বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
মুক্তাঞ্চলে যা দেখেছি
—অধ্যাপিকা মীরা দে
কালিন্দী পেরোবার পর সাত মাইলের রাস্তা। ফাঁকা রাস্তা, মাঝে মাঝে ছোট দরমা দেওয়া কুঁড়ে চোখে পড়ে। বাচ্চা, মহিলাদেরও দেখা যায় কুঁড়ের মধ্যে। রিক্সাচালক বলে চলে, কিছুদিন আগেও কুঁড়ের সংখ্যা ছিল আরও বেশী। গত মে থেকে এ রাস্তা দিয়ে পথচলা ভীড় ঠেলার সামিল ছিল। এখন কিন্তু ফাঁকা, কারণ বাংলাদেশ তো মুক্ত হতে চলেছে। ওপারে বসন্তপুর কালীগঞ্জ শ্যামনগরের অনেক লোক চলে গিয়েছে।
কথাটা সত্যি। কালীগঞ্জে পৌঁছলুম সাড়ে চারটেয়। পশ্চিমাকাশে মুঠো মুঠো সোনা তখন। নৌকার মধ্যে আলাপ হ’ল এক মুক্তি যোদ্ধার সঙ্গে। বাচ্চা ছেলে, কলেজের 1st year এর ছাত্র ছিল। নৌকা বোঝাই যাত্রী, আমরা ছাড়া সবাই ওপারের বাসিন্দা, পাকসৈন্যের তাড়নায় এসেছিলেন, এখানে, এখন সবাই দেশাভিমুখী। মাঝি বলে আর সাত দিনের মধ্যেই সবাইকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেব—তাতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাটি তেতে বলে উঠে পাঠাতে হবেনা, সবাই নিজে থেকেই চলে যাবে।
ইছামতী থেকে বার হয়ে আসা কপোতাক্ষের উপর দিয়ে নৌকা যাচ্ছিল। দুপাশে বাংলাদেশ। আমার জীবনে প্রথম দেখা বাংলাদেশ। এদিক ওদিক ছড়ান নৌকো—অনেকগুলি দেখলাম চ্যাটালো ময়ূরপঙ্ক্ষীর মত। ওগুলি নাকি খুলনার। আরও একটা জিনিস চোখে পড়ার মত, দুপাশে সারি সারি বাঙ্কার। বইএ পড়া, কানে শোনা আর চোখে দেখার মধ্যে তফাৎ আছে। চিলে কোঠার ঘরের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। অনেক রক্তাক্ত ঘটনার ইতিহাস মনে পড়িয়ে দেয়।
কালীগঞ্জে নামলাম। ডাক বাংলোয় ছোটখাট একটা অফিস মত রয়েছে। ওখানের যাঁরা ছিলেন তাঁরা বললেন ক্যাম্প। আমাদের সঙ্গে সামান্য জামাকাপড় আর লন্ঠন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ওঁরা সেগুলি নিলেন, এবং আমার সঙ্গী কিছু “বিপ্লবী বাংলাদেশ” ও New Wave কাগজ পড়তে দিলেন। তারপর আমরা ভিতরের দিকে গেলাম। পাশে দোতালা হলদে রং এর থানা, সেখানে আর দুদিন আগেও নাকি তিনজন দালাল বন্দী হয়েছিল। থানার আশে পাশের মাটি এবড়ো খেবড়ো। আমাদের পথের সঙ্গী ছাত্র মুক্তি যোদ্ধাটি মাইনের পর মাইন পোঁতার চিহ্ন দেখাতে লাগলেন। পথের পাশে, পথের মাঝে, কাঁচা বাঙ্কার, যেখানে নৌকো পারাপারের ঘাট আছে তার পাশ শক্ত বাঁধান বাঙ্কার, গুণে শেষ করা যায় না। একটা অসম্পূর্ণ বাড়ী রয়েছে, তার চার থামের উপর, থামের মতই চারটে বাঙ্কার, নদীর পাড় অনেক উঁচু করা হয়েছে। জিগ্যেস করি বিস্ময়ে ব্যাপারটা কি, এত আয়োজন, এত অস্ত্র—মুক্তিযোদ্ধারা কি করে হঠালেন? উত্তর আসে, ঈদের দিন মুক্তিযোদ্ধারা আসছে এই খবর আগে থেকে ওরা পায় এবং তাতে নাকি তারা পলায়ন করে!! নৈতিক কারণ ছাড়া আর অন্য কিছু আমার মনে পড়ে না।
রাস্তায় এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, সামনে এক মহিলা, সিঁদুর দেওয়া সিঁথিতে। কোথায় যাচ্ছেন?—স্বদেশে। গরুর গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছেন ওঁরা, আমরা কলকাতার লোক জেনে বললেন ওঁদের গ্রামে যেতে। বৃদ্ধের দন্তহীন হাসি এক অশেষ মুক্তির চিহ্ন—“প্রাণে খুসির তুফান উঠেছে…” সত্যিই। দুই ভদ্রলোক সাইকেল করে ভেতরের গ্রামে যাচ্ছেন। খুলনার নেওয়াবেকী গ্রামে। আমাদের ঢাকার মুক্তিযোদ্ধার পরিচিত ভদ্রলোক। নেওয়াবেকী কেন? প্রশ্ন তোলেন আমাদের যোদ্ধা। লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভদ্রলোক জবাব দেন শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছি!
হাটের পথে লোক ধরে না। দোকানী দোকান খুলেছে, ব্যাপারীরা বসেছে। ঝালমুড়ি বিক্রীও বেসেছে। পান আর তাল তাল চুন নিয়ে বসা দেখে তাম্বুল চর্বিত বাঙালীর গপ্পে স্বভাবের কথা মনে পড়ল। তবে সবই মনে পড়িয়ে দেয় এ হাট খুব জমজমাটের ছিল। দোচালা গুলি এখনও খোলেনি। কেনা বেচা কম। দোকানে জিনিসপত্রের কিছু অভাব। দোকানী পীর মহম্মদ দিন সাতেক হ’ল দোকান খুলেছে। তার অর্দ্ধেক জিনিষ লুঠ হয়েছে, Peace কমিটির লোকেরা নাকি দোকানের চাবি এবং ঘরের চাবির দুইই কেড়ে নেয়। প্রাণে মারার আদেশও ছিল, অনেক টাকা Peace কমিটিকে দিয়ে সুন্দরবনে পালিয়ে যায় স্ত্রীপুত্র পরিবারকে নিয়ে। আমরা কলকাতার বাসিন্দা শুনে কেউ ছাড়বে না, বাড়ী নিয়ে যাবে, খোওয়াবে ইত্যাদি। সেই সন্ধ্যেয় আমাদের ফেরার কথা—হিঙ্গলগঞ্জে পৌঁছতে হবেই। এর পরের দুটো ঘটনা খুব মজার। কাটাখালি পাড় থেকে সাত মাইল লম্বা রাস্তার পর কালিন্দী। টেম্পোতে উঠেছি। তিনজন ভারতীয় জওয়ান সহ দুইজন হাবিলদার উঠলেন ওই টেম্পোতে। টেম্পো চলে না। জওয়ানদের ঠেলতে হল, তারপর তার চাকা চলল। ওঁরা U.P.র লোক কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলেন। কারণ, “পাড়াগাঁয়ে ইংরাজীও চলে না, হিন্দীও চলেনা” বললেন হাবিলদার সাহেব। ড্রাইভারের সঙ্গে এবং Conductor এর সঙ্গে খুব হাসিঠাট্টার সম্পর্ক ওঁদের। আমাদের নমস্কার জানিয়ে পথের মাঝে বিদায় নিলেন। আমাদের জওয়ানদের এই অমায়িক পরিচয় পেয়ে বেশ গর্ব হল।
আমরা কালীগঞ্জে ভারতীয় সৈন্য একজনের দেখাও পাইনি। তাঁরা সবাই রণক্ষেত্রে, মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের মানুষ। এপার ওপারের যাওয়া আসার নিষেধ নেই। এপারে মানুষ ওপারে হাটবাজার করছেন, কেউ কেউ বাংলাদেশের দরদী বলে, কেউ কেউ আর্থিক দিকের কথা চিন্তা করে।
আমার সেই বৃদ্ধ ও মহিলার মুখ এখনও মনে পড়ে। “প্রাণে খুসির তুফান উঠেছে”—বাংলাদেশের সর্বস্তরে। বৃদ্ধের নিমন্ত্রণ মনে আছে। বলেছিলাম, যাব, নিশ্চয়ই যাব আপনাদের গ্রামে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল