বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত চক্রান্ত এবং চীন সংশোধনবাদীদের ঘৃণ্য অপকৌশলকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছে ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ। ভারতের ভ্রাতৃস্থাণীয় জনগণ দৃঢ় হিমালয়ের মত দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের নিপীড়িত গণমানবের পক্ষে।
ভারতের দুর্জয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা এবং নেতৃত্বে বাংলাদেশের দুর্বার মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। ভারতের মহান জনগণের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অবিচল ও সুকঠিন রাজনৈতিক অজ্ঞতার জন্যে তাঁর কাছে বাঙলাদেশ বিশেষভাবে ঋণী। শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ উন্মোচন করেই ক্ষান্ত হন নি, বাঙলাদেশেকে স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপায়িত করে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এশীয় রণকৌশলের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছেন।
বাংলাদেশের বিজয় তাই মূলত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় এবং চীনা সংশোধনবাদীদের পক্ষে একটি দারুণ শিক্ষা।
বাংলাদেশের মানুষ ঘরে ফিরছে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শুভেচ্ছা বহন করে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ভারতের মহান জনগণকে। উভয়দেশের মধ্যে মৈত্রী বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রশ্স্ত পথে সোভিয়েত রাশিয়ার অর্ঘ-কুসুম শান্তির নব-দিগন্ত মুক্ত করেছে। এ বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হৌক্।
নবজাতক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির স্বীকৃতি লাভ করবে নিঃসন্দেহে। আর সেদিনই আমাদের বিজয় হবে সম্পূর্ণ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা সংশোধনবাদীরা অস্ত্র, বিমান আর ট্যাঙ্ক দিয়ে গড়ে তুলেছিল ক্ষুদে নাৎসী দেশ পাকিস্তান। সেই ক্ষুদে নাৎসী দেশের কবর রচিত হয়েছে বাংলার মাটিতে। বাংলার মাটিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এবং চীনা সংশোধনবাদের মৃতদেহকে আমরা চিরকালের জন্য সমাধিস্থ করেছি। আণবিক শক্তি পরিচালিত ‘এন্টারপ্রাইজ’কে তাই ফিরে যেতে হবে নিজেদের জায়গায়। ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটিরূপে চিহ্নিত হল ইতিহাসে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা সংশোধনবাদের ‘কাগুজে যাঘসুলি’র সদম্ভ গর্জনকে স্তব্ধ করে দিয়েছি আমরা।
বাঙলাদেশের সব গেছে, কিন্তু সব কিছুর বদলে বাঙলাদেশ পেল স্বাধীনতা। ভারতের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করবার সমস্ত ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছে ভারতের বীর জওয়ানরা। ক্ষুদে নাৎসী ইয়াহিয়ার দর্পিত চক্ষুগুলি আর কোনদিন ঘৃণা ছড়াবে না ভারতের সীমান্তে। বাংলাদেশের শিশুরা আর কোনদিন ভয়ে মুখ লুকোবে না মায়ের কোলে, যুবকের রক্তে রক্তাক্ত হবে না বাংলা মাটি, ধর্ষিতা হবে না ষোড়সী বোনের সোমত্থ যৌবন। বাঙলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের কবি ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এই বিপ্লবী কবিই লিখেছিলেন “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।” হ্যাঁ দুর্বৃত্তরা আজ ঠিকেই বুঝেছে।
বাংলাদেশের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে শত্রুরা। ক্ষেতখামায় ফসল নেই। পুকুরে মাছ নেই। ছায়াচ্ছন্ন মায়াময় গ্রামগুলিতে রক্তের ছাপ লেগে আছে। বিশলক্ষ মানুষ কোথায় হারিয়ে গেছে। দিন আসবে যখন ক্ষেতে ক্ষেতে ফসলেরা হাসবে, নতুন ধানের গন্ধে দিশেহারা হবে কৃষাণীরা—শুধু বিশলক্ষ মানুষ থাকবে না। দিন আসবে যখন তরুণেরা আবার ভালোবাসবে তরুণীদের—কিন্তু থাকবে না সেই বিশলক্ষ মানুষ। বাংলার মা-বোন-ভাইয়েরা শোনো—প্রতিজ্ঞা করো বিশলক্ষ শহীদের স্বপ্নগুলি, কথাগুলি, ভালবাসাগুলি, আশা ও আকাঙ্ক্ষাগুলি যেন আমাদের মধ্যে সফলতা পায়।
মনে রাখুন, বাংলার মাটিতে ভারতীয় জওয়ানের পূত রক্তধারা মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীদের রক্তধারায় মিলে মিশে পরিণত হয়েছে এক মহান পবিত্র রক্তস্রোতে। এ পূণ্যময় রক্তস্রোতের কথা যেন আমরা মনে রাখি। বিশলক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলার মাটিকে দুর্জয় ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে।
আজ আনন্দের দিন বটে, কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও আমাদের শত্রু আছে। প্রগতি, শান্তি ও স্বাধীনতার শত্রুদের পরাজিত করেই কেবল আমরা সমাজতন্ত্রের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল