বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
—জিষ্ণু দে (বিশেষ প্রতিনিধি)
ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লীর রামলীলা ময়দানে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। সাধারণতঃ অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতারা দেশের উদ্দেশ্যে অনেক গরম গরম বক্তৃতা ছাড়েন। এগুলি আসলে অন্তরের কথা নয় বলে খেলাপও হয়। রাজনীতি জিনিষটাই নাকি এরকম। কিন্তু যে প্রাচ্যরীতির জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তার ইতিহাসে এই মিথ্যাভাষণ রাজনৈতিক চাল হিসেবে সম্মানীয় নয়। যে শেখ মুজিবের আদর্শে আজ বাংলা উদ্বুদ্ধ—তাঁর মুখের কথার খেলাপ কোনদিন হয় নাই, হবে না। তিনি কি আমাদের চেনা শ্রেষ্ঠ রাজনীতিক নন? তিনি কি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একমন্ত্রে এক করে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিলেন না?
বাংলার কোটি কোটি মানুষের পাশে এগিয়ে এলো না চীন; মনে পড়ছে বেগম মতিয়া চৌধুরির রোষদীপ্ত কন্ঠ : “বন্ধুরা আমার, ইতিহাসের পাতায় ইয়াহিয়া খান জল্লাদের সঙ্গে মাও সে তুঙের নাম লেখা থাকবে একই সারিতে—একই পংক্তিতে।”
কিন্তু বাংলার মানুষের পাশে এগিয়ে এলো সমস্যাক্লিষ্ট দরিদ্র পশ্চিমবাংলার মানুষ। খুলে দিল দ্বার। এলো শরণার্থীর স্রোত। ভরে গেল কারো উঠোন কারো দালান, কারো বাড়ীর সামনের গাছের তল। এগিয়ে এলেন ভারত সরকার। ইন্দিরাজীর কাজ শুরু হল বিশ্বের দরবারে এই শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরা। আটমাস, দীর্ঘ আটমাস চলল প্রতীক্ষা। রামলীলা ময়দানে সমস্ত অন্তর ঢেলে ইন্দিরাজী জানালেন—আমরা প্রতীক্ষা করেছি ভারতবর্ষের প্রাচ্য রীতিসম্মত ধৈর্যের সঙ্গে, যে ধৈর্য্য নিয়ে গরীব চাষী অপেক্ষা করে গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার জন্য। যে ধৈর্য নিয়ে বর্ষার প্লাবনের মধ্যে সহায়সম্বলহীন মানুষ অপেক্ষা করে জল সরে নতুন পলিমাটী ওঠার অপেক্ষায়। যে ধৈর্য্য নিয়ে আমাদের দেশে শীতের শেষের জন্য অপেক্ষা করে দেশের তামাম গরীব মানুষ—যাদের গায়ে দেবার মত ধুতির খুঁটটুকু পর্যন্ত জোটে না। এ সেই ধৈর্য্য যা নিয়ে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে তরুণ যোদ্ধারা অপেক্ষা করেছে কবে তাদের প্রতি অত্যাচারের জবাব তারা দেবে। ছাত্ররা ঘুরে ফিরেছে অভুক্ত অর্দ্ধভুক্ত অবস্থায় কবে তারা যুদ্ধশিক্ষার সুযোগ পাবে।
কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা শুধু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করাই নয়। আমাদের দেশেরই মেয়ে ইন্দিরাজী জানালেন আমাদের সর্বংসহা মেয়েরাও শুধুই সহ্য করতে শেখেনি। শত আক্রমণ, শত অনাচার নীরবে সয়ে যাওয়াই আমাদের ইতিহাস নয়। তাই পাকিস্তানের সামরিক শাসকের নিলর্জ্জ ভারত আক্রমণের সমুচিত জবাব আমরা দিচ্ছি। ধৈর্য্য ধরে মুক্তিবাহিনী আটমাস যাবৎ যে আঘাত হানছেন তা আজ মিত্রবাহিনীর সহায়তায় ঢাকা মুক্তিতে শেষ হতে চলেছে এই সপ্তাহের মধ্যেই।
ইন্দিরাজী আরো বলেছেন রামলীলা ময়দানে। তিনি জানিয়েছেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু বলার নেই। আজ বাংলাদেশের মানুষের মত সমস্তটা জানলে তারাও ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলত না, অস্ত্র ধরত না জঙ্গী কুচক্রীদের হয়ে। এই জঙ্গীশাহী তাদের কু প্রচারযন্ত্র চালিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে—যে চেষ্টা ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের সামনেও সে চালানোর চেষ্টা করেছে।
মুজিব বলেছিলেন বাংলার মানুষকে মুক্তি দেবেন। তিনি কথা রেখেছেন। ইন্দিরাজী কথা দিয়েছিলেন শরণার্থীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা তিনি করবেন। তিনি কথা রেখেছেন। এই দুই নেতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত বাংলার সর্বহারা সর্বস্বান্ত মানুষ আজ ভবিষ্যতে নিশ্চিন্ত জীবনের আশা করছেন। এ আশা সত্যি হবেই।
ইন্দিরাজী অত্যন্ত মূল্যবান রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্য বিশ্লেষণ করেছেন। দেশের নাম না করে তিনি বলেছেন, যে সমস্ত দেশ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আধুনিকতম অস্ত্রে সশস্ত্র করেছে তারাই আজকের এই ট্র্যাজেডীর জন্য দায়ী। আজ বাংলাদেশের মানুষের এই যে কষ্ট, আজ শরণার্থীদের কষ্ট, মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের ত্যাগ স্বীকার ও প্রাণ দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা—সমস্ত কিছুর পিছনে আছে এই সামরিক চক্রের মদমত্ততা। সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করে তাদের দাবীদাওয়া অগ্রাহ্য করে মিথ্যা বক্তৃতা ঝেড়ে তারা ভেবেছিল বাজীমাৎ করে দেবে। তাদের অস্ত্র ও তাদের মিথ্যার জোর আজ ঐক্যবদ্ধ দুই দেশের গণতন্ত্র ও শান্তিকামী ৬২ কোটি লোকের ইচ্ছার কাছে হেরে গেল।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল