You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.26 | মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী —সুনীল কুমার দাস | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—সুনীল কুমার দাস

মুক্তিযুদ্ধ এখন শেষ। রাজধানী ঢাকা দখলের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা লড়েছেন তাদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ডাইরীর পাতায় পাতায় অনেকের কথাই লেখা আছে। তাঁদের কথাই লিখে রেখেছি যারা একদিন আমার একান্ত কাছের লোক ছিলেন। চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের পর আজ বার বার কেন যেন বসিরের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে।
বরিশালের এক নগন্য গ্রামে বসিরের জন্ম। চাখার কলেজ থেকে বি-এ পাশ করে গ্রামের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতো। গরীবের সংসার। বাবা তালেব মাষ্টার অবসর প্রাপ্ত লোক। টানাটানির মধ্য দিয়ে দিন চলে যায়। মা-বাবার স্নেহের ‘বসি’ আর ছোট ভাই বোনদের প্রিয় বসির ভাই। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে বরিশাল হানাদার বাহিনীর দখলে যায়। বরিশাল হাতছাড়া হয়ে যাবার পূর্বেই গৌরমদী ট্রেনিং সেন্টার থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে বসির মুক্তি যুদ্ধে বেরিয়ে পড়েছেন। আমি ছিলাম কালিশুরি অঞ্চলে। আমার সাথে বসিরের দেখা নভেম্বরের শেষের দিকে। লালুয়া গ্রামে আমরা অনেক দিন বাদে আবার মিলিত হলাম। কাসেমের প্রচেষ্টায় এখানেও একটা মুক্তি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এক মুখ দাড়ি গোফ নিয়ে বসির যখন প্রথম এল আমি ওকে চিনতে পারিনি। আমাকের জড়িয়ে ধরে বলে উঠল। ‘দাদা কেমন আছ’। তারপর অনেক দিনের জমানো অনেক কথাই হলো। এক সময় বাড়ির কথা এসে যায়। ওদের বাড়ির কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলে কোন সঠিক জবাব না দিয়ে, না জানার ভান করলাম।
বরিশাল পতনের পর এখানকার মুক্তি যোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। পথ চলতে তখন পায়ে পায়ে বিপদ। ইয়াহিয়ার পশু বাহিনীর চেয়ে দেশীয় মীরজাফরদের ভয় তখন কোন অংশে কম ছিলনা। রাজাকার ও বদর বাহিনী সেজে এবং শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে কতকগুলো দেশী শয়তানও কম অত্যাচার চালায়নি। আমরা খান সেনাদের যেমন নিশ্চিহ্ন করেছি তেমনি এই সব পদলেহী কুত্তাদেরও রেহাই দেইনি এবং দেবো না।
চাখারের কুখ্যাত শয়তান জাতেম আলী খাঁ সেনাদের প্রথম গ্রামে এনেছে। শয়তান, বসিরের নাম বলেছে এবং জল্লাদদের দেখিয়ে দিয়েছে ওর বাড়ি। রাতের বেলায় বৃদ্ধ তালেব মাষ্টারকে শয়তানেরা ধরে আনে। তাঁর অপরাধ হল ছেলে কেন মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মাষ্টার সাব্ যখন কিছুতেই ছেলে ও মুক্তি যোদ্ধাদের কোন গোপন তথ্য দিলেন না তখন তাকে বস্তার মধ্যে দড়ি দিয়ে বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে। এমনি নির্মম ভাবে বসিরের বাবাকে হত্যা করেছে। বসিরের বড় বোনটাকে কুকুরের দল ধরে নিয়ে গেছে তার পর আর কোন খোঁজ নেই। হয়তো পশুর লালসার খোরাক হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে! এ সব খবর বসির কে বলার মত ভাষা আমার ছিল না।
খানসেনারা খেপু পাড়া থানার কাছে একটা ঘাটি করেছে। এই ছাউনিতে প্রচুর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। যে কোন প্রকারেই হোক অস্ত্রগুলো আমাদের দখল করতে হবে। মাত্র ২০ টা রাইফেল আর ২টা হাল্কা মেসিনগান আমাদের সম্বল। খেপু পাড়া বন্দরটা যারা দেখেছেন তারা সঠিক বঝুতে পারবেন এর অবস্থান। দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে রয়েছে বড় নদী। উত্তর ও পশ্চিম দিক দিয়ে আমাদের আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।
কাসেম আমাদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করেছে। অনেক দিন পরে পেট ভরে খেলাম। রাত বারোটার সময় নদী পথে পূর্ব পারের তাল গাছগুলোর আড়ালে আমরা জড়ো হলাম। নির্দ্ধারিত সময় আগত প্রায়। রাত প্রায় একটার সময় কাসেমের নেতৃত্বে আমরা ছাউনি আক্রমণ করলাম। কয়েকটা গ্রেনেড চার্জ করে প্রথমে সকল শত্রু সেনাকে চমকিয়ে দিলাম। গ্রেনেড যে দিকে ফাটানো হয়েছে শয়তানরা সেদিকে পাল্টা আক্রমণ করল। ঝাকে ঝাকে রাইফেল ও মেসিনগানের গুলি সমস্ত অঞ্চলটাকে কাঁপায়ে তুলল। আমরাও পজিসন নিয়ে উত্তর ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবল ভাবে আক্রমণ করলাম। এ রকম আক্রমণের জন্য ওরা প্রস্তুত ছিলনা। বসির ও কাসেম ঝুকি নিয়ে ছাউনির মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মজুত অস্ত্রগুলো এনে আমাদের কাছে দিতে লাগল। কয়েকটা শয়তানের লাস ছাউনির কাছাকাছি পড়ে রয়েছে। পাঞ্জাবী সুবেদার জয়নাল খাঁ গুলি খেয়ে মরার মত পড়েছিল। বসির ও কাসেম তা বুঝতে পারেনি আর পারেনি বলেই চরম অঘটন ঘটে গেল। সুবেদার খানের হঠাৎ আক্রমণে কাসেম ও বসির দু’জনেই ধরাশায়ী হল। কাসেম পড়ে গিয়ে ও খান কুত্তাটাকে বেয়োনেট চার্জ করলেন। শয়তানটা এখন চিরদিনের জন্য স্তব্ধ।
এই অপারেশনে রাজাকার ও খান কুত্তাদের প্রায় ৪০ জনকে আমরা খতম করেছি। বাকিগুলো অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেছে। অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করলাম অনেক কিন্তু যে ক্ষতি হল তা আর পূরণ হবার নয়! বসির ও কাসেমকে মুমূর্ষু অবস্থায় কাঁধে করে নিয়ে এলাম। কিন্তু বাচাতে পারলাম না। লালুয়ার চরে ওদের কবর দিয়ে রেখে গেলাম।
বাংলা দেশ আজ স্বাধীন। বরিশাল শহরের বগুড়া রোডের ভাঙ্গা বাড়িটার মধ্যে বসে যখন ডাইরীর ছেড়া পাতাগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখি তখন বার বার মনে পড়ে যায় বসিও ও কাসেমের কথা। বসির আর কোন দিন তার বাড়ির খবর জানতে চাইবে না। বসির ভাইয়ের জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষায় রত ছোট ছোট ভাইবোন কোনদিন ফিরে পাবে না তাকে। এ সব আত্মত্যাগের কথা আমরা যদি কোন দিন ভুলে যাই তা হবে চরম বেইমানি।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল