You dont have javascript enabled! Please enable it! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব - মযহারুল ইসলাম (Part 1) - সংগ্রামের নোটবুক

ভূমিকা

আমি যখন বর্তমান গ্রন্থটি লিখছি, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই দেশের সর্বজন বরেণ্য, শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী। জনগণ তাঁকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান আসনে বসিয়েছেন। যে গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই আদর্শের মাধ্যমেই তিনি জনগণের পক্ষা থেকে ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। এদিক থেকে তাঁর জীবনেতিহাস রচনায় ও ব্যক্তি-চরিত্রের মূল্যায়নে কোন বাধা থাকতে পারেন না, কেননা তিনি জনগণেরই একজন। আমি তাই জনগণের সামগ্রিক সংগ্রামকে সামনে রেখে সংগ্রামের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনকে ও তাঁর কালের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য ঘটনাবলীকে তথ্যের সাহায্যে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।
এদেশের কিছুসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তির মধ্যে এমন ধারণা ও প্রবণতা বিদ্যমান যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অথবা সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস-বিশ্রুত ব্যক্তিদের তথ্যমূলক জীবনকাহিনী লিখবার সময় এখনো আসে নি। আমি ইতিহাসবেত্তা নই এবং ইতিহাসবিদের স্পর্ধাও আমার নেই। কিন্তু আমি মনে করি যে, এইরূপ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ ক’রে আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে সমসাময়িক ঘটনা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে অজস্র গ্রন্থ লিখিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
ইতিহাস কোন ব্যক্তিবিশেষের কল্পনা-বিলাসের অভিব্যক্তি হতে পারে না। ইতিহাস অগ্রসর হয় তথ্যের হাত ধরে। তথ্যের সাহায্যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে বলেই ইতিহাস একটি বিজ্ঞান। তথ্য বিশ্লেষণে একজন
পৃষ্ঠা নংঃ [সাত]

আরেকজনের থেকে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন—বিশ্লেষণ-পদ্ধতি ভিন্নতর হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে নিজস্ব মনগড়া কথা বলবার কোনরূপ অবকাশ নেই।
এ-কারণেই সাম্প্রতিক কালের ইতিহাস লিখবার মত তথ্য যদি হাতে থাকে, তবে সেই তথ্যের সাহায্যে ইতিহাস রচনায় কোন বাধা থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। ইতিহাস রচনায় কিংবা ঐতিহাসিক গবেষণায় শেষ কথা বলে কিছু নেই। ইতিহাস লেখার পদ্ধতি একটি গতিশীল পদ্ধতি। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাপঞ্জী নিয়ে ইতিহাস হতে পারে, যদি তা’ তথ্যনির্ভর হয়। কিন্তু ইতিহাসের বক্তব্য কখনই চূড়ান্ত নয়। পরবর্তী ঐতিহাসিক আরো নতুন কথা বলবেন, নতুন তথ্য সন্নিবেশিত করবেন-সে সম্ভাবনা সব সময়ই ঐতিহাসিক গবেষণায় বিদ্যমান। সুতরাং, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখবার সময় এখনো আসে নি, শেখ মুজিবের জীবনী এখন লেখা ঠিক হবে না, —এইসব প্রতিক্রিয়াশীল বিরূপ মনোভাব যারা পোষণ করেন বা প্রচার করেন আমি তাঁদের সাথে একমত নই। ইতিহাস যদি একটি তথ্যনির্ভর বিজ্ঞান হয় তার বর্ণনার জন্য সময়ের পরীক্ষার হয়তো কিছুটা প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু তা’ অপরিহার্য নয়। ইতিহাসের পথ প্রশস্ত এবং উন্মুক্ত।
ইতিহাস সম্পর্কে প্রাচীন ধারণার বহুল পরিবর্তন ঘটেছে। এক সময় রাজ-রাজড়াদের কাহিনী বর্ণনাই ছিল ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু বর্তমানে ইতিহাসের প্রধান লক্ষ্যে একটি গোটা জাতি, একটি গোটা সমাজ, একটি সমগ্র দেশ। এর সাথে মিলিত হয় অপর জাতি, সমাজ বা দেশের আপেক্ষিক ও তুলনামূলক একটি বিশ্লেষণ । একই পরিস্থিতিতে অপর দেশে যা ঘটেছে, তার দৃষ্টান্ত সম্মুখে রেখে বর্ণনীয় কাহিনীর মূল্যায়ন ইতিহাসের একটি মৌল লক্ষ্য। কেননা, ইতিহাস ঘটনার চলমান জীবন্ত ছবি এবং তা’ অত্যন্ত সবাক। একই পরিস্থিতিতে ও ঘটনাবর্তে এক দেশে যা ঘটে, অন্য দেশেও অনুরূপ পরিস্থিতি ও ঘটনাবর্তে তা’ ঘটতে পারে এবং কখনো কখনো ঘটে থাকে। আবার ব্যতিক্রমও যে না
পৃষ্ঠা নংঃ [আট]
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পদত্ত বইয়ে আট নম্বর পৃষ্ঠার পরে দশ নং পৃষ্ঠা রয়েছে। ৯ নং পৃষ্ঠা মিসিং থাকার দরুন উক্ত পৃষ্ঠাটি এখানে দেওয়া সম্ভবপর হলো না।
তাঁর জীবনেতিহাস বর্ণনা করতে হ’লে, তাঁর জননী জন্মভূমি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, প্রতিবেশ, সমাজ, ঐতিহ্য সবই সামনে ও পেছনে এসে ভিড় করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বর্তমান গ্রন্থে আমি আমার বক্তব্য পেশ করবার চেষ্টা করেছি। আমার গ্রন্থের সর্বত্র সেই প্রয়াস ছড়িয়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আমি তথ্যকেই বড় ক’রে দেখাবার চেষ্টা করেছি, কল্পনা বা ভাবাবেগকে নয়। আর সেই তথ্য যেমন বঙ্গবন্ধুর জীবনকে প্রতিফলিত করেছে সত্যালোকে, তেমনি সেই তথ্যের ঔজ্জ্বল্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাস ও শেখ মুজিব দুটো অবিচ্ছিন্ন সত্তা। একটিকে ছাড়া অপরটি অসম্পূর্ণ।
এমন একটি গ্রন্থ রচনার কাজ যে সহজসাধ্য নয়, তা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।
স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমী ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, এই দুটো অসম প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় ক’রে বাংলা একাডেমী নামে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবার ও সেই প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলবার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হয়। ফলে আমাকে কঠোর পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠানটির গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়। সেই কাজের ফাঁকে সবটুকু সময় আমি এই গ্রন্থ রচনার পশ্চাতে ব্যয় করেছি। আমি যখন পশ্চিম বাংলার জলংগীতে সীমান্ত-যুদ্ধ-শিবিরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংগঠনিক কর্মে লিপ্ত ছিলাম, তখনই এই গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বহুবিধ কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আমি যে এমন একটি গ্রন্থ লিখবার দুরূহ কর্ম সম্পাদন করতে সমর্থ হয়েছি এবং সেই গ্রন্থ যে আজ পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি, সেজন্য আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে এযাবত বেশ কিছু সংখ্যক গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। কিন্তু সব গ্রন্থ নির্ভরশীল, একথা বলতে পারি না। আমি মূলতঃ পত্র-পত্রিকা এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত কিছু গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এছাড়া, বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সুদীর্ঘ
পৃষ্ঠা নংঃ [দশ]

ব্যক্তিগত পরিচয় আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। কঠোর ব্যস্ততার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু আমাকে যে কয়েকটি অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার দান করছেন তার মূল্য এই গ্রন্থ রচনার পশ্চাতে অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কোন বিশিষ্ট অনুরাগী আমাকে সাক্ষাৎকার দান ক’রে বাধিত করেছেন।
আমি গ্রন্থটিকে তথ্যনিষ্ঠ ও গবেষণামূলক ক’রে তুলবার চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধুর জীবন ঘটনাবহুল। আমি সেই ঘটনাগুলোকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছি এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ক’রে ঘটনাপঞ্জী সাজানোর দিকে দৃষ্টি রেখেছি। যেখানেই প্রয়োজন, আমি ঘটনার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছি—তথ্যনিষ্ঠ বলেই এই মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ সত্যসন্ধ বলে আমি দাবী করতে পারি। সবাই আমার সাথে একমত হবেন, এমন আশা করি না —তবে আমি নিজে যে সত্যানুসন্ধানে আন্তরিক হতে চেষ্টা করেছি, সেই আত্মবিশ্বাসই আমার একমাত্র শক্তি। কি তথ্য পরিবেশনায়, কি মূল্যায়নে, সর্বত্রই আমি ইতিহাস-বিজ্ঞানের বস্তুগত ও যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গী অনুসরণে যত্নবান হবার চেষ্টা করেছি। কতটা সফল হয়েছি, সে বিচার পাঠকের হাতে। তবে একথা সবিনয়ে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু অথবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে এযাবতকাল প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে আমার এই গ্রন্থ নির্ভরযোগ্যতায়, ব্যাপক তথ্য পরিবেশনায় এবং অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে বিশিষ্টতার দাবী করতে পারে।
আমার আশঙ্কা হয়, আমার কোন কোন বন্ধু বইটির মলাট দেখেই অথবা নাম শুনেই মন্তব্য করতে পারেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মনোরঞ্জনের জন্যই আমি এই গ্রন্থ রচনা করেছি। তাঁদেরকে একবার গ্রন্থটি অভিনিবেশ সহকারে পড়তে অনুরোধ করবো। তারপরও যদি নিজের নির্মল বিবেককে সাক্ষী রেখে তাঁরা এমন মন্তব্য করেন, তবে আমার বলবার কিছু থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনই স্বার্থের দ্বারা আচ্ছন্ন নয়। আসলে বঙ্গবন্ধুর একটি তথ্যনিষ্ঠ জীবনী রচনার গুরুদায়িত্বকে আমি পবিত্র জাতীয়-কর্তব্য বলে মনে করেই এই কাজে ব্রতী হয়েছিলাম। আমার এই দায়িত্ব পালনে আমি কতটা আন্তরিক ও পরিশ্রমী এবং কতটা নিষ্ঠাসম্পন্ন ও তথ্য-জিজ্ঞাসু হতে পেরেছি, তার মূল্যায়ন নিরপেক্ষ সমালোচনার কষ্ঠিপাথরে যাচাই হবে বলে আমি আশা রাখি।
পৃষ্ঠা নংঃ [এগার]

বঙ্গবন্ধুর জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র, তাঁর সংগ্রামী জীবনের সামগ্রিক আলেখ্য, ব্যক্তি-চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং জীবন-দর্শনের মৌলকতা সবই আমি যথাযথ তথ্যের সাহায্যে এই গ্রন্থে তুলে ধরতে যত্নবান হয়েছি। অভ্রান্ত ও সঠিক তথ্য পরিবেশনাই আমার আন্তরিক লক্ষ্য অর্জনে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। প্রায় তিনটি দশক যাবত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কিত সামগ্রিক ঘটনাবলীতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা এতই প্রবল ও ব্যাপক যে তাঁর সমগ্র জীবনালেখ্য বর্ণনায়, তথ্যগত ত্রুটি কিংবা কোন কোন তথ্যের বিচ্যুতি, আমার আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও হয়তো বা কোথাও ঘটে থাকতে পারে —সেটা অস্বাভাবিক নয়। তেমন ত্রুটি-বিচ্যুতি অথবা অনুল্লেখন, যদিও বা কোথাও আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে হয়ে থাকে, সুধী পাঠক তা’ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আমি আশা করি । কোন সহৃদয় তথ্য-সচেতন ব্যক্তি এ-ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করলে আমি বাধিত হব।
আমার এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির অনুলিপিতে সাহায্য করেছে আমার কয়েকজন স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্র। তাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান, মঞ্জুর মুর্শেদ, মোশাররফ হোসেন, জাকিউল হক এবং সুকুমার বিশ্বাসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার প্রাক্তন ছাত্র আবদুর রাজ্জাক গ্রন্থটির নির্ঘন্ট ও গ্রন্থপঞ্জী প্রণয়নে সাহায্য ক’রে আমার পরিশ্রম লাঘব করেছে। এদের সবার ঋণ আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।
মযাহারুল ইসলাম
বাংলা একাডেমী, ঢাকা
১৭ই মার্চ, ১৯৭১

রাত্রি : রক্ত : সূর্‍্য : সম্ভাবনা

।। এক ।।
হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে রাত্রি এলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সূর্য ক্রন্দনের হাহাকার ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হ’ল। আকাশের গায়ে রক্তের দাগ। এই রক্ত আকাশ থেকে নেমে এলো বাংলার নরম মাটিতে। মাটি থেকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। সে ইতিহাস যেমন করুণ তেমনি প্রতিশ্রুতির ও প্রত্যয়ের সম্ভাবনায় ভাস্বর। রক্তস্নাত ২৫শে মার্চের রাত্রির মাধ্যমেই বাঙালীর হাজার বছরের মুক্তি-স্বপ্ন বাস্তব রূপ ধারণ করেছে—জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পশ্চিমাকাশের গায়ে লাল লাল রক্তের চিহ্ন দেখতে দেখতেই আমি সোবহানবাগ থেকে পদব্রজে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ীতে এসে দাঁড়ালাম। তখন কয়েকজন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা গেটের সামনে একটি জীপে আসন গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আমাকে দেখেই তাঁদের একজন নেমে এসে চুপে চুপে বললো —‘স্যার, খবর তো শুনেছেন। এবার রক্তের পিচ্ছিল পথেই আমাদের যাত্রা শুরু হ’ল।’ আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম —“সংগ্রামের পথ কোনদিন সহজ হতে পারে না। আর এই পিচ্ছিল পথেই আসছে মুক্তি।” তিন মাস পর এই ছাত্রনেতাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ হয়েছিল সীমান্তের রণাঙ্গনে। আমরা সবাই তখন সৈনিক।
ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম সবাই ম্লান —সবার মুখেই হতাশার সুস্পষ্ট চিহ্ন। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই মুখে সেনাপতির সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে
পৃষ্ঠা নংঃ ১

সবার সাথে আলাপ করছেন একসঙ্গে তিন চারজনকে নিয়ে ঘরের কোণায় বা পর্দার অন্তরালে চলে যাচ্ছেন এবং চুপি চুপি নির্দেশ দিচ্ছেন —‘এক্ষুণি চলে যাও, ঢাকা ছেড়ে নিজের এলাকায় চলে যাও — তারপর গড়ে তোল প্রতিরোধ — বাংলার মাটিকে স্বাধীন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ কর।’
সময় গড়িয়ে চলেছে। একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। রাত তখন প্রায় ন’টা। তখনো ঘরে ছিলেন ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান, যশোরের কামরুজ্জামান, ময়মনসিংহের আবদুল মোমেন, খন্দকার মহম্মদ ইলিয়াস প্রভৃতি। আমি এবং ইলিয়াস ভাই একটি সোফায় বসে। ইলিয়াস ভাই তাঁর স্বভাব-সুলভ ভঙ্গীতে বলছেন, “ইয়াহিয়ার চেহারায় আছে নিরোর চেহারার সাক্ষাৎ প্রতিচ্ছবি। সে একটি রক্ত-পিপাসু জানোয়ার।” কথাগুলো আমি শুনেছিলাম, কিন্তু হৃদয়ঙ্গম করার মত মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। তাছাড়া আমার দৃষ্টি ছিল তখন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ওপর —আমি সর্বক্ষণ তাঁর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। তাঁর নির্দেশে ওবায়দুর রহমান, যশোরের কামরুজ্জামান এঁরা চলে গেলেন —কিছুক্ষণ পর ইলিয়াস ভাইও বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি তখন ঘরে একা। বঙ্গবন্ধু আমার পাশে এসে বসলেন। রাত্রি তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। তাঁকে তখন বেশ পরিশ্রান্ত অথচ প্রশান্ত দেখাচ্ছে। আমি সবিনয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বললাম, “সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সংগ্রামের নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন”—
বঙ্গবন্ধু আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। তিনি একটু মৃদু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, সবাইকে পাঠিয়ে দিলাম, এবার আপনার পালা। এক্ষণি চলে যান—আজ রাত্রেই রাস্তা পার হতে না পারলে পারবেন না—রাজশাহী, পাবনা, সমগ্র উত্তর বাংলায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলুন; সংগ্রাম করুন, দেশকে জানোয়ারদের হাত থেকে মুক্ত করুন।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি, কিন্তু আপনাকে এমন নিশ্চিত বিপদের সামনে রেখে আমরা সবাই চলে যাব?”
বঙ্গবন্ধু আবেগে আমার হাত চেপে ধরলেন। বললেন, আমার জন্য ভাবতে হবে না বন্ধু! আপনি তো জানেন জীবনে কোনদিন কোনরকম
পৃষ্ঠা নংঃ ২

পরিস্থিতি থেকে আমি পলায়ন করি নি—পলায়ন কারে বলে আমি তো জানি না।”
আমি বাধা বাধা দিয়ে বললাম, ‘এতো ঠিক পলায়ন নয়, আত্মরক্ষা। আর আত্মরক্ষাও নয় —আপনি আমাদের প্রধান নির্দেশদাতা —আপনার নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়েছে —এবার শুরু হবে সংগ্রাম।”
—সে সংগ্রামের নির্দেশ আমি দিয়েছি —আমি না থাকলেও আমার নির্দেশ থাকবে, সংগ্রাম চলবে আর সে সংগ্রাম সফল হবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
—কিন্তু আপনাকে তো আমরা হারাতে পারি না।
—আমি কি এতই স্বার্থপর যে সাড়ে সাতকোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাব? তাদেরকে আগুনের মুখে রেখে আমি চলে যেতে পারি না, আমি তা পারি না।
—আপনার জীবনের মূল্য অনেক বেশী—বাঙালীর কাছে তাঁর মূল্য অপরিসীম।
—না, তা নয়। সংগ্রাম শুরু হ’লে দেখবেন রণাঙ্গনে হাজার হাজার মুজিব তৈরী হ’য়ে গেছে। তা’ছাড়া আমি যদি এই বাড়ী থেকে সরে যাই তা’হলে ওরা যে সমগ্র ঢাকাকে ভস্মে রূপান্তরিত করবে।
—সে কথা হয়তো কিছুটা সত্য। কিন্তু আপনি বাইরে না থাকলে অন্যান্য রাষ্ট্র, বিশেষ করে ভারত আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করবে কেন—কেন আমাদের তাঁরা অস্ত্র দেবেন, আশ্রয় দেবেন?
—আপনারা আশ্রয় পাবেন, অস্ত্রও পাবেন। সে ব্যবস্থা আমি সম্পন্ন করে রেখেছি। কিন্তু আমি নিজে যদি চলে যাই, কাল দেশ স্বাধীন হলে পর যখন বাংলার মাটিতে ফিরে আসব আমার হাজার হাজার মা-বোন-ভাইয়েরা এসে যখন বলবে ‘মুজিব, তুমি তো নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সংগ্রাম করে জীবন রক্ষা করেছ—কিন্তু আমার স্বামী, আমার পিতামাতা, আমার ভাই, আমার বোন, এদের তুমি কি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলে, ফিরিয়ে দাও, তাদেরকে তুমি ফিরিয়ে দাও—তখন আমি তাঁদের কি জবাব দেব বলুন। না না, আমি পারি না। আমি যেতে পারি না। মরতে হয় মরবো। মৃত্যুকে তো কোনদিন আমি ভয় করিনি। কিন্তু I must
পৃষ্ঠা নংঃ ৩

Share the sufferings of my people along with them. I must share. I cannot Leave them on the face of fire. I can not. আমি পারি না।
আবেগে বঙ্গবন্ধু শেষের কথাগুলো ইংরেজীতেই বললেন। এরপর কিছুক্ষণ আমরা আর কোন কথা বলতে পারি নি। নীরবতা ভেঙে বঙ্গবন্ধু এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনি তা’হলে আসুন। যদি বেঁচে থাকি তবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে আবার দেখা হবে।
দু’জন হাতে হাত মিলিয়ে বিদায় নিলাম। আমার দুই গণ্ডে উত্তপ্ত অশ্রুর স্পর্শ। মনে হ’ল যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম।
ঘরের বাইরে এসে দেখি করিডোরে উদাস নেত্রে স্থির গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধু আবদুল মোমেন। আমি তাঁকে বললাম, “বঙ্গবন্ধু কিছুতেই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে রাজী নন। আমি ব্যর্থ হয়েছি, আপনি শেষ চেষ্টা করে দেখবেন।”
বন্ধু মোমেন আশ্বাস দিলেন। আর বন্ধুবৎসল কণ্ঠেই আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। কিন্তু রাত্রি চারটার দিকে জানতে পেলাম যে, আমার অনুরোধেই বঙ্গবন্ধু বাড়ী ছাড়েন নি। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর কাছাকাছি সোবহানবাগের একটি ছোট টিনের ঘরে আত্মগোপন করে—ছিলাম। রাত্রি বারোটা থেকে শুরু হ’ল সেই ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ। সমগ্র ঢাকা জ্বলছে। চারপাশে শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ! কয়েকজন বুলেটাহত লোক রক্তাক্ত দেহে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। শেষ রাত্রে একজন পৌঢ়া ঝি’র মুখে শুনলাম যে বঙ্গবন্ধুকে রাত্রি একটার দিকে বর্বর পাক সেনারা নিয়ে গেছে। স্ত্রীলোকটি আশেপাশের কোন বাড়ীতে কাজ করত। বহুকষ্টে সে সেখান থেকে পালিয়েছে— কিন্তু সে দূরে পালিয়ে থেকেই লক্ষ্য করেছে যে একটি মিলিটারী গাড়ী বঙ্গবন্ধুকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
হতাশার মধ্যেও বেদনায় মনটি সম্পূর্ণ ভেঙে যেন চুরমার হয়ে গেল। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলে উঠলাম, ‘বঙ্গবন্ধু সত্যিই তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে রেখে তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারলেন না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্যে যা আছে সেই ভাগ্যকেই তিনি
পৃষ্ঠা নংঃ ৪

বরণ করে নিলেন। তিনি জনতার নেতা, তিনি মানুষের নেতা, তিনি আপামর বাঙালীর বঙ্গবন্ধু। আগুনের মধ্যে বসেও তিনি ফুলের হাসি হাসতে জানেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েও সেই মৃত্যুকে তিনি অস্বীকার করতে জানেন। বাংলার ইতিহাসে তাই তিনি অমর মহানায়ক।
ভয় যার ললাটে কোনদিন লিখে নাই কোন লিখন—শত ভয়াবহতার মধ্যেও যিনি দুর্জয় এবং অটল—বাংলার ভাগ্যলক্ষী সেই অজেয় শক্তির অধিকারী বীরপুরুষের গলায়ই জয়মাল্য অর্পণ করেছেন —তাঁর হাত দিয়েই বঙ্গজননীর হাজার হাজার বছরের অভিশাপ দূরীভূত হয়েছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর মর্যাদা এই কারণেই তাঁর পাপ্য।
।। দুই ।।
না, না, এ হতে পারে না। একি শুনছি আজ এই রাষ্ট্রনায়কের মুখে? তিনি বলছেন উর্দুই হবে সমগ্র পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা! তিনি না জাতির জনক? তিনি না এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা? কি করে তিনি এমন সাংঘাতিক বাক্য উচ্চারণ করতে পারলেন? না, না, এ আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। প্রতিবাদ জানাতে হবে —প্রতিবাদ জানাবো আমরা—তিনি যিনিই হোন, তাঁর এই উক্তি নির্বিচারে আমরা মেনে নেব না —নিতে পারি না। উপস্থিত সকলের মনেই এই একই কথা। কথা মন থেকে মুখে এসে বারবার প্রকাশের দুর্বারতা খুঁজছে। সভার প্রান্তে প্রান্তে কথা গুঞ্জনের প্রবাহ সৃষ্টি করছে।
না, না, এ হতে পারে না —আমরা মানবো না —বাংলা আমাদের চাই। বিশাল জনসমুদ্রে যেন আপত্তি ও প্রতিবাদের একটি চাপা গুঞ্জন উঠলো। সমবেত কিছু কিছু চাপা প্রতিধ্বনি যেন বুদবুদের মত বাতাসে আঘাত করে বাতাসেই মিলিয়ে গেল। সে কণ্ঠস্বর নতুন প্রতিজ্ঞার সূর্‍্যালোকে ভাস্বর।
পৃষ্ঠা নংঃ ৫

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনতা আপত্তির ঝড় না তুললেও সহসা যেন চমকে উঠলো, হতচকিত হয়ে গেল। বক্তা চমকে উঠেছিলেন কিনা জানি না —তবে তাঁর বিবেক নিশ্চয়ই চমকে উঠে থাকবে। অবশ্য যদি বিবেক বলে তাঁর কিছু থাকে।
এদিকে সভার এক প্রান্তে কিছু যুবক নিজেদের রক্তিম চোখ তুলে একে অপরের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। তাঁদের দৃষ্টিতে যে বাক্য লেখা ছিল তা যেমন কঠিন তেমনি দুরন্ত। অনেকেই ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছেন কারা এই অসম সাহসী যুবক? কাদের বুকে এমন হিম্মত, চোখেমুখে এমন দুর্জয় প্রতিশ্রুতি। কেউ চিনলো, কেউ চিনলো না। সহসা বিক্ষুদ্ধ এই ছোট্ট অথচ প্রত্যয়ী ছাত্রদলের যিনি নেতৃত্ব দান করছিলেন অনেকেরই দৃষ্টি তাঁর দিকে। সকলের মুখে একটি উদ্বিগ্নতার ছায়া। বক্তার চোখেমুখেও কিনা তা’ কেউ বুঝতে পারে নি। বক্তা অর্ধ—অসুস্থ, দেহে এবং মনে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে সভার মেজাজ দেখে এবং বিশেষ করে তরুণদের চোখেমুখের হাবভাব দেখে তিনি উপলব্ধি করলেন যে সভায় অনেকেই উর্দুর ঘোষণা শুনে তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি।
বক্তা স্বয়ং পাকিস্থানের জাঁদরেল গভর্নর জেনারেল —বক্ষরোপের শিকার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেকালের কায়েদে আযম।
লক্ষ জনতা শুধু আজ তাঁকে এক নজর দেখাবার জন্য দূর পথ অতিক্রম করে এখানে সমবেত। কিন্তু এ কোন সুরে কথা বলছেন তিনি? ইনিই কিনা জাতির জনক? এই ব্যক্তির পশ্চাতেই কি এতদিন মুক্তির অন্বেষণে কয়েক কোটি বাঙালী বজ্রমুষ্টি নিয়ে সমবেত হয়েছিল? বাংলা ভাষাকে তিনি অস্বীকার করছেন? বাঙালী জাতিকেও তিনি অস্বীকার করছেন? সবার মনেই এই প্রশ্ন। প্রশ্ন নয়, অগ্নিশিখা।
তারিখটি ছিল ১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ। সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। তারিখটি পাকিস্থানের ইতিহাসে বিশ্বাসভঙ্গের সূচনার দিন। এই দিন থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষের চিন্তা প্রবাহ নতুন পথে মোড় নিতে শুরু করলো। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, ঐতিহ্য —এসব বিসর্জন দিলে কি নিয়ে বাঁচবো আমরা? শুরু হ’ল নতুন চেতনার। চেতনা থেকে জন্ম নিলো নতুন পথযাত্রা। সেই যাত্রাপথ যেখানে নিয়ে এলো তাঁর নাম বাংলাদেশ। যে দেশে দাঁড়িয়ে শুধু গাইতে ইচ্ছে করে —‘আমার সোনার বাংলা —আমি তোমায় ভালোবাসি।’
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্সের সভার মেজাজকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করলেন পরদিন ২৪শে মার্চ পাকিস্থান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন উৎসবে প্রধান অতিথির ভাষণে। কার্জন হলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এবার তিনি দ্বিগুণ জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা।’
ছাত্র-সমাজ এই ঘোষণার জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রস্তুত ছিলেন অন্যান্যদের মধ্যে আরো একজন। ভবিষ্যতে আর একটি রাষ্ট্রে জাতির জনক হবার গৌরব তাঁর ললাটে লিখিত। তিনি তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। রেসকোর্স ময়দানে যারা রক্ত চক্ষুকে দৃষ্টি বিনিময় করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে দাঁতে দাঁত চেপেছিলেন তিনি তাঁদেরই একজন।
কার্জন হলে প্রবেশাধিকার তাঁর ছিল না। তিনি ডিগ্রি গ্রহণকারী ছাত্রদের একজন ছিলেন না। তবু হলে কি করতে হবে সে সম্পর্কে পূর্বেই কয়েকজনকে সাথে নিয়ে সিদ্ধান্ত তিনি দান করেছেন। নিজে কিছুসংখ্যক ছাত্র নিয়ে বাইরে প্রতীক্ষা করছিলেন। প্রতীক্ষা করছিলেন কখন ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে সমগ্র কার্জন হল হট্টগোলে ফেটে পড়বে। সত্যি সত্যি সেই স্বর্ণ মুহুর্ত এলো। যেমন ব্যবস্থা ঠিক তেমনি কাজ হয়েছে। জিন্নাহর ঘোষণার সাথে সাথে No No ধ্বনিতে প্রতিবাদ জানিয়ে উঠলেন একদল ছাত্র। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, ছাত্রনেতা মতিন এবং এ.কে.এম. আহসান ছিলেন অন্যতম। সমগ্র ব্যবস্থাপনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিব।
জিন্নাহ সম্বিত ফিরে পেলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর নমনীয় হয়ে এলো।
এই প্রথম স্বাধীনতার পর বাঙালীর প্রতিবাদ-চেতনা সোচ্চার ধ্বনিতে আত্মপ্রকাশ করলো। ধীরে ধীরে এই ধ্বনি রূপান্তরিত হয়েছে আন্দোলনে, আন্দোলন সংগ্রামে, সংগ্রাম স্বাধীনতায়। আর ধাপে ধাপে সমগ্র জাতিকে জিজ্ঞাসা থেকে প্রস্তত-পর্বে এবং প্রস্তুতি-পর্ব থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নিয়ে আসার পথে যিনি নেতৃত্বদান করেছিলেন তিনি শেখ
পৃষ্ঠা নংঃ ৭

মুজিব। বাংলার প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহা-নায়ক। পাকিস্থান সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরেই বাঙালী জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করবার জন্য এবং বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জন্য শেখ মুজিবকে দিনের পর দিন নিরলস আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। আর তার ফলে শাসকগোষ্ঠী বরাবর তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবেই অভিযুক্ত করে এসেছে।
আসলে এক হিসাবে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহীই ছিলেন। যে রাষ্ট্র মানুষের মর্যাদাকে পদদলিত ক’রে স্বৈরাচারী শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা প্রবর্তনে যত্নবান, যে রাষ্ট্র জন্ম-লগ্ন থেকে একই দেশের এক অংশকে অপর অংশের দ্বারা শোষণের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল, যে রাষ্ট্রে সত্যভাষণের অধিকার পদে পদে বিঘ্নিত, তিনি সেই রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। আর পারছিলেন না বলেই তিনি বারবার সেই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। যে দেশের লোকের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, যে দেশের মানুষ শাসকদের নির্যাতনে ও শোষণে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল, যে দেশের সম্পদ দেশবাসীর ভোগে না লেগে মুষ্টিমেয় মানুষের আরাম-আয়েশের সামগ্রী হয়ে উঠেছিল, সেই দেশে জন্মে সে দেশের মানুষের আর্ত চীৎকারে যাঁদের প্রাণ বিগলিত হোত, তিনি আসলে তাঁদেরই একজন। দেশবাসীর নাঙ্গা ও ভুখা মূর্তি তাঁর নিকট বয়ে আনতো অসহ্য বেদনার আর্তনাদ। লাখ লাখ মানুষের এই আর্তনাদ মুখ বুজে সহ্য করতে না পেরেই তিনি বারবার প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতেন। দেশবাসীর প্রতি অসীম দয়া, স্নেহ, মায়া, মমতাই ছিল তাঁর একমাত্র সম্বল। আর এই সম্বল নিয়েই তিনি শোষকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঝাপিয়ে পড়লেন দেশবাসীর দুঃখ লাঘবের সাধনায়, তাঁদের স্বাধিকার অর্জনের জন্যই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অপরিমেয় লাঞ্ছনা ও নির্যাতন। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তিনি একই কথা শত সহস্রবার উচ্চারণ করে বলেছেন—‘আমরা আমাদের অধিকার চাই—রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সমতা । আমরা
পৃষ্ঠা নংঃ ৮

সুফলা সোনার বাংলাকে শোষণমুক্ত করতে চাই। মায়ের মতই প্রিয় আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ আর বাংলাভাষা মায়ের মুখের ভাষা এ ভাষায় কথা বলবার অধিকার চাই। এ ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চাই।’
অধিকার তিনি আদায় করে ছেড়েছেন। শুধু মুখের ভাষা প্রকাশের অধিকারই নয়—একটা গোটা জাতিকে তিনি মুক্ত করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈথিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের নাগপাশ থেকে। বিশ্বের মানচিত্রে এক পুরানো ভূখণ্ডকে নতুন রঙ-এ রঞ্জিত করেছেন তিনি। চিরবঞ্চিত ভূখণ্ড বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। বাঙালীর হাজার বছরের সাধনা বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেছে, লক্ষ মানুষের সুদীর্ঘকালের চেতনা একটি মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এসে আত্মস্থ হয়েছে আর সেই আত্মস্থ সাধনা ও রক্তিম ত্যাগের ফসল হ’ল বাংলাদেশ। এ যেন এক মহাকবির রক্তাক্ষরে লিখিত একটি জীবন্ত মহাকাব্য।
শেখ মুজিবের বিদ্রোহী সত্তার উন্মেষ কোন আকস্মিক ঘটনার ফলশ্রুতি নয়। তিনি জাত—বিদ্রোহী। যেদিন প্রথম এই মাটিতে তাঁর আগমন ঘটে, সেদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে অসন্তোষের বীজ উপ্ত হয়েছিল। বাংলার মানুষের চোখেমুখে বিদ্রোহের অগ্নি সংগুপ্ত ছিল। দেশের একটা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে এই প্রধূমায়িত বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ আমরা লক্ষ্য করেছি। বিদ্রোহী চেতনা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁর ভেতরে প্রকাশমান। তাঁর এই বিদ্রোহী সত্তার একটি স্বতন্ত্র রূপ ছিল, ছিল স্বতন্ত্র নির্যাস। তাঁর বিদ্রোহের মধ্যে হঠকারিতা নেই, নেই ধ্বংসাত্মক মনোভাবের কোন প্রতিফলন। বুদ্ধদেব, গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে বিদ্রোহ করে গিয়েছিলেন সেই ঐতিহ্যই শেখ মুজিবের বিদ্রোহী সত্তায় লালিত।
অসহযোগ আন্দোলনই হচ্ছে শেখ মুজিবের বিদ্রোহী সত্তার প্রধান অস্ত্র। তিনি সকল সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। বস্তুত অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের তিনি এক সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। বাংলাদেশের মাটি থেকে ধর্মান্ধতার বিষ অপসারিত করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তিনি এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব।
একদা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের শাসননীতির যাঁতাকলে বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা নংঃ ৯

মানুষ নিষ্পেষিত হয়েছিল। নির্যাতন আর অত্যাচার ছিল জনগণের দোসর। একদিন এই সুজল সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলতো। কবির উক্তি ‘গোয়ালভরা গরু আর গোলাভরা ধান’ নিছক কল্পনা নয়। তখন গৃহস্থের ঘরে বসত আনন্দ উৎসবের মেলা। পায়েস, পুলি, পিঠা আর নবান্নের সপ্ত ব্যঞ্জনে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতো। সেই বাংলাদেশ আর বাঙালী জাতি শোষণ ও নির্যাতনে আজ নিঃস্ব। বাংলার আনাচে-কানাচে অভাব-অভিযোগ, অনশন, মৃত্যু ও হাহাকারের ছায়া।
বৃটিশ সরকারের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি “পাকিস্থান” নামে একটি দেশের জন্ম হ’ল। আর এই জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালী জাতির ভাগ্যে নেমে এলো অমানিশার খড়গ-কৃপাণ। জঙ্গীশাহী পশ্চিমাগোষ্ঠীর শোষণে পূর্ব বাংলা অন্তঃসারশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাঙালী তার নিত্যনৈমিত্তিক অর্ধাহার, অনশনের মধ্যে দিয়ে দিনানিপাত করতে লাগলো। এদেশের সঞ্চিত সম্পদ চলে যেতে শুরু করলো পশ্চিম পাকিস্থানে। বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে বাঙালীর কণ্ঠস্বর চিরতরে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চললো। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা এদেশ গড়েছিলো তারা হ’ল বঞ্চিত। রোগে, শোকে, বন্যায়, অনাহারে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষের অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। স্বাধীন পাকিস্থানে পূর্ব বাংলার চারিদিকে শুরু হ’ল আবার হাহাকার, ক্রন্দন ও হা-হতাশ। এই অবস্থা থেকে বাঙালী জাতিকে উদ্ধার করবার জন্য সুর্দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে নিরলসভাবে সংগ্রাম করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর হিংসা নয়, অহিসিংসা জ্যোতিই আমরা বিচ্ছুরিত হতে দেখেছি তাঁর এই সংগ্রাম শোষণের বিরুদ্ধে, জালিমের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। মোট কথা জাতিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁর এই সংগ্রাম। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে সর্বপ্রকার শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন ছিল তাঁর আশৈশব। যেদিন থেকে পাকিস্থান সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন
পৃষ্ঠা নংঃ ১০

থেকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে একটি অশুভ লগ্নে এদেশের জন্ম, আর এর পরিণাম হিসাবে একদিন বাঙালী জাতির ওপর নেমে আসবে এক বিপর্যয়। সেদিন বাঙালী জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করাই হবে দুরূহ। পাকিস্থান সৃষ্টির পশ্চাতে তাঁর বলিষ্ঠ সমর্থন ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় আমরা পাই তাঁর ছাত্রজীবন থেকে। ইংরেজদের শাসন ও শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর কৈশোরোত্তীর্ণ জীবনের এক মহান প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু এর চাইতেও একটা বিরাট পরিকল্পনা সেদিন থেকেই তাঁর অন্তরে লুকিয়ে ছিল। সে হ’ল বাংলাদেশকে শোষণমুক্ত করা। সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে নিজের ভেতরে তিনি এই পরিকল্পনা লালন করেছেন এবং তার বাস্তবায়নে তিনি তাঁর জীবনে দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনকে নিত্য সঙ্গী হিসাবেই গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু কোনদিন তিনি সংগ্রাম ও সংগ্রামী-চেতনা থেকে দূরে থাকতে পারেননি। শেখ মুজিবের জীবন-কাহিনী সংগ্রামময় ইতিহাসে সমৃদ্ধ। সেই ইতিহাসকে আবার কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সামগ্রিক জীবন বিশ্লেষণ করে আমি তাঁর সংগ্রামী জীবনের পর্যায়কে মোটামুটি নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছি।
প্রথম অধ্যায় (১৯২০ – ১৯৪৭): জন্ম থেকে পাকিস্থান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত।
দ্বিতীয় অধ্যায় (১৯৪৮ – ১৯৫৮): পাকিস্থান সৃষ্টির পর থেকে প্রথমে সামরিক শাসন জারীর পূর্বকাল পর্যন্ত।
তৃতীয় অধ্যায় (১৯৫৮ – ১৯৬৫): প্রথম সামরিক শাসন জারীর পর থেকে পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত।
চতুর্থ অধ্যায় (১৯৬৫ – ১৯৬৯): পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তীকাল, ছয়দফা, ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা ও গণ-অভ্যুত্থান, দ্বিতীয় সামরিক শাসন।
পঞ্চম অধ্যায় (১৯৬৯ – ১৯৭১): ইয়াহিয়ার শাসনামল : নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়, নির্বাচন, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণহত্যা, বিশ্ববিবেক ও শেখ মুজিব, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১১
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পদত্ত বইয়ে ১১ নম্বর পৃষ্ঠার পরে ১৩ নং পৃষ্ঠা রয়েছে। ১১ নং পৃষ্ঠা মিসিং থাকার দরুন উক্ত পৃষ্ঠাটি এখানে দেওয়া সম্ভবপর হলো না।

সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায়
(১৯২০ – ১৯৪৭)
জন্ম
তখন ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বেশ দানা বেধে উঠেছে। এদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কোন না কোন ভাবে সে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালী সমাজ ও সেদিক থেকে পশ্চাতে ছিল না। বরং সমগ্র বৃটিশ-ভারতে বাঙালীর ভূমিকা ছিল স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রণী। দেশের এই সংক্ষুব্ধ পরিবেশে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের ১৭ই মার্চ ঢাকা শহর থেকে মাত্র ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বেগম সাহেরা খাতুনের গর্ভে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পারিবারিক পরিচয়
তাঁর পিতা শেখ লুতফর রহমান সিভিল কোর্টের একজন সেরেস্তাদার। তাঁর অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল। জোত সম্পত্তি ভালই ছিল। নিজস্ব বাড়ীতে গোলাঘরে যে ধান উঠতো তা দিয়ে সারা বছর বেশ স্বচ্ছন্দেই কেটে যেত। তিনি অসাধারণ কোন পরিবারের সন্তান নন —আবার সে পরিবারকে একেবারেই সাধারণ দীনহীন কোন পরিবারও বলা যায় না। তাঁর জন্ম সময়ে তাঁদের পরিবারের যে অবস্থা ছিল বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এই ধরনের পরিবারের সংখ্যা কম ছিল না। আজো নেই।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩

শেখ মুজিব পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। দুটো কন্যা সন্তানের পর শেখ মুজিবকে পুত্ররূপে পাওয়ায় স্বভাবতঃই তার প্রতি বাবা-মা’র আদর ও স্নেহের মাত্রা একটু বেশী হয়ে যায়। মুজিবকে ঘিরেই তাঁদের স্বপ্নকুসুম রচিত হচ্ছিল।

পিতার আকাঙ্খা
পিতা চাইলেন শেখ মুজিবকে আইনজীবী রূপে গড়ে তুলতে। তিনি নিজে সরকারী চাকুরে ছিলেন। বিদেশী যন্ত্রণায় তিনি দগ্ধীভূত হচ্ছিলেন। বিবেকের দংশন তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না বলেই পুত্রের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে এই নতুন বাসনায় উদ্বুদ্ধ তিনি। অবশ্য আর দশজন পেশাদার আইনজীবীর মত মুজিবকে তিনি দেখতে চান নি । যে গোলামীর শৃঙ্খল তাঁর জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে তিনি তাঁর আবেষ্টনী থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। সে মুক্তি শুধু নিজের জন্যই নয়, সারা ভারতবর্ষের মানুষ যাতে তাঁর আস্বাদ অনুভব করতে পারে সে আকাক্ষাও তিনি মনে মনে পোষণ করতেন। সেজন্যই তিনি চাইলেন মুজিব যেন আইনজীবীর মত একটা স্বাধীন ব্যবসায় নিয়োজিত থেকেই দেশ ও দশের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারেন। নিজে যা পারেন নি – যা পারা সম্ভব হয়নি মুজিবকে দিয়ে তিনি তা’ চরিতার্থ করতে চান। পিতার এই মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় পুত্রের প্রতি তাঁর অবাধ স্বাধীনতা প্রদানের অভিপ্রায় থেকেই। শৈশবেই মুজিব ছিলেন যেমন দুর্বার, তেমনি ছিলেন দুর্ধর্ষ। তাঁর হৃদয়ে সব সময় একটা বিক্ষোভ দানা বেঁধে থাকতো। স্কুল জীবনেই এক দুঃসাহসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর সে বিক্ষুদ্ধ হৃদয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।

কৈশোর জীবনের দুঃসাহসিকতা
১৯৩৯ সাল। তিনি তখন গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময় শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেব স্কুল পরিদর্শনের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। নেতাকে যথাযোগ্য সম্বর্ধনা জানাতে হবে। প্রথমদিকে কংগ্রেসের সমর্থকগণ এতে সম্মত হন। কিন্তু পরে তাঁরা বেঁকে বসলেন এবং ঐ সম্বর্ধনা প্রদান থেকে তাঁরা বিরত থাকেন ও বাধার সৃষ্টি করেন। যাহোক, নেতাকে যথারীতি সম্বর্ধনা জানানো হ’ল। হক সাহেব চলে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪

যাবার পর এই ব্যাপারে মন কষাকষি, বচসা ও কথা কাটাকাটি চলতে থাকে এবং একটি ছোটখাট গোলমাল বেঁধে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সম্বর্ধনা প্রদানের স্বপক্ষে। তিনি তাঁর প্রচেষ্টা ও যত্ন দ্বারা কংগ্রেস ও ফজলুল হক সমর্থকদের মধ্যে একটা সমঝতার চেষ্টা করেন। কেননা তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন আদর্শবাদী যুবক।

প্রথম কারাবরণ
তাঁর চেষ্টা সফল হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই এক চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে পুলিশ কর্তৃক সাত দিনের জন্য কারাগারে আবদ্ধ হন। এই প্রথম তিনি সাম্রাজ্যবাদ শক্তির শিকারে পরিণত হন। এই হ’ল তাঁর কারাগার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। এই প্রথম জেলের স্বাদ পেলেন মুজিব। পেলেন এক নতুন জীবনের ইঙ্গিত। স্পন্দিত হ’ল তাঁর সা্রা অন্তর। শুরু হ’ল সংগ্রামী জীবনের প্রথম অধ্যায়। পিতা এতে ক্ষুদ্ধ হন নি। বরং ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম করার জন্য তিনি সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। কেননা, তিনি জানতেন দেশকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হ’লে রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। আর পরাধীন দেশে রাজনীতি করতে গেলে জেলখানাকে দ্বিতীয় বাড়ী বলে মনে করতে হবে। ব্রিটিশ-ভারতে এছাড়া উপায় ছিল না।

রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ
শেখ মুজিব প্রথম রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট থেকে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুজিবের সাক্ষাতকারও তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের ফলশ্রুতি। তখন তিনি মিশন স্কুলেরই ছাত্র। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার অন্যতম সহকর্মী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার গোপালগঞ্জের সেই মিশন স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁরা যখন অগ্রতোরণ পার হয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়িয়েছেন ঠিক সে সময় একটা লিকলিকে ছেলে এসে অকস্মাৎ তাঁদের গতিপথ বাধা দিয়ে বললোঃ ‘আপনারা স্কুলে যেতে পারবেন না’। সবাই অবাক হ’ল । স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলেটিকে ভাল করেই চিনতেন। স্কুলের হেডমাস্টার তাড়াতাড়ি এসে তাঁকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেই মন্ত্রীদ্বয় হাত দিয়ে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫

তাঁকে থামিয়ে ছেলেটিকে তাঁর বক্তব্য বলার জন্য সুযোগ দিতে বললেন। ছেলেটি একেবারে সামনে দাঁড়াল। সে তাঁর পরিচয় দিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে বললোঃ ‘স্যার, আমাদের স্কুলের বোডিং নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ওটা আমরা ঠিক করে নিতে চাই।’ ছেলেটির বলার ভঙ্গিতে যে ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছিল মন্ত্রীদ্বয় তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেনঃ “আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার দাবী পূরণ করা হবে।”

হক-সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয়
শহীদ সাহেব এই দৃপ্ত কিশোরের ছবিখানা ভুলতে পারেননি। তিনি তাঁকে নিভৃতে ডেকে তাঁর সঙ্গে ডাক-বাংলায় দেখা করার জন্য বললেন। নির্দিষ্ট সময়ে ছেলেটি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করলো। দীক্ষা নিল এক নতুন জীবনের। সে জীবনের নাম সংগ্রাম। বলা বাহুল্য সংগ্রামী জীবনের দীক্ষিত সেই কিশোর ছেলেটিই শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দী তাই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষাগুরু।
তখন ভারতবর্ষের দেশীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ চরম সীমায় উপনীত হয়েছে। ইংরেজরা তাঁদের উদ্দেশ্য সফলে উৎফুল্ল। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশ সরকার স্বভাবতঃই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন।

মুসলিম লীগের জন্ম
১৯০৬ সালে মুসলীম লীগের জন্ম হলে তাঁরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এদেশের জনগণের মধ্য সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাঁচিয়ে রেখে শাসন ব্যবস্থাকে টিকেয়ে রাখা। কংগ্রেসকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্থা আখ্যা দিয়ে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর নেতৃত্বে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আলাদা রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। তবু ১৯২১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত এই দুই দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির অবকাশ তেমন গুরুতরভাবে দেখা যায়নি। বরং ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দের দিকে ভারতবর্ষের জাতীয় আন্দোলনে মুসলিম সমাজ ও কংগ্রেস উভয় দলই সম্প্রীতি বজায় রেখেই কাজ করে চলেছিল। এমনকি মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলী এই দুই ভাই সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা দান করতে গিয়ে ছয় বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬

১৯২১ সালে ‘স্বরাজ’ কথাটিকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র অর্থে ব্যবহারের খেন্য খেলাফত আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দাবী জানালেন এবং এর ফলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। মহাত্মা গান্ধী এই দাবী মানতে রাজী হন নি । পরে চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ কতিপয় বিশিষ্ট হিন্দু নেতাও সেই একই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে যান।

হিন্দু মহাসভা
১৯২৫ সালের দিকে মুসলিম বিরোধিতা চরমে ওঠে। এ সময় লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরোধিতা করবার জন্যই হিন্দু মহাসভা গঠিত হয়। ইংরেজ সরকার এই বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নানাভাবে প্ররোচিত করেছেন। অবশ্য ১৯২৮ সালে এক সর্বদলীয় সম্মেলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে এক করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রয়াস সফলকাম হয় নি।

মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কোন্দল
এই বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ প্রাদেশিক বিধান সভাগুলোতে মন্ত্রিসভা গঠনে ও আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে একটি বোঝাপড়ায় আসতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানান -কংগ্রেস তা’ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় অর্থাৎ ১৯৩৭ সালের জানুয়ারীতে জিন্নাহর নিকট এক পত্রে শ্রীযুক্ত জওয়াহেরলাল নেহেরু লিখেছিলেনঃ “বর্তমান পরিস্থিতি পর্যন্ত বিশেষভাবে পর্যালোচনা ক’রে দেখা যায় যে, আজ ভারতবর্ষে কেবল দু’টো শক্তিই আছে-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং কংগ্রেস -যে দল কিনা সারা ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছে…মুসলিম লীগ কেবলমাত্র একদল মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তাঁরা সবাই গণ্যমান্য লোক। কিন্তু তাঁদের কার্যক্ষেত্র উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তাঁদের সঙ্গে মুসলমান জনসাধারণের কোন যোগাযোগ নেই এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলমানদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ খুবই সীমিত।”
[আমি মুজিব বলছিঃ কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৪২]
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭

শ্রী নেহেরুর চিঠির শেষোক্ত বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন যে, মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের কার্যক্ষেত্র শুধুমাত্র উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের কোন যোগাযোগ নেই। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের শ্রেণী-চরিত্র এবং উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলেই এ সত্য ধরা পড়ে।

মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের শ্রেণী-চরিত্র
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিজয়ের বহু পূর্বে থেকেই এদেশে মুসলমান সম্প্রদায় প্রধানতঃ দু’টো শ্রেণীতে বিভক্ত -কৃষক ও অভিজাত। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরাই দেশের শাসন-ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ ক্ষমতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত মুসলমান কর্মচারীদেরকে সরিয়ে নিজ দেশীয় লোকদের বহাল করতে থাকে। এর অন্যতম কারণ ছিল এই যে, মুসলমান শাসনকর্তার কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য ইংরেজরা তাদেরকে প্রথম থেকেই অবিশ্বাসের চোখে দেখতে থাকেন। এই সুযোগে হিন্দুরা আস্তে আস্তে ইংরেজদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করেন এবং চাকুরী ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা অর্জন করতে থাকেন।
ব্রিটিশ বণিকেরা এ দেশ থেকে অতিরিক্ত উৎপাদন দ্রব্য চুষে নেবার সহজ পদ্ধতি প্রয়োগ করার জন্য কলকারখানা বসাতে থাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে গ্রাম্যশিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে গড়ে উঠতে থাকে বড় বড় শহর। হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজদের সেই উৎপাদনের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে এবং নিজেরাও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হতে থাকেন। কালক্রমে এঁরাই ধীরে ধীরে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে রূপান্তর লাভ করেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই কালক্রমে সৃষ্টি হয় জমিদার, মহাজন ও ধনিক শ্রেণীর। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে অনেক মুসলমান জমিদার উক্ত আইনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারায় জমিদারী হারান। ইংরেজের বিশ্বস্ত অনেক অর্থশালী হিন্দু ঐ সকল জমিদারী হস্তগত করেন।
এমনিতেই এই সমস্ত কারণে মুসলমান অভিজাত সম্প্রদায় ইংরেজদের সম্পর্কে খুবই বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন -তদুপরি ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৮

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক শিক্ষা ও সরকারী কাজকর্মের মাধ্যমে হিসেবে ফার্সীর বদলে ইংরেজী ভাষা চালু করায় তাঁরা আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ফলে তাঁরা সর্বক্ষেত্রেই ইংরেজদের সঙ্গে অসযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকেন। এর ফল মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কোনক্রমেই শুভ হয় নি। হিন্দুরা এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কারণ ফার্সী এবং ইংরেজী উভয় ভাষাই তাঁদের কাছে ছিল বিদেশী। ফার্সীকে তাঁরা উচ্চমধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাষা বলে মনে করতেন। পক্ষান্তরে, ইংরেজী ভাষা প্রচলনের ফলে তাঁদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলেই সেটাকে তাঁরা স্বাগত জানাতে থাকেন।

স্যার সৈয়দ আহমদ
উচ্চমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অপরিণামদর্শিতার দরুন সাধারণ মুসলমানদের দুর্দশার কথা চিন্তা ক’রে স্যার সৈয়দ আহমদ সর্বপ্রথম তাঁদের ইংরেজী শিক্ষার পক্ষে প্রচার অভিযান শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দে আলীগড় মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন, যা পরবর্তী কালে আলীগড় মুসলীম বিশ্ববিদ্যালয় নামে অভিহিত হয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, যাতে করে তাঁরাও দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তাঁর আরো উদ্দেশ্য ছিল-মুসলমানদেরকে যেন হিন্দু কর্তৃত্বের অধীন হয়ে না থাকতে হয় তার জন্য নিজেদেরকে প্রভাবশালীরূপে গড়ে তোলা।
কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদের এই প্রচেষ্টা সার্থক হয় নি। কারণ তাঁর মৃত্যুর পর উচ্চ মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণ মুসলমানদেরকে হিন্দুদের পর্যায়ে ফেলে তাঁদেরকে বাংলাভাষা শিক্ষার উপদেশ দেন এবং উর্দুকে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন।
পক্ষান্তরে ইংরেজদের সংস্পর্শে যাওয়ার দরুন যে হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তাঁরা বিভিন্ন শ্রেণীর সংমিশ্রণজাত বিধায় তাঁদের মধ্যে তেমন কোন বৈষম্য ছিল না। অবশ্য উচ্চমধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈষম্যমূলক মনোভাব থাকলেও একটা বিষয়ে তাঁরা সব সময়ই
পৃষ্ঠা নংঃ ১৯

সজাগ ছিলেন-তা হ’ল হিন্দু আধিপত্য যেন তাঁদেরকে স্বীকার করতে না হয়। আর এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তাঁরা প্রথমতঃ মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব করতে প্রয়াস পান। এর অস্ত্র হিসাবে তাঁরা ধর্মকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেন। ঠিক এই একই উদ্দেশ্যে চরিতার্থের জন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মুসলিম লীগ মূলতঃ কংগ্রেসের বিরোধী দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রথমদিকে কংগ্রেস হিন্দু সম্প্রদায়ের একক প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে হিন্দু ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীর কিছু অংশ স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এটি একটি উদারনীতিভিত্তিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। মুসলমান উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল পুরোপুরি রক্ষণশীল। এই শ্রেণীর লোকেরা কংগ্রেসের উদারনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রথমদিকে গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত তা’ সহ্য করতে পারেন নি। মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে কংগ্রেস প্রায় হিন্দু সম্প্রদায়ের একক দল হিসেবে পরিচিত হয়ে পড়ে।

মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস
কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসে যোগ দিলে তাঁর নেতৃত্বে এই দল একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা দেয়। তিনি প্রচার করেন যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সব ধর্মেরই লক্ষ্য এক, কেবল পথ ভিন্ন। তা’ছাড়া তুরস্কের খেলাফত আন্দোলনকে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালে অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং অনেক মুসলমান নেতৃবৃন্দ গান্ধীজি কর্তৃক আহূত অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন।
কিন্তু খেলাফত আন্দোলন নানা কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ভারতীয় মুসলমানেরা এক গভীর হতাশার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়। কংগ্রেসের প্রতিও তাঁদের আকর্ষণ ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। ফলে কংগ্রেস আবার হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে প্রতিভাত হতে শুরু করে। বিত্তবান মুসলিম সম্প্রদায়েরা এবার মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার কাজে উঠে পড়ে লাগেন এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হ’তে থাকেন। এর আগে ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে মুসলমান সম্প্রদায় তাঁদের
পৃষ্ঠা নংঃ ২০

জন্য আলাদা নির্বাচনী এলাকা ও প্রার্থী পদের স্বীকৃতি লাভ করেন।

বঙ্গ বঙ্গ
এখানে স্মর্তব্য যে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার এক বৎসর আগে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম প্রধান অঞ্চল বৈশিষ্ট্যে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, এর পেছনে কার্জন সরকারের যে উদ্দেশ্য কার্যকরী ছিল তা’ হ’ল এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরশত্রুতা জাগ্রত রেখে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থাকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করা। স্বাভাবিকভাবেই বিত্তবান মুসলমান সম্প্রদায় এই উদ্দেশ্যকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ সরকারের এই উদ্দেশ্য বেশীদিন স্থায়িত্ব লাভ করে নি। প্রবল আন্দোলনের জোয়ারে উভয় বাংলার মাঝখানের বাঁধ আবার ধ্বসে গিয়ে একাকার হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে নির্বাচন উপলক্ষে মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের সমর্থন লাভের জন্য প্রচার অভিযান শুরু করেন। এই প্রচার অভিযানে তাঁরা ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এই সঙ্গে আরও একটা বিষয়ে তাঁরা মুসলমান সম্প্রদায়কে উপলব্ধি করাতে সমর্থ হন যে, মুসলিম লীগ সকল শ্রেণীর মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। শতাব্দী ধরে বাঙালী মুসলমানগণ হিন্দু জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন-তা’ছাড়া চাকুরী,ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতির সুযোগ-সুবিধা থেকেও তাঁরা বহুলাংশে বঞ্চিত ছিলেন। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বাঙালী মুসলমানদের এই দুর্বলতাকেও তাঁদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে তৎপর হন। কিন্তু কোন কোন বাঙালী মুসলমানের নিকট মুসলিম লীগের প্রকৃত উদ্দেশ্য অজ্ঞাত ছিল না। তাঁরা স্পষ্টতঃ জানতেন, মুসলিম লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলার কৃষক বা মেহনতী শ্রেণীর কোন স্বার্থসিদ্ধি হবে না। কংগ্রেসের উদ্দেশ্যাবলীর প্রতিও অনেক হিন্দু নেতা আস্থা রাখতে পারেন নি। তাই কেউ কেউ দল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এঁদের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বোস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মুসলমান নেতাদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হকই প্রথম বাঙালী যিনি স্পষ্টভাবে কৃষক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নামে আলাদা একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা ক’রে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা নংঃ ২১

কৃষক প্রজাদেরকে বৃহৎ জমিদার ও মহাজনের অত্যাচার এবং শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৩৭ সালের নির্বাচন ও কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা
এই আন্দোলনের পটভূমিকায় ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল অংশ গ্রহণ করেন। নির্বাচনে কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। তবু মুসলিম লীগের সঙ্গে আপোষরফা করে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভার মধ্যে মুসলিম লীগের সদস্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন।
বলা বাহুল্য, সোহরাওয়ার্দীর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর শেখ মুজিবও স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগের অন্যতম কর্মী হিসেবে আস্তে আস্তে নিজেকে নিয়োজিত করতে থাকেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত যে, মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীই একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোক হয়েও সাধারণ বাঙালী মুসলমানদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছিলেন। এই জন্যই বাঙালী সাধারণ মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অপরিসীম। তা’ছাড়া সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাস মোটেই ছিল না। সোহরাওয়ার্দী শ্রেণী-মর্যাদা ভুলে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন বলে মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁকে কোনদিনই সুনজরে দেখেন নি। পাকিস্থান সৃষ্টির পর সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তাঁদের বিরূপ আচরণই তা’ প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করে। পাকিস্থানের প্রাথমিক পর্বে সোহরাওয়ার্দীর কোন স্থানই হ’ল না এবং তাঁকে দীর্ঘদিন ভারতেই থেকে যেতে হয়েছিল।

শেখ মুজিবের স্কুল-জীবন
ছাত্রাবস্থাতেই যে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তা’ আগেই বলেছি। মাত্র সাত বৎসর বয়সে তিনি শিক্ষা-জীবন শুরু করেন গোপালগঞ্জের পাবলিক স্কুলে। পরে মিশন স্কুলে ভর্তি হন এবং প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত সেখানেই পড়াশুনো করেন। মাঝখানে, ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে বেরীবেরী জাতীয় এক আকস্মিক ব্যাধির ফলে তাঁর চোখ অপারেশন করতে হয়-যার দরুন তিন বছর স্কুলে না গিয়ে তিনি বাড়ীতে বসে পড়াশুনো করেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ২২

তিন বছর পর ১৭ বছর বয়সে তিনি আবার সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বিবাহ
ইতিমধ্যে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠ্যাবস্থায় তাঁর আত্মীয়া ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর স্ত্রীর বয়স তখন মাত্র তিন বছর। শেখ মুজিবের অধিকাংশ জীবনীকার তাঁর বিয়ের সময় সম্পর্কে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নের কথা উল্লেখ করছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এক সাক্ষাৎকারে আমাকে জানিয়েছেন যে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠ্যাবস্থায় তিনি বিয়ে করেন।

প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ
সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণের পর শেখ মুজিব পত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি অল ইণ্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ও বাংলা মুসলিম লীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। তা’ছাড়া এ সময়েই তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারীও নির্বাচিত হন। স্পষ্টবাদী, সাহসী ও উদ্যমী কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব সে সময় থেকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকেন।

লাহোর অধিবেশন
১৯৪০ সাল ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ কাল। এতদিন ধরে যে মুসলিম লীগ মুলমানদের জন্য আলাদা প্রদেশ গঠনের দাবীর পাঁয়তারা করে আসছিল, ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চে লাহোর অধিবেশনে তা’ সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই অধিবেশনে পাকিস্তান নামে একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবী উত্থাপন করা হয়-যার অন্তভূর্ক্ত হবে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলো। সভায় পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে পরিশেষে প্রস্তাবটি পাশ হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিতম এই যে, ভৌগলিক সংলগ্ন প্রদেশগুলোকে আবশ্যক মত পুনর্গঠন করা হোক এবং যে সকল অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাধিক্য সেই সকল অঞ্চলকে-যথা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও পূর্বাঞ্চল একত্র ক’রে মুসলিম জাতির আবাসভূমির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করা হোক, এই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলো স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে।
পৃষ্ঠা নংঃ ২৩

পাকিস্তান ও ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকারও স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে উভয় দেশের শাসনতন্ত্রে উপযুক্ত কার্যকরী ও বাধ্যতামূলক রক্ষা-কবচের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই লাহোর প্রস্তাব মূলতঃ মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। মিঃ জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যাখ্যাকে সামনে রেখেই এই প্রস্তাবটি করা হয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভাল যে, মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বহুদিন আগে থেকেই মুসলমানদেরকে একটি আলাদা জাতি হিসাবে ঘোষণা করে আসছিলেন। তিনি তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ “হিন্দু ও মুসলমান সম্পূর্ণ দুই স্বতন্ত্র ধর্ম, দর্শন, সামাজিক সংস্কার ও সাহিত্য থেকে উদ্ভূত। -এমনকি হিন্দু ও মুসলমানগণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ইতিহাসের ধারা থেকে তাঁদের অনুপ্রেরণা লাভ করে থাকেন।”
লাহোর অধিবেশনে তাঁর এই ব্যাখ্যা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হয়। শুধু তাই নয়, এ সময় মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। এর ফলাফল অবশ্যই সুখকর হয় নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধ এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল যে, বিভিন্ন প্রদেশে পর পর কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও সংঘটিত হ’ল। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। গোটা ভারতবর্ষও আস্তে আস্তে সেই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ইংরেজ সরকার তাঁদেরকে অর্থাৎ মিত্রপক্ষকে সাহায্য করার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ভারতবাসীর কাছে সাহায্য আবেদন জানান। কিন্তু কোন দল থেকেই স্বাধীনতা ব্যতিরকে কোন প্রকার সাহায্য প্রদানে স্বীকৃতি জানানো হয় নি।
যুদ্ধের এই সংক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার ক্রীপস নামক একজন মন্ত্রীকে ভারতবর্ষে পাঠান। উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধে যাতে ভারতীয়রা ইংরেজদের সহযোগিতা ও সাহায্য দেন তাঁর প্রচেষ্টা চালানো। আর এর বিনিময়ে তাঁরা ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরেরও প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ঐ সালেই ক্রীপক কর্তৃক যে প্রস্তাবগুলো পেশ করা হয়েছিল তাঁর সারমর্ম নিম্নরূপঃ
পৃষ্ঠা নংঃ ২৪

(ক) একটি নতুন ভারতীয় ইউনিয়ন ডোমিনিয়ন সৃষ্টি করা হবে।
(খ) যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে এবং ব্রিটিশের নিকট থেকে ভারতীয়দের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে গণপরিষদ ও ব্রিটিশ রাজের সন্ধি স্বাক্ষরিত হবে।
(গ) যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বে যদি ভারতীয় নেতাগণ নিজেদের মধ্যে কোন প্রকার সমঝোতায় পৌছতে না পারেন, তা’হলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থা নিম্নরূপে গঠিত হবেঃ যুদ্ধ অবসানের পরে যে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাঁর ফল ঘোষণার পরক্ষণেই সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন সভার নিম্ন নির্বাচক পরিষদের সদস্যগণ শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী একটি গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা দলের এক-দশমাংশ হবে। ভারতীয় দেশীয় রাজ্যসমূহকে তাঁদের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
(ঘ) সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর সমবায়ে দেশরক্ষা বিভাগের পূর্ণ দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতেই থাকবে।
(ঙ) ইহা প্রস্তাবিত ভারত ইউনিয়ন থেকে বাইরে থাকবার অধিকার প্রদেশকে প্রদান করে এবং যে সকল প্রদেশ ইউনিয়নের বাইরে থাকবার সিদ্ধান্ত করবে, সে সকল প্রদেশ ব্রিটিশ সরকারের সাথে পৃথকভাবে সন্ধিস্থাপন করবার অধিকার ও সুযোগ লাভ করবে।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক ক্রীপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই এই প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যান করেন। কংগ্রেস মনে করলেন যে এর ফলে ভারতের মুক্তি বিলম্বিত হবে। অপরপক্ষে মুসলিম লীগ দেখলেন যে যদিও পাকিস্তানের মূলনীতিকে পরোক্ষভাবে এতে স্বীকার ক’রে নেয়া হয়েছিল, তথাপি এই প্রস্থাব সমূহের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটি সর্বভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা। ফলে উভয় দলের প্রত্যাখ্যানের দরুন ক্রীপস মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
পৃষ্ঠা নংঃ ২৫

শেরে বাংলার মন্ত্রিসভা গঠন ও পদত্যাগ
এই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। ১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কৃষক প্রজা পার্টি সুভাষপন্থী কংগ্রেস ও হিন্দুসভাকে নিয়ে হক সাহেব প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু ইংরেজ সরকারের চক্রান্তের ফলে ১৯৪৩ সালের ২৯শে মার্চ তাঁর মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়।

নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা ও পঞ্চাশের মন্বন্তর
এর একমাস পরে মুসলিম লীগ দল মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মুখ্যমন্ত্রী হন স্যার নাজিমুদ্দিন। তিনি ছিলেন স্বার্থবাদী মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণীর ধ্বজাধারী। ফলে তাঁর সময় থেকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এই নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার কার্যকালেই বাংলাদেশে কুখ্যাত পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা সন ১৩৫০) দেখা দেয়। যে মন্বন্তরের ফলে প্রায় ৫০ লক্ষ বাঙালী নিঃশেষ হয়ে যায়।

যুদ্ধোত্তর পরিবেশ ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেল মিত্রপক্ষের জয়লাভ হলেও ইংরেজদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় নেতারা ব্রিটিশদের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করতে কসুর করলেন না। বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পূর্বের চাইতেও জোরালোভাবে স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হলেন।

মিঃ জিন্নাহর প্রস্তাব
১৯৪৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে মুসলিম লীগের দাবী ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে জিন্নাহ স্বাধীনতা অর্জনের পথ নির্দেশ করলেনঃ “আজ ভারতের রাজনীতিতে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটি মূলতঃ ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের মধ্যকার ব্যাপার নয়। এই ঘটনার মূলে রয়েছে হিন্দু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব। কোন কিছুই সমাধান হ’তে পারে না, বা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তানের দাবী মেনে নেয়া হচ্ছে।”
[ আমি মুজিব বলছি: কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৫৯]
পৃষ্ঠা নংঃ ২৬

তিনি আরো বললেনঃ “একটি নয়, এখানে সংবিধান তৈরীর জন্য দু’টি আলাদা দল করতে হবে। যার একদল হিন্দুস্তানের সংবিধান রচনা করবে এবং অন্যটি করবে পাকিস্তানের জন্য।
আমরা দশ মিনিটে ভারতবর্ষের সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। মিঃ গান্ধী বলেন আমি পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি স্বীকার করছি যে, ভারতবর্ষের এক-চতুর্থাংশ অধিবাসী যে ছ’টি প্রদেশে থাকে-সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বাংলাদেশ ও আসাম -বর্তমানে যে সীমারেখা আছে সেই রকম অবস্থাতেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এটা খুব সম্ভব যে, দুই দেশের অধিবাসীদের স্থানান্তর করা হবে, যদি কিনা সেটা ইচ্ছাপূর্ণ হয়। সীমানা-রেখা নির্ধারণের ব্যাপারটিও ঠিক করতে হবে। যদি এগুলো সবই হয় তবে বর্তমান প্রাদেশিক সীমারেখাকে ভবিষ্যতের পাকিস্তানের সীমারেখা হিসাবে মেনে নিতে হবে, আমাদের পাকিস্তানের রাষ্ট্র-কাঠামো হবে ফেডারেল ধরনের যার মধ্যে প্রতিটি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন অধিকার থাকবে।”
[ আমি মুজিব বলছি : কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৫৯ -১৬০]

কলকাতায় শেখ মুজিবের ছাত্র-জীবন
এর আগেই অর্থাৎ ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শেখ মুজিব উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে এসেছিলেন। কলকাতায় এসে তিনি ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট কলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। তখন তিনি ধর্মতলা স্ট্রীটে বেকার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতে থাকেন। এই সময় কলকাতায় শুধুমাত্র কারমাইকেল এবং বেকার হোস্টেলই মুসলমানদের জন্য আবাসিক হোস্টেল ছিল। এই হোস্টেল দু’টো ছিল তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির আখড়া-যা’ সারা বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। স্বাভাবিকভাবে শেখ মুজিবও এখানে এসে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। এখানে এসেই তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন।
বাঙালী যুবকের নিকট নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ এক মহান প্রেরণার সৃষ্টি করেছিল।
পৃষ্ঠা নংঃ ২৭

যুদ্ধের সময় নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ক’রে জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশ-ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে আক্রমণ চালানোর জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাধীনতার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়েই দেশনিবেদিতপ্রাণ এই মহান নেতা স্বয়ংক্রিয় সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শার্দুলকে যুদ্ধের সময়ের বিপর্যস্ত অবস্থায় আঘাত না হানলে দেশের স্বাধীনতা সুদীর্ঘ বিলম্বিত হবে এই ধারণার ফলেই নেতাজী অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মিত্রশক্তির জয়লাভের পর এই আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং নেতাজীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর অনুসারীবৃন্দ ধৃত অবস্থায় দিল্লীর লালকেল্লায় আনীত হন। বিচারে তাঁদের অনেকেই মুক্তি লাভ করেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কেউ কংগ্রেসে, কেউ মুসলিম লীগে যোগদান করেন । জেনারেল শাহনওয়াজ কংগ্রেসে যোগ দেন। এদিকে এই সংগ্রামের সাথেই যুক্ত নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন রশীদ আলীকে তখনো মুক্তি দেওয়া হয় নি। রশীদ আলীর মুক্তির দাবীতে কলকাতায় মিছিল হয় এবং ওয়েলিংটন স্কয়ারে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। দিনটিকে ‘রশীদ আলী দিবস’ বলা হয়। শেখ মুজিব উক্ত সভায় তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন অনেকের নিকটই তা’ একটি উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে। শেখ মুজিবের সংগ্রামী জীবনের এই হ’ল আর একটি উদাহরণ।

হলওয়েল মনুমেন্ট ভেঙে দেবার আন্দোলনেও শেখ মুজিব
সিরাজুদ্দৌলার স্মৃতির প্রতি কলঙ্ক আরোপ করে কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হবার সাথে সাথে এই মনুমেন্টটি ভেঙে ফেলার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। নেতৃত্ব দান করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবও এই সংগ্রামে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু নানা কারণে সেদিন এই পরিকল্পনা সার্থক হতে পারে নি। যদিও নেতাজীর সাথে শেখ সাহেবের সাক্ষাৎ ঘটে নি, কিন্তু সুভাষ বসুর দেশপ্রেম বঙ্গবন্ধুকে এক পবিত্র প্রেরণা দান করেছিল। একথা বঙ্গবন্ধু এখনো শ্রদ্ধার সাথেই স্বীকার করেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ২৮

শেখ মুজিবের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ
ইংরেজ আমলেও শেখ মুজিবের মধ্যে জাতীয়তাবোধ প্রচণ্ড ভাবে প্রবহমান ছিল। বিদেশীর প্রতি ঘৃণা নয়, তাঁদের নীতির প্রতিই ছিল তাঁর বিতৃষ্ণা। তাঁর দেশপ্রেম ও নীতিবোধ এতো প্রবল ছিল যে, দেশ ও জাতির শত্রুকে তিনি কোন দিন ক্ষমা করতে পারেন নি-পারবেনও না। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা বাংলা-ভারতের ওপর যে নির্যাতন, শোষণ ও অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিল শেখ মুজিব সে সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ-শক্তির প্রতি বিরূপ মনোভাব তাঁর আশৈশব। এ পটভূমিকায় অমিতাভবাবু তাঁর “গতিবেগ চঞ্চল বাঙলাদেশঃ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব” শীর্ষক পুস্তকে একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেনঃ
“১৯৪৪ সালে কলকাতায় ফরিদপুরবাসীদের একটা সংস্থা “ফরিদপুর ডিষ্ট্রিকট এ্যাসোসিয়েশন”-এর সেক্রেটারী ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। প্রেসিডেন্ট ছিলেন কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট নবাবজাদা লতিফুর রহমান। সে সময় অবিভক্ত বাংলার গভর্নর স্যার জন হারবার্টের মৃত্যুর পর নতুন গভর্নর হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন অষ্ট্রেলিয়ার আর. জি. কেসি। একদিন নবাবজাদা শেখ মুজিবকে ডেকে বললেন- “আমাদের এ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে নয়া গভর্নরকে একদিন সম্বর্ধনা জানানো উচিত। তোমরা ব্যবস্থা করো।”
“কিন্তু সেক্রেটারী মুজিব তৎক্ষণাৎ প্রেসিডেন্ট লতিফুর সাহেবের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, একজন বিদেশী গভর্নরকে এত খাতির করার কোন প্রয়োজন আছে কি? এরপর শেখ মুজিব নিজে ফরিদপুর এ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সমিতির প্রতি সদস্যের বাড়ী গিয়ে বললেন, “নবাবজাদা গভর্নরকে সম্বর্ধনা জানাতে চান, আমার নিজের এতে একেবারেই মত নেই, কিন্তু উনি আমার বাবার বয়সী -ওঁর মুখের উপর কোন কথা বলা আমার শোভা পায় না। তবে আপনারা যদি নবাবজাদার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন তো করুন কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমাকে সেক্রেটারী পদ থেকে অব্যাহতি দিন।”
“এই বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য যথাসময়ে “ম্যানেজিং কমিটির’ বৈঠক বসল। কিন্তু দেখা গেল সেক্রেটারী শেখ মুজিব আসেন নি।
পৃষ্ঠা নংঃ ২৯

প্রেসিডেন্ট লতিফুর সাহেব বললেন, সেক্রেটারীর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। কিন্তু সেক্রেটারী শেখ মুজিব এলেন না। তখন কার্যকরী সমিতির একজন সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে মুজিব তাঁদেরকে এ ব্যাপারে কি বলেছিলেন সব জানালেন। তখন নবাজাদাও বলতে বাধ্য হলেন, সেক্রেটারীর যদি আপত্তি থাকে তবে এ ব্যাপারে আর এগিয়ে কাজ নেই। পরদিন শেখ মুজিবকে ডেকে বললেন, আমি তোমার দেশপ্রেম ও নীতিবোধের তারিফ করি।”
[গতিবেগ চঞ্চল বাঙলাদেশ: মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব, অমিতাভ গুপ্ত, পৃঃ ৩৮ – ৩৯]
১৯৪৬ সালে সারা দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে সারা দেশ নির্বাচন উপলক্ষে জনমনে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হ’তে থাকে। বহুদিন থেকে বিভিন্ন ভাবে এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায় শোষিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন। তাই শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবার আশায় তাঁরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নতুন কিছু আশা করেছিলেন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। আর স্বভাবতঃই মুসলিম লীগ এবারেও ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে। মুসলিম জনমনে ধর্মীয় ভাব জাগরিত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার একটা স্পষ্ট ভাবধারা এখানে দৃষ্টিগোচর হয়ে। কিন্তু বাংলার সাধারণ মুসলমান মুসলিম লীগকে ব্যাপক সমর্থন জানান এই জন্য নয় যে তাঁরা শুধু ধর্মীয় নিরাপত্তা চান-বরঞ্চ ধর্মীয় নিরাপত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করাই ছিল মুসলিম লীগকে সমর্থনের পশ্চাতে তাঁদের সবচেয়ে বড় কারণ।
এতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেও জনগণের নিকট অর্থনীতিই বড় ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ একেবারে পশ্চাদপদ হয়ে পড়েছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী ও জমির মালিকানা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দুদের হাতে চলে যায়। যারা ছিলেন একদিন ভূমির মালিক তাঁদের অনেকেই হয়ে পড়েলেন ভূমিহীন। একদিকে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে হিন্দু সমাজ চাকুরীর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকলেন। আর মুসলিম সমাজ ডুবে থাকলেন ধর্মীয় কুসংস্কার
পৃষ্ঠা নংঃ ৩০

ও অশিক্ষার অন্ধকারে। হিন্দু জমিদার, চাকুরীজীবিদের সাথে সাথে সৃষ্টি হ’ল মহাজন শ্রেণী। মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের শোষণে কঙ্কালসার মুসলিম সমাজ জর্জরিত হয়ে পড়লেন। কি চাকুরী, কি বাণিজ্য, কি শিক্ষা, কি রাজনীতি কোন দিকেই তাঁদের সুযোগ-সুবিধা মিললো না। ইংরেজী ভাষাকে উপেক্ষা করায় এই মুসলিম সমাজ হিন্দুদের তুলনায় প্রায় একশত বছর পেছনে পড়ে রইলেন। ফলে চাকুরীর ক্ষেত্রে হিন্দুরা পর্যাপ্ত পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে লাগলেন আর মুসলমানেরা ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে গ্রাম্য জীবনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে রইলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের অধিক পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দিতে শুরু করলেন। সমাজে আর্থিক বৈষম্য দেখা দিল নিদারুণভাবে। হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে ব্রিটিশ সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছেন। সুতরাং বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানিয়েছেন আর্থিক ও সামাজিক মুক্তির তাড়নায়। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ-এর বিজয় এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলার শোষিত, নির্যাতিত, উৎপীড়িত মুসলমান পাকিস্তান বলতে এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে শুধু ধর্মীয় নিরাপত্তাই থাকবে না, থাকবে আর্থিক মুক্তির ও শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থার এর নতুন সম্ভাবনা। সুতরাং পাকিস্থান একমাত্র ধর্মীয় কারণে সৃষ্টি হয়েছিল, একথা সত্য নয়। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের পাকিস্তানের আন্দোলনে ঝুঁকে পড়ার পেছনে কতকগুলো যুক্তিসংগত কারণ ছিল। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তৎকালীন মোগল সম্রাটের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করেন। তারপর ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানী এক ঘোষণায় জানালেন যে, প্রজাদের উপর করের বোঝা চাপানো তাঁদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এসে দেখা গেল কোম্পানীর এই প্রতিশ্রুতি লংঘিত হয়েছে এবং প্রজাদের ওপর জোর-জুলুম ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।……………….
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেনঃ
‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী
দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।’
পৃষ্ঠা নংঃ ৩১

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ভিন্নতর। যেনতেন প্রকারেন এ দেশের সম্পদ শোষণ ক’রে, লুণ্ঠন ক’রে এ দেশের মানুষকে রিক্ত, নিঃস্ব ক’রে সাম্রাজ্য বিস্তার করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। একদিকে কোম্পানী অন্য দিকে কোম্পানীর কর্মচারীরা এদেশের সম্পদ শোষণ ক’রে বাংলার মানুষকে এক মহা দুর্যোগের সম্মুখীন ক’রে তুলেছিল। এর ফলেই বাংলার মানুষের ভাগ্যে নেমে এসেছিল দুর্যোগের ঘনঘটা-ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সত্যি কথা বলতে কি, এই দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির তেমন কোন কারণই বিদ্যমান ছিল না। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কৃত্রিম, এর জন্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অব্যবস্থা ও অসদুদ্দেশ্যই মূলতঃ দায়ী ছিল। এ প্রসংগে সুপ্রকাশ রায়ের একটি ইংরেজী গ্রন্থ থেকে অনূদিত গ্রন্থ ‘ভারতে কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ (১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩-১৪) থেকে সংশ্লিষ্ট উক্তি স্মরণ করা যায়ঃ
“তাহাদের মুনাফা শিকারের পরবর্তী উপায় হইল চাউল কিনিয়া গুদামজাত করিয়া রাখা। তাহারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবন ধারণের পক্ষে অপরিহার্‍্য এই দ্রব্যটির জন্য তাহারা যে মূল্যই চাহিবে তাহাই পাইবে। চাষীরা তাহাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফসল অপরের গুদামে মজুদ হইতে দেখিয়া চাষবাস সম্বন্ধে উদাসীন হইয়া পড়িল। ইহার ফলে দেখা দিল খাদ্যাভাব। দেশে যাহা কিছু খাদ্য ছিল তাহা ইংরেজ বণিকদের একচেটিয়া দখলে চলিয়া গেল। ……খাদ্যের পরিমাণ যত কমিতে লাগিল ততই দাম বাড়িতে লাগিল, শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃখময় জীবনের উপর পতিত হইল এই পুঞ্জীভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু ইহা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।
“এই হতভাগা দেশে দুর্ভিক্ষ কোন অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নহে। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিল, তাহা এমন কি ভারতবাসীরাও আর কখনও চোখে দেখে নাই বা শুনে নাই।
পৃষ্ঠা নংঃ ৩২

চরম খাদ্যাভাবের এক বিভীষিকাময় ইংগিত লইয়া দেখা দিল ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দ; সংগে সংগে বাংলা ও বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক তাহাদের সকল আমলা, গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী, যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সে সেইখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান চাউল ক্রয় করিতে লাগিল। এই জঘন্যতম ব্যবসায় মুনাফা হইল এত শীঘ্র ও এরূপ বিপুল পরিমাণে যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এই ব্যবসা করিয়া দুর্ভিক্ষ শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার পাউণ্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) ইউরোপে পাঠাইয়া দিলেন।”
জনাব বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থের ৫ম পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ “দুর্ভিক্ষের পূর্বে বাংলাদেশের রাজস্ব ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দে ছিল ১,৫২,০৪,৮৫৬ টাকা কিন্তু দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ খ্রীস্টাব্দে প্রদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১,৫৭,২৬,৫৭৬ টাকায়।”
দেশের মানুষকে শোষণ ক’রে বছরে যে রাজস্ব আদায় করা হ’ত তাঁর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশী পরিমাণ অর্থ বিলাতে পার হয়ে যেত। এই অর্থনৈতিক শোষণের প্রতিক্রিয়া হিন্দু সমাজের চেয়ে মুসলিম সমাজেই অধিক প্রতিফলিত হয়েছিল। সেদিনের বাংলাদেশে অভিজাত শ্রেণীর মুসলমান যে ছিল না তা’ নয়-কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। কৃষক ও শ্রমজীবী-এই দুই ধরনের মেহনতী মানুষ নিয়েই গড়ে উঠেছিল বৃহৎ মুসলিম সামাজিক কাঠামো । এ সম্পর্কে ডঃ আনিসুজ্জামান একটি চমৎকার উক্তি করেছেনঃ
“মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশের কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে মুসলমানদের যে প্রাধান্য ছিল, এখন অনুমান করা চলে। অতএব ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ প্রজাদের যে দুর্দশার কথা আমরা বলেছি, ঘটনাক্রমে তাদের অধিকাংশই ছিলেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী।”
[ ডঃ আনিসুজ্জামান : মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, পৃঃ ৯ ]

ইংরেজ বেনিয়াদের অত্যাচার
এখন দেখা যাক, কৃষক ও শ্রমজীবী কিভাবে ইংরেজ কর্তৃক শোষিত হয়েছিল। উইলিয়ম বোল্টস নামক জনৈক ইংরেজ বণিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়ঃ
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৩

“তাঁতিদের সাধ্যাতীত পরিমাণ কাপড় বয়ন করে দেবার চুক্তি করতে বাধ্য করা হ’ত। যারা কাঁচা রেশম বয়ন করত, তাঁদের উপর অত্যাচার এতো বেশী হয়ে গিয়েছিল যে, অনেক সময় এই অবাধ্য দাবী এড়াবার জন্য তাঁরা নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে ফেলত। ….সাধারণতঃ রায়তেরাই হ’ত একাধারে চাষী ও কারিগর; খাজনা মেটাবার জন্যে গোমস্থাদের অত্যাচারের ফলে তাদেরকে দেশ ছেড়ে পালাতে হ’ত কিংবা ছেলেমেয়ে বিক্রি করতে হ’ত।
“তাছাড়া কোম্পানীর এজেন্টদের নির্দিষ্ট মূল্যে মাল বিক্রি না করলে তাঁতিদের কোম্পানীর ফ্যাক্টরীতে অবরুদ্ধ ক’রে রাখা হ’ত, এমনকি এই রকমের অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে বন্দী তাঁতিদের মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে হ’ত।”
[ Ramesh Datta: The Economic History of India under Early British Rule, 3rd Ed. 1908, p. 2527]

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
এ ধরনের নির্যাতন চালিয়েই যে কোম্পানী সরকার ক্ষান্ত হয়েছিলেন তা’ নয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ভূমি রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছে এক নতুন প্রস্তাব পেশ করেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে সুপরিচিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বণিক শাসকগোষ্ঠী সৃষ্টি করলেন একটি নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণী, যাদের নাম জমিদার। এঁরা প্রতি বৎসর একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক কোম্পানীকে দিতে বাধ্য থাকবে এবং কোম্পানীর ঘরে ঐ পরিমাণ অঙ্ক পৌছিলেই জমিদারগণ বংশপরম্পরায় উক্ত জমিদারীর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকবে। এমন কি, জমির মূল্যর হ্রাস-বৃদ্ধিতে কোম্পানীর বন্দোবস্তের কোন হেরফের হবে না। এই ব্যবস্থায় সুচতুর শাসকগোষ্ঠীর ভাণ্ডারে বিনা আয়াসে রাজস্ব জমা হতে থাকল। অন্য দিকে সৃষ্টি হ’ল একটি সামন্ত শ্রেণী, যারা কোম্পানীর তাবেদার এবং বশংবদ সেজে দশকে শোষণ করতে লাগলো। এই সমস্ত শ্রেণীর অধিকাংশ লোকই ছিল অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের। এরা জমিদারী লাভ করবার পর রাজস্ব আদায়র জন্য
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৪

যে সমস্ত লোক নিযুক্ত করা হ’ল তারাও হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত। এই ভাবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী-প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদার, ইজারাদার, তহসীলদার ইত্যাদি শ্রেণীর লোকদের আর্থিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে গেল এবং তাঁর পরিণামে সমাজে শ্রেণীবৈষম্য দিনের পর দিন প্রকট হয়ে দেখা দিল। আর এই সামন্ত শ্রেণির লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য জনসাধরণের উপর করের ও খাজনার বোঝা চাপিয়ে দিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ ও অন্যান্য উপায়ে দেয় টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দিল। শোষণের যাঁতাকলে বাংলার সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে উঠল। নরহরি কবিরাজ যথার্থই লিখেছেনঃ “কৃষকদের উপর তাদের অত্যাচার এত চরমে উঠল যে ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে রংপুর ও দিনাজপুরে শেষ পর্যন্ত কৃষকেরা মরিয়া হয়ে ইজারাদারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ” তিনি ইংরেজ শাসন-ব্যবস্থার সংকীর্ণ ভূমিকার চিত্রটি তুলে ধরে কৃষকদের দুরবস্থা সম্পর্কে আরো লিখেছেনঃ “মুঘল যুগে জমির উপর মালিকানা না থাকলেও দখলিস্বত্ব ছিল কৃষকদের। রাষ্ট্র জমির মালিক ছিল না। জমির উপর প্রধান অধিকার ছিল তার যে জমি কর্ষণ করত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এইদিকে অগ্রগামী পরিবর্তনের সূচনা না ক’রে পশ্চাদগামী পরিবর্তনের সূচনা করল। কৃষকদের যে অধিকার ছিল তা’ সর্বাংশে কেড়ে নিয়ে জমিদারদের মালিকানাস্বত্ব দেওয়ার ফলে কৃষকেরা শক্তিশালী জমিদারের অর্ধদাসে পরিণত হল।”
[ স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, পৃঃ ৩০]
সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী মুঘল আমলের জমিদার শ্রেণীর ধ্বংস সাধন ক’রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পত্তন করে। মুঘল আমলীয় জমিদারদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা কোম্পানীর প্রভুত্ব স্বীকার করলেও ভেতরে ভেতরে তাঁদের মনে অসন্তোষ ছিল। এঁদের সম্পর্কে ওয়ারেন হেস্টিংস বলেছিলেন, “বড় বড় জমিদারেরা তাঁদের প্রচণ্ড প্রভাব ব্যবহার করে থাকেন সরকারের বিরুদ্ধে এবং সেই জন্যই তাঁদের প্রভাব নষ্ট করা বাঞ্ছনীয়।”
[ Introduction to the fifth Report, নরহরি কবিরাজ উদ্ধৃত, পৃঃ ৩২]
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৫

লর্ড কর্নওয়ালিস উপলব্ধি করেছিলেন যে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে ভারতে টিকে থাকতে হলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী কারণ এই প্রথার ভেতর দিয়ে কতকগুলো জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হবে যারা কোন মতেই কোম্পানীর স্বার্থের প্রতিকূলে যাবে না। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেনঃ “আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই (এদেশের) ভূ-স্বামিগণকে আমাদের সহযোগী করিয়া লইতে হইবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূ-সম্পত্তি নিশ্চিত মনে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করিতে পারে, তাহার মনে উহার কোন পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগিতেই পারে না।”
[ সুপ্রকাশ রায়: ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃঃ ১৩]
গ্রাম বাংলার কৃষক বিদ্রোহের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে জমিদার শ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এক সরকারী ভাষণে বলেছিলেনঃ
“আমি এটা বলতে বাধ্য যে ব্যাপক গণবিক্ষোভ অথবা গণবিপ্লব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়েছে। অন্যান্য অনেক দিক দিয়ে, এমন কি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যর্থ হলেও, এর ফলে এমন এক বিপুল সংখ্যক ধনী ভূস্বামী শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে যারা বৃটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে আগ্রহশীল এবং জনগণের উপর যাঁদের অখণ্ড প্রভুত্ব বজায় আছে।”
[ Lord William Bentick: Speech-Quoted in R.P. Dutt, India To-day, p. 218]
কোম্পানী-পুষ্ট নতুন ভূস্বামী সম্প্রদায় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অথবা প্রায় সামগ্রিকভাবেই হিন্দু পরিবার থেকে উদ্ভূত, একথা ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেন। এই প্রসঙ্গে আমি আবার নরহরি কবিরাজ মহাশয়কে স্মরণ করিঃ
“প্রথমেই কাসিম বাজারের রাজপরিবারের উৎপত্তির কথা ধরা যাক, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা কান্তবাবু ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান ছিলেন। হেস্টিংসের কৃপায় নাটোরের রাজার জমিদারির কিছুটা
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৬

আত্মসাৎ ক’রে তিনি বিরাট জমিদারির মালিক হন। হেস্টিংসের অনুগ্রহে তাঁর মুন্সী নবকিষণ কলকাতার সবচেয়ে বড় জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ইনিই শোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা।
“ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যখন হুগলী থেকে কলকাতা, সূতানটী, গোবিন্দপুরে এসে বসতি স্থাপন করল, তখন তাদের সঙ্গে হুগলীর একদল সুবর্ণ বণিক এল কলকাতায়। এই সুবর্ণ বণিক সমাজের একজন প্রধান লক্ষীকান্ত ধর ওরফে নকু ধর কোম্পানীরকে ঋণ দিয়ে সাহায্য করেন। ইনিই আবার প্রথম মারাঠা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্যে ইংরেজকে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। কোম্পানী তাঁর পৌত্রকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। এই লক্ষীকান্তের বংশধরেরাই কলকাতার প্রসিদ্ধ পোস্তার রাজপরিবার।
………….এইভাবে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার, জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার, বড় বাজারের মল্লিক বংশ, সিমলার ছাতু বাবুর বংশ, হাটখোলার দত্ত পরিবার-এই সব বংশের সম্পত্তি ও সমৃদ্ধি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অনুগ্রহে।”
[ স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, পৃঃ ৩৩]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কোম্পানীর পক্ষপাতমূলক আচরণে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে একটি নতুন অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী হিন্দু জমিদার ও জমিদার-সংলগ্ন শ্রেণী গড়ে উঠে এবং যে মুষ্টিমেয় মুসলিম বিত্তশালী শ্রেণী বাংলার মাটিতে সুদীর্ঘকাল শিকড় গেড়ে বিরাজমান ছিলেন, তাঁদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে বিলোপ হয়ে যায়। নতুন যে আর্থিক চক্র জমিদারদের কেন্দ্র ক’রে গড়ে উঠে এবং যে আর্থিক লেনদেনের বৃত্ত (Circle of monetary circulation) সৃষ্টি হয়, দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় এবং নিম্নবিত্ত তফসিলী সম্প্রদায় তা’ থেকে দূরে সরে পড়ে। দিনে দিনে এদেশে যে হ্যাভনটদের বা বঞ্চিতদের সমাজ গড়ে উঠে তারা মুসলিম এবং মুষ্টিমেয় অস্পৃশ্য হিন্দু। অর্থনৈতিক অবস্থার সাথেই নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা সমাজের রাজনৈতিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সাথে তার ফলশ্রুতি তাঁদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও জাজ্জ্বল্যমান
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৭

হয়ে উঠল। সমাজ জীবনের যে নতুন নাটকের অভিনয় শুরু হ’ল ধীরে ধীরে মুসলীম সমাজ তার পশ্চাদ পটভূমিকায় পর্দার অন্তরালে গিয়ে দাঁড়ালেন, আর সম্মুখ মঞ্চে মুখর হয়ে এগিয়ে এলেন নবজাগ্রত সামন্ত হিন্দু সম্প্রদায় এবং তাঁদের অনুগ্রহ-পুষ্ট বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। তফসিলী সম্প্রদায় এবং নিম্নবিত্তভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থাও মুসলমানদের সমপর্যায়েই বিচার্য। তবে তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং সমাজের উঠানামায় তাদের অবদান তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না।

নীলকরদের অত্যাচার
এই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর একটি অত্যাচার, যার প্রতিক্রিয়া সমগ্র কৃষি-নির্ভর সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইতিহাসে এর নাম নীলকর অত্যাচার। বাংলার হতভাগ্য কৃষক সমাজের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সেদিনের সভ্যাতাকে ম্লান করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে তৎকালীন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিলঃ
“নীলকরদিগের কার্যের বিবরণ করিতে হইলে কেবল প্রজা পীড়নেরই বৃত্তান্ত লিখিতে হয়। তাহারা দুই প্রকারে নীল প্রাপ্ত হয়েন, প্রজাদিগকে অগ্রিম মূল্য দিয়া তাহারদের নীল ক্রয় করেন, এবং আপনারা ভূমি কর্ষণ করিয়া নীল প্রস্তুত করেন। সরল-স্বভাব সাধু ব্যক্তিরা মনে করিতে পারেন, ইহাতে দোষ কি? কিন্তু লোকের কত ক্লেশ, কত আশাভঙ্গ, কতদিন অনশন, কত যন্ত্রণা যে এই উভয়ের অন্তর্ভূক্ত রহিয়াছে, তাহা ক্রমে ক্রমে প্রদর্শিত হইতেছে। এই উভয়ই প্রজানাশের দুই অমোঘ উপায়! নীল প্রস্তুত করা প্রজাদিগের মানস নহে; নীলকর তাহারদিগের বল দ্বারা তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত করেন, ও নীলবীজ বপনার্থে তাহারদিগের উত্তমোত্তম ভূমি নির্দিষ্ট করিয়া দেন। দ্রব্যের উচিত পণ প্রদান করা তাঁহার রীতি নহে, অতএব তিনি প্রজাদিগের নীলের অত্যল্প অনুচিত মূল্য ধার্য্য করেন। নীলকর সাহেব স্বাধিকারের একাধিপতি স্বরূপ, তিনি মনে করিলেই প্রজাদিগের সর্বস্ব হরণ করিতে পারেন, তবু অনুগ্রহ ভাবিয়া দাদন স্বরূপ যৎকিঞ্চিত যাহা প্রদান করিতে অনুমতি করেন, গোমস্তা ও অন্যান্য আমলাদের দস্তরি ও হিসাবাদি উপলক্ষে তাহারও কোন না অর্দ্ধাংশ কর্ত্তণ যায়? এ কারণে প্রজারা
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৮

যে ভুমিতে ধান্য ও অন্যান্য শষ্য বপন করিলে অনায়াসে সম্বৎসর পরিবার প্রতিপালন করিয়া কালযাপন করিতে পারে, তাহাতে নীলকর সাহেবের নীল বপন করিলে লাভ ভাব দূরে থাকুক, তাহারদিগের দুশ্ছেদ্য ঋণ জালে বদ্ধ হইতে হয়।”
[ বিনয় ঘোষ সম্পাদিত সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজ চিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১২৬]
নীলকরদের প্রতি দেশবাসীর ঘৃণা ধীরে ধীরে প্রবল হয়ে দেখা দেয়, শুধু পত্র-পত্রিকায় নয়, সেকালের নাটকে, অভিনয়ে, গানে তাদের প্রতি ঘৃণা বাণীরূপ লাভ করে। এ জাতীয় রচনার বিশিষ্টতম নিদর্শন দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’। তৎকালীন লোকসাহিত্যেও এই অত্যাচারের প্রচণ্ডতা প্রতিবিম্বিত হয়েছে; একটি তৎকালীন জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের অংশবিশেষ স্মরণ করিঃ
নীল বাঁদরে সোনার বাংলা
কল্লে এবার ছারখার
অসময়ে হরিণ মোল
লংয়ের হল কারাগার
প্রজার প্রাণ বাঁচানো ভার…….
নীলকর সাহেবেরা কৃষকদের নীল উৎপাদনের জন্য অগ্রিম টাকা দিত। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে যদি পর্যাপ্ত নীল উৎপন্ন না হ’ত তথাপি কৃষককে এই অগ্রিম পরিশোধ করতেই হ’ত। এছাড়া নীল চাষের জন্য নিযুক্ত যাবতীয় কর্মচারীর বেতনও বহন করতে হ’ত কৃষকদের। নীলকরগণ বেতনভুক পুলিশ ও লাঠিয়াল পুষতেন। টাকা যথাসময়ে না দিলে লাঠিয়াল লাগিয়ে কৃষকদের মালামাল নিয়ে আসা হ’ত। সমস্ত দক্ষিণ বাংলা, পশ্চিম বাংলা ও উত্তর বাংলার অংশ বিশেষ এই অত্যাচারে রিক্ত, নিঃস্ব ও জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি দুটো উক্তি এখানে স্মরণ করা যায়ঃ
In a good year a ryot could produce enough indigo to repay his advance and collect a small profit; in a bad year his expenses exceeded his advance. One fault of the indigo
পৃষ্ঠা নংঃ ৩৯

System of lower Bengal was that the risk of crop failure fell directly upon the riot.
[ Blair B. King: The Blue Mutiny, University of Pennsylvania Press, Philadelphia, 1966 P. 25]
The meager salaries of these employees were augmented by unauthorized commissions exacted form the cultivators.
[ Report of the Indigo Commission, 1860, A, 2092]
The police or military division of the staff consisted of lathiyals, bands of professional warriors armed with lathis or sticks. The majority were natives of Faridpur and Pabna where entire villagers hired out as lathiyals.
[ W.S. Seton-kar: Indigo in Lower Bengal, Calcutta Review, VII (Jan-June 1847), 186-219, and Lal Behari Day, Bengal Peasant Life (London, 1909), P. 327]
এইসব অত্যাচারের সমগ্র প্রতিক্রিয়া পড়তো বাংলাদেশের কৃষক শ্রেণীর উপর যাদের প্রায় শতকরা ষাট-সত্তর জন ছিলেন মুসলমান। একদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ও ইংরেজী ভাষার প্রতি অনীহা থাকায় তাঁরা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছিলেন অন্যদিকে নীলকরদের অত্যাচার, কোট-কাছারীতে বিচারের নামে প্রহসন সবকিছু মিলিয়ে মুসলিম সমাজে বিতৃষ্ণার ধোঁয়া ঘনীভূত হতে থাকে। মুসলিম কৃষক ও নিম্নবিত্ত শ্রেণী ক্রমেই সমাজ-জীবনের তলদেশে তলিয়ে যেতে শুরু করলেন। জমিদার, মহাজন, শাসক সবাই এই সমাজের মাথার উপর চেপে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথ নির্মাণ করল। এর পরিমাণ ব্রিটিশ শাসনের জন্য যেমন ভয়াবহ হতে থাকল, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়ে উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই তার পরিণামও চূড়ান্ত অকল্যাণের দিকেই যাত্রা করল। একটি শ্রেণীকে বঞ্চিত করে আর একটি শ্রেণী চিরকাল বড় হতে পারে না। ব্রিটিশের সঙ্গে আঁতাত সৃষ্টি করে মুসলিম সমাজকে বঞ্চনার পথে ঠেলে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়েরও যে কল্যাণ হয় নি, পরবর্তী ইতিহাসই তা’ প্রমাণ করেছে।

উচ্চবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা
যাহোক, বৃহত্তর মেহনতী মুসলিম সমাজের যখন এইরূপ অর্থনৈতিক দুরবস্থা, তখন মুষ্টিমেয় উচ্চ মুসলিম সমাজের অবস্থাও যে খুব সন্তোষজনক
পৃষ্ঠা নংঃ ৪০

ছিল এমন নয়। এ সম্পর্কে হান্টার সাহেব বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতেঃ
“মুসলমান উচ্চবিত্তের উপরে প্রথম আঘাত আসে নবারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্কোচনের ফলে। নবারের আশ্রিত মুসলমান কর্মচারী, সভাসদ, জায়গীরদার ও অনুগ্রহিতেরা সর্বপ্রকার পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হন। ইংরেজ আধিপত্যের সূচনায় অনেকে বাংলাদেশ ত্যাগ ক’রে অন্যত্র ভাগ্যান্বেষণে চলে যান, এমন কথাও শোনা যায়।”
[ W.W. Hunter: The Statistical Account of Bennal, Vol. IX, London, 1876. ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃঃ ৯]
হান্টার সাহেব আরো মত প্রকাশ করেছেনঃ “নবাবী আমলে অভিজাত মুসলমানদের অর্থাগমের তিনটি প্রশস্ত পথ ছিল- সামরিক পদ লাভ, রাজস্ব ভোগ আর বিচার ও রাজনৈতিক নিয়োগ। কোম্পানী আমলে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন ও ছাটাইয়ের ফলে অনেকে চাকুরী হারালেন। কোম্পানীর দেওয়ানী লাভের প্রথম কয়েক বৎসর পর্যন্ত রাজস্ব বিভাগে মুসলমান কর্মচারীদের আধিপত্য ক্ষুণ্ন হয় নি। কিন্তু নতুন রাজস্ব ব্যবস্থায়, বিশেষতঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইংরেজ কালেকটরদের নিয়োগ হতে থাকায়, এদের স্থান সংকুচিত হয়।”
[ W. W. Hunter: The Indian Musalmans, 3rd Ed., London, 1876, P. 159]
অবশ্য মুসলমান সম্প্রদায় এতদিন যে সমস্ত অধিকার ভোগ করে এসেছেন তার সবই যে ন্যায়সঙ্গত একথা বলব না। য়ুরোপীয় মানবতাবাদে বিশ্বাসী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী এদেশে যে মানবতাবাদী আইন ও শিক্ষা প্রবর্তন করেন, মুসলিম সম্প্রদায় অকারণে তার প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে থাকেন। এতে এই সমাজের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ হয়েছে অনেক বেশী। একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করি। থম্পসন ও ক্যারেট বর্ণনা করেছেনঃ
“কর্ণওয়ালিসের আরেকটি সংস্কার শিক্ষিত মুসলমানকে অন্ততঃ
পৃষ্ঠা নংঃ ৪১

বড় রকম মানসিক আঘাত দিয়েছিল। নবাবী আমলে ‘কাফের’দের সাক্ষ্যে কোন মুসলমানের প্রাণদণ্ডাদেশ হতে পারত না। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না বলে ১৭৯২-তে গভর্নর জেনারেল এই নিয়ম রহিত করেন।”
[ Rise and Fulfilment of British Rule in India, 2nd Ed., London, 1935, P. 194]
মুসলমানদের এই মানসিক আঘাত যে অমানবিক সেকথা আর ব্যাখার প্রয়োজন করে না। অনুরূপভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রেও ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে মুসলিম সম্প্রদায় সুদীর্ঘকাল ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। যাহোক, মানবিকতা ও শিক্ষার পসঙ্গ ছেড়ে আমাদের প্রাক্তন প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।

লাখেরাজ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
একথা প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে যে, বাংলার মুসলমান সমাজ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল; এছাড়া কোম্পানী-প্রবর্তিত লাখেরাজ-সম্পত্তি আইনের আওতায় অনেক মুসলমান পরিবার যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে শ্রী বিমান বিহারী মজুমদার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা’ প্রণীধানযোগ্যঃ
“১৭৯৩ থেকে ১৮২৮ পর্যন্ত লাখেরাজ-সম্পত্তি সম্পর্কে অনেকগুলো আইন তৈরী হয়। এই সব আইন-কানুন লোকসাধারণের গোচরীভূত করার কোন ব্যবস্থা হয় নি। ফলে, অনেকের সম্পত্তি তাদের অগোচরেই নতুন আইন অনুযায়ী বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এসব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আবেদন করেও সাধারণতঃ কোন ফল হ’ত না।
লাখেরাজ-সম্পত্তির বাজেয়াপ্তির ফলে মুসলমান উচ্চবিত্তের পতন হয়, এই মত লোকপ্রিয়। এই ব্যবস্থায় মুসলমানদের ক্ষতি হ’ল ঠিকই, কিন্তু এ ক্ষতি কেবল তাদেরই হ’ল না। দেবোত্তর সম্পত্তির বাজেয়াপ্তিতে হিন্দুর ক্ষতিও কম হয় নি। কিন্তু হিন্দু সমাজ অন্য ভাবে (যেমন, নতুন জমিদারী লাভ ক’রে বা কোম্পানীর চাকুরী গ্রহণ ক’রে বা ইংরেজ বণিকদের সহকারী হয়ে) নিজেদের পুনর্গঠন করতে পেরেছিলেন, মুসলমানেরা সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন নি।’
[History of Political Thought, Calcutta, 1934, Vol. I PP. 390-91]
পৃষ্ঠা নংঃ ৪২

ব্রিটিশদের শিক্ষানীতি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মনোভাব
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই ভারতবর্ষে ইংরেজী শিক্ষা আমদানী করেছিল। কিন্তু ১৮৩৫ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে দেশীয়দের কি ধরণের শিক্ষা দেওয়া হবে-এ বিষয়ে তাদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ ছিল। মেকলে সেই মতভেদের অবসান ঘটিয়ে যা বলেছিলেন সেই বহু-ব্যবহৃত উক্তিটি আমিও এখানে স্মরণ করিঃ
“আমাদের এখন যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণী সৃষ্টি করতে- যারা হবে আমাদের এবং আমরা যে লক্ষ লক্ষ লোককে শাসন করছি সেই শাসিতদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানকারী। এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা হবে রক্তে ও রঙে ভারতীয় আর রুচিতে, মতে, নীতিতে ও বুদ্ধিতে ইংরেজ।”
[মেকলে মিনিট, ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৩৫ -নরহরি কবিরাজ উদ্ধৃত, পৃঃ ৯২]
নবাবী আমলে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের জন্যই শিক্ষার মাধ্যম ছিল ফার্সী। ফার্সী ভাষার প্রতি মুসলমানদের যে একটি দুর্বলতা ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ইংরেজী ভাষা প্রবর্তনের পর সে কারণে হিন্দু সম্প্রদায় এ ভাষাকে যত সহজে গ্রহণ করতে পারলেন, মুসলমান সম্প্রদায় তা’ পারলেন না। এর ওপর যুক্ত হ’ল গোঁড়া ধর্মীয় সংস্কার। ফার্সীর সাথে আরবীর সাদৃশ্য আছে-আরবী কোরআনের ভাষা-আল্লাহ পাকের জবান। সুতরাং ফার্সীকে বর্জন করলে ধর্ম বিপন্ন হবে, ইংরেজী শিখলে সবাই ধর্মবিমুখ হবে এই ভয়টি মোল্লাদের মূর্খতার ফলেই হোক, অথবা অন্যান্য কারণেই হোক, মুসলিম সমাজে প্রচার লাভ করল। ইংরেজ-প্রবর্তিত নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মুখ ফিরিয়ে রাখবার ফলে মুসলিম সমাজ শিক্ষা ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক পশ্চাৎগামী যাত্রী হিসেবে পরিগণিত হলেন।
ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়াও অর্থনৈতিক কারণেও কৃষি-নির্ভর মুসলিম সমাজের পক্ষে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। কেননা ইংরেজী শিক্ষা ছিল তৎকালীন অর্থনৈতিক কাঠামোতে খরচ-সাপেক্ষ। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মুসলমান সম্প্রদায় দিনে দিনে আর্থিক সচ্ছলতা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং ইংরেজী শিক্ষা যখন প্রবর্তিত হ’ল, খুব কম
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৩

ক’জন অভিভাবকেরই তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে ইংরেজী স্কুল বা কলেজে পাঠানোর মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল। এর ওপর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সক্রিয় নিস্পৃহতাও মুসলমানদের শিক্ষার আগ্রহ ও সামর্থ্যকে স্তিমিত রাখতে সাহায্য করেছে। কলকাতা মাদ্রাসায় প্রথম দিকে ইংরেজী শিক্ষার কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নি। যদিও ১৮২৯-এর দিকে ইংরেজী ক্লাস চালু হয়, তথাপি সরকারী তত্ত্বাবধানের অদূরদর্শিতায় নানা অভাব-অভিযোগের সৃষ্টি হ’ল। এ সম্পর্কে ডক্টর মল্লিকের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্যঃ
“The obvious conclusion that suggests itself in respect of education under state patronage up to 1835 is that the Muslims who cared for education were not in any way prejudiced against receiving English or western education, but they had very limited opportunities of acquiring this education. The System and course of studies offered to them was defective and their only Institution was very badly managed and inefficiently run. Again, the early efforts of the company to educate the people were made in the city of Calcutta where the Hindus Predominated. The overwhelming Muslim majority district of East and North Bengal did not receive the much-needed attention to the Government till very late. Another factor was the known poverty of the Muslims which made it impossible for them to educate themselves without adequate help from the Government. Without ascribing any motive whatsoever, it can also be said that the policy of ruling authorities was often fettering and, in most cases, though well intentioned, it served to benefit the Hindus rather than Muslims.”
[Dr. A. R. Mallick: The British Policy and the Muslims f Bengal, Dacca,1961, P.193]
ইংরেজী শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনীহা ও পশ্চাদপদতার কারণ সম্পর্কে আরো একটি তথ্য এখানে উদঘাটন করা যায়ঃ
“এরপর শিক্ষা বিস্তারের জন্য নির্দিষ্ট সকল অর্থ যখন সরকার
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৪

কেবল ইংরেজী শিক্ষার জন্য ব্যয় করার সঙ্কল্প করলেন এবং গরীব ছাত্রদেরকে স্টাইপেণ্ড দেবার নিয়ম রহিত করে কেবল মেধার ভিত্তিতে স্বলারশীক দানের ব্যবস্থা করা হ’ল, তখন মুসলমান সমাজ প্রমাদ গুণলেন। এই দু’টি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলকাতার সকল সম্ভ্রান্ত মুসলমান ও মৌলভীসহ আট হাজার ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে প্রেরিত হয়। নীতিগতভাবে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ক’রে এতে বলা হয় যে, হিন্দু ও মুসলমানের শাস্ত্রালোচনার পথ বন্ধ করে সরকার যেভাবে শুধু ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চাইছেন, তার ফলে, প্রজাদের মনে এমন সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, সরকারের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে সকলকে খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত করা।”
[ A History of English Education in India (1781-1893) Aligarh, 1895 PP. 52-53, Sixth Report of the Select Committee of the House of Commons on Indian Territories, 12 A বর্ণিত H. H. Wilson -এর সাক্ষ্য থেকে উদ্ধৃত]
খ্রীস্টান মিশনারীরা খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ দেশবাসীর মনে যে সন্দেহের ও বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করেছিল,সে সব কথাও এই ঘটনার সঙ্গে স্মরণ করা সমীচীন।
ইংরেজী শিক্ষা বা ইউরোপীয় নব মানবধর্মে প্রণোদিত শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেও প্রথমদিকে শাসকগোষ্ঠীর মনে দ্বিধা সংকোচ ছিল। এদেশের মানুষ, বিশেষ করে পাক্তন শাসক সম্প্রদায় মুসলমানগণ যেন ইউরোপীয় বৈপ্লবিক চেতনার অধিকারী হতে পারে, এ সম্পর্কে কোম্পানী সরকার যথেষ্ট সচেতেন ছিলেন। লর্ড এলেনবরার (ডেসপ্যাচ, ১৮৫৮) বরাত দিয়ে নরহরি কবিরাজ বলেছেনঃ
“ছকে বাঁধা সংকীর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন হলেও নবপ্রবর্তিত বিদ্যালয়গুলিতে যারা শিক্ষা লাভের সুযোগ পেলেন তাঁরা ইংল্যাণ্ডের বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতি ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করলেন। কোম্পানীর বড় কর্তারা কেউ কেউ আশঙ্কা করতে থাকেন-ইউরোপের এই বিপ্লবী ভাবধারা ইংরেজী শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতবাসীর মনে বিদ্রোহের আকাঙ্ক্ষা
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৫

জাগরিত করবে। ১৮৫৮ সালে লর্ড এলেনবরা অভিযোগ করেন, ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের বিদ্রোহটি ইংরেজী শিক্ষার প্রসারে উৎসাহ পেয়েছে এবং তিনি সুপারিশ করেন ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দের ডেসপ্যাচটি এই কারণে প্রত্যাহার করা উচিত।”
[ স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, পৃঃ ৯৩]
মুসলমানদের সাংস্কৃতিক স্বাজাত্যবোধের পশ্চাতেও আত্মরক্ষার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে এবং শিক্ষার আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা নিজেদের ঐতিহ্য, ধর্মীয় অতীত ইত্যাদির মধ্যে অবগাহন করে তৃপ্তির ও যুক্তির সন্ধান করতে লাগলেন। আমি এই মানসিকতাকে পলায়নী মনোবৃত্তি বলে উল্লেখ করতে চাই। এ সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দীন উমর চমৎকার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেনঃ
“ইংরেজরা এদেশ দখল করার পর উচ্চশ্রেণীর মুসলমানরা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে শ্রেণীগতভাবে বঞ্চিত হ’ল। দফতর আদালতে, বিশেষতঃ ফৌজী ব্যবস্থায় তাদের পূর্ব কর্তৃত্বের অবসান ঘটল। তাদের মাথার উপর বসল ইংরেজ এবং পাশে দাঁড়ালো হিন্দু, শিখ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ভূক্ত ভারতীয়। অবস্থার এই পরিবর্তনকে তারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলো না…..রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন আন্দোলন অথবা অভ্যুত্থানের দ্বারা এ অবস্থার অবসান ঘটাতেও তারা সমর্থ হলো না। সুতরাং তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত হলো সাংস্কৃতিক জীবন ক্ষেত্রে। নিজেদের গৌরববোধ, স্বাজাত্য এবং সামন্ততান্ত্রিক অভিমানকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের চারিদিকে সৃষ্টি করলো নানান বাধার দেওয়াল, সৃষ্টি করলো এক সাংস্কৃতিক অচলায়তন, যে অচলায়তনের নাম মুসলিম সংস্কৃতি দিয়ে তারা উদ্যত হলো তার পরিচর্যা এবং স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে।”
[ সংস্কৃতির সংকট, পৃঃ ৪২-৪৩]

সাম্প্রদায়িক মনোভাবের উৎস ও বিকাশ
মুসলিম সংস্কৃতি নামক এই সাংস্কৃতিক অচলায়তনের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায় যত বেশী প্রাচীর নির্মাণ করতে লাগলেন, আত্মরক্ষার কবচ যতই তাঁদের মধ্যে সুদৃঢ় হতে থাকল ততই প্বার্শস্থিত সম্প্রদায়ের অগ্রগতি
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৬

লক্ষ্য করে হিংসার ও বিদ্বেষের বহ্নি তাঁদের মনে সঞ্চারিত হতে শুরু করল। এতোদিন যে প্রতিবেশী হিন্দু ভাইকে ‘দাদা’ অথবা ভাই বলে মনে হ’ত, এ চেতনা জাগ্রত হবার ফলে ধীরে ধীরে তাকে ‘কাফের’, ‘মুশরেক’ বা শত্রু বলে মনে হতে থাকল। হিন্দু দাদাও তার নতুন অর্থনৈতিক সংগতির দৌরাত্ম্যে পাশের মুসলমান ভাইকে শুধু শত্রু ভেবেই ক্ষান্ত হলেন না-তাকে ম্লেচ্ছ এবং অস্পৃশ্য মানুষ বলে বিবেচনা করতে থাকলেন। তৎকালীন সমাজের সর্বত্র এবং সর্বস্তরেই আমরা এই বক্তব্য অভ্রান্তভাবে সত্য ছিল-একথা বলবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে, সাম্প্রদায়িকতার যে বিদ্বেষ-বহ্নি বাংলার মাটিতে ধীরে ধীরে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, আমার উক্ত বক্তব্যে তার একটি মূল কারণ নিঃসন্দেহে সন্ধান করা যায়। এই ক্রমবর্ধমান হিংসা ও বিদ্বেষের মূলে ব্রিটিশ শক্তি যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়েছেন সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। শাসকগোষ্ঠীর ভেদ-বুদ্ধির ফলশ্রুতি পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলিম হানাহানি ও দাঙ্গার রূপ নিয়েছিল।
১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবার মধ্যেই ইংরেজদের ভেদ-বুদ্ধি নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম প্রধান অঞ্চলবৈশিষ্ট্য দুই ভাগে ভাগ করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতাকে একটি নতুন রূপ দান করেন। ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে নির্বাচনে মুসলমান সম্প্রদায় তাঁদের জন্য আলাদা নির্বাচনী এলাকা ও পৃথক প্রার্থীদের স্বীকৃতি লাভ করে আত্মতৃপ্তি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এর পরিণাম যে কিরূপ ভয়াবহ হতে পারে সে দূরদর্শিতা তখন তাঁদের ছিল না। কেননা তখন তাঁরা সাংস্কৃতিক অচলায়তনের অধিবাসী। পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দীন উমর যথার্থই বলেছেনঃ
“সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য মিলিত রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অনেকখানী নিশ্চিহ্ন হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল পৃথক নির্বাচন তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে বিলুপ্ত করলো।
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৭

ভারতবর্ষে জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হলো সংক্রীর্ণ শাসতান্ত্রিক পথে এবং পৃথক নির্বাচনের মহিমায় হিন্দু-মুসলমানের এক পথ ধরে চলার পথ হলো বন্ধ।”
[ সাম্প্রদায়িকতাঃ পৃঃ ১৫-১৬]

মুসলিম লীগের জন্ম ও উদ্দেশ্য
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকে অবশ্য শুধু সাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বিচার করা যায় না। ধর্মীয় নিরাপত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই এইরূপ একটি রাজনৈতিক দল গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। মুসলমানদের পৃথক অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে ঠেলে দিয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর বিভেদ নীতি এবং মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সমাজের বৈরী মনোভাব। নবজাগ্রত হিন্দু সমাজ মুসলমানকে অপাংক্তেয় ভেবে দূরে সরিয়ে রেখে ইংরেজ প্রভুদের নিকট থেকে সমগ্র সুযোগ-সুবিধা বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নিজেরাই ভোগ করবার ষড়যন্ত্রে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত ছিলেন। সুতরাং মুসলিম সমাজ সাংস্কৃতিক অচলায়তন সৃষ্টি করে আত্মপরায়ণ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এই বলে শুধু তাদেরকে একাই দোষী করা যায় না। এই প্রক্রিয়ায় হিন্দু সমাজের অবদান কম নয়। বিদেশী প্রভু আসলে যে এদেশের মানুষের শত্রু, সে মানুষ হিন্দু হোক, অথবা মুসলমান হোক, এ কথাটি ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ প্রথমদিকে একেবারেই উপলব্ধি করেন নি, পরের দিকে উপলব্ধি করেলেও মুসলমান সমাজ তার মধ্যে আন্তরিকতার সন্ধান খুব কমই পেয়েছে। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষমতা হস্তগত করে রাজত্বের স্বপ্নে হিন্দু মহাসভা এবং আর দু’একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন বিভোর হয়ে পড়েছিল। এমন কি ধর্মনিরেপেক্ষ রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের একটি শক্তিশালী অংশ পর্যন্ত এই সব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তাদেরকে ইন্ধন যোগাতেন। এসব কারণেই ব্রিটিশ ভারতে জাতীয়তাবাদ আন্দোলন যথার্থই একটি ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন বিকৃতির মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং সাম্প্রদায়িকতা সব কিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে এ
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৮

এক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ দুর্ভাগ্যের মাধ্যমেই ইতিহাসের ক্রমপরিণতি হিসেবে বাঙালীর জীবনে দেখা দিয়েছে সৌভাগ্যের প্রভাত-সূর্য, তার নাম বাংলাদেশ। পাকিস্তান এই পথ-পরিক্রমায় একটি সিঁড়ি মাত্র।
এতক্ষণ যে সব ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে এবং পরিবেশন করা হয়েছে যে সব তথ্য, তার সাহায্যে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমির জন্য যে কেন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা’ অনুধাবন করা সহজ হবে বলে মনে করি। এই প্রশ্নের উত্তরে আমার ব্যাখ্যা আশা করি, সুস্পষ্টই হয়েছে যে আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় নিরাপত্তা সামনে থাকলেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও আর্থিক মুক্তির বাসনাই ছিল বাঙালী মুসলিম সমাজের নিকট প্রধানত প্রেরণা। এই আন্দোলনে মুসলিম লীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছিল-বাঙালী মুসলমান সেই নেতৃত্বকে প্রথম দিকে অর্থাৎ পাকিস্তান অর্জন পর্যন্ত অর্থনৈতিক মুক্তির কারণেই বিশ্বস্তভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যেই মুসলিম লীগের বুর্জোয়া শ্রেণী-চরিত্র এবং সাম্প্রদায়িক চারিত্র উন্মোচনে বাঙালী মুসলিম সমাজের বিলম্ব ঘটে নি। ১৯৪৭ সাল থেকে পরবর্তী ঘটনাবহুল আন্দোলনসমূহ সে কথার প্রমাণ করে। আর এই আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা যেমন সুদূর প্রসারিত তেমনি দুর্বার।

পাকিস্তান আন্দোলনে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভূমিকা
দুর্ভাগ্যের বিষয় পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলাদেশ যখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, পাকিস্তানের অন্য অংশ যথা -পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ তখন এই আন্দোলনে দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা নিয়ে যোগ দিয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট নির্ধারণ করতে হয়েছে যে এখানকার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে যোগ দিবেন কিনা-তাঁদের মনে সুদীর্ঘকাল দ্বিধা-সংকোচ বিদ্যমান ছিল। পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর মানসিকতাও খুব সুস্পষ্ট ছিল না । অথচ যে বাংলাদেশ পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, প্রথম, থেকেই সেই বাংলাদেশকেই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এমন কি পাকিস্তান
পৃষ্ঠা নংঃ ৪৯

প্রতিষ্ঠার পূর্বে থেকেই এই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। বন্ধু গাজীউল হক একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেনঃ
The Pakistan resolution adopted by the Annual Convention of All India Muslim League in Lahore in 1940, it is useful to remember, was moved by the undisputed Muslim Leader of Bengal, Sher-e-Bangla A. K. Fazlul Haque. Prior to the final transfer of power Lord Mountbatten proposed an interim government of India in which he invited both the Indian Congress and Muslim League to participle. Jinnah decided to join the interim government on the 15th October, 1946. The panel of Ministers to represent the Muslim League included Nawabzada Liaquat Ali Khan, I. I. Chundrigar, Sardar Abdur Rob Nishtar, Raja Gaznafar Ali Khan and Jogendra Nath Mondal. It looks Significant in retrospect that stalwarts amongst the leaders of Muslim Bengal like A. K. Fazlul Haque, H. S. Shuhrawardy, Abul Hashem, or even ‘very loyal’ Khawja Nazimuddin were carefully avoided. …..This evasion is all the more ironic since only a few months back in a referendum on the partition issue ninety eight per cent of the Bengali Muslims had cast their votes in favor of the creation of Pakistan as against forty nine per cent of the Punjabi Muslims. The unequivocal Bengali mandate was used as the basis in the bargain for power but claims of the Bengali Leadership was by-passed in a very undemocratic manner. Subsequent history of Pakistan is the history of systematic elimination of Bengali leadership from positions of influence and power in Pakistan through a series of evasion, prevarication, deceit and undemocratic surreptitious maneuvers.
[ Bangladesh Unchained, Calcutta, 1971, P. 30]
ভারতীয় হিন্দুদের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়া হলে সেই দেশে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে ১৮৮৮
পৃষ্ঠা নংঃ ৫০

সালে ভারতের প্রখ্যাত মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ এই ধারণা প্রদান করেছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ যে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে এ কথা বলেছিলেন তা’ সত্য নয়। পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করবার জন্য তাঁর যে উৎকণ্ঠা ছিল সেই উদ্বেগ থেকেই তিনি এমন কথা বলেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর উক্তিটি উল্লেখযোগ্যঃ
“Is it possible that under these circumstances two nations- The Mohammadan and Hindu could sit on the same throne and remain equal in power? Most certainly not. It is necessary that one of them should conquer the other and thrust it down. To hope that both could remain equal is to desire the impossible and the inconceivable.”
[ Cited in Richard Symonds: The Making of Pakistan, London, P.31]
স্যার সৈয়দ আহমদ “পাকিস্তান” সৃষ্টির কথা বলেন নি। তবে ভারতে হিন্দু-মুসলমানের একত্রে বসবাস যে অসম্ভব তার ইংগিত তিনি দিয়েছিলেন। এর জন্য ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তাই তিনি ভারতীয় মুসলমানদের ইংরাজী শিক্ষার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলন। জাতি শিক্ষিত হয়ে না উঠলে নিজের অধিকার আদায় করতে অসমর্থ হবে। সত্যি কথা বলতে কি, স্যার সৈয়দ আহমদ পরোক্ষভাবে মুসলিম গণমনে জাতীয়তাবোধ সঞ্চার করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ইংরেজদের বিরোধিতা করেন নি, তবে মুসলিম জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোকের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে বাংলার মুসলমান ইংরেজ ও হিন্দু জমিদার, তহসিলদার, মহাজন কর্তৃক নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল-সে ইতিহাস আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অধিকাংশ মুসলমানই জমিদার শ্রেণী থেকে উদ্ভূত। সেখানে জমিদারদের নির্যাতন গণমনে বিশেষ কোন বিক্ষোভের সৃষ্টি করে নি। তবে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নির্যাতন যে কমবেশী বিদ্যমান ছিল একথা অস্বীকার করি না। ১৯০৫ সালে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা যখন বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য
পৃষ্ঠা নংঃ ৫১

ঐক্যজোট বেঁধেছিলেন এবং বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন তখনও পশ্চিম-ভারতে বিশেষতঃ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের জনগণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিলেন নিদারুণভাবে পশ্চাদপদ। এসব প্রদেশের অধিকাংশ মুসলিম বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দ কংগ্রসের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন এবং মুসলিম লীগের সাথে সহযোগিতা করেন নি। এ সম্পর্কে কে.কে. আজিজ সাহেবের উক্তিটি উল্লেখযোগ্যঃ
“It was an interesting feature of Muslim politics in India that the demand for Pakistan received greatly support in the Hindu majority province that in the Muslim majority province.
The Punjab was predominately Unionist till the end of 1945, Sindh did not take kindly to the Muslim League till 1946 and the Frontier Province maintained its Red Shirts in power till the Independence Day.”
[ K.K. Aziz: The Making of Pakistan, 1967, London, P. 205]
১৯০৬ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। নবাব সলিমুল্লাহ এর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেনঃ
(ক) “ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের রাজভক্তি বৃদ্ধি করা এবং সরকারী কার্যক্রমের ব্যাপারে তাদের মধ্যেকার ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটান;
(খ) ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও অধিকার আদায় এবং সংরক্ষণ করা; এবং যথাযোগ্য পদ্ধতিতে তাদের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয় সরকারের ওয়াকিফহাল করা; এবং
(গ) অপরাপর সম্প্রদায়ের প্রতি মুসলমানদের মধ্যে যাতে কোন বিদ্বেষের সৃষ্টি না হয়, তজ্জন্য, লীগের অপরাপর নীতি ব্যাহত না করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।”
[ আকবর উদ্দীনঃ কায়েদে আযম, পৃঃ ৭৩]
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের জোরদার হতে থাকে। বাংলার জনগণ কেন পাকিস্তান সৃষ্টির বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছিল এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল সেকথা পূর্বে বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণের মনে এই
পৃষ্ঠা নংঃ ৫২

আন্দোলনের তরঙ্গ তেমনভাবে নাড়া দিতে পারে নি। তাদের মনের ওপর দিনের পর দিন ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে হয়েছিল এবং প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা তাদের মনে তেমন কোন আবেদন সৃষ্টি করে নি। বিশেষতঃ পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণ ও নেতৃবৃন্দকে মুসলিম লীগের ছায়াতলে একত্রিত করতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে কষ্ট পেতে হয়েছিল। জিন্নাহর জীবনী লেখক বলেছেনঃ
“১৯৩৭ -এর নির্বাচনে পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ প্রার্থীগণ মোটেই সুবিধা করতে পারেন নাই। স্যার ফজলে হোসেন-প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নিস্ট পার্টি জয়ী হয়। ..১৯৩৭ সালে লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে সিকান্দার হায়াত দলীয় মুসলীম সদস্যদের নিয়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। বাংলার মতো পাঞ্জাবের দুর্ভাগ্য ছিল যে, উক্ত প্রদেশেও শিখ ও হিন্দুরা ছিল সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মালিক ও অত্যান্ত প্রতিপত্তিশালী। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব সমর্থন করার জন্য সিকান্দার হায়াতকে শিখ ও হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সিকান্দার হায়াত প্রকৃতপক্ষে ভারত বিভাগ প্রস্তাবের আন্তরিক সমর্থন ছিল না। …কায়েদে আযম তাঁর মনোভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তিনি হঠাৎ কিছু করারও পক্ষপাতী ছিলেন না। যতদিন পাঞ্জাবে মুসলিম জনগণের মত লীগের পক্ষে সুসংবদ্ধ না হয়, ততদিন তিনি সিকান্দার হায়াতকে প্রকাশ্য বিরোধিতা করার সুযোগ দিতে চান নাই। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে সিকান্দার হায়াতের মৃত্যুর পর পাঞ্জাবের বৃহত্তম জমিদার খিজির হায়াত খান তিওয়ানা ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতা প্রাদেশিক উজীরে আলা নির্বাচিত হন। খিজির হায়াত সিকান্দার হায়াতের দু’মুখী নীতি অনুসরণ করতে থাকেন।
…পাঞ্জাবের গভর্নর ও ব্রিটিশ শাসকবর্গ এবং ভারত সরকার তাঁকে লীগের আওতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। …কায়েদে আযম প্রথম দিকে খিজির হায়াতের দু’মুখী নীতি সত্ত্বেও কোন প্রকার গুরুতর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে পাঞ্জাবের মুসলমানদের লীগের পতাকাতলে সঙ্ঘবদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকেন-যাতে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ইউনিয়নিস্ট পার্টির ক্ষমতা ধ্বংস করা সম্ভব হয়। ১৯৪৪ সালের মার্চ
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৩

ও এপ্রিল মাসে কায়েদে আযম লাহোরে গিয়ে খিজির হায়াত ও ইউনিয়নিস্ট দলীয় অন্য মুসলিম সদস্যদের ‘ইউনিয়নিস্ট পার্টি মন্ত্রিসভা’র পরিবর্তে ‘মুসলিম লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা’ নামকরণের প্রস্তাব করেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং হিন্দু ও শিখ সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার দরুন কায়েদে আযমের আপোষ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।”
[ আকবর উদ্দীনঃ কায়েদে আযম, পৃঃ ৬৩০-৬৩১]
পাঞ্জাবের অবস্থা সম্বন্ধে আরো বলা যায়ঃ
“In the Punjab Assembly elected in 1937, only two members were returned on the League ticket. One of them Raja Ghazanfar Ali Khan, joined the Unionist Party, which secured 96 seats out of 175. The Chief Minister, Sikander Hayat Khan, joined the Muslim League at the Lucknow session of the League held in October, 1937. However, he remained the ‘coalitionist first and Leaguer second’, and maintained the separate existence of the Unionist Party. In spite of Sikander Hayat khan’s reconciliatory attitude towards the Hindus and Shikhs, there were frequent ‘Scenes’ in the legislature on communal issues. After Sikander Hayat Khan’s death in 1942, Khizr Hayat Khan, the Minister for local-self-government formed a ministry and included Sikander’s son, Saukat Hayat Khan, as minister for public works, who was later dismissed in 1945 on charges of corruption and maladministration. Khizr Hayat Khan was less willing to co-operate with the Muslim League. In the elections of 1946, the Muslim League own 79 out of 86 Muslim seats but with the support of the provincial governor and Congress blessing Khizr Hayat again formed a ministry. The Muslim League launched civil disobedience movement against the ministry and in March 1947 The Khizr Ministry resigned.”
[Talukder Moniruzzaman: The Politics of Development: The Case of Pakistan 1947 – 1958, PP. 34 – 35]

পাকিস্তান আন্দোলন ও সিন্ধু
সিন্ধুর অবস্থা আরো শোচনীয় ছিল।
১৯৩৫ সালের অ্যাক্টস অনুসারে বোম্বাই প্রদেশ থেকে সিন্ধু বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সিন্ধুতে মুসলিম রাজনীতির ক্ষেত্রে যে দৈন্য ও অস্থিতিশীলতা বিরাজমান ছিল তা’ সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে আর কোথাও ছিল না। ৬০টি আসনের মধ্যে মুসলিম সদস্যরা ৩৪টি আসন দখল করলেও এঁরা সবাই ছিলেন বিরাট ভূস্বামী-মুসলমানদের দল নানা বিবদমান দলে বিভক্ত ছিল। পর পর স্বল্পস্থায়ী মন্ত্রিত্ব গঠন করেন জি. এইচ. হেদায়েতুল্লাহ, আল্লাহ বখশ, বন্দে আলী খান এবং পুনরায় আল্লাহ্ বখশ। ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে গভর্নর কর্তৃক আল্লাহ বখশের অপসারণের পর গোলাম হোসেন হেদায়েতুল্লাহ মন্ত্রিত্ব গঠন করেন এবং মুসলিম লীগে যোন দেন। কিন্তু জি. এম. সাঈদের সাথে হেদায়েতুল্লাহর বিরোধের ফলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীলই রয়ে গেল। এমন কি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যদিও মুসলিম লীগ ২৯ টি মুসলিম আসন দখল করল, তখনও অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি এবং অচলাবস্থা এমন একটি পর্যায়ে মোড় নিল যাকে উপমহাদেশের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ইতিহাসে একক বলে উল্লেখ করা চলে। ১৯৪৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবার জন্য পরিষদের বৈঠক বসে। দলগুলোর মধ্যে সমান সমান ভোট হওয়ায় স্পীকার পদত্যাগ ক’রে সরকার পক্ষে ভোট দেন এবং ডেপুটি স্পীকার পদত্যাগ ক’রে ভোট দেন বিরোধী পক্ষে পরিষদ-সভাপতির আসন শূন্য থাকে। এই অবস্থায় গভর্নর ফ্রান্সিস মুডী গভর্নর জেনারেলকে ভারত সচিবের সাথে আলোচনাক্রমে পরিষদ ভেঙে দেবার পরামর্শ দেন এবং অবশেষে তাই করা হয়।
[ Kith Callard, Pakistan: A Political Study, London, George Allen & Unwin Ltd., 1957, P. 29]
এরপর নতুন নির্বাচন হয় এবং এতে মুসলিম লীগ ৩৪টি মুসলিম আসনই লাভ করে। কিন্তু তথাপি গোলাম হোসেন হেদায়েতুল্লাহ ও এম. এ. খুরো এই দুই জনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর পদ নিয়ে বিরোধ বাধে এবং পাকিস্তান অর্জিত হবার পরেও এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে।
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৫

বেলুচিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে সাইমন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ
In the large tract of Beluchistan, consisting of the British administered territory and the states of Kalat, Makran, Las Bella and Karan, no reforms were introduced. British Beluchistan was ruled with the help of Tribal Jirga system. Similarly, the states of Khairpur, Bahawalpur and the states of N.W. F.P Like Chitral, Chamb, Dir, and Swat, which joined Pakistan were under princely rule and did not have any experience in responsible govt.”
[ Simon Report, Vol. I, PP.325-328. আরও দ্রষ্টব্যঃ W.A. Welcox, Pakistan, the Consolidation of a Nation, New York. Col, Un. Press, 2nd Printing, 1964]
সীমান্ত প্রদেশের অবস্থাও একইরূপ। সেখানেও মুসলিম লীগকে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জনগণকে লীগের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। এ সম্পর্কে একটি উক্তি স্মরণ করিঃ
“In the 1937 elections Congress had a commanding position, because though it won only 19 out of 50 seats, the other Muslim members were far from united. At first, Sir Abdul Qayyum Khan formed a minority ministry. After his death, a Congress Ministry was formed by Dr. Khan Shahib. After the resignation of Dr. Khan Shahib in 1939 under the direction of the Congress ‘High Command’, Governor’s rule was imposed. In May 1944 when eight Congress members were in the jail, Aurangazeb Khan succeeded in forming a ministry with Sardar Abdur Rab Nistar as his Finance Minister. In March 1945, after the release of the Congress Members, Dr. Khan Shahib retained a dominant position and formed a ministry again. He continued in office until after the referendum in which the N.W.F.P voted overwhelmingly for Pakistan. After the referendum Dr. Khan’s Cabinet was
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৬

Dismissed by the Governor under the instruction of Jinnah, the new Governor General.
[তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬]
এদেশে পার্লামেন্টরী গণতন্ত্রের পত্তন কে করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। এ সম্পর্কে জনৈক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক যা, বলেছেন তা’ থেকে আমরা আলোকপ্রাপ্ত হতে পারিঃ
The British approach to political development in British Indian differed from the colonial model because of the absence of a participant citizen body. Since 1920, an attempt was made to create a participant type of electorate and give some Indians training as Ministers and Legislators. Under the 1919 Reforms four provincial elections were held with about 3 percent of the people forming the electorate. Under the 1935 Act, two provincial elections were held with about 14 per cent of the people enfranchised. But before 1914 there was no mass-based Muslim political parties. So, the elections in Muslim Provinces were contested on personal and communal issues rather than on political programmers. The elections of 1945-46, of course, created great enthusiasm among the Muslim masses. But the elections this time were fought, as Jinnah put it on numerous occasions, ‘on the single issue of Pakistan’, and even the illiterate voters with their ‘united frame of reference’ could understand the simple issue of Pakistan. It is, therefore, difficulted to conclude that the successive elections held under British auspices did in part adequate understanding of the process of the parliamentary system of Government to the Muslim masses. Similarly, the number of Muslim Politicians who got experience as legislators and Ministers was small and the study of the operation of the parliamentary system in the Muslim Provinces during the years 1936-47 shows that, because of various reasons-lack of disciplined parties in the Assemblies
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৭

of the Muslim-Majority Provinces, less than proportionate Muslim representation in some of the assemblies, the Muslim Leaders, preoccupation with the achievements of Pakistan rather than learning the art of governing-the Muslim politicians could not accrue much skill in administering the country and the parliamentary rule”.
[ তালুকদার মনিরুজ্জামান প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬-৩৭]

পাকিস্তানের জন্ম
পাকিস্তান আন্দোলন কেন হয়েছিল এবং কেনই বা বাঙালী মুসলমান সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন একথা বিশদভাবেই আলোচনা করা হয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। নির্যাতিত মানুষ, শোষিত মানুষ মুক্তির জন্যই এই আন্দোলনকে গণ-আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাপক সমর্থন দান করেছিল।একথা স্বীকার করি যে মুসলিম লীগ একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান এবং একথাও স্বীকার করতে হয় যে মুসলিম লীগ ধর্মকে সামনে রেখে জনগণের সস্তা সেন্টিমেন্টকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবার কাজে ব্রতী ছিল-কিন্তু একথাও অস্বীকার করবার উপায় নেই যে মুসলিম লীগ যে ভাবে এবং যে উদ্দেশ্যেই এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানে অগ্রসর হোন না কেন, জনগণ মূলতঃ অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে এবং গৌণতঃ ধর্মীয় নিরাপত্তার কারণে এই আন্দোলনে শরীক হয়েছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে এই আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
পাকিস্তান আন্দোলনের সঠিক সাফল্য নির্ভরশীল ছিল ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ওপর। উক্ত নির্বাচনকে, পাকিস্তান আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেভাবে সর্বত্র ঘোষণা করেছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের মুসলমান পাকিস্তান চাহেন অথবা চাহেন না, এই প্রশ্ন মীমাংসার প্রধানত উপায় হিসাবে গ্রহন করা হয়েছিল। সুতরাং মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কামনায় সেদিন প্রায় সবাই এই নির্বাচনকে অনুরূপ দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিলেন। এই নির্বাচনে শেখ মুজিব তাঁর তরুণ নেতৃত্বের প্রায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৮

১৯৪৬ সনের নির্বাচন ও শেখ মুজিব
১৯৪৩ সাল থেকে শেখ মুজিব বাংলাদেশের মুসলিম লীগের কাউন্সিলার ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের নেতৃবর্গ যুবক শেখ মুজিবের অসাধারণ সংগঠন ক্ষমতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও জনসংযোগ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফলে ছাত্রাবস্থায় অর্থাৎ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর জেলায় মুসলিম লীগের নির্বাচনী কাজ চালানোর পুরো দায়িত্ব শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। এই সময়ই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি বাস্তবকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছিল। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘূর্ণির ন্যায় ছুটে বেড়াতেন জনতার সাথে মিশে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতে তাঁর ভাল লাগতো। এই দুঃখ-দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি পাবার পথ তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। এই ভাবেই ক্ষুদে রাজনীতিবিদ তিল তিল করে বাংলার মাটি থেকে রস সংগ্রহ করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচার-ক্ষেত্র শুধু ফরিদপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি যশোহর, খুলনা, বরিশাল জেলাতেও নির্বাচনী প্রচারের তদারকী করতে যেতেন। বিশাল জনসমুদ্রে তিনি দিনের পর দিন ভাষণ দিতেন।
পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে, যুগ যুগ ধরে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছে আর এই সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছে সমাজের শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষ। শাসকের অত্যাচারের মাত্রা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে, তখনই তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরাচারী শাসকের আচরণে জনমনে তিল তিল করে দিনের পর দিন যে বিক্ষোগ জমে উঠে, একদিন তা’ বীভৎসভাবে ফেটে পড়ে। আর ইতিহাস এসব কাহিনী তার পাতায় বহন করে ভাবী বংশধরদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। ভাবী বংশধরগণ পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে শিক্ষা লাভ করে।
পৃষ্ঠা নংঃ ৫৯

শেখ মুজিবের সংগ্রামী চেতনার উৎস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার প্রেরণা বাংলার পূর্বপুরুষদের, বিশেষতঃ কৃষক, শ্রমিকদের কাছ থেকেই পেয়েছেন। কোন দেশ ও জাতি যখনই অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ওঠে, সেই বিপর্যয়ের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করবার জন্য মানুষের মধ্যে থেকেই আবির্ভূত হন এক একজন মহান নেতা, যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস একথা প্রমাণ করেছে। শেখ মুজিবও এমনি একজন মহান নেতা। সাধারণ মানুষের শ্রেনী থেকেই তাঁর উদ্ভব। দু’শো বছর ব্রিটিশ শোষণ ও শাসন এবং পরবর্তী ২৪ বছর পাকিস্তানী বর্বরতা এমন এক নেতৃত্বকে জন্মদান করেছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই শেখ মুজিবের ন্যায় এমন একজন মহান নেতার নেতৃত্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য, হতাশা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই দেশের যুগে যুগে যে প্রতিবাদ জানিয়েছে, গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ অথবা ফেটে পড়েছে বিদ্রোহের প্রচণ্ডতায়, শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। বিভিন্ন সময়ের কৃষক-বিদ্রোহ, নীল-বিদ্রোহ এবং এ জাতীয় বিদ্রোহের অন্তরালে যে মুক্তির আলোক এদেশের মানুষ যুগে যুগে সন্ধান করে এসেছে -শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বে তারই এক মূর্ত প্রতীক দেখতে পাই। বাংলাদেশকে শৃঙ্খলমুক্ত করাই ছিল তাঁর প্রধানত সাধনা।

বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত
ব্রিটিশ আমলে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মুক্তি সাধনের জন্য যে সংগ্রাম, তা’ কোম্পানীর শাসনামল থেকেই শুরু হয়েছিল। এ সম্পর্কে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঙলা’ গ্রন্থের রচয়িতা নরহরি কবিরাজ লিখেছেনঃ
“বাংলার জনগণের কাছে সেদিন কোম্পানীর শাসন বিদেশীর শোষণ বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। সিরাজদ্দৌলা ছিলেন শেষ স্বাধীন নবাব, তিনি স্বদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করেন। বিদেশী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মুক্তি সাধনের জন্য প্রথম সংগ্রাম ঘোষণা করেন মীর কাসিম। কাজেই তাঁর এই সংগ্রাম তদানীন্তন ঐতিহাসিক পর্বে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ।
পৃষ্ঠা নংঃ ৬০

প্রকৃতপক্ষে, মীর কাসিমের সময় থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত।”
[ পৃষ্ঠা ৫২]
ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে পরিণত করার জন্য ১৮৩৩ খ্রীস্টাব্দ থেকে কোম্পানী ভারতে জায়গা-জমি কিনতে ও ক্ষেত-খামার গড়তে শুরু করে। কোম্পানী এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েই নীলচাষে উৎসাহ প্রদান করে। ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নীলচাষের ব্যাপক প্রচলন হয় এবং ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দে ভারত থেকে রপ্তানীকৃত দ্রব্যের মধ্যে নীল একটি প্রধান দ্রব্য হয়ে ওঠে। নীলকুঠির মালিক ছিল ইংরেজ। এরা নিরীহ কৃষকদের জমিতে নীলচাষ করত। তা’ছাড়া বিভিন্নভাবে উৎপীড়ন করে বাংলার কৃষকদেরকে নীলচাষে বাধ্য করেছিল। ফলে, ইংরেজদের এই লাভজনক ব্যবসার ক্ষেত্রে বহু বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। নীলচাষীরা ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করে। ইংরেজ কুঠিওয়ালা নিরীহ জনগণের ওপর কি ব্যবহার করত তা’ পূর্বে উল্লেখ করেছি। Blair B. Kling-এর The Blue Mutiny গ্রন্থ থেকে উদাহরণ দেয়া যায়ঃ
“The most active and numerous groups of peasant leaders were village headmen and substantial ryots. As spokesmen for the villagers, they were approached by the planters to contract on behalf of the cultivators to supply indigo. If they refused, they were taken hostage by the planters and confined in factory godowns.”
[ পৃষ্ঠা ৮৫]
কিন্তু বাংলার মানুষ নীরবে এই অত্যাচার সহ্য করে নি। ইংরেজ কুঠিওয়ালা নিরীহ জনগণের ওপর কি ব্যবহার করত পূর্বে তা’ উল্লেখ করেছি। Blair B. Kling-এর The Blue Mutiny গ্রন্থ থেকে আরো উদাহরণ দেয়া যায়ঃ
“Bengal might well be proud of its peasantry. …. Wanting power, wealth, political knowledge and even leadership, the peasantry of Bengal has brought about a revolution inferior in magnitude and importance to none that has happened in the social history of any other country…. With the Government
পৃষ্ঠা নংঃ ৬১

against them, the law against them, the Tribunals against them, the press against them, they have achieved a success of which the benefits will reach all orders and the most distant generations of our countrymen. And all this they have done by sheer force of virtue, by patience, Perseverance and fortitude, without committing a single crime-almost a single act of violence.”
[ পৃঃ ১২০]
শুধু নীল-বিদ্রোহ নয়, বাংলার মানুষ সব সময় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনে গড়ে তুলেছে। তিতুমীরের বিদ্রোহ, সিপাহী-বিদ্রোহ, কৃষক-বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী-বিদ্রোহ, ফকির-বিদ্রোহ দৃষ্টান্ত হিসেবে এগুলোকে উল্লেখ করা যায়।
বিভিন্ন সময়ে বাংলার কৃষক-বিদ্রোহকে বাঙালীর জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত বলা যায়। এমন কি, পাকিস্তানী আমলেও যে সমস্ত কৃষক-অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল, সেগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা দরকার।

কৃষক-বিদ্রোহ
১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় যে সব কৃষক-বিদ্রোহ ও সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় -এসব চেতনার মধ্যে দিয়ে দিনের পর দিন ১৯৭১ সালের মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিকা ত্বরান্বিত হয়েছে।
ময়মনসিংহের নেত্রকোণার হাজং এলাকার কৃষক সমাজ দীর্ঘ দিন ধরে জমিদার, জোতদার, মহাজনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করে, এখানে তা’ বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন মনি সিংহ এবং নগেন সরকার। হাজং এলাকার কৃষকদের সংগ্রাম অন্য এলাকার জনগণের ওপর এবং বিশেষভাবে কৃষক সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ সময় সিলেট, রাজশাহী, যশোর প্রভৃতি জেলায় কৃষক-অসন্তোষ প্রবলভাবে দেখা দেয় এবং ছোটখাট সংঘর্ষ সংঘটিত হয়।
১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের ১৮ই আগষ্ট সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার এলাকায় কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে-এই সংঘর্ষের উল্লেখ করে জনাব বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ
পৃষ্ঠা নংঃ ৬২

“এই সংঘর্ষের সময় কৃষকরা লাঠি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে পুলিশের গুলির সামনে এগিয়ে যান। পুলিশ এই কৃষকদের উপর ৪২ রাউণ্ড গুলি ছোঁড়ে এবং তার ফলে ৬ জন কৃষক নিহত হন এবং ৩ জন মহিলাসহ ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।”
[ পৃঃ ৩৩০]

নাচোল কৃষক বিদ্রোহ ও ইলা মিত্র
রাজশাহী জেলার নাচোল অঞ্চলে যে কৃষক-বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা’ সত্যই হৃদয়বিদারক। স্থানীয় জোতদাররা সাঁওতাল কৃষকদেরকে ঠকিয়ে নিজেদের উদরপূর্তির চেষ্টায় থাকতেন। শোষণ, লাঞ্ছনা, ও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে সাঁওতালগণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এই অঞ্চলের সাঁওতাল ও কৃষক শ্রেণীকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও প্রেরণা দান করেন ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, আজহার হোসেন এবং ইলা মিত্রের স্বামী হাবোল মিত্র।
নাচোল বিদ্রোহের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৫০-এর প্রথম দিকে। এই ঘটনার উল্লেখ করে জনাব উমর লিখেছেনঃ
“সমবেত সাঁওতাল জনতা পুলিশের উপস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং তারা কৃষকদেরকে কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেই উত্তেজনা ক্রমশঃ তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত এই উত্তেজনা এত বেড়ে উঠে যে কারো পক্ষেই জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না এবং পুলিশ তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে একজন সাঁওতালকে হত্যা করে। এরপর সাঁওতালরা এ. এস. আই. সহ অন্য তিনজন কনস্টেবলকে বন্দী করে তাদের রাইফেল কেড়ে নেন এবং পরে তাদেরকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলেন।
থানার দারোগা এবং কনস্টেবলদের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পেয়ে রাজশাহী জেলা শাসক এবং পুলিশ সুপার একদল সশস্ত্র পুলিশসহ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং স্থানীয় সাঁওতাল ও কৃষকদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করেন। মৃত চারজন পুলিশের লাশ তাঁরা স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় মাটি খুঁড়ে বের করেন এবং রাজশাহী সদরে পাঠিয়ে দেন এবং তারপরই শুরু হয় তাঁদের আসল অত্যাচার
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৩

পুলিশ সমস্ত এলাকায় প্রতিটি কৃষক-বাড়ীর মধ্যে ঢুকে নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্মমভাবে তাদের মারপিট শুরু করে। বহু নারীকে তারা ধর্ষণ করতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। পুলিশ হত্যার ‘উপযুক্ত’ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয় নি। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের খোঁজ-খবরের জন্য তাঁরা আরও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কায়েম করে একটা ত্রাসের রাজত্ব।”
[ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিঃ পৃঃ ৩৩২ – ৩৩৩]
তদানীন্তন সরকার ইলা মিত্রকে গ্রেফতার ক’রে তাঁর উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল তা’ তাঁর জবানবন্দীর মধো পাওয়া যাবে। জনাব বদরুদ্দীন উমর তাঁর গ্রন্থে এই অত্যাচার ও লাঞ্ছনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেনঃ
“ইলা মিত্রকেও এই সময় মাঝে মাঝে জেল গেটে নিয়ে গিয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় হাজির করা হ’ত এবং কয়েদীদেরকে দেখিয়ে তারা বলতো, ‘তোমরা রাণীমাকে দেখো। ইনি আবার রাণী হয়েছিলেন।”
[ ঐ, পৃঃ ৩৩৭]
কৃষক-বিদ্রোহের দু’ একটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হ’ল। এসব ঘটনা থেকে শেখ মুজিব নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। শেখ মুজিব বাংলার বেদনার্ত মানুষের মুক্তির জন্যই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। সেই প্রস্তুতি সংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করে। আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ যা কামনা করেছে সেই দুর্লভ এবং প্রিয় স্বাধীনতা। শেখ মুজিব এই স্বাধীনতার মহানায়ক।
যাহোক, এবার আমরা আগের কথায় ফিরে আসি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার মুসলমান সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন মুসলিম লীগকে আরও শক্তিশালী করে তুলল। এই নির্বাচনে শেখ মুজিবও বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। যদিও এই সময় তিনি ছাত্র, তথাপি অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের বলে তিনি নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন অনেক বড় বড় নেতাও তাতে বিস্মিত না হয়ে পারেন নি। এই নির্বাচন উপলক্ষেই শেখ মুজিব তমিজ উদ্দীন খাঁ, লালমিয়া, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ নেতাদের সাথে পরিচিত হন।
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৪

ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের ভারত আগমন
এ সময় ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কথাবার্তা বলে ভারতকে স্বাধীনতা দেবার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য ভারতবর্ষে আসেন। ব্রিটেন-এ তখন শ্রমিক দল মন্ত্রিসভায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। শ্রমিক মন্ত্রিসভা তাঁদের তিনজন প্রতিনিধিকে ভারতে পাঠান।

ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান
কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরস্পর-বিরোধী দাবীর মধ্যে কোন সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন নি। তখন মন্ত্রী-মিশন ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র গঠন সম্পর্কে এক পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এই পরিকল্পনা ‘ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান’ বলে পরিচিত। তাঁদের পরিকল্পনায় যেসব প্রস্তাব ছিল তা হ’লঃ
(১) ব্রিটিশ-ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর সমবায়ে একটি ভারত ইউনিয়ন গঠিত হবে। ইউনিয়ন সরকারের উপর বৈদিশিক, দেশরক্ষা ও যানবাহন এই তিনটি বিষয়ের ভার দেয়া হবে। এছাড়া ইউনিয়ন সরকারের কাজ পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় অর্থ আদায়ের ক্ষমতাও তাকে গ্রহণ করতে হবে। এগুলো ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয় প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হবে।
(২) কোন প্রধান সাম্প্রদায়িক বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হলে আইন সভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের এবং প্রধান দুই সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আবশ্যক।
(৩) প্রদেশগুলোকে তিনটি দলে (group) ভাগ করা হয় এবং তাদেরকে দলীয় সরকার বা গ্রুপ সরকার গঠনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। তিনটি গ্রুপ যথা- গ্রুপ ‘এ’ প্রদেশগুলোতে থাকবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। গ্রুপ ‘বি’-তে থাকবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ বেলুচিস্তান –যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। গ্রুপ ‘সি’-তে থাকবে বাংলা ও আসাম যেখানে মুসলমানগণ অল্প কিছু-সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৫

মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর প্রস্তাবাবলী
এখানে উল্লেখ করা উচিত যে, ক্যাবিনেট মিশনের এই প্রস্তাব মূলতঃ মনীষী ও কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি ক’রে তৈরী করা হয়েছিল। মওলানা আজাদ এর আগে উক্ত মিশনের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের ১৫ই এপ্রিল এক ঘোষণায় এ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লিখলেনঃ
“আমি মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবীটিকে সর্বতোভাবে বিবেচনা করে দেখলাম। একজন ভারতবাসী হিসাবে ভবিষ্যতে এটি ভারতবর্ষের পক্ষে কতটা উপযোগী সেটিও বিবেচনা করে দেখেছি। একজন মুসলমান হিসাবেও এটি আমি বিচার করে দেখেছি যে, ভবিষ্যতে এটি মুসলমানদের ভাগ্যকে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। এই পরিকল্পনাটিকে সর্বতোভাবে বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছি যে এটি শুধুমাত্র ভারতবর্ষেরই ক্ষতি করবে তা’ নয়, এই পরিকল্পনা ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষেও ক্ষতিকর। সত্যি কথা বলতে কি, এই পরিকল্পনা সমস্যাগুলোর সমাধান করার চাইতে সমস্যাগুলোকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
এখানে আমি নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করছি যে পাকিস্তান কথাটাই আমার অভিরুচির বিরুদ্ধে। এই নামের দ্বারা এটাই বোঝায় যে পৃথিবীর কিছুটা জায়গা শুধু পবিত্র অন্য সব জায়গা অপবিত্র। এইভাবে পবিত্র ও অপবিত্র তরিকায় দেশ ভাগ ইসলাম বিরোধী এবং ইসলামের মূল দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচ্যুত। ইসলাম এই ধরনের কোন ভাগাভাগি স্বীকার করে না। আল্লাহর দূত বলেছেনঃ ‘আল্লাহ সমস্ত পৃথিবীটাকেই আমার মসজিদ হিসাবে গড়েছেন।’ এ ছাড়া আমাদের মনে হয় যে, পাকিস্তানের পরিকল্পনা পরাজিত মনোভাবের প্রতীক এবং এটি ইহুদীদের মাতৃভূমির দাবীর মতই দাবী। এ কথা অতি পরিষ্কারভাবেই স্বীকার করতে হয় যে, যেহেতু ভারতের মুসলমানগণ সারা ভারতকে নিজেদের শাসনে রাখতে পারবেন না, সেইজন্য তাঁরা ভারতবর্ষের একটি কোণকে বেছে নিয়েছেন, যেখানে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। যে কেউই যুক্তি দিয়ে ইহুদীদের একটি নির্দিষ্ট মাতৃভূমির দাবীকে
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৬

মেনে নিতে পারেন। কারণ তাঁরা পৃথিবীময় বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছেন। এবং কোন দেশের ব্যাপারেই তাঁরা কোন বক্তব্য রাখতে পারেন না। ভারতবর্ষের মুসলমানদের অবস্থা কিন্তু সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সারা ভারতবর্ষের নয় কোটির উপর মুসলমান জনগণ সংখ্যার দিক থেকে ও গুণের দিক থেকে ভারতবর্ষের জনজীবনের ও শাসনঘটিত সমস্ত ব্যাপারেই যথেষ্ট প্রভাবশালী। এতদুপরি প্রকৃতি তাঁদেরকে সাহায্য করছে কয়েকটি বিশেষ জায়গায় তাঁদের একত্রিত ক’রে।
এই বাস্তব অবস্থায় পাকিস্তানের দাবীর কোন মূল্যই থাকতে পারে না। একজন মুসলমান হিসাবে আমি তো কিছুতেই সমস্ত ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব থেকে আমাদের সরিয়ে নেবার কথা ভাবতেও পারি না। আমি মনে করি যে, যেটি আমার প্রাপ্য ও যেটিতে আমার অধিকার আছে সেটি থেকে সরে যাওয়া ভীরুতারই নামান্তর।”
[ আমি মুজিব বলছিঃ কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৬২ – ১৬৩]
মওলানা আজাদ সাহেব স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করেছিলেন যে মুসলমানরা দেশ বিভক্তির দাবীতে সোচ্চার হচ্ছেন। তিনি বুঝেছিলেন যে মুসলমানদের একটাই মাত্র ভয় ছিল অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতার সম্বন্ধে, তাঁরা মনে করতেন, ভারত বিভাগ না হয়ে স্বাধীন হলে কেন্দ্রে যে সরকার স্থাপিত হবে তাতে হিন্দুরাই আধিপত্য করবে এবং মুসলমানদের উপর করবে নির্যাতন। এই সমস্যার সমাধানের জন্য মওলানা আজাদ সাহেব এক পরিকল্পনা দিয়ে বললেন যে মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশগুলো যে যার নিজের প্রদেশে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার পাবে। এই একই সঙ্গে বৃহত্তর স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেবার অধিকারো তাদের থাকবে।
এই প্রস্তাব ছাড়াও বৃহত্তরভাবে তিনি যে পরিকল্পনা করেছিলেন সেটি নিন্মরূপঃ
The situation of India is such that all attempts to establish a centralized and unitary Government are bound to fail, equally doomed to failure is the attempt to divide India into two states. After considering all aspects of the questions, I have come to the conclusion that the only solution can be on
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৭

the lines embodied in the Congress formula which allows room for development to both the provinces and to India as a whole. ……I am one of those who consider the present chapter of communal bitterness and differences as transient phase of India. I am reminded of a saying of Gladstone that the lest cure for a man’s fear of water is to throw him into it. Similarly, India must assume responsibility and administer her own affairs before fears and suspicion can be fully allowed. When India attains her destiny, she will forget the present chapter of communal suspicion and conflict and face the problems of modern life from the modern point of view. Difference will no doubt persist but they will be of economic, not communal. Opposition among political parties will continue, but they will be based not on religion but on economic and political issues. Class and not the community will be the basis of future alignment and policies will be shaped accordingly.’’
[ আমি মুজিব বলছিঃ কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৬৪ – ১৬৫]

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দ
আজাদের এই পরিকল্পনার উপর ভিত্তি ক’রে ক্যাবিনেট মিশনের উত্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবৃন্দ উভয়েই সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। মিঃ জিন্নাহ এই প্রস্তাবকে পাকিস্তান দাবীর কাছাকাছি বলে মন্তব্য করলেন। গান্ধীজি ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের প্রশংসা করলেন কিন্তু ঐ বছরেই কংগ্রেস সভাপতি বদলে যাওয়ায় পরিকল্পনাটি বানচাল হয়ে যায়। নব নির্বাচিত সভাপতি মিঃ জওয়াহেরলাল নেহেরু এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেনঃ
“Completely unfiltered by agreements and free to meet all situation as they arise.”

[ আমি মুজিব বলছিঃ কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৬৭]

ডাইরেক্ট এ্যাকশন
নেহেরুর এই উক্তির তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে। মিঃ জিন্নাহ এটিকে ‘কংগ্রেসের বদ মতলব’ বলে সমালোচনা করতে লাগলেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৮

২৭শে জুলাই (১৯৪৬) মুসলিম লীগের এক সভা ডেকে উক্ত সভায় ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকে বাতিল ক’রে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আরেক প্রস্তাবে ১৬ই আগষ্ট (১৯৪৬) পাকিস্তানের দাবীকে ‘ডাইরেকট এ্যাকশন ডে’ পালন করার আহ্ববান জানানো হ’ল। সেদিন জিন্নাহ ঘোষণা করেছিলেন, “আমাদের সামনে দু’টি পথ, হয় বিভক্ত ভারত, তা’ নাহলে চূর্ণবিচূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারত।”
[ আমি মুজিব বলছিঃ কৃত্তিবাস ওঝা, পৃঃ ১৬৮]
মিঃ জিন্নাহ ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’র কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা করলেন না, বরং তিনি ঘোষণা করলেন, “আজ হইতে মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ত্যাগ করিল।”
[ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরঃ আবুল মনসুর আহমদ, পৃঃ ২৫৩]
এই সময় সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছিলেন যে-আমাদের সংগ্রাম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়-হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’র বিষয়টি পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারলেন। প্রদেশের জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে তিনি ১৬ই আগস্ট ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করলেন। পরিশেষে শহীদ সাহেবের ধারণাই ঠিক হ’ল-বেঁধে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ (পৃঃ ২৫১-২৫২) গ্রন্থে বলেছেনঃ
“১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট ও পরবর্তী কয়েক দিন কলিকাতায় যে হৃদয়বিদারক, অচিন্তনীয় ও কল্পনাতীত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হইয়াছিল, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া এ সব নৃশংসতা আর কোথাও দেখা যায়না। কলিকাতা দু’টি মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। দূর্ভাগ্যবতঃ ‘দুইটার সময়ই আমি কলিকাতায় উপস্থিত ছিলাম। একটা ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে, অপরটা ১৯৪৬ সালের আগষ্টে। গভীরতা, ব্যাপকতা ও নিষ্ঠুরতা সকল দিক
পৃষ্ঠা নংঃ ৬৯

হইতে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা ১৯২৬ সালের দাঙ্গার চেয়ে অনেক বড় ছিল। চল্লিশ বছরের আগের ঘটনা বলিয়া ছাব্বিশ সালের দাঙ্গার নৃশংসতার খুঁটিনাটি মনে নাই। কিন্তু মাত্র বিশ বছরের আগের ঘটনা বলিয়া ছয়চল্লিশ সালের চোখের দেখা অমানুষিক নৃশংসতা আজও ঝলমলা মনে আছে। মনে হইলেই সজিব চিত্রের মতই চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে। গা কাঁটা দিয়া উঠে। স্বাভাবিক হৃদয়বান ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিবার কথা। ঘটিয়াছিল অন্ততঃ একজনের। আমার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ আলীপুর কোর্টের এক ব্রাক্ষ্মণ তরুণ মুন্সেফ সত্য সত্যই কিছুকালের জন্য মনোবিকার রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। রিটায়ার্ড জজ ও বয়স্ক উকিল-ব্যারিস্টারের মত উচ্চশিক্ষিত কৃষ্টিবান ভদ্রলোকদিগকে খড়্গ রামদা দিয়া তাঁদের মহল্লার বস্তির মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করিতে দেখিয়াই ঐ তরুণ হাকিমের ভাবালু মনে অমন ধাক্কা লাগিয়াছিল। তিনি ছুটি লইয়া বেশ কিছুদিন সেন্ট্রাল হাসপাতালে থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। আমার অবস্থাও প্রায় ঐরূপ হইয়াছিল। আমার মহল্লায় হয়তো একজন মুচি ফুটপাতে বসিয়া মুসলমানদেরই জুতা মেরামত করিতেছে। হয়তো একজন হিন্দু নাপিত ফুটপাতে বসিয়া ক্ষৌরকাজ করিতেছে। হটাত কয়েকজন মুসলমান আততায়ী ধারাল রড বা বল্লম তার মাথায়,গলায় বা পেটে এপার ওপার ঢুকাইয়া দিল। মুহূর্তের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া লোকটি সেখানেই মরিয়া পড়িয়া রহিল। বীরেরা জয়ধ্বনি করিতে করিতে চলিলেন অন্য শিকারের তালাশে। এমন নৃশংসতা দেখিলে কার না মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিবে? অথচ এটাই হইয়া উঠিয়াছিল স্বাভাবিক মনোবৃত্তি। বিপরীতটাই ছিল যেন অস্বাভাবিক। হৃদয়বান মানব-প্রেমিক বলিয়া পরিচিত আমার জানা এক বন্ধু এই সময় একদিন আমার কৈফিয়ত তলবের ভাষায় বলিয়াছিলেন, “কয়টা হিন্দু মারিয়াছেন আপনি? শুধু মুখে মুখেই মুসলিম প্রীতি।”
এই দাঙ্গার মুখ্য উদ্দেশ্য যে হিন্দু-মুসলমানদের আলাদা অস্তিত্ব নিরূপণ করা তা’ বলাই বাহুল্য। মানবতাবিরোধী নৃশংস কার্যকলাপ চালিয়ে জাতির আলাদা অস্তিত্ব নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের স্থান ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট জায়গা জুড়ে থাকবে। পরবর্তীকালে পাকিস্তান
পৃষ্ঠা নংঃ ৭০

সৃষ্টির পরও মুসলিম লীগ সরকার দেশ থেকে বিধর্মীদের উচ্ছেদকালে পর পর কয়েকবার এখানে নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল।
১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় ভারতীয় ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেস স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করলেন যে, দেশবিভাগ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। যে নেহেরু এতদিন পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতের জন্য লড়াই করেছেন এবং জিন্নাহকে বিভেদপন্থী বলে উপহাস করেছেন, তিনিও শেষাবধি মুসলিম লীগের কারসাজির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।

ভারত-স্বাধীনতা আইন
১৯৪৭ সালের মার্চে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে নতুন ‘ভাইসরয়’ হয়ে আসেন। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি ক’রে পাকিস্তান দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়ে একটি নতুন পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন এবং তাতে কংগ্রেসের স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হন। মাউন্ট ব্যাটনের এই পরিকল্পনাটি কার্যকরী করবার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই তারিখে “ভারত-স্বাধীনতা আইন” নামে একটি আইন পাশ করেন। এই আইন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের সমাপ্তি ঘটায়। নিন্মে এই স্বাধীনতার প্রধান প্রধান ধারাগুলো দেয়া গেলোঃ
(১) এই আইন ভারত ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামে দু’টো নতুন ডোমিনিয়ন সৃষ্টি করবে।
(২) ইহা ভারতবর্ষের উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ অবসান ঘটাবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ভারতের উপর ব্রিটিশ সরকারের এবং পার্লামেন্টের সমগ্র ক্ষমতা ভারত ইউনিয়নে ও পাকিস্তানে হস্তান্তরিত হবে।
(৩) দুই দেশের ইচ্ছেমতো স্ব-স্ব শাসনতন্ত্র রচনার পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়, এবং প্রতিটি গণপরিষদ স্ব-স্ব দেশের ক্ষমতাশীল আইন প্রণয়নকারী সংস্থা হিসেবে নতুন শাসনতন্ত্র রচিত ও প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ হিসেবে কাজ করে যাবে।
(৪) ডোমিনিয়নদ্বয় ব্রিটিশ রাষ্ট্রপুঞ্জের বা কমনওয়েলথের মধ্যে থাকবে কিনা, পাকিস্তান ও ভারতের গঠনতন্ত্র রচনার সময় সেই সিদ্ধান্তু করবার পূর্ণ অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়।
পৃষ্ঠা নংঃ ৭১

(৫) নতুন শাসনতন্ত্র রচিত ও প্রবর্তিত হবার পূর্ব পর্যন্ত নিন্মলিখিত শর্তাধীনে বা পরিবর্তন স্বীকারান্তে ভারত ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট মোটামুটিভাবে ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইন অনুসারে পরিচালিত হবে। তবে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আইনে ১৯৩৫ সালের আইনের নিন্মলিখিত পরিবর্তন করা হয়ঃ
(ক) গভর্নর জেনারেলের এবং প্রাদেশিক গভর্নরদের ‘ঐচ্ছিক’ এবং বিচারবুদ্ধি (Discretionary powers and powers of individual judgment) অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। সুতরাং তাঁরা সকল সময়, সর্ব অবস্থায় এবং সকল বিষয়ে তাঁদের মন্ত্রিমন্ডলীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য থাকবেন।
(খ) ১৫ই আগস্টের পর পাকিস্তান ও ভারতের মন্ত্রিসভা ব্রিটিশ কমনওয়েলথের শাসনতান্ত্রিক প্রথানুসারে স্ব-স্ব দেশের গভর্নর জেনারেল এবং প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ করবার অধিকার পাবে।
(গ) ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট হতে দেশীয় রাজ্যসমূহের উপর থেকে সম্রাটের সার্বভৌম-ক্ষমতা (Paramounty of the Crown) বিলুপ্ত হবে এবং তাদেরকে দুই ডোমিনিয়নের যে-কোন একটিতে যোগদান করবার অথবা স্বাধীনতা ঘোষণা করবার অধিকার দেয়া হয়।

ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা
এই আইন ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে কার্যকরী করা হয় এবং এই উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান দু’টো স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। উভয় দেশের স্বাধীনতা দিবস একই দিনে পড়ে যায় বলে পাকিস্তান ১৪ই আগস্টে (১৯৪৭) স্বাধীনতা দিবস বলে ঘোষণা করে।

সিলেট রেফারেন্ডাম ও শেখ মুজিব
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের মধ্যরাতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারত-বিভাগের মাধ্যমে মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলোকে নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবীকে মেনে নেয়া হলেও আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার পাকিস্তানভুক্তির প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকে যায়। এর দরুন পরবর্তী সময়ে তার জন্য সিলেটে রেফারেন্ডাম বা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব সেই রেফারেন্ডামে
পৃষ্ঠা নংঃ ৭২

৫০০ কর্মীর নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ক্লান্তিবিহীন কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান। অথচ সে সময় তিনি মাত্র বি. এ. ক্লাশের ছাত্র।

ছাত্র রাজনীতি ও শেখ মুজিব
ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ছাত্রসমাজে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৪৩ সালের উক্ত কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তিনি তাঁর সমর্থক প্রার্থীকে নিজের প্রভাববলে বিজয়ীর গৌরব দান করেছিলেন। তা’ছাড়া ১৯৪৬ সালে উক্ত ছাত্র নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনীতিকে জীবনের মুখ্য আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলেও লেখাপড়ার প্রতি তিনি কোনদিন অবহেলা প্রদর্শন করেন নি। কেননা তিনি জানতেন, আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষালাভের দরকার। আর সে শিক্ষাকে তিনি কেবলমাত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে গ্রহণ করেন নি। একদিকে ইতিহাস ও সাহিত্য, অপরদিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনদর্শনের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন কলেজ-ছাত্রাবস্থা থেকেই। এই সময়ই তিনি কার্ল মার্কস, বার্নার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ মনীষীর ভক্ত হয়ে পড়েন।

বি. এ. ডিগ্রীর অর্জন
এর সাথে সাথে পরীক্ষার বৈতরণীও তিনি অনায়াসে পার হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে উক্ত ইসলামিয়া কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বি. এ. -তে তাঁর পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

রাজনীতির উদ্দেশ্য
যে রাজনীতিকে শেখ মুজিব জীবনের মুখ্য আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে তা’ যশ, প্রতিপত্তি বা ক্ষমতার অর্জনের উদ্দেশ্যে নয় -দুঃখ, দারিদ্র প্রপীড়িত অসহায় মানবাত্মা তাঁর চিত্তের বীণায় যে কান্নার সুর তুলেছিল তারই তাড়নায় তিনি উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন। সেই সব মানুষের নায্য অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই দেখা যায়, ছাত্রজীবন থেকেই সেই সংগ্রামের জন্য তিনি কিভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সে সময়ের রাজনৈতিক চেতনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জনৈক গ্রন্থকার শেখ মুজিবের সমসাময়িক বন্ধুদের বক্তব্যের কথা তুলে ধরেনঃ
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৩

“একদিন উত্তর কলকাতায় শ্যামবাজার অঞ্চলের একটি সিনেমা হলে বাংলা ছবি দেখতে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু। যেমন- আফসার উদ্দীন, কাজী আহমদ কামাল ( কামাল সাহেব বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টের খ্যাতনামা ব্যারিস্টার)। কিন্তু ছবি দেখার দিকে শেখ মুজিবের মন ছিল না। তিনি হলের মধ্যেই বন্ধুদের বললেন, এসো আমরা একটা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ি। তারপর কামাল সাহেবকে বললেন-তুমি এ ব্যাপারে যা লেখাপড়া, খসড়া ইত্যাদি করা দরকার তা’ করবে। আফসার উদ্দীনকে বললেন-তুমি যা টাকার দরকার দেবে। আর আমি নিজে মানুষের সামনে যাব, আমাদের দলের কথা, আমাদের কর্মসূচীর কথা বলব। এর কিছুদিন আগেই আফসার উদ্দীনের বাবা ( যিনি ছিলেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্টেট) ছেলের জন্যে নগদ ত্রিশ হাজার টাকা রেখে হঠাত মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের এই পরিকল্পনা সফল হয় নি। কারণ আফসার উদ্দীনের পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব হ’ল না।”
[ গতিবেগ চঞ্চল বাঙলাদেশঃ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব, অমিতাভ গুপ্ত, পৃঃ ৩৭ – ৩৮]

সংগ্রামী জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়
(১৯৪৮ – ১৯৫৮)

১৯৪৭ সালের আগস্টের মাঝামাঝি দেশ বিভাগের পর স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের শাসনভার মুসলিম লীগের উপর ন্যস্ত হয়। আমি আগেই বলেছি যে, মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের সবাই উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রবাহ থেকে আগত, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন নওয়াব, জোতদার এবং বোম্বাই লাক্ষ্মৌ গুজরাটির পুঁজিপতি।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর
ক্ষমতা হাতে পেয়েই মিঃ জিন্নাহ লিয়াকত আলী খানকে প্রধান মন্ত্রিত্ব দিয়ে নিজে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর বর্তমানে কোন বিষয়ে অন্য কেউ কর্তৃত্ব করুন এ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জিন্নাহ ইচ্ছামত শাসন কাজ পরিচালনা করতে লাগলেন।
কিন্তু দৈনন্দিন শাসনকার্য সম্পর্কে মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের কোন প্রকার জ্ঞানই ছিল না। ফলে সমস্ত ক্ষমতা গিয়ে পড়ে আমলাদের হাতে।
এই মুসলিম আমলারাও পাকিস্তান সৃষ্টিতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অন্যদের মত তাঁরাও আশা করেছিলেন যে, পাকিস্তান থেকে হিন্দু আমলারা অপসারিত হলে তাঁদের দ্রুত পদোন্নতি হবে। তাঁদের এ আশা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল।
দেশ বিভাগের পর রাজনৈতিক ক্ষমতা আমলাতন্ত্র কর্তৃক প্রভাবিত
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৫

হওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিবর্তনও তাঁদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। পাকিস্তানের ভূস্বামী এবং পুঁজিপতিদের সাথে তাঁদের এমন একটা সখ্যতা ও আঁতাত গড়ে ওঠে, যা পূর্ব বাংলার পক্ষে চরম সর্বনাশের সূচনা করে। দেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর কিছু সংখ্যক মুসলমান পুঁজিপতি প্রচুর অর্থ নিয়ে ভারত থেকে চলে আসেন এবং এখানে কল-কারখানা, ব্যাঙ্ক-বীমা প্রতিষ্ঠা ক’রে এদেশের অর্থনৈতিক জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রিত করতে থাকেন। আগেই বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলায় যে সব জমিদার ছিলেন তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু। এঁদের অনেকেই আবার প্রাণে বাঁচার জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই দেশ ত্যাগ ক’রে বসবাসের জন্য ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে ভূমি সংস্কার নীতি প্রবর্তন ক’রে হিন্দু জমিদারদেরকে সম্পত্তিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণীত হয় এবং বাংলায় জমিদারী প্রথা বিলোপ করা হয়। ফলে পূর্ব বাংলায় সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামীদের প্রতি কোনরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। পাঞ্জাবের শতকরা ৬০ ভাগ জমির মালিক ছিলেন জমিদার শ্রেণী। সিন্ধুতে জমির মালিকানাই ছিল মাত্র শ’খানেক ভূস্বামীর হাতে। এঁদের প্রতি কোনরূপ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হ’ল এঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ, যাঁদের অধিকাংশই ধীরে ধীরে স্বল্পকালের মধ্যেই পাকিস্তানের হর্তাকর্তা বিধাতা সেজে বসেন। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির যে আশা আর উদ্দীপনা নিয়ে পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন, দেশ বিভাগের পর পরই তাঁরা নিজেদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারলেন। কিছু সংখ্যক দূরদর্শী অবশ্য অনেক আগেই মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাদেশের সীমানা নিয়ে বেশ দরকষাকষি চলল। বাংলার বর্ণহিন্দুরা বাংলা ভাগ করার জন্য উঠেপড়ে লাগল-সোহরাওয়ার্দী চাইলেন বাংলা ও আসাম মিলেয়ে বৃহত্তর বাংলা প্রদেশ গঠন করা হোক। কিন্তু কংগ্রেস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৬

শুধু তাই নয়, বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতাও শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তা’ রক্ষার জন্য, কিন্তু মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ধৃষ্টতার জন্যই তা’ রাখা সম্ভব হয় নি।

‘কলকাতা রাখ’ আন্দোলন ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ভূমিকা
এর আগে আগস্টের ৫ তারিখে শহীদ সাহেবকে পরাজিত ক’রে খাজা নাজিমুদ্দিন ব্রিটিশ বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের নেতৃত্ব পান। নাজিমুদ্দিন ও তাঁর অনুসারীদের ধারণা ছিল যে, কলকাতা পূর্ব বাংলার ভাগে পড়লে পূর্ব বাংলার রাজধানী কলকাতাতেই স্থানান্তরিত হবে। যদিও ১৯৪৭ সালের ৩রা জুনের ভারত স্বাধীনতা আইনে বলা হয়েছিল যে, ঢাকাকেই ( সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী) পূর্ব বাংলার রাজধানী করা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘কলকাতা রাখ’ আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে, যদিও এ আন্দোলন যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারে নি। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নাজিমুদ্দিন সরকার ‘কলকাতা রাখ’ আন্দোলনের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করলেন। ফলে দলে দলে মুসলমানগণ কলকাতা ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসতে শুরু করেন।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সোহরাওয়ার্দী
এ সময়ে ভারতে অবস্থানকারী মুসলমানেরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। স্বভাবতঃই হিন্দু মুসলমান একে অপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করতে থাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যায়। পাকিস্তান হাসেল হওয়ার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে শহীদ সাহেবকে যখন তাঁর দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানালেন, ভারতীয় মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থার কথা চিন্তা করেই উত্তরে তিনি লেখলেন, ‘আপনার সুদক্ষ পরিচালনায় পাকিস্তানের হেফাজত করিবার যোগ্য লোকের অভাব নাই। কারণ মুসলিম লীগের প্রায় সব নেতাই পাকিস্তানে চলিয়া গিয়াছেন কিন্তু পিছনে-ফেলিয়া-যাওয়া বেচারা ভারতীয় মুসলমানদের হেফাজত করিবার কেউ নাই। আমাকে এদের সেবা করিতে দিন।’
[ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরঃ আবুল মনসুর আহমদ, পৃঃ ২৬৮]
সোহরাওয়ার্দী সাহেব নিজের জীবন বিপন্ন করে দাঙ্গা রোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু দুঃখের কথা, অনেক গ্রন্থকার এ বিষয়ে তাঁর চরিত্র কলঙ্ক
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৭

লেপন করে বলেন যে, তিনিই নাকি সে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছিলেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাঁর বিরুদ্ধ-দল উগ্রপন্থী মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দই এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছিলেন, যাতে সোহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
ভারতীয় হিন্দু নাগরিকদের কিছু কিছু লোক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছিলেন এবং শহীদ সাহেব ছিলেন যেহেতু মুসলমান, সেহেতু তাঁরাও শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে কসুর করেন নি। পরবর্তীকালে সে দৃষ্টিভঙ্গিই অনেককে বিভ্রান্ত করেছে।
যাহোক, এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী অনশনব্রত পালন করায় দাঙ্গা প্রশমিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাতে কমলার রস খেয়ে গান্ধীজি অনশন ভঙ্গ করেন।

সিরাজদ্দৌলা হলে শেখ মুজিবের ঘোষণা
দেশ বিভাগের পর বেশ কিছুদিন শেখ মুজিবও ভারতেই ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থন ক’রে যুবনেতৃত্ব দান করেছিলেন সত্য, কিন্তু মুসলিম লীগের বুর্জোয়া চরিত্রকে বিশেষভাবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাঙালীর ওপর নতুন ধরনের শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবে, যদি না মুসলিম লীগের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে জনগণের হাতে দেওয়া হয়। তাই ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দানের কথা ঘোষণা করার পর পরই তিনি ইসলামিয়া কলেজের ‘সিরাজদ্দৌলা হলে’ ছাত্র ও যুব-নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিলিত হয়েছিলেন এবং পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ বিরোধী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সভায়ই তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করলেও জনগণ চায় অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই মুক্তি অবশ্যই আনতে হবে। তাঁর এই বিশ্লেষণ তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক অমর সাক্ষী।
উক্ত সভায় তিনি আরও বলেনঃ “স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে হবে, কেননা, আমার আশংকা হচ্ছে, এ স্বাধীনতা সত্যিকার স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৮

ক’রে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে-মুসলিম লীগের বুর্জোয়া মনোবৃত্তি ও পশ্চিমা প্রাধান্য থেকে আমার এই আশঙ্কা হচ্ছে।”
উক্ত সভায় উপস্থিত অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন কে. জি. মোস্তফা (লেখকের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা শেখ মুজিব বলেন।)
যতীন্দ্র ভাটনগর তাঁর The Architect of Bangladesh গ্রন্থে যা বলেছেন এই প্রসঙ্গে তা’ স্মরণ করা যায়ঃ
“As Pakistan emerged on the horizon on August 14,1947, there was Jubilation in Muslim regions but not so much in Bengal and politically conscious Bengali Muslim homes. It became evident right from the first days that political and administrative power, that is the real power, was surely gravitating towards West Pakistan. East Pakistan was looked down upon more or less a colony and Bengalis as second-class citizens. This was a terrible shock for the intellectuals of Bengal.”
(“১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্থানের জন্ম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান সমাজের মধ্যে মহা ধুমধামের সাথে আনন্দ উৎসব পালিত হয়। কিন্তু রাজনীতিতে প্রজ্ঞাসম্পন্ন বাংলাদেশের বাঙালী মুসলমানের ঘরে ঐ দিনটি তেমনভাবে পালিত হয় নি। ইহা অবধারিত সত্য যে, পাকিস্তান জন্মের প্রথম দিন থেকে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক শক্তি পশ্চিমাগোষ্ঠীর কুক্ষিগত হ’তে চলেছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে একটা উপনিবেশ এবং বাঙালীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে তারা মনে করত। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিগণ ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন।”)

পাকিস্তান ও মুসলিম বুদ্ধিজীবী
যতীন্দ্র ভাটনগর মহাশয় যা বলেছেন তার মধ্যে সত্যতা যে একেবারেই নেই, একথা বলা যায় না। এ দেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবীর একটি বিরাট অংশ মুসলিম লীগের শ্রেণী-চরিত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান যে ধর্মের নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনীতে রূপান্তর করবে এ সম্পর্কে তাঁরা প্রথম থেকেই আশংকাগ্রস্থ ছিলেন। কিন্তু একথা ঠিক নয় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ দেশের
পৃষ্ঠা নংঃ ৭৯

বুদ্ধিজীবী সমাজ আনন্দিত হন নি। হোক পাকিস্তান, তবু একথা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, সাম্রাজ্যবাদ শক্তির হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম। এই মুক্তি শুধু ধর্মীয় নয়-আর্থিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক। কিন্তু আনন্দিত হলেও অনেকের মনেই যে আশংকা ও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। শেখ মুজিব ছিলেন এঁদেরই একজন। ইতিহাসের ঘটনাচক্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তান ছিল বাংলাদেশ অর্জনের প্রথম সিঁড়ি। পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশের সৃষ্টি অসম্ভব ছিল।

শেখ মুজিবের ঢাকায় আগমন
যাহোক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর ঢাকায় এসে সেখ মুজিব অল্পদিনের মধ্যেই কতিপয় স্বাধীনচেতা ও উন্নতমনা যুবকদের নিয়ে গঠন করেন ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক লীগ’। টাঙ্গাইলের জনাব শামসুল হকও ডেমোক্র্যাটিক লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এ সময় শেখ মুজিব মুসলিম ছাত্র লীগের গোড়াপত্তন করেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। আশৈশব তাঁর আকাঙ্খা যে, তিনি একজন আইনজীবি হবেন। তাই তিনি আইন বিভাগেই ভর্তি হয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মুখোশ উন্মোচন হতে শুরু করেছে। পূর্ব বাংলার অধিবাসী এক শোষণ থেকে আরেক শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হবার আশংকায় হতাশ হয়ে পড়তে লাগলেন। তাঁরা চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে, পশ্চিমারা তাঁদের মুখের ভাষাকে পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। ঢাকার যুব-সমাজ তাই আগে থেকেই সচেতন হয়ে উঠলেন।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত আকস্মিকভাবে ঘটে নি। আধুনিক কালের অন্যান্য সক্রিয় আন্দোলনের মত এরও একটি পশ্চাদভূমি ও মানসিক প্রস্তুতির পটভূমিকা ছিল। যদিও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন সক্রিয়ভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে, তথাপি দেশ বিভাগের পূর্বেই বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে সচেতন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে
পৃষ্ঠা নংঃ ৮০

প্রকাশিত পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক পত্র-পত্রিকা এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্রসমূহ বাঙালী মুসলিম লেখক সমাজের এক সচেতন প্রয়াসের স্বাক্ষর বহন করে চলেছিল।
লাহোর প্রস্তাবের পর পাকিস্তান সৃষ্টিই এই উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের আন্দোলনের একমাত্র বিষয় ছিল। ধর্মীয় উন্মাদনা পাকিস্তান প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশসমূহের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান ও ভাষাগত পার্থক্যকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। অবশ্য শিক্ষিত সমাজ যে এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না তা’ নয়, স্বাধীনতা আস্বাদনের সম্ভাবনা নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা নীরব ছিলেন মাত্র।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত ও বাঙালী লেখক সমাজের প্রতিবাদ
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্ট ব্যাটন পরিকল্পনা ঘোষণার পর ভাবী পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যার সাথে সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। আলোচনা কতকটা উত্তেজনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। কারণ শতকরা ৫৬ জন লোকের মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার ক’রে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চক্রান্তের কথা ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। বাঙালী লেখকবৃন্দ এ বিষয়ে নীরব থাকতে পারেন নি। তাঁরা এ অশুভ প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বিরোধিতাপূর্ণ যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন। বাংলার স্বপক্ষে তাঁরা দৈনিক, মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় জোড়ালো প্রবন্ধ লিখে প্রচার কার্য চালিয়ে যান। ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ ও ‘দৈনিক আজাদ’ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তিই ছিল না। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সে ভাষার স্থান আঞ্চলিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা বা ইংরেজীর মত তা’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনে সমর্থ হয় নি। তা’ছাড়া উর্দুভাষী লোকের সংখ্যাও ছিল নগণ্য।
পক্ষান্তরে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জনের অধিকারী কবিগুরুর মাধ্যমে এ ভাষার সাহিত্য বিশ্ব-দরবারে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত । তাছাড়া বাংলা ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা পরিকল্পিত ভাবী পাকিস্তানের সমগ্র লোকসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী।
পৃষ্ঠা নংঃ ৮১

তথাপি উর্দু-সমর্থকরা বাংলার প্রতি একটুকুও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁরা বাংলাকে হিন্দু-সংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতার ভাষা বলে মনে করতেন। মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার অযোগ্য।
উর্দু-সমর্থকদের এই বক্তব্যের ও যুক্তির পেছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমানঃ
১। বাংলাভাষা চর্চায় হিন্দুদের প্রায় একাধিপত্য ছিল।
২। বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ কতিপয় হিন্দু সাহিত্যিকগণ মুসলমানদের চরিত্রের প্রতি কলঙ্ক লেপন ক’রে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন।
৩। রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্ববরেণ্য কবির রচনাতেও মুসলিম চরিত্র প্রায় অনুপস্থিত।
৪। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান কোনক্রমেই অস্বীকার করবার নয়; অথচ হিন্দু সমালোচকরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁদের কথা এড়িয়ে গেছেন।
৫। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য হিন্দু ভাবধারার পরিচয় বহন করে।
মোট কথা, একটি নিছক সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এই অভিযোগগুলো তুলে ধরা হয়েছিল। আসলে এসব অভিযোগ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রয়াস মাত্র। এটা যে ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে বাঙালীকে দাবিয়ে রাখবার কৌশল মাত্র বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তা’ স্পষ্টতঃ অনুধাবন করেছিলেন।
উর্দু রাষ্ট্রভাষা হ’লে বাঙালী মুসলমানদের ভাগ্যে কি পরিণতি ঘটতে পারে সে বিষয়ে বাঙালী শিক্ষিত সমাজ অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাঙালী মুসলমানগণ বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তা’ হ’লে সরকারী চাকরী, ব্যবসা ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে উর্দুভাষীর অগ্রাধিকার পাবে এবং আস্তে আস্তে বাঙালীদেরকে গ্রাস করে নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে। এর অর্থই হ’ল বাঙালী সত্তার সমাধি, অন্য কথায় পূর্ব পাকিস্তানবাসীদেরকে পুনরায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধকরণ। তাঁদের এই আশঙ্কা
পৃষ্ঠা নংঃ ৮২

যে অমূলক ছিল না, পরবর্তীকালে রক্তাক্ত আন্দোলনের ফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও পঁচিশ বছরের পাকিস্তানী রাজত্বই তাঁর প্রমাণ দিয়েছে।

ভাষা-চেতনার মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ
সেদিন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাঙালীরা ভাষার প্রশ্নে যে স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সেটাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকাই জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের প্রথম সোপান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে যে, উর্দুকে রাষ্টভাষা হিসেবে গ্রহণের চক্রান্তের প্রতিবাদে বাঙালী লেখক সমাজই প্রথমে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক বাঙালী নেতারা পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত তেমন সক্রিয়তার পরিচয় দেন নি। ফলে ভাষা আন্দোলনের প্রথম স্তর প্রধানতঃ লেখার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। অবশ্য বাঙালী লেখক সমাজের সবাই যে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলনের স্বপক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন, তা’ নয়। অনেক বাঙালী লেখক উর্দুর মধ্যে ইসলামের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন। এবং তাতে ভাবী পাকিস্তানের ইসলামী সংস্কৃতি প্রসারের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক হবে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য তাঁরাও যে বাংলাকে একেবারে বাদ দিতে বলেছিলেন, এমন নয়। সরকার পরিচালনা ও আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে তাঁরা উর্দুকে প্রাধান্য দিয়ে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে সুপারিশ করেছেন। কিন্তু তাঁদের কণ্ঠ তেমন সোচ্চার ছিল না। উর্দুর পক্ষে যুক্তির অসারতাই তার কারণ।
কেউ কেউ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষারই নাম প্রস্তাব করেন। আবার কেউ কেউ লাহোর প্রস্তাবের মূল নীতিকে সামনে রেখে পূর্ব ও পশ্চিম-এই দু’টো পৃথক পৃথক অঞ্চলের জন্য যথাক্রমে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা প্রচলনের জন্যও সুপারিশ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, লাহোর প্রস্তাবে প্রদেশসমূহকে পূর্ণাংগ স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ করা হয়েছিল এবং আশা করা গিয়েছিল ‘আজাদী হাসেল’ হলে লাহোর প্রস্তাবের মূল নীতি সম্পূর্ণ কার্যকরী হবে।
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৩

রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সঠিক মীমাংসায় বাঙালী লেখকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও তাঁরা সবাই একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে, বাংলাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উর্দুকে ভাবী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে না। যদি জোর করে তা’ বাঙালীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়, তা’ হ’লে তার পরিণতি যে শুভ হবে না, সে সম্পর্কেও তাঁরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২শে জুন ও ২৯শে জুন তারিখে মোহাম্মদ আবদুল হকের ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দু’ দফায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটিতে লেখক বাঙালীর ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যের স্বপক্ষে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। এই সঙ্গে বাঙালী জাতির হীনমন্যতার পরিচয়ও তাতে বিধৃত হয়েছিল। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় দফায় লেখক বলেছেনঃ
“প্রায় বাঙালী এটা মনেপ্রাণে জানেন যে, হিন্দী উর্দু ভাষীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তাঁকে হিন্দী উর্দু বলতে হবে। কেননা অপর পক্ষ বাংলা জানেন না। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হলেও এটা একটা বাধ্যবাধকতা; এরূপ বাংলা জানা এবং বলার বাধ্যবাধকতা ও গরজ এখন পর্যন্ত অবাঙালীর নেই।” এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি উক্ত প্রবন্ধেই বলেছেনঃ
“বাঙালীর জাতীয়তাবোধ এখনো পরিপূর্ণভাবে স্ফূরিত হয় নি। তার জাতীয় মর্যাদাবোধ এখনো অত্যন্ত কাঁচা, তাঁর পূর্ণ জাতীয় ব্যক্তিত্ববোধ এখনো অপ্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই বাঙালীরা সাধারণতঃ বুঝতে পারেন না যে, নিজ বাসভূমেও ইংরেজ তথা অবাঙালীদের সঙ্গে তাদেরই ভাষায় কথা বললে জাতীয় বোধের দিক থেকে নিজেকে ছোট করা হয়, নিজের অমর্যাদা করা হয়, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয় হয়। ……… আমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময়েই উদ্যত থাকেঃ আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজী উর্দু হিন্দী বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দু হিন্দী ভাষীরা কেন বাংলা লিখতে বাধ্য হবে না?”
প্রশ্নটিকে এই ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যবোধের বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সূচনা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবন্ধ প্রকাশের দু’দিন আগে অর্থাৎ ২৭শে জুন (১৯৪৭) ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৪

পত্রিকায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে তার পরিণাম কি হতে পারে সে সম্পর্কে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে। উক্ত পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিলঃ
“একটা দেশকে পুরোপুরি দাসত্বে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীর যত রকম অস্ত্র আছে, তার মধ্যে সব চাইতে ঘৃণ্য ও মারাত্মক অস্ত্র হইতেছে সেই দেশের মাতৃভাষার পরিবর্তে একটি বিদেশীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা। মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে এই ঘৃণ্য দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধিতে যদি কেউ বাসনা করে, তাহা হইলে তাহার সেই উদ্ভট বাসনা বাঙালীর প্রবল জনমতে ঝড়ের তোড়ে তৃণখণ্ডের মত ভাসিয়া যাইবে।”
৩০শে জুন (১৯৪৭) ‘দৈনিক আজাদ’-এর সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ভাষার প্রশ্নের মীমাংসাকল্পে বাংলা ভাষার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে তা’ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুস্পষ্ট দাবী জানানো হয়। এতে বলা হয়েছিল; “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা’ এখন স্থির করার সময় এসেছে। যে ভাষাকেই আমরা রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে, কোন ভাষায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশী লোক কথা বলে। পাকিস্তানের মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ঠ ভাষা কোনটি, কোন ভাষায় সব থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন ভাষা ভাব প্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশী উপযোগী। ………যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবীই সবচেয়ে বেশী। …… এর মধ্যে দ্ব্যর্থক যদিও কিছু নেই তবু এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন মনে করছি যে কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই নয় পশ্চিম পাকিস্তান সহ সমগ্র পাকিস্তানেরই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবী এবং যোগ্যতা সবচেয়ে বেশী বাংলা ভাষার।”
প্রবন্ধটিতে উর্দু এবং বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করা হয় এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হ’লে পূর্ব বাংলার ৫ কোটি বাঙালীর পক্ষে তার ফলাফল কি হতে পারে,
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৫

সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে আশঙ্কাস্বরূপ দেখানো হয়েছে যে, এর ফলে শিক্ষা, চাকরি প্রভৃতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাঙালীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পক্ষান্তরে উর্দুভাষীরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অধিকতর সমৃদ্ধির সুযোগ লাভ করবে। উক্ত প্রবন্ধে আরো আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করলে আমাদের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে। কেননা, যে ইংরেজী সাহিত্য বাংলা অপেক্ষা বহুগুণে উন্নত এবং যার প্রভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করেছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হ’লে অনিবার্যভাবেই বাংলা ভাষা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। আর “ যে সাহিত্য শ্রেষ্ঠতর নয়, তার প্রভাব পড়বে শ্রেষ্ঠতর সাহিত্যের উপর, এবং তার ফলে বাংলা সাহিত্য লাভবান না হয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তাছাড়া যে-ইংরেজীকে বাঙালীরা এতকাল বিদেশী ভাষা বলে নিজেদের ভাষার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার সযত্ন প্রয়াস চালিয়ে এসেছেন, উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হ’লে পাকিস্তানী বাঙালীরা হয়তো আর তা’ রক্ষা করতে পারবে না। তাই উক্ত সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “এতে এমন সম্ভাবনাও আছে যে, আমরা সম্পূর্ণভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বর্জন ক’রে সম্পূর্ণভাবে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করবো; বাংলা সাহিত্যের আসর থেকে আমরা চির বিদায় নেব………যার অর্থ হবে আমাদের মৃত্যু।”
ঠিক এ ধরনেরই আশঙ্কার প্রতিধ্বনি করেছিলেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্টি’ নামক একটি সংকলনে ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক। ১৩৫৪ সনের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি উর্দুকে ইংরেজীর মত ‘অপরিচিত বিদেশী ভাষা’ হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এর স্বীকৃতির বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, যদি এই প্রস্তাব কার্যকরী হয় তা’ হ’লে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে। ……উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৬

সর্ব বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণ ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেজী রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র।”
[ কৃষ্টি, কার্তিক, ১৩৫৪, পৃঃ ৩০]
উক্ত প্রবন্ধে তিনি আরো বলেছেনঃ “উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকার করিয়া লইলে বাংলা ভাষার সমাধি রচনা করিতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানবাসীরও জাতি হিসাবে ‘গোর’ দেওয়ার আয়োজন করিতে হইবে।”
বাঙালী জাতির এই সম্ভাব্য অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ডঃ এনামুল হক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যথাক্রমে বাংলা ও উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব করেন। এক রাষ্ট্রে একাধিক ভাষা অচল বলে যারা মত প্রকাশ করেন সে সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই শ্রেণীর ধারণা সাম্রাজ্যবাদের পরিপোষক।”
[ কৃষ্টি, কার্তিক, ১৩৫৪, পৃঃ ৩২]
লক্ষণীয়, ডঃ এনামুল হক উভয় ভাষাকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু কোন একটি বিশেষ ভাষার দাবীকে এককভাবে অগ্রাধিকার দেন নি।
এ বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায় ২০শে জুলাই তারিখের ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় মাহবুব জামাল জাহেদীর লেখা একটি প্রবন্ধে। ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে লিখিত একটি প্রবন্ধে তিনি বাংলা ও উর্দু উভয়কেই যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দেন। ডঃ এনামুল হকের ন্যায় তিনিও উর্দুকে বিদেশী ভাষা বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য প্রদেশদ্বয়ের জন্য রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করতে পারেন নি।
কবি ফররুখ আহমদ সম্পূর্ণ অন্য কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর এই সমর্থনের মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবোধ বলে কিছু ছিল না। তিনি যতটা ছিলেন বাঙালী, তার চেয়েও ঢের বেশী ছিলেন পাকিস্তানী। পাকিস্তানের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি শুধু সচেতনই ছিলেন না, তা’ বাস্তবায়নের জন্যও তিনি ছিলেন
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৭

সচেষ্ট। বলা বাহুল্য, ইসলামী সংস্কৃতি প্রকাশের সুবিধার্থেই তিনি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই এ সত্য ধরা পড়ে। আশ্বিন সংখ্যা (১৩৫৪) ‘সওগাত’-এ ‘পাকিস্তানঃ রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।”
ফররুখ আহমদ এবং তাঁর ন্যায় উগ্র ইসলামপন্থীরা বাংলাকে সমর্থন করেছিলেন এই কারণে যে, বাংলাদেশে যদি ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করতে হয়, তবে বাংলা ভাষার মাধ্যমেই তা’ করতে হবে। বাংলা ভাষাকে বর্জন করে তা’ বাস্তবায়ন করা দুরূহ কার্য হবে। তথাপি যে কারণেই তাঁরা সমর্থন করুন, এই সমর্থন নিঃসন্দেহে প্রগতিবাদী সমাজকে সাহায্য করেছে। এ দিক থেকেই ফররুখের একটি উক্তি সেদিন অভিনন্দিত হয়েছিলঃ
“গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপায়িত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
[ সওগাত, আশ্বিন, ১৩৫৪]
আগেই বলা হয়েছে যে, উর্দু ভাষার দাবীদাররা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বাংলাকে ‘হিন্দুর ভাষা’ এবং ‘হিন্দু-সংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতার ভাষা’ বলে অভিহিত করেছেন। উর্দু ভাষীদের এই অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭শে জুলাই (১৯৪৭) তারিখের ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় মোহাম্মদ আবদুল হক ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ “পাকিস্তানে এই মানসিকতার প্রসার ঘটার সম্ভাবনা আছে, এবং প্রসার ঘটলে বাঙালী মুসলমান হয়তো একদিন বাংলাকে বর্জন করে উর্দুকেই মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করে বসতে পারে। কিন্তু বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা নয়, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ভাষা এবং হিন্দুর চেয়ে বাঙালী মুসলমানের সংখ্যাই বেশী। এককালে এ ভাষার প্রতি
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৮

ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতের বিদ্বেষ ছিল, মুসলিম রাজশক্তিই একে লালন করে সম্মানের আসন দিয়েছে। পৌত্তলিকতা কোনো ভাষার স্থায়ী লক্ষণ বা একমাত্র লক্ষণ নয়, কোন ধর্মালম্বী লেখক, কোন ভাষায় কি পরিমাণে লিখেছেন, তার উপরই নির্ভর করে সে ভাষায় কোনো বিশেষ ধর্মের প্রভাব কতখানি। অন্যথায় কোনো ভাষাই, কোনো ভাষা থেকে পবিত্রতর বা অপবিত্রতর নয়।”
১৩৫৪ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মাসিক সওগাত’-এ ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন উভয় প্রদেশের জন্য পৃথক পৃথক রাষ্ট্রভাষা না করে বরং সমগ্র পাকিস্তানের জন্যই উর্দু ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলন করার প্রস্তাব দেন। নতুবা, “বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তা’ হ’লে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।”
কিন্তু এতদসত্ত্বেও কোন কোন মুসলমান লেখক উর্দুর পক্ষে ওকালতি করেছেন। এ বিষয়ে ‘সওগাতের’ ভূমিকা ছিলো দুঃখজনক। যদিও এই পত্রিকায় কতিপয় লেখক বাংলা ভাষার পক্ষে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তথাপি সওগাতের সম্পাদকীয় নীতি ছিল উর্দুর স্বপক্ষে। সওগাত প্রথম থেকে শেষাবধি এই নীতিই অনুসরণ করে এসেছে। অবশ্য সওগাতগোষ্ঠী বাংলাকে একেবারে অস্বীকার করেন নি, তবে পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার স্বাভাবিক বাহন হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের পক্ষে তাঁরা মত দিয়েছেন। পক্ষান্তরে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারী ভাষা ও আন্তঃপ্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর প্রস্তাব করেছেন। সওগাতের পৌষ (১৩৫৪) সংখ্যায় মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘শিক্ষার কথা’ প্রবন্ধে এই বক্তব্যের সোচ্চার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সে সময় সওগাতের সম্পাদকীয় লিখতেন উক্ত প্রবন্ধেরই লেখক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী। শুধু সে সময়ই নয়, পরবর্তীকালে ভাষা আন্দোলন যখন কতকটা সক্রিয় আকার ধারণ করতে চলেছিল, তখনও এই পত্রিকা দুঃখজনকভাবে উর্দুর স্বপক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন
পৃষ্ঠা নংঃ ৮৯

১৩৫৪ সনের চৈত্র সংখ্যায় সওগাত সম্পাদক তাঁর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেনঃ
“উর্দুকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও আন্তুঃপ্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হইতেছে এবং সমগ্র পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক করা সঙ্গত হইবে। ইংরেজীর স্থলে উর্দুই অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা। (Lingua Franca) হইবে এবং হওয়া উচিতও।”
[পৃঃ ২৩৯]
বলা বাহুল্য, সওগাতের এই উর্দুপ্রীতির পেছনে যে কারণ বর্তমান ছিল, তা’ হ’ল ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের অস্বাভাবিক দুর্বলতা। তাঁদের ধারণা ছিল যে, উর্দু ইসলামী চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ এবং এটি একটি অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাষা। এ ভাষার সম্মান তাঁদের কাছে কতকটা আরবীর মতই। তাই ইসলামী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই তাঁরা এমন প্রচারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এদিকে ঢাকাতেও রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত আলোচনা ধীরে ধীরে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে থাকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই ঢাকার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র সমাজ উর্দুকে চাপিয়ে দেবার মাধ্যমে একটি অকল্যাণের পূর্বাভাস সতর্কতার সংগে লক্ষ্য করতে থাকেন।
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় জুলাই মাসে ‘গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন গঠন করা হয়। ঢাকাস্থ মুসলিম লীগের নেতা কমরুদ্দিন আহমদ কর্তৃক ‘গণ-আজাদী লীগে’র আশুদাবী কর্মসূচী শীর্ষক ম্যানিফেস্টোতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়ঃ

গণ-আজাদী লীগ
“রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন মূল্যই নাই, যদি সেই স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে, কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভয় নয়। সুতরাং আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব।”
[ আশুদাবী কর্মসূচী, পৃঃ ১]
পৃষ্ঠা নংঃ ৯০

আরো বলা হয়ঃ
“বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”
গণ-আজাদী লীগের সাথে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে এসে প্রত্যক্ষভাবে এই জাতীয় আন্দোলনে সমর্থন জানাতে থাকেন। ‘গণ-আজাদী লীগ’ একটি দল হিসেবে মূলতঃ নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েই কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রেখেছিল। ১৯৫০ সালে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ‘সিভিল লিভার্টিজ লীগ’। কিন্তু নানা কারণে একটি শক্তশালী দল হিসেবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।

ভাষার প্রশ্নে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমত
ওদিকে আবার ঠিক এই মুহূর্তেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ডঃ জিয়াউদ্দিন এই বিতর্কের সূত্রপাত করেন ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে। তাঁর এই অভিমত প্রকাশিত হবার পর পরই ১৩৫৪ সনের ১২ই শ্রাবণ সংখ্যায় দৈনিক আজাদে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে এতে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেনঃ
“বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।”
[ “আমাদের ভাষা সমস্যা”, রেনেসাস পাবলিকেশন, পৃঃ ৩৪ – ৩৫]
অবশ্য একজন বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও পণ্ডিত ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শুধুমাত্র বাংলার দাবীই তুলেছিলেন
পৃষ্ঠা নংঃ ৯১

তাই নয়, ভাষা হিসেবে উর্দু যে রাষ্ট্রভাষা অর্জন করতে পারে না এ কথাও যুক্তিসহ প্রমান করেছিলেন। উর্দু একটি ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে শুধু জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, জাতীয় শিক্ষা বা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত হতে পারে না।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে বাংলা সমস্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবার দাবিদার এবং পূর্ব বাংলার সমগ্র কাজে এই ভাষা ব্যবহৃত বাঞ্ছনীয়। শুধু তাই নয়, বাংলার সাথে সাথে বৈকল্পিক ভাষা হিসেবে আরবী ও ইংরেজী গ্রহণের পক্ষেও তিনি মত দেন।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আরবীর পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন বলে তাঁকে ভুল বুঝবার অবকাশ আছে। কিন্তু মনে রাখতে হব যে, সবার উর্ধ্বে তিনি বাংলাকেই স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রেই আরবীর পক্ষে তিনি ওকালতি করেছিলেন। আর তিনি এই যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন উর্দুকে প্রতিরোধ করার জন্য। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে ভারতাগত পশ্চিমা এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যাবে-উর্দু এঁদের অনেকেরই মাতৃভাষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোকের পক্ষে উর্দু শেখা সহজ। অন্যপক্ষে আরবী রাষ্ট্রভাষা হ’লে বাঙালী ও পশ্চিম পাকিস্থানী উভয়েরই জন্যই তা’ হবে একটি বিদেশী ভাষা-কারো বিশেষ সুবিধা ভোগের প্রশ্ন উঠবে না।
এছাড়া ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, আরবী বেহেস্তের রাষ্ট্রভাষাও বটে। মৃত্যুর পরেও এ ভাষার আবেদন চিরন্তন। অন্যপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হ’লে উর্দুর চেয়ে আরবীর প্রয়োজন অনেক বেশী। মোটামুটি এই সব যুক্তিই ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র চেতনাকে পরিচালনা করেছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বাংলাকে তিনি সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার জন্য তিনি সেদিন সমগ্র বাংলা ভাষার ছাত্রদের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর ন্যায় অনমনীয় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব বাংলা ভাষার আন্দোলনকে বহুলাংশে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কোন প্রলোভন বা ভয় তাঁকে এই সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি।
পৃষ্ঠা নংঃ ৯২

পূর্বেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে উগ্র ইসলামপন্থীদের অনেকেই নানাবিধ কারণে বাংলা ভাষার সপক্ষে জোরালোভাবে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে তমদ্দুন মজলিশের কর্মকর্তা ও কর্মীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব এই মজলিশকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থন দান করেন।

তমদ্দুন মজলিশ
এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র এবং অধ্যাপকের উদ্যোগে নিজেদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়। এই মজলিশ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বব তারিখে প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা না উর্দু’-এই শীর্ষক একটি পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য জোরালো ভাষায় বক্তব্য পেশ করেন এবং প্রয়োজনবোধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে আহ্বান জানান।

তমদ্দুন মজলিশের প্রস্তাব
উক্ত পুস্তিকার প্রবন্ধগুলোতে নানা যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা হয় যে, বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত। পুস্তিকাটির মুখবন্ধে তমদ্দুন মজলিশের একটি প্রস্তাব সন্নিবেশিত হয়। প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছিলঃ
১। বাংলা ভাষাই হবে-
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা।
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা দু’টি-বাংলা ও উর্দু।
৩। বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা।
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ’ জনই এ ভাষা শিক্ষা করবেন।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরী ইত্যাদি কাজে যারা নিযুক্ত হবেন শুধু তারাই এ ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে।
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৩

মাধ্যমিক স্কুলে উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া যাবে।
(গ) ইংরেজী হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসাবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকুরী করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়োজিত হবেন, তাঁরাই শুধু ইংরেজী শিক্ষা করবেন। তাঁদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের হাজারকরা ১জনের চেয়ে কখনো বেশী হবে না। ঠিক এই নীতি হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে (স্থানীয় ভাষার দাবী না উঠলে) উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজী তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে।
৪। শাসন কার্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাততঃ কয়েক বৎসরের জন্য ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকার্য চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে। দেশের শক্তির যাতে অপচয় না হয় এবং যে ভাষাতে দেশের জনগণের সহজে ও অল্প সময়ে লিখতে, শিখতে ও বলতে পারে সে ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই অকাট্য যুক্তিই উপরোক্ত প্রস্তাবের প্রধান ভিত্তি।
[ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা না উর্দু, পৃঃ ৩ -৪]
পরবর্তীকালে এই তমদ্দুন মজলিশ যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তবু ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুসলি সংস্কৃতি বলতে যে আরবীয় সংস্কৃতির চিন্তা এঁদের মনে ছিল বাংলা জাতীয়তাবাদ চেতনা প্রকট হবার সাথে সাথে তাঁর সাথে তাঁদের গরমিল দেখা দিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে এঁরা আর সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। যাহোক, ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে ভাষার প্রশ্ন আলোচনার জন্য এক সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। সভায় যারা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কাশেম এবং কয়েকজন মন্ত্রী।
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৪

প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
এ সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান করাচীতে বসে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কয়েকটি আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এতে বাংলা ভাষাভাষীদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ফলে মজলিশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালীরা একাত্মতাবোধ করে। তারা আস্তে আস্তে ইউনিভার্সিটির নিকটস্থ মজলিশের অফিসে আসতে শুরু করে। “এই অফিসেই মজলিশ কর্মীদের এক বৈঠকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তদানীন্তন মজলিশ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া সংগ্রাম পরিষদের প্রথম কনভেনর নির্বাচিত হন।”
[ সৈনিক, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৩, শহীদ সংখ্যা, পৃঃ ৫ -৬]
এই সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা প্রথমে ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে এক তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রী কর্মীদের সঙ্গে কতকটা অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করেন।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে উক্ত সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষার দাবী জ্ঞাপক একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে এবং কয়েক হাজার স্বাক্ষরসহ সেটি সরকারের নিকট প্রেরিত হয়। এ ব্যাপারে অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবও অক্লান্ত পরিশ্রমে ব্রতী হন।

ভাষা আন্দোলন দাবিয়ে রাখতে সরকারী অপচেষ্টা
অতঃপর সংগ্রাম পরিষদের এই আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। সরকারের এই হীন প্রচেষ্টার বর্ণনা দিতে গিয়ে ১৯৫৩ সালের শহীদ সংখ্যা (২১শে ফেব্রুয়ারী) ‘সৈনিক” লিখেছেনঃ
“আন্দোলন এইভাবে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে ইহাকে মূলেই পণ্ড করিয়া দিয়া ইহার মধ্যে দিয়া স্বার্থোদ্ধারের জন্য জোর চেষ্টা হইতে থাকে। সরকারী এজেন্ট বলিয়া সন্দেহ করা হইয়াছিল এমন কয়েকজন লোক বড় বড় সংগ্রামী কথা বলিয়া সংগ্রাম পরিষদে ঢুকিবার চেষ্টা করিতে থাকে-তাহারা নানা রকম অবাস্তব কথা তুলিয়া ছাত্র ও কর্মীদের মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পায়। অন্যদিকে কয়েকজন এম. এল. এ. এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করিয়া মন্ত্রিত্ব পাইবার জন্য মাতিয়া উঠেন। ইহাদের অনুসারী বহু ছাত্রও
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৫

এই কার্যে নিযুক্ত হইয়া ভাষা আন্দোলনকে তলাইয়া দিয়া ইহাকে মন্ত্রিত্ব সঙ্কট আন্দোলনে পরিণত করার জন্য ইহারা উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যায়। বলা বাহুল্য, কিছুদিন আগেও ইহারা ভাষা আন্দোলনকে অবাঞ্ছিত বলিয়া মনে করিতেন। এই সময় বড় বড় বক্তৃতা দিয়া মোহাম্মদ আলী সাহেব, তোফাজ্জল আলী সাহেব ও নসরুল্লাহ সাহেব প্রভৃতি এম. এল. এ. বাংলাভক্ত হইয়া ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। তৃতীয় আর একদল এই আন্দোলনকে স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য, ইহারা কমবেশী ছাত্র ফেডারেশনের সভ্য ছিল। এতদিন ইহারা কোন কাজেই আগাইয়া আসে নাই। অথচ আন্দোলন যখন বেশ জমিয়া উঠিয়াছে তখন ইহারা গোপনে পাকিস্তান বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক কয়েকটি হ্যাণ্ডবিল ও পোস্টার দিয়া জনগণকে আন্দোলন বিরোধী করিয়া তোলে। জনসাধারণ তখন সন্দেহ করিতে আরম্ভ করে যে, এই আন্দোলন নিশ্চয়ই ভারতের প্ররোচিত। এমনও হইয়াছে যে, কয়েকজন ছাত্র ফেডারেশন কর্মীকে উত্তরবঙ্গে প্রচারের জন্য যাতায়াত খরচ দিয়া পাঠানো হইয়াছিল। কিন্তু ঐ কর্মীরা ভাষা আন্দোলনের জন্য তো কোন কাজই করে নাই, বরং সেই টাকার কোন হিসাবও দিতে পারে নাই।
অপূর্ব মিলনঃ
এইভাবে সরকারী গুপ্তচর, মন্ত্রিত্বলোভীরা এবং তথাকথিত প্রগতিশীলরা এক জোট বাঁধিয়া ভাষা আন্দোলনকে স্যাবোটেজ করার কাজে লাগিয়া যায়। এবং নানারূপ অবান্তর প্রচার করিয়া জনমত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। অনেক এম. এল. এ. বড় বড় কথা বলিয়া নেতা হইয়াছেন এবং তাহাঁরা আন্দোলনের সুযোগে রাষ্ট্রদূতের পদ বা মন্ত্রিত্ব লাভ করেন (জনাব মোহাম্মদ আলী ও জনাব তোফাজ্জল আলী সাহেব)। ইহারাই মন্ত্রিত্ব পাইয়া প্রকাশ্যভাবে বাংলার বিরুদ্ধচরণ করিতেও লজ্জাবোধ করেন নাই।”
[ সৈনিক, শহীদ সংখ্যা, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৩, পৃঃ ৫ – ৬]
এদিকে প্রগতিবাদী ও বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী যুবকগণ কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। সেদিন গণতান্ত্রিক
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৬

যুবলীগ এবং মুসলিম ছাত্রলীগ এই দুই যুব প্রতিষ্ঠান গঠন ও যুব সমাজে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার অধিকার অর্জনের প্রয়াসে অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিব ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা।

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা
প্রতিষ্ঠার স্বল্পকালের মধ্যেই ছাত্রলীগ দুটো দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহ আজিজুর রহমান এই দলটিকে মুসলিম লীগের লেজুড় হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে প্রাধান্য দেবার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক নীতির উপাসক শেখ মুজিব এতে বাঁধা প্রদান করেন এবং পরিণামে এই দলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব, আজিজ আহমদ, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ব্যক্তির নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ বলে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মিঃ নঈমুদ্দিন। ভাষা আন্দোলনে এই দল একটি বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে। তমদ্দুন মজলিশের সাথে হাত মিলিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ও এই আন্দোলনকে একটি সার্বিক ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে উন্নীত করতে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। প্রথমদিকে কতকগুলো রাজনৈতিক কারণে ছাত্রলীগের নামের পূর্বে ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করলেও এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী ছিল। পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই এই ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নামে দলটির নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমে এই ছাত্রদলের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।
যেমন দেশে একটি সুষ্ঠু যুব আন্দোলন গড়ে তুলতে, তেমনি বাংলা ভাষাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে শেখ মুজিবের অক্লান্ত নেতৃত্ব বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। ১৯৪৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারী বাসভবন তৎকালীন বর্ধমান হাউসে এবং বর্তমান বাংলা একাডেমীতে বঙ্গীয়
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৭

প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়াকিং কমিটির একটি বৈঠক বসে-প্রধানতঃ ভাষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণই এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল। বৈঠক চলাকালে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের একটি মিছিল সেখানে বাংলা ভাষার দাবী জানিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবও এই মিছিলের নেতৃত্ব দান করেন।

বাংলা ভাষার প্রশ্নে লিয়াকত আলীর মন্তব্য
১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট মুসলিম লীগের কর্তৃত্বকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে বামপন্থি কর্মীরা ঢাকা শহরে একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ওয়ার্কাস ক্যাম্প নামে এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দান করেন এবং বাংলা দেশের মানুষের সার্বিক স্বার্থে দেশের যুবশক্তি ও বামপন্থীদের সংঘবদ্ধ করতে কতকগুলো বৈল্পবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। ইংরেজী ও উর্দুর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করেন শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর এই প্রস্তাবের সমর্থনে কয়েকজন সদস্যও বক্তৃতা দেন। কিন্তু এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র ক’রে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং লিয়াকত আলী খান পর্যন্তু ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধিতে তিনি তাঁর ভাষণে হিন্দু প্রাধান্যের সূত্র সন্ধান করেন। তিনি বলেনঃ
“প্রথমে এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্যে নির্দোষ বলিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”
[ নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ, ১৯৪৮]
বলা বাহুল্য, লিয়াকত আলী খানের বক্তৃতায় হিন্দু সদস্যদের প্রতি সুস্পষ্ট কটাক্ষপাত বিদ্যমান।
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৮

খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্তব্য
ঐ অধিবেশনে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুর সপক্ষে একটি উদ্ভট রায় প্রকাশ করেন। তিনি বলেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।”
[ নওবেলাল, ৪ঠা মার্চ, ১৯৪৮]

সংবাদপত্রের প্রতিক্রিয়া
২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ তারিখে অনুষ্ঠিত গণপরিষদে প্রদত্ত খাজা নাজিমদ্দিনের এই বক্তৃতার ফলে পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রদেশের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ ২৭শে ফেব্রুয়ারী ‘বাংলা ভাষা ও পাকিস্তান’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেনঃ
“খাজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভোট গহণ করিলেন,তাহা আমরা জানি না। আমাদের মতে, তাঁর উপরোক্ত উক্তি মোটেই সত্য নয় । আমরা বিশ্বাস করি, গণভোট গ্রহণ করিলে বাংলা ভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯ ভোটের বড় কম হইবে না। এ অবস্থায় এমন গুরুতও ব্যাপারে তিনি (খাজা নাজিমুদ্দিন) এইরূপ একটি দায়িত্বহীন উক্তি করিয়া শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থেরই ক্ষতি করেন নাই, এদেশবাসীর পক্ষে আপন প্রধিনিধিত্বের অধিকারে মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ন করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থকে এভাবে বিকাইয়া দেওয়া কি এতই সহজ?”

জনগণের প্রতিক্রিয়া
মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়, এমনকি গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবী পর্যন্ত অগ্রাহ্য হওয়ার সংবাদ ঢাকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্র প্রগতিবাদী ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল তীব্র অসন্তোষে ফেটে পড়তে থাকে। ২৬শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় এক ধর্মঘট পালন করা হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার ছাত্রসমাজ বাংলা ভাষার সমর্থনে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। পরে বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবুল কাশেম। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান করেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ৯৯

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
শেখ মুজিবসহ সকল প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। এই উদ্দেশ্যে প্রদেশের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা ২রা মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় মিলিত হন। কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাশেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সভায় গণপরিষদ সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণ আজাদী লীগ গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, ছাত্রাবাসাগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দু’জন করে প্রতিনিধি দান করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্ববায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ, তেমনি সুদূরপ্রসারী।

ঐতিহাসিক ১১ই মার্চ
সংগ্রাম পরিষদ ১১ই মার্চে সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঐদিন সারা পূর্ব বাংলায় এক প্রবল গণবিক্ষোভের উত্তাল তরঙ্গে সরকারের ভিত্তি কেঁপে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নব অধ্যায়ের সূচনা করে। এই দিনের ঘটনা যে ভাষা আন্দোলনে কতখানি গুরুত্ব সৃষ্টি করেছিল, জনাব কে. জি. মুস্তফা তাঁর একটি প্রবন্ধে তা’ তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকাও বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
‘১৯৫২ সালের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মূলতঃ প্রাচীন ও নবীন চিন্তাধারার দ্বন্দের ইতিহাস।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর এ দ্বন্দ্ব সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রাচীনপন্থীদের
পৃষ্ঠা নংঃ ১০০

নিকট লাহোর প্রস্তাবের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সমবায়’ ( sovereign and independent states) গঠনের প্রতিশ্রুতি ভারতবর্ষের, বিশেষতঃ বাংলাদেশ তরুণ বুদ্ধিজীবী সমাজকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। তাঁরা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করেছিল, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা তাদের আত্মবিকাশের দ্বার উন্মুক্ত করবে। বিভিন্ন সংস্কৃতির স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে, গণমুক্তির প্রথম স্তররূপে জাতীয় মুক্তির পথ প্রশস্ত করবে। তাদের একান্ত প্রত্যয় ছিল, বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় সত্তারূপে পাকিস্তান গড়ে তুলতে জাতীয় সার্বভৌমত্বের যে স্বীকৃতি অপরিহার্য, লাহোর প্রস্তাব তা’ সুনিশ্চিত করেছে। এবং পাকিস্তানকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী করার মূলমন্ত্রও ঐ স্বীকৃতিতে নিহিত।
প্রাচীনপন্থীরা নব্যশক্তির মোকাবিলায় ইতিহাসকে বিকৃত করার মহাজনী পন্থা অবলম্বন করলেন-কালক্ষেপ না ক’রে তাঁরা ঘোষণা করলেন-এক আল্লাহ, এক কোরান, এক রসুলের অনুসারী মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তান হবে এক রাষ্ট্র, এক ভাষা ও এক সংস্কৃতির দেশ। লাহোর প্রস্তাবের states শব্দের ‘s’ কে তাঁরা ব্যাখা দিলেন টাইপের ভুল।
লাহোর প্রস্তাবের এই বিকৃত ব্যাখ্যার প্রবক্তরা ভারতের সদ্য বিকাশোন্মুখ মুসলিম অর্থনৈতিক স্বার্থের সক্রিয় সহযোগিতায় বলীয়ান। সুতরাং অধিকতর বেপরোয়া। এবং এই বেপরোয়া মনোবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ ঘটলো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে এবং পরে কার্জন হলের সুধী সমাবেশে……১৯৪২ সালের ইতিহাসের বিকৃতি পর্যায় থেকে ব্রিটিশ সরকারের ৩রা জুনের (১৯৪৭) ঘোষণা পূর্বকাল পাকিস্তান আন্দোলনের অন্তর্নিহিত নব্যশক্তির প্রস্তুতি-পর্ব। কলকাতা সিটি মুসলিম ছাত্রলীগ ‘শহীদ হালিম’ গ্রুপের উদারপন্থী মুসলিম মহল এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ মুসলিম তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করলেন আসন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে ‘একটি গণতান্ত্রিক যুবসংস্থা ও একটি প্রগতিশীল ছাত্রসংস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা
পৃষ্ঠা নংঃ ১০১

গৃহীত হ’ল। পরবর্তীকালে জন্ম নিল পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ (শামসুল হক ও আতাউর রহমানের নেতৃত্বে) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি (শেখ মুজিবুর ও নঈমুদ্দিনের নেতৃত্বে) ।
প্রবীণ চিন্তাধারা ১৫ই আগস্টের পর যেমন পেলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক শক্তির উৎসাহ, নবীন চিন্তাধারা পেলো সাংগঠিক শক্তির হাতিয়ার ও উচ্চতর আদর্শের ধর্ম। ফলে উভয় চিন্তাধারার স্বাধীনতাপূর্ব কালের সুপ্ত দ্বন্দ্ব স্বাধীনতা উত্তরকালের সুস্পষ্ট সংকটে রূপান্তরিত হ’ল। এবং সে সংকটের গভীরতার অভিব্যক্তি ঘটলো কার্জন হলে সেই সুধী সমাবেশে-একমাত্র উর্দুর আসফালন স্তব্ধ হয়ে গেল বজ্রকণ্ঠের ‘না’ ধ্বনির তরঙ্গাঘাতে।
২১শে ফেব্রুয়ারী (৫২) আন্দোলনের পথিকৃত ১১ই মার্চের (৪৮) আন্দোলন ছিল এই ঐতিহাসিক ‘না’ ধ্বনির উত্তাল তরঙ্গ। ঢেউ লাগলো সারা প্রদেশে। স্বাধীনতাকামী জনসমষ্টির যেন নব যাত্রা শুরু হ’ল। তরুণ সমাজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে এরা বেরিয়ে এলো রাস্তায়। পুলিশের মুখোমুখি। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। এরা পাকিস্তানের নব্যশক্তির। স্বাধীনতা লাভের পূর্বে এরা উপরতলার চক্রান্ত উপেক্ষা ক’রে কলকাতার দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি মিছিলে সামিল হয়েছে। ব্রিটিশ-বিরোধী শ্লোগানে কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছে। ১৯শে জুলাইয়ের (১৯৪৬) সর্বাত্মক হরতাল সফল করেছে, ‘রশিদ আলী দিবসে’র যৌথ নেতৃত্বে অংশ গ্রহণ করেছে। ইতিহাসের গতি নির্ণয় করেছে এরা বালুঘাট উপনির্বাচনে, ৪৫ ও ৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে।
১১ই মার্চ এঁদের ত্যাগের পরীক্ষা, ঈমানের পরীক্ষা, নবলব্ধ চেতনার অগ্নিপরীক্ষা। এরা জয়ী হ’ল। চারদিন সংগ্রামের পর।”
[ ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৬৫, পৃঃ ২০৯ – ২১১]

কারাগারে শেখ মুজিব
১১ই মার্চের ধর্মঘট পালনের কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আগের দিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ব্যাপকভাবে পিকেটিং
পৃষ্ঠা নংঃ ১০২

করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নির্দিষ্ট দিনে ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করে। তারা ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করতে থাকলে সরকারের নির্দেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ধর্মঘটের জন্য পিকেটিং-এর সময় যেসব ছাত্রনেতা বন্দী হন, শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁকে প্রথমে কোতয়ালী থানায় ও পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ১১ই মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়ঃ
“বাংলাকে কেন্দ্রের সরকারী ভাষা না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১১ই মার্চ আহূত সাধারণ ধর্মঘটকে কার্যকর করার জন্যে আজ ঢাকাতে কিছু সংখ্যক অন্তর্ঘাতক এবং একদল ছাত্র ধর্মঘট করার চেষ্টা করে। শহরের সমস্ত মুসলিম এলাকা এবং অধিকাংশ অমুসলিম এলাকাগুলি ধর্মঘট পালন করতে অসম্মত হয়। শুধুমাত্র কিছু কিছু হিন্দু দোকানপাট বন্ধ থাকে। শহরের এবং আদালতের কাজকর্ম সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। রমনা এলাকায় অবশ্য ধর্মঘটকারীরা কিছু কিছু অফিসের লোকদের কাজে যোগদানে বাধা দেয়। পিকেটিং করার উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি দল সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট এবং অন্য কতকগুলি অফিসের সম্মুখে সমবেত হয়। এদের মধ্যে অনেককে শান্তভাবে স্থান ত্যাগ করতে সম্মত করা গেলেও অন্যান্যেরা আক্রমণোদ্যত হয়ে সেখানে অবস্থিত পুলিশ ও অফিসে যোগদানে ইচ্ছুক কিছু সংখ্যক লোকজনের উপর ইট-পাটকেল ছোড়ে এবং অন্যান্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। এর ফলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয় এবং ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। এক সময় দু’বার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ পর্যন্ত করতে হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শন ও পুলিশ তৎপরতার ফলে মোট চৌদ্দ ব্যক্তি আহত হন এবং তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে কেউই গুরুতরভাবে অথবা গুলির আঘাতে আহত হন নি। খানাতল্লাসীর ফলে যে সমস্ত প্রমাণাদি এখন সরকারের হস্তগত হয়েছে, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৩

বিভেদ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে হতবুদ্ধিতা সৃষ্টি ক’রে পাকিস্তানকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।”
[প্রেসনোট, ১২-৩-৪৮]

সরকারী নির্যাতনের প্রতিবাদ
সরকারী প্রেসনোটেই ১১ই মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে—যদিও সরকার সমস্ত দোষ কিছু সংখ্যক অন্তর্ঘাতক এবং একদল ছাত্রের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, প্রেসনোটটিতে সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
পরদিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে ১১ই মার্চের নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন। বিবৃতিতে তিনি ঐ দিনের ঘটনাবলীতে আহত ও পুলিশ কর্তৃক ধৃত ছাত্রদের একটি হিসেবও দেন। তাঁর মতে, সর্বমোট আহতের সংখ্যা ২০০, গুরুতররূপে আহত ১৮, ধৃত ৯০০ এবং জেলবন্দী ৬৯। ধৃত কর্মীদের মধ্যে অনেককে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
১২ই মার্চে জগন্নাথ কলেজে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ছাত্রেরা মিছিল বের করে। পুলিশী জুলুম ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ঢাকার সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
১১ই মার্চের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ই মার্চে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং তা’ ১৫ই মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৪ই মার্চে ঢাকাসহ প্রদেশের সকল জেলাতেও পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়।
১৫ই মার্চ তারিখের ধর্মঘটে পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেন। সেক্রেটারীয়েটের কর্মচারী, অন্যান্য অফিসের বাঙালী কর্মচারী, এমন কি শেষ পর্যন্ত রেলকর্মচারীরাও তাঁদের কাজ ফেলে রেখে ধর্মঘটে যোগ দেন। পুলিশও পাইকারী হারে গ্রেফতার করতে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের গেটের সামনে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাসও নিক্ষেপ করে।
ইতিমধ্যে খবর আসে যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসছেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৪
আরো শোনা যায় যে, তিনি নাকি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে ভাষার গণ্ডগোল মিটমাট করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে সংগ্রাম পরিষদ এই মর্মে একটি অনুরোধ পত্রও পান। তাতে লেখা হয়েছিল যে, সরকার তাঁদের দাবী মেনে নিতে রাজী আছেন এবং এর জন্য সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের আলোচনার প্রয়োজন। সংগ্রাম পরিষদ প্রথমে তাঁর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও দাবী মেনে নেয়ার একটি সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় বসতে সম্মত হন।
সংগ্রাম পরিষদ নাজিমুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে ঐদিন অর্থাৎ ১৫ই মার্চে পর পর দুটো বৈঠকে মিলিত হন। উক্ত বৈঠকে যাঁরা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবুল কাশেম, কমরুদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
নাজিমুদ্দিনের সাথে ছাত্রনেতাদের তুমুল বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। অনেক হুমকি সহ্য করেও ছাত্রনেতৃবৃন্দ সরকারকে কতকগুলো শর্ত পালনের জন্য চাপ দিতে থাকেন। নাজিমুদ্দিন সবগুলো মেনে নিতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। প্রথম দফা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর পুনরায় বৈঠক বসে। অবশেষে সংগ্রাম পরিষদের নিকট সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হন।
ছাত্রদের নিম্নলিখিত ৮ দফা দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়।
“।। এক ।। ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ সাল হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাঁহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাঁহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।
।। দুই ।। পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
।। তিন ।। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারী আলোচনার জন্য যেদিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেইদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৫

এবং তাহাকে পাকিস্তান গণ-পরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
।। চার ।। এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।
।। পাঁচ ।। আন্দোলনে যাঁহারা অংশ গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
।। ছয় ।। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
।। সাত ।। ২৯শে ফেব্রুয়ারী হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে, সেখান
হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
।। আট ।। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই (এই দফাটি নাজিমুদ্দিন নিজের হাতে লেখেন) ।”
[পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতিঃ বদরুদ্দিন উমর, পৃঃ ৮১]
এই চুক্তিতে সরকারের পক্ষে সই করেছিলেন নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কমরুদ্দিন আহমদ।
১৯৪৮ সালের এই ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পর্কে খোন্দকার গোলাম মুস্তাফা বলেছেনঃ
“একদিকে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন, অন্যদিকে সংগ্রাম পরিষদ। ১৫ই মার্চ চুক্তি স্বাক্ষরিত হ’ল। নাজিমুদ্দিন সরকার অংগীকার করলেন যে, বাংলাকে প্রদেশের সরকারী ভাষা করা হবে এবং দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকার সুপারিশ করবেন কেন্দ্রের নিকট।”
(একুশে ফেব্রুয়ারী, হাঃ হাঃ রঃ সম্পাদিত, পৃঃ ২১১]
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৬

মুসলিম লীগ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা
এই চুক্তির পর ছাত্রসমাজ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পক্ষের ইচ্ছা ছিল একেবারে বিপরীত। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতারা বলতে শুরু করলেন যে, নাজিমুদ্দিনকে ভয় দেখিয়ে উক্ত চুক্তিতে সই দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হ’ল যে, ভারতীয় এবং কম্যুনিস্ট এজেন্টদের সাথে ষড়যন্ত্র ক’রে কিছু লোক নিয়ে এই আন্দোলন করা হয়েছে। সুতরাং তা’ কোনরূপেই জাতীয় আন্দোলন হতে পারে না-এর কোন মূল্য নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেদিন নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে সই করেছিলেন। সেই চুক্তি কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না।
জনাব খোন্দকার গোলাম মুস্তাফা মুসলিম লীগ সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
… “এ যেন মধ্যপ্রাচ্যের নৃপতিদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের চুক্তি। লংঘন করার জন্যই চুক্তি সম্পাদন। শুধু প্রাদেশিক সরকার কেন? নবাবজাদা লিয়াকত আলীর কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার উর্দুর প্রভুত্ব বিধিসিদ্ধ করার জন্য শাসনতন্ত্রের মূলনীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টে সুপারিশ করলেন-
—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় ভাষা (১৯৫০) । নাজিমুদ্দিনের চুক্তিকে কেন্দ্রীয় কর্তাব্যক্তিরা দুর্বলতার নামান্তর, ভারতীয় ও কম্যুনিস্ট এজেন্টদের কাছে আত্মসমর্পণের সামিল বলে অভিহিত করলেন।”
[প্রাগুক্ত, ১৯৬৫, পৃঃ ২১১]
১৫ই মার্চ পূর্ব বাংলার অ্যাসেম্বলীর বৈঠক বসবার কথা। ঐদিনই মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বাসভবন-বর্তমান বাংলা একাডেমীতে মুসলিম লীগ পার্লিয়ামেন্টারী পার্টির বৈঠক চলাকালীন ধৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবীতে একটি বিরাট মিছিল রাত্রি ন’টা পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভের ফলে সরকার শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন ছাত্রনেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
১৬ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। তিনি সর্বসম্মতিক্রমেই সভাপতি
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৭

নির্বাচিত হয়েছিলেন। উক্ত সভায় পূর্ব-অনুষ্ঠিত ফজলুল হক হলের বৈঠকে গৃহীত সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয় এবং গৃহীত প্রস্তাবগুলো নাজিমুদ্দিনের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য অলি আহাদের হাতে দেয়া হয়। অতঃপর বক্তৃতাপর্ব শেষ হ’লে একটি মিছিল অ্যাসেম্বলী ভবনের দিকে যাত্রা করে।
১৬ই মার্চ-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই সভা সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দিন উমর তাঁর “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” গ্রন্থের ৯০ পৃষ্ঠায় যে সব কথা বলেছেন সে সব সম্পর্কে এখানে আলোচনার প্রয়োজন। তিনি বলেছেনঃ
“বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ সভার নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেলা দেড়টার সময় শেখ মুজিবুর রহমান কালো শেরওয়ানী এবং জিন্না টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতলবিহীন চেয়ারে সভাপতির আসন অধিকার করে বসেন ( তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। সেই সভায় তাঁর সভাপতিত্ব করার কোন কথা ছিল না কারণ ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিলো নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সভাপতির চেয়ার দখল করেন ( তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। সভার প্রথম দিকেই সকালে ফজলুল হক হলের বৈঠকে নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়ঃ
১। ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করিতে হইবে।
২। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পূর্ব বাংলা পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারিত করিতে হইবে।
৩। সংবিধান সভা কর্তৃক তাঁহারা উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৮

অনুমোদন করাইতে অসমর্থ হইলে সংবিধান সভার এবং পুর্ব বাংলা মন্ত্রিসভার সদস্যদিগকে পদত্যাগ করিতে হইবে।
উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে সেটি প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় (তাজউদ্দিনের ডায়েরী ১৬-৩-১৯৪৮)। প্রস্তাব গ্রহণের পর মুজিবুর রহমান অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেন। সেই এলোপাথাড়ী বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিল না ( তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। অল্পক্ষণ এইভাবে বক্তৃতার পর তিনি অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলী চলো’ বলে শ্লোগান দিয়ে সকলকে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য আহবান জানান (তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদের তথ্য থেকে)। সেদিনকার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিছিলের কোন কথা ছিল না। কিন্তু এই হঠাৎ-উদ্ভূত পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব হ’ল না। কাজেই ছাত্রেরা সরকার-বিরোধী এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে নানাপ্রকার ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হ’ল।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ এবং পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী চৌমাথার কাছে মিছিলটি পৌঁছালে পুলিশ তাঁদেরকে বাধা দান করে। এরপর ছাত্রেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তারের বেড়া পার হয়ে কলেজ এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই অবস্থান করে। নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিত্বের পদত্যাগ দাবী এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে থাকে।”
জনাব উমর ১৬ই মার্চ-এর সভা সম্পর্কে যে সব বর্ণনা দিয়েছেন তার সব তথ্যই সরবরাহ করেছেন জনাব তোয়াহা ও তাজউদ্দিন আহমদ। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ উক্ত তারিখে যে ডায়েরী লিখেছিলেন, তার চিত্রানুলিপি জনাব উমরের গ্রন্থেই আছে। পাঠকের অবগতির জন্য সেই ডায়েরীর নকল এখানে প্রদত্ত হ’লঃ
16.3.48 Rise 7 A.m. Study No.
To F. H. Hall at 8 A.m.-Some amendments were taken about the terms made yesterday with the premier in the
পৃষ্ঠা নংঃ ১০৯

Committee meeting. At 1-30 P.m. meeting began in the University premises-Mujibur Rahman presided-amendments were adopted and sent to the premier by Wali Ahad-though there was no programmed made by Committee of Action, a demonstration went to the Assembly House-they stayed there up to evening cursing the Govt. Party M.L.As-in spite of request students did not disperse-we, the members of the Committee of Action met in the room of ASE Main Hostel-remained there up to 5 P.m. When we heard of the attempts of the students to catch their MLAs-at this many MLAs of the Govt. party could not get out. Just at 7 P.m. a band of police under M. Gafur and Dist. magistrate Rahmatulla arrived and took to lathi charge, teargas and blank fire -hey opened fire and teargassed in the Medical College Hospital compound too-from lathi charge 19 persons were wounded seriously-Saokat was one of them-Shamsuddin and I inform this to the opposition MLAs were at a meeting in Baliadi House.
At about 11-30 P.m. meeting of the Committee of Action sat at about 12 A.m. in the Hall (N)-continued up to 2A.m. Decided to hold protest strike in Institutions only and hold meeting but not demonstration on 17th March. Back at 2-30 A.m. Bed at 3A.m.
Weather: Normal-excessive cold owing to rain former day.”
[পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৮০-৮১ পৃষ্ঠার মধ্যবতী একটি চিত্রানুলিপি]
জনাব তাজউদ্দিনের এই ডায়েরীতে এমন তথ্য কোথাও নেই যে শেখ মুজিবুর রহমান জোরপূর্বক চেয়ার টেনে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। জনাব তোয়াহার দোহাই ঠিকতে পারে না। কেননা, তাঁর বক্তব্যের কোন প্রমাণই জনাব বদরুদ্দিন উমর তাঁর গ্রন্থে উপস্থিত করেন নি। সুতরাং জনাব উমর ১৬ই মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার বিবরণে শেখ মুজিবের যে চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন, তা সমর্থন করা যায় না। উক্ত সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে জনাব আবদুল মোমেন (বর্তমানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী), জনাব
পৃষ্ঠা নংঃ ১১০

কে. জি. মোস্তফা এবং জনাব বাহাউদ্দিনের সাথে আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। সেদিনের ভাষা আন্দোলনের সাথে এই তিন ব্যক্তি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, জনাব উমর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা’ সত্য নয়। উক্ত সভায় শেখ মুজিবের নাম যথারীতি প্রস্তাবিত ও সমর্থিত হয়েছিল এবং তিনি যথানিয়মে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভায় কোনরূপ হট্টগোল হয় নি। এ ছাড়া অ্যাসেম্বলী ভবনে মিছিল নিয়ে যাবার ব্যাপারে যদিও কমিটি অব অ্যাকশনের কোন পূর্বসিদ্ধান্ত ছিল না তথাপি সভায় উপস্থিত সকল বক্তা ও শ্রোতার বিশেষ আগ্রহ বারবার ব্যক্ত হয়েছিল বলেই সভাপতি অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিবের সংগ্রামী ও অকুতোভয় চারিত্র্যের একটি নিদর্শনও এ থেকে উপলদ্ধি করা যায়। তিনি শুধু গরম বক্তৃতা দিয়ে বা সবাইকে মিছিলে উদ্বুদ্ধ করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেন নি–মিছিলের পুরোভাগে থেকে সমগ্র মিছিল তিনি পরিচালনা করেছিলেন। জনাব উমর কৌশলে একথাটি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন।
জনাব উমর আরো একটি কথা বলেছেন, “ঢাকার তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল নিতান্ত নগণ্য।” অন্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই; উমরের নিজস্ব বর্ণনা থেকেই প্রমাণ দেওয়া যায় যে, শেখ মুজিব সম্পর্কে জনাব বদরুদ্দিন উমরের এই উক্তি সত্যকে বিকৃত করেছে। এখানে আমি জনাব উমরের “পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” গ্রন্থ থেকেই প্রমাণ দেবঃ
“১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোস্টেলে কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রেরা পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের পরবর্তী কর্তব্য এবং কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে হিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রভৃতি। এ ব্যাপারে তাঁরা অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথেও আলাপ-আলোচনা করেন। এই সব আলোচনার পর স্থির হয় যে, স্বাধীনতা উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার উপযুক্ত সংগঠন গঠন করা প্রয়োজন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১১১

এর পর উপরোক্ত রাজনৈতিক কর্মীরা ঢাকায় এসে কমরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, তসদ্দুক আহমদ, মহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নুরুদ্দিন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। নতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য একটি সম্মেলন আহ্বানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁরা সকলেই একমত হন এবং এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করেন।”
[ ঐ, পৃঃ ৬]
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর কলকাতার সিরাজুদ্দৌলা হোস্টেলে অসাম্প্রদায়িক দল গঠনের যে প্রয়াসের কথা জনাব উমর উল্লেখ করেছেন সেখানে কৌশলে তিনি শেখ মুজিবের নাম বর্জন করেছেন। অথচ শেখ মুজিব ও অপর কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে একথা আমি জানতে পেরেছি যে, উক্ত আলোচনা সভায় শেখ মুজিব নিজেও উপস্থিত ছিলেন। শুধু তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এমন নয়, রাজশাহীর আতাউর রহমান ও শেখ মুজিবের উদ্যোগেই এই আলোচনা সভার ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল। পরে তিনি ঢাকায় এসেও এই আলোচনা ও কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ইতিহাস প্রমাণ দেবে যে, এই অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত জনসমর্থন লাভ করে জয়যুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ এই-জাতীয় আন্দোলনের একটি বাস্তব ফসল।
আমরা একথা জানি যে, শেখ মুজিব নিজেও কলকাতা থেকে পাকিস্তানে এসে এমনি একটি রাজনৈতিক ছাত্রদলের সন্ধান করছিলেন। তা’ ছাড়া মুসলিম লীগের শ্রেণী-চরিত্র সম্পর্কেও তিনি ধীরে ধীরে বিতৃষ্ণা পোষণ করতে থাকেন। পুরাতন ছাত্রলীগের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্যই শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাংঘাতিক মতবিরোধ ঘটেছিল। জনাব উমরের উক্ত গ্রন্থে তার প্রমাণ আছে।
[ ঐ, পৃষ্ঠা ৮]
১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর বেলা ৩-৩০ মিনিটে ‘বলিয়াদী হাউসে’ পার্লামেন্টারী উপদলের বৈঠক বসে। এখানে শেখ মুজিব বামপন্থীদের
পৃষ্ঠা নংঃ ১১২

নেতৃত্ব দান করেন এবং নাজিম মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নের প্রস্তাব করেন। পরের দিনও রাত্রি আটটা পর্যন্ত বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে কয়েকজন ছাত্রনেতা ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকাটি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে বিতরণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। শেখ মুজিব এদের নেতৃত্ব দান করেন। “তখন ইত্তেহাদকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময় লোক মারফৎ বড় বড় প্যাকেটে নিয়মিতভাবে ইত্তেহাদ ঢাকাতে আসতো এবং ছাত্ররা তা’ মাঝে মাঝে বিতরণ করতেন।”
(ঐ, পৃঃ ৯৯)
“বামপন্থী মুসলিম লীগ কর্মীরা যাতে নতুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কার্যে অংশগ্রহণ করতে পারেন তার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের উদ্দেশ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মুশতাক আহমদ প্রভৃতি যৌথভাবে ১৯৪৮-এর জানুয়ারীতে ঢাকা শহরে পুরাতন মুসলিম লীগের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প, নামে অভিহিত এই সম্মেলন মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগের বামপন্থীদের পক্ষে সাংগঠনিক কার্যে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।’
(ঐ, পৃঃ ৩৮)
ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সাফল্য দেখে মুসলিম লীগের আকরম খাঁ, নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন প্রভৃতি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। অন্যান্যদের সাথে শেখ মুজিব আকরম খাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলিম লীগের বুর্জোয়া চরিত্র ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। আকরম খাঁ “ক্যাম্পের কর্মীদেরকে মুসলিম লীগ কর্মী হিসাবে বিবেচনা করতেই অস্বীকার করেন।”
(ঐ, পৃঃ ৩৯)
ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ সকালে সেক্রেটারীয়েট গেটে পিকেটিং করে যারা পুলিশ কর্তৃক বন্দী হয়ে জেলে প্রেরিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন একজন।
(ঐ, পৃঃ ৬৯-৭০)
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৩

ভাষা অন্দোলনের সংগ্রাম পরিষদ ১৫ই মার্চ-এ যে চুক্তিপত্র প্রণয়ন করেন তা’ অনুমোদনের জন্য জেল-এ নিয়ে যেতে হয় এবং অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবের অনুমোদন বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়।
(ঐ, পৃঃ ৮১-৮২)
১৫ই মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ও শওকত আলী ফজলুল হক হল থেকে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে গিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করেন। পরদিন খুব সকালে তাঁরা আবার ফজলুল হক হলে ফেরত গিয়ে ছাত্রদেরকে একটি প্রতিবাদ সভার জন্য একত্রিত করার চেষ্টা করতে থাকেন।
(ঐ, পৃঃ ৮৮-৮৯)
অতঃপর ১৬ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। সভাশেষে তিনি অ্যাসেম্বলীর দিকে মিছিল পরিচালনা করেন।
(ঐ, পৃঃ ৯০)
বামপন্থী রাজনীতি গড়ে তুলতে যারা অক্লান্তভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়। ১৯৪৮ সালের ১৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রাষা কর্মপরিষদের যে বৈঠক বসে সেখানে শেখ মুজিব উপস্থিত ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর নিকট এ সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি প্রদানের জন্য তিনি জোরালো চাপ সৃষ্টি করেন। “সেই স্মারকলিপিটি খসড়া তৈরীর ভার অর্পিত হয় কমরুদ্দিন আহমদের উপর।”
(ঐ, পৃঃ ১৬৭)
১৯৪৮-এর প্রথম দিকেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দান করেন শেখ মুজিব। “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ-এর অস্থায়ী অর্গানাইজিং কমিটির” যে ক’জন সদস্য নির্বাচিত হন তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(ঐ, পৃঃ ১৮৯)
রাজনৈতিক কারণে মুসলিম নামটি সংযুক্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৪৯ সালের ৮ই জানুয়ারী ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়।
“ঢাকা কলেজে আংশিক, ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৪

বেলা দু’টার সময় মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রভৃতি বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবীসমূহ বিবেচনা করে সেগুলিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়।”
(ঐ, পৃঃ ১৯২)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন কর্মচারীদের ধর্মঘটে সহানুভূতি জানিয়ে যাঁরা নেতৃত্ব দান করেন শেখ মুজিব ছিলেন তাঁদেরই একজন। এর ফলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। একথা জনাব উমরও স্বীকার করেছেন।
(ঐ, পৃঃ ১৯৪-২২১)
জনাব উমর আরও স্বীকার করেছেন, “যে সমস্ত কর্মীরা পূর্ব বাংলায় নতুন রাজনীতি গঠন চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান, শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আওয়াল প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য কয়েকজনও কলকাতা থেকে আসার পর। সেই রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।”
(ঐ, পৃঃ ২২১)
আশা করি এতক্ষণ জনাব বদরুদ্দিন উমরের নিজের তথ্য থেকেই তাঁর এই উক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়েছি যে, “ঢাকায় তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল নিতান্ত নগণ্য।” বস্তুত ১৯৪৭ থেকে এদেশে একটি অসাম্পদায়িক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে শেখ মুজিব যে ভূমিকা পালন করেছেন, তারই ফলশ্রুতি হিসেবেই তিনি এ দেশের অবিসংবাদিত নেতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। অসীম ত্যাগ, অনেক সাধনা, সুচতুর কর্মপন্থা প্রভৃতি তাঁকে সাফল্যের স্বর্ণসিংহদ্বারে নিয়ে এসেছে। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে নতুন রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন হয়েছিল শেখ মুজিবের নাম সেখানে, সহ-সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাবিত ও “সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়।”
(ঐ, পৃঃ ২৪৯)
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৫

মনে রাখা দরকার যে, শেখ মুজিব ছিলেন কারাগারে এবং তাঁর অনুপস্থিতেতেই তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়। একথা সত্য যে, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বের নিদর্শন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সমগ্র আন্দোলনে অনুপস্থিত। সে রকম আশা করাও দুরাশা, কেননা এই সময়টি ছিল তাঁর নেতৃত্বের প্রস্তুতি-পর্ব। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সর্বপ্রকার আন্দোলনেই তিনি যথাসাধ্য অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং কখনো প্রত্যক্ষ কখনো বা পরোক্ষভাবে তাঁর সম্ভাবনা সূচিত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। আর এভাবেই ভবিষ্যতের একজন বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার প্রস্তুতি-পর্ব তিনি অতিক্রম করেছেন। প্রথম থেকেই দুর্জয় সাহসিকতা, অসীম সহনশীলতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা, ত্যাগের জন্য সার্বিক মানসিক প্রস্তুতি, নিষ্ঠা ও সাধনা তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এবং দিনের পর দিন এই সমস্ত গুণ তাঁর ব্যক্তি-চরিত্রের ভূষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আবার সংগ্রাম
যাহোক, এবার আবার মূল বক্তব্যে ফিরে আসা যাক। আমরা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করছিলাম। ১৬ই মার্চে যে মিছিলটি অ্যাসেম্বলী ভবনে গিয়ে অবস্থান করছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে, সন্ধ্যার দিকে এই মিছিলের উপর লাঠিচার্জ করা হয়, এবং এতে ১৯ জন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হয়। রাত্রে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে ফজলুল হক মুসলিম হলে। ১৭ই মার্চ তারিখে প্রদেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্ৰ-সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ,শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণ-আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা,
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৬

মিছিল আর শ্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার- ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। দাবী আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেইসব ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেবার বেলায় অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়—এমনকি তাঁরই প্রেরণায়ই ৭৬ বছরের বৃদ্ধ শেরে বাংলা ফজলুল হক পর্যন্ত এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিলেন। সরকারী পুলিশ বাধা দিতে চেষ্টা করলো। ছাত্রদের ওপর হামলা চালালো। এমন কি, তারা শেরে বাংলাকেও আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করল না। এই আঘাত হানার ব্যাপারে একজন পুলিশ অফিসার জাকির হোসেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তা আইয়ুব খানের ভূমিকা ছিল যেমন জঘন্য, তেমনি বর্বরোচিত।

জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও ঘোষণা
আগেই বলা হয়েছে, আইয়ুব খান তখন পূর্ব বাংলার সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। যাহোক, ঠিক এই বিক্ষুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেই জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। ১৯শে মার্চ বিকেলে তেজগাঁ বিমান বন্দরে তাঁকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। মনে রাখতে হবে যে তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অবিসম্বাদিত গণনেতা, জাতির জনক এবং পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। জিন্নাহর ধারণা ছিল যে, তাঁর মুখের ওপর কথা বলবে, এরকম সাহস পাকিস্তানের কারো নেই। তাই প্রথমে তিনি ২১শে মার্চে অনুষ্ঠিত রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করলেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর এই বক্তব্য সবাই নির্বিচারে গ্রহণ করেন নি-সভার একপ্রান্তে প্রতিবাদের ধ্বনি উত্থিত হয় এবং যারা এই ধ্বনি তুলেছিলেন তাদের নেতৃত্ব দান করেন শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ ও আবদুল মতিন। যদিও এই প্রতিবাদের সুর খুব প্রচণ্ড ছিল না, তবু জাতির জনক এই প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় একটি অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেলেন। তাঁর জেদ বেড়ে গেল। অপমান তিনি হজম করতে অপারগ! তিনদিন পরে ঢাকার কার্জন হলে
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৭

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দানকালে আবার সেই একই কথা তিনি জোর দিয়ে ঘোষণা করলেন।-
-এবার শুধু মুজিব নয় এবং আবদুল মতিনও নয়, হলের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত শুধু গর গর গর ধ্বনিতে জিন্নাহ, সাহেবের কণ্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে এসেছিল। ক্ষোভে দুঃখে অপমানে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর আবার তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন। কিন্তু এবার তাঁর সুর অপেক্ষাকৃত নরম। “রেসকোর্সের বক্তৃতা এবং এই একই সমাবর্তন সভার বক্তৃতায় যখনই তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব করেছেন তখন সে প্রস্তাবকে তিনি প্রকাশ করেছেন একটি বলিষ্ঠ ঘোষণার ন্যায়। কিন্তু ছাত্রদের দ্বারা বাধা পেয়ে এবং সভার বিক্ষুদ্ধ পরিবেশ লক্ষ্য করে তিনি তাঁর প্রাক্তন শক্তি আর ফিরে পেলেন না; তাই অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষা প্রয়োগ করে বললেন, “পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশগুলি একত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষার এবং আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা।”
[ বঃ উমর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১০-১১১]
কিন্তু এবারেও মৃদু প্রতিবাদ এবং বিক্ষুদ্ধ গুঞ্জন সভার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে উত্থিত হ’ল। আর এই সমগ্ৰ পরিস্থিতি সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠন করেছিলেন শেখ মুজিব।

ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে জিন্নাহর আলোচনা তার ফলশ্রুতি
জিন্নাহ, ঢাকা অবস্থানকালে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে ভাষা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে একাধিকবার আলোচনায় বসেন। কিন্তু কয়েকবার আলোচনার পর একথাই প্রতীয়মান হয় যে, জিন্নাহ, ছাত্র রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে আবার জাগ্রত করতে সংকল্পবদ্ধ এবং ভাষার প্রশ্নে তিনি কোন আপোষ করতে প্রস্তুত নন। আলোচনার মাধ্যমে অন্য কোন লক্ষ্য অর্জিত হলেও শেখ মুজিব ও তার বন্ধুদের সাথে শাহ আজিজুর রহমানের পার্থক্য আরো তীব্র হয়ে ওঠে এবং শাহ আজিজ অসাম্প্রদায়িক ছাত্র শক্তিকে আঘাত হানবার জন্যে সরকারী সমর্থন সামগ্রিক ভাবেই অর্জন করেন। অন্যপক্ষে শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন, তোয়াহা, শামসুল হক, নঈমুদ্দিন, কমরুদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লীগ রাজনীতি থেকে
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৮

বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন যুবশক্তি ও জনশক্তি গঠনের জন্য নতুনভাবে যাত্রার জন্য সংঘবদ্ধ হবার প্রেরণা লাভ করেন।
কিন্তু সরকারী দমননীতিও এই সময় থেকেই প্রচণ্ড হতে থাকে। বিচ্ছিন্ন যুবশক্তিকে সংঘবদ্ধ করতে এবং ভাষা আন্দোলনকে একটি গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে শেখ মুজিব যতই নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে শুরু করলেন, ততই দ্রুত তিনি সরকারের কোপানলে পতিত হতে লাগলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে অসাম্প্রদায়িক যুব নেতৃত্ব এবং ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা, এই দুটো কারণেই তাঁকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকার পুনরায় কারারুদ্ধ করে। শেখ অম্লানবদনে এই নিয়তিকে স্বীকার করেন।

শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ
১৯৪৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর পরই শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে প্রতিবাদস্বরূপ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য তাজউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আবুল কাশেম, জনাব অলি আহাদ, তোয়াহা প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ভাষা আন্দোলেনকে আরও জোরদার করে তোলেন।

দুর্ভিক্ষঃ শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানীর গ্রেফতার
১৯৪৯ সালেই পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতির ফলে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। সরকার খাদ্য সংকট সমাধানে উদাসীনতার পরিচয় দেন। ফলে বাধ্য হয়ে শেখ মুজিবকে তার জন্য আন্দোলন শুরু করতে হয়। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তিনি একটি ‘ভুখা মিছিলে’নেতৃত্ব দেন। এতে খাপ্পা হয়ে সরকার উভয় নেতাকেই কারারুদ্ধ করেন। পাকিস্তান অর্জনের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এইভাবে ন্যায়ের পথে সংগ্রাম করে বিপ্লবী যুবনেতা শেখ মুজিব কয়েকবার কারাবরণ করেন। কিন্তু কোন নির্যাতনের মাধ্যমেই ন্যায়ের ও সত্যের পথ থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যায় নি।

শেখ মুজিবকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার
ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় পড়াশুনোর সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন, যদি তিনি ভবিষ্যতে ভালো হয়ে চলবার ‘বণ্ড সই’ করে দিতেন। মুজিব এতে রাজী হন নি। সে সময়
পৃষ্ঠা নংঃ ১১৯

তিনি বলেছিলেন, “শেখ মুজিব আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আসবে তবে ছাত্র হিসাবে নয়, একজন দেশকর্মী হিসাবে।” শেখ মুজিব তাঁর ওয়াদা পালন করেছিলেন। আড়াই বছর পর আবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তোরায় ফিরে এসেছিলেন। তবে ছাত্র হিসেবে নয়—একজন দেশকর্মী হিসেবেই। তিনি তখন আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট নেতা।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন ও শেখ মুজিব সহ-সম্পাদক নির্বাচিত
এদিকে যুব আন্দোলন এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন ইত্যাদি কারণে নতুন রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি আসন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের ৩রা জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। তখন এই দলের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। বলা বাহুল্য,এই দলের উদ্যোক্তারা অনেকেই ছিলেন মুসলিম লীগের বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী। মুসলিম লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে শাসনের মাধ্যমে শোষিত হতে দেখে এদেশের কতিপয় দেশপ্রেমিক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন, মওলানা আকরম খাঁ, ফজলুর রহমান প্রমুখ কয়েকজন মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিবিদ ক্ষমতার লোভে পশ্চিমাদের সহায়তা করে যাচ্ছিলেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
মুসলিম লীগের বিরোধী দল মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন শেখ মুজিব তার সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন তিনি জেলে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর বিগত দু’ বছরের বিপ্লবী নেতৃত্ব ও মহান ত্যাগের কথা বিবেচনা ক’রে তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে এই নবগঠিত দলের সহ-সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এই দলের অন্যান্যদের মধ্যে আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান ও আবুল মনসুর আহমদ সহ-সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবসহ রফিকুল হোসেন ও খন্দকার মোশতাক আহমদ সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ধরতে গেলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দেশ বিভাগকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শহীদ সাহেবের
পৃষ্ঠা নংঃ ১২০

বনিবনা হয় নি। তাই ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পরও ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য তিনি কলকাতায় থেকে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন, কিন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নারায়ণগঞ্জে স্টীমার থেকে নামতে না দিয়ে তাঁকে পুনরায় কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দেন। এর প্রধান কারণ হ’ল, একে তো মুসলিম লীগের নেতারা শহীদ সাহেবকে ভয় করতেন, উপরন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালে কলকাতা থেকে করাচীতে তার শ্বশুর স্যার আবদুর রহীম-এর বাসভবনে আসেন।
তাঁর করাচীতে পৌঁছানোর ব্যাপারে তদানীন্তন ফ্যাসিষ্ট মুসলিম লীগ সরকার খুশী হতে পারে নি। সরকার কর্তৃক শহীদ সাহেবের গণপরিষদ সদস্য পদটি বাতিল ক’রে দেওয়া হয়। তারপর থেকে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমে সরকার-বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।

শেখ মুজিব গ্রেফতার
এই উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। এর সভাপতি শহীদ সাহেব স্বয়ং এবং সম্পাদক হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। ভাষা অন্দোলন তখন আস্তে আস্তে চরম পর্যায়ে উন্নীত হতে শুরু করে দিয়েছে। ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ গণআন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। দেশের পরিস্থিতি উপলদ্ধি করে পূর্ব বাংলার তৎকালীন নুরুল আমীন সরকার দমননীতির মাধ্যমে আন্দোলনের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা চালালেন। ১১ই মার্চের সংগ্রাম দিবসের কর্মসূচীর প্রধান উদ্যোক্তা শেখ মুজিবকে পুনরায় কারারুদ্ধ করা হয়।

নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা ও পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়া
১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকা সফরকালে নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে আবার দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন— “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ভুলে গেলেন তিনি তাঁর চুক্তির কথা। বিশ্বাসঘাতকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখালেন তিনি। খোন্দকার গোলাম মুস্তাফা লিখেছেনঃ “১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ। আর ১৯৫২ সালের
পৃষ্ঠা নংঃ ১২১

২৬শে জানুয়ারী। মাঝখানে কয়েকটি বিশ্বাসঘাতক বৎসর আর খাজা নাজিমুদ্দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের সংগ্রামের কথা স্মরণ করলো। আর স্মরণ করলো ১৫ই মার্চের চুক্তিপত্র লঙঘন। পাঁচটি বৎসর যেনো বৃথা চলে গেছে। এত প্রতিবাদ, এমন দাবী, কোনও ফল নেই? প্রত্যয় দৃঢ়তর হয় ছাত্র-সমাজের। আবার আন্দোলন। অধিকার হরণকারীর বিরুদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধ।”
[একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৫, পৃঃ ২১৩]
এবার সমগ্র পূর্ব বাংলার ছাত্র-সমাজ ফেটে পড়লো। শুরু হ’ল মহাসংগ্রামের আয়োজন।
১৯৫২-এর ২৭শে জানুয়ারী ডাকসুর ছাত্রনেতারা মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হ’ল। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ফজলুল হক হল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করলো মধুর ক্যান্টিন। মধুর ক্যান্টিনে সভা শুরু হ’ল। গাজীউল হক একরাশ বেদনা ও ঘৃণা নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে উঠলেন। তার বক্তৃতার অংশ এখানে তুলে দেয়া হ’লঃ
“ভাইসব, ফ্যাসিষ্ট লীগ সরকার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নাজিমুদ্দিন কাল বলেছেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বেঈমান! বেঈমানের দল বারবার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, চুক্তি করেছে- বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বারবার সে চুক্তি ভেঙ্গেছে। আজ ওদের কথার জবাব দেবার সময় এসেছে।
ওরা আমাদের প্রাণের ভাষা, বাপ-দাদার মুখের বুলি কেড়ে নিতে চায়। এ দেশের মাঝি আর মনের আনন্দে ভাটিয়ালী গান গাইতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মাইকেল-সুকান্ত আমাদের কাছে হয়ে যাবে ইতিহাসের বস্তু, মায়ের কাছে চিঠি লিখব-উর্দুতে ঠিকানা লিখতে হবে। উর্দু না জানার অপরাধে সরকারী চাকরি-বাকরি থেকে বঞ্চিত থাকবে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে উর্দুভাষীরা ছেয়ে ফেলবে বাংলাদেশ। আমাদের বুকের উপর
পৃষ্ঠা নংঃ ১২২

দাঁড়িয়ে আমাদেরই খবরদারী করবে তারা। সোনার বাংলাকে দেউলে করবে। শুষে নেবে সমস্ত সম্পদ। বাঙালীকে ভিখিরীর জাত বানিয়ে ওরা আমাদের তাদের তাবেদার বানাবে।……একটা জাতিকে ধ্বংস করার প্রধান উপায় হলো তার ভাষা কেড়ে নেওয়া। ভাষা কেড়ে নিয়ে ওরা আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিতে চায়। বজ্রকষ্ঠে তার প্রতিবাদ করার সময় এসেছে। পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি লোক আজ ছাত্রসমাজের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে রয়েছে। মায়ের সম্মান রাখতে এগিয়ে আসুক ছাত্র-সমাজ। ঝাঁপিয়ে পড়ুক মহাসংগ্রামে। লীগ-সরকার দেখুক, বাংলার ছাত্ৰজনতা তথা সাড়ে চার কোটি বাঙালীর অমিত শক্তি। আমরা যদি সকলে মিলিত আওয়াজ তুলি-রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, ফ্যাসিস্ট লীগ সরকার নিপাত যাক- তা’ হ’লে শুধু সেই প্রচণ্ড গর্জনের তোড়েই লীগ সরকার ভেসে যাবে।”
[ জয়বাংলা মুক্তিফৌজ ও শেখ মুজিবঃ কলহন, পৃঃ ৬২-৬৩]
উক্ত সভায় ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০শে জানুয়ারী স্কুল-কলেজের ছেলেরা ধর্মঘট করে। কচি কচি ছেলেমেয়ে এই ধর্মঘটে শরিক হয়। তারা সমস্বরে আওয়াজ তুলেঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘আমাদের দাবী মানতে হবে, নইলে গদী ছাড়তে হবে’। মিছিলের প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের চোখেমুখে এক বজ্রকঠিন শপথের ইঙ্গিত রয়েছে। তারা সকলে সামনের দিকে নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে চলেছে—জয়ের মুকুট আজ তাদেরকে কেড়ে নিতেই হবে। ছাত্রনেতারা কথার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বলে চলেছেঃ ‘বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা—সেই ভাষাকে জালিম দস্যুর দল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীরা কেড়ে নিতে চায়। আসুন-আমরা সবাই মিলে বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করি। আমরা প্রাণ দেব, তবু মাতৃভাষার অপমান সহ্য করবো না। আমরা রক্তবীজের দল-হাসিমুখে যেমন রক্ত দিতে জানি, তেমনি ফ্যাসিস্ট সরকারের টিয়ার গ্যাস আর রাইফেলকেও উপেক্ষা করতে পারি। বাংলা হিন্দুর ভাষা নয়-বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়-বাংলা বাঙালীর ভাষা। আমরা বাঙালী। বাংলা মায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা প্রাণ বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করব না।’
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৩

সেদিন বাংলার রাজনৈতিক গগনে যে কালবৈশাখীর তাণ্ডব নৃত্যের শুরু হয়েছিল, যে ঝড়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তাতে কোন বাঙালী ভীত হয় নি। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের পাশে দামাল মেয়েরাও এসে উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন নারায়ণগঞ্জের মরগ্যানের ছাত্রীরা ঘরে বসে থাকতে পারে নি। তারা নেমে এসেছিল রাজপথে। মেয়েদের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি অসাধারণ নন—তিনি আমাদের সাধারণ ঘরের একজন কন্যা বা বধূ। এক ডাকে তাঁকে সকলেই চিনবে। তিনি সকলের মমতাজ আপা। সেদিন এই অগ্নিকন্যা অসংখ্য ছাত্রী সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রীদের নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। নারায়ণগঞ্জে এসময় তরুণ কিশোর নেতা মোস্তফা সরওয়ার বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে এগিয়ে আসেন। কলহন বলেছেনঃ “দিনের পর দিন মমতাজ আপা ও মোস্তফা সরওয়ারের জ্বালা ধরানো বক্তৃতায় নারায়ণগঞ্জ শহরটা জেগে ওঠা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত গর্জন করতে থাকলো।”
(জয়বাংলা মুক্তিফৌজ ও শেখ মুজিব, কলহন, পৃঃ ৬৭)
প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলার সব শহরের অবস্থাই ছিল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মতই বিক্ষুদ্ধ।
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র ক’রে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে, মহকুমায়, গ্রামে চলছিল আন্দোলন, সভা ও মিছিল। ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারীতে ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট বার-লাইব্রেরী হলে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন হয়েছিল। উক্ত সম্মেলনে এত লোক হয়েছিল যে তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
এই আন্দোলনের মধ্যে বাঙালী মানসের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা’ প্রমাণ করে যে, সামগ্রিক মুক্তিই তাঁদের একমাত্র কাম্য। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য শুধু বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা ছিল না; সমগ্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ন্যায্য অধিকারে বাধা সৃষ্টি থেকে। এই অধিকার যেমন ভাষার ক্ষেত্রে তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং সমগ্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাঙালী দিনের পর দিন ছিল বঞ্চিত, অবহেলিত এবং শোষিত। সুতরাং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৪

করে বাঙালী তার সামগ্রিক মুক্তির সন্ধান করছিল। আর এ কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তস্নাত দিন থেকে আমাদের নতুন দিগন্তের পানে যাত্রা শুরু হ’ল—যে দিগন্ত স্বাধীনতার প্রান্তসীমা পর্যন্ত প্রসারিত।

সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি
ভাষা আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলবার জন্য ৩০শে জানুয়ারী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সংগ্রামকমিটিতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, খিলাফতে রাব্বানী সর্বদলীয় সংগ্রাম পাটি, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে কমিটিতে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, খিলাফতে রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ দু’জন দু’জন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়। কমিটির আহবায়ক ছিলেন গোলাম মাহবুব। কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দের মধ্যে ছিলেন—আবুল হাশেম, আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, মহম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, খালেক নওয়াজ খান, শামসুল হক প্রমুখ। বলা বাহুল্য, এ সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন।
সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির ডাকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করলো। তাদের শ্লোগানে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ছাত্র-জনতার হাতে এক একটি করে প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছিল। প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিলঃ ‘ভাষার উপর হামলা চলবে না’, ‘ফ্যাসিস্ট নুরুল আমীন নিপাত যাও’, ‘নাজিম চক্রান্ত ব্যর্থ করুন’, ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি।
সেদিন বিকেলে সংগ্রাম কমিটির তরফ থেকে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁদের জ্বালাময়ী ভাষণে সরকারকে ক্ষত-বিক্ষত ক’রে তুলেছিল। উক্ত সভায় প্রস্তাব নেওয়া হয়—
(ক) বাংলা ভাষার দাবী সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে।
(খ) একুশে ফেব্রুয়ারী ‘ভাষা দিবস’ হিসাবে পালন করা হবে।
(গ) ঐদিন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে প্রদেশব্যাপী ডাক দেওয়া হবে সর্বাত্মক হরতালের।
সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হওয়ায় ১১ই ও ১৩ই ফেব্রুয়ারীকে ‘পতাকা দিবস’ বলে ঘোষণা করা হয়। সেদিন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কৌটা হাতে নিয়ে
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৫

পথে পথে বেরিয়ে পড়ে। পথচারীদের বুকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা কাগজের ব্যাজ এঁটে দেয়। জনতাও খুশীমনে নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী টাকা-পয়সা কৌটার ভেতরে ফেলে দিয়ে মনে করে— আমি বা আমরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের এক একজন অংশীদার।

ভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তান অবজারভার
সে সময় ভাষা আন্দোলনের প্রচারের বাহন ছিল ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকা। সারা বাংলাদেশে বাঙালীর ঘরে ঘরে ভাষা আন্দোলনের সংবাদ বহন করতো উক্ত পত্রিকা। কিন্তু ১৩ই ফেব্রুয়ারী নিষেধাজ্ঞা জারী করে সরকার উক্ত পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সারা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের সংবাদ পৌঁছে দেবার তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। তবে উল্লেখযোগ্য যে, এর পূর্বেই ‘২১-এর ডাক’—বাঙালীর ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল। তা’ ছাড়া,সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ তখন এই আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায়।
১৯৫২-এর ২০শে ফেব্রুয়ারী। তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তখন করাচীতে। পূর্ব বাংলার ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি তাঁর শয়নকক্ষে গালিচার উপর অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। একটু আগে নরুল আমীনের সাথে টেলিফোনে আলাপ করছিলেন। পায়চারি করতে করতে আবার তিনি রিসিভার তুলে পূর্ব বাংলার চীফ সেক্রেটারীকে ফোনে ১৪৪ ধারা জারীর আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি ঢাকা সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিন্ত হ’লেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় ঢাকা বেতার থেকে ১৪৪ ধারা জারীর সংবাদ প্রচার করা হ’ল।
খবরটি প্রচারের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ সমবেত হ’লেন একটি জরুরী সভায়। সদস্যদের কেউ কেউ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা যাতে ভাঙ্গা না হয় এই সিদ্ধান্তেই অধিকাংশ সদস্য রায় দেন। তবে সাধারণ ছাত্র, যারা ছাত্র সমাজের বৃহত্তর অংশ, সংগ্রাম পরিষদের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিক্রিয়াশীল ও সরকারী নীতির পরিপোষক বলে ধিক্কার জানালেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৬

১৪৪ ধারা ভেঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বৃহত্তর ছাত্র সমাজ যে বদ্ধপরিকর একথা পরদিন ভোরেই স্পষ্টতর হয়ে উঠলো।
১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারী। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল খুবই কম। যে দু’একটি দোকান খোলা হয়েছিল তা’ ছাত্রদের সনির্বন্ধ অনুরোধে বন্ধ হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাজপথে বেশ কিছু সংখ্যক পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুলিশদের অনেকের কোমরে টিয়ার গ্যাসের বাক্স। কারো হাতে লাঠি, কারো বা বেয়নেট লাগানো রাইফেল।
বেলা দশটা থেকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করেছে। বেলা বারোটায় সভা শুরু হ’ল। বটতলায় দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতারা বক্তৃতা দিচ্ছে। প্রতিটি ছাত্রের চোখে-মুখে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন দাঁড়িয়ে লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত ভাষায় বিষোদগার করতে শুরু করলেন। ছাত্র সমাজকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “মায়ের অপমান সহ্য করা যায় না। মা তাঁর এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ডাক দিয়েছেন। বলুন, আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবেন, না ঘরে ফিরে যাবেন?”
সহস্র সহস্র কণ্ঠে নাগ-নাগিণীরা গর্জে উঠলোঃ ‘১৪৪ ধারা মানব না, মানব না।’
সর্বদলীয় কর্ম পরিষদের শামসুল হক ছেলেদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের বললেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না। ছাত্রদের তরফ থেকে বিদ্রুপাত্মক উক্তি ভেসে এল। শামসুল হক বসে পড়লেন। ছাত্রনেতা আবদুস সাত্তার পরামর্শ দিলেন–দশ দশ জন করে বেরুলে আইন অমান্য করা হবে না।
এ প্রস্তাব সকলে মেনে নিল। দশ দশজন ছাত্র নিয়ে এক-একটি দল তৈরী হ’ল তারা সমস্বরে চীৎকার করে উঠলোঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘১৪৪ ধারা মানি না’। ‘নাজিম-নূরুল নিপাত যাক’। ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলী চলো’। প্রথম দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই জনৈক পুলিশ অফিসার সাবধানী বাণী উচ্চারণ করে বললেনঃ “আপনারা বেরুবেন না। বেরুলেই গ্রেফতার করবো।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৭

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনি দিতে দিতে প্রথম দশজনী দলটি গেটের বাইরে আসামাত্র একঝাঁক পুলিশ হুমড়ি দিয়ে তাদের উপর এসে পড়লো এবং টেনে হিঁচড়ে তাদেরকে ট্রাকের উপর তুললো। ট্রাকের উপর থেকে ওরা আওয়াজ দিলোঃ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”
এবার দ্বিতীয় দশজনী দলটি বের হওয়া মাত্র তাদেরকে গ্রেফতার করা হ’ল। মেয়েদের একটি দলও রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’—শ্লোগান দিতে দিতে পথে বের হ’ল।
মেয়েদের দলটি পরে শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে আর একদল দশজনী মিছিল ক’রে বেরিয়ে এল। এমন সময় এক পুলিশ অফিসার বিনা দোষে লাথি মেরে একটি ছেলেকে ফেলে দেয়। ছেলেটি উঠে অফিসারটির মুখে থু-থু দিয়ে দেয়। এ হেন অবস্থায় একঝাঁক পুলিশ লাঠি হাতে ছেলেটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে ছেলেরা ক্ষেপে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুড়তে থাকে ঢিল। পুলিশ বাহিনীর টিয়ার গ্যাসের একটি শেল এসে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে। শুরু হয় ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ।
ছেলেরা একে একে মেডিক্যাল হোস্টেলে সমবেত হয়েছে। পুলিশ সেখানেও ঢুকতে চেষ্টা করেছে। অবশেষে টিয়ার গ্যাসও ছুঁড়ছে। ছেলেরা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে চীৎকার করে উড়লোঃ “পুলিশী জুলুম চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”
পুলিশ অনবরত টিয়ার গ্যাস ছেড়ে চলেছে। সারা মেডিক্যাল কলেজ ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। রোগীরা কাশছে আর কম্বল দিয়ে নিজেদের চোখ ঢেকে নিয়েছে। ইমারজেন্সীতে কতকগুলো ছেলেমেয়ে গ্যাসের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাদের কাতর ডাক ভেসে আসছে। মেডিক্যাল কলেজের দু’জন ছাত্রী ড্রপারে করে লিকুইড প্যারাফিন ঢেলে দিচ্ছে। ছেলেরা আবার ছুটছে গেটের দিকে। এভাবে বেলা দুটো পর্যন্ত ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ চললো।
তিনটা বাজে। অধিবেশন বসার সময় হয়ে এল। ছাত্ররা এম, এল, এ-দের নিয়ে একটি জীপ ছুটে যাচ্ছে দেখে চীৎকার করে উঠলো “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৮

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাও কলেজ গেট থেকে আওয়াজ দিচ্ছেঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
ছাত্রদের শ্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সারা পরিবেশ গম গম করতে লাগল একজন পুলিশ অফিসার ছাত্রদেরকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনারা দু’জন প্রতিনিধি অ্যাসেম্বলীতে পাঠিয়ে আপনাদের দাবী পেশ করে আসুন।
ছাত্ররা এই ধোঁকায় পড়তে রাজী নয়। তারা সমস্বরে চীৎকার করে উঠলঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঠিক এমন সময় একটা টিয়ার গ্যাসের শেল ছাত্রদের সামনে এসে ফাটল। ছাত্ররা চোখে রুমাল দিয়ে বসে পড়ল। পর মূহুর্তে ‘গুড়ুম’ ক’রে শব্দ হ’ল। একটি বাচ্চা ছেলেকে কয়েকজন ধরাধরি ক’রে ইমারজেন্সী রুমের দিকে নিয়ে চলছে। ছেলেটির সার্ট রক্তে ভিজে গেছে।
আবার গুলীর আওয়াজ পাওয়া গেল। ছেলেদের মধ্যে হৈ চৈ, দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। অনেকের হাত-পা কেটে গেছে। সকলে এসে ভীড় করেছে ইমারজেন্সী রুমে। ছেলেটির মাথার খুলি থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। সকলেই এই দৃশ্য দেখে বিচলিত। সকলের চোখ সিক্ত। একটা আক্রোশ তাদেরকে উন্মত্ত করে তুলেছে।
ছেলেটির নাম জব্বার। সে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সারা দেহ নিথর হয়ে গেল।
আর একটি গুলীবিদ্ধ ছেলেকে কয়েকজনে ধরাধরি করে নিয়ে এলো। তারও মাথায় গুলী লেগেছে। সেখান থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখলেন, তার দেহে আর প্রাণ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। মার কোল শূন্য করে পরপারে যাত্রা করেছে। ভাষা আন্দোলনে এই বীর শহীদের নাম রফিক।
পুলিশী নির্যাতন তখনও সমভাবেই চলেছে। টিয়ার গ্যাস আর গুলীর শব্দে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভীত ও সন্ত্রস্ত। ছাত্র-ছাত্রীরাও ভেজা রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে আর আওয়াজ তুলছেঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী গুলীবিদ্ধ অবস্থায় ইমারজেন্সীতে আশ্রয় পেয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের ভাক্তার-নার্স আর ছাত্ররা যান্ত্রিকভাবে কাজ করে চলেছে।
পৃষ্ঠা নংঃ ১২৯

ছাত্র হত্যার কথা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। জনতা ১৪৪ ধারার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে দলে দলে মেডিক্যাল কলেজে এসে ভীড় জমাচ্ছে। তখন আর পুলিশ গুলী চালায় নি।
কিছুক্ষণ পর আবার গুলীর শব্দ। মেডিক্যাল কলেজের সামনে গাছগুলোর ওপর অনেক কাক বসে ছিল। গুলীর শব্দ পেয়ে তারাও কা-কা রবে বিপদের আশঙ্কা ঘোষণা করে চলেছে।
হঠাৎ একটা গুলী এসে একটি ছেলের উরুতে লাগে। ছেলেটি মেডিক্যাল হোস্টেলের শেডের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ থুবড়ে সে মাটিতে পড়ে যায়। চাপ-চাপ রক্তে ঐ জায়গাটি লালে লাল হয়ে উঠেছে। কয়েকজন ছাত্র ধরাধরি ক’রে তাকে ইমারজেন্সীতে নিয়ে গেল। তখনও অনবরত রক্ত ঝরছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছেলেটির সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে। পাশের ছেলেটিকে ডেকে ফিস্ ফিস ক’রে বললোঃ আমাদের বাড়ীতে একটু খবর পাঠাবেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন……পল্টন লাইন। একটু পরে সে পানি খেতে চাইলো। মেডিক্যাল কলেজের একজন ছাত্রী দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ালো।
হেলেটির নাম বরকত। স্নাতকোত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। মুর্শিদাবাদে তার বাড়ী। বাড়ীতে রয়েছে তার মা।
বরকত এই বাংলার মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বরকত, জব্বার, রফিক নিজের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার ছাত্র-জনতাকে পথ দেখিয়ে গেল।
বরকতের মৃত্যুর খবর শুনে মেহনতী মানুষ রাস্তায় নেমে পড়লো। ছাত্র-জনতা সাগরের গর্জনের মত গর্জিয়ে উঠলো। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘কসাই মুসলিম লীগ সরকার ধ্বংস হউক।’
ওদিকে পরিষদ কক্ষে অধিবেশন চলছে। পুলিশের গুলীতে ছাত্র হত্যার সংবাদ পরিষদ ভবনেও পৌঁছেছে। মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ লাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এই দু’জনেই উক্ত সংবাদ বহন করে পরিষদ কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিরোধী দলের সদস্যরা এই মর্মান্তিক সংবাদে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁরা নুরুল আমীনের নিকট এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জবাব দাবী করেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩০

নুরুল আমীন প্রথমে এই সংবাদ বিশ্বাস করতেই চান নি। তিনি বলেছিলেন, “ইটস এ ফ্যানটাসটিক স্টোরী।” বিরোধীদলের যুক্তির মুখে তিনি আর বিষয়টাকে চাপা দিতে সমর্থ হলেন না। তিনি বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি না করেই উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ “পুলিশ ঠিকই করেছে। উচ্ছৃঙ্খলতা দমানোর জন্যই তো পুলিশ। এর পেছনে কমুনিস্টদের উস্কানি আছে। আমরা তাদের নির্মূল করবই।”
নুরুল আমীনের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তিকে বিরোধী পক্ষ ও সরকার পক্ষের বেশ কয়েকজন সদস্য নিন্দা করলেন। সরকারী পক্ষের মধ্যে ছিলেন—মওলানা তর্কবাগীশ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দিন। পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে মুসলিম লীগের পার্টি থেকে তাঁরা পদত্যাগ করলেন। মওলানা তর্কবাগীশ পরিষদ কক্ষে বললেনঃ ‘আমাদের ছাত্ররা যখন শাহাদত বরণ করছেন, আমরা তখন আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকব, এ বরদাশত করা যায় না। চলুন, মেডিক্যাল কলেজে চলুন। মেডিক্যাল কলেজ আজ পাঁচ কোটি জনতার তীর্থস্থান। শহীদের রক্তে পবিত্র হয়েছে সেখানকার মাটি।’ তারপর তাঁরা সদলবলে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ ক’রে বেরিয়ে পড়েন।
মেডিক্যাল কলেজে তখন হাজার হাজার জনতা। ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানীদের শেষ দেখা দেখবার জন্য এই সমাবেশ!
মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল ভবনে তোলা হয়েছে শহীদের রক্তে ছাপানো পতাকা। ছেলেরা মাইকে পুলিশী হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনবরত বলে চলেছে। থেকে থেকে সমুদ্রের কল্লোল গর্জনে গর্জে উঠছেঃ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘লীগ সরকার নিপাত যাক’।
পরের দিন পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হ’ল।
সংগ্রাম পরিষদ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল—২২শে ফেব্রুয়ারী শহীদদের লাশ দাফন করা হবে এবং মেডিক্যাল কলেজে গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে মেডিক্যাল কলেজের দিকে। জনতার সীমাহীন কাফেলা চলেছে সেই তীর্থস্থানে যেখানে বরকত, জব্বার
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩১

ও রফিক মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের রক্ত দিয়েছে। জানাজার সময় জানা গেল সরকার শহীদদের লাশ দেবেন না। অনেক চেষ্টা করেও লাশ পাওয়া গেল না। লাশ ছাড়াই গায়েবী জানাজা শুরু হ’ল। পরে অবশ্য এদের কবর চিহ্নিত হয়েছে।
ইমাম সাহেব দু’হাত তুলে মোনাজাত করলেনঃ
‘আল্লাহ, জালিমের গুলীতে কচি কচি ছেলেরা মারা গিয়েছে। ওদের খুনে রাঙা হয়েছে ধুলো আর ঘাস। তুমি তো জান আল্লাহ, ওরা নিরপরাধ। ওরা শুধু বলেছিল—বাপ-দাদার মুখের ভাষা ওরা কেড়ে নিতে দেবে না। কিন্তু গুলী করে জালিমরা খালি ক’রে দিল কতো মায়ের বুক। তুমি ওদের ক্ষমা ক’রো না। তোমার রোষের আগুনে জালিমদের নিশ্চিহ্ন করো দুনিয়ার বুক থেকে।’
জানাজার পর এক শোক-মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল এগিয়ে চললো নবাবপুর রোডের দিকে। দোকান-পাট, যানবাহন সব বন্ধ। হঠাৎ এই মিছিলের উপর চললো অতর্কিত আক্রমণ। পুলিশের লাঠির ঘায়ে অনেকের মাথা ফাটলো। পুলিশের লাঠির আঘাতে ফজলুল হক সাহেবও আহত হয়েছিলেন। লাঠি-চার্জ করার পরই গুলীর শব্দ শোনা গেল। হাইকোর্টের সামনে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল একটা ছেলে—নাম তার শফিকুর রহমান। সে ল’ ক্লাশের ছাত্র। এই মিছিলে আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম।
বিক্ষুদ্ধ জনতা এই সংবাদ পেয়ে রাগে উন্মত হয়ে উঠলো। তখন বেলা তিনটা। পরিষদ কক্ষে অধিবেশন চলছে। জনতাও সেখানে গিয়ে অ্যাসেম্বলী ঘিরে ফেলেছে। বিরোধী দল থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেয়া হ’ল। সরকার পক্ষের কিছু সদস্য তা’ সমর্থন করলেন। এদিকে চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের সাথে নুরুল আমীনের মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় প্রস্তাবটি কার্যকরী হতে বিলম্ব হ’ল। অবশেষে লীগ সরকার বাংলাকে প্রদেশের সরকারী ভাষা করতে রাজী হ’ল এবং বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণ-পরিষদের কাছে সুপারিশ করে প্রস্তাব পাঠানো হ’ল।
নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশী নির্যাতন ও হত্যাকে এবং শহীদদের লাশগুলো গায়েব করার উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র ক’রে ‘দৈনিক মিল্লাত’ ২৩শে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩২

ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখলেনঃ ‘ইসলামী বিধান অনুসারে লাশ খুবই পবিত্র। অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে সে লাশ দাফন করা বিধেয়। কিন্তু গত দুই দিনে পুলিশের গুলীতে শাহাদতপাপ্ত লাশগুলো তাদের অভিভাবকের হাতে দেওয়া হয় নি। জানি না, শরিয়ত মোতাবেক শেষকৃত্য হয়েছে কি-না। এ যে কতো বড় মর্মান্তিক, অনৈসলামিক এবং গুণার বিষয় তা’ বলে বোঝানো যায় না। সরকার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন, পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র। এই কি ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিচয়?”
বরকত-জব্বার-রফিক-শফিকদের রক্তের ঋণ এই দেশবাসী শোধ করতে পারবে না। শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য শহীদ মিনারের পরিকল্পনা নেওয়া হ’ল। মেডিক্যাল কলেজের সামনের জায়গাটিতে ‘শহীদ-মিনার’ তৈয়ার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ’ল। ছাত্ররা নিজেরাই ইট, সিমেন্ট নিয়ে লেগে গেল মিনার তৈরীর কাজে। হৃদয় নিঙড়ানো ভক্তি ও শ্রদ্ধা দিয়ে গেঁথে তুললো শহীদ-মিনার। শহীদ শফিকুরের বাবাকে দিয়ে উন্মোচন করানো হ’ল এই শহীদ-মিনারটি।
একথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে ও ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এ কারণেই ২১শে ফেব্রুয়ারীর পূর্বে অনেকবার তিনি কারাবরণ করেন। আবার ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রাক্কালে ১৪ই ফেব্রুয়ারী তারিখে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ঢাকা জেল থেকেই তিনি গোপনে তার বন্ধু ও অনুরাগীদের সংগ্রামের নির্দেশ দিতে থাকেন। তিনি জেলে অবস্থান কালে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র সবাইকে মানিক (জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর)-এর সাহায্যে খবর দেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষার প্রশ্নে মিছিল করে অ্যাসেম্বলীতে যাবার নির্দেশ দান করেন। তারপর ১৬ই ফেব্রুয়ারী থেকে ভাষার প্রশ্নে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দেন ছাত্রকর্মী মহিউদ্দীন। তিনিও তখন শেখ মুজিবের সঙ্গে জেলে ছিলেন। অনশনের ফলে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে, তখন তাঁকে ঢাকা জেল থেকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৩

শেখ মুজিবের মুক্তি
কিন্তু ছাত্ৰ-সমাজে তাঁর অপরিসীম প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার তাকে ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৮ই ফ্রেব্রুয়ারী তারিখে তাঁকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তিনি চালাকি ক’রে সময় হরণ করার চেষ্টা করেন। ইচ্ছা করেই নারায়ণগঞ্জ স্টীমার ফেল করেন। অনশনরত ছাত্রনেতাকে ছাত্রজনতা দেখতে এলে নারায়ণগঞ্জের স্টীমার ঘাটে সমবেত জনতার উদ্দেশে বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম গড়ে তুলবার আহ্বান জানিয়ে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারী তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তখনও অনশন ভাঙেন নি। ২১শে ফেব্রুয়ারী তিনি ফরিদপুর জেলে কড়া পাহারায় অবস্থান করেন। তখন তাঁর শরীর সাংঘাতিকভাবে ভেঙে পড়েছে। অবশেষে তাঁর শারীরিক অবস্থার অস্বাভাবিক অবনতি ঘটলে তাঁকে ২৭শে ফেব্রুয়ারী মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির সময় তাঁকে স্ট্রেচারে করে জেল গেটে নিয়ে এসে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার আত্মীয়-স্বজন তাঁকে বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে প্রায় একমাস চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ঢাকায় ফিরে এসে আবার যুব-নেতৃত্ব দান করতে থাকেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে এখানকার রাজনীতির গতিধারা বড় বিচিত্র আকার ধারণ করে। একদিকে পূর্ব বাংলায় যেখানে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আগুন জ্বলছে, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্রমাগত ক্ষমতার হাত বদল করছে।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে মিঃ জিন্নাহ লিয়াকত আলী খানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করলেন—কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে মনোনীত ক’রে গেলেও লিয়াকত আলী খান ষড়যন্ত্র ক’রে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে করলেন গভর্নর জেনারেল। লিয়াকত আলী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিনের মতই চরম সাম্প্রদায়িক। তা’ ছাড়া নাজিমুদ্দিন ছিলেন লিয়াকত আলীর খুবই অনুগত। আর সে জন্যই তাঁর ভাগ্যে বড়লাটের পদগৌরব সম্ভব হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৪

জিন্নাহ আওয়ামী লীগ গঠন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে এসে করাচীতে অবস্থানকালে জিন্নাহ আওয়ামী লীগ গঠন করেন। মিস ফাতেমা জিন্নাহ্ তাতে সমর্থন দেন এতে স্পষ্টতঃই বোঝা যায়, শেষের দিকে কায়েদে আযমের সঙ্গে লিয়াকত আলীদের সম্পর্কের চীড় ধরেছিল। কিন্তু লিয়াকত আলীও তাঁর একনায়কতন্ত্র বেশী দিন প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারেন নি।
তাঁর বিরুদ্ধেও পশ্চিমের একটি চক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবং তাদেরই হাতে শেষ পর্যন্ত তিনি নিহত হন। তারিখটা ছিল ১৬ই অক্টোবর, ১৯৫১ সাল।
লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং গভর্নর জেনারেল হলেন পাঞ্জাবের গোলাম মোহাম্মদ।
অবশেষে নাজিমুদ্দিনকেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হ’ল। গোলাম মোহাম্মদ অকস্মাৎ বে-আইনীভাবে তাঁকে বরখাস্ত ক’রে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে এনে তার জায়গার প্রধানমন্ত্রিত্বে বসিয়ে দিলেন।
এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ ক’রে রাখা ভাল। এসময় তৎকালীন স্থলবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খাঁ এবং মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা আমেরিকায় গিয়েছিলেন সামরিক বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্য। পরে গোলাম মোহাম্মদও চিকিৎসার ভান ক’রে প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের সেক্রেটারী জেনারেল অব স্টেটস মিঃ ডালেসের সঙ্গে গোপনীয় কথাবার্তা চালান। পরবর্তীকালের ইতিহাস প্রমাণ করে যে সে সময় তাঁরা আমেরিকার কাছে পাকিস্তানকে এক রকম বিক্রিই ক’রে দিয়ে এসেছিলেন।

শেখ মুজিব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত
যাহোক, ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব মুক্তিলাভের কিছু দিন পরেই প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলের কল্যাণমুখী আন্দোলনকে অধিকতর দুর্বার ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্য তৎকালীন প্রাদেশিক সম্পাদক জনাব শামসুল হকের অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ সাহেবকে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। শেখ সাহেব
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৫

যোগ্যতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন ক’রে যেতে লাগলেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আন্দোলন একটি গণমুখী আন্দোলনের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসে। ফলে নির্বাচন-বিমুখ মুসলিম লীগ সরকার শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হলেন।

কৃষক-শ্রমিক পার্টির পুনর্জীবন
১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল ব্যতীত সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি পাকিস্তান সৃষ্টির অনেক আগেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাডভোকেট জেনারেল সে সময় বরিশালের এক জনসভায় তাঁর সেই লুপ্ত K. S. P. বা কৃষক শ্রমিক পার্টিকে তিনি পুনরুজ্জীবিত বলে ঘোষণা করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় ১৯৫৪ সালে যখন প্রদেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছিল শেরে বাংলা আওয়ামী লীগের প্রতি তখন নির্বাচনী ঐক্যের আহ্বান জানান। এই বৃদ্ধ জননেতার বিপুল জনপ্রিয়তার দরুনই আওয়ামী লীগ তাতে সমর্থন জানান। উক্ত নির্বাচনী ঐক্যে বিরোধী দল হিসেবে অন্যান্য দলের মধ্যে নেজামে ইসলাম পার্টি ও অংশ গ্রহণ করে। নির্বাচন অভিযান পরিচালনার জন্য মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও শেখ মুজিব অক্লান্তভাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন
নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যে ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম লীগ সরকার মাত্র নয়টি আসন লাভ করতে সক্ষম হবে। তাঁর এই ভবিষ্যৎ-বাণী তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতারই পরিচয় বহন করে। নির্বাচনে শেখ মুজিবকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ নির্বাচনী কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হ’ল। শেখ মুজিব তেরো হাজার ভোটের ব্যবধানে কোটিপতি ওয়াহিদুজামানকে পরাজিত করলেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সাহেব তাঁর নিজের কেন্দ্রে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৬

যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী খালেক নওয়াজ নামে ২৫ বৎসরের এক যুবক ছাত্রের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। মুসলিম লীগের স্বপ্নসৌধ চুরমার হ’ল। ২৩৭টি আসনের মধ্যে তাঁরা পেলেন মাত্র ৯টি আসন। যুক্তফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে ছিল তাঁদের একুশ দফা কর্মসূচী।
এই ২১-দফা কর্মসূচীতে বলা হয়েছিলঃ
১। বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা।
২। ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে যে কোন প্রকারের জমিদারি বিলুপ্তিকরণ এবং উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন। করের পরিমাণ হ্রাস।
৩। পাটশিল্পকে জাতীয়করণ, পাট উৎপাদকদের জন্য উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ। মুসলিম লীগ আমলের পাটশিল্পের দালালদের অনুসন্ধান ক’রে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
৪। সমবায় শিল্পপ্রথা প্রতিষ্ঠা দ্বারা কুটিরশিল্প ও শ্রমশিল্পের উন্নতি।
৫। লবণশিল্পে পূর্ব পাকিস্তানের স্বনির্ভরতার জন্য এই শিল্পের পত্তন এবং পাট-দালালদের মত লবণশিল্পের দালালদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬। সর্বপ্রকার উদ্বাস্তু –বিশেষতঃ কারিগর ও শিল্প-শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭। বন্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সেচ-পরিকল্পনা।
৮। পূর্ববঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠার দ্বারা শিল্প-শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।
৯। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতা ব্যবস্থা।
১০। সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থা বিলোপের দ্বারা মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তন।
১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন বাতিল করে তাদের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরকরণ।
১২। প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন,উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতনে সমতা আনয়ন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীরা ১,০০০ টাকার বেশী বেতন গ্রহণ করবেন না।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৭

১৩। সর্বপ্রকার দুর্নীতি, আত্মীয় পোষণ, উৎকোচের অবসান এবং এই উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের পরের সময়ের প্রত্যেক সরকারী অফিসার ও বাণিজ্যপতিদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ।
১৪। বিভিন্ন জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স কর্তৃক ধৃত সকল বন্দীদের মুক্তি এবং সভা-সমিতি, প্রেস ও বাক স্বাধীনতা দান।
১৫। বিচার-ব্যবস্থা ও প্রশাসন-ব্যবস্থা পৃথকীকরণ।
১৬। বর্ধমান ভবনকে প্রথমে ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগারে পরিণতকরণ।
১৭। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে একটি শহীদ-স্তম্ভ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ।।
১৮। ২১শে ফেব্রুয়ারী ‘শহীদ দিবস’ এবং ছুটির দিন ঘোষণা।
১৯। ঐতিহাসিক লাহোর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। প্রতিরক্ষা বিষয়েও কেন্দ্রে যেমন থাকবে ‘নেভি হেড কোয়ার্টার্স’ এবং পূর্ববঙ্গকে অস্ত্রের ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য তেমনি পূর্ববঙ্গে হবে ‘অস্ত্রকারখানা’ প্রতিষ্ঠা। আনসারদের পু্রোপুরি সৈনিক রূপে স্বীকৃতি।
২০। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন কারণেই আইনসভা বা মন্ত্রিসভার কার্যকাল বৃদ্ধি করবেন না এবং যাতে নির্বাচনী কমিশনারের মাধ্যমে স্বাধীন পক্ষপাতহীন নির্বাচন হতে পারে তার জন্য তারা নির্বাচনের দু’মাস পূর্বে পদত্যাগ করবেন।
২১। প্রত্যেকটি আইনসভা সদস্যদের শুন্যপদ শূন্য হওয়ার তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন দ্বারা পূর্ণ করা হবে এবং যদি যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পর পর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হয় তবে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, ১৯৫৩ সালের ১৫ই নভেম্বর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যে ৪২ দফা কর্মসূচী গৃহীত হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৮

নেতা ও সাহিত্যিক জনাব আবুল মনসুর আহমদ উক্ত ২১ দফা কর্মসুচী প্রণয়ন করেন।

শেরে বাংলাঃ পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর K. S. P. এর প্রধান শেরে বাংলাকে পার্টির নেতা মনোনীত ক’রে তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও যুক্তফ্রন্টের বিজয়ী ২২৮টি আসনের মধ্যে ১৪৩টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগই সদস্যসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তথাপি শেরে বাংলার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বয়সের কথা বিবেচনা করে তাকেই পার্টি-প্রধান মনোনিত করা হয়। শেরে বাংলা হন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ মুজিবের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ
শেখ মুজিব প্রথমে পার্টির সংগঠনের গুরুদায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি ক’রে মন্ত্রিসভায় যোগদান থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশক্রমে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং সমবায়, কৃষি ও বনবিভাগের মন্ত্রীরূপে কাজ করতে থাকেন। এই সময়েই বাংলা ভাষাকে সমগ্র পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি জানানো হয়। অপর রাষ্ট্রভাষা উর্দু। যে ভাষা-আন্দোলন বাংলা জাতীয়তাযাদের চেতনায় এদেশের মানুষকে বিপ্লবমুখী ক’রে তুলেছিল তার একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হ’ল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের আরো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল-সে হ’ল এদেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি।

পশ্চিম পাকের চক্রান্ত
যা হোক, বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠনের ফলে কেন্দ্রীয় তথা পশ্চিম পাকিস্তানী ফ্যাসিস্ট সরকার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে এই সমস্ত নেতৃবর্গ যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠনকে বানচাল করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা অন্য পথের ফিকির খুঁজতে লাগলেন। আবার পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনে এক জঘন্য ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হ’ল। কতিপয় পুঁজিবাদী নেতা, আমলা, সৈনিক এই ষড়যন্ত্রের নায়ক হিসেবে দেখা দিলেন।

বাঙালী-অবাঙালী দাঙ্গা
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তখন গোলাম মোহাম্মদ। তিনি ইতিহাসের একজন কলঙ্কিত চরিত্র। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভাকে ভেঙে দেবার জন্য তাঁরই গোপন হাতের কারসাজিতে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৩৯

নারায়ণগঞ্জে আদমজী জুট মিলে বাঙালী ও অবাঙালী শ্রমিকদের মধ্যে এক ভয়াবহ দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। দাঙ্গায় হাজার হাজার বাঙালী শ্রমিক নিহত হয়। এই মিলে বাঙালী শ্রমিকদের যে ইউনিয়ন ছিল, তার সভাপতি হিলেন মওলানা ভাসানী। স্বভাবতঃই এই সব বাঙালী শ্রমিকেরা যুক্তফ্রন্টে ভোট দেয়। ফলে, মিলের অবাঙালী মালিক এতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই মুসলিম লীগের কারসাজিতে বাঙালীদের শিক্ষা দেবার জন্য মিল কর্তৃপক্ষ নৃশংসভাবে অবাঙালী শ্রমিকদের দ্বারা হামলা বাধিয়ে দেয়। এই দাঙ্গাকে কেন্দ্র ক’রে প্রদেশে অশান্তি বিরাজ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারকে দায়ী করেন। শেরে বাংলাকে জরুরী সংবাদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে আরও একটি ঘটনা ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ ক’রে দিয়েছিল।

শেরে বাংলার কলকাতা গমন ও প্রাণঢালা সম্বর্ধনা লাভ
সুদীর্ঘ ১১ বছর পর শেরে বাংলা আবার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেই বিভক্ত পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে উপবেশন করেছিলেন। তাঁর এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা স্মরণ করেই এপার-ওপার উভয় বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার সাতাশ দিন পরে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। তাঁর এই সফর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত নয়। যখন পূর্ব বাংলায় ভাষা অন্দোলন পুরোদমে চলছিল, ঠিক সে সময় এক শোভাযাত্রায় তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং পুলিশবাহিনীর নির্দয় লাঠিচালনায় তিনি পায়ে গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সেই আঘাতে তিনি বেশ কিছুদিন যাবৎ কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাঁকে ইনভ্যালিড চেয়ারে চলাফেরা করতে হ’ত। সুতরাং পায়ের চিকিৎসার জন্যই তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর যৌবন-সহচর ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে দিয়ে তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেন এবং ফেলে আসা পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আবার দেখা সাক্ষাৎ করবেন।
১৯৫৪ সালের ৩০শে এপ্রিল। বেলা সাড়ে তিনটা। ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজে শেরে বাংলা ফজলুল হক তাঁর লোকজনসহ দমদম বিমান
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪০

ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। সঙ্গে তাঁর পত্নী ও দশ বছর বয়স্ক পুত্রও ছিলেন। বিমান বন্দরে ফজলুল হক সাহেবকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানাবার জন্য বিপুল জনতার সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি সেখানে অনেক পরিচিত মুখ দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠেছিলেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ “এখানে আমি পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এই কলকাতা শহরে ৬০ বছরেরও বেশী আমি আমার জীবনের সেরা আনন্দময় দিনগুলো কাটিয়েছি। সে সব দিনগুলোর কথা আজ বড় মনে হচ্ছে। সে সব পুরোনো স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে এবং সম্ভব হ’লে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করতে আমি কলকাতায় এসেছি। ভবিষ্যতেও আবার আসবো।”
পরদিন সকালে হক সাহেব রাইটার্স বিল্ডিংস-এ ডাঃ বিধান রায়ের সাথে দেখা করেন। সেখানে অনেক পুরোনো বন্ধু থেকে শুরু করে অফিসের কর্মচারীবৃন্দ তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন জানালেন। ডাঃ রায় যথারীতি তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেন। সেখানে হক সাহেবের বিশিষ্ট চিকিৎসক সার্জেন রায় বাহাদুর উপস্থিত ছিলেন।

হক-রায় আলোচনা
ডাঃ রায় এবং হক সাহেবের মধ্যে প্রাণখোলা আলোচনা হয়েছিল। দুই বাংলার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তারা সরাসরি আলোচনা করেছিলেন। তাঁদের আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
(ক) দু’ বাংলার মধ্যে যাতায়াতের জন্য ভিসা প্রথার বিলোপ সাধন।
(খ) উভয় বাংলার মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তন।
(গ) জনসাধারণের ভ্রমণের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করা ও যাত্রীদের কষ্ট লাঘবের জন্য থ্রু টিকেট দেয়ার ব্যবস্থা।
(ঘ) সীমান্ত সংক্রান্ত বিধি নিষেধ শিথিলকরণ।
(ঙ) বাস্তুহারাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
এই সমস্ত বিষয় আলোচনার পর মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ডাঃ রায়ের নিকট বিদায় নিলেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে হক সাহেবকে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪১

সম্বর্ধনা জানানো হয়। খিদিরপুরে হিন্দু-মুসলমান মিলিত এক সম্বর্ধনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেনঃ “বাংলাদেশ রাজনৈতিক দিক থেকে দু’ভাগ হয়েছে সত্যি, কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে উভয় বঙ্গের কোন ফারাক নেই। রাজনীতিকরা দেশটাকে দু’ ভাগ ক’রে এই সাংস্কৃতিক ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেন নি, ভবিষ্যতেও কোনদিন পারবেন না।”
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি বহু মানপত্র পেয়েছিলেন। ৬ই মে বৃহস্পতিবার হক সাহেব দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ রায়ের সাথে দেখা ক’রে প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী বিভিন্ন বিষয় আলোচনা ক’রে সময় কাটান। তারপর আ-যৌবন সহচরের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। জীবনে আর ডাঃ রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য তার হয় নি।
কলকাতা ত্যাগ করার পূর্বে এক বিদায়বাণীতে তিনি বলেছিলেনঃ “বিষাদ ভারাক্রান্ত অন্তরে কলকাতার আমার অগণিত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীকে আমি বিদায় জানাচ্ছি। আমি বহুবার বলেছি যে, ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি প্রথম কলকাতায় আসি এবং আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই মহানগরীতেই অতিবাহিত হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের ঐতিহ্য, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগসুত্র এতই গভীর ও দৃঢ় যে, রাজনৈতিক বিভাগ তা’ বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। কলকাতায় আমার বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলবার সময়ে আমি খোলাখুলি মন নিয়েই আমার অনুভূতির কথা প্রকাশ করেছি।
আমি অবশ্য এই কথা শুনে বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হই নি যে ঢাকায় একদল লোক, বিশেষ করে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আমার কথার কদৰ্থ করে নানারূপ বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আমি তাঁদের কোন সমালোচনার কোন জবাব দিতে চাই না, শুধু বলব, আমার দলের কাছে নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তাঁদের পক্ষে জনসাধারণের প্রতিনিধি সেজে কথা বলা সাজে না।
……আমি অবশ্যই একজন পাকিস্তানী, এবং আমি নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগ পন্থী থেকে উৎকৃষ্ট পাকিস্তানী। কিন্তু আমি একজন পাকিস্তানী
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪২

হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের জনসাধারণের মধ্যে যেন কোন রাজনৈতিক বিচ্ছেদ হয় নি এমন ভেবে তাঁদের সম্পর্ক উন্নত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ করার চেষ্টায় কোন দোষ দেখতে পাই না।
আমার এই বিবৃতি শেষ করার আগে আমি পুনরায় কলকাতার অধিবাসীদের তাঁদের সাদর ও আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
আমি আশা রাখি ও বিশ্বাস করি যে, দুই বাংলা মিলেমিশে কাজ করে তাদের যুগ্ম প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধি ও সুখের পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে।”
জনাব ফজলুল হকের কলকাতা ভ্রমণ ও সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর ভাষণদান কুচক্রী মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু করলো। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বেতার ভাষণে হক সাহেবকে “পাকিস্তানের শত্রু” এবং “বিশ্বাসঘাতক” ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করলেন। এভাবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টকে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়েছিল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন নিছক ক্ষমতার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার নির্বাচন নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুদীর্ঘ সাত বছর ধরে পশ্চিমা শক্তি পূর্ব বাংলায় চালিয়েছিল নির্মম শাসন ও শোষণ। পূর্ব বাংলার নিরীহ মানুষ এই নির্বাচনের মাধ্যমে পশ্চিমাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
করাচী-লাহোরের শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করেছিল যে যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রিত্ব গঠনের সুযোগ দিলেই এঁরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। কিন্তু বহু ষড়যন্ত্র এঁটেও তারা লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে নি।

শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অভিযোগ
অবশেষে জনাব ফজলুল হক কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে আসার পর তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল জনাব গোলাম মোহাম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী তাঁকে করাচীতে ডেকে পাঠালেন। হক সাহেব ২১শে মে শুক্রবার করাচীতে পৌঁছলেন। সেখানে গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সাতদিনব্যাপী বাকবিতণ্ডা চলেছিল। হক সাহেব পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবী করেন। ভারতের সাথে হক সাহেবের একটা যোগসাজস রয়েছে একথা বলে পশ্চিমা শাসকরা সেদিন হক সাহেবকে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৩

দোষারোপ করেছিল। শুধু তাই নয়, শেরেবাংলা মিঃ কাহলান নামক জনৈক মার্কিন সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নাকি অনেক দেশদ্রোহী কথাবার্তা বলেছিলেন বলে মিঃ কাহলান অপপ্রচার চালাতে থাকেন। শেরে বাংলাকে কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে শাসকবর্গ মনের ঝাল মিটিয়েছিলেন। তাঁর দেশদ্রোহিতামূলক মনোভাবের সাক্ষী হিসেবে মিঃ কালহানকে পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী জনগণের উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে সাড়ম্বরে প্রচার করলেন যে, যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলাকে ভারতের সাথে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। পাকিস্তানকে ধ্বংস করাই যুক্তফ্রন্টের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই অন্তর্ঘাতীদের হাত থেকে পাকিস্তানকে বাঁচাবার জন্য ৯২(ক) ধারা প্রবর্তন ক’রে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দেয়া হ’ল।
জনাব ফজলুল হক করাচী থেকে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় দমদম বিমানঘাঁটিতে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর সাথে ছিলেন মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য—জনাব আজিজুল হক, জনাব আতাউর রহমান খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান।
সেদিন কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিকরা হক সাহেবকে নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। বাস্তবিক হক সাহেব খুব পরিশ্রান্ত ছিলেন। তিনি শুধু বললেন, “আমার কাছে এসে আর লাভ নেই। আমি কিছু বলতে পারব না। আমার মুখ বন্ধ।”
কলকাতার সাংবাদিকরা এক ঘোলাটে আবহাওয়ার কথা পূর্বেই অনুমান করেছিলেন। হক সাহেবকে আর বিরক্ত না করে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁরা বিদায় জানালেন।

শেরে বাংলার অন্তরীণ ও শেখ মুজিবের গ্রেফতার
শেরে বাংলা ঢাকার মাটিতে পা দেয়ার সাথে সাথে তাকে গৃহাভ্যন্তরে অন্তরীণ ক’রে রাখা হ’ল আর তাঁর মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হক – সোহরাওয়ার্দীর উত্তরাধিকার শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হ’ল। পাকিস্তান সরকার তাঁকে জেলের বাইরে রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। কারণ শেখ মুজিবের অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্বন্ধে তাঁরা বেশ ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। তাই কিছুদিনের জন্য
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৪

হলেও তাঁকে জেলে রাখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ঈদের আগের দিন তিনি গ্রেফতার হন। তাঁকে ঈদের নামাজ পর্যন্ত পড়তে দেয়া হয়নি। শেরে বাংলার ভাগ্যেও একই অবস্থা ঘটেছিল। তাঁকেও আপন ঘরের বাইরে নামাজ পড়তে দেয়া হয় নি।

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা
এর আগেই ১৯৫৪ সালের ৩১শে মে রোববার গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ব পাকিস্তানে ৯২(ক) ধারা প্রবর্তন করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন এবং তদানীন্তন গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে সরিয়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা-সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে গভর্নর হিসেবে পাঠালেন পূর্ব বাংলাকে ঠাণ্ডা করার জন্য। গদিতে বসেই ইস্কান্দার মীর্জা লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিতে লাগলেন। তিনি পূর্ব বাংলার বাঙালীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বললেনঃ “৯২(ক) ধারা প্রয়োগের বিরুদ্ধে কেউ ‘টুঁ’ শব্দটি করলে তা’ সহ্য করা হবে না, দরকার হলে আমি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি জেলায় সৈন্যবাহিনী পাঠাবো। মোদ্দা কথা, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এর জন্য যদি দশ হাজার বাঙালীকে খুন করতে হয়, তা’ও করতে রাজী। তবুও আমি এ কাজে পেছপা হব না।”
তিনি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নকে কম্যুনিস্ট ও ভারতের এজেন্ট বলে দোষারোপ ক’রে বললেনঃ “এরা পূর্ব বাংলাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ঘোরতর ষড়যন্ত্র করছে। তারা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরোধিতা করছে এবং সেই চুক্তির বিরোধী দিবস পালন করেছে গত ১৬ই এপ্রিল তারিখে।” তিনি ভাসানীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বললেনঃ “ভাসানীকে আমি গুলি ক’রে হত্যা করব।” সৌভাগ্য যে ভাসানী সাহেব মীর্জা সাহেবের পিস্তলের নলের সামনে ছিলেন না, তখন তিনি বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য সুইডেনের রাজধানী স্টকহমে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে লণ্ডনে গিয়ে অবস্থান করছিলেন।
কিছুদিন পর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সবাইকে চমকিয়ে দিয়ে বাংলা সম্পর্কে এক বিবৃতি দিলেন। তিনি বললেন যে, “হক
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৫

সাহেব দেশদ্রোহী নন। বরং তাঁকে বন্ধু বলেই তিনি মনে করেন।” ফলে বৃদ্ধ বয়সেও হক সাহেবের মনে আবার নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হ’ল। এর আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন; কিন্তু গোলাম মোহাম্মদ পরে যখন ঢাকায় এলেন তখন তাঁর চালবাজীকে সরল মনে গ্রহণ ক’রে কৃতজ্ঞতাবশতঃ হক সাহেব গভর্নর জেনারেলের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খানও। এমনকি কার্জন হলে গোলাম মোহাম্মদকে অভিনন্দনও জানান হ’ল।

পুনরায় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন
এই অভিনন্দনের ফল একদিকে শুভই হয়েছিল বলতে হবে। কারণ ১৯৫৫ সালের ৩রা জুন করাচী থেকে ফরমান জারী করে পূর্ব বাংলার বুক থেকে গভর্নরের শাসন তুলে নেয়া হ’ল। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের অধিকারী ছিলেন। পার্টির লীডার ফজলুল হককে সে অধিকার দান করা হয়। কিন্তু হক সাহেব নিজে মন্ত্রিসভা গঠন না করে কৃষক-শ্রমিক পার্টিরই সদস্য আবু হোসেন সরকারের ওপর সে দায়িত্ব অর্পণ করেন। আবু হোসেন সরকার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করলেন।

শেখ মুজিবের মুক্তি
ইতিমধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল। এই নির্বাচনেও শেখ মুজিব সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হ’ল। তাতে ঠাঁই পেলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও মুসলিম লীগ। শেরে বাংলা ফজলুল হকও উক্ত মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ছিল সর্বাধিক; তথাপি তাঁদেরকে বাদ দিয়েই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করায় ফ্রন্টের মধ্যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হ’ল।
আসলে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলের এই ভাঙ্গনের জন্যই গোলাম মোহাম্মদ চালাকি ক’রে ফজলুল হককে নিজের কাছে টেনে নিলেন। বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৬

এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার জন্য ভাসানী ও শহীদ সাহেবকে রাজী করালেন। পরিশেষে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী ওয়াদা পালনের জন্য শেখ সাহেব একটা পূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্বে দিতে থাকেন।
আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জনসমর্থন লাভের মূলে ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবী। পূর্ব বঙ্গের ওপরে জাতীয় ঐক্যের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান—এই ধ্বনি মূর্ত হয়েছিল নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে।

কেন পূর্ব বঙ্গের অটোনমি চাই
পশ্চিম পাকিস্তানের এই উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মাধ্যমে শুরু করলেন ব্যাপক গণ আন্দোলন। ‘কেন পূর্ব বঙ্গের অটোনমি চাই’—সে বিষয়ে জনমতকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করলো। এর খসড়া তৈরী করেছিলেন শেখ মুজিব স্বয়ং। এই পুস্তিকায় বলা হয়েছিলঃ
“পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মৌলিক প্যাটার্নের পটভূমিতে ভূগোলের দিক দিয়ে পূর্ব বঙ্গের অটোনমির দাবীকে স্বীকার না করে উপায় নেই। পাকিস্তান একটি অখন্ড ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। এই রাষ্ট্রের দু’টি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বিমানপথে এক হাজার মাইল এবং জলপথে তিন হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। ক্যানাডা ও ব্রিটেনের মধ্যে যে ব্যবধান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান তার চেয়েও বেশী।
বাস্তব ক্ষেত্রে করাচী সরকারের কাছে পূর্ব বঙ্গের কণ্ঠস্বর পৌঁছে না এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের বক্তব্যেরও কোন গুরুত্ব নেই। এক হাজার মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পূর্ব বঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং তার ফলে দুই ভূখণ্ডের জনসাধারণের পক্ষে পরস্পরকে জানা এবং পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন করাও সম্ভব নয়।
অর্থনীতির দিক দিয়েও পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী অতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ পরস্পরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের অর্থনীতির
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৭

ভিত্তি সম্পূর্ণ পৃথক, যোগাযোগের অভাব। উৎপাদনের ব্যবহার ভিন্নপ্রকৃতির এবং মূল্যমানের বিরাট পার্থক্যের ফলে এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের পারম্পর্য রক্ষা করাও সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী ও পুর্ব বঙ্গের মধ্যে চৌদ্দশ’ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড অবস্থিত। স্থলপথে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। বিমান বা স্থলপথে পরস্পরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব বঙ্গের তুলনায় অনেক কম। প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচীতে আমদানী করা হয় এবং তারপরে আবার রফতানী করা হয় পূর্ব বঙ্গে। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের রফতানীকারীরা যে শুধু অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে তাই নয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাল রফতানী করার জন্যও অতিরিক্ত দাম ধার্য করে। সে জন্য বৈদেশিক জিনিসপত্র যে পূর্ববঙ্গের চাহিদার তুলনায় অনেক কম পাওয়া যায় তাই নয়, পূর্ব বঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামেও বিক্রি হয়।
রাজনীতির দিক দিয়েও পুর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবী অনস্বীকার্য। বর্তমান যুগে সবদেশেই সরকারী কাজকর্ম জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রেখে পরিচালিত করা হয়। তিন হাজার মাইল দূর থেকে পূর্ব বঙ্গের জনসাধারণের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সামান্য যোগাযোগ রাখাও সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ ক’রে তাই রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে এই রাষ্ট্রের সমস্ত কাজকর্ম ইউনিটারী বা ঐকিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কতখানি ঐক্য স্থাপন করা হয়েছে? জোর জুলুম ক’রে অথবা পিস্তল দেখিয়ে কোন দেশে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয়।
পূর্ব বঙ্গের ইতিহাস এক শোষণের ইতিহাস। এই অঞ্চলের জনসাধারণের আয় থেকে এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কাজে। এই অর্থ থেকে পূর্ব বঙ্গের ভাগ্যে সামান্য অংশও জোটে নি। পাকিস্তান গঠনের পরে রাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক সংগঠন স্থাপিত হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৮

মিলিটারী কলেজ, প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর সবই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে ও করাচীতে। এরূপ কাজে অথবা এরূপ সংগঠন তৈরীর ব্যাপারে পূর্ব বঙ্গ কোনো অংশই পায় নি। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার ৬০-৭০ কোটি টাকা পুর্ব বঙ্গ থেকে সংগ্রহ করে কিন্তু তার প্রায় সবই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ এবং অন্যান্য শোষণের ফলে পূর্ব বঙ্গের সর্ব শ্রেণীর জনজীবন আজ এক শোচনীয় দারিদ্রের সম্মুখীন। পূর্ব ও পশ্চিম পাক ভূখণ্ড দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ড হওয়ায় এবং একটি অর্থনৈতিক সংগঠন বা অঞ্চল না হওয়ায় পূর্ব বঙ্গের পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়ে এই পূর্ব ভূখণ্ডের অর্থনীতিকে আজ এক চরম দুর্বিপাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানীর ক্ষেত্রে এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে যে, তার ফলে পূর্ববঙ্গের জনজীবন গুরুতর ভাবে বিপন্ন হচ্ছে। পূর্ব বাংলা বহুবার এই অভিযোগ করেছে যে, ব্যবসা বাণিজ্যের লাইসেন্স এবং বৈদেশিক আমদানীর সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের এমন পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে যে, তার ফলে আমদানীর প্রায় অধিকাংশই যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ পক্ষপাতিত্বের জন্য পূর্ব বঙ্গের বাজারে জিনিসপত্র শুধু দুষ্প্রাপ্য নয়, অগ্নিমূল্যও বটে। বর্তমানে পূর্ব বঙ্গকে সমস্ত বৈদেশিক জিনিসপত্র আমদানী করতে হয় করাচী থেকে এবং তার ফলে প্রত্যেক জিনিসের জন্য পূর্ব বঙ্গকে পঞ্চাশ শতাংশ বেশী দিতে হয়। এইভাবেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গের পুঁজি নিয়মিতভাবে শোষণ ক’রে নিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্মে কি ভাবে পূর্ব বঙ্গকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কি ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত, কেন্দ্রীয় সরকারে নিযুক্ত কর্মচারীদের আঞ্চলিক বন্টনের তথ্যে তা’ অতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পোস্ট
ডিপার্টমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গ
কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট ৬৯২ ৪২
শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ১৬২ ৩
পৃষ্ঠা নংঃ ১৪৯

ডিপার্টমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গ
রেডিও ৯৮ ১৪
সাপ্লাই ও ডেভেলপমেন্ট ১৬৪ ১৫
রেলওয়ে ১৫৮ ১৪
পোস্ট ও টেলিগ্রাফ ২৭৯ ৫০
কৃষি অর্থনীতি কর্পোরেশন ৩৮ ১০
সার্ভে ৬৪ ২
বিমান বাহিনী ১,০২৫ ৭৫
শিক্ষাক্ষেত্রে এবং মেডিকেল গঠনেও পূর্ব বঙ্গের অবস্থা একই রকম শোচনীয়। যথাঃ

বিষয় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গ
নতুন কলেজ ১ ০
মেডিকেল কলেজ ৬ ১
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ৩ ১
ইউনিভার্সিটি ৪ ২
কলেজ ৭৬ ৫৬
প্রাইমারী স্কুল ৬,২৪৬ ২,২১৭
হাসপাতালে বেড সংখ্যা ১৭,৬১৪ ৫,৫৮৯
ডাক্তার ৮,৫০০ ৩,৩৯৩
মেটারনিটি হাসপাতাল ১১৮ ২২
উক্ত পুস্তিকার উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই কি ভাবে শোষণ করেছে।
আসলে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ চেয়েছিল পূর্ব বাংলাকে শোষণ ক’রে নিজেদেরকে একটি উন্নত ধনিক শ্রেণীতে রূপান্তরিত করতে। কিন্তু নবজাদাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে গেল সৈনিক ও আমলাদের হাতে। তবে আশার কথা এইযে, আমলারাও তাদের স্বার্থেই সব সময় নিয়োজিত থেকেছেন। অর্থাৎ চাকা একইভাবে ঘুরতে লাগল- পূর্ব বাংলাকে শোষণ কর।
এই উদাহরণের স্বপক্ষে ‘কেন অটোনমি চাই’ পুস্তিকাই যথেষ্ট নয়।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫০

পূর্ব বাংলাকে যে সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছিল ইতিহাস তার যথেষ্ট প্রমাণ দেবে।

আঞ্চলিক বৈষম্য
১৯৪৬ সালের ১৫ই অক্টোবরে জিন্নাহ সাহেব যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদের নাম ঘোষণা করেছিলেন তাতে রাজনৈতিক দাবার গুটি হিসেবে অনুন্নত সম্প্রদায়ের যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলের নাম ছাড়া পূর্ব বাংলা থেকে আর কারো নাম ঘোষণা করা হয় নি। এতে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন লিয়াকত আলী খান, আই. আই. চুন্দ্রীগড়, সর্দার আবদুর রব নিশতার ও গজনফর আলী খান।
অথচ পাকিস্তানের দাবীতে মাত্র কয়েক মাস পূর্বে ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে বাংলার মুসলমানের শতকরা ছিয়ানব্বইটি ভোট দিয়েছিলেন আর পাঞ্জাবের মুসলমানেরা দিয়েছিলেন শতকরা উনপঞ্চাশটি ভোট। ক্ষমতা অর্জনের সোপান তৈরীতে ব্যবহৃত হ’ল বাংলার শক্তি। অথচ ক্ষমতা গ্রহণ কালে বঞ্চিত হ’ল বাংলার যথার্থ অধিকার।
পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলাকে যে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা’ আগেই কিছু কিছু বলা হয়েছে। ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক আর রাজনৈতিক বাস্তবতার পটভূমিকায় এদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল ফেডারেল কাঠামোর। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে একটা চরম একনায়কত্ববাদী আর সর্বশক্তিমান কেন্দ্রীভূত সরকারই সর্বক্ষণের জন্য ছিল বিরাজমান।
কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারী প্রতিষ্ঠান, এমন কি, সামরিক বিভাগের সব সদর দফতরই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পূর্ব বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে। আবার ১৯৫৫ সালের পশ্চিমাঞ্চলের সবগুলো প্রদেশকেও একত্র ক’রে গড়া হয়েছিল একটি মাত্র রাজনৈতিক ইউনিট।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পদ্ধতিই ছিল এই রকম যে, দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু বাঙালীদের কিংবা ছোট ছোট অঞ্চলের যেমন পাঠান, সিন্ধী, বালুচীদের কারোরই কোন সক্রিয় প্রতিনিধিত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কোন কর্তৃপক্ষ কখনই যথাযোগ্য স্থান পায় নি। শুধুমাত্র পাঞ্জাবীরা আর অবিভক্ত ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে হিজরত করা উদ্বাস্তু অফিসাররাই
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫১

একচেটিয়াভাবে আঁকড়ে থেকেছে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে এবং প্রশাসনিক শক্তিকে। ১৯৫৫ সালেই কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস আর প্রতিরক্ষা বাহিনীর উর্ধ্বতন পদে বাঙালীদের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য; বলা চলে প্রায় চোখে না পড়ারই মত। তারপর থেকে এই অবস্থার আর কখনো হেরফের হয় নি। এমন কি পূর্ব বাংলার উর্ধ্বতন প্রশাসনিক পদেও নিয়োগ করা হ’ল অবাঙালী অফিসারদের। তাঁদের মনোভাব ছিল একেবারেই উপনিবেশবাদী। বাঙালীদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন কিছুর প্রতিই তাঁদের ছিল একটা ঘৃণ্য আর বিদ্বেষের মনোভাব।
সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালেই পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে কি পরিমাণ বৈষম্য বিদ্যমান ছিল তার একটা নজীর পাওয়া যায় ১৯৫৬ সালের ৯ই জানুয়ারী তারিখে প্রকাশিত করাচীর ‘ডন’ কাগজের পৃষ্ঠায়। এতে যে তুলনামূলক চিত্রটি দেওয়া হয় তা’ নিম্নরূপঃ
সামরিক ক্ষেত্রে
পূর্ব বঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান
জেনারেল x ৩(?)
মেজর জেনারেল x ২০
বিগ্রেডিয়ার x ৩৪
কর্নেল ১ ৪৯
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ২ ১৯৮
মেজর ৯০ ৫৯০
নৌবাহিনী অফিসার ৭ ৫৯৩
বিমান বাহিনী অফিসার ৪০ ৬৪০

বেসামরিক ক্ষেত্রেঃ কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে চাকুরীর বৈষম্য
কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তান
সেক্রেটারী x ৪২
জয়েন্ট সেক্রেটারী ৮ ২২
ডেপুটি সেক্রেটারী ২৩ ৫৯
সেকশন অফিসার ৫৫ ৩২৫
প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার ৮১৪ ৩,৭৯৬
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫২

শুধু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বঞ্চনাই নয়—এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রেও চরম প্রবঞ্চনা করেছে তারা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর-পরই এদেশের অর্থ ও অর্থনৈতিক সম্পদ কি ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়েছে পর্যালোচনা করলেই তা’ স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ত্রিশ কোটি টাকা ক’রে মোট ১৮০ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে। ১৯৪৮ এবং ১৯৪৯ সাল—এ দু’বছরে প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়ন খাতে সরকার-প্রদত্ত ঋণের ২৪ কোটি টাকার মধ্যে একা পাঞ্জাব পেলো ১০ কোটি টাকা আর পূর্ব বঙ্গ পেলে মাত্র ৮ কোটি টাকা। ১৯৪৯ এবং ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর জন্যে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং ১৯৫০-৫১ সালে ৪৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু এই টাকার ৯০ ভাগ খরচ হ’ল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানে যে ৫২ হাজার টন লোহা আমদানী করা হয় তার সবটাই ব্যয় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের শিক্ষাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৭০ লক্ষ টাকা সাহায্য দেয়া হয় ১৯৫০ সালে; কিন্তু ঐ বছরেই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য দেয়া হয় ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ১৯৫০ সালে করাচী, লাহোর এবং পেশোয়ার এই তিন বেতার কেন্দ্রের এর জন্য ব্যয় করা হয়েছিল ৯ লক্ষ ১২ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে ঢাকা বেতারের জন্য মাত্র ১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা ব্যয় করা হ’ল। ঐ বছরে দেশরক্ষা খাতে মোট ব্যয় ৮০ কোটি টাকা তার মধ্যে ৭৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছিল, তার সবটাই খরচ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে।
ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলার কথা আগেই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কিভাবে বাঙালীদের তাজা লাল খুনে বাংলা ভাষার দাবীতে বাংলার মাটিকে রঞ্জিত করা হয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি হামলার পেছনেও শাসকগোষ্ঠীর শোষণমূলক মনোভাব ক্রিয়াশীল ছিল। কেননা, তাঁরা
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৩

জানতেন কোন জাতিকে শোষণ করতে হ’লে সে জাতির তিনটি বিষয়ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে হয়। তা’ হ’ল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক’। এর একটির ব্যতিরেকে অপরটিতে সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সাথে বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিকেও পদদলিত করতে চাইলেন তাঁরা। সেই কারণেই একটি অত্যন্ত সংখ্যালঘু মানুষের ভাষাকে সর্বাপেক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ওপর চাপিয়ে দেবার হীন ষড়যন্ত্র অব্যাহত ভাবে চলেছে দীর্ঘদিন। এখানে বলা অব্যশক যে, পাকিস্তানের শতকরা ৫৪.৬ ভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলে। পক্ষান্তরে উর্দু ভাষাভাষীদের সংখ্যা শতকরা ৭.২ ভাগ। আরো বিস্ময়ের বিষয় এই যে, উর্দুর চেয়ে পাঞ্জাবী এবং পশতু ভাষাভাষীদের সংখ্যাই বরং অধিক—যথাক্রমে ২৮.৪ ভাগ এবং ৭.১ ভাগ।
শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনাই নয়, ‘পাকিস্তান’ নামের মধ্যেই পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। কেম্ব্রিজের পাঞ্জাবী ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী এই ‘পাকিস্তান’ শব্দটির উদ্ভাবক। এই শব্দটি কয়েকটি প্রদেশের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত। যেমন P-Punjab, A-Afganistan, K-Kashmir, S-Sind, Tan-Beluchistan. এখানে স্পষ্ট যে, পাকিস্তান শব্দটির মধ্যে পূর্ব বাংলা প্রদেশের কোন অস্তিত্ব নেই।
যাহোক, এতক্ষণ যে শাসন ব্যবস্থায় বৈষম্যের কথা বলা হ’ল সেই শাসন ও শোষণের প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে তাঁরা বারবার ক্ষমতার হাতবদল করেছেন কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তাঁরা উদার থেকেছেন। সে হ’ল পাঞ্জাবের স্বার্থের প্রশ্ন। এই প্রশ্নে তাঁরা সর্বদা সচেতন থেকেছেন। পশ্চিমাগোষ্ঠীর তাঁবেদার বগুড়ার মোহাম্মদ আলীরাও এই উদারতাকে উপেক্ষা করতে পারেন নি।
আগেই বলা হয়েছে যে, নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে ওয়াশিংটন থেকে ধরে এনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী সে সময় প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। ইস্কান্দার মীর্জা গিয়েছিলেন লণ্ডনে। করাচীতে তখন চলছিল বড় রকমের ষড়যন্ত্র।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৪

এই ষড়যন্ত্রের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় Eclips of East Pakistan নামক নিবন্ধে। তাতে বলা হয়েছেঃ
Mr. Ghulam Mohammed sent spies to watch what was happening at Karachi, when he was convalescing at Abbottabad. Many of the spies were holding key posts in the administration. From them, he obtained a clear picture of the conspiracy against him, hatched and executed by the Constituent Assembly as a whole and by Prime Minister Mohammed Ali. He was furious over the ammendment of the Govt. of India Act. He came down to Karachi immediately but Mr. Mohammed Ali bad already left for the United States.
While enjoying American hospitality during his stay in the United States Mr. Mohammed Ali got a jolt. He got summons from the Governor General of his country to return at once. Mr. Ali cancelled his scheduled visit to Ottowa within few hours of his receiving the summons. Mr. Ali was flying over the Atlantic on his way back to Karachi. At London Air Port Mr. Ali and General Ayub Khan were joined by General Iskander Mirza and Mr. M.A. H. Ispahani, Pakistani High Commissioner in the U. K. They all flew to Karachi together. The Mouripur Air Port was heavily guarded by troops when they landed there at midnight on 23 October.
Emissaries of the Governor General surrounded Mr. Mohammed Ali as soon as he came down the runway of the aircraft. Mr. Ali asked his Begum Saheba who also accompanied him to go home. Like a prisoner Mr. Ali was escorted to the car and driven to the residence of the Governor General.
What pained between Mr. Ghulam Mohammed and Mr. Mohammed Ali came to be known to the public through whisp from men who were eye witness to their meeting. Pressmen had been to the Governor General’s residence. They saw how Mr. Mohammed Ali went in and how he came out at 2 in the morning. They saw him weeping when he came out. Mr.
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৫

Ghulam Mohammed gave him an ultimatum: “Do as I order or go to prison.”
Reports appeared in foreign press of Mr. Mohammed Ali’s surrender to Mr. Ghulam Mohammed in preference to detention in jail as a prisoner within a few hours of his surrender, early on the morning of 24 October.” [Eclipse of East Pakistan: জ্যোতি সেনগুপ্তঃ উদ্ধৃত, কৃত্তিবাস ওঝাঃ আমি মুজিব বলছি, পৃঃ ২৫৯-২৬১]

মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা বাতিল
১৯৫৪ সালের ২৪শে অক্টোবর আকস্মিকভাবে গোলাম মোহাম্মদ জনাব মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। সেদিন সকাল বেলায় এক জরুরী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রচার করা হ’লঃ “বর্তমান মন্ত্রিসভা ও আইনসভাকে ভেঙে দেওয়া হ’ল। দেশের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তাই হ’ল সকলের বড় কথা। জাতীয় স্বার্থের কাছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রাদেশিক স্বার্থকে বলী দেয়া যায় না। আর তা’ যেতে দেয়া হবে না। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কথা মনে ক’রে গভর্নর জেনারেল অতি দুঃখের সংগে এই সিদ্ধান্ত নেন।”

প্রেস বিজ্ঞপ্তি
ঐ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হ’ল, “বর্তমান আইনসভা জনগণের বিশ্বাস হারিয়েছে। তাঁদের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব রয়েছে জনসাধারণের হাতে। জনগণ তাঁদের নবনির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে নতুন আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠন ক’রে দেশের বহুবিধ সমস্যা সমাধান করতে যত্নশীল হবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যে পর্যন্ত না নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে পর্যন্ত পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা দেশের শাসন কাজ চালিয়ে যাবেন। দেশকে স্থায়ী ও শক্তিশালী শাসন উপহার দেবার জন্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর মন্ত্রিসভার সংস্কারের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।”

গুণময় মন্ত্রিসভাঃ সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ
ঐ দিনই বিকেল বেলায় মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রেখে মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন করা হ’ল। এই পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভার নাম দেয়া হ’লঃ “Ministry of talents” বা ‘গুণময় মন্ত্রিসভা’। এই গুণময় মন্ত্রিসভায় বিশিষ্টদের মধ্যে স্থান পেলেন আইয়ুব খান, ইস্কান্দার মীর্জা, চৌধুরী রহমত আলী, ডাঃ খান সাহেব, শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ। আইয়ুব খান, ইস্কান্দার
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৬

মীর্জা ও চৌধুরী রহমত আলী পেলেন যথাক্রমে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও অর্থ দফতর। শহীদ সাহেবকে দেয়া হ’ল আইন বিভাগের ভার।
শহীদ সাহেব যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন ক’রে দিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য জুরিখে। সেখান থেকে গোলাম মোহাম্মদ তাঁকে ডেকে আনান। ১৯৫৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর তিনি করাচীতে ফিরে এলেন।
তাঁকে ডেকে আনা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রিত্ব দেয়ার জন্য—কিন্তু শেষে তাঁকে অন্য পদে বসানো হ’ল। তবে প্রতিশ্রুতি দেয়া হ’ল, কিছুদিন পরে তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী করা হবে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের এই মন্ত্রিত্ব গ্রহণকে আওয়ামী লীগ অনুমোদন দিতে পারেন নি। পার্টির নেতার কাছে এ ব্যাপারে অনুমতি নেয়ার জন্য শহীদ সাহেব লণ্ডনে অবস্থানকারী ভাসানী সাহেবের সংগে দেখা করেছিলেন। এর আগে ঐ একই ব্যাপারে আতাউর রহমান খানও গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এসেছিলেন। শহীদ সাহেবকে ভাসানী অনুমতি না দিয়ে বলেছিলেন যে, যেহেতু মোহাম্মদ আলী একদা অবিভক্ত বাংলায় নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পি. এ. ছিলেন এবং উক্ত মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দী একজন মন্ত্রী ছিলেন—সেহেতু মোহাম্মদ আলীর অধীনে মন্ত্রিসভায় যোগদান করা সোহরাওয়ার্দীর উচিৎ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দিক চিন্তা করে তিনি গুণময় মন্ত্রিসভা’য় যোগ দিলেন।
শহীদ সাহেবের এই সিদ্ধান্তে শেখ মুজিব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু নেতার প্রতি তাঁর ছিল অসীম বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা, তাই প্রকাশ্যে তাঁর কোন সমালোচনা তিনি করলেন না।
দেশের শাসনতন্ত্র রচনার ভার আইনমন্ত্রী হিসেবে সোহরাওয়ার্দীকে দেয়া হ’লেও তিনি তা’ সম্পন্ন করতে গিয়ে পদে পদে নানা বাধার সম্মুখীন হলেন। একবার মোহাম্মদ আলীকে সরিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীও হবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জাতীয় পরিষদে অমুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি তাতে সফলকাম হতে পারেন নি। এর পরিণতিতে, মাত্র ১ মাস মন্ত্রিত্ব করার পর ১৯৫৫ সালের আগস্টে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৭

গুণময় মন্ত্রী পরিষদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন।
১৯৫৬ সালে ৭ই ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন বসল। উদ্দেশ্য, এই অধিবেশনে উক্ত সালেরই জানুয়ারীতে রচিত খসড়া শাসনতন্ত্রটি পাশ করা।
১৯৫৬ সালের এই শাসনতন্ত্রের কতকগুলো মারাত্মক ধরনের ধারা ছিল। যেমন—
(১) পাকিস্তান হবে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ নামে পরিচিত।
(২) রাষ্ট্রপ্রধানের পদে কোন হিন্দু স্থান পাবে না।
(৩) পাকিস্তানের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হবে কেন্দ্রে।

১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র
জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল এই নতুন শাসনতন্ত্রকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেন। তাঁরা বললেন, “রাষ্ট্রের সংগে ধর্মকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, পাক-নেতারা মধ্যযুগের অন্ধকারে এবং গোঁড়ামির রাজত্বে বাস করছেন। আর সেই কারণে তারা অগণতান্ত্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রপ্রধানের পদ কেবল মাত্র মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ক’রে রেখেছেন। তার ওপর পাকিস্তানের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থা হয়েছে কেন্দ্রে। এ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র। এর দ্বারা প্রকারান্তরে স্বৈরতন্ত্রেরই জন্ম দেয়া হচ্ছে।
এই নয়া শাসনতন্ত্রের খসড়াকে কেন্দ্র ক’রে ঐদিনই অর্থাৎ ৭ই ফেব্রুয়ারী আইন-সভায় দারুণ হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। এক সময় বিরোধী দলের সদস্যরা সভাকক্ষ ত্যাগ ক’রে বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগে শাসকগোষ্ঠী শাসনতন্ত্রের ৫০টি ধারা পাশ করিয়ে নেন।
সেদিনের মত আইন-সভার অধিবেশন শেষ হলে দীর্ঘ বিরতির পর ২৯শে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৬) পুনরায় অধিবেশন বসলে সেদিনও বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সমস্ত খসড়া শাসনতন্ত্রটি গৃহীত হয়।
শুধু তাই নয়, পূর্ব বাংলার বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পাকিস্তানের গৃহীত প্রথম সংবিধানে পূর্ব বঙ্গের অটোনমির দাবী প্রত্যাখ্যাত হ’ল। এমন কি পূর্ব বাংলা নামটি পর্যন্ত মুছে দিয়ে তা’ ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে রূপান্তরিত করা হল।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৮

‘পূর্ব বাংলা’ নামের এই বিলুপ্তির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিষদে ১৯৫৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জোরালো ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ
“Sir, you will see that they want to place the words ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should make it Bengal (Pakistan). The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it, then we will have to go back to Bengal and ask them whether they accept it.
So, for as the question of One Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want to take it up just now, what about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The peoples of East Bengal will be prepared to consider One Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of a referendum or in the form of a plebiscite. Let the people of the frontier say that they want One Unit. At the moment, they say that they are against it. But Dr. Khan Shahib said the other day that people were in favour of One Unit but his brother Khan Abdul Gaffer Khan and Pir Shahib of Manki Sharif said that they were against it. Now who will judge it? Who should be the judge? If the people of the Frontier say that they are in favour of One Unit we have no objection to that. Similarly in Sind, Mr. Khuro says that they are in favour of it, while Mr. G. M. Syed and others say that people are against One Unit. All right, if they are in favour let a referendum be held and let the people decide themselves and we will accept it.”
[ Political Ideas of Sheik Mujib 1955-71, Pakistan Desk, Dept. of Political Science, Gandhian Institute of Studies,
Rajghat, Varnasi, India, Special Number, Vol. No. 21
পৃষ্ঠা নংঃ ১৫৯

পরিষদে একদিন মোহাম্মদ আলী পূর্ব বাংলার প্রশ্নে শেখ মুজিবকে কটাক্ষ করেছিলেন। মুজিব তার জবাবে বলেছিলেনঃ “পূর্ব বাংলার জন্য কথা বলবার অধিকার আপনার আছে না আমার আছে তার প্রমাণ দিতে হলে পূর্ব বাংলায় এসে আমার সাথে আপনার জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। পূর্ব বাংলার যে কোন অঞ্চল থেকে, এমন কি আপনার বগুড়া থেকে আমার সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। যদি আপনাকে না হারাতে পারি, আমি জীবনে আর কোন দিন রাজনীতি করবো না। আশা করি প্রধানমন্ত্রী আমার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন।” মোহাম্মদ আলী এই অমিত সাহসী বক্তব্যের জবাব দিতে পারেন নি। গণ-সমর্থন শূণ্য এই ভুঁইফোড় নেতার সে সাহসও ছিল না, তিনি ছিলেন কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রের খেলার পুতুল।
কেউ কেউ মনে করেন, ‘পূর্ব বঙ্গ’ নামের পরিবর্তনের পেছনে শেরে বাংলা ফজলুল হকেরও সক্রিয়তা ছিল। অবশ্য এ ধারণার পিছনে কোন প্রমাণ নেই। আর আজীবন যিনি বাংলার হয়ে কাজ করেছেন তিনি এমন সিদ্ধান্তে সক্রিয় অংশ নেবেন একথা ভাবা যায় না।
‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’-এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা। মীর্জা সাহেব এর আগে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের পদে বহাল ছিলেন। গোলাম মোহাম্মদ গুরুতর অসুস্থতার দরুন চিকিৎসার্থে ইউরোপে গেলে তাঁর অবর্তমানে মীর্জা সাহেব অস্থায়ী গভর্নর জেনারেলের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পর গোলাম মোহাম্মদ আর তাঁর পদ ফিরে পেলেন না। এমনকি তাঁকে চিরদিনের জন্যই রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হ’ল।
১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ থেকে নব প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রটি চালু হ’ল। ঐদিন সারাদেশে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে মহাসাড়ম্বরে উদযাপিত হ’ল।

শেরে বাংলা পূর্ব বাংলার গভর্নর
ইতিমধ্যে শেরে বাংলা পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চে ‘পাকিস্তান দিবসে’ নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে তিনি আবার আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রী পরিষদকে শপথ গ্রহণ করালেন এবং নিজে শপথ পরিচালনা করলেন। পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করায় সংখ্যালঘু
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬০

সম্প্রদায় যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে আবু হোসেন সরকারের যুক্তফ্রন্ট গঠনের আর কোন যৌক্তিকতাই থাকলো না। আওয়ামী লীগ আইন-সভার অধিবেশন আহ্বান ক’রে ক্ষমতাসীন দলের সংখাধিক্য প্রমাণের জন্য বার বার চাপ দিতে থাকলেও সরকার তা’ প্রতি বারই এড়িয়ে যেতে লাগবেন।
ইতিপূর্বে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ কথাটি বাদ দিয়ে শুধু ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করেন। ১৯৫৫ সালে অক্টোবর মাসে এ বিষয়ে তিনি একটি প্রস্তাব আনলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তা’ গৃহীত হয়। কিছু সংখ্যক সদস্য এর প্রতিবাদ করলেও ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ শ্লোগানে তাঁদের সে ক্ষীণ প্রতিবাদ চাপা পড়ে গিয়েছিল।
ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রিত্বে নিয়োগ করলেন। এখানে বলে রাখা উচিৎ যে, গোলাম মোহাম্মদ-এর আমলেই তাঁর কৃপায় চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে আসীন হয়েছিলেন।

চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্ব
পরে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি পূর্ব বাংলায় এলেন, অথচ আগে তিনি একবারও এ পথে পা বাড়ান নি। আসলে সাহসই পান নি, কেননা শেখ মুজিব ইতিমধ্যেই তার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব বাংলাকে যে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল, তার নজীর তুলে ধরে শেখ মুজিব ১৯৫৬ সালের ৪ঠা জানুয়ারী ঢাকার বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছিলেনঃ “এই সেই ব্যক্তি, যে নাকি পূর্ব বাংলাকে বিকল করে তাকে চিরকালের দাস ক’রে রাখতে চায়। এই সেই শক্তি, যে নাকি পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব বাংলার জন্যে অর্থ বরাদ্দ করতে গিয়ে চরম অবিচার করেছিল। সুতরাং অর্থনীতির দিক দিয়ে পূর্ব বাংলাকে ধ্বংস করার মূল পাণ্ডা হিসেবে আমরা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে চিরকাল স্মরণ করবো।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬১

কিন্তু নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি আর না এসে পারলেন না। এলেন, বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা করতে গেলেন; ঠাই পেলেন না কোথাও।

পূর্ব বাংলায় খাদ্য ঘাটতি ও শেখ মুজিব
কুমিল্লায় এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। উর্দুতে বক্তৃতা দিতে উঠলে জনতার মধ্য থেকে ‘বাংলায় বলুন’, ‘বাংলায় বলুন’ চিৎকার ধ্বনি উঠলো। পরিস্থিতি অনুকূল নয় দেখে ভয় পেয়ে চৌধুরী সাহেব ঐ যে পালিয়ে গেলেন আর বাংলাদেশ মুখো হন নি। প্রদেশে তখন আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিত্ব চলছে। কিন্তু সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার দরুন প্রদেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আবু হোসেনের মন্ত্রিসভা এই খাদ্য সংকটের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। বুভুক্ষু জনতা ‘এ জালিম সরকার জাহান্নামে যাক’, ‘গরীব মারা এ শাসন বরবাদ হোক’—ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে সরকারের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সরকার সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হলেন।
খবরটা জানতে পেরেই আওয়ামী লীগ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হ’ল। ১৯৫৬ সালের ১লা জুলাইয়ে এক সভায় মিলিত হয়ে প্রশাসন ব্যবস্থায় সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতির বিরোধিতা ক’রে শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত এক প্রস্তাব পাশ করা হ’ল। প্রস্তাবে বলা হলঃ “মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও তাঁর মন্ত্রিসভা, গভর্নর ও কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশের খাদ্য সংকটের মোকাবিলা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির কোন তোয়াক্কা না করে, সামরিক বাহিনীর হাতে খাদ্য ও পরিবহন দফতরের ভার তুলে দিয়েছেন, এমনকি তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাও। অতএব, আমরা দাবী জানাচ্ছি, এই অযোগ্য মন্ত্রিসভা অবিলম্বে পদত্যাগ করুক। জনসাধারণ ও আইনসভার অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট কোন নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করা হোক।”
কিন্তু এতদসত্ত্বেও গভর্নর ফজলুল হক সাহেব আবু হোসেন সরকারকে বরখাস্ত তো করলেনই না, বরং ১১ই জুলাই (১৯৫৬) খাদ্য দফতরের সম্পূর্ণ ভার সেনাবাহিনীর হাতেই দেয়া হল।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬২

ভুখা মিছিল
আওয়ামী লীগ খাদ্যের দাবীতে গণ-আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। গ্রামের ক্ষুধার্ত নিরন্নক্লিষ্ট মানুষ খাদ্যের দাবীতে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য দলে দলে শহরে এসে জমায়েত হয়। শেখ মুজিব এদেরকে নিয়ে বের করলেন এক বিরাট মিছিল। সেদিন ছিল ৪ঠা আগস্ট, ১৯৫৬ সাল। ঢাকার আশেপাশের গ্রাম থেকে নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাই ছুটে ঢাকা শহরে এসেছে। সরকার তাদেরকে শহরের বুকে আসতে অনেক বাধা দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষুধার্ত নিপীড়িত জনগণ শেখ মুজিবের আহ্বানে বাঁধভাঙা বন্যার জলের মত সব বাধাকে তুচ্ছ ক’রে ভুখা মিছিলে সামিল হয়েছে। এরপর সরকার ১৪৪ ধারা জারী ক’রে ৫ জনের বেশী মানুষের একত্রে সমাবেশ নিষিদ্ধ ক’রে দিলেন। তা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মিছিলকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ক’রে খাদ্যের দাবীতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে এগিয়ে চলে। চকবাজারে পুলিশ তাদেরকে বাধা দিল। কিন্তু বন্যার স্রোত কি বাধা মানে? অশান্ত জনতার ওপর পুলিশ ক্রুদ্ধ হয়ে লাঠি চার্জ করলো ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলো। তাতেও জনতার গতিরোধ করা সম্ভব হ’ল না—এবারে পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলী ছুঁড়তে বাধ্য হ’ল। তিনজন বুভুক্ষু গ্রামবাসীর দেহ পড়লো লুটিয়ে। প্রাণ হারালো তারা।
শেখ মুজিব এগিয়ে এসে একজনের মৃতদেহ কোলে তুলে নিয়ে শোভাযাত্রা ক’রে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পথ পরিভ্রমণ করতে থাকেন। শহীদের রক্তে তাঁর জামাকাপড় ভিজে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল।
সেদিন নেতার দু’চোখে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা লাল জিহবা বের ক’রে গ্রাস করার জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি নিজেকে সংযত রেখে বদ্ধমুষ্টি উত্তোলন ক’রে বজ্রকণ্ঠে বলে উঠেছিলেনঃ “যে সরকার নিরন্ন দেশবাসীর ওপর অত্যাচার উৎপীড়ন করে, তার দিন ঘনিয়ে এসেছে। সে আর বেশীদিন রাজত্ব করতে পারবে না।”
এই নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে সারা প্রদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। শেখ মুজিব দাবী জানালেনঃ “অবিলম্বে আইন-সভার অধিবেশন ডেকে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হোক।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৩

সরকার বাধ্য হয়ে আইন-সভার অধিবেশন ডাকলেন। এতোদিন পর্যন্ত বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেট পাশ না করিয়ে নিলে আর সরকার চালানো সম্ভব নয়।

আইন-সভার অধিবেশন
ফজলুল হক সাহেব প্রাদেশিক গভর্নর, আইনতঃ তিনি কোন রাজনৈতিক দলের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন না। কিন্তু তাঁর নিজের পার্টি K. S. P. অর্থাৎ প্রদেশের যুক্তফ্রন্টের সরকারের স্বার্থকে না দেখে থাকেন কি করে। আর সে জন্যই যখন তিনি দেখলেন যে অধিবেশন আইনসঙ্গতভাবে চললে তাঁর দলের সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠতার দরুন বাতিল হয়ে যেতে পারে, তখন তিনি কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। আইন-সভার স্পীকারকে ডেকে নির্দেশ দিলেনঃ “আপনি আইনসম্মত ছোটখাটো এক বৈঠকের আয়োজন করুন। সে বৈঠকে কোন ভোটাভুটি চলবে না। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কোন বক্তৃতাও করা চলবে না। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কোনরূপ অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে না। শুধুমাত্র বাজেট পাশ করিয়ে নেয়া হবে।”
১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে ২২শে মে আইন-সভার অধিবেশন বসলে গভর্নরের নির্দেশ মোতাবেক স্পীকার জনাব আবদুল হাকিম কোন বিরোধী দলের সদস্যকে মুখ খুলতে দেন নি। সেদিন অধিবেশন মুলতবী রাখার পর ১৩ই আগষ্ট (’৫৬) আবার সে অধিবেশন ডাকা হ’ল।
সদস্যরা হলের ভিতরে গিয়ে দেখলেন যে ট্রেজারী বেঞ্চ বা মন্ত্রীদের আসনগুলো শূন্য। অধিবেশনের শুরুতেই স্পীকার সাহেব গভর্নরের একটি নয়া আদেশ পড়ে শোনালেন। “পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত আইন-সভার অধিবেশন বন্ধ রাখা হ’ল।” স্পীকারের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই শেখ মুজিব উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ “আমরা বিরোধী দলের সদস্যরা এই অপদার্থ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনছি।”
বিরোধী দলের সকল সদস্যই একযোগে হাত তুলে তাঁর প্রস্তাব সমর্থন করলেন-মন্ত্রীদের অনুপস্থিতিতেই মোট ২৯৭ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ২০০ জন সদস্যের সমর্থনে উক্ত প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬8

কংগ্রেসী সদস্য শ্রী মনোরঞ্জন ধর (বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী) মন্ত্রীদের শূন্য আসনগুলো দেখে ব্যথিত হয়ে অধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে বললেনঃ “এই সকল আসনের মালিকেরা আজ অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকে আপনার ও মাননীয় সদস্যদের অপমান করেছেন।”
শ্রী মনোরঞ্জন ধর গভর্নরের কাজের সমালোচনা ক’রে বললেন, “গভর্নরের এই আদেশ শুধু গণতন্ত্রকে প্রতারিতই করে নি, পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে।” শ্রী ধরের এই কথা শুনে জনৈক সরকারী গুণ্ডা সদস্য বদ্ধমুষ্টি উত্তোলন ক’রে তাঁকে আক্রমণ করলেন। ফলে অধিবেশন কক্ষেই হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল।

আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন
স্পীকার অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরে বিরোধী দলের সদস্যরা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠালেন। তাতে বলা হ’লঃ “পূর্ব বাংলার ২৯৭ জন বিশিষ্ট আইন-সভার আমরা ২০০ জন সদস্য ঘোষণা করি যে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার উপর আমাদের কোন আস্থা নেই। এই মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করা হোক।” অন্য একটি প্রস্তাবে গভর্নরকে বরখাস্তের দাবী জানিয়ে প্রেসিডেন্টের নিকট তার পাঠানো হ’ল। তাতে বলা হ’লঃ “আমরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে দাবী জানাচ্ছি যে, তিনি যেন অবিলম্বে পক্ষপাত-দুষ্ট পূর্ব বাংলার গভর্নর ফজলুল হককে বরখাস্ত করেন। তিনি এখনও একটি রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি শাসনতন্ত্র অমান্য ক’রে আইন-সভার অধিবেশন স্থগিত রাখার যে আদেশ দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ বে-আইনী। তিনি তাঁর নিজের দলকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে কর্তব্যের অবহেলা করেছেন।”
এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালের ১৭ই আগস্ট এ বিষয়ে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। তাতে তিনি বলেনঃ “আবু হোসেন মন্ত্রিসভার সুনিশ্চিত পতন রোধ করার জন্য এবং আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় না বসতে পারে সে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৫

উদ্দেশ্যেই গভর্নর প্রাদেশিক আইন-সভা বসবার কয়েক ঘন্টা আগে অধিবেশন স্থগিত রাখার আদেশ জারী করেছিলেন।”
তিনি বিবৃতিতে আরো বললেনঃ “আজকের দিনে কি কেন্দ্রে, কি প্রদেশে কোন আইন-সভা ভেঙে দেবার অর্থ হল—শাসনতন্ত্রের মূল নীতির বিরুদ্ধাচরণ করা। নিজেদের ক্ষমতার আসনে চড়িয়ে রাখবার জন্যে এটা হ’ল ডিকটেটর, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষের কাজ। পাকিস্তানের জন্যে এদেশের মানুষ যত ত্যাগই স্বীকার করুক না কেন, এ দেশের মানুষ যত দুর্বল, যত সহজই হোক না কেন, গণতন্ত্র ও শাসনতন্ত্রের এ অবমাননা চিরকাল তারা সহ্য করবে না। ইতিহাসে এর বহু নজীর রয়েছে। শাসকবর্গ যদি অনিয়মতান্ত্রিক কাজ করে, তা’ হ’লে জনতাও অনিয়মতান্ত্রিক পথে চলতে বাধ্য হয় এবং সে পথেই তারা প্রতিশোধে গ্রহণের জন্যে চেষ্টা করে। শাসকবর্গ যদি স্বেচ্ছাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেন, তা’ হ’লে জনসাধারণও প্রশ্রয় দেবে আইন অমান্যের মত স্বেচ্ছামূলক বেপরোয়া কাজকে। এই রকম অবস্থা যদি চলে তা’ হ’লে পাকিস্তানের অস্তিত্বই শেষকালে বিপন্ন হয়ে পড়বে। অতএব, পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে এই দুই সর্বনাশী পথকে পরিহার ক’রে চলতে হবে।” শহীদ সাহেবের বিবৃতি শুনে প্রেসিডেন্ট মীর্জার টনক নড়লো। তিনি গভর্নর ফজলুল হক গংসহ আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে করাচীতে ডেকে পাঠালেন। প্রেসিডেন্ট যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভাকে আদেশ দিলেন ১৯৫৬ সালের ৩০শে আগস্ট তারিখে আইন-সভার অধিবেশন ডেকে মন্ত্রিসভাকে বিরোধী দলের অনাস্থা প্রস্তাবের মোকাবিলা করতে। গভর্নর ফজলুল হক অবশ্য বিষয়টি ধামাচাপা দেবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেন নি।

আবু হোসেন সরকারের পদত্যাগঃ আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠন
ব্যাপার সুবিধাজনক নয় দেখে যুক্তফ্রন্টের অনেক সদস্য আওয়ামী লীগে যোগ দিতে লাগলেন। ফলে বাধ্য হয়ে আবু হোসেন সরকার ১৯৫৫ সালের ৩০শে অক্টোবরে গভর্নরের কাছে তাঁর মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র পেশ করলেন। ফজলুল হক পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন এবং ৪ঠা সেপ্টেম্বর (’৫৬) আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক নেতা জনাব আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি দিলেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৬

আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেন। নানান কুৎসা রটিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা চালালেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অন্যতম নেতা পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা ‘পাকিস্তান অবজারভার’ এ কুৎসা প্রচারের বাহন হ’ল। তাতে অভিযোগ করা হ’লঃ “পাকিস্তান থেকে ভারতে অর্থ ও অস্থাবর সম্পত্তি যথেচ্ছ ও অব্যাহতভাবে পাচার করার অধিকারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছেন।”
এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগকে সমর্থন ক’রে যাচ্ছিলেন প্রাদেশিক আইন-সভার কংগ্রেসের ২৯ জন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্লামেন্টারী পার্টির ৭ জন, রসরাজ মণ্ডল ও গৌরচন্দ্র বালার তফসিলী ফেডারেশনের ১২ জন সদস্য। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই সমর্থনের দরুনই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐরূপ উদ্ভট অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার বুদ্ধিজীবী ও জনগণ তাঁদের সে প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয় নি।
আতাউর রহমান খানের কাছে যেদিন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমন্ত্রণ লিপি পাঠানো হ’ল, সেদিন ঘটল এক দুঃখজনক ঘটনা। খাদ্যের দাবীতে মিছিল আর বিক্ষোভ ক্রমাগত চলে আসছিল। ঢাকার জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারী করলেন তার প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। কিন্তু অনমনীয় বুভুক্ষুরা তা’ মানলো না। ফলে তাদের উপর চালানো হ’ল লাঠি, নিক্ষেপ করা হ’ল কাঁদুনে গ্যাস। শেষ পর্যন্ত চালানো হ’ল গুলী। ৪জন প্রাণ হারালো, শত শত আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হ’ল। বিপদ দেখে ফজলুল হক সাহেব প্রেসিডেন্টের নিকট তারবার্তা পাঠালেন। পরে ১৪8 ধারা তুলে নেয়া হলে অবস্থা কিছুটা শান্ত হয়।

শোক মিছিল
পরদিন ঢাকায় মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক বিরাট শোকমিছিল বেরুলো। ঐ সময় কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফকে রাস্তার মধ্যে পেয়ে উত্তেজিত জনতা তাঁকে মোটর গাড়ী থেকে টেনে বের করে মুখে গোবর মাখিয়ে দিল।

আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ ও নয়া মন্ত্রিসভা গঠন
যথাবিধি ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর জনাব আতাউর রহমান খান
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৭

পূর্ব বাংলার নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গভর্নর জনাব ফজলুল হকের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত যে, দলের অভ্যন্তরে শেখ মুজিবের প্রভাব সবচেয়ে বেশী থাকলেও প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে জনাব আতাউর রহমান খানের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত ক’রে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে।

শেখ মুজিবের পুনরায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ
অবশ্য এতে মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হিসেবে শেখ মুজিবকেও শিল্প-বাণিজ্য-শ্ৰম-দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দফতরের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। তাঁর সাথে অন্যান্য দের মধ্যে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, মাহমুদ আলী ও কফিল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের শেষে সিলেটের প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা শ্রীবসন্তকুমার দাস সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, আজকের দিনটি পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কেননা, এই প্রথম একটি প্রকৃত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করলো।

মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব
শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব পেয়ে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি দক্ষতার সাথে তার কর্তব্য পালন ক’রে যেতে থাকেন। এতদিন ধরে পূর্ব বাংলার ওপর যে অসমতাপূর্ণ ব্যবহার করা হয়ে আসছিল, তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তার মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হলেন। পূর্ব পাকিস্তানী আমদানী ও রফতানীকারীদের সুযোগ-সুবিধার জন্য সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানে রিজিওন্যাল কন্ট্রোলার অব এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের দফতর স্থাপন ক’রে বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে তিনি অন্তরিকতার সাথে অগ্রসর হন।
শাসন-ব্যবস্থার অরাজকতার সুযোগ নিয়ে সমগ্র দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি দমন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হয়েই শেখ মুজিব দেশকে দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনা প্রাদেশিক পরিষদেও গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেন্দ্রীয় সরকার তা’ অনুমোদন করেন নি। তবুও এতে বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহ হলেন না শেখ মুজিব। তিনি দুর্নীতি দমন বিভাগ খুলে সরকারী ও বেসরকারী
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৮

সদস্যগণের সমন্বয়ে দুর্নীতি দমন সংস্থার মাধ্যমে তাঁর কার্যক্রম নির্দেশ করেন। কিন্তু এই কার্যক্রমও সফল হতে পারলো না। কারণ দেশ তখন আমলাতান্ত্রিক নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী। আমলারা নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী এ ধরনের পরিকল্পনাকে সবদিক থেকে বানচাল করবার ষড়যন্ত্রে সাফল্য অর্জন করলেন। কারা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যেরই ছিল। তাই বন্দীজীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সরকার প্রদেশের সমস্ত রাজবন্দীকে মুক্তি দেন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রীরা রাজবন্দীদের স্বয়ং অভ্যর্থনা জানান। পার্টির সম্পাদক ও মন্ত্রিসভার অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য হিসেবে শেখ মুজিবের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।

শেখ মুজিবের চীন ও রাশিয়া সফর
পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল দ্ব্যর্থহীন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তীকাল পাকিস্তান বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ একদেশদর্শী ছিল। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সম্পর্কে পাকিস্তান বৈরীমূলক মনোভাব পোষণ করতো। ১৯৪৮-৪৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খানকে তাঁদের দেশ সফরে আমন্ত্রণ জানালেও খান সাহেব সেখানে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সফর ক’রে পশ্চিমা চক্রের সঙ্গে পাকিস্তানের ভাগ্যকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবার পর ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে এগারজন প্রতিনিধি নিয়ে শেখ মুজিব নয়চীনে গেলেন এক শুভেচ্ছা সফরে। পাকিস্তানের সাথে মহাচীনের বন্ধুত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের হাতেই।
পরে শেখ মুজিব আবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে চীন ভ্রমণ করেন এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী মিঃ চৌ-এন-লাইকে দাওয়াত করে পাকিস্তানে এনে উভয় দেশের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের পথ পরিষ্কার করতে প্রয়াস পান। এর কিছুদিন পর ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ দূত হিসেবে শেখ মুজিব রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশে শুভেচ্ছা সফরে যান। আওয়ামী লীগ যখন প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন তখন ইস্কান্দার মীর্জা ঢাকায় ছিলেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৬৯

সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্ব
এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করায় তাঁর পদ-গৌরব থেকে বঞ্চিত হন। ইস্কান্দার মীর্জা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে করাচীতে উড়ে গেলেন এবং শহীদ সাহেব বহু প্রতীক্ষার পর ১৯৫৬ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে তাঁর ঈপ্সিত পদে আসীন হলেন।

পল্টন ময়দানে জনসভা
প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার দু’দিন পর অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এলেন। সেই দিনই ঢাকার পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এক জনসভা হ’ল এবং প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং।
সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী সাহেব সরকারকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে, যদি পনেরো দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলায় প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য না পাঠান, তা’ হ’লে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে হবে। তিনি আরও বললেনঃ “মন্ত্রিত্বের লোভে আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া চলবে না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা যেন ভুলে না যান যে, দেশে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসন, পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, পশ্চিমী যুদ্ধজোট বর্জন প্রভৃতি ব্যাপারে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আওয়ামী লীগকে এ প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে।”

সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর বিরোধ
শহীদ সাহেব ভাসানীর এমনতর বক্তৃতায় বেশ কিছুটা বিরক্তই হয়েছিলেন। কিন্তু সব বিরক্তি দমন ক’রে ধীরস্থির কণ্ঠে তিনি বললেনঃ “মওলানা সাহেবের কথায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমি তো আর বসে নেই। রাতদিন কাজ করে চলেছি। পূর্ব বাংলার জন্য খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি। এমন কি ত্রিশ হাজার টন চাল সাহায্যের জন্য শ্রী নেহেরুকেও লিখেছি। মওলানা ভাসানী পদত্যাগের কথা বলেছেন। আমিও চাই না যে, কাজ না করে কেবল গদি আঁকড়ে থাকি। আমিও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি-১৫ দিনের মধ্যে যদি ১৭ হাজার মণ চাল পূর্ব বাংলায় পাঠাতে না পারি, তা’ হলে’ নিশ্চয়ই আমি পদত্যাগ করবো।”
সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭০

অন্তর্বিরোধ দেখা দিল। মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সভা-সমিতিতে শহীদ সাহেবের কঠোর সমালোচনা করতে লাগলেন। বিশেষতঃ পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে তাঁদের এ বিরোধ বেধে যায়। ভাসানী পাক-মার্কিন যুদ্ধজোটের বিরোধী। তাই আমেরিকার আওতা থেকে পাকিস্তানকে সরিয়ে আনার জন্য তিনি সোহরাওয়ার্দীকে বারবার চাপ দিতে থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থার কথা চিন্তা ক’রে শহীদ সাহেব এ ব্যাপারে সহসা এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত ছিলেন না, যা বৈদেশিক নীতিতে হঠাৎ শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে। বরং ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঢাকায় এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে এ সম্পর্কে শহীদ সাহেব বললেনঃ “সামরিক চুক্তির যারা বিরোধিতা করছে তারা যে শত্রু পক্ষের এজেন্ট তা প্রমাণ করবার মত কাগজপত্র আমার রয়েছে।”
একথা শুনে ভাসানী তাঁর চিরাচরিত স্বভাবেই ক্রদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি শহীদ সাহেবকে চ্যালেঞ্জ করলেনঃ “জনাব সোহরাওয়ার্দী আপনার গোপন কাগজপত্র আপনি জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করুন। আমরা শত্রুপক্ষের পয়সায় কেনা এজেন্ট বলে যদি প্রমাণ করতে পারেন তা’ হ’লে প্রকাশ্য আদালতে আমাদের বিচার করুন।”
ঠিক এ সময় পূর্ব বাংলা থেকে একদল বাণিজ্য প্রতিনিধি গেলেন ভারতে। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, প্রাদেশিক শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদ।
আবুল মনসুর আহমদ প্রথমে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী হলেও পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁকে কেন্দ্রে টেনে নেন। কেন্দ্রে তিনি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
প্রতিনিধিরা ভারতে গিয়েছিলেন উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার জন্য। প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আবুল মনসুর আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওয়াহেরলাল নেহেরুকে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ এক বোতল সুন্দরবনের মধু উপহার দিলেন। এ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মুসলিম লীগের নেতারা মওকা পেয়ে গেল। তারা হৈচৈ শুরু করে দিল। তাদের মুখপত্র করাচীর ‘ডন’ পত্রিকায়
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭১

ভারতের সাথে মধুর মাধ্যমে মধুর সম্পর্ক স্থাপনের নিন্দা ক’রে প্রতিনিধিদের কঠোর শাস্তির দাবী জানাল।

মওলানা ভাসানীর হুমকি
মওলানা ভাসানী চারিত্রিক দিক থেকে যে একজন মওলানা, সে কথা বারবার তাঁর উক্তি প্রত্যুক্তিতে প্রতিপন্ন হয়েছে। জনগণকে উত্তেজিত করবার সুযোগ তিনি কোন দিনই ব্যর্থ হতে দেন নি। সুতরাং সময় বুঝে মওলানা ভাসানী দেশের মধ্যে বেশ গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে এই সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করতে শুরু করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জনসভায় বলতে লাগলেন, “হয় একুশ-দফা পালন কর, নয়তো গদি ছেড়ে দাও।”
শহীদ সাহেব এতে বিরক্ত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্ষীয়ান এই গণনেতার জনপ্রিয়তাকে তিনি একেবারে উপেক্ষা করতে পারলেন না। দিনের পর দিন মওলানা সাহেবও শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেন। তিনি ১৯৫৭ সালের ৩রা জানুয়ারী এক বিবৃতিতে বললেনঃ “আমি আওয়ামী লীগ সরকারের বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বহু লোকের কাছ থেকে রোজই চিঠিপত্র পাচ্ছি। এ ছাড়াও যে সব প্রশ্ন দলের সভাপতি হিসেবে আমার কাছে পূর্ব বঙ্গের অসংখ্য মানুষ তুলছেন,তা’ হ’লঃ
(ক) আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায় করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
(খ) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীতে প্রতি একশ’ জনের মধ্যে মাত্র চারজন বাঙালী কেন?
(গ) পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদেরই নিযুক্ত করা হচ্ছে কেন?
(ঘ) কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের, তারা বাঙালীই হোন আর পশ্চিম পাকিস্তানীই হোন, প্রাইভেট সেক্রেটারীরা সবাই অবাঙালী কেন? এ ব্যবস্থা কি বাঙালী মন্ত্রীদের কার্যকলাপের উপর নজর রাখার জন্য?”
ভাসানী শেষবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মোকাবিলা করার উদ্দশ্যে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের কাগমারীতে এক সম্মেলন আহবান করলেন। ১৯৫৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭২

সন্তোষের মহারাজার প্রাচীন রাজপ্রাসাদের নাটমন্দিরে আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সদস্যদের বৈঠক বসলো।

কাগমারীর সম্মেলন
৮৯৬ জন কাউন্সিল সদস্য সেদিন উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। উক্ত সভায় মওলানা ভাসানী শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। সেদিন ভাসানী সাহেব যুদ্ধজোটের বিরোধিতা ক’রে বলেছিলেনঃ “আমি আমার জান দিয়ে যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করবো। কেউ যদি আমাকে দিয়ে জোর ক’রে এই চুক্তি মানিয়ে নিতে চান, তবে আমি কবর থেকেও চেঁচিয়ে বলে উঠবো, না-না-না- ওই সর্বনেশে যুদ্ধজোটের পথে আমি নেই।”
কাগমারী সম্মেলনের মত এরূপ ঐতিহাসিক সম্মেলন আর হয় নি। টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত সুদীর্ঘ রাস্তায় তৈরী করা হয়েছিল অনেক গুলো তোরণ। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ লোকদের নামানুসারে উক্ত তোরণগুলোর নাম রাখা হয়েছিল। লেনিন, শেক্সপিয়র, আব্রাহাম লিঙ্কন, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। কাগমারী সম্মেলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন এবং কৌশলে নিজের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণ দান কালে আওয়ামী লীগের সমবেত প্রতিনিধিদের উদ্দেশ ক’রে। বলেছিলেনঃ
“আপনারা যারা দলের মেরুদণ্ড, গরীবের রক্ত জল ক’রে যারা দল গড়েছেন তাঁরা বড়, না বড় এই ভদ্রলোকটি? আপনারাই শহীদকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করেছেন—তাই তিনি আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আপনারা তাঁর পিছন থেকে সরে গেলে এ ভদ্রলোকটিকেও সরে যেতে হবে। তাই আপনাদের নির্দেশ পাটি সদস্য হিসেবে এঁকে মানতেই হবে।”
বক্তৃতা চলাকালীন তিনি আরো বলেছিলেনঃ “পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করে ১৯৫৩ সালে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তারপর প্রতি বছর প্রতি অধিবেশনে সে প্রস্তাবের প্রতি জানিয়েছে গভীর আস্থা। আওয়ামী লীগ আজ তাই সে প্রস্তাব থেকে সরে দাঁড়াতে পারে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের যে তেরো জন সদস্য আছেন,
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৩
তাঁদের দলের ঘোষিত নীতি মেনে চলতেই হবে। এজন্য তাঁদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে যদি পদত্যাগ করতে হয়, তাঁরা বিনাদ্বিধায় তা’ করুন।”
জনাব সোহরাওয়ার্দীর প্রতি লক্ষ্য করে ভাসানী সাহেব বলেছিলেনঃ “এই ভদ্রলোক প্রচার করছেন যে, তাঁর হাতে পড়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি নাকি অনেকখানি সফল হয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্নটিকে তিনি নাকি আবার তাজা করে তুলেছেন। কথার উপর ট্যাক্স নেই। অনেক লোক অনেক কথা বলতে পারেন, তার জন্যে ট্যাক্সের কড়ি লাগে না। এই ভদ্রলোকও তেমনি বাক্যব্যয় করছেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ শক্তিগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আফ্রো-এশিয়ান জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস হারানোর নাম কি পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য? নিজের ভাবনা, নিজের চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে পরের ডিকটেশনে চলার নাম কি প্রগতি? এই ভদ্রলোক কি নিজের বুকে হাত দিয়ে সে কথা বলতে পারেন?
ভদ্রলোক বলছেন, কাশ্মীর প্রশ্নটিকে তিনি আবার জাগিয়ে তুলেছেন। তার উত্তরে আমি যদি বলি যে এদেশের একশ্রেণীর রাজনৈতিকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাশ্মীর সমস্যার নাম ক’রে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছেন। তবে আমার পাশে বসা আপনাদের প্রধানমন্ত্রী তার কি জবাব দিবেন? সে জবাব তাঁর কাছ থেকে আপনারা দাবী করুন।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেদিন ভাসানী সাহেবকে জব্দ করার জন্য একটি চিরকুট আর একটি টেলিগ্রাম নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাসানীর বিরুদ্ধে এ দুটো অস্ত্র তৈরী করেছিল পাকিস্তানী গুপ্তচর বিভাগ। শহীদ সাহেব স্পষ্ট উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এ দিয়ে ভাসানী সাহেবকে কাবু করা যাবে না। তাই ভাসানী সাহেবকে তিনি আর বিপর্যয়ের দিকে না নিয়ে ঘোষণা করলেন, “প্রয়োজন হলে পদত্যাগ করব।” কিন্তু সাথে সাথে একথাও তিনি ঘোষণা করলেন যে, পূর্ব বাংলার স্বার্থে আজ আমাদের সমগ্র পথ নির্ণয় করতে হবে। শহীদ সাহেবের নিকটেই বসা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শহীদ সাহেবের উপরিউক্ত উক্তির পর উঠে বললেন, “স্যার, আপনাকে আমরা ছাড়বো না, ছাড়তে পারি না। বাংলাদেশের স্বার্থেই আপনার কেন্দ্রে থাকবার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭8

কাগমারী সম্মেলন ভাসানী সাহেবের পক্ষেই গিয়েছিল। কিন্তু ভাসানী সাহেব যা’ চেয়েছিলেন তা’ তিনি করতে সক্ষম হন নি। কেননা তরুণ নেতা শেখ মুজিবুরের ব্যক্তিত্ব সকল নেতৃত্বকে আচ্ছন্ন ক’রে দিয়েছিল। যদিও সম্মেলন ডেকেছিলেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু উদীয়মান নেতা শেখ মুজিব এই সম্মেলনের মাধ্যমে এক অনন্য ব্যক্তি-পুরুষ হিসেবে বেরিয়ে এলেন। এ কারণেই এ সম্মেলনের কিছুদিন পর ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ ক’রে অন্য দল গঠন করলেও আওয়ামী লীগ তাতে শক্তি হারায় নি, বরঞ্চ নতুন শক্তি লাভ করেছে। কাগমারী সম্মেলন শেষ হলে শহীদ সাহেব ঢাকা হয়ে করাচীতে ফিরে গেলেন। পরদিন সকালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সময় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বললেন, “শতকরা ৯৮ জন সদস্যই আমাদের সরকারের বৈদেশিক নীতি অনুমোদন করেছে।” এছাড়াও তিনি দাবী করলেন যে, তাঁর দলের সদস্যরা তাঁর প্রতি আস্থাবান এবং বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে কাউন্সিলে প্রস্তাব উঠলেও তিনি তাতে শঙ্কিত হন নি। তিনি আরও দাবী করলেনঃ “আমি প্রধানমন্ত্রী হবার পর পূর্ব বাংলাকে ইতিমধ্যেই ৯০ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে।”

কাগমারী সম্মেলনের পর
মওলানা ভাসানী দু’দিনব্যাপী সম্মেলনের পর অবস্থার ব্যাখ্যা ক’রে সাংবাদিকদেরকে বললেনঃ “১৯৫৬ সালের মে মাসের সিদ্ধান্ত বাতিল ক’রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পার্টি কাউন্সিল আমাকে ক্ষমতা প্রদান করেছে যে, যে কোন সদস্য, মন্ত্রী, এম. পি. এ., অথবা এম. এন. এ. যাই হোন না কেন, তিনি যদি পার্টির সিদ্ধান্ত অমান্য করেন তবে আমি যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।” সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এ সময়টা ভাসানীর পক্ষে খুবই সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠে। কাগমারী সম্মেলনে তিনি ভারতীয় কবি-সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ এবং কিছু কিছু স্তম্ভ ভারতীয় নেতাদের নামে নামকরণ করেছিলেন, ফলে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁর বিরুদ্ধে ভারতের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনে। তিনি এতে অতিষ্ঠ এবং বিব্রত হয়ে ওঠেন। ভাসানী চুপ করে থাকলেন না। তিনি বললেন যে, “নিপীড়িত জনগণের দাবী আদায়ের সংগ্রাম যদি
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৫
ষড়যন্ত্র হয়, তবে কাগমারী সম্মেলনে তো প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও প্রাদেশিক মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সেখানেই একথা উত্থাপন করেন নি কেন? আর ষড়যন্ত্রের কথা যদি জানতেনই তবে কেন তাঁরা সম্মেলনে হাজির হলেন?”
বলাই বাহুল্য, ভাসানী মন্ত্রীদের প্রতি এরূপ কটাক্ষ করলেও কোন মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ নেতা তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন নি।
কাগমারী সম্মেলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে তখন আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিঃ হারেস এ. হিলড্রেথ ১৮ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, সিয়াটো চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা, কোন সদস্য-রাষ্ট্র—সে পাকিস্তান হ’লেও কমুনিস্ট আক্রমণ ছাড়া অন্য কোন আক্রমণে সাহায্য করতে বাধ্য নয়। যা হোক, ভাসানীর তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও যথাসময়ে জাতীয় পরিষদে সোহরাওয়ার্দী তাঁর বৈদেশিক নীতি অনুমোদন ক’রে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শহীদ সাহেবের প্রতি শেখ মুজিবের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তিনি পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকেন। আতাউর রহমান খানও উক্ত নীতির প্রশ্নে ভোটদান থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু করাচী থেকে ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের কাছে তিনি শহীদ সাহেবের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।
মাস দু’য়েক পরে ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল শেখ মুজিবের সাথে আলোচনাক্রমে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রাদেশিক আইনসভায় এক প্রস্তাব আনলেন। তাতে প্রাদেশিক সরকারকে বলা হ’ল যে, তাঁরা যেন একমাত্র অর্থ, বৈদেশিক দফতর ও প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা বাদে আর সব বিষয়ে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিরোধী দলের নেতা আবু হোসেন সরকারসহ অনেকেই এ প্রস্তাব সমর্থন করলে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হ’ল। এই প্রস্তাবটি যাতে গৃহীত হয় তার জন্য শেখ মুজিব অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন এবং প্রস্তাবটি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উত্থাপন করলেও শেখ মুজিবের দানই ছিল সবচেয়ে বেশী।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৬

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। মুসলিম লীগের সংবাদপত্রগুলো কড়া ভাষায় এর বিরোধিতা করতে লাগলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পশ্চিম পাকিস্তানী মীর গোলাম আলী খান তালপুর হুমকি দিয়ে বললেনঃ “পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের লেজুড় বানানোর যে-কোন প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীয় সরকার তার লৌহ মুষ্ঠির আঘাতে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে।”
কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী পূর্ব বাংলার এম. এ. খালেক তালপুরের বিবৃতির তীব্র সমালোচনা করে’ বললেন যে, পূর্ব বাংলার পাঁচ কোটি মানুষের প্রতিনিধিদের সর্বসম্মত প্রস্তাবের প্রতি হস্তক্ষেপ করার অধিকার তালপুর সাহেবের নেই। শেখ মুজিবও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে হুশিয়ার করে দিয়ে বললেনঃ “বাঙালীদের ব্যাপারে মাথা গলাতে আসবেন না। বাঙালীরী জানে কিভাবে অধিকার আদায় করতে হয়। আপনাদের কামান-বন্দুকের পরোয়া তারা করে না।” কিন্তু আশ্চর্যের কথা সোহরাওয়ার্দী সাহেব পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের এই প্রস্তাবকে সেদিন খুব সুনজরে দেখতে পারেন নি। পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়ে এবং আইয়ুব খানের হাতে শিকারে পরিণত হয়ে তিনি অবশ্য তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর সম্পর্ক এমন একটি পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, মওলানা সাহেব আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ভাসানী-চরিত্রে একই আদর্শে চিরদিন অবিচলিত নিষ্ঠায় থাকা এবং একই প্রতিষ্ঠানে বিশ্বস্ত হওয়া লিখিত নেই। সুতরাং এ ঘটনা বিচিত্র কিছু নয়। যা হোক, দল থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ভাসানী এক পত্র লিখলেনঃ “কেন্দ্র ও পূর্ববঙ্গে সমতার আসনে বসে আওয়ামী লীগের নায়কগণ, বিশেষ ক’রে জনাব সোহরাওয়ার্দী দলের আদর্শ ও একুশ-দফা ক্রমাগতই লংঘন ক’রে চলেছেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী দলের মূলনীতির প্রতি ও বহু প্রস্তাবের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দেশকে ধীরে ধীরে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির জোয়ালের সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছেন। কাজেই আমি আর এ দলের সভাপতি পদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে চাই না।” আগামী ২৫শে জুলাই থেকে আমি এ দলের সদস্যও থাকতে চাই না।”
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৭

ভাসানীর পদত্যাগ ও নয়া দল গঠন
অবশ্য এই পদত্যাগ ও দলত্যাগের পশ্চাতে রহস্য ছিল অন্যরূপ। এ সম্পর্কে জনাব আবুল মনসুর আহমদ অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ “আগেই তিনি মিয়া ইফতিখার উদ্দিন ও জি. এম. সৈয়দ প্রভৃতি বামপন্থী পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ ও শহীদ সাহেব কর্তৃক বিতাড়িত সাবেক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী জনাব মাহমুদুল হক ওসমানীর সাথে গোপন পরামর্শ করিতে থাকেন … ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা বন্ধ দরজায় মওলানা ভাসানীর সাথে পরামর্শ করিয়া গিয়াছেন। এটা চলে পর পর কয়েকদিন। তবুও কাউন্সিল মওলানাকে ইস্তাফা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। মওলানা তদুত্তরে ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপ গঠনে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার হাত ছিল এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।”
[আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরঃ আবুল মনসুর আহমদ, পৃঃ ৪৯২]
মনসুর সাহেবের সন্দেহ অমূলক ছিল না। সোহরাওয়ার্দী ক্ষমতায় যাবার পর প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ইচ্ছামত শাসনকার্য চালাতেন। এতে পশ্চিমাগোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলেন না। আবার তাঁদেরকে ক্ষমতা না দিলেও নির্বিঘ্নে পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা স্পষ্টতঃ উপলদ্ধি করতে পারলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি না করতে পারলে তাঁদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে না। আর সে জন্যই সোহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতা দানের মাধ্যমে অথবা তোষামোদ ক’রে পূর্ব বাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে সচেতন রাখতে চেষ্টা করা হয় আর যাতে ক’রে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানো যায় সেই চেষ্টা পুরোপুরি চলতে থাকে। অবশ্য সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁদের সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে এসব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
ওদিকে ভাসানীকেও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করা হয় এবং তা’ যে সফল হয় তাতে সন্দেহ নেই। ভাসানী স্বভাবে আবেগপ্রবণ, অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। ধীরস্থিরভাবে কোন কিছু বিচার করবার মত মানসিকতা তাঁর নেই। আর তাই পশ্চিমাগোষ্ঠীর উস্কানীতে ভাসানী সাহেব অতি সহজেই সোহরাওয়ার্দীর ওপরে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। আর সেই বিতৃষ্ণা নিয়েই তিনি নিজেই গঠন করলেন একটি রাজনৈতিক দল। জন্ম
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৮

হ’ল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’। ১৯৫৭ সালের ২৫শে জুলাই ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত একটি সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে পাকিস্তান গণতন্ত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ল। এর আগে ১৭ই জুলাই এক বিবৃতিতে তিনি এ সম্মেলন আহ্বান করেন। তাঁর এ আহ্বানে যোগ দিয়েছিলেন (আবুল মনসুর সাহেবের মতে আগে থেকেই এ বিষয়ে কথাবার্তা ছিল) সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান, খান আবদুস সামাদ খান, জনাব জি.এম. সৈয়দ, জনাব আবদুল মজিদ সিন্ধি, আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলী প্রমুখ বিশিষ্ট নেতৃবর্গ। সম্মেলনে প্রায় ১২০০ কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। জন্ম হ’ল এক নতুন সংগঠন নাম ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি’। সংক্ষেপে ন্যাপ। মওলানা ভাসানী হলেন ঐ সংগঠনের অন্যতম শক্তিশালী কর্ণধার।
ইতিমধ্যে শেখ মুজিব পার্টির ওয়াকিং কমিটির ইচ্ছানুসারে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি উপলদ্ধি করছিলেন যে, জনতাকে যদি সংঘবদ্ধ করতে হয় তবে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তাঁকে পার্টিতে ফিরে যেতে হবে। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণও উপলদ্ধি করলেন যে ভাসানীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ক’রে আওয়ামী লীগকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে হয় তবে শেখ মুজিব ছাড়া গত্যন্তর নেই। শেখ মুজিবের সাংগঠনিক শক্তি অপরিসীম। সুতরাং মন্ত্রিত্বের আসনের চেয়ে শেখ মুজিব জনগণের মিছিলে সামিল হওয়াটাকেই অধিকতর শ্রেয়ঃ বলে মনে করলেন। একথাও তিনি উপলদ্ধি করলেন যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলে জনগণের কাছ থেকে তিনি অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। আর সেই বেদনাবোধ তাঁকে অহরহ পীড়া দিত। তাই তিনি আবার নেমে এলেন পথে। শেখ মুজিব কাজ শুরু করার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নতুন শক্তি ফিরে পেল- দিন দিন এই প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো অপূর্ব গতিতে। বর্ষীয়ান নেতা ভাসানী, আতাউর রহমান সবাই সরে যেতে লাগলেন পর্দার অন্তরালে আর জনতার পর্দায় এগিয়ে আসতে লাগলো একটি ব্যক্তিত্ব—শেখ মুজিব। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের জন্য দাবী উঠতে শুরু ক’রে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট মীর্জা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দানের চেয়ে একনায়কতন্ত্র শাসন চাপিয়ে দেয়ারই পক্ষপাতী। এই উদ্দেশ্যে ১৯৫৭
পৃষ্ঠা নংঃ ১৭৯

সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে তিনি এক ঘোষণায় বললেন—ব্রিটিশ পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার অনুকরণে পাকিস্তানে যে শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, পাকিস্তানীরা তাতে অনভ্যস্ত এবং অনুপযুক্ত। কাজেই এ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে মন্ত্রীদের ক্ষমতার বিলোপ সাধন ক’রে কেন্দ্রে রাষ্ট্রপ্রধান শাসন-ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

সোহরাওয়ার্দীর পদত্যাগ
প্রেসিডেন্টের এরূপ মন্তব্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে চিন্তিত করলো। কেননা, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে মীর্জাকে সরিয়ে তাঁর প্রিয়পাত্র গুরমানীকে প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর জন্য গোপনে কাজ ক’রে যাচ্ছিলেন। এতে ক’রে তিনি নিশ্চিতভাবে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারবেন বলে মনে করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি মীর্জা সাহেবের দল রিপাবলিকান পার্টির নেতৃবর্গের সঙ্গেও গোপনে আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সব ভরসাই নির্মূল হয়ে গেল। মীর্জা সাহেব সোহরাওয়ার্দীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি শহীদ সাহেবকে গদিতে রাখা আর সমীচীন মনে করলেন না। ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর দীর্ঘ ১৩ মাস প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে আসীন থেকে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। শেখ মুজিব তখন পাকিস্তান প্রতিনিধিদের সাথে রাশিয়ার পথে ক্যানাডায় ছিলেন। তিনি সোহরাওয়ার্দীর তারবার্তা পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। অবশেষে পাকিস্তানের যষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হলেন মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা—জনাব আই. আই. চুন্দ্রীগড়। কিন্তু চুন্দ্রীগড়ের ভাগ্যেও বেশীদিন প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকলো না। প্রেসিডেন্ট মীর্জা তাঁর জায়গায় এনে বসালেন মালিক ফিরোজ খান নুনকে।

আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বাতিল ও আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতেও একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটতে লাগলো। ১৯৫৮ সালের ৩১শে মার্চ প্রাদেশিক গভর্নর ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত ক’রে তাঁর দলকেই আবার ক্ষমতায় বসালেন। এবারেও মুখ্যমন্ত্রী হলেন আবু হোসেন সরকার। আওয়ামী লীগকে পদচ্যুত করায় সোহরাওয়ার্দী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। সেদিন রাতেই তিনি কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুনকে টেলিফোনে ভয় দেখালেন যে, যদি আধ ঘন্টার মধ্যে গভর্নর
পৃষ্ঠা নংঃ ১৮০

ফজলুল হক ও আবু হোসেনের মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত না করা হয় তা’ হ’লে তিনি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সদস্যদেরকে ফিরোজ খান নুন-এর মন্ত্রিসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেবেন।

শেরে বাংলা অপসারিত ও আবু হোসেন সরকারের বিদায়
নুন সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন। মন্ত্রিত্ব হারাবার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় মাত্র ৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি ফজলুল হককে বরখাস্ত ক’রে পূর্ব বাংলার চীফ সেক্রেটারী জনাব হামিদ আলীকে প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত করলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হামিদ আলী পরদিনই অর্থাৎ ১লা এপ্রিল (’৫৮) মুখ্যমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকারকে বরখাস্ত করলেন। মাত্র ১২ ঘন্টা অন্ধকারে (শুধু ৩১শে মার্চ রাত্রিবেলা) রাজ্য শাসন ক’রে আবু হোসেনের বিদায় নিতে হ’ল।

পুনরায় আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা গঠন
আবার আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য গভর্নর আহ্বান জানালেন। ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রদেশে তাঁদের ক্ষমতা ফিরে পেলেন।

আতাউর রহমান খানের পতন ও আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন
কিন্তু ১৮ই জুন আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা আবার সংকটের সম্মুখীন হ’ল। ইস্কান্দার মীর্জা গোপনে গোপনে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই ষড়যন্ত্র সফল হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ১৮ই জুন প্রাদেশিক আইন-সভায় অতর্কিতভাবে একটি প্রস্তাব ভোটে অসমর্থিত হয়। পরদিন অর্থাৎ ১৯শে জুন আইন-সভায় একটি cutmotion-এ হেরে যাওয়ার ফলে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। ইতিমধ্যে হামিদ আলীর স্থলে জনাব সুলতানউদ্দিন আহমদ পূর্ব বাংলার স্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পতন হওয়ায় তিনি আবু হোসেন সরকারকে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানালেন। ২০শে জুন(’৫৮) জনাব সরকার রাজশাহীর প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী ও সিলেটের জনাব আবদুল হামিদসহ গভর্নর সুলতান আহমদের নিকট শপথ গ্রহণ করলেন। এই নিয়ে আবু হোসেন সরকার তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
পৃষ্ঠা নংঃ ১৮১

আবুল হোসেন সরকারের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন ও তাঁর পতন
কিন্তু সরকারের দুর্ভাগ্য, শেষের বারেও তিনি তিনদিনের বেশী মন্ত্রিত্ব করতে পারলেন না। ২২শে জুন (’৫৮) শেখ মুজিব আইন-সভায় আবু হোসেনের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। প্রস্তাবটি বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ১৫৬—১৪২ ভোটে পাশ হ’ল।
এ সময় সরকার দলীয় সদস্যরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। পরদিন ২৩শে জুন বাধ্য হয়ে আবু হোসেন গভর্নরের কাছে পদত্যাগ পত্র পেশ করলেন।

পূর্ব বাংলায় প্রেসিডেন্ট শাসন জারী
প্রদেশের এই বিশৃঙখলার সুযোগ নিতে কসুর করলেন না ইস্কান্দার মীর্জা। দেশে ডিকটেটারশিপ চালু করে মহাপরাক্রমশালী দেশনায়ক হয় আজীবন রাজত্ব করবার খায়েশ তিনি বহুদিন থেকে মনে মনে পোষণ করছিলেন। পূর্ব বাংলার আইনসভা সাময়িকভাবে বাতিল করে দিয়ে চালু করলেন প্রেসিডেন্টের শাসন—আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবার এই হ’ল প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মীর্জা সুবিধা করতে পারলেন না। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় খণ্ডেই তখন সাধারণ নির্বাচনের দাবীতে জনগণ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত ক’রে তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগের নেতা খান আবদুল কাইয়ুম খান মীর্জাকে হুশিয়ার করে দিয়ে বললেন যে, অবিলম্বে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হ’লে একটা রক্তাক্ত কাণ্ড ঘটে যাবে।
১৯৫৮ সালের ৬ই জুলাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ঢাকার নারায়ণগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় বললেনঃ “স্বাধীনতার পর ১১ বছরের মধ্যে ভারতে দুটো সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল, তৃতীয় নির্বাচনও আসন্ন, অথচ আমাদের দেশে নির্বাচনের কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না।” উভয় প্রদেশের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে মীর্জা সাহেবও ১৯৫৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। এই উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদে একটি বিলও গৃহীত হ’ল।
অবস্থার চাপে পড়ে দু’মাস পর ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ব বাংলা থেকে
পৃষ্ঠা নংঃ ১৮২