বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলার বঞ্চনা
—মীর্জা ওয়াজেদ আলী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরবর্তী পর্যায়ে আমরা অতি সংক্ষেপে সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে দেখবো কিভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর থেকে আমাদের নিজেদের সম্পদ ও সামর্থ্যের একটা ধারণা আমরা করতে পারবো।
প্রথমে ধরা যাক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠির অতি সাধারণ বিষয়গুলো, যেমন গড়পড়তা মোট আয়, মাথাপিছু আয় দ্রব্যমূল্য ও ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে জীবনযাত্রার মান। দুই অঞ্চলের মোট আঞ্চলিক আয় এবং মাথা পিছু আয়ের হিসাব আমরা নীচের তালিকায় পাবো। এখানে ১৯৬৪/৬৫ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান দেওয়া হলো।
আয়ের তালিকা
পরিকল্পনা পূর্ব বার্ষিক গড় | প্রথম পরিকল্পনাকালে বার্ষিক গড় | দ্বিতীয় পরিকল্পনাকালে বার্ষিক গড় | ||||
১৯৫০/১ | ১৯৫৪/৫ | ১৯৫৫/৬ | ১৯৫৯/৬০ | ১৯৬০/১ | ১৯৬৪/৫ | |
পূর্ব বঙ্গ | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব বঙ্গ | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব বঙ্গ | পশ্চিম পাকিস্তান | |
আঞ্চলিক আয় (কোটি টাকা) | ১৩৫০.৮ | ১৩০০.৬ | ১৪১০.৭ | ১৫৫৯.৯ | ১৭৪৮.০ | ১৯১৪.৩ |
মাথাপিছু আয় (টাকা) | ২৯৭ | ৩৪৩ | ২৭৫ | ৩৬৪ | ৩০১ | ৩৯৩ |
এই তালিকা থেকে আমরা দেখেছি পরিকল্পনা শুরু হওয়ার আগে পূর্ববাংলার আয় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশী ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা শুরু হলে ১৯৬০ সালের মধ্যেই দেখা গেল পূর্ব বাংলার আয়কে অতিক্রম করে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় বেশী হয়েছে ১৪৯ কোটি টাকার মত। এক্ষেত্রে পঃ পাকিস্তানে আয় বৃদ্ধির হার গড়ে শতকরা ১২ টাকা এবং পূঃ বাংলায় ৪.৪ টাকা কিন্তু মোট আঞ্চলিক আয় দিয়ে বৈষম্যের প্রকৃত তথ্য ধরা পড়ছে না। কারণ বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বেশী থাকায় পরিকল্পনাপূর্বকালে তার মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শতকরা ১৫ ভাগ কম ছিল। কাজেই পরিকল্পনার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ছিল এই বৈষম্যটাকে রোধ করা। কিন্তু পরিকল্পনা শেষে ১৯৬০ সালে দেখা গেল উল্টো ব্যাপার, অর্থাৎ সেই বৈষম্যের হার হয়েছে শতকরা ৩২ ভাগ। আর তৃতীয় পরিকল্পনার শেষে তা ৩০%। দুটি পরিকল্পনাকালে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার পঃ পাকিস্তানে যথাক্রমে শতকরা ৬ ভাগ ও ৮ ভাগ। কিন্তু পূর্ববাংলায় মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি দুটি পরিকল্পনা কালের দশ বছরে শতকরা ১ ভাগ, অর্থাৎ কোন বৃদ্ধিই হয়নি। এ সমস্ত পরিসংখ্যান দৃষ্টে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকেনা যে বাংলাদেশকে সুপরিকল্পিত ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ পর্যন্ত আমরা আয়ের দিকটা দেখলাম। এবারের ব্যয়ের দিকটাও আমরা দেখবো। কারণ শুধু আয় দিয়েই কোন দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান বোঝা যায়না। এখানে ব্যয় বলতে আমরা বুঝবো একজনের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য ব্যয়। অর্থাৎ ব্যয়ের মাধ্যমে সে কি পরিমাণ দ্রব্য তার ভোগে লাগাতে পারে। দ্রব্য ভোগের এই মাত্রা থেকে আমরা দুটি অঞ্চলের জনসাধারণের জীবনযাত্রার স্বচ্ছলতা তুলনা করতে পারি। নীচে সে উদ্দেশ্যে কয়েকটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ভোগের মাথা পিছু ১৯৫১—১৯৬০ সালের গড় দেখানো হলো।
দ্রব্য | একক | পূর্ব বাংলা | পশ্চিম পাকিস্তান |
শষ্য | পাউন্ড | ৩৮.৯ | ৩৯.৯ |
চিনি | পাউন্ড | ১৮.৮ | ৫৩.৭ |
চা | পাউন্ড | ০.১ | ০.৮ |
মাছ | পাউন্ড | ৮.৩ | ৩.২ |
কাপড় | গজ | ২.২ | ৭.৮ |
সিগারেট | সংখ্যা | ২১ | ১২১ |
বিদ্যুৎ | কিলোওয়াট | ১.০ | ১৮.৮ |
একমাত্র মাছ বাদে প্রতিটি দ্রব্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ বেশী। এই তালিকায় বিলাস দ্রব্যাদি স্থান পায়নি, যেমন রেডিও, মোটরগাড়ী ইত্যাদি। এগুলির ক্ষেত্রে ভোগের বৈষম্য অনেক বেশী। ভোগের এই বৈষম্যের দুটি প্রাথমিক কারণ হলো, আয়ের বৈষম্য এবং দ্রব্যমূল্যের বৈষম্য। দ্রব্যমূল্যের বৈষম্যের উদাহরণ স্বরূপ যেমন ১৯৬৬/৬৭ সালে চাল ঢাকায় ৩৯.৩১ টাকা মণ এবং করাচীতে ৩১.৬৭ টাকা মণ, চিনি ঢাকায় প্রতিমণ ৬৩.৯৫ টাকা, করাচীতে ৫৫.৬৭ টাকা; সরিষার তেল ঢাকা ও করাচীতে যথাক্রমে প্রতিমণ ১৬৮.১৮ ও ১২৮.০৯ টাকা ছিল।
দেখা যাচ্ছে একদিকে নিম্ন আয় আর অপরদিকে চড়া দ্রব্যমূল্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের কোটাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। জীবনের অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথা ছিল তাদের কল্পনারও বাইরে। প্রকৃতপক্ষে মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা, দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি দিয়ে দুই অঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের খুব সামান্যই ধরা পড়ে। এছাড়াও পোষাক, পরিচ্ছদ, আবাসিক সুবিধা, চিত্তবিনোদানের সুযোগ ও আরো অনেক ছোটখাটো সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও দুই অঞ্চলের বৈষম্য ব্যাপক ও তীব্র।
যে বাংলাদেশের মাটি পৃথিবীর উর্বরতম অঞ্চলগুলির অন্যতম সেই বাংলাদেশকে প্রতিবৎসর খাদ্যের জন্য অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হতে হয় এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কি হতে পারে। কয়েকটি পরিসংখ্যান আলোচনা করলেই বোঝা যাবে বাংলাদেশ যাতে করে কোনদিন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হতে পারে এবং সব সময় পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় সেদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। (চলবে)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল