You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | স্বাধীনতার এক নাম—ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম —অধ্যাপিকা রেহানা বেগম | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১

স্বাধীনতার এক নাম—ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম

১৯৪৯ এ ষাট কোটি শ্রমিক কৃষকের দেশ রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদের বিপ্লবকে সফল করে তুলল। ১লা অক্টোবর জন্ম হ’ল বিপ্লবী চীন রাষ্ট্রের—চীন প্রজাতন্ত্র। এশিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯৫০ এর জানুয়ারী মাসে চীন ভিয়েতনামের স্বাধীন সরকার—“হো চি মিনের সরকার”কে স্বীকৃতি দিল। সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিও হো’র সরকারকে স্বীকৃতি জানাল। সঙ্গে সঙ্গে বৃটেন ও আমেরিকা দক্ষিণের “বাও দাই সরকার”কে স্বীকৃতি দিল। আন্তর্জাতিক জটিলতার আবর্ত্তে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ল ভিয়েতনাম।
ফরাসীরা মার্কিনীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য পেল। আর পেল ‍যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রচুর উৎসাহ। এমনিভাবেই আজকের মার্কিনী বর্বরতার সূত্রপাত হল সেদিন। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ এই রক্তাক্ত যুদ্ধনীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে লাগল। কমিউনিষ্টরা প্রকাশ্য ভাবেই যুদ্ধবিরোধী প্রচার চালাতে লাগল। কিন্তু যুদ্ধের শতকরা ৮০ ভাগ খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকা ভিয়েতমীনকে (ভিয়েতনামের মুক্তি বাহিনী) ধ্বংস করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইল।
১৯৫৩’তে ইন্দোচেীনের যুদ্ধের ভারপ্রাপ্ত প্রধান, জেনারেল নাভারে দিয়েন বিয়েন কু’তে ফরাসীদের এক দুর্জয় ঘাঁটি তৈরী করলেন। ভিয়েতনামের সর্বসমেত লোকসংখ্যা যত তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী সৈন্য মোতায়েন করা হ’ল মুক্তি যোদ্ধাদের খতম করে দেবার জন্য। ভিয়েতনামে যুদ্ধের দায়িত্ব নিলেন জেনারেল গিয়াপ। গেরিলা পদ্ধতিতে আর নয়, সামনা সামনি লড়াই হল। সমস্ত মানুষকে বিস্মিত করে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ফরাসী সৈন্যকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল ভিয়েতনামী সৈন্যরা। ৭ই মে, ১৯৫৪, ভিয়েতমীনরা জয়লাভ করল, ফরাসী বাহিনী পরাস্ত হল। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সর্বাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত এবং অর্থ সাহায্যে পরিপুষ্ট ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের এই শোচনীয় পরাজয় বিস্ময়কর হলেও, ইতিহাসে আবার প্রমাণিত হ’ল—স্বাধীনতার জ্বলন্ত আদর্শে উদ্দীপিত সহস্র সহস্র মানুষ যখন তার শত্রুর বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়াতে পারে তখন শুধু অস্ত্র আর অর্থের জোরে তাকে হারানো যায়না। দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধ স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। দিয়েন বিয়েন ফু’র প্রান্তরে সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল নতুন ইতিহাস।
কিন্তু মার্কিনী ধুরন্ধরেরা এত অল্পেই হার মানতে চাইলনা। মার্কিনী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডালেস নৌশক্তি ও বিমান শক্তি প্রয়োগ করে ভিয়েতমীনকে ধ্বংস করতে চাইল, কারণ ইন্দোচীন হাতছাড়া হয়ে গেলে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তাদের নীতির ভরাডুবি ঘটবে। কিন্তু ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স কেউই তাঁর প্রস্তাবে রাজী হলনা। ফ্রান্সে বিশেষ করে মাঁন্ডেস ফ্রাঁ ভিয়েতনামে যুদ্ধ শেষ করে, তার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাধান করবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। ইতিপূর্ব্বে কোরীয় সংকটের সমাধানের জন্য ১৯৫৪’তে জেনেভায় এক সম্মেলন আহ্বান করা হল। স্বভাবতঃই ৭ই মে তারিখে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে জয়লাভ করায় ভিয়েতনাম সম্পর্কিত আলোচনাই এই সম্মেলনে প্রাধান্য পেল।
৮ই মে শুরু হল জেনেভা সম্মেলন। এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কম্বোডিয়া, গণপ্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম, লাওস, ফ্রান্স, চীন, দঃ ভিয়েতনাম, রাশিয়া, বৃটেন এবং আমেরিকা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে এই সম্মেলনে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া এবং বৃটেন। আমেরিকা সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও সে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেনি এবং চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরও করেনি। ১৯৫৪’র ২১শে জুলাই জেনেভা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় :-

(১) ভিয়েতনামকে ১৭ ডিগ্রী সমান্তরাল রেখাই দুই ভাগে ভাগ করা হবে। উত্তরে ভিয়েতমীনের দখলে গণপ্রজাতান্ত্রিক ভিয়েতনাম, এবং সায়গণ সরকারের দখলে দক্ষিণ ভিয়েতনাম।
(২) তবে এই বিভক্তিকরণ স্থায়ী ভাবে নয়। ১৯৫৬’র জুলাই মাসে গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণ করা হবে এবং সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম আবার ঐক্যবদ্ধ হবে। সমস্ত নির্বাচন হবে আন্তর্জাতিক কমিশনে (International Commission) তত্ত্বাবধানে।
(৩) লাওস ও কাম্বোডিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করা হবে।
(৪) দুই ভিয়েতনামের কোথাও বিদেশী সৈন্য ঘাঁটি করতে পারবে না। বিদেশী সামরিক অধিকর্তার অবস্থান, বিদেশী অস্ত্র শস্ত্রের ঘাঁটি, সবই নিষিদ্ধ করা হল।
(৫) লাওস ও কম্বোডিয়ার সরকারও সামরিক ব্যাপারে ভিয়েতনামের মত রীতি নীতি মেনে চলবে।
(৬) ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীরা ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার মাটি থেকে তার সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
(৭) চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরিত সব দেশগুলোই ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার অর্থাৎ ইন্দোচীনের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ঐক্য এবং আঞ্চলিক সংহতি মেনে চলবে। (“to respect ther Sovereignty, the Independence, the Unity and the Territorial Integrity”)
(৮) কানাডা, পোল্যান্ড ও ভারতবর্ষকে নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক পরিষদ (International Control Commission) গঠিত হল। এই পরিষদ ভিয়েতনামে যথাযথ ভাবে উপরোক্ত বিধিগুলি পালিত হচ্ছে কিনা এইসব দেখাশুনা করবে। এই পরিষদের সভাপতি হ’ল ভারতবর্ষ।

১৯৫৪’র ২১শে জুলাই’র পর মনে হল এতদিনে ভিয়েতনাম স্বাধীনতা পেল। রক্তাক্ত যুদ্ধের হাত থেকে অব্যহতি পেয়ে এবার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু তা হলনা। ভিয়েতনামের মানুষকে আবার জীবনপণ করে লড়তে হচ্ছে, আজও সে লড়াই করছে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য। এবারের শত্রু—পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এবারের শত্রু—মানবতার শত্রু, সুখ শান্তি ও স্বস্তির শত্রু, সভ্যতা ও প্রগতির শত্রু—নির্লজ্জ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল