You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—শিশির কুমার দাস

(সাতক্ষিরা ১৬ই ডিসেম্বর)
এলোমেলো কথাগুলি দিনের পর দিন লিখে যাচ্ছি ডাইরীর পাতায় পাতায়। কোন মূল্য এর আছে কিনা জানিনা। বরিশালের নাম না জানা ছোট একটা গ্রামে আমার জন্ম। দেশের ডাকে দশের সাথে আমিও পথে বেরিয়ে পড়েছি। বেরিয়ে পড়েছি বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছে। রাজধানী ঢাকা দখল করে নেবার পরই আমাদের প্রথম স্তরের সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে। এর পরও আমাদের কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে। দেশ গঠনের জন্য আরো দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে যেতে হবে। সাতক্ষিরা দখলের পর পথ অতিক্রম করে যেতে যেতে যে সব ঘটনা দেখলাম তারই বিবরণ আজ লিখে যাচ্ছি। বিভিষীকাময় অত্যাচারের অনেক ঘটনা আজ লিখছি। ইয়ুসুফ, মিন্টু, ফরিদ ও আমি যখন কালিগঞ্জে ঢুকি তখন দশটা বেজে গেছে। এই অঞ্চলটা পেরিয়ে যাবার সময় পিছনের কথাগুলো আবার মনে পড়ে যায়। এখানে, আমাদের প্রিয় সাথী নারায়ন ও নজরুলকে আমরা হারিয়েছি। আজ যেমন নিশ্চিন্তে কাঁধে রাইফেল নিয়ে ঘুরছি সেদিন কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে ছিল বিপদ। এই বিপদকে বরণ করে নিয়েই আমরা পথ চলেছি। নারায়ন, নজরুল, ফরিদ, মিন্টু, ইয়ুসুফ, জয়নাল, কাদের ও আরো কয়েকজন মুক্তি যোদ্ধারা সেদিন অপারেশনে গিয়েছিলেন। নারায়নের শরীরটা সেদিন ভাল ছিলনা। যাবার সময় শুধু এক বার চা খেয়েছিল। বলেছিল ফিরে এসে ভাত খাবে। জ্বর থাকার জন্য আমি যেতে পারি নি। সেদিনের দলনেতা ইয়ুসুফের নির্দেশ অমান্য করে ফ্রন্ট লাইনে বেশী এগিয়ে যাবার সাথে সাথে হানাদারদের একটা ‍বুলেট নারায়নের বাম চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে মাথার পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কয়েকটা মুহূর্তের ব্যবধানে একটি জীবন শেষ হয়ে গেলো। রাতের প্রথম প্রহরে সাথীরা নারায়নের লাস বহন করে নিয়ে এসেছে। ও বলেছিল ফিরে এসে ভাত খাবে। ফিরে ও এসেছে কিন্তু জীবিত নয় মৃত। ভাতের গ্রাস এখনো যখন মুখে দিতে যাই নারায়নের কথা মনে পড়ে যায়! মনে পড়ে যায় ওর মিষ্টি মধুর মুখ খানি। ডাইরীর পাতা নারায়নের কথা লিখেই ভরে ফেললাম—ওযে আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। গ্রামের লোকদের কাছ থেকে জানতে পেলাম তাঁদের দুর্বিসহ লাঞ্ছনার কথা। সাতক্ষিরা পতনের কয়েকদিন আগে প্রায় দুশো ছেলেকে ধরে এনে খান সেনারা মাঠের মধ্যে দাড় করে হত্যা করেছে। এখনো শেয়াল কুকুরে লাসগুলো নিয়ে টানাটানি করছে। পথে পথে অসংখ্য বাঙ্কার দেখলাম। মাটির নীচে ও উপরে দুরকমের বাঙ্কারই রয়েছে। এমনকি মসজিদের উপর পর্যন্ত ইসলামের ধ্বজা ধারী বাঙ্কার তৈরী করেছে। মাটির নীচের বাঙকারের মধ্যে পাশবিকতার নির্দশন এখনো রয়েছে। মেয়েদের অন্তর্বাস অনেকগুলো বাঙকারের মধ্যেই দেখা গেল। জানিনা কুকুরের দল কোন হতভাগিনীদের সর্বনাশ করেছে!
দে ভাটা দখল করে নেবার খান সেনারা পিছু হটে প্রথমে কালিগঞ্জের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে পশুর দল নিরীহ গ্রামবাসীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। বেশ কিছু সংখ্যক ছেলেকে ধরে এনে বড় একটা গর্ত করে তার মধ্যে জীবন্ত চাপা দিয়েছে। দুটো ছেলে গর্ত খুলে কুড়ি পঁচিশটা কঙ্কাল দেখালো। এসব দেখে হাতের রাইফেলের মুঠিটা শক্ত হয়ে উঠে। প্রতিহিংসা গ্রহণে ইচ্ছে হয় কিন্তু নিজেদের সংযত রাখি। এই স্বজন হারানো শ্মসানে দাড়িয়ে মনটা ভারি হয়ে উঠে।
বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কন্ঠের ঘোষণা আমরা রক্ষা করতে পারবো তো—“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।…তেইশ বছরের বাংলার ইতিহাস নিরীহ বাঙালীর রক্তের ইতিহাস।” এই সর্বহারাদের মুক্তি দিতে আমরা যেন ভুলে না যাই। ভুলে না যাই যেন সেই সব শয়তানদের যারা বাংলাদেশের আক্রমণকারীদের সাহায্য করেছে। এখন অনেক শয়তানই আবার বাংলা দেশের ভক্ত হয়ে উঠছে। এই সব মুখোশধারীদের ক্ষমা নেই। যে বজ্র মুষ্ঠিতে একবার অস্ত্র ধরেছি কোন অন্যায়কেই সে হাত বরদাস্ত করবে না। দালাল ও বেইমানদের তাই বলছি হুঁশিয়ার। শোষণ ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য তোমার দিনের পর দিন খোলস বদল করে চলছো—আমরা কিন্তু তা চিনতে ভুল করবো না। রক্ত ঋণে যারা আমাদের ঋণী করে রেখে গেছেন তাদের আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হব না। দেশ এখন পুরো স্বাধীন। এখন শয়তানদের তালিকা ধরে হিসেব মেলাবো কত অপকর্ম ওরা করেছে এবং কি শাস্তি বাংলাদেশ সরকার দেবে!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!