You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১

—প্রশ্ন—
—বিপ্লবী পথচারী

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই নবজাতক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল বিগত ৭ই মার্চ শেখ সাহেবের রেস কোর্স ময়দানে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তারপর দীর্ঘ আট মাসাধিক কাল ধরে চলেছেন মরণপণ সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন লাখ লাখ বাংলার সাধারণ মানুষ। যারা জীবন ভর পেয়েছে খুবই কষ্ট আর হারিয়েছে জীবনের অমূল্য সম্পদ। অনেকে প্রশ্ন তোলেন ভারতীয় মিত্রবাহিনী সক্রিয়ভাবে সাহায্য না করলে শুধু মুক্তিবাহিনী কি বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করতে পারতো? প্র প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেওয়া যায়না। পৃথিবীর বুকে যে সমস্ত মুক্তি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে সব জায়গায়ই পূর্ব প্রস্তুতি ছিল খুবই কম। এ যেমন গেল অস্ত্র প্রস্তুতির কথা তেমনি জনগণের মানসিক প্রস্তুতির কথা। চিন্তা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের বিরোধীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। প্রকৃত পক্ষে একটা দেশের জাগ্রত জনগণই হল শোষণ ও শাসনের হাত থেকে মুক্তির সহায়ক ও নিয়ামক। পাশাপাশি এ সত্যটাও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে—যে আজ বিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শক্তিশালী মরণাস্ত্রের বিরুদ্ধে খালি হাতে সংগ্রাম করা যায় না। বাংলা দেশের মুক্তি বাহিনী তাদের উচ্চ ক্ষমতাহীন অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই করে বিপুলসংখ্যক পাকবাহিনীকে দিশেহারা করে তুলেছিল। এ বাস্তব সত্য কোন লোকই অস্বীকার করবে না যে বাংলাদেশের ১৯টা জেলা শহর এবং রাজধানী ঢাকা ও বন্দরগুলো ছাড়া ৭০ হাজার গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার গ্রাম ছিল মুক্তিবাহিনীর কবলে। সেখানে সাধারণ মানুষ গড়ে তুলেছিলেন দুর্জয় ঘাটি। বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনীর উর্দ্ধধন কর্মচারী টিক্কা, নিয়াজি ও ফরমান সকলেই একথা স্বীকার করেছে মুক্তিবাহিনীর (ওদের ভাষার বিচ্ছিন্নতাকামী) পৈশাচিকরা ওদের দিশেহারা করে তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর পায়ের তলায় মোটেই মাটি ছিল না অর্থাৎ বাংলাদেশের কোথায়ও তারা শেষের দিকে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছিল না। কতকগুলো ঘটনা নিরেখে আমরা এই সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবো।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, চালনা, মঙ্গলা প্রভৃতি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বন্দরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা বার বার আঘাত হেনে শত্রু বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি নস্যাত করে দিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর আতঙ্ক রোগে প্রায় সকলেই ভুগছিল। এখন কথা হল মিত্র বাহিনীর সক্রিয় অংশ গ্রহণ এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় বাংলাদেশের মুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পাক বাহিনীর মনোবল কতটা ভেঙ্গে গিয়েছিল তার প্রমাণ আমরা যশোহর ক্যান্টনমেন্ট পতনের পর উপলব্ধি করতে পারি। মিত্র বাহিনীর একজন উচ্চ-পদস্থ সামরিক কর্মচারী বলেছিলেন, আমাদের হাতে এত অস্ত্রশস্ত্র এবং দুর্জয় ক্যান্টনমেন্ট থাকলে আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতাম। পাঁচশতের উপর ট্রাক ভর্তি যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকা সত্ত্বেও পাক বাহিনী চোরের মত যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং শুধু মুক্তি বাহিনী যে, বাংলাদেশ মুক্ত করতে পারতো না এ প্রশ্ন যারা করে থাকেন এবং ধারণা পোষণ করেন তা সঠিক নয়। মার্কিণ সেনাদের শোচনীয় পরিণতি আমরা ভিয়েতনামে দেখতে পাচ্ছি আর বাংলাদেশে পাক বাহিনীরও একই পরিণতি হত। তাদের সময় হয়তো আরো অনেক বেশি লাগত। বাংলার দুর্দম তরুণদের ইস্পাতশক্ত মনোবল এবং আত্মদানের মহান দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কম যায়গায়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। ভারত সরকার এবং মিত্র বাহিনী হানাদারদের বর্বর অত্যাচার ও উৎপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যে ভাবে এগিয়ে গেছেন তা উচ্চ-প্রশংসার দাবী রাখে। মানবতার শোচণীয় পরিণতি দেখে বিবেক সম্পন্ন প্রত্যেক মানুষেরই এগিয়ে আসা উচিত। আমেরিকা ও চীন এই মুক্তি যুদ্ধে যে ন্যক্কার জনক ভূমিকা গ্রহণ করেছে তাতে ওরা কোন সুসভ্য দেশ বলে স্বীকার করতে দ্বিধা আসে। আমেরিকার বর্বরতার পরিচয় আমরা ভিয়েতনামে পেয়েছি কিন্তু চীন? সারা সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে নিজেদের পরিচয় দান করে। সে মাও-সেতুংয়ের ঘোষণা ছিল ‘যেখানেই অত্যাচার সেখানেই প্রতিরোধ।’ কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম কেন? আদর্শ বিচ্যুত হয়ে সংকীর্ণতাবাদী হলে এই পরিণতিই হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে যেসব অত্যাচারী দখলদার বাহিনী এবং আল বদর ও রাজাকার প্রভৃতি শয়তানেরা ধরা পড়েছে এবং আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের অপরাধের কোন বিচারই হবে না? এ প্রশ্ন মাঝে মাঝে অনেকেই করে থাকেন। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছেন ‘গণহত্যাকারীদের বিচার করা হবে’। প্রকৃতপক্ষে বিচার হওয়ার একান্ত প্রয়োজন। ফরমান নিয়াজি ও আরো কয়েকটি কর্ণেল ব্রিগেডিয়ারের বিরুদ্ধে যেসব গোপন তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বিশেষ ট্রাইবুনালে ওদের বিচার হওয়া উচিত। সুস্থ মাথায় কয়েক শত বুদ্ধিজীবীদের ওরা খুন করিয়েছে। স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল গঠন করে কোন একজন প্রখ্যাত বিচারপতির দ্বারা বিচার করা উচিত এবং শাস্তি সেখান থেকে নির্দ্ধারিত হবে জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা উচিত। যে সব দেশী শয়তানেরা বাংলা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হানাদারদের সাহায্য করেছে তাদেরও কঠোর শাস্তি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। পাক হানাদারবাহিনী ও দেশী শয়তানেরা শুধু নীচু স্তরের মানুষ নয় ওরা বিশ্বমানবতার শত্রুদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ ও টোকিওতে যেভাবে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচার করা হয়েছে এবং জনসমক্ষে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের আক্রমণকারী ও ষড়যন্ত্রকারী যেসব শয়তানেরা মানবতার শত্রু বলে বিবেচিত হবে তাদেরও জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করা উচিত।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!