বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ
—মনিরুল হাসান
(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
পশ্চিমবঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ‘গণবার্তা’য় নিম্নের প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়। বাংলাদেশে পাক হানাদারদের বীভৎসতম কার্যকলাপ এতে বিধৃত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক, তথা, বিশ্বের প্রতিটি সভ্য নাগরিকের এটা জানা উচিত বলে এর পুনর্মুদ্রণ করা হলো।
—সম্পাদক, বিপ্লবী বাংলাদেশ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আজকে ঢাকার লঞ্চকে মুন্সীগঞ্জ হয়ে বাঁয়ে ঢাকার দিকে যেতে হলে থামতে হয়। চলতে চলতে হঠাৎ কখন দেখা যায় দুটো গানবোট এসে পাশে থেমেছে। যাত্রীদের মুখে ফুটে উঠেছে শঙ্কা আর ভীতির ছাপ। তারপর শুরু হয় তল্লাসী : এ স্টুডেন্ট হ্যায়। আওয়ামী লীগ হ্যায়। কাফের হ্যায়।
ওরা খোঁজে ছাত্র আছে কিনা। আওয়ামী লীগের কোন সদস্য আছে কিনা। কোন কাফের আছে কিনা। তল্লাসী শেষ হয়। শিকারের লোভে হন্যে ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর লোক চীৎকার করে পাশব আনন্দে। লঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় কজনকে। পদ্মা ধলেশ্বরী মেঘনার মোহনার কাছের চরে কতকগুলি মানুষ কাঁপে। আর গর্জন করে কয়েকটা রাইফেল। রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে কয়েকটা লাস। বাকী যাত্রীদের নিয়ে লঞ্চটি তখন দূরে চলে গিয়েছে। এমনি করে যাদের জীবন যায় তাদের ঠিকানা কেউ জানে না। কোন গ্রামের প্রতীক্ষাব্যাকুল মাতা পিতা ভাই বোনেরা প্রিয়জনেরা হয়ত কোনদিন আর ফেরে না। জানে না কেউ তাদের কাহিনী।
০০০
এমনি করে আবার কোন গাড়ি রাজধানী ঢাকার তের মাইল উত্তরে টঙ্গী পুলের কাছে দাঁড়ালে সঙ্গিনধারী ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী থামিয়ে দেয় গাড়িটিকে। আর সেই একই সুরের চীৎকারে শোনা যায়—‘ঠহরিয়ে’। সার করে দাঁড় করায় যাত্রীদের। জিজ্ঞাসাবাদ করে : আওয়ামী লীগকা কৌন আদমী হ্যায়? ছোটা আদমী নহী, বড়া আদমী হ্যায় আউর কাফের হ্যায় তো আও। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কোন নেতা বা কাফের থাকলে তাদের আর টঙ্গীর পথে ঢাকা যাওয়া হবে না। তাদের খোঁজ পেলে যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা-ও কেউ জানে না।
অথচ এমন ঘটনা নাকি ঘটেনি মুন্সীগঞ্জে, নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণে গজারিয়ায়। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে কাহিনী যিনি বলছিলেন তাঁর চোখে তখন পানি এসে গিয়েছে। তিনি প্রায় ভেঙ্গে পড়েছেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী হামলা শুরু করলে পর অসংখ্য মানুষ চলে এসেছিল আশ্রয় নিতে গজারিয়ায়। ভেবেছিল হয়ত খানিকটা স্বস্তিতে বাস করা যাবে। ৮ মে ভোর রাতে হঠাৎ সেখানে হামলা চালালো ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী।
কাউকে তারা প্রশ্ন করেনি। তারা খোঁজেনি আওয়ামী লীগের সদস্য, ছাত্র বা কাফের।
এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছে চার থেকে পাঁচশ। তরুণ শিশু নারী বৃদ্ধ বৃদ্ধা।
মে মাসের রোদ ঢাকা পড়েছে মেঘে। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে যিনি বলছিলেন তাঁর চোখে পানি টলমল করছে। শুধালাম : আপনার কেউ নিহত হয়েছে?—বাবা মা ভাইবোন সকলে।
আর তাঁর দিকে তাকাতে পারিনি। বিদায় সম্ভাষণ জানাইনি। মাত্র বলেছিলাম : আবার দেখা হবে।
মনে হয়েছিল আকাশের মতো একলা একটা মানুষ রাজধানীর রাস্তায় কাদের যেন খুঁজছে। রাজধানী থেকে যাদের নিয়ে গিয়েছিল তাদের আর ফিরিয়ে আনা হলো না।
।। দুই।।
মেঘনার পানি বাড়তে শুরু করেছে। খাল বিল নালা ঝিলে একাকার হয়ে গিয়েছে। মেঘনা যেন সমুদ্রের মতো বিশাল। বিশাল মেঘনার বুকে আনাগোনা করে ইয়াহিয়ার গানবোট। মাঝে মাঝে লঞ্চে সেনাবাহিনীর লোক নামে। খবর ছড়িয়ে যায় গ্রাম-গ্রামান্তে। চরের পাটক্ষেতগুলি কাঁপে। বাতাসে নুয়ে পড়ে কচি ধানের পাতা। কোন কোন প্রান্ত থেকে কান্না শোনা যায়। শোনা যায় চীৎকার। ধোঁয়ায় আকাশ আচ্ছন্ন করে দেয়। জ্বলে গ্রাম। পুড়ে ছারখার হয় গঞ্জ বন্দর হাট। নিদারুণ আক্রোশে যেন নিঃশেষ করতে চায় সবকিছু।
০০০
ঢাকা আর ময়মনসিংয়ের সীমান্তে এমনি করে দিন কাটে রাত আসে। লঞ্চের শব্দে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। নিঃশব্দে মানুষ বিশাল মেঘনার বুকে কান পেতে শোনে : ওটা কি যাত্রীবাহী লঞ্চ? কার্গো (মালবাহী)? না, সামরিক বাহিনীর জবরদখল করা লঞ্চ?
ঘুমহীন রাত্রি কাটে শঙ্কায়। এর মধ্যে কোন দিন ওপারের দিক থেকে সারারাত ধরে শব্দ আসে। চীৎকার কানে পৌঁছে আগুনে রাতের আকাশ লাল হয়ে যায় : গুলি চলেছে রামচন্দ্রপুরে। কতজন মারা গেছে? ৭৬ জন। কতজনকে নিয়ে গেছে? ৫০ জন। তারাও আর ফিরে আসেনি।
১২৬ জানের কাহিনী। কিন্তু ফরিদপুরের গোঁসাইর হাট, পালং নড়িয়া গোপালগঞ্জ, ঢাকার কলাকোপা দোহার নবাবগঞ্জ থানার খবর কি? খবর কি বরিশালের?
সঠিক কোন খবর নেই। গোঁসাইর হাট বলতে কিছু নেই। আছে ধ্বংসের একটি স্বাক্ষর। নড়িয়া ভোজেশ্বর পালং-এ গিয়েছিল সামরিক বাহিনী। গোপালগঞ্জ পুড়িয়ে দিয়েছে। মুকুন্দপুরের এক আখক্ষেতে গুলি করে মেরেছে তিনশজনকে। মাদারীপুর থেকে শুরু করে বরিশালের রাস্তা ধরে সামনের দিকে গেলে কারা আছে-কোথায় আছে-কোন্ বাড়ি আছে-কোন্ বাড়ি নেই ঠিকুজি আজও নেওয়া যায়নি। নেই শিকারপুরের বাজার। লুট হয়েছে উজিরপুরে। গুলি বর্ষিত হয়েছে বরিশালের আরতার পাড়ায়। গুলি চলেছে বরিশালের সদর মহকুমার কলসকাঠি আর বোয়ালিয়া হাটে। হাটের দিনে এ দুটি হাটকে ঘেরাও করে সেনাবাহিনীর লোক মানুষ মেরেছে পাখির মতো। রাখরগঞ্জ থানার শ্যাম মুকুজ্যের কন্যাটির খবর কেউ জানে না। খবর জানে না বারুইবাড়ির অসংখ্য মহিলার। খবর পাওয়া যায়নি ঢাকা জেলার মাণিকগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা জাতীয় পরিষদের সদস্য আনোয়ারুদ্দীন শিকদারের কন্যার। আনোয়ারুদ্দীন শিকদার আত্মহত্যা করেছে। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায় একদিনে গুলি করা হয়েছে ৪৫ জনকে। হাজার হাজার মানুষ রাত কাটিয়েছে ঢাকা জেলার কলাকোপা দোহার জয়াপাড়া মরিচা তুলসীখালির প্রান্তরে। (চলবে)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল