটি পন্থা হিসেবে গৃহীত হয়েছে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই পন্থা বহু ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করেছিল। কিন্তু সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার গ্লানিও এই পন্থার ললাটে কম লিখিত হয় নি। কারণ সর্বক্ষেত্রে এই আন্দোলনকে অহিংসার চৌহদ্দীর মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় নি। ‘মন্টেগু সংস্কার’ এবং ‘রাওলাত আইনে’র বিরুদ্ধে এই পন্থা প্রয়োগ করতে গিয়ে জনগণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং হিংস্রতার পথ অনুসরণ করে। ফলে বহুলোক হতাহত হয়। গান্ধীজী বহুবার হিংস্রতার বাড়াবাড়ি দেখে নিজে থেকেই বাধ্য হয়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিহার করেছেন। সে সব বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই।
১ ধরণী গোস্বামী, ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, পৃঃ ৪
২ Ahmed Muktar, Tradeunionism and Labour Dispute in India, P.10-16.
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৫
কিন্তু গান্ধীজীর জীবনে যা বহুলাংশে সম্ভব হয় নি, শেখ মুজিব বাংলাদেশের মাটিতে তা’ সম্ভব ক’রে তুলেছিলেন। ৩রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন যে সাফল্য অর্জন করে, সত্যাগ্রহের ইতিহাসে তা’ একান্তভাবেই দুর্লভ। ন্যাপ নেতা খান ওয়ালী খান এই আন্দোলনের সাফল্য দেখে বিস্ময়ে মন্তব্য করেছিলেনঃ Ever Gandhi would have marvelled. এ সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস বলেছেনঃ
“On 3 March Mujibur Rahman called a provincewide strike and launched a non-violent non-co-operation movement……. Everywhere the people responded to Sheikh Mujib’s appeal and the movement became more orderly and effective; …. Restoration of order in Dacea was assisted by the withdrawal of troops after it was found they could not enforce the curfew. The troops also began to feel the pinch of hunger as supplies, including foodstuffs, were denied on tic orders of the Awami League.”
[ এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস, দি রেপ অব বাংলাদেশ, পৃঃ ৯০]
ম্যাসকারেনহাস অন্যত্র বলেছেনঃ “অসহযোগ আন্দোলন বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মনোভাবও কঠোর হতে লাগলো এবং উপর্যুপরি কয়েকবার হরতালের ফলে প্রদেশের কর্মপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। ৩রা মার্চ মুজিবুর রহমান অবিরাম হরতাল পালনের নির্দেশ দেন—প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে অপরাহ্ন ২টা পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ থাকবে। তদনুযায়ী এই কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যে প্রদেশের সবকিছুর কাজকর্ম বন্ধ রইল। সরকারী অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গেল, ব্যাঙ্কগুলোর দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হ’ল; এমনকি ডাক, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বিমান ও রেল চলাচল ব্যবস্থা পর্যন্ত অচল হয়ে গেল। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোহর ও অন্যান্য স্থানের সেনানিবাসগুলো খাদ্যদ্রব্য হিসাবে যে স্বল্প পরিমাণ রেশন পেত, অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বাঙালীরা তা-ও সরবরাহ করতে অস্বীকার করল।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৬
বঙ্গবন্ধুর এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শুধু পূর্ব বাংলার কাগজগুলো নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকাতেও বিস্ময় প্রকাশ করা হ’ল।
[ দ্রষ্টব্যঃ দি ডন (করাচী), ৪,৫,৬,৭, এবং ৮ই মার্চ, ১৯৭১ এবং দি মনিং নিউজ (করাচী), ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
এই সাফল্য সম্পর্কে একজন পণ্ডিত আইনজীবী বলেছেনঃ
“The response of the entire people in East Bengal to the call of their leader was spontaneous, complete and overwhelming. Since in contemporary international law the effectiveness of an authority is to be measured by the popular support it commands, the authority of Mujib and his Awami League in East Bengal was conclusively proved by the success of the movement between 1 and 25 of March.”
সুতরাং এই অচিন্তনীয় সাফল্যই প্রমাণ করে যে, শেখ মুজিব শুধু নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেছিলেন তা’ নয়—পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁর নির্দেশেই পথ চলতে উদগ্রীব, ইয়াহিয়া বা অন্য কোন কায়েমী স্বার্থবাদী ব্যক্তির আদেশে নয়। দেশের সাধারণ পথচারী ও পিওন থেকে শুরু ক’রে হাইকোর্টের বিচারপতি সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকেই দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্দেশ বলে মেনে নিয়েছিলেন। পূর্বের ঘটনা পরম্পরায় যেমন, এই ঘটনায়ও তেমনি প্রমাণিত হ’ল যে, দেশ শাসনের অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই, অপর কারো নেই, একমাত্র যার আছে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
এই প্রসঙ্গে আবার ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীর একটি মূল্যবান উক্তি স্মরণ করিঃ
“By admitting the total success of the non-co-operation movement, Yahya bad admitted the forfeiture of his lawful authority to administer the country. It was the writ of Mujib alone which ran throughout East Bengal during the three weeks of peaceful non-co-operation movement. There was no one to carry out the
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৭
orders of the military janta. If Mujib could run a parallel Government in East Bengal, it was only because he had the unstinted lawalty of seventy-five million people. If Yahya’s authority was ignored during the three weeks of March, 1971, it only proved the truth of the immortal Lincoln concept that bullets can never successfully replace ballots. The minimum right of the people in East Bengal to launch a peaceful non-co-operation movement for achieving self-determination can never be in dispute. This is an acknowledged right of the people.”
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭২-৭৩]
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তবে কি মুজিব শুধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অর্জনে আস্থাবান ছিলেন? সহজ উত্তর,—না, তা’ নয়। মুজিব অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে একান্ত বিশ্বাসী। গান্ধীবাদে নিশ্চয়ই তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু শান্তি যে শুধু অহিংস ও অসহযোগ কার্যক্রমের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব একথা তিনি বিশ্বাস করেন না। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রয়োজন আছে—তবে শান্তির জন্য প্রয়োজন হ’লে অস্ত্রের আশ্রয় নিতে হবে। হিংস্রতাকে অস্ত্র দিয়েও দমন করতে হয়। যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়, তখন হিংস্রতাকে বৃহত্তর হিংস্রতা দিয়েই ধ্বংস করতে হয়। এ কারণেই ৩রা মার্চ থেকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেও এবং অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে এই পদক্ষেপ উজ্জ্বলতম সাফল্য অর্জন করলেও মুজিব জনগণকে অন্যভাবে আহ্বান করতেও ভুল করলেন না। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা করলেন যে, যদি এই অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হয় তবে জনগণ যেন যার যা আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করে—তখন যেন তারা সশস্ত্র সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ক’রে দেশকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে। সুতরাং মুজিব শান্তিকামী, আবার মুজিব সংগ্রামী। সমুদ্রের মতই কখনো তিনি স্থির এবং শান্ত, আবার কখনো তিনি উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুদ্ধ। শান্তি ও প্রগতির জন্যই তাঁর সকল পথযাত্রা, সকল প্রয়াস—কখনো অহিংসার বাণীকে আবার কখনো শাণিত তরবারিকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আসলে অস্ত্রেরই এই দুই রূপ।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৮
বাঙালীর জাতীয় জীবনে একাত্তরের মার্চ মাসটি নানা কারণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে। চব্বিশ বছরের একটি নাটক, চব্বিশ বছরেরই বা বলি কেন, প্রায় দু’শো চব্বিশ বছরের একটি মহানাটক যেন চূড়ান্ত পরিণতির জন্য এই মাসটিতে এসে অস্বাভাবিক দ্রুতগতি ও দুর্বারতা লাভ করেছে। মহানাটকের কাহিনী যেন একটি প্রান্তসীমার পথে এসে জটিলতায় ও সচলতায়, দ্বান্দ্বিক ঋজুতায় ও খর প্রবাহতায় অলঙ্ঘনীয় পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গঙ্গা যেন বহু পথ পরিক্রম শেষ ক’রে এসে সমুদ্র মোহনায় মিলিত হয়েছে। মার্চ মাসটি এই মোহনার পূর্ব-পথ নির্মাণ করেছে। এবার সামনে শুধুই সমুদ্র—আর কোন পথ নেই। সমুদ্র স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সমুদ্র। সেই মার্চ মাসের বর্ণনায় আমরা এখন সমুপস্থিত। আমরা ৩রা মার্চের কথা বলছিলাম।
ঢাকায় হরতাল
শেখ মুজিবের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এই দিন সারা দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। ঢাকায় পালিত হরতালের বর্ণনা দিয়ে সংবাদপত্রে বলা হয়ঃ “সকাল থেকেই আন্দোলনের ধারা এবং জঙ্গী জনতার মনোভাব দেখে মনে হতে থাকে তারা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে পা বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়েই রয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে সান্ধ্য-আইন ভঙ্গ ক’রে মিছিল করার পর শহরের যে রূপ দেখা যায়, গতকাল সকাল থেকেই সর্বত্র তার প্রভাব প্রতিফলিত হতে থাকে। জনতা আগের রাতের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন এলাকায় নতুন ক’রে শক্তিশালী ব্যারিকেড সৃষ্টি করার কাজে নিয়োজিত হয়। গত রাতে যেসব ব্যারিকেড পরিষ্কার ক’রে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়, সেগুলি নতুন ক’রে এবং যথাসম্ভব দুর্ভেদ্য ক’রে নির্মাণের চেষ্টা চলতে থাকে। রামপুরায় গতকাল অপরাহ্নে এই ধরনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র ক’রে গুলী বর্ষণের ফলে ফারুক ইকবাল নামে ১৮ বছরের একজন জঙ্গী ছাত্রনেতা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়।
মঙ্গলবার রাতের সান্ধ্য আইন ভঙ্গের সময় যারা শহীদ হন তাঁদের লাশ নিয়ে গতকাল কয়েকটি খণ্ড মিছিল বের করা হয়। ঐ রাতে গুলীতে নিহত ৫ জনের লাশ নিয়ে ইকবাল হল থেকে শোকযাত্রা সহকারে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ ক’রে ইকবাল হলে রাখা হয়। পরে মেডিকেল কলেজ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭০৯
হাসপাতাল থেকে আরও তিনটি লাশ নিয়ে মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখানে শহীদদের প্রতি শিক্ষক ছাত্রগণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে লাশ তিনটি সেখান থেকে ইকবাল হলে নিয়ে যাওয়া হয়।
গতকাল সকাল সাড়ে দশটার দিকে নওয়াবপুরে গুলী বর্ষিত হয়। এখান থেকে একজনকে গুরুতররূপে আহত অবস্থায় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
চট্টগ্রামে দাঙ্গা
ঢাকার মত প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও এই দিন পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। কয়েকটি জেলায় মিছিলকারী জনতার ওপর সেনাবাহিনী গুলী বর্ষণ করে। প্রথম দিনের হরতালে একমাত্র চট্টগ্রামেই ৭৫ জন শহীদ হয়েছেন বলে পরদিন সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। আন্দোলন বানচালকারীদের উস্কানিতে চট্টগ্রামে সে দিন বাঙালী অবাঙালীর মধ্যে এক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। এই হাঙ্গামার বিবরণ দিয়ে সংবাদে বলা হয় “ফিরোজ শাহ কলোনী, আমবাগান, পাহাড়তলি, জুট ফ্যাক্টরী এবং সন্নিহিত অন্যান্য এলাকায় আজ সকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড, হামলা, প্রতি-হামলা, প্রাইভেট বন্দুকের গুলী বর্ষণ, সংঘর্ষ এবং আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা-বাহিনীর গুলী বর্ষণ ইত্যাদি ঘটনায় অন্যূন অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারাইয়াছেন এবং কয়েকশত লোক আহত হইয়াছেন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় আড়াই শতাধিক হতাহতকে আনয়ন করা হয়। তন্মধ্যে নিহতের সংখ্যা ৪৭ বলিয়া জানা যায়। প্রকাশ জনৈক প্রশাসনিক কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একটি ট্রাকে করিয়া ২০টি মৃতদেহ আনয়ন করা হইলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ মৃতদেহগুলি ট্রাকে সরাসরি মর্গে পাঠাইয়া দেন।
নিহত ও আঘাতপ্রাপ্ত প্রায়ই সবাই বুলেট ও বন্দুকের গুলীজনিত বলিয়া জানা যায়। অধিকাংশ মৃতদেহ তৎক্ষণাৎ সনাক্ত করা না গেলেও উহাদের মধ্যে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, পথচারী, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক এবং পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্র রহিয়াছে বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১০
ঐ দিন ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও সিলেটে কারফিউ জারী করা হয়। রাজশাহীতে বেলা দু’টোর পর কারফিউ জারী ক’রে আন্দোলন রোধের চেষ্টা করা হয়।
এদিকে ৩রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। সংবাদে বলা হয় “গতকাল বুধবার ভোর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে চরম উত্তেজনা ও বিক্ষোভ বিরাজ করতে থাকে। গত পরশু রাত্রে রাইফেলের গুলীতে নিহত অনেক অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ বিভিন্ন আবাসিক হলে নিয়ে আসা হ’লে গত পরশু রাত থেকেই এই উত্তেজনা শুরু হয়। প্রায়ই ঘন্টাখানেক পর পর আবাসিক হলের করিডোরে দলবেঁধে ছাত্ররা সংগ্রামী শ্লোগান দিতে থাকে। ছাত্ররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনির্ধারিত সভা ক’রে গণহত্যার প্রতিবাদ জানায়। সকাল ৯টার দিকে পাঁচটি লাশ নিয়ে ছাত্র-জনতার এক বিরাট শোক মিছিল নীলক্ষেত এলাকায় এক মর্মবিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
শহীদদের লাশগুলো গতকাল দুপুর পর্যন্ত ইকবাল হল মিলনায়তনে রাখা হয়। দুপুর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী, জনসাধারণ, আবাল-বৃদ্ধবণিতা শ্রদ্ধাবনতভাবে লাইন ক’রে শহীদদের দেখতে ভীড় করে। অনেককে লাশের কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। ইকবাল হলে এই সময় সর্বক্ষণ এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে।
বেলা সাড়ে এগারটার দিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মিছিল শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসে তখন কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী মেডিকেল হাসপাতাল থেকে তিনজন যুবকের লাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নিয়ে আসে। … … বেলা বারোটা পর্যন্ত এই তিনজনের লাশ বটতলায় রাখা হয়। এই সময় রোকেয়া হল থেকে একদল ছাত্রী খালি পায়ে বটতলায় আসেন। সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদদের ঘিরে শ্লোগান দিতে থাকে। এই শ্লোগানগুলো তখন কান্নাভেজা বিলাপের মত ধ্বনি তোলে এবং বটতলার সকলকে অশ্রুসজল ক’রে তুলেছিল। এই পরিবেশে সাড়ে এগারটার সময় একজন ছাত্র বটতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে লাশগুলোকে ইকবাল হলে নিয়ে রাখা হয়। পরে পল্টন ময়দানে ৯টি লাশ নিয়ে যাওয়া হয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১১
পল্টনে শেখ মুজিবের ঘোষণাঃ অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন
আর ঠিক এই দিনই ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পল্টন ময়দানে এক জনসমাবেশে শেখ মুজিব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত জনতা—‘চল চল পল্টনে চল’ শ্লোগান দিতে দিতে পল্টনের দিকে এগিয়ে যায়। এক বিরাট জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের শীর্ষে দাঁড়িয়ে বজ্রনির্ঘোষে যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, সে সংবাদ পরিবেশন ক’রে ইত্তেফাক লিখেছেনঃ “জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে ঘোষিত কর্মসূচী পালনের দ্বিতীয় দিবসে গতকল্য (বুধবার) ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের উত্তাল-উদ্দাম, বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণদান কালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বিগত দিনের ঘটনাবলীর পটভূমিতে বিচার করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে সামরিক সরকারকে অবিলম্বে গণ-প্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা সমৰ্পণ করিয়া ব্যারাকে ফিরিয়া যাওয়ার আহ্বান জানাইয়া জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করেনঃ ‘বাংলার গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করিয়া ব্যারাকে ফিরিয়া না যাওয়া পর্যন্ত সরকারের সহিত স্বাধিকারকামী বাংলার মানুষ আর সহযোগিতা করিবে না, কোনও কর-খাজনাও দিবে না।’
ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই মহতী সমাবেশে আগ্রহ-ব্যাকুল অযুত শ্রোতৃমণ্ডলীকে সাক্ষী রাখিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান সর্বাত্মক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়া সরকারী, বে-সরকারী চাকুরিজীবীদের প্রতি নির্দেশ দেনঃ ‘পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আপনারা অফিস-আদালতে যাওয়া বন্ধ রাখুন।’
বেতার, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার প্রতি নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেনঃ ‘যদি আমাদের বক্তব্য, বিবৃতি, আমাদের আন্দোলনের খবরাখবর প্রকাশ-প্রচারের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, সে নির্দেশ আপনারা লঙ্ঘন করুন।’
ভুট্টো গং-এর উদ্দেশে তিনি বলেনঃ গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি চান, আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করিব।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১২
গণ-অধিকার আন্দোলনের সূতিকাগার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জীবনের সর্বস্তরের মানুষের এই মহতী সমাবেশে ভারাকান্ত কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করিয়া এবারকার আন্দোলনের সূচনাপর্বে স্বাধিকারকামী ‘যে বীর বন্ধুরা আত্মাহুতি দিলেন’ তাহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন প্রসঙ্গে সাত কোটি বাঙালীর বিক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বরকে নিজের কণ্ঠে তুলিয়া লইয়া জলদগম্ভীর স্বরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন। ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য—গুলী খাওয়ার জন্য নয়। তাই গরীব বাঙালীর পয়সায় কেনা বুলেটের দ্বারা কাপুরুষের মত গণহত্যার পরিবর্তে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নিন, বাংলার শাসনভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তুলিয়া দিন।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী শেখ সাহেবের এই সভাশেষে পল্টন ময়দান হইতে একটি গণ-মিছিলের নেতৃত্ব করার কথা ছিল। কিন্তু পরে এই কর্মসূচী পরিবর্তন করিয়া তিনি সমাবেশে ভাষণদান করেন এবং জনগণের আশুকর্তব্য নির্দেশ করেন। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত পল্টনের সেই বিশাল জনসমুদ্র আর বসন্তের বৈকালিক সূর্যকে সাক্ষী রাখিয়া শেখ মুজিব দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেনঃ ‘প্রস্তুত, আমরা প্রস্তুত। দানবের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য যে কোন পরিণতি মাথা পাতিয়া বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। তেইশ বছর ধরিয়া রক্ত দিয়া আসিয়াছি, প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তে গঙ্গা বহাইয়া দিব। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়াইয়াও বাংলার বীর শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করিব না।’
নিন্দার ভাষা জানা নাই
বক্তৃতার শুরুতেই শেখ মুজিব বলেনঃ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আজ আমি এখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। তিনি বলেন, গতরাত্রে—গত দুই দিনে ‘বহু লোক’ হত্যা করা হইয়াছে। আমি নিজে মেশিনগানের গুলীর আওয়াজ শুনিয়াছি। এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নাই। তিনি বলেন, গরীব মানুষের পয়সায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভরণ-পোষণ চলে। তাদের দায়িত্ব দেশরক্ষা—সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি বলেন, নিরস্ত্র জনতাকে গুলী করিয়া হত্যা করা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৩
কাপুরুষতারই সামিল। তিনি অবিলম্বে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লইয়া গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলিয়া দেয়ার দাবী জানান।
আমরা দায়ী নহি
দেশের বর্তমান সঙ্কট পরিস্থিতির পটভূমিকা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ সাহেব বলেনঃ ‘এ জন্য আমরা দায়ী নই—এ জন্য দায়ী গণ-প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল প্রয়াসী ষড়যন্ত্রকারী দল। তিনি বলেন, মেজরিটি জনগণ আমার পেছনে। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করা হয় নাই। তিনি বলেন, ভুট্টো পরিষদের অধিবেশন স্থগিত দাবী করিয়া অচলাবস্থার সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা হয় নাই—অস্ত্র ধরা হইয়াছে বাংলার নিরস্ত্র শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে। শেখ সাহেব বলেন, আমি আবার বলি, আগুন লইয়া খেলা করিবেন না। যদি করেন, পুড়িয়া ভস্ম হইয়া যাইবেন।
মৃত্যুর ভয় দেখাইবেন না
সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্দেশে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া শেখ মুজিব বলেনঃ বাংলার মানুষকে মৃত্যুর ভয় দেখাইবেন না। শত্রুর সঙ্গে, দুর্দৈবের সঙ্গে, দুর্যোগের সঙ্গে কোলাকুলি করিয়াই আমরা বাঁচিয়া আছি। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা ধরিয়া, মৃত্যুকে বুক পাতিয়া বরণ করিয়াই আমরা স্বাধিকার আদায় করিব। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন পরিচালনার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, উচ্ছৃঙ্খলতা আন্দোলনকে বিপথগামী করিতে পারে।
পল্টনের জনসভায় ভাষণদানকালে শেখ মুজিব তাঁর অনুপস্থিতিতেও আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, বাংলার ভাইয়েরা আমার—আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালীর রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন, তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউই না থাকেন, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালীকে নেতা হইয়া নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে—যে কোন মূল্যে স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে হইবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৪
এই স্বাধিকার আন্দোলন বানচাল করার জন্য একশ্রেণীর লোক যে লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছৃঙ্খল ঘটনার সৃষ্টি করছে, তার তীব্র নিন্দা ক’রে জনসাধারণকে সতর্ক ক’রে দিয়ে তিনি বলেন, “মনে রাখবেন, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হানাহানি, আত্মকোলাহল আন্দোলনের লক্ষ্যকেই বানচাল করিয়া দিবে। আর সাবধান, মুখচেনা মহলের ভাড়াটিয়া উস্কানিদাতাদের ফাঁদে পা দিবেন না। ইহারা এই আন্দোলন বানচালের জন্য ষড়যন্ত্র চালাইতেছে। স্বাধিকার আন্দোলনের স্বার্থে এই অশুভ তৎপরতা প্রতিহত করিতেই হইবে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
স্বাধিকার আন্দোলনের যে-সব সংগ্রামী বীর বুলেট ও অন্যান্য আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালসমূহে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাঁদের জীবন রক্ষার জন্য শেখ মুজিব অকাতরে রক্তদানের আহ্বান জানান।
পরদিন প্রকাশিত সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় আগের রাত্রি থেকে এই দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর গুলীতে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত এবং বহু লোক হতাহত হয়। নিহত ও আহতদের অনেকেরই নাম-ঠিকানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আত্মীয়-প্রিয়জনদের লাশের খোঁজে বহু লোক সেদিন ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে’ ভীড় জমায়। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক পাকিস্তান লিখেছেনঃ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দৃশ্য
“কালকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। একদিকে লাশের সারি। অন্যদিকে কান্নার মিছিল। বাবা-ভাই-সন্তানহারা মানুষ ছুটে এসেছিলেন তাদের প্রিয়জনের খোঁজে। শতশত লোক মর্গে গিয়ে ভীড় জমানোর পর গুলীবিদ্ধ শহীদদের লাশের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। কয়েকজন ছাত্রী মর্গের মাঝেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের খোঁজ করতে ছুটে আসতে শুরু করেন নারী-পুরুষেরা। যাত্রাবাড়ীর জনৈক বৃদ্ধ তাঁর পুত্রের বিকৃত লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মাত্র ১৫-১৬ বছরের ছেলেটির বুকে আর চোয়ালে গুলী লাগায় লাশ বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা এই বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে। এরপর ছুটে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৫
আসেন জনৈক বৃদ্ধা। এই বিধবার ছোট্ট ছেলেটি বুলেটের গুলীতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। পাগলিনীর মত এই মা বিলাপ শুরু করেন তার ছেলের জন্য। এছাড়া আরও অনেক লোক খোঁজ করতে শুরু করেন তাদের খোজ না-পাওয়া ছেলেমেয়ে পরিজনদের। বস্তুতঃ এই পরিবেশে মেডিকেল কলেজ এক শোকপুরীতে পরিণত হয়। এরপর বহু ছাত্র-জনতা বিভিন্ন দিক থেকে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে এবং নিহতদের লাশ নিয়ে ইকবাল হল অভিমুখে এগিয়ে যায়। কলেজ প্রাঙ্গণের মর্গের মত ইমার্জেন্সীতেও অনুরূপ করুণ দৃশ্যের সূচনা হয়। আবুজর গিফারী কলেজের ফারুকের লাশকে নিয়ে বলিষ্ঠ সংগ্রামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বহু ছাত্র নতুন জঙ্গী সংগ্রামের রায় ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আনীত শহীদদের লাশগুলো হাজারো মানুষের মনে দুরপনেয় সঙ্কল্পের দৃঢ়তা এনে দেয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বাধিকার আন্দোলনের আহত বীর সৈনিকদের দেখতে যান। তিনি আহত ব্যক্তিদেরকে সান্ত্বনা দান করেন ও আত্মীয়-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
ইয়াহিয়া কর্তৃক নেতৃ সম্মেলনের বৈঠক আহ্বান
অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খান ঘাবড়ে গেলেন। তিনি ১০ই মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলনের আমন্ত্রণ জানালেন। ৩রা মার্চ রাওয়ালপিণ্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষিত এই আমন্ত্রণের সংবাদ প্রচার ক’রে খবরে বলা হয়ঃ
“একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাহায্য করিতে প্রেসিডেন্ট তাঁহার সাধ্যানুযায়ী সবকিছু করিবেন বলিয়া গত ১লা মার্চের ঘোষণায় প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, তদনুযায়ী তিনি ঢাকায় এক বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য জাতীয় পরিষদে সকল পার্লামেন্টারী গ্রুপের নির্বাচিত নেতাদের নিকট জরুরী ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ-লিপি প্রেরণ করিয়াছেন। আগামী ৮ই মার্চ পবিত্র আশুরার দিন পড়ায় আগামী ১০ই মার্চ এই সম্মেলনের দিন ধার্য করা হইয়াছে। এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন জাতীয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৬
পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতে পারিবে না; প্রেসিডেন্ট উহার কোন কারণ দেখিতেছেন না।”
সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত নেতারা হইলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, পি. পি. পি. প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো, কাইয়ুমপন্থী পাকিস্তান মুসলিম লীগের খান আবদুল কাইয়ুম খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মোহাম্মদ মমতাজ দৌলতানা, হাজারভী পন্থী জমিয়তুল উলেমা-ই-ইসলামের মওলানা মুফতী মাহমুদ, ন্যাপের খান আবদুল ওয়ালী খান, জমিয়তুল উলেমা-ই-পাকিস্তানের মওলানা শাহ আহমদ নূরানী, জামাতে ইসলামের জনাব গফুর আহমদ, কনভেনশন মুসলিম লীগের জনাব মোহাম্মদ জামান কোরিফা, পি. ডি. পি-র জনাব নূরুল আমীন এবং উপজাতীয় অঞ্চল হতে জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি মেজর জেনারেল জামালদার ও মালিক জাহাঙ্গীর খান।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
শেখ মুজিব কর্তৃক ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান
৩রা মার্চ রাতেই এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের এই আমন্ত্রণকে ‘বন্দুকের নলের মাথায়’ আমন্ত্রণের নামে ‘নিষ্ঠুর তামাসা’ বলে উল্লেখ ক’রে তা’ প্রত্যাখ্যান করেন। পরদিন প্রকাশিত খবরে বলা হয়ঃ “গতকাল (বুধবার) রাত্রে এক বিবৃতিতে শেখ সাহেব বলেন, বেতারে প্রচারিত এই আমন্ত্রণের পটভূমিতে রহিয়াছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের পাইকারী হারে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়।’ তিনি বলেন, “যে মুহূর্তে এই সব বীর শহীদের রক্তের দাগ রাজপথের বুক হইতে শুকাইয়া যায় নাই, যখন বহু শহীদের নশ্বরদেহ দাফনের প্রতীক্ষায় পড়িয়া আছে, যখন শত শত বুলেটবিদ্ধ মানুষ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা করিয়া চলিয়াছে সেই মুহূর্তে এই সম্মেলন আমন্ত্রণ নিষ্ঠুর তামাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইহা আরেক নির্মম পরিহাসস্বরূপ এইজন্য যে, এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমাদের বসিতে বলা হইয়াছে, যাহাদের হীন চক্রান্তই নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
শেখ মুজিব বলেন, যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত, যখন আমাদের কানে বাজিতেছে অস্ত্রের ভাষায় সুতীব্র হুংকার, সেই মুহূর্তে এই আমন্ত্রণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৭
বন্দুকের নলের মাথায় আমন্ত্রণেরই সামিল। আর এই পরিস্থিতিতেই এ ধরনের কোন আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমি ইহা প্রত্যাখ্যান করিতেছি।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১]
একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ জন শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপক সংবাদে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য শোষকশ্রেণী ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহলকে দায়ী করেন। সে দিন মওলানা ভাসানী এক তারবার্তায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়ে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সরোজমিনে তদন্ত ক’রে যাবার জন্য আহ্বান জানান।
পরদিন ৪ঠা মার্চ, ১৯৭১। পদচ্যুত প্রাদেশিক গভর্নর জনাব এস. এম. আহসান সপরিবারে ঢাকা থেকে বিমানযোগে করাচী গমন করেন। যাবার পথে তিনি বিমান বন্দরে বাংলাদেশের জনসাধারণকে শুভেচ্ছা জানান।
আসগর খানের দাবী
করাচী থেকে এয়ার মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট দাবী জানান। তিনি বলেন যে, ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট যদি অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর না করেন, তা’ হ’লে তিনি পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণের সমর্থনে আন্দোলন শুরু করবেন। পরদিন শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ঢাকায় আসার সিদ্ধান্তও তিনি জ্ঞাপন করেন।
৪ঠা মার্চের হরতাল
এ দিনের ঘটনাবলী প্রকাশ করতে গিয়ে ৫ই মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদ-শিরোনামায় লেখেন ‘জয় বাংলা’র জয়। ইত্তেফাকের রাজনৈতিক ভাষ্যকার লিখেছেনঃ “ক্ষমতার দুর্গ নয়, জনগণই যে দেশের সত্যিকার শক্তির উৎস, বাংলাদেশের বিগত তিনদিনের ঘটনাবলী তাহাই নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত করিয়াছে। ‘অস্ত্রের ভাষায়’ মোকাবিলায় স্বাধিকারকামী নিরস্ত্রের সংগ্রাম প্রথম পর্বে জয়যুক্ত হইয়াছে। বাংলার মানুষের দুর্জয় প্রত্যয়ের মুখে দেশের পশ্চিমাঞ্চলেও মনে হয় নতুন করিয়া চিন্তা-ভাবনা শুরু হইয়াছে। প্রেসিডেন্টের নেতৃসম্মেলনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়া স্বাধিকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৮
সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবের কণ্ঠে যে প্রত্যয় ঘোষিত হইয়াছে দলমত নির্বিশেষে বাংলার মানুষ তা’ অভিনন্দিত করিয়াছে।……অস্ত্রের ঝংকার, শক্তির আস্ফালন সব কিছুরই মুখে বাংলার মানুষের হইয়া শেখ মুজিবের কণ্ঠে পর্যায়ে পর্যায়ে যে সঘন গর্জন ধ্বনিত হইয়াছে; এ দেশের আপামর মানুষকে তা’ এমনই প্রত্যয়ী করিয়া তুলিয়াছে যে, অফিস-আদালত, কলকারখানা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কুত্রাপি বড় সাহেব ছোট সাহেব হতে শুরু করিয়া মায় পিওন পর্যন্ত একটি প্রাণীও হাজিরা দিতে যান নাই। দিনমজুর তার কাজে যায় নাই। রিক্সা, অটো-রিক্সা, বাস-ট্যাক্সীর চাকা ঘোরে নাই। একটি মাত্র ব্যক্তিত্বকে ঘিরিয়া বাঙালীর চিত্তে আজ এমনই আলোড়ন জাগিয়াছে যে, তাঁর নির্দেশ ব্যতীত বাংলার প্রকৃতির একটি স্তবকও যেন আর আন্দোলিত হইতে জানে না। সংগ্রামী বাংলার আপামর মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনীর বাঙালী জওয়ানদের কণ্ঠও উচ্চকিত হইয়াছে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে। আর সে সুরের অনুরন জাগিয়াছে সরকারী প্রচার মাধ্যমেও। এককালে যে বেতার ও টেলিভিশন ছিল জনগণের নাগালের বাহিরে, গত বুধবার হইতে সে দুইটি মাধ্যমও জয় বাংলার জয়গানে মুখরিত। গতকাল হইতে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা, কেবল ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ আর ‘পাকিস্তান টেলিভিশন’ কেবল ‘ঢাকা টেলিভিশন’ বলিয়া শ্রোতৃমণ্ডলীর খেদমতে হাজির হইতেছে। বাংলা ও বাঙালীর বর্ণনা গীতিই এখন তাদের উপজীব্য। সবকিছু মিলাইয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, গত তিন দিনের আন্দোলন রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলার মন ও মানসকে এতদিন একসূত্রে গ্রথিত করিতে সক্ষম হইয়াছে। ‘জুজুর ভয়’ বা ‘অস্ত্রের ভাষায়’ অতীতে যে কণ্ঠ দাবাইয়া দেওয়া সম্ভব হইয়াছে; সে কণ্ঠ এবার একটি মাত্র শ্লোগানে মুখরিত—‘জয় বাংলা’।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
ঢাকার পরিস্থিতি
এ দিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্চের ৫ তারিখে দৈনিক পাকিস্তানে বলা হয়ঃ “কল-কারখানায় বাজছে না বাঁশী। মানুষ নেই অফিস-আদালতে। অগ্নিগর্ভ দেশ আজ পথে নেমেছে। এক-দুই করে’ কাল কেটে গেছে চারদিন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় দেশ অগ্নিগর্ভ। বে-সামরিক শাসন-ব্যবস্থা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭১৯
যেন ভেঙে পড়েছে। স্বাধিকার আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে মানুষ—রংপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকায়—বিক্ষুব্ধ এই বাংলাদেশে—।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
গত দু’দিনে ক্ষুদ্ধ জনতার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষে প্রায় তিনশত জন নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়েছেন বলে সংবাদপত্রের তথ্যে জানা যায়। রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা প্রভৃতি জেলায় সান্ধ্য-আইন জারী করা হ’লেও আন্দোলনকারীরা তা’ লঙ্ঘন করে। ঢাকায় এদিন সান্ধ্য-আইন তুলে নেয়া হয়। কারণ সান্ধ্য-আইনের কোন কার্যকারিতাই ছিল না। গণ-মিছিলের দুর্বার স্রোতে আইনের শাসন কোন বাধাই মানে নি। জনগণ ব্যারিকেড সৃষ্টি ক’রে সর্বপ্রকার যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ রুদ্ধ ক’রে দিয়েছিল।
চট্টগ্রামের পরিস্থিতি
৪ঠা মার্চ তারিখেও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ভয়াবহভাবেই বিরাজ করে। বাঙালী অবাঙালীদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ফলে ৯ ব্যক্তি নিহত ও ৫০ ব্যক্তি আহত হয়। এ সংবাদ পরিবেশন ক’রে দৈনিক পাকিস্তান লিখেছেনঃ “আজ (অর্থাৎ ৪ঠা মার্চ) দু’দলের নতুন ক’রে গোলযোগের ফলে চট্টগ্রামে ৯ ব্যক্তি নিহত ও ৫০ ব্যক্তি আহত হয়। গতকালের গোলযোগে নিহতের সংখ্যা ছিল ১১১ ও আহতের সংখ্যা প্রায় ৩ শত। ফলে গত দু’দিনে এখানে নিহতের সংখ্যা ১২০ ও আহতের সংখ্যা সাড়ে তিন শ’তে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ১০০ জন ধারালো ছুরি ও গুলীর আঘাতে এবং ২০ জন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
সংগ্রামী জনতার প্রতি শেখ মুজিবের অভিনন্দন
৪ঠা মার্চের হরতালে প্রায় প্রতিটি সভার শুরুতেই পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত একটি নতুন পতাকা উড়ানো হয়। এই পতাকাই বাংলাদেশের নিজস্ব পতাকারূপে চিহ্নিত হয়।
এই তারিখে সংগ্রামী জনতার প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে ও কতিপয় ক্ষেত্রে হরতালের আওতা শিথিল ক’রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ “শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য আমাদের আহ্বানে বাংলাদেশের প্রতিটি
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২০
নারী, পুরুষ ও শিশু যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন, তার জন্য আমি আপনাদের বীর জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ—যথা শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্ররা তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে বুলেটের সামনে যে সাহস ও দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, বিশ্বের জনগণের তা’ জানা দরকার।
ক্রমাগত হরতালের ফলে জনগণকে যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, তা’ সহ্য করার জন্যও আমি আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাদের অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে যে, চরম আত্মত্যাগ ব্যতীত কোন জনগণই মুক্তি পায় নি। কাজেই জনগণকে যে কোন মূল্যে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, পূর্ব ঘোষণমত ৫ই ও ৬ই মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত থাকবে। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে হরতালের আওতা শিথিল করা হয়। এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান ক’রে বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ
(১) যে সব সরকারী ও বেসরকারী অফিসে কর্মচারীরা এখনও বেতন পান নাই, শুধু বেতন দানের জন্য সেগুলি বিকাল আড়াইটা হইতে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকিবে। শুধু বাংলাদেশের মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৫শত টাকার বেতন চেক ভাঙানোর জন্য উল্লেখিত সময়ে ব্যাঙ্কসমূহও চালু থাকবে। স্টেট ব্যাঙ্ককে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাহিরে টাকা পাঠানো যাইবে না। রেশন দোকান এবং খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থাগুলিও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতে পারে।
(২) আরও যাহা হরতালের আওতায় আসিবেনা, সেগুলি হইতেছে হাসপাতাল ও ঔষধের দোকান, হাসপাতালের গাড়ী (এ্যাম্বুলেন্স), ডাক্তারের গাড়ী, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের গাড়ী, ওয়াটার সাপ্লাই, গ্যাস সাপ্লাই, ইলেকট্রিক সাপ্লাই, স্থানীয় টেলিফোন এবং বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২১
বিভিন্ন জেলার মধ্যে ট্রাঙ্ক-টেলিফোন, দমকল বাহিনী, ঝাড়ুদার, ময়লার আবর্জনা গাড়ী।”
[দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
মওলানা ভাসানীর বিবৃতি
মওলানা ভাসানী এই তারিখে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি পুনরায় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালীর সার্বভৌমত্বের দাবী জানান। এই দাবীর প্রশ্নে যাতে কোন আপোষ করা না হয়, সে বিষয়েও তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। গণহত্যার নিন্দা ক’রে মওলানা ভাসানী বলেন, “আমি কংগ্রেস, খিলাফত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমার ৮৯ বছর বয়সে এবারকার মত গণজাগরণ এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ আর দেখি নি। জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত ও নজীরবিহীন আত্মচেতনা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার দৃঢ় সংকল্পের জন্য তিনি জনসাধারণের প্রতি মোবারকবাদ জানান।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
একই দিনে নূরুল আমীনও এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি ইয়াহিয়া কর্তৃক আহূত নেতৃ-সম্মেলনে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং অবিলম্বে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান। এছাড়া পূর্ব বাংলার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দও ইয়াহিয়ার কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ জনসাধারণ ও ছাত্রদের প্রতি নিম্নোক্ত আবেদন জানানঃ
জনসাধারণের প্রতি
১। ব্যারিকেডগুলিতে সকাল ৭ টার পরে গাড়ী চলাচলের ব্যবস্থা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বা রাত সাড়ে ন’টায় পুনরায় বন্ধ ক’রে দেয়া।
২। রিক্সা ও বেবী ট্যাক্সী ড্রাইভারদের বেশী পয়সা দেয়া এবং মালিকদের প্রাপ্য টাকার এক-চতুর্থাংশ নেয়া।
ছাত্রদের প্রতি
১। পাড়া, অঞ্চল, থানা, মহকুমা ও জেলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন। ঢাকা শহরে ৬ই মার্চের মধ্যে এবং সমগ্র বাংলাদেশে ৭ই মার্চের মধ্যে শেষ করতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২২
২। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো নিম্নরূপঃ
একজন আহ্বায়ক, দশজন সদস্য নিয়ে মোট এগারজনের কমিটি।
৩। প্রত্যেক পাড়া, অঞ্চল ও থানা সংগ্রাম পরিষদের এক কপি মহকুমা এবং এক কপি জেলায় পাঠাতে হবে। প্রত্যেক জেলা ও মহকুমার এক কপি কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
কতিপয় বিশিষ্ট শিল্পীর ঘোষণা
বেতার ও টেলিভিশনের বিশিষ্ট ২০ জন শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতিতে জানান যে, গত ২রা মার্চ থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পী বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করছেন না। বিবৃতিতে তাঁরা ঘোষণা করেন, “যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে এবং যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্র সমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন ততদিন পর্যন্ত আমরা বেতার ও টেলিভিশনে অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৫ই মার্চ, ১৯৭১]
সামরিক বিজ্ঞপ্তি
পরদিন ৫ তারিখে এমনকি সামরিক কর্তৃপক্ষের এক সংবাদ-বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় যে, “জনগণকে শান্ত করার জন্য শেখ মুজিবের আবেদনে ঢাকার পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।” পরিস্থিতির সত্যি উন্নতি ঘটে। সেনাবাহিনী উস্কানীমূলক আচরণ না করলে জনগণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই অসহযোগ আন্দোলন চালাতে থাকে। এদিকে ঢাকা ও তার আশেপাশে গত কয়েক দিনে সামরিক বাহিনীর গুলীতে প্রায় তিনশত জন নিহত ও ২০০০ জন আহত হয়। এসবই ঘটে সেনাবাহিনীর উস্কানীমূলক আঘাতের ফলে।
তাজউদ্দিনের বিবৃতি
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এই সময় এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বাংলার বুকে এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন যে, “ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারীর বুলেটে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ—শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের ধরাশায়ী করা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৩
হইতেছে। অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধ করিতে হইবে। যাহারা এই ঘটনার জন্য দায়ী, তাহাদের জানা উচিত যে, নির্বিচারে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই মার্চ ১৯৭১]
গণ-আন্দোলনের প্রবাহে এই সময় অনেক রাজনৈতিক দলই গণ-কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। ভাসানী বা পিকিং ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিহুর রহমান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেছেন যে, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণকারী যে কোন ব্যক্তি বা দলের সাথে তিনি ও তাঁর দল এক কাতারে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ই মার্চ, ১৯৭১]
টঙ্গীতে গুলী বর্ষণ
সেনাবাহিনীর উস্কানীমূলক আক্রমণ ও হত্যা কয়েক জায়গায় চলতেই থাকে। ঢাকার টঙ্গী এলাকায় সেনাবাহিনী কয়েক দফা গুলী চালিয়ে ৪ জনকে নিহত এবং ২৫ জনকে আহত করে। সংবাদে বলা হয়ঃ “শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর গুলীতে গতকাল (শুক্রবার) টঙ্গী এলাকায় ৪ ব্যক্তির মৃত্যু ও ২৫ ব্যক্তি আহত হইয়াছে। বর্তমানে সমগ্র টঙ্গী এলাকায় প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করিতেছে। স্থানীয় কোন কোন ব্যক্তির মতে সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা দফায় দফায় মোট ৬২ রাউন্ড গুলীবর্ষণ করে এবং এই গুলীবর্ষণের শব্দে সমগ্র টঙ্গী শিল্প এলাকা প্রকম্পিত হইতে থাকে। বেসরকারী সূত্রে হতাহতের সংখ্যা বহু বেশী বলিয়া দাবী করা হয়। টঙ্গী থানার অফিসার ইন-চার্জ সহ ৩ জন পুলিশ কর্মচারীও আহত হয়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ই মার্চ, ১৯৭১]
এই গুলীবর্ষণের ফলে সমগ্র টঙ্গী এলাকার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা টঙ্গীর কংক্রীট ব্রীজের পার্শ্ববর্তী কাঠের ব্রীজে আগুন লাগিয়ে দেয়। সংবাদে বলা হয়। “গুলী বর্ষণের পর সমগ্র টঙ্গী এলাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা টঙ্গীর কংক্রীট ব্রীজের পাশ্ববর্তী কাঠের ব্রীজে আগুন লাগিয়ে দেয়। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছ কেটে ফেলে তারা কংক্রীটের পুলের দিকে টঙ্গী অভিমুখে গমন পথে ব্যারিকেড রচনা করে। আরও নানাভাবে তারা ব্যারিকেড রচনা করে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৬ই মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৪
ঢাকার অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। শেখ মুজিবের নির্দেশে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শৃঙ্খলার সাথে জনগণ আইন অমান্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা একেবারে বিকল হয়ে পড়ে। খবরে বলা হয়ঃ “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য ব্যাঙ্ক খোলা ছিল। বেতনের ব্যাপারে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাও কার্যকরী করা হয়। প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট ও পদস্থ কর্মচারীরা বেলা আড়াইটায় অফিসে এসেছিলেন। এ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিস দু’ ঘন্টা পর্যন্ত খোলা ছিল। অন্যান্য অফিসেও দু’ ঘন্টা কাজ চলে-বিকল প্রশাসনযন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আবার সচল হয়ে ওঠে দু’ ঘন্টার জন্য। গতকালের হরতালে এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে যে সত্যটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তা’ হ’ল বর্তমান বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক জনগণ কাজ করেছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৬ই মার্চ, ১৯৭১]
লেখক-শিল্পী সমাজের ঘোষণা
চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনীতেও সে দিন মিলিটারী গুলীবর্ষণ করে। ফলে একজন মহিলা সহ তিনজন নিহত ও একজন আহত হয়। গত কয়েকদিনে সেখানে ১৮৮ জন নিহত হয় বলে পরদিন প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়,
ঐ দিন পূর্ব বাংলার লেখক-শিল্পীবৃন্দ ‘পূর্ব বাংলাকে জাগ্রত বাঙালীর প্রার্থিত দেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রামে শপথ ও সংগ্রামী জনগণের সাথে তাঁদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁরা ঢাকার তোপখানা রোডে লেখক সংঘের অফিস থেকে মিছিলে শামিল হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হন এবং হাত তুলে শপথ গ্রহণ করেন। সমবেত সভায় যারা বক্তৃতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর আহমদ শরীফ, শামসুর রহমান, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী মহিউদ্দীন। আমি নিজেও এই মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম এবং শহীদ মিনারে ভাষণ দিয়েছিলাম। সভায় বক্তাগণ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীও বুদ্ধিজীবিগণকে অতীতের সকল মতানৈক্য ও তিক্ততা ভুলে গিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানান। সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সম্পর্কে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৫
খবরে বলা হয়ঃ “……দেশের এই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় বাংলাদেশের লেখকরা নিশ্চুপ থাকিতে পারে না। যে কারণে দেশের সর্বত্র গণআন্দোলনে সাধারণ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ দিচ্ছে, লেখক-শিল্পীরাও তার সাথে একাত্ম অনুভব করছেন। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়, যে সার্বিক স্বাধিকারের জন্য দেশবাসী রক্ত দিচ্ছে তার প্রশ্নে নেতৃবৃন্দ যেন আপোষ না করেন। এই সংগ্রামের বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিবিদ, লেখক, শ্রমিক, কৃষক তথা জনগণের প্রতি প্রস্তাবে আহ্বান জানান হয়।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৬ই মার্চ,১৯৭১]
৫ই মার্চের আর একটি উল্লেখযোগ্য মিছিল ছিল ছাত্রদের। ছাত্রলীগের উদ্যোগে একটি ‘লাঠি মিছিল’ বের করা হয়।
প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ
মার্চের ৬ তারিখে অকস্মাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদ আহ্বান করলেন। ভাষণে তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য তিনি ন্যূনতম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মাত্র। দুই অঞ্চলের সংহতি রক্ষার জন্য তিনি যে-কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বদ্ধপরিকর। পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রেসিডেন্টের ভাষণ নিম্নে দেয়া হলঃ
“প্রিয় দেশবাসিগণ,
আসসলামু আলায়কুম। আমার ১লা মার্চের ভাষণে আমি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমার পদক্ষেপ বর্ণনা করিয়াছি। সেই ভাষণে আমি একথাও বলিয়াছি যে, গণতন্ত্রে উত্তরণের সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হইবার জন্য আমি আমাদের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে আমায় সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করিব।
আপনারা জানেন, এ ব্যাপারে আমার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসাবে আমি সকল পার্লামেন্টারী দলের নেতৃবৃন্দকে ১০ই মার্চ আমার সহিত এক পক্ষে সম্মেলনে মিলিত হইবার আহ্বান জানাইয়াছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ মতানৈক্য নিরসনের ব্যাপারে আমার আন্তরিক প্রয়াসকে সম্পূর্ণভাবে ভুল বোঝা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৬
হইয়াছে। বিশেষ করিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, যিনি বেতারে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে এই ধরনের সম্মেলনের প্রতি কোন বিমুখ মনোভাব পোষণ করেন না বলিয়া আভাস দিয়াছিলেন। তিনি সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। তাঁহার সরাসরি প্রত্যাখ্যান বিস্ময়কর ও হতাশা ব্যঞ্জক। আপনারা জানেন, জনান নূরুল আমিনও সম্মেলনে যোগদান করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছেন। ইহার ফলে বোঝা যাইতেছে যে, প্রস্তাবিত সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান হইতে কোন প্রতিনিধি থাকিবে না।
…. …. …. ….
বিশাল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিনিধি ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করিতে অসম্মতি জানান। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, ঐ তারিখে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠান ব্যর্থ প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হইবে। এমন কি, ইহার পরিণতিতে পরিষদ ভাঙিয়া পর্যন্ত যাইতে পারে। কাজেই আমি অধিবেশনের তারিখ স্থগিত রাখিয়া পরিস্থিতিকে রক্ষা করিতে সচেষ্ট হই। এই পন্থায় আমি দুইটি লক্ষ্য অর্জনের আশা করিয়াছিলাম। প্রথমতঃ, পরিষদ ও ইহার জন্মলগ্ন হইতে যে সকল জাতীয় প্রচেষ্টা চালান হইয়াছে সে সমস্ত রক্ষা করা এবং দ্বিতীয়তঃ পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য ও ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনা চালানোর জন্য সময় দেওয়া। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত সেই মনোভাব লইয়া গ্রহণের পরিবর্তে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ ইহাকে এমনভাবে দেখিয়াছেন, যাহার পরিণতিতে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিরা রাস্তায় নামিয়া আসিয়াছে এবং জান-মালের ক্ষতিসাধন করিয়াছে। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোন সরকারই নীরব দর্শক হিসাবে থাকিতে পারেন না।
…. …. …. ….
পরস্পর ভুল বুঝাবুঝির সুযোগে অরাজকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিরা মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। যখন এই ধরনের ব্যক্তিরা তৎপর হইয়া উঠে, তখন নিরীহ নাগরিকদেরই প্রধানতঃ দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করিতে হয়। কেননা এইরূপ অবস্থায় তাহাদের দৈনন্দিন জীবন দারুণভাবে বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে এবং তাহাদের প্রাণ বিপন্ন এমন কি মৃত্যুর সম্মুখীন হইতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৭
হয়। পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এটা জানা থাকা সত্ত্বেও আইনভঙ্গকারীদের লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য আমি ইচ্ছা করিয়াই ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগের জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়াছি। দেখা যাইতেছে যে, পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার ব্যাপারে আমার অন্যতম উদ্দেশ্য, যথা খোদ পরিষদ বজায় রাখার লক্ষ্য অর্জিত হইতেছে। আমার অপর ও সমান গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যঃ একটি ফলপ্রসূ আলোচনা সাফল্যমণ্ডিত হয় নাই। এদিকে নিরীহ মানুষের প্রাণ বিনষ্ট হইতেছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি আমার পূর্ণ সমবেদনা রহিয়াছে। এই পরিস্থিতি আমার সৃষ্ট নয় এবং এ ধরনের পরিস্থিতি আমি কখনও সৃষ্টি করিতে পারি না।
আগেই বলিয়াছি, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের উদ্বোধনী তারিখ নির্ধারণের জন্য আমি যে প্রচেষ্টা চালাই, উহা ব্যর্থ হইয়াছে।
এমতাবস্থায়, এই দেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন পরিচালক হিসাবে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এই দুর্ভাগ্যজনক অচলাবস্থার নিরসন করা আমার কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমি অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করিতে পারি না। এই হেতু আমি সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইবে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি যে, এই সিদ্ধান্তের ফলে সকল রাজনৈতিক নেতার নিকট হইতে দেশপ্রেমিক-জনোচিত ও গঠনমূলক সাড়া পাওয়া যাইবে।
শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে সকলের উদ্দেশে আমি বলিতে চাই যে, আইনগত কাঠামো আদেশের চাইতে বড় আশ্বাসের প্রয়োজন নাই।
পরিশেষে আমি সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে চাই যে, যাহাই ঘটুক না কেন, যতদিন আমি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক ও রাষ্ট্র প্রধান পদে নিযুক্ত রহিয়াছি, ততদিন পাকিস্তানের পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক সংহতি বজায় রাখিব। এই প্রশ্নে কোন সন্দেহ বা ভুল করা সঙ্গত নয়। এই দেশের অস্তিত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের প্রতি আমার একটি দায়িত্ব রহিয়াছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৮
তারা আমার কাছে এই আশাই করে এবং আমিও তাদের বিফল মনোরথ করিব না। আমি মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে কখনও কোটি কোটি নিরীহ পাকিস্তানীর মাতৃভূমি ধ্বংস করিতে দিব না। পাকিস্তানের সংহতি, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য-বিশেষ এবং এ দায়িত্বে তারা কখনও ব্যর্থ হয় নাই।
পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া আসুন আমরা আমাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র অর্জনের পথে আগাইয়া যাই এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে জাতির প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেই।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
সকাল থেকে প্রেসিডেন্টের এই বেতার ভাষণ দানের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর থেকে পূর্ব বাংলার জনতা আকুল আগ্রহে তা’ শোনার জন্যে প্রতীক্ষা করতে থাকে। নিদিষ্ট সময়ে বেতারের কাছে প্রচুর জনসমাগম লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনার পর জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে সামিল হয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টো বিরোধী নানাবিধি শ্লোগান দিতে থাকে।
প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান—জুলফিকার আলী ভুট্টো, কাইয়ুম খান, নসরুল্লাহ, মওলানা নূরানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতার কাছেই অভিনন্দিত হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো সে অধিবেশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আগের দিন অর্থাৎ ৫ই মার্চ-এ ইয়াহিয়া-ভুট্টো রাওয়ালপিণ্ডি প্রেসিডেন্ট ভবনে ৫ ঘন্টারও অধিককাল ধরে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টার সঙ্গে পরামর্শ করেই ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। সে দিনই কাউন্সিল মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল নূর খান লাহোরের এক জনসমাবেশে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেন, “আইনতঃ শেখ মুজিবই দেশের শাসন পরিচালনার অধিকারী। শেখ মুজিবের উপর দোষারোপ ক’রে প্রেসিডেন্ট
পৃষ্ঠা নং ~ ৭২৯
যে বেতার ভাষণ দেন তার জন্য দুঃখ প্রকাশ ক’রে জনাব নূর খান অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধকতা দূর করার আহ্বান জানান।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
নূর খানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে একটি সত্য চিত্র দেবার প্রয়াস আছে, যা কিনা প্রায়শঃই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। নূর খান একজন বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ না হতে পারেন—কিন্তু একথা বুঝতে তাঁর কষ্ট হয় নি যে, আসলে কায়েমী স্বার্থবাদীদের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলিয়েই পাকিস্তানী শাসন-ব্যবস্থার গতিপথ নির্ণীত হয়। জনগণের রায় আর আমলা-সৈনিক-রাজনীতিবিদ, যাদের পশ্চাতে আছে বাইশ পরিবারের অগাধ সহানুভূতি, প্রভৃতির বখরা, এ দুইয়ের মাঝে সে কারণেই আকাশ-পাতাল ফারাক সব সময় বিদ্যমান। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর কাল পরমায়ুর ইতিহাস আসলে এই নির্মম ও দুর্ভাগ্যজনক পার্থক্যের ইতিহাস। শেখ মুজিব এই পার্থক্য ঘুচিয়ে দেশে জনগণের রায় বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন—কায়েমী স্বার্থবাদীদের অপসারণ ক’রে জনগণের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এখানেই তিনি অপরাধী—তিনি একজন দেশদ্রোহী। তবে ইতিহাস তাঁর অমোঘ নিয়মে জনগণের ইচ্ছাকেই পূরণ করেছে। জনগণের ইচ্ছার একচ্ছত্র প্রতিভূ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই ইতিহাস নির্মাণের মহানায়ক। সুদীর্ঘ এবং ভয়ঙ্করভাবে স্থিতিশীল ষড়যন্ত্রের সমগ্র জাল ছিন্ন ক’রে তিনি বাংলাদেশের নবজন্মের পথ নির্মাণ করেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
যা হোক, আবার নাটকীয় ঘটনাসমূহের মূল আখ্যানভাগে ফিরে আসা যাক। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ সমাপ্ত হওয়ার পর পরই শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বাংলাদেশ শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের আলোকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচনা করা হয় বলে জানা যায়।
কার্যকরী কমিটির বৈঠক চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাত করেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩০
তাঁদের আলোচনা ৩০ মিনিট কাল স্থায়ী হয়। পরে আলোচনার বিষয়বস্তু জানতে চাওয়া হ’লে আসগর খান তা’ জানাতে অস্বীকার ক’রে বলেন যে ৭ই মার্চের জনসভায় শেখ মুজিবই এর জবাব দেবেন।
এদিকে ঢাকার রাজপথ স্বাধিকারকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণায় বারবার কম্পিত হতে থাকে। সংবাদে বলা হয়ঃ
“গতকালও বেলা আড়াইটা হইতে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাঙ্কসমূহ এবং যে সব সরকারী-বেসরকারী অফিসের কর্মচারী এখনও বেতন পান নাই, সেগুলি চালু থাকে। গতকালও সকাল হইতেই রাজপথে জনতার স্রোত নামিয়া আসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সভা, সমাবেশ, মিছিল।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
“সেদিন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে ৩২৫ জন কয়েদী ও বিচারাধীন আসামী পলায়ন করে। গেট-ভেঙে পালানোর সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে তাদের মধ্যে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
অলী আহাদের আবেদন
বাংলা জাতীয় লীগের উদ্যোগে এই দিন রমনা রেসকোর্সে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব অলী আহাদ বাংলার স্বাধিকার ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর সাথে একাত্মতা ঘোষণা ক’রে তিনি বলেন, “মুজিব ভাই, আপনি আন্দোলনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন আপনার একমাত্র কাজ হচ্ছে আগামী কাল দৃঢ়চিত্ত হয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা করা, আমরা আপনার পেছনে আছি।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ই মার্চ, ১৯৭১]
জয় বাংলা শ্লোগান
মার্চ মাসের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান এবং বাংলাদেশের পতাকা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা প্রয়োজন মনে করি। একথা উল্লেখ করেছি যে, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি প্রথম উদ্ভাবিত হলেও বঙ্গবন্ধু যখন এই শ্লোগানকে একটি শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলেন মাত্র তখন থেকেই তা’ সমগ্র দেশে, এমন কি ভারতবর্ষে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। ১৯৭০ সালে ১১ই জানুয়ারী তারিখে পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিব এই শ্লোগানটিকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩১
নিজের শ্লোগান এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের শ্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর জনৈক জীবনীকার লিখেছেনঃ
“১৯৭০ সালের ৪ঠা জানুয়ারী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নির্মিত মঞ্চের দেবদারু পাতার পশ্চাৎপটের ওপর ফুল দিয়ে প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি লেখা হয়। তারপর ‘জয় বাংলা’ লেখাটি নিয়ে ছাত্রলীগের ছেলেদের মিছিলও বের হয়। কিন্তু সাধারণের মধ্যে ধ্বনিটির প্রচার ঘটে ১৯৭০ সালের ১১ই জানুয়ারী থেকে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারীর গোড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে ইয়াহিয়া আরোপিত বাধা নিষেধ তুলে নেওয়া হ’ল। রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠানের উপর থেকে বাধা-নিষেধ তুলে নেওয়ার পর ১১ই জানুয়ারী শেখ সাহেব পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা করলেন। ওই দিনই প্রথম প্রকাশ্যে সভা মঞ্চের সামনে হার্ডবোর্ডে বড়ো বড়ো হরফে ছাত্ররা লিখেছিলেন ‘জয় বাংলা’ শব্দ দু’টি।
‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আজ এপার বাংলা ওপার বাংলার হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে রণিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের বীজমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ‘জয় বাংলা’। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব জয়ের পিছনে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি একটি ফ্যাক্টর। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে ঢাকায় দেখা গেছে, একজন রিক্সাওয়ালা আর একজন রিক্সাওয়ালাকে দেখলেই ‘জয় বাংলা’ বলে কুশল বিনিময় করছে। ক্রমশঃ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এটা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়।”
[ জয় বাংলা মুক্তিফৌজ, ও শেখ মুজিব কলহন, পৃঃ ২৮৫-২৮৬]
স্বাধীন বাংলার পতাকা
পতাকা সম্পর্কেও কলহন যে তথ্য দিয়েছেন তা’ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেনঃ
“২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং-এর প্রাঙ্গণে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে ছাত্রদের একটি বিরাট সভা হ’ল। ছাত্রদের সভা সাধারণতঃ বটতলাতেই হয়। কিন্তু ওই দিন অসংখ্য ছাত্ৰ-ছাত্ৰীতে সারা অঙ্গন ছয়লাপ হয়ে গেল। ছাত্রনেতারা তখন ছাদের ওপর উঠে ভাষণ দিলেন। ওই দিনের সভাপতি ছিলেন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী। ছাত্রনেতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩২
আ. স. ম. আবদুর রব জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে ‘উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা’ পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করার ডাক দিলেন।
পোড়ানো হ’ল পাকিস্তানী পতাকা। যে দিয়াশলাই দিয়ে প্রথমে পাকিস্তানী পতাকা পোড়ানো হয়, ঢাকায় একজন ছাত্রনেতা আজও পরম যত্নে সেই দিয়াশলাইটা রেখে দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মিউজিয়ামে তা’ সংরক্ষিত হবে ভাবীকালের ছেলেমেয়েদের জন্য।
পাকিস্তানী পতাকা তো পোড়ানো হ’ল। কিন্তু জাতীয় পতাকা কোথায়? ছাত্রলীগের জঙ্গী বাহিনীর (রেজিমেন্টাল) পতাকাটাই এগিয়ে দিল একজন। ছাত্রনেতা আবদুর রব সেই পতাকা হাতে তুলে নিয়ে ঘোষণা করলেন, এই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পতাকার জমিন সবুজ। মাঝে সিঁদুর রাঙা গোলাকার সূর্য। তারই মাঝে সোনালিতে আঁকা পূর্ব বাংলার মানচিত্র। ছাত্র-ছাত্রীরা বিপুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে বরণ ক’রে নিল সেই পতাকা। তারপর সেই পতাকা সামনে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল বের করলেন। রমনা এলাকায় ঘুরল সেই মিছিল। বাংলাদেশের মানুষ সেই প্রথম দেখল তাদের জাতীয় পতাকা। সকলে সশ্রদ্ধচিত্তে সম্মান জানাল সেই পতাকাকে। পরের দিন ছাত্রলীগ আয়োজিত প্রকাশ্য জনসভায় ১নং ইস্তাহার বিলি করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসাবে সে পতাকাও তোলা হ’ল।
১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহে ছাত্রলীগের জঙ্গী বাহিনীর পতাকারূপে এই পতাকার পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনাও সিরাজুল আলম খানের। ১৫ই ফেব্রুয়ারী সার্জেন্ট জহুরুল হকের স্মৃতি স্মরণে ছাত্রলীগের জঙ্গী বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয়। তাতে ওই পতাকার প্রথম বাস্তব রূপ দেখা যায়। কিন্তু প্রকাশ্যে পতাকাটি ব্যবহৃত হয় ৭ই জুন সকাল সাড়ে আটটায়। ৬-দফা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাবাহিনীর কুচকাওয়াজ হয় পল্টন ময়দানে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সে দিন। তার মধ্যেই শেখ সাহেব ছাত্রলীগ স্বেচ্ছাবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করলেন। গোল ক’রে মোড়ানো ছাত্রলীগের পতাকাটা একজন শেখ সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। শেখ সাহেব তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৩
ওই পতাকা খুলে ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রবের হাতে তুলে দিলেন, কুচকাওয়াজ শুরু হবার ঠিক আগে।
‘স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘোষণা নিয়েও ছালীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ১২ই আগষ্ট ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক বর্ধিত সভা হয় ইকবাল হলে। সভায় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি এবং নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে আলোচনা এবং বিতর্ক হয়। ছাত্রনেতাদের গরিষ্ঠ দলের বক্তব্য ছিল, পূর্ব বাংলা পাকিস্তান সরকারের একটি উপনিবেশ। তাই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন তীব্র করতে হবে। তাঁদের লক্ষ্য হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। নির্বাচনে জয়ী হলেই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খান গণ-প্রতিনিধিদের হাতে আপসে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এ তাঁরা বিশ্বাস করেন না। নির্বাচনে যোগ দেওয়ার পিছনে তাঁদের উদ্দেশ্য, জনমত গঠন করা। নির্বাচনে যোগ না দিলে আওয়ামী লীগ জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন তো হয়ে পড়বেই তদুপরি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করলে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম, জমিয়তে ওলামা প্রভৃতি দলের একটা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ক্ষমতায় চলে আসবে অনায়াসেই। তার ফলে শোষণ-মুক্তির বাস্তবায়নের স্বপ্ন হবে সুদূর পরাহত। তাঁদের মতে, নির্বাচন জনমত গঠনের একটি মাধ্যম মাত্র। সেই ঐক্যবদ্ধ জনতার আন্দোলনকে একদিন সশস্ত্র রূপ ধারণ করতেই হবে।
ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু ছাত্রদের একাংশ প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। তাঁরা যে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠনের বিরোধী ছিলেন তা’ নয়। তবে ওই মুহূর্তে তাঁরা ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘোষণার বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ মতবিরোধ ছিল সময় নিয়ে।
সমস্যা সমাধানের জন্য ছাত্রনেতারা গেলেন শেখ মুজিবের কাছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই প্রয়োজনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদনে দলের গুরুত্বপূর্ণ সব নীতি নির্ধারিত হয়। শেখ মুজিব কিন্তু কখনই চাইতেন না, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ এমন কোন প্রস্তাব পাশ করুক যার প্রতি
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৪
একাংশের অনুমোদন নেই। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রস্তাব পাশ করা যায় ঠিকই, কিন্তু তাতে দলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তিনি ছাত্রনেতাদের বললেন, ‘তোমরা যা খুশী প্রস্তাব পাশ করতে পারো। সে অধিকার তোমাদের আছে। তবে শুধু প্রস্তাব পাশ করেই বিপ্লব হয় না। বাস্তব দিকটাও বিচার করতে হবে। সরকার ভালই জানেন, আমরা কী করছি বা করতে যাচ্ছি। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের কিছু করতে পারছেন না। ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠনের প্রস্তাবটি এই মুহূর্তে লিখিতভাবে পাশ হলেই জঙ্গী-সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই সব কিছু বানচাল হয়ে যাবে। প্রস্তাবটা লিখিত না থাকলেও হয়ত বিশেষ কিছু হবে না। ছাত্রনেতারা শেখ সাহেবের কথা মেনে নিল।”
[ কলহন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৬-২৯০]
১লা মার্চ সিরাজুল আলম খান এবং তাঁর সহযোগী ছাত্রনেতারা পরবর্তী গণ-আন্দোলনের রূপ এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ ক’রে একটি ইস্তাহারের খসড়া করেন। এটা প্রকাশ করা হয় ৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের সভায়। শেখ মুজিব সেই সভায় ভাষণ দেন। ইস্তাহারটি আজ একটি ঐতিহাসিক দলিল। মার্চের সমস্ত গণ-আন্দোলন পরিচালনা, স্বাধীনতা ঘোষণা, শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের’ সর্বাধিনায়ক ঘোষণা সব কিছুই ওই ইস্তাহারের নির্দেশ মতোই হয়েছে। আমি এখানে ইস্তাহারটি হুবহু তুলে ধরছিঃ
জয় বাংলা
এশতেহার নং/এক
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা ও কর্মসূচীঃ
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা হয়েছে। গত তেইশ বছরের শোষণ, কুশাসন ও নির্যাতন একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাত কোটি বাঙালীকে গোলামে পরিণত করবার জন্য বিদেশী পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, তা’ থেকে বাঙালীর মুক্তির পথ স্বাধীন জাতি হিসাবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকা। গত নির্বাচনের গণ-রায়কে বানচাল ক’রে শেষবারের মতো বিদেশী পশ্চিমা শোষকরা সে কথার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করেছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৫
৫৪ হাজার ৫শত ৭৬ বর্গ মাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’। ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠনের মাধ্যমে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
(১) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন ক’রে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি সৃষ্টি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
২। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন ক’রে অঞ্চলে অঞ্চলে ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন ক’রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু ক’রে কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েম করতে হবে।
৩। স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ গঠন’ করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।
(ক) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
(খ) সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
(গ) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত ক’রে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায়, ‘মুক্তি বাহিনী’ গঠন করতে হবে।
(ঘ) হিন্দু-মুসলমান বাঙালী-অবাঙালী সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
(ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে।
স্বাধীনতা-আন্দোলনের ধারা নিম্নরূপ হবে।
(অ) বর্তমান সরকারকে বিদেশী উপনিবেশবাদী শোষক সরকার গণ্য ক’রে এ বিদেশী সরকারের ঘোষিত সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা করতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৬
(আ) তথাকথিত পাকিস্তানের তল্পীবাহী পশ্চিমা অবাঙালী মিলিটারীদের বিদেশী ও হামলাকারী সৈন্য হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং হামলাকারী শত্রু সৈন্যকে খতম করতে হবে।
(ই) বর্তমান বিদেশী উপনিবেশবাদী শোষক সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
(ঈ) স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণরত যে কোন প্রতিরোধ প্রতিহত, পাল্টা আক্রমণ এবং খতম করার জন্য সকল প্রকার সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে হবে।
(উ) বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সকল প্রকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(ঊ) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে।
(ঋ) শোষক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন করতে হবে এবং সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
(এ) উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে।
(ঐ) স্বাধীনতা সংগ্রামে রত বীর সেনানীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান ক’রে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে
* স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’—দীর্ঘজীবী হউক।
* স্বাধীন কর স্বাধীন কর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
* স্বাধীন বাংলার মহান নেতা— ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিব।
* গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়—মুক্তি বাহিনী গঠন কর।
* বীর বাঙালী অস্ত্র ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
* মুক্তি যদি পেতে চাও—বাঙালীরা এক হও।
বাংলা ও বাঙালীর জয় হোক। জয় বাংলা
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৭
কেন এই বাংলাদেশ গঠন, কি তার লক্ষ্য, স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে; কী হবে আন্দোলনের ধারা; আন্দোলনের শ্লোগানই বা কী কী হবে—সব কিছুর স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে ইস্তাহারে।
বাংলাদেশ গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি গঠন, অঞ্চলে অঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন ক’রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু ক’রে কৃষক-শ্রমিকরাজ কায়েম করা, গণতন্ত্র মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলন জাতীয়তাবাদী এবং সেই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের অন্দোলন। দেখা যাচ্ছে, এই স্বাধীনতা আন্দোলন পশ্চিমা শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নয়। পশ্চিমা শোষকশ্রেণীকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘বিদেশী’ এবং “উপনিবেশবাদী’ আখ্যা দিয়েছেন। পশ্চিমা এই শোষকশ্রেণীর মধ্যে আছে ইয়াহিয়া সরকার এবং পুঁজিপতিরা। স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তারা জনসাধারণের সহযোগিতা এবং ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন, শ্রমিকদের এবং কৃষকদের সংগঠিত ক’রে ‘মুক্তি বাহিনী’ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকসৈন্য খতম করা এবং সশস্ত্র প্রস্তুতির ডাকও দেয়া হয়েছে। এই আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল যে হিন্দু-মুসলমান এবং বাঙালী অবাঙালীতে দাঙ্গা লাগাতে পারেন সে সম্পর্কেও জনসাধারণকে আগেই সতর্ক করে’ দেয়া হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশিকা এই ইস্তাহারেই রয়েছে। পরবর্তী সমস্ত আন্দোলন এই ইস্তাহারের নির্দেশ মতোই পরিচালিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের যে একাংশ এতদিন ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ ঘোষণা ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, ইয়াহিয়ার অগণতান্ত্রিক মনোভাবের দরুন তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হ’ল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার পর। পূর্ব বঙ্গের নির্বিচার গণহত্যা চালানোর পর তাদের পক্ষে ইস্তাহারের নির্দেশ সমর্থন না ক’রে আর কোন উপায়ই রইল না।
২৮শে ফেব্রুয়ারী আর ১লা মার্চের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান ঘটে গেল। পূর্ব বঙ্গের রাজনীতিতে, গণ-আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়ে গেল ১লা মার্চ দুপুরের পর।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৮
৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ আয়োজিত জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হ’ল। ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ গঠনের কথা ঘোষণা ক’রে ইস্তাহার বিলি করা হ’ল। শেখ মুজিব ওই জনসভায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানালেন। শেখ মুজিব বললেন, হিংস্রতা আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
[ কলহন, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯১-২৯৬]
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পটভূমিকা হিসেবে ‘জয় বাংলা’-শ্লোগান, বাংলাদেশের পতাকা ও স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনা ইত্যাদির আলোচনা করা গেল। আশা করি এ থেকে ৭ই মার্চের ঘোষণা আমাদের পক্ষে উপলদ্ধি করা সহজ হবে।
৭ই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ৬ই মার্চ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডীস্থ বাসভবনে উপস্থিত ছিলাম। ছাত্রদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বাধীনতা ঘোষণার এক বিরাট চাপ এসেছিল। এক সময় বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে ঠাট্টাস্থলে আমাকে বললেনঃ ‘অধ্যাপক, আপনার এই গুণধর ছাত্রদের সামলান। এদের নিয়ে আমি আর পারছি না।’ তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন প্রখ্যাত সংগ্রামী ছাত্রনেতা আবদুর রউফ এবং আরো কয়েকজনকে। রউফ তখন নির্বাচিত পরিষদ সদস্য। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্র ছিল। আমি আব্দুর রউফ এবং আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে নিকটস্থ সাংহাই চীনা রেস্তোরায় গেলাম এবং সেখানে আহারের সময় তাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনায় তারা সবাই সম্মত হ’ল যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আগামীকল্য অর্থাৎ ৭ই মার্চ তারিখে ঘোষণা করা হবে কি না হবে তা’ সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। রাত্রি প্রায় বারোটার দিকে ছাত্রনেতাদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে আমাদের আলোচনার ফলাফল তাঁকে জানানো হ’ল। তিনি আনন্দে গদগদ হয়ে আমাকে ও ছাত্রনেতাদের জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। ছাত্রনেতৃবৃন্দের এই আচরণের জন্য আমি তাদের নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ।
’৭১—এর ৭ই মার্চ
এলো ৭ই মার্চ, ১৯৭১। বাঙ্গালী জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিন বাঙালী জাতির ভাগ্য নিয়ন্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৩৯
রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ, বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ চারিদিকে। সে দৃশ্য যারা না দেখেছে তাদের নিকট যেন বর্ণনা করা যায় না। বাঁধ ভাঙা মানুষ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়—বাংলাদেশ স্বাধীন কর,’ ‘তোমার দেশ আমার দেশ—বাংলাদেশ বাংলাদেশ,’ ‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ ইত্যাদি শ্লোগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস-মাটি সে দিন কাঁপিয়ে তুলেছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল। অথচ লাখো লাখো জনতা গ্রাম-বন্দর-অলিগলি থেকে ছুটে চলেছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। তাদের হাতে রয়েছে লাঠি, রড, বাঁশ ইত্যাদি। এই দিনের রেসকোর্স ময়দানের ঘটনাবলীর চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ৮ই মার্চের দৈনিক পাকিস্তান লিখেছেনঃ “মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। শ্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লক্ষ কণ্ঠের বজ্ৰ শপথ। হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালীর সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক শতকোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু শ্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে। এই ছিল গতকাল রোববার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ই মার্চ, ১৯৭১]
দেশ-বিদেশ থেকে সাংবাদিকরাও এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনতে; তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা দেখে। স্বাধীনতার জন্য একটি জাতি যে কিরূপ উদ্বেল রূপ ধারণ করতে পারে তা’ দেখে সে দিন দেশ-বিদেশের সবাই অবাক না হয়ে পারলেন না।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ
বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে তাঁর নির্দেশ শুনবার জন্য। দেখলেন বাংলার মানুষ শুধু
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪০
তাঁর কথায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন তিনি। তারপর জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন তাঁর নির্দেশাবলী। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি এখানে সম্পূর্ণ তুলে ধরা হলঃ
“ভাইয়েরা আমার!
আজ দুঃখ ভারাকান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবাই জানেন এবং বুঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়—তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়ী করিয়েছিলেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে—আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও গদীতে বসতে পারি নি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারী ক’রে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম ক’রে রাখল। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেয়া হ’ল এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হল। ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন—আমরা মেনে নিলাম। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হ’ল—আমরা তাঁকে ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই—সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে। তিনি মার্চের তিন তারিখে অধিবেশন ডাকলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪১
আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা’ মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।
জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা হ’ল। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়; আরো আলোচনা হবে। মওলানা নূরানী, মওলানা মুফতি মাহমুদ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারী নেতা এলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হ’ল—উদ্দেশ্য ছিল আলাপ-আলোচনা ক’রে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাঁদের আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, ৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ।
কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ডবল জিম্মী হতে পারবেন না। পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙ্গে দেয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবে না।
তা’ সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশজন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্তু পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ক’রে দিলেন। দোষ দেওয়া হ’ল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হ’ল আমাকে, বলা হ’ল আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু করা হয় নি।
এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো।
কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হ’ল। আমাদের হাতে অস্ত্র নাই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলী । আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে, —আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪২
ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি দশই মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি—তাঁর সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি—আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় আসুন, দেখুন, আমার গরীব জনসাধারণকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; আমার মায়ের কোল কিভাবে খালি করা হয়েছে। আমি আগেই বলে দিয়েছি, ‘কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না, কিসের গোলটেবিল বৈঠক, কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা-বোনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে?’
তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম, ‘অফিস-আদালত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন।’
হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমার দলের সঙ্গে আলোচনা না ক’রে এক জনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো, কিন্তু গুলী করা হ’ল আমার বাংলার মানুষকে—আমরা গুলী খাই, দোষ আমাদের, আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের।
ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন কিন্তু আমার দাবী, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা ক’রে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসবো না। এ দাবী মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয় নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাব না। ভাইয়েরা আমার। ‘আমার উপর বিশ্বাস আছে?’ (লাখো জনতা হাত উঠিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে) । ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারে নি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারে নি।’ আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত ক’রে এনেছিলেন। সে দিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবোঃ মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৩
আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীম-কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না—এ আমার নির্দেশ।
গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। ট্রেন চলবে তবে সেনাবাহিনী আনা-নেওয়া করা যাবেনা। করলে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।
সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট সহ সরকারী-আধা সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের জন্য ব্যাঙ্কগুলো দু’ ঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবে না। বাঙালীরা বুঝে শুনে চলবেন। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে, তবে সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।
এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন, দরকার হ’লে সমস্ত চাকা বন্ধ ক’রে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। বেতন যদি না দেয়া হয়, যদি একটিও গুলী চলে, তা’ হ’লে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল—যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ ক’রে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো—পানিতে মারবো। আমি যদি হুকুম দেবার জন্য না থাকি, যদি আমার সহকর্মীরা না থাকেন, আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। গুলী চালালে আর ভালো হবে না। সাতকোটি মানুষকে আর দাবাতে পারব না। বাঙালীরা যখন মরতে শিখেছে—তখন কেউ তাদের দাবাতে পারবে না।
শহীদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন।
সাত দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেন নি—শিল্প মালিকেরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭88
সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা’ মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন—আন্দোলন কি ভাবে করতে হয়, তা’ আমি জানি।
কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালী-অবাঙালী, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোন বাঙালী রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না।
শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা’ না হ’লে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখা-দেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হ’লে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। কারণ শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। জয় বাংলা।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৮ই মার্চ, ১৯৭১]
বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা ঢাকা বেতার থেকে রীলে করার কথা ছিল। জনগণ উন্মুখ হয়ে বেতারের নিকট অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ শোনার জন্য। কিন্তু সামরিক কর্তাব্যক্তির হস্তক্ষেপের ফলে সে দিন তা’ করতে দেয়া হয় নি। এর প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের প্রায় পাঁচশ বাঙালী কর্মচারী কাজ বন্ধ রেখে অফিসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন। এমনকি অনুষ্ঠানের শেষে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর যে রেওয়াজ প্রচলিত ছিল, তাও বাজানো হয় নি।
৭ই মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রেস-বিবৃতি
২৫শে মার্চ তারিখে জাতীয় পরিষদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৫
অধিবেশন বসবে—এই আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৬ই মার্চ তারিখে যে বেতার ভাষণ দেন, তার জবাবে শেখ মুজিব ৭ই তারিখ সকালে এক দীর্ঘ প্রেস বিবৃতি দান করেন। এই প্রেস বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ
“১লা মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করতে হচ্ছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ (শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র) যারা জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ওপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা শহীদ হয়েছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার স্বেচ্ছাচারমূলক ও অযাচিত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে যেয়েই তাঁরা শহীদ হয়েছেন। এই শহীদদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বলে চিত্রিত করা সত্যের অপলাপ মাত্র। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এক সত্যিকারের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য যারা দায়ী বস্তুতঃপক্ষে তারাই হচ্ছে আসল দুষ্কৃতিকারী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ অবস্থার অবতারণা করা হয়েছে, তা’ দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসার একটু সময় করতেও সক্ষম হন নি। প্রেসিডেন্ট যাকে ক্ষমতার ‘ন্যূনতম’ প্রয়োগ বলে অভিহিত করেছেন তার ফলেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হয়ে থাকে, তা’ হ’লে আমাদের কি এটাই বুঝতে হবে যে, তিনি যাকে ‘পর্যাপ্ত পরিমাণ’ ক্ষমতার প্রয়োগ বলবেন তার লক্ষ্য হবে কি সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেয়া? বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এই নগ্ন হুমকির আমি নিন্দা করছি। জাতি অনেক অর্থ ব্যয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে বিদেশী হামলা প্রতিহত করার জন্য। বেসামরিক নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়ার জন্য নয়। অপর অঞ্চলের উর্দিপরা সৈনিকরা যে বাড়াবাড়ি করছে, তারা দখলকারী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৬
বাহিনীর মতো যে ভূমিকা পালন করছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের আজ রক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন।
বলা হয়েছে যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে ভুল বোঝা হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য এবং একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ঘোষিত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু দলের একক খেয়ালের প্রতি সাড়া দিয়েই কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয় নি? আমরা ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিলাম। অপর দিকে উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপটি চেয়েছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন হোক। এই সংখ্যালঘু গ্রুপটির মতের কাছেই নতি স্বীকার করা হয়েছে এবং ৩রা মার্চ পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও সেই একই সংখ্যালঘু গ্রুপটি পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রথমতঃ, এই সংখ্যালঘু গ্রুপ একটা অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য উত্থাপন ক’রে বলেছে যে, ঢাকা এলে এর সদস্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা ডাবল জিম্মী হয়ে যাবে। এর পর এই দল থেকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে, তারা যে সব শর্ত আরোপ করবে তা’ মেনে নিলেই শুধু তারা পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে। এরপর আর এক পর্যায়ে এই সংখ্যালঘু গ্রুপের সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নেয়। সবচেয়ে যা বিস্ময়কর তা’ হ’ল এই যে, উক্ত গ্রুপের সদস্যরা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই আইনগত কাঠামো আদেশে আনা হ’ল একটি সংশোধনী। এতে বলা হ’ল পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সদস্যরা ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারবেন। কিন্তু এরপর উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিলেন পদত্যাগ না করার। এই দলের এলোপাথাড়ী ইচ্ছা অনিচ্ছা চরমে পৌঁছালো ২৭শে ফেব্রুয়ারী। সে দিন এই দল থেকে ঘোষণা করা হ’ল যে, এই দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া যদি পরিষদের অধিবেশন বসে, তা’ হ’লে এই দল এক গণ-আন্দোলন শুরু করবে। এই দল এতদূর পর্যন্ত বলতে পারল যে, পরিষদের অধিবেশনে যারা যোগদান করবে, তাদের ওপর জনগণ পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে এবং জনগণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৭
যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয়, তা’ হ’লে এই দলটিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই দলটি থেকে আরও হুমকি দেয়া হয় যে, এই দলের কোন সদস্য যদি পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করে তা’ হ’লে দলীয় কর্মীরাই তাদের নিশ্চিহ্ন ক’রে দেবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পার্লামেন্টারী পার্টি ঢাকায় সমবেত হন এবং পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও পরিষদ সদস্যরা ঢাকায় আসতে শুরু করেন।
প্রধান নির্বাচনী কমিশনারও ঢাকা এসে পৌঁছান এবং ২রা মার্চ পরিষদের মহিলা সদস্যদের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের নিজেরও ১লা মার্চ ঢাকা আসার সম্ভাবনা ছিল। গত ২৭শে ফেব্রুয়ারী আমরা এ পর্যন্তও বলেছিলাম যে, কোন সদস্য ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত কিছু পরিষদে উত্থাপন করলে আমরা তা’ মেনে নেবো। কিন্তু সে প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় এবং তা’ করা হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেই। পয়লা মার্চ এক বেতার বিবৃতিতে আকস্মিক ও অহেতুকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ক’রে দেওয়া হয়। এ জন্য অজুহাত দেখানো হয়, সমঝোতা সৃষ্টির জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এ কথাও বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। বাংলাদেশের মানুষ কি এর থেকে মনে করতে পারে না যে, একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নির্দেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে? তারা কি যুক্তিসঙ্গত ভাবেই ভাবতে পারে না যে, একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করা এবং সংখ্যাগুরু জনসাধারণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কতিপয় শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছে? দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে এ সব সন্দেহ আরো দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। এতে প্রমাণ হয়, ‘রাজনৈতিক বিরোধ’ অচিরেই ‘সামরিক বিরোধের’ রূপ নিচ্ছে যদি না সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নির্দেশের কাছে মাথা নত করে।
আওয়ামী লীগ কোনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করছে এ অভিযোগের জবাবেই আমি এ সব কথা বিস্তারিত উল্লেখ করলাম। এ ধরনের বাধা সৃষ্টি থেকে যাদের ফায়েদা হতে পারে, সংখ্যাগুরু দল তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দেশের জনসাধারণ এবং কার্যতঃ সারা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৪৮
বিশ্বের কাছেই আজ একথা পরিষ্কার যে, পশ্চিমাঞ্চলের একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ক’রে চলেছে। দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিজে এই সংখ্যালঘু চক্রটির নির্দেশে নতি স্বীকার করাকেই তাঁর নৈতিক কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন। একটি সংখ্যালঘু চক্র যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বানচাল করার জন্য কায়েমী স্বার্থের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়, তবে গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থা কায়েম কিংবা জনসাধারণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত যদি গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয় তবে তার দায়িত্ব এই সংখ্যলঘু চক্র এবং তার সাথে চক্রান্তকারীদেরই বইতে হবে।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই ক্ষমতার বৈধ উৎস। গত সাত দিনের ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলী মেনে চলেছে। প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদস্থ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। কাজেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ না করা বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এরপর আমাদের আসতে হয় আগামী ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা সংক্রান্ত প্রশ্নে। আমরা নিজেরাই বারবার শীঘ্র অধিবেশন আহ্বানের জরুরী প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছি। কিন্তু আজ এক অস্বাভাবিক ও মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার নীতির অনুসরণে প্রকৃতপক্ষে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও বিশ্বের সর্বত্র সুবিবেচক জনগণসহ সবদিক থেকেই এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে বলে আওয়াজ তোলা হচ্ছে।
জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ভীতিপ্রদ পরিবেশে কাজ করবেন, এটা আশা করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও
পৃষ্ঠা নং ~৭৪৯
অস্ত্র আমদানী সহ এই মোকাবিলাজনিত অবস্থা বজায় থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নির্যাতনের পরিবেশ অব্যাহত থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেসামরিক জনতার ওপর প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর গুলীবর্ষণের খবর আসতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা বন্দুকের মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয় বিবেচনা করবেন, এটি আশা করা যায় না।
যদি প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবে কামনা করেন যে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তা’ হ’লে অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাটি গ্রহণ করতে হবেঃ
(ক) অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।
(খ) বেসামরিক জনগণের ওপর গুলীবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যাতে এখন থেকে একটা বুলেটও ছোড়া না হয়।
(গ) সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং দেশের পশ্চিম অংশ থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য আমদানী অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
(ঘ) বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন শাখায় সামরিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না এবং সরকারী অফিসার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আক্রোশজনিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে।
(ঙ) আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ কেবলমাত্র পুলিশ ও বাঙালী ই. পি. আর. বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের উক্ত কাজে সহায়তা করবেন।
(চ) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(ছ) অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
যদি সামরিক মোকাবিলা চলতে থাকে এবং যদি আমাদের নিরস্ত্র জনগণের ওপর বুলেট নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে সন্দেহের কোন অবকাশ না রেখে আমি বলতে চাই যে, সে অবস্থায় কোন জাতীয় পরিষদই কাজ করতে পারে না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫০
আমাদের জনগণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা তাঁদেরকে আর উপনিবেশ অথবা বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করেছেন। আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতী জনগণকে অনাহার, রোগ ও বেকারত্ব থেকে বাঁচাতে হবে। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ লোককে পুনর্বাসনের কাজ এখনো বাকী রয়েছে। যদি শাসকগোষ্ঠী এ সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তা’ হ’লে মুক্তির জন্য দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে জনগণও প্রস্তুত। যে মুক্তির জন্য অনেক শহীদের রক্ত ঝরেছে এবং যার জন্য বহুলোক চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জনগণের মুক্তির সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদদের রক্ত কখনও বৃথা যাবে না।
আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনগণ অদম্য সাহস ও সঙ্কল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা বীরত্বের সাথে বুলেটের মোকাবিলা করেছেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে সান্ধ্য-আইন ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বাঙালী ও তথাকথিত অবাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দালাল উস্কানিদাতা ও সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ ক’রে দেওয়ার জন্য আমি আমাদের জনগণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আবার বলছি যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি লোকই বাঙালী এবং তার শারীরিক নিরাপত্তা, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং যে কোন মূল্যে তা’ রক্ষা করতে হবে। আমরা গর্বের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, যখন থেকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সতর্ক দৃষ্টি রাখার ও পাহারা দেওয়ার কাজ হাতে নিয়েছেন, তখন থেকে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি।
আমাদের সংগ্রাম অবশ্যই চলবে। সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত না হয়, আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ১৯৭১
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫১
সালের ৮ই মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছেঃ (১) খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। (২) সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজন বোধে এ ব্যাপারে কোন কোন অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে। (৩) রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের উপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয় তা’ হ’লে রেলওয়ে শ্রমিক ও বন্দর শ্রমিকরা সহযোগিতা করবেন না। (8) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না, অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে বাঙালীরা সহযোগিতা করবেন না। (৫) কেবল স্থানীয় ও আন্তঃজেলা টাঙ্ক টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে। (৬) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। (৭) ব্যাঙ্কগুলো স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অথবা অন্য কোন উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না। (৮) প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে। (৯) অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে যে কোন সময় উপরোক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে। (১০) প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি ক’রে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ই মার্চ, ১৯৭১]
টিক্কা খানের ঢাকা আগমন
সে দিন অপরাহ্নেই পূর্ব পাকিস্তানের নয়া গভর্নর হয়ে টিক্কা খান এসেছিলেন। আগের দিন অর্থাৎ ৬ই মার্চ তাঁর নিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর অফিসার ছাড়া কোন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী তাঁকে বিমান বন্দরে সম্বর্ধনা জানান নি। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান তখন ঢাকায় ছিলেন। তিনি মুজিবের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। ৭ই মার্চের সন্ধ্যায় তিনি শেখ সাহেবের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সামরিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫২
শাসন প্রত্যাহার ক’রে অনতিবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “যখনই দেশের জনসাধারণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সুযোগ পায়, তখনই কায়েমী স্বার্থবাদীরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করিয়া দেওয়ার জন্য যড়ষন্ত্রে তৎপর হয়।” জনাব আসগর খান আরো বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করিবার অধিকার আছে। আমি বুঝিতে পারি না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা দেওয়া হইবে না।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ই মার্চ ১৯৭১]
সরকারী প্রেসনোট
ঐ দিন গভীর রাতে প্রকাশিত এক সরকারী প্রেসনোটে স্বীকার করা হয় যে, গত কয়েকদিন প্রদেশব্যাপী হাঙ্গামায় ১৭২ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। কিন্তু সরকারী কর্তৃপক্ষ এর জন্য আন্দোলনকারীদের উপরই দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন। প্রেসনোটে বলা হয়ঃ
“পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক দুঃখজনক গোলযোগের সময় আইন কার্যকরীকরণ এজেন্সিগুলি শত শত ও সহস্র সহস্র ব্যক্তিকে নিহত করেছে বলে সাধারণ মনে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা’ দূর করার জন্যে জনগণের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বাস্তব ঘটনা ও অবস্থাটি তুলে ধরা প্রয়োজন। গুজব, ভীতিপ্রদ, গালগল্প ও অপপ্রচারের সহজ শিকারে পরিণত জনসাধারণের অবগতি ও সন্তুষ্টির জন্যে প্রকৃত অবস্থাটি তুলে ধরা প্রয়োজন। এ ধরনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
গত ১লা মার্চে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছানুযায়ী ২রা মার্চ সকাল থেকে হরতাল শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুদ্ধ জনতা সমাজ-বিরোধী কাজ, যেমন লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও ছুরিকাঘাত চালাতে থাকে। এতে সমাজ-বিরোধী দুষ্কৃতিকারীরা এই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। তারাও ব্যাপকহারে অরাজকতার সৃষ্টি করে। এইসব সমাজ-বিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম যেমন লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যার আশঙ্কায় পাহারারত সামরিক বাহিনীর ইউনিটগুলো ছাড়াও ২রা মার্চ ব্যারাকে অবস্থানরত
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৩
সৈন্যবাহিনীকে অবস্থা মোকাবিলার জন্য ডাকা হয়। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধেই তারা দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে। জিন্নাহ এভিনিউ, নবাবপুর রোড, ঠাটারী বাজার ও ঢাকার অন্যান্য এলাকার অবস্থা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার প্রেক্ষিতেই তারা সৈন্যবাহিনীকে অনুরোধ জানান।
ঐ সন্ধ্যায় সান্ধ্য আইন জারী করা হয়। সান্ধ্য আইন রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত বলবৎ ছিল। সান্ধ্য আইন কার্যকরী করার ব্যাপারে পুলিশ এবং ই. পি. আর-কে সহযোগিতা করার জন্য সৈন্যবাহিনী রাত ৯টার আগে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় নি।
প্রদেশব্যাপী সপ্তাহব্যাপী গোলযোগের জন্য ১৭২ জন লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং ৩৫৮ জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, ফরোঘাট কলোনী এবং অয়ারলেস কলোনী থেকে দাঙ্গাকারীদের মধ্যে ৭৮ জন মারা যায় এবং ২০৫ জন আহত হয়। …….”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৮ই মার্চ, ১৯৭১]
সরকারী প্রেসনোটের প্রতিবাদে তাজউদ্দিন
পরদিন এই বিবৃতির কঠোর নিন্দা করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ “সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রেসনোটে যে কথা বলেছেন, আমি তার নিন্দে করছি। প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা যে কেবল একেবারে নগণ্য ক’রে দেখানো হয়েছে তা’ নয়, বরং কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো বলা হয়েছে যে, নিহতের সংখ্যা ১৭২ এবং আহতের সংখ্যা ৩৫৮ এবং এই হত্যাকাণ্ড ভীতি ও নিন্দা প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট নয়।
নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর ব্যাপক গুলী চালানোর ফলে কেবল মাত্র বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই যে অপরিমেয় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তা’ নয়, বরং সর্বত্রই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের মধ্যেই তা’ ব্যাপক ক্ষোভের উদ্রেক করেছে। কেবল মাত্র লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ ক্ষেত্রেই গুলী চালানো হয়েছে বলে প্রেসনোটে যে কথা বলা হয়েছে, তা’ জানা ঘটনাসমূহের বা প্রকৃত ঘটনাসমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বাধিকারের দাবীতে শান্তিপূর্ণভাবে যারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল, তাদেরই মিছিলের উপর গুলী চালানো
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৪
হয়েছে। প্রেসনোটে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজের জন্য পুলিশ যথেষ্ট ছিলনা বলে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তা’ যে কতখানি মিথ্যে, তা’ প্রমাণিত হয়েছে সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কর্তৃক আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার মাধ্যমে। এছাড়া আজ মহরমের মিছিলে আওয়ামী লীগের সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী শৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালনের যে নজির সৃষ্টি করেছেন তা’ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, জনগণকে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে কিভাবে নিয়োজিত করতে হয়। পুলিশ ও ই.পি.আর. বাহিনীই গুলী চালিয়েছে বলে প্রেসনোটে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে কথা বলা হয়েছে আমি তার তীব্র নিন্দা করছি। বাঙালীর বিরুদ্ধে বাঙালীকে লেলিয়ে দেবার জন্য এবং বাঙালীদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টির জন্যই গুলী চালানোর অপবাদ পুলিশ ও ই.পি.আর-এর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। বাঙালীরা আজ সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ ও একক শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে এবং এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি ও সন্দেহ সৃষ্টির কোন প্রচেষ্টাই আজ আর সফল হবে না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ যোগ্য যে, পুলিশ যে সব এলাকার শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সে এলাকার কোথাও একটিও গুলী হয় নি। এক্ষেত্রে আমি একথা উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করি যে, জওয়ানদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ঘোষণা করার পরও এখনও বিভিন্ন এলাকায় তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে আবার আমরা দাবী জানাচ্ছি।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ই মার্চ, ১৯৭১]
তাজউদ্দিনের ব্যাখ্যা
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু রমনার মাঠে যে নির্দেশ ঘোষণা করেছেন ৮ই মার্চে তাজউদ্দিন আহমদ তা’ ব্যাখ্যা ক’রে বিভিন্ন অফিস, ব্যাঙ্ক ও প্রতিষ্ঠানে কি ভাবে ও কত সময় ধরে হরতাল পালিত হবে এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান হরতালের আওতায় পড়বে না পড়বে তার পূর্ণ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও কর্মসূচীর বিশ্লেষণ নিম্নে দেয়া হ’লঃ
(১) ব্যাঙ্কঃ ব্যাঙ্কের কার্যপরিচালনার জন্য সকাল ৯টা থেকে সাড়ে বারটা পর্যন্ত ব্যাঙ্কগুলো খোলা থাকবে এবং প্রশাসনিক কাজের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৫
জন্য বিকেল তিনটা পর্যন্ত চালু থাকবে। অর্থ-কড়ি জমা, বাংলাদেশের মধ্যে আন্তঃব্যাঙ্ক ক্লিয়ারেন্স এবং নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যে
অর্থ আদান-প্রদান চলবেঃ
(ক) পূর্ববর্তী সপ্তাহের ভাতা ও বেতন প্রদান।
(খ) যারা এক হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন।
(গ) মিল-ফ্যাক্টরীগুলো পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কেনার জন্য অর্থ প্রদান করা যাবে। চিনি কলগুলো চালানোর ইক্ষু ক্রয় আর চটকল ইত্যাদির পরিচালনার জন্য পাট কেনা এর অন্তর্ভুক্ত। স্টেট ব্যাঙ্কের মারফৎ বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাইরে টাকা-পয়সা পাঠানো যাবে না।
(২) শুধু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর কাজ চালানোর সুবিধার জন্য স্টেটব্যাঙ্ক খোলা থাকবে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।
(৩) শুধু বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ই. পি. ওয়াপদার প্রয়োজনীয় দফতরগুলো খোলা থাকবে।
(8) শুধু সার ও শক্তিচালিত পাম্পগুলোর ডিজেল সরবরাহের নিশ্চয়তার জন্য ই.পি.এ.ডি.সি. চালু রাখা হবে।
৫) ব্রিকফিল্ডের জন্য কয়লা ও পাটবীজ ও ধানবীজ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু থাকবে।
(৬) খাদ্য আনা-নেয়ার কাজ অব্যাহত রাখা হবে।
(৭) উপরে উল্লিখিত যে কোন উদ্দেশ্যে চালান পাশ করার জন্য ট্রেজারী ও এজি অফিস খোলা রাখা হবে।
(৮) ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাসমূহে সাহায্য, পুনর্বাসন কাজ অব্যাহত থাকবে।
(৯) চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম ও বাংলাদেশে যে কোন স্থানে টাকা-পয়সা পাঠানোর জন্য পোস্ট ও টেলিগ্রাম অফিস খোলা রাখা হবে। বাংলাদেশের বাইরে প্রেস টেলিগ্রাম পাঠানো যাবে। পোষ্ট অফিস সেভিংস ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে।
(১০) বাংলাদেশের সর্বত্র ই.পি.আর.টি. সি-র কাজ চালিয়ে যাবে।
(১১) পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে।
(১২) স্বাস্থ্য ও নিষ্কাশণের কাজ চলবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৬
(১৩) শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে পুলিশ তাদের কর্তব্য পালন ক’রে যাবে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রয়োজনে তাদের সহায়তা দান করতে হবে।
(১৪) আধা-সরকারী সংস্থার মধ্যে যেগুলোকে বাদ দেয়া হয়েছে, সেগুলি ছাড়া অন্যান্য আধা-সরকারী সংস্থাগুলোতে হরতাল পালন করা হবে।
(১৫) যে সকল প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট থেকে অব্যাহতি পাবে বলে ঘোষিত হয়েছিল, সেগুলো সম্পর্কে আগের নির্দেশই কার্যকরী থাকবে।
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ই মার্চ, ১৯৭১]
নূরুল আমীনের বিবৃতি
ঐ দিন পি. ডি. পি. প্রধান জনাব নূরুল আমীন এক বিবৃতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে শেখ মুজিবের সাথে বসার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান। খবরে বলা হয়ঃ “পি. ডি. পি. প্রধান জনাব নূরুল আমীন আজ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতির ব্যাপারে একটা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সংখ্যগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলাপ-আলোচনা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।
তিনি বলেন, একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অকস্মাৎ স্থগিত ঘোষণার ফলেই এই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। অথচ এই জাতীয় পরিষদের অধিবেশনই ছিল নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম পর্যায়।
জবাব নূরুল আমীন দুঃখ ক’রে বলেন যে, ৬ই মার্চের ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন যা বর্তমান অবস্থার অনুকূল নয়। সারা দেশে রাজপথ যখন মানুষের রক্তে রঞ্জিত ঠিক তখন প্রেসিডেন্ট এমন কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যা সঠিক তথ্যপূর্ণ নয়।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ই মার্চ, ১৯৭১]
বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন নূরুল আমীনের নাম ঘৃণার সাথেই উচ্চারিত হবে। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর হত্যাকাণ্ডে এই ঘৃণিত ব্যক্তির হাত ছিল। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তিনি তাঁর অতীত
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৭
শোধরানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে একেবারেই সাময়িক পরিবর্তন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু জনগণের সাথে তাঁর যোগ কোনদিন ঘনিষ্ঠ হ’তে পারে নি। তাঁর উপরের ভাষণে তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের আচরণে অস্থিরতা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। কিন্তু ইয়াহিয়া বা পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থবাদীদের আচরণে কোনদিন তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে নি। এ কারণেই যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তখন নূরুল আমীন ও তদীয় কয়েকজন অনুসারী ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে হাত মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে রাজত্ব কায়েমের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। বাংলার মানুষ ও মাটি ঘৃণার সাথেই এইসব পরগাছাকে বর্জন করেছে।
৮ই মার্চে ঢাকার পরিস্থিতি
যা হোক, শেখ মুজিবের নির্দেশানুযায়ী ৮ই মার্চ থেকে প্রতিটি গৃহশীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি শহর ও গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সরকারী, আধাসরকারী, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারী বন্ধ থাকে। তবে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাংলাদেশের ভেতর টেলিফোন ও ট্রাঙ্ককল ব্যবস্থা, বিদেশে সংবাদ পাঠাবার বিশেষ ব্যবস্থা স্বাভাবিক নিয়মে চালু থাকে। ব্যাঙ্কও চালু থাকে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাচার বন্ধ রাখা হয়। প্রদেশের সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, সব রকম কর প্রদান স্থগিত রাখা হয়। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যে কোন প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় অসহযোগিতা দেখান হয়।
বিচারপতি কর্তৃক টিক্কা খানের শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি
এই দিন এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে। লেঃ জেঃ টিক্কা খান প্রাদেশিক গভর্নর হিসাবে শপথ নেবেন, কিন্তু পূর্ব বাংলার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। কোন বিচারপতিই টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে রাজী হলেন না। এ এক চরম অবমাননা। বাধ্য হয়ে এই ঘৃণিত সেনানায়ককে কেবল মাত্র ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব পালনেই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে—গভর্নর হবার দুর্বার লোভ তাঁর আপাততঃ চরিতার্থ হ’ল না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৮
পরদিন ৯ তারিখে পল্টনে মাওলানা ভাসানী একটি ভাষণ দেন। তাঁর পাশে ছিলেন জাতীয় লীগের প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে পল্টন ময়দানে এই বৃদ্ধ জননেতা ঘোষণা করেন, “শেখ মুজিবের নির্দেশিত ২৫শে মার্চের মধ্যে কোন কিছু করা না হইলে আমি শেখ মুজিবের সহিত মিলিয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করিব।”
ভাসানী একথা উপলদ্ধি করলেন যে, দেশ আজ এক সঙ্কটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হ’লে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন। ঐক্যবদ্ধভাবেই পশ্চিমা শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেনঃ ‘মুজিব আমার ছেলের মত। আর ছেলে যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, পিতৃতুল্য হয়ে তিনি কি নিশ্চুপ থাকতে পারেন?’
ভাসানী সেদিন শেখ মুজিবের আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন করে জনগণকে তাঁর নির্দেশ মেনে চলার আহ্বান জানান। ন্যাপ প্রধান সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে পুনরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন। তিনি ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।
মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন সহ তাঁর প্রশংসা ক’রে বলেন, “আপনারা শেখ মুজিবকে কেউ অবিশ্বাস করবেন না। মুজিবকে আমি ভালো ক’রে চিনি। তাঁকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে সুদক্ষ প্রাইভেট সেক্রেটারী।”
তুমুল করতালির মধ্যে তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, “পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই, পাকিস্তান আর অখণ্ড রাখবো না। ইয়াহিয়ার বাপেরও ক্ষমতা নাই এই স্বাধীনতাকে ঠেকায়।”
এই সভায় জাতীয় লীগের প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান অবিলম্বে শেখ মুজিবকে জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, “বাংলার মানুষ শুধু সেই জাতীয় সরকারের হুকুমই মেনে চলবে, অপর কারো হুকুম নয়।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৫৯
ঐদিন অর্থাৎ ৯ই মার্চ ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এক জরুরী সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার একটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ছাত্রলীগ সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব আ. শ. ম. আবদুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্ৰ-সংগ্রাম পরিষদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সভায় আরেকটি প্রস্তাবে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ জাতীয় সরকার গঠনের জন্যেও অনুরোধ করা হয়।
জাতিসংঘের আচরণ ও বঙ্গবন্ধু
এদিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল এবং অন্যান্য দেশের সরকার ঢাকায় এবং পূর্ব বাংলার অপরাপর অঞ্চলে অবস্থিত নাগরিকদের জন্য ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা চালাতে থাকেন।
১০ই মার্চে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি ঢাকাস্থ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ থেকে অপসারণ সংক্রান্ত নির্দেশের কথা উল্লেখ ক’রে বলেনঃ “জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন এবং এতে ক’রে বাংলাদেশে বসবাসকারীদের জান ও মাল সামরিক শক্তি যে বিপজ্জনক ক’রে তুলেছে তা’ তিনি স্বীকার ক’রে নিলেন। বস্তুতঃপক্ষে তাঁর অনুধাবন করা উচিত যে, শুধুমাত্র জাতিসংঘ কর্মচারীদের সরিয়ে নিলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ আজকে যে হুমকি দেখা দিয়েছে, তা’ হচ্ছে গণহত্যার হুমকি; জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী স্বীকৃত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের হুমকি।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১১ই মার্চ, ১৯৭১]
যারা বলে যে, শেখ মুজিব ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব সজাগ ছিলেন না, তাঁদের ভ্রান্ত ধারণার নিরসনকল্পে এই সব বিবৃতির উল্লেখ করা যায়। দেশে যে একটি ব্যাপক গণহত্যার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর একাধিক ভাষণে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬০
তার পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এই সময়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং সমগ্র ঘটনাপঞ্জী এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। এই সময়ের পরিস্থিতি কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের চোখে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে। একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক এ সম্পর্কে কি বলেন আমার নিজস্ব বঙ্গানুবাদ থেকে তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছিঃ …“লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আকস্মিকভাবে বরখাস্তকৃত গভর্নর আহসানের কাছ থেকে প্রদেশের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য ঢাকায় আগমন করে। গোলযোগ দমনের কাজে টিক্কা খানের পাকা হাত ছিল। কয়েক বছর আগে বেলুচিস্তানের বিশৃঙ্খলা দমনে এই লোকটি যে ভাবে কঠোর হস্ত ব্যবহার করেছিল, তার জন্য সে ইতিপূর্বে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে আখ্যায়িত হয়েছিল। এখন তাকে পূর্ব বাংলায় সেই একই কাজ করার জন্য বলা হয়েছে এবং বিনা বাধায় এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তার উপর একই সঙ্গে প্রদেশের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে।
যা হোক, টিক্কা খানের উপস্থিতির ফলে সরকারের অনু্কূলে পরিস্থিতির কোন উন্নতিই লক্ষিত হ’ল না। বরং অবস্থার আরো অবনতি ঘটল। বাঙালীদের আইন অমান্য আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে উঠল।
সরকারী পরোয়ানা প্রদেশের প্রায় সর্বত্র, বিশেষ ক’রে সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল ঢাকায় কার্যকর হয় নি। সরকারী অফিসগুলোতে ও অন্যান্য ভবনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার স্থলে কালো পতাকা উত্তোলিত হ’ল। শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তে বাংলাদেশের স্তুতিগান প্রচারিত হতে লাগলো। এ সমস্ত সরকারী অফিসের কর্মচারিগণ প্রকাশ্যভাবে তাঁদের উর্ধ্বতন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের অবাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগ নেতার আদেশ পালন করতে লাগলেন। প্রত্যহ ঢাকায় হরতাল শেষ হওয়ার পর অপরাহ্ন দু’টায় স্টেডিয়ামে ও অন্যান্য স্থানে সভা অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। এ সমস্ত সভায় ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাগণ বক্তৃতা করতেন। তাঁরা বক্তৃতামঞ্চ থেকে শেখ মুজিবের আদেশাবলীর ঘোষক হিসেবে কাজ করলেন। এক সুযোগে ৩৪১ জন কয়েদী আকস্মিকভাবে ঢাকা জেল থেকে পালিয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬১
এসে স্টেডিয়ামের সভায় যোগদান করে। পরে কর্তৃপক্ষের অসহায় দৃষ্টির সম্মুখেই ধৃষ্টতার সঙ্গে কয়েদখানার উর্দি পরিহিত অবস্থায় তারা রাস্তায় প্রদক্ষিণরত শোভাযাত্রায় সামিল হয়।
আন্দোলনের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা দাবীর ব্যাপকতাও বেড়ে চলল। শীঘ্রই সকলের দৃষ্টি ঢাকা ঘোড়দৌড় ময়দানের দিকে নিবদ্ধ হ’ল, যেখানে ৭ই মার্চ তারিখে শেখ মুজিব স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করবেন বলে সবাই আশা করেছিল।
নিঃসন্দেহে এমন একটা সঙ্কটকাল এগিয়ে এলো, যা ছিল সমস্ত প্রত্যাশার অতীত। প্রেসিডেন্ট দ্রুত কঠোর কর্মব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। যে ক্ষেত্রে এককালে পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক বিস্ফোরণ দমন এবং এর ঊর্ধ্ব নেতৃবৃন্দকে শক্তি দেখিয়ে সহজে বশীভূত করা, সে ক্ষেত্রে এখনকার উদ্দেশ্য হবে নির্মমভাবে বিদ্রোহের মূলোৎপাটন করা। রাজনৈতিক বিকল্প ব্যবস্থার কথা প্রেসিডেন্টের মনকে অযথা ভারাক্রান্ত করে নি। রাজনৈতিক বিকল্প ব্যবস্থাগুলোতে জড়িত ছিল বিনা সংগ্রামে পরাজয় স্বীকারজনিত মনোভাবের গন্ধ এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে পশ্চাদপসরণের উপায় ছিল না।
গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আরেকবার তাঁকে জোরের সঙ্গে সমর্থন জানালেন। অকুস্থল ঢাকায় যে লোকটি ছিল, সেই টিক্কা খানের কাছ থেকে উৎসাহ পাওয়া গেল। ‘আমাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সামরিক বাহিনীর লোক ও রণসম্ভার দেওয়া হ’লে আমি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাঙালীদেরকে ঠাণ্ডা ক’রে দেব।’ প্রেসিডেন্ট এই যুক্তিতে কোন ত্রুটি দেখতে পেলেন না। এ কথা প্রেসিডেন্টের ধারণার অতীত ছিল যে, বাঙালীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মরণ ছোবলকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ হবে। তাই তাদের ভাগ্যে রয়েছে মৃত্যু। ঘটনার পরিণতি যাই হোক, সেনাবাহিনীকে তার নিজের অধিকার বজায় রাখতেই হবে। পূর্ব বাংলার মানুষকে আচ্ছা ক’রে শিক্ষা দিতেই হবে।
ইয়াহিয়া খান কি করবেন তা’ ৫ই মার্চের অপরাহ্নে তাঁর মনে হয়েছিল। তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের কৌশল হবে প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তির যোগান দেওয়া, প্রস্তুতির জন্য সময় নেওয়া এবং যথোপযুক্ত মুহূর্তে মরণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬২
আঘাত হানা। সেই অনুসারে তিনি আকাশ-পথে ব্যাপকভাবে সমরোপকরণ পাঠাবার আদেশ দিলেন। সম্ভাব্য যুদ্ধ আইন আদেশ বলবৎ করা হ’ল। পরদিন তিনি বেতারে ঘোষণাও করলেন যে, যেহেতু পরিষদের অধিবেশন মুলতবী সম্পর্কে ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হাঙ্গামাকারী শক্তিগুলোর সমবেত চীৎকারে পরিণত হয়েছে, সেহেতু প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে তিনি এই দুর্ভাগ্যজনক অচলাবস্থার মীমাংসা করাকে তাঁর অপরিহার্য কর্তব্য বলে মনে করেন এবং ২৫শে মার্চকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের নতুন তারিখ রূপে নির্ধারিত করেন।
স্পষ্টতঃ ইয়াহিয়া খান কেবল ঘোড়দৌড় ময়দানে সভার প্রাক্কালে শেখ মুজিবের অস্ত্রকে ভোতা ক’রে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন বলে সবাই আশা করেছিল। এটা ছিল সুপরিকল্পিত জুয়াখেলা। অন্ততঃ এই সময়ে তিনি হিসাবে ভুল করেন নি।
মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কিং কমিটি এবং এই দলের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ ফাঁদে আটকা পড়লেন। ঘোড়দৌড় ময়দানের সভায় সম্মিলিত জনগণের অনেককে হতাশ ক’রে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা স্পষ্টতঃ ঘোষিত হয় নি। তার পরিবর্তে শেখ মুজিব ‘স্বাধিকার অর্জন’-এর জন্য আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম-মুক্তির সংগ্রাম’ এবং ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই আন্দোলন ইয়াহিয়া খানের শাসন-ব্যবস্থার কাছে যতই ধ্বংসাত্মক ও অপ্রীতিকর মনে হোক না কেন, এটা পূর্ব বাংলার সামরিক প্রস্তুতির জন্য আকাঙ্ক্ষিত সময় দিয়েছিল।
জনগণের একজন বিপ্লবী নেতা হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রধান যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তার প্রতি তাঁর আস্থা থাকলে তিনি টিক্কা খানের আত্মসমর্পণের দাবী ক’রে তাঁকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য দৃঢ় মনোভাবাপন্ন লাখ লাখ বাঙালীকে চার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনানিবাসে পাঠাতেন। বাঙালীরা তা’ করার জন্য প্রস্তত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য সানন্দে কয়েকশো লোক জীবন বিসর্জন দিত। তখন ন্যূনতম রক্তপাতে বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ লাভ করত-
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৩
পরবর্তীকালে কিছুতেই লাখ লাখ লোক নিহত হত না এবং সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে অগণিত লোক দেশত্যাগ করত না।”
[ বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃঃ ১০৯-১১৩]
ম্যাসকারেনহাস আরো বলেছেনঃ “৩রা ও ২৫শে মার্চের মধ্যে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত বাঙালী সদস্যগণ পৃথকভাবে তিনবার শেখ মুজিবের নির্দেশ লাভের জন্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কেননা যা ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁদের কোন সংশয় ছিল না। প্রতিবারই শেখ মুজিব তাঁদের সঙ্গে সময়োচিত ব্যবহার করেছেন কিংবা মামুলি কথা শুনিয়ে বিদায় ক’রে দিয়েছেন। আমার তো মনে হয় না, এই সাহসী ও আত্মত্যাগকারী লোকগুলো, যারা এখন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করছেন, কখনও এই অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাবেন। রাজনীতিবিদগণ যতই তাঁদের পেছনের দিকে চলুন না কেন, এই লোকগুলো এবং তাঁদের মত সাহসী যে সব ছাত্র তাঁদের পাশে থেকে সংগ্রাম ক’রে যাচ্ছেন তাঁরা বাংলাদেশের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রকৃত বীর হিসাবে পরিচিত হবেন এবং পরিশেষে তাঁরাই নতুন প্রজাতন্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক হবেন।”
[ বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃঃ ১১৪]
৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ম্যাসকারেনহাস বলেছেনঃ “এবার এই মার্চের কথায় ফিরে আসা যাক। সেদিনকার ময়দানের সভায় বাঙালীদের সংগ্রামের একটি নাটকীয় মোড় লক্ষিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জনগণ যা আশা করেছিল তা’ হয় নি। শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বায়ত্ত্বশাসন’ অর্জনের পথে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি কর্মসূচী দেওয়ার ওয়াদা করেন। কিন্তু সভায় সমবেত দশ লক্ষাধিক লোক শুনতে চেয়েছিল আর কিছু-স্বাধীনতার ঘোষণা। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা পূর্ব বাংলা ক্রোধে ফেটে পড়ছিল। ঢাকায় এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, বাঙালীরা পরিস্থিতির এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে; যেখানে থেকে আর ফিরে আসা যায় না। ছাত্রনেতাগণ, যারা ছিলেন বাস্তব পরিস্থিতির প্রতি স্পন্দনশীল, প্রকাশ্যভাবে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারকার্য চালালেন। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত এবং অবশিষ্ট সকলের সঙ্গে সামিল হওয়ার জন্য চরমপত্র দিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে জনসাধারণ ঘোড়দৌড় ময়দানে সমবেত হয় এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৪
তাদের দৃঢ় সংকল্পের অবলম্বনরূপে তারা তাদের সঙ্গে শর্টগান, তরবারি, ঘরের-তৈরী বর্শা, বাঁশের লাঠি প্রভৃতি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। মাঠে একটি পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর একটি লোকও দেখা যায় নি।
সেনাদলের উপস্থিতির একটি মাত্র সাক্ষ্য দেখা গিয়েছিল, একটি সবুজ পিঙ্গল বর্ণের হেলিকপ্টার, যা গাছের উপর দিয়ে অবিরামভাবে উড়ছিল। সেনাবাহিনীর আবির্ভাব কিছু লোককে বিচলিত করতে পারে এই আশায় হেলিকপ্টারটি উড়লেও জনগণকে মোটেই বিচলিত হতে দেখা যায় নি। সম্ভবতঃ সেদিনের জন্য একবার হেলিকপ্টারটির আরোহীরা জনগণের চেয়ে অধিক ভীত হয়ে পড়েছিল। নিরাপদ দূরত্ব থেকে সেদিন জনসমুদ্রে যে দৃঢ় প্রতিবাদ তারা স্বচক্ষে দেখেছিল, তা’ তাদের মারাত্মক দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিল। যদি এই জন সমুদ্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান করত, তা’ হলে ট্যাঙ্ক কিংবা কামান-বন্দুক নিয়ে তাদেরকে স্তব্ধ করা সম্ভব হ’ত না। এই বিপদের কথা টিক্কা খানকে জানানো হয়। হেলিকপ্টারটির আবির্ভাবের কারণ ছিল তাই।
ময়দানে সমবেত জনসমুদ্রের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সভামঞ্চের উপর, যেখানে যে কোন মুহূর্তে শেখ মুজিবের উপস্থিতি আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’, যাকে সবাই আদরের সাথে এ নামে ডেকে থাকে, সভায় উপস্থিত হতে বিলম্ব করছিলেন।
সভায় দাঁড়িয়ে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে ৪-দফা দাবী পেশ করবেন এবং প্রদেশব্যাপী ‘অহিংস আন্দোলনের’ নেতৃত্ব দান করবেন, যা নিশ্চিতভাবে বাঙালীদের দৃঢ় সংকল্পের কথা প্রকাশ করবে। এই চার দফা দাবী হ’লঃ
(১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(২) সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোককে অবিলম্বে ছাউনিতে ফেরত নিয়ে যেতে হবে।
(৩) জীবনহানির তদন্ত করতে হবে এবং
(৪) অবিলম্বে অর্থাৎ ২৫শে মার্চ পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। দাবীগুলো ছিল আপোষ জাতীয়। এগুলোর লক্ষ্য অপরিবর্তনীয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৫
থাকবে—যেমন, জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সেনাবাহিনী প্রত্যাহার—কিন্তু এর পদ্ধতি হবে অহিংস।
অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে শেখ মুজিবের বিশ্বাসের কারণ, তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে, তাঁর হাতে জনগণের ক্ষমতারূপ শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। তাঁর ভুল ছিল এই যে, তিনি প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায়কে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন নি এবং সেইজন্যই তিনি সেই চরম অস্ত্রের সবচেয়ে বাস্তব ব্যবহার করতে সাময়িকভাবে সফল হন নি।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি শেখ মুজিবের পরিকল্পনাকে অনুমোদন করতে দ্বিধা করেন নি। স্পষ্টতঃ এই ব্যবস্থা আরেকটি মধ্যপন্থা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বাইরে অপেক্ষমান ছাত্রনেতাগণ এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে স্পষ্টতঃ নিরুৎসাহ হয়ে পড়লেন। ঘোড়দৌড় ময়দানে যাওয়ার আগে শেখ মুজিব তাঁদের শান্ত করতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে কোন ফল হয় নি।
শেখ মুজিব একজন শক্তিশালী বক্তা। সেদিন ঘোড়দৌড় ময়দানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি সব কিছুই ব্যবহার করেছেন—যথার্থ শব্দ, প্রজ্ঞা এবং বজ্রধ্বনি। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তার সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশার মিল ছিল না। বক্তৃতার সময় যদিও তারা মাঝে মাঝে করতালি দিচ্ছিল এবং যথার্থ স্থানে প্রশংসাধ্বনি উচ্চারণ করছিল, তথাপি একথা স্পষ্ট যে, তিনি জনগণের কাছ থেকে দূরেই রয়ে গেলেন। জনগণের যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা’ নিশ্চয়ই ঘটনার উপযোগী হয়নি। পূর্ব থেকে সুচিন্তিত বক্তৃতা শেষ করার পর তিনি কিছুক্ষণের জন্য নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং বিরাট জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এর হতাশার ভাব উপলদ্ধি করলেন। তখন তিনি আবার বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন। তিনি তার দৃষ্টি উত্তোলন ক’রে সর্বোচ্চ কণ্ঠে বললেনঃ “আমাদের এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা যে জন্য এসেছিল, তা’ তারা পায় নি; কিন্তু শেখ মুজিব তো মুক্তি এবং স্বাধীনতার কথা বলেছেন। এই মনোভাব নিয়েই তারা ময়দান থেকে চলে গেল এবং আওয়ামী লীগের আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচীতে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার সঙ্কল্প গ্রহণ করল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৬
পরদিন সেনাবাহিনীর ছাউনিগুলো ছাড়া পূর্ব বাংলার সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে গেল, ‘জনগণের শাসন প্রবর্তিত হ’ল। জনগণ ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক রাজস্ব বিভাগে কর পরিশোধ করা বন্ধ করে দিল। ৩রা মার্চে প্রদত্ত শেখ মুজিবের নির্দেশে বাঙালী মালিকানাধীন দুটি ব্যাঙ্কে যাবতীয় অর্থ জমা হতে লাগল। তখন সরকারী কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রতি অবাধ্যতা লক্ষণীয়ভাবে বিস্তার লাভ করল। এই ব্যাপারে বাঙালীরা ছিল পুরোমাত্রায় শৃঙ্খলাবদ্ধ ও উৎসর্গীকৃত; প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশু কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করাকে ব্যক্তিগত সম্মানের প্রশ্ন হিসেবে ধরে নিয়েছিল এবং অত্যন্ত যত্নের সাথে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলী পালন করছিল। এ জাতীয় শান্তিপূর্ণ আইন অমান্যের দৃশ্য আর কখন দেখা যায় নি। এ কারণেই অহিংস আন্দোলনের আজীবন ভক্ত খান ওয়ালী খান বলেছেন, … … … … এমনকি গান্ধীও অভিভূত হতেন।”
[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৫-১১৯]
৭ই মার্চের ঘটনাবলী ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে মন্তব্য ক’রে ম্যাসকারেনহাস পরবর্তী কালের, বিশেষ ক’রে ৮ই মার্চের ঘটনাবলীরও একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেনঃ
“৮ই মার্চ তারিখে যখন এই সমস্ত নির্দেশ পালিত হয়, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে দারুণ ভীতি দেখা দিল। করাচীর স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার; বিশেষ ক’রে যে সমস্ত কোম্পানির ভিত্তিকেন্দ্র পূর্ব বাংলায় অবস্থিত ছিল, সেগুলোর কাগজপত্রের মূল্য দ্রুতগতিতে নেমে এল। প্রধান শেঠেরা (ব্যবসায়ী মোগলেরা) কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিলেন—তারা কি তাদের মিলগুলো দেখাশোনার জন্য তাদের লোক পাঠিয়ে বিপদের মুখে ফেলবেন, নাকি পরিস্থিতির উন্নতির আশায় করাচীতেই অপেক্ষা করবেন। মাত্র দু’একজন লোক সাময়িকভাবে পূর্ব বাংলায় গেলেন। বাকী সবই করাচীতে রয়ে গেলেন এবং রাওয়ালপিণ্ডির সরকারকে ‘তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার’ জন্য আবেদন ও বিরক্ত করতে লাগলেন।
সরকারী অফিস ও ব্যাঙ্কের প্রতি ‘নির্দেশাবলী’ বোধগম্যভাবেই জনসাধারণের জন্য খুব অসুবিধার কারণ হ’ল এবং খাদ্যদ্রব্য ও অতি
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৭
প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হ’ল। প্রাদেশিক অর্থনীতির পক্ষে যা অপরিহার্য, সেই রপ্তানী বন্ধ হয়ে গেল। তাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা তাজউদ্দিন আহমদ জনসাধারণের অসুবিধা দূর করবার জন্য এবং পূর্ব বাংলার অর্থনীতির ক্ষতিরোধ করার জন্য কতিপয় ‘ব্যাখ্যা’ ও ‘অব্যাহতির’ কথা প্রচার করেন। তাজউদ্দিনের ‘ব্যাখ্যা’ ও ‘অব্যাহতিকে’ বাইবেলের বাণীর মত পবিত্র বলে মনে করা হ’ল।
এ সমস্ত কর্মসূচীর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পূর্ব-বাংলার একটি সমান্তরাল আওয়ামী লীগ সরকার চালু হয়ে গেল। পাকিস্তানে এমন ঘটনা আর কখনও দেখা যায় নি।”
[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২০-১২১]
আমার অনুদিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা’র ভূমিকায় আমি বলেছি যে, ম্যাসকারেনহাসের অনেক অভিমতের সাথেই আমরা একমত হতে পারি না, যদিও বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে প্রথম ব্যাপক বর্ণনা তুলে ধরে তিনি বিশ্বে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাঁর প্রথম প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ ও পরবর্তীকালে ‘The Rape of Bangladesh’ গ্রন্থটি বিশ্বের জনমত গঠনে ব্যাপক সাহায্য করেছিল। তিনি মনে করেন যে, এই মার্চে শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা ঘোষণা ক’রে টিক্কা খানকে আবদ্ধ করতেন তা’ হ’লে তখনই দেশ স্বাধীন হয়ে যেত এবং পরবর্তীকালে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনাবসান হোত না। তাঁর এই মত সমর্থন করা যায় না। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ লোক গভর্নরের বাসভবন আক্রমণ ক’রে হয়ত দখল ক’রে নিতে পারতো—কিন্তু তার পরিণতি হোত ভয়াবহ। সাথে সাথেই কয়েক ডিভিশন সৈন্য, যারা ঢাকা ক্যান্টনমেটে অপেক্ষা করছিল, তারা নিশ্চয়ই চুপ ক’রে বসে থাকতো না। তারা আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শেখ মুজিব ও অপর একটি নেতাকেও রেহাই দিত না। নেতৃস্থানীয় প্রত্যেকটি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার পূর্বেই একেবারে নির্মূল করে দিত। প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারী সমগ্র নেতা ও ছাত্রনেতাদের সেনাবাহিনী ন্যায়সঙ্গতভাবেই হত্যা করবার একটি অজুহাত পেত। বিশ্ববিবেক
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৮
এতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চলে যেত এবং ভারতের পক্ষেও তখন প্রকাশ্যে দ্রুত এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে অসুবিধা হোত। মনে রাখতে হবে যে, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন, প্রশিক্ষণ দান করেছেন—কিন্তু সবই ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়েছে। ৭ই মার্চে প্রকাশ্য যুদ্ধ আরম্ভ হ’লে ভারত সাথে সাথেই আমাদের জন্য যুদ্ধে নামতে পারতেন না—আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম ব্যাহত হোত। ৩রা ডিসেম্বরে (’৭১) ভারত যে যুদ্ধে নেমেছিলেন, সেতো আত্মরক্ষার জন্য, আক্রমণের জন্য নয়। পাকিস্তানই প্রথম আক্রমণ করেছিল, —আগ্রা, শাম্বালা, অমৃতসর প্রভৃতি স্থানে বিমান আক্রমণ শুরু করেছিল। সুতরাং, ৭ই মার্চ যুদ্ধ ঘোষণা করলে অবস্থা যা হয়েছিল তার চেয়ে ভয়াবহ হোত এবং স্বাধীনতা আদৌ সম্ভব হোত কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ উত্থাপন করা যায়।
এ কথা ঠিক যে, ছাত্র-সমাজ ও জনগণের এক বিরাট অংশ যুদ্ধ ঘোষণাই আশা করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব এমন একজন নেতা যিনি জনগণের কল্যাণেই জনগণকে পথনির্দেশ দিতে পারেন। ৭ই মার্চে তিনি তা’ দিয়েছিলেন। তিনি শান্তির পথটিকে শেষ অবধি পরীক্ষা করেছেন—যখন অপর পক্ষ চরম আঘাত হেনেছে তখন কেবল তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে ঠিক যথোচিত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। অন্যরূপ করলে ইতিহাস অন্যরূপ হোত—স্বাধীনতা সম্ভব নাও হ’তে পারত।
তা’ ছাড়া ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু একেবারেই যুদ্ধ ঘোষণা করেন নি একথা ঠিক নয়। তিনি সুপরিপক্ক রাজনীতিবিদের ন্যায় এমনভাবে ঘোষণাটি করলেন যে, শাসকপক্ষ বুঝতে পারলো যে এ ঘোষণা সংগ্রামের ঘোষণা, যুদ্ধের নয়—অন্যপক্ষে জনগণ ঠিকই বুঝলেন যে, এ ঘোষণায় যুদ্ধেরই আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন যে, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে—ওদেরকে ভাতে মারতে হবে; পানিতে মারতে হবে—এবং এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বস্তুতঃ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ-এর বক্তৃতা, মনে হয়, এক ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবজাত বক্তৃতা। এমন যথাযথ, সংযত, শাণিত এবং প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৬৯
৪-দফার প্রতি সমর্থন
শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ঘোষণা বাংলাদেশের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং জনগণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মোতাবেক অবিলম্বে ৪-দফা মেনে নেবার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবী জানাতে থাকেন। অসহযোগ আন্দোলনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে চলে। প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণই সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেখ মুজিবের নির্দেশেই বাংলাদেশের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কাজ সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকে।
সম্পর্কের শেষ সংযোগ
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান তখন ঢাকায় ছিলেন। তিনি সব প্রত্যক্ষ করছেন। দূরদর্শী নেতা এ-সত্যও অনুধাবন করতে পারলেন যে, পাকিস্থানের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা শেষ ক’রে ১১ই মার্চ করাচীতে ফিরে গিয়ে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর সে আশঙ্কার কথা প্রকাশ না ক’রে পারলেন না। তিনি বললেন, “পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত ক্ষীয়মান সম্পর্কের শেষ সংযোগ হচ্ছেন শেখ মুজিব। জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১২ই মার্চ, ১৯৭১]
১৩ তারিখে ভাসানী রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য জেল ভাঙার আন্দোলনের ডাক দেন। অপর দিকে এক ঘোষণায় শেখ মুজিব জানান যে, ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে তিনি তাঁর সাথে আলোচনায় বসতে রাজী আছেন।
নতুন সামরিক আদেশ জারী
ঐ দিন ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক এক সামরিক আদেশ জারী করেন—যাতে বলা হয়ঃ “যে সকল কর্মচারী প্রতিরক্ষা খাত হইতে বেতন পাইয়া থাকেন তাঁহাদের সোমবার হইতে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে। অন্যথায় তাঁহাদের চাকরী হইতে বরখাস্ত করা হইতে পারে। যে সকল বেসামরিক কর্মচারী প্রতিরক্ষা খাত হইতে বেতন পাইয়া থাকেন, তাঁহাদের ১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ বেলা ১০ টায় নিজ নিজ বিভাগের কাজে যোগদান করিতে হইবে। যদি কোন ব্যক্তি উপরোক্ত সময়ে তাঁহাদের কর্মস্থলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭০
যোগদান করিতে না পারেন তবে তাঁহাদের চাকরী হইতে বরখাস্ত ও পলাতক বলিয়া গণ্য করা হইবে। সামরিক আইনের ২৫ নং বিধি অনুসারে এই নির্দেশ অমান্যকারীদের ১০ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হইতে পারে।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ মার্চ, ১৯৭১]
নতুন সামরিক আদেশ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব
এই আইন আদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, এটা সম্পূর্ণ উস্কানীমূলক। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, “যেক্ষেত্রে আমরা জনগণের পক্ষ হইতে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী জানাইতেছি, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের আদেশ জারী জনগণকে উস্কানী দান ছাড়া আর কিছুই নহে। বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি এ ধরনের উস্কানীমূলক তৎপরতা হইতে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ মার্চ, ১৯৭১]
মুজিব-ওয়ালী আলোচনা
মার্চের ১৩ তারিখেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) প্রধান জনাব ওয়ালী খান ঢাকা আগমন করেন। বিমান বন্দরে তিনি অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য শেখ মুজিবের দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পরদিন রোববার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় ৮৫ মিনিট ধরে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর জনাব ওয়ালী খান পরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তি পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবীর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে।
ভুট্টোর আবদার
একই দিনে জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক জনসভায় তাঁর মতলব প্রকাশ ক’রে ফেলেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁকে যেন ক্ষমতা ভাগাভাগি ক’রে দেয়া হয়।
এই একটি মাত্র উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই আসলে জনাব ভুট্টো এতদিনে ধরে পাঁয়তারা করছিলেন। অধিবেশন বর্জনের হুমকি দিয়ে শত শত লোকের প্রাণহানির কারণ সৃষ্টি করেছিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭১
শেখ মুজিবের বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ
পরদিন ১৫ই মার্চ। ঐ দিন বাংলার জনগণ ও প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের দাবীতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। এক ঘোষণায় তিনি বলেন যে, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের কল্যাণের জন্যই তাঁকে এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে দেশবাসীকে জানান যে, ‘এই শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জনগণ যেন তা’ রক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকে।’ এক বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না। কারণ, প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণ বরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার সাথে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আমি জনগণকে যে কোন ত্যাগের জন্য এবং সম্ভাব্য সব কিছু নিয়ে যে কোন শক্তির মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাই।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৫ই মার্চ, ১৯৭১]
বঙ্গবন্ধু দেশের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি জারী করেন। এই বিধিগুলো হ’লঃ
১নং নির্দেশঃ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধা সরকারী অফিসসমূহ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহ, হাইকোর্ট ও সমগ্র বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। নিচে যে বিশেষ নির্দেশাবলী হরতালের আওতামুক্ত তার ব্যাখ্যা প্রদান করা হ’ল, তার এবং বিভিন্ন সময়ে যে সব নির্দেশাবলী ও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই হরতাল পালন করতে হবে।
২নং নির্দেশঃ বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৩নং নির্দেশঃ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা—(ক) ডিপুটি কমিশনার ও সাবডিভিশনাল অফিসারগণ অফিস না খুলে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে, তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা’ পালন করবেন এবং উন্নয়ন কর্মসূচীসহ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭২
বর্ণিত নির্দেশাবলী বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার, সে সব দায়িত্ব পালন করবেন।
নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদেব সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করবেন ও পরিষদের সহযোগিতায় কাজ করবেন।
(খ) পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রয়োজন হ’লে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সহায়তা গ্ৰহণ করবে।
(গ) জেল ওয়ার্ডার ও জেলের অফিসসমূহে কাজ চলবে।
(ঘ) আনসার বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করে যাবে।
৪নং নির্দেশঃ বন্দরসমূহঃ (আভ্যন্তরীণ নৌ বন্দর সহ) নৌযান চলাচল অব্যাহত রাখা সহ বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল পর্যায়ে কাজ চালু রাখবে, তবে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন সব দ্রব্যাদি বা সেনাবাহিনী মোতায়েনের কাজে সহযোগিতা সম্প্রসারণ ব্যতীত জাহাজসমূহের বন্দরে ভীড়া ও বন্দর ছাড়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন,—বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসের শুধুমাত্র তেমন বিভাগই চালু থাকবে। সকল জাহাজ বিশেষ ক’রে বাংলাদেশের জনগণের জন্য যে সকল জাহাজ, খাদ্যশস্য বহন ক’রে আনছে, সে সব দ্রুত খালাস করতে সার্বিক চেষ্টা রাখতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের ন্যায্য পাওনা ও মাল খালাস চার্জ করবে। আভ্যন্তরীণ নৌ-বন্দরসমূহও অপরাপর চার্জ আদায় করবে।
৫নং নির্দেশঃ মাল আমদানীঃ আমদানীকৃত সকল মাল খালাস করতে হবে। সকল বিভাগের প্রয়োজনীয় সেকশনসমূহ কাজ চালু রাখবে এবং নিরূপিত শুল্কের পুরা অর্থ জমা দেয়া হ’লে তার ভিত্তিতে মাল খালাসের অনুমোদন দান করবে। এতদুদ্দেশ্যে ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন লিমিটেডে শুল্ক কালেক্টর কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ একাউন্টে উক্ত অর্থ জমা দিতে হবে। শুল্ক কালেক্টর আওয়ামী লীগের নির্দেশ মোতাবেক এসব একাউন্ট পরিচালনা করবে। আওয়ামী লীগ সময়ে সময়ে এ সম্পর্কে নির্দেশ দেবে। এভাবে সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবে জমা হবে না।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৩
৬নং নির্দেশঃ রেলওয়েঃ রেলওয়ে চালু থাকবে। তবে রেলওয়ে চালু রাখার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের যে যে সেকশন খোলা থাকা দরকার কেবল মাত্র সেই সেকশনই কাজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন সব ক্ষেত্রে সৈন্য মোতায়েন কিংবা রসদ পরিবহনের কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। বন্দরসমূহ থেকে অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য পরিবহনের বেলায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ওয়াগনসমূহ বরাদ্দ করতে হবে।
৭নং নির্দেশঃ সড়ক পরিবহনঃ বাংলাদেশের সর্বত্র ই.পি.আর.টি.সি. চলাচল করবে।
৮নং নির্দেশঃ আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনঃ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর সঠিকভাবে কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় আই. ডবলিউ. টি. এ-র স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী, ই. পি. এস. সি. এবং আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কাজ করবে। কিন্তু জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এ্ররূপ বাহিনী অথবা সরঞ্জামাদি সমাবেশ করার ব্যাপারে কোনরূপ সহযোগিতা করা যাবে না।
৯নং নির্দেশঃ ডাক ও টেলিগ্রাফঃ বাংলাদেশের মধ্যে চিঠি, টেলিগ্রাম ও মানি অর্ডার পাঠানোর জন্যই কেবল ডাক ও টেলিগ্রাফ অফিস কাজ করবে। তবে সকল শ্রেণীর বিদেশী মেল সার্ভিস ও বিদেশী টেলিগ্রাফ সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রেরণ করা যেতে পারে। ২৫ নং নির্দেশে যে সমস্ত বার্তা আদান-প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্কগুলোকে কেবল সে ধরনের বার্তা টেলিপ্রিন্টারে আদানপ্রদান করতে দেওয়ার জন্য সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ঘন্টার জন্য আন্তঃ প্রাদেশিক টেলিপ্রিন্টার চ্যানেল খোলা থাকবে।
পোষ্টাল সেভিংস ব্যাঙ্ক ও জীবন বীমা চালু থাকবে।
১০নং নির্দেশঃ টেলিফোনঃ বাংলাদেশের মধ্যে কেবল স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক টেলিফোন চালু থাকবে। টেলিফোন ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সেকশনগুলো কাজ করবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৪
১১নং নির্দেশঃ বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রঃ বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র চালু থাকবে এবং এগুলোতে জনগণের আন্দোলন সংক্রান্ত সকল খবর ও বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে। অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না।
১২নং নির্দেশঃ স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন সার্ভিসেসঃ জেলা হাসপাতাল, যক্ষা ক্লিনিক ও কলেরা গবেষণা কেন্দ্র সহ সকল হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এবং স্বাস্থ্য ও সেনিটেশন সার্ভিস চালু থাকবে। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স চালু থাকবে এবং সকল হাসপাতাল, মফঃস্বল শহরের হাসপাতাল, গ্রামাঞ্চলের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঔষধপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৩ নং নির্দেশঃ বিজলী সরবরাহঃ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ সহ বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার কাজের সাথে সম্পর্কিত ইপি ওয়াপদার সমস্ত বিভাগ কাজ করবে।
১৪নং নির্দেশঃ পানি ও গ্যাসঃ গ্যাস ও পানি সরবরাহ চালু থাকবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও চালু থাকবে।
১৫নং নির্দেশঃ কয়লাঃ ইটের ভাটা এবং অন্যান্য কাজের জন্য কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৬নং নির্দেশঃ খাদ্য সরবরাহঃ খাদ্য সরববাহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাদ্যশস্যের আমদানী বন্টন, গুদামজাতকরণ ও স্থানান্তরে চালান অব্যাহত থাকবে। এ কাজের জন্য ওয়াগন, বার্জ, ট্রাক ইত্যাদি সহ সব রকম যানবাহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
১৭নং নির্দেশঃ কৃষি তৎপরতা—(ক) ধান ও পাটের বীজ, সার এবং কীটনাশক ঔষধ সংগ্রহ, চলাচল এবং বন্টন অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার, চাল গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং এগুলোর সকল প্রকল্পের কাজ চলবে।
(খ) পাওয়ার পাম্প এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের চলাচল, বন্টন, স্থাপন (ফিল্ডিং) এবং চালানোর কাজ চলবে। এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তেল, জ্বালানী, যন্ত্রপাতির সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৫
(গ) নলকূপ খনন, পরিচালনা এবং খালের সেচসহ সব রকম পানিসেচ ব্যবস্থা চালু থাকবে।
(ঘ) পূর্ব পাকিস্তান সমবায় ব্যাঙ্ক, সেন্ট্রাল সমবায় ব্যাঙ্ক ও এদের অনুমোদিত সংস্থা, থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ও অন্যান্য সব
সমবায় প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে।
(ঙ) এতদুদ্দেশ্যে ই. পি. এ. ডি. সি-র প্রয়োজনীয় সেকশন চালু থাকতে পারে।
(চ) কৃষি উন্নয়ন ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ব্যাঙ্ক কর্তৃক ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা সমূহে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান অব্যাহত থাকবে।
(ছ) গুদামে রাখার উদ্দেশ্যে গোল আলু কেনার জন্য এ. ডি. বি. পি. দ্রুত অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করবে।
১৮নং নির্দেশঃ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণঃ বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ, শহর সংরক্ষণ এবং নদী খনন ও যন্ত্রপাতি স্থাপন সহ ইপি ওয়াপদা ও অন্যান্য সংস্থার পানি উন্নয়ন কাজ, মালপত্র খালাস ও চলাচল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জরুরী কাজ সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া হবে। সরকারী সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা স্বাভাবিক নিয়মে কন্ট্রাকটরদের পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
১৯নং নির্দেশঃ উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজঃ বৈদেশিক সাহায্যে তৈরী সড়ক ও সেতু প্রকল্পসহ সরকারী স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারী সংস্থার সব উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজের বাস্তবায়ন সুচারুরূপে চলবে। সরকারী সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা যথারীতি কন্ট্রাকটরদের পাওনা মিটিয়ে দেবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল-মসলা সরবরাহের নিশ্চয়তাও বিধান করবে।
২০নং নির্দেশঃ সাহায্য ও পুনর্বাসনঃ ঘূর্ণিবাত্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ সহ সব রকম সাহায্য পুনর্বাসন ও পুনঃ নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারী সংস্থা কন্ট্রাকটরদের পাওনা যথারীতি মিটিয়ে দেবে।
২১নং নির্দেশঃ ই. পি. আই. ডি. সি., ইপসিক কারখানা ও ইস্টার্ণ রিফাইনারীঃ ই. পি. আই. ডি. সি. ও ইপসিকের সব কারখানার কাজ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৬
চলবে এবং যত বেশী সম্ভব উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এসব কারখানা চালু রাখার জন্য অর্থ সরবরাহ ও ক্রয়ের জন্য ই. পি. আই. ডি. সি. ও ইপসিকের যে সব বিভাগ খোলা রাখা দরকার হবে সে গুলোতে কাজ চলবে। ইস্টার্ন রিফাইনারী লিমিটেডেও যথারীতি কাজ চলবে।
২২নং নিদেশঃ বেতন দানঃ সরকারী ও আধা-সরকারী সংস্থার কর্মচারী ও শ্রমিক এবং প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের বেতন তা’ দৈনিক, মাসিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক যে ভিত্তিতেই দেওয়া হোক না কেন, তা’ তাদের পাওনা হ’লে সেভাবেই দিতে হবে। যে সব সরকারী কর্মচারীর বন্যা সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে এবং বকেয়া বেতন রয়েছে তা’ দিতে হবে। বেতনের বিল তৈরী ও বেতন দানের জন্য সরকারী ও আধা-সরকারী অফিসের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে কাজ চলবে।
২৩নং নির্দেশঃ পেনসনঃ সামরিক বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সহ সব পেনসন প্রাপ্তদের নির্ধারিত তারিখে পেনসন দিতে হবে
২৪নং নির্দেশঃ এজিইপি ও ট্রেজারীঃ বেতনের বিল তৈরী এবং এসব নির্দেশ অনুমোদিত লেনদেনের জন্য এজিইপি ও ট্রেজারীতে সামান্য সংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবে।
২৫নং নির্দেশঃ ব্যাঙ্ক-(ক) ব্যাঙ্কিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য বিকেল ৪টা পর্যন্ত (বিরতির সময় সহ) সব ব্যাঙ্ক খোলা থাকবে। তবে শুক্র ও শনিবার দিন ব্যাঙ্কগুলো ব্যাঙ্কিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। অনুমোদিত লেনদেনের ক্ষেত্রে বুক ব্যালেন্সিং ও সব স্বাভাবিক কাজ নিয়মিতভাবে চলবে।
(খ) নিম্নলিখিত বিধি-নিষেধ ছাড়া ব্যাঙ্কগুলো যে কোন পরিমাণ জমা গ্রহণ বাংলাদেশের ভেতর যে কোন পরিমাণ আন্তঃ ব্যাঙ্ক ক্লিয়ারেন্স, বাংলাদেশের ভেতর আন্তঃব্যাঙ্ক ট্রান্সফার এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিটি বা মেল ট্রান্সফার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ ড্র করার কাজ চালিয়ে যাবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৭
বিধি-নিষেধগুলো হচ্ছেঃ
(১) চেকের সাথে যদি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংস্থার প্রতিনিধির বা বেতন রেজিষ্ট্রারের সার্টিফিকেট থাকে তা’ হ’লে বেতন ও মজুরী পরিশোধ করা।
(২) সপ্তাহে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাফাইড ব্যক্তিগত ড্রইংস।
(৩) চিনিকল, পাটকল ইত্যাদির জন্য আঁখ ও পাট সহ শিল্পের কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য অর্থদান।
(৪) বাংলাদেশের ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় সহ যে কোন বোনাফাইড প্রয়োজনে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রদান। এই অর্থ নগদ অর্থে বা ক্যাশ ড্রাফট মারফত উঠানো যাবে। তবে উপরে উল্লিখিত ৩ ও ৪ নম্বর শর্তে কোন অর্থ দেওয়ার পূর্বে অতীত রেকর্ড দেখে ব্যাঙ্ককে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, অর্থগ্রহণকারী একজন বোনাফাইড শিল্প অথবা বাণিজ্যিক সংস্থা বা ব্যবসায়ী এবং যে পরিমাণ অর্থ উঠানো হচ্ছে তা’ গত এক বছরে সপ্তাহে গড়ে উঠানো অর্থের চেয়ে বেশী নয়।
(৫) উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে নিযুক্ত তালিকাভুক্ত কন্ট্রাক্টরদের অর্থদান। তবে যে কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার কাছ থেকে চেকে একটি সার্টিফিকেট আনতে হবে যে, যে টাকা উঠানো হচ্ছে তা’ উল্লিখিত কাজের জন্য প্রয়োজন।
(গ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন একাউন্টে ক্রস চেক ও ক্রস ডিমান্ড ড্রাফট প্রদান করা ও জমা নেয়া যাবে।
(ঘ) স্টেট ব্যাঙ্ক ও ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে অর্থপ্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠি পাঠাতে পারবে। যেসব ব্যাঙ্কের সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেগুলো ঢাকাস্থ ব্যাঙ্ক ও নাশনাল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পাওনা গ্রহণ করবে।
(ঙ) অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ের জন্য সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত আন্তঃ শাখা টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস চালু থাকবে।
(১) প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক সোমবার ও বুধবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি খবর পাঠাতে পারে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৮
(২) প্রত্যেকটি ব্যাঙ্ক অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে খবর পেতে পারে।
(চ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাঙ্ক পদ্ধতির জন্য টেলিপ্রিন্টার সার্ভিসের কাজ অব্যাহত থাকবে।
(ছ) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিল সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রস চেক বা ক্রস ড্রাফটের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করতে হবে
(জ) অনুমোদিত ডিলারের সাহায্যে ফরেন ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গানো যাবে।
(ঝ) কূটনীতিকরা অবাধে তাদের একাউন্টের কাজ পরিচালনা করতে পারবেন এবং বিদেশী নাগরিকরা বৈদেশিক একাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করতে পারবেন।
(ঞ) লকার্স পরিচালনার কাজ বন্ধ থাকবে।
(ট) স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বা অন্যকোন উপায়ে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।
(ঠ) বিদেশী রাষ্ট্র থেকে লাইসেন্সের মাধ্যমে দ্রব্যাদি আমদানীর জন্য ঋণপত্র খোলা যাবে।
(ড) পণ্য বিনিময়ের চুক্তি (যে সব দ্রব্যাদি ইতিমধ্যেই পাঠানো হয়েছে) অনুযায়ী প্রেরিত দ্রব্যাদি ছাড় করতে হবে।
(চ) ইস্টার্ন মার্কেনটাইল ব্যাঙ্ক লিমিটেড ও ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন-এর মারফত বকেয়া রফতানী বিল সংগ্রহ করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কগুলোর প্রতি পদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী কাজ পরিচালিত হবে।
২৬নং নির্দেশঃ স্টেট ব্যাঙ্ক— স্টেট ব্যাঙ্ক অন্যান্য ব্যাঙ্কের মতই কাজ করবে এবং সেখানে একই অফিস সময় চলবে। বাংলাদেশের ব্যাঙ্কিং পদ্ধতি কাজ করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও অনুরূপ ভাবে খোলা থাকবে। উল্লিখিত কাঠামো ও বিধি-নিষেধ এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ‘পি’ ফর্ম বরাদ্দ করা যেতে পারে এবং বিদেশে অবস্থানরত ছাত্র ও অন্যান্য অনুমোদিত প্রাপকের জন্য বিদেশে প্রেরণের টাকাও গৃহীত হতে পারবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৭৯
২৭নং নির্দেশঃ আমদানী ও রফতানী কন্ট্রোলারঃ বাংলাদেশের জন্য আমদানী লাইসেন্স ইস্যুকরণ ও আমদানীকৃত দ্রব্যাদি চলাচলের বিধিব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আমদানী-রফতানী কন্ট্রোলারের অফিস নিয়মিতভাবে চলবে।
২৮নং নির্দেশঃ ট্রাভেল এজেন্ট ও বিদেশী এয়ার লাইন্সঃ সব ট্রাভেল এজেন্ট অফিস ও বিদেশী বিমান পরিবহন অফিস চালু থাকতে পারে। তবে তাদেরকে বিক্রয়লদ্ধ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাঙ্কে জমা রাখতে হবে।
২৯নং নির্দেশঃ ফায়ার সার্ভিসঃ বাংলাদেশের সব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চালু থাকবে।
৩০নং নির্দেশঃ পৌরসভাঃ পৌরসভা, ময়লাবাহী ট্রাক, রাস্তায় বাতি জ্বালানো, সুইপার সার্ভিস এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যবস্থা চালু থাকবে।
৩১নং নির্দেশঃ করদান বন্ধ রাখা অভিযানঃ (ক) পুনরায় নির্দেশ দেওয়া না পর্যন্ত — (১) সব ভূমি রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে, (২) বাংলাদেশের কোথাও কোন লবণ কর আদায় করা যাবে না, (৩) বাংলাদেশের কোথাও কোন তামাক কর আদায় হবে না এবং (৪) তাঁতীরা আবগারী শুল্ক ছাড়াই বাংলার সূতা কিনবেন। মিল মালিক ও ডিলাররা তাদের কাছ থেকে কোন আবগারী শুল্ক আদায় করতে পারবে না।
(খ) এ ছাড়া প্রাদেশিক সরকারের সব কর যেমন—প্রমোদ কর, হাট-বাজার, সেতু ও পুকুরের ওপর ধার্যকৃত কর আদায় করা যাবে
এবং বাংলাদেশের সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে।
(গ) অকট্রয়সহ সব স্থানীয় কর আদায় করা যাবে।
(ঘ) কেন্দ্রীয় সরকারের সব পরোক্ষ কর যেমন—আবগারী শুল্ক কর, বিক্রয় কর এখন থেকে আদায়কারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা আদায় হবে। তবে তা’ কেন্দ্রীয় খাতে জমা করা যাবে না বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে হস্তান্তর করা যাবে না। এ সব আদায়কৃত কর ইস্টার্ন আর মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্ক বা ইস্টার্ন ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনে ‘বিশেষ একাউন্ট’ খুলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮০
জমা রাখতে হবে এবং ব্যাঙ্ক দুটিও তাদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী এগুলো গ্রহণ করবে। আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে এ নির্দেশ ও বিভিন্ন সময় তাদের প্রতি যে নির্দেশ দেওয়া হবে তা’ মানতে হবে।
(ঙ) কেন্দ্রীয় সরকারের সব প্রত্যক্ষ কর যেমন আয়কর, আদায়কর ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া না পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
৩২নং নির্দেশঃ পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন চালু থাকলে এবং পোস্টাল লাইফ ইনসুরেন্স সহ সব বীমা কোম্পানীতে কাজ চলবে।
৩৩নং নির্দেশঃ সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং দোকানপাট নিয়মিতভাবে চলবে।
৩৪নং নির্দেশঃ সব বাড়ীর উপর কালো পতাকা উড়া অব্যাহত থাকবে।
৩৫নং নির্দেশঃ সংগ্রাম পরিষদগুলো সর্বস্তরে তাদের কাজ চালু রাখবে এবং এসব নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে যাবে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ই ও ১৬ই মার্চ, ১৯৭১]
বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে অসহযোগ আন্দোলন
দেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করার পর জনসাধারণ ও সরকারী কর্মচারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করতে লাগলো। ২রা মার্চের
অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর জনসাধারণ সাময়িকভাবে বেশ কিছুটা অসুবিধায় পড়েছিল। যোগাযোগের অচলাবস্থার দরুন খাদ্যদ্রব্য ও অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর ৮ই মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলীর কতিপয় সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও ‘অব্যাহতির’ কথা প্রচারিত হওয়ার পর জন-জীবনের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে সরকারব সঙ্গে অসহযোগিতা পূর্ণোদ্যেমে চলতে থাকে। সেনাবাহিনীর লোকেরা যাতে যথাযথভাবে চলতে না পারে সে জন্য তাদের প্রতি পদক্ষেপে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছিল। তাদের খাদ্য-পানি সরবরাহের ক্ষেত্রেও বাঙালীরা অসহযোগিতা করে। এ সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা ক’রে সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস লিখেছেনঃ “……পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো চরম দুঃখ-কষ্ট ও অবমাননার শিকারে পরিণত হ’ল। স্থানীয় বাজার থেকে সেনাদলকে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে অস্বীকার করা হ’ল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮১