You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—প্রদীপ কুমার দাস

(৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১, হিলি রণাঙ্গন)
অনেক কথাই আজ মনের কাছে ভীড় করে দাঁড়ায়। জীবনে যাদের পাশাপাশি দীর্ঘপথ অতিক্রম করলাম তারা আজ কোথায়? অনেকেই তো হারিয়ে গেছে, কোন দিন আর সন্ধান মিলবে না তাদের। রমনার মাঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মার্কেট, গুলিস্তান সিনেমা—সব গুলোই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবার স্বপ্নের মত মিলিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটা বছর মনে হয় জীবনের পূর্ণতার মহান লগ্ন। আমি আজো পথ চলছি। সাথে আছে বিশ্বস্ত বন্ধু; যাকে আমি ছিনিয়ে নিয়েছি পাক শয়তানদের কাছ থেকে। বন্ধু’ এল-এম-জিটাকে যখন বুকে জড়িয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে রাতের বিশ্রাম নিই তখন মনে হয় মাকে জড়িয়ে যেন আমি ঘুমিয়ে আছি।
রমজান আমাদের দলের নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক কালের ছাত্র। ও আমার চেয়ে এক বছরের জুনিয়ার। দাদা বলে ডাকতো। আজ ঠিক মনে করতে পারছিনা কবে কখন প্রথম দেখা হয়েছিল, এবং কবে আমরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে গেলাম। আজ হিলি সেক্টরে আমরা মরণপণ যুদ্ধ করে চলছি। একের পর এক শত্রু সৈন্যদের খতম করে দুর্নিবার গতিতে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের সোনার বাংলাকে যারা শ্মশান করেছে তাদের আমরা কোনদিন ক্ষমা করবো না। যে ইতিহাস বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সৃষ্টি করে চলছি আগামী দিনের বংশধরেরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে সেসব কাহিনী, আর প্রেরণা পাবে দেশকে শোষণহীন, সুখসমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলার। বিশ্বের মুক্তিকামী দেশগুলোর মানুষ, যারা সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের কবলে আটক থেকে এখনো ধুঁকে ধুঁকে মরছে তারাও, প্রেরণা পাবে আমাদের বিপ্লবী বাংলার অকুতোভয় ছেলেদের মুক্তি সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করে। নাগ পাশের বন্ধন ছিন্ন করে যে স্বাধীনতাকামী মানবাত্মা চিরদিন মুক্তির পূজারী তারেই বহিঃপ্রকাশ আমাদের বাংলাদেশে। আমার লেখা ডায়েরীর পাতাগুলো হয়তো চিরদিন লোক চক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাবে—যে যায় যাকনা তবু লিখে যাচ্ছি বিক্ষুব্ধ মনের এলোমেলো কথাগুলো।
বাঘাযতীন, সূর্যসেন, তীতুমীর, জব্বার, বরকত, সামাদের দেশের ছেলে আমি। ওরা আজ অমর, ইতিহাস—পথের সৃষ্টি দিশারী—বিদ্রোহী জনতার মুক্তির অগ্রদূত। শয়তানদের কাছে মাথা অবনত না করে হাসিমুখে মরণকে বরণ করার মহান আদর্শ নিয়ে ওরা চিরদিন বেঁচে থাকবে। হিলির দক্ষিণ দিকের খাদেম আলী চৌধুরীর বড় বাড়ীটায় পাক আক্রমণকারীরা আমাদের আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে না পেরে আশ্রয় নিয়েছে।
রমজানের নির্দেশে আমরা মারমুখী হয়ে এগিয়ে চলেছি। খান সেনাদের সাথে আমরা এখন মুখোমুখী সংগ্রামে লিপ্ত। স্বাধীন বাংলার পতাকা দিনাজপুরের অনেক শহরেই এখন পতপত করে উড়ছে। হিলি অঞ্চল আজ আমরা দখল করবোই; ক্ষয়ক্ষতি যাই হোক না কেন কিছু আসে যায় না। তিন দিক দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছি। আমাদের মুক্তি ফৌজের অপর এক বাহিনী পার্বতীপুরের দিকে প্রবল ভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। সেখানের গোলা গুলির প্রবল শব্দ আমরা ঘনঘন শুনতে পাচ্ছি। আমাদের দখল করা চীনা হাল্কা কামানগুলোর ১৫ পাউন্ড ওজনের গোলা বর্ষণে সমস্ত অঞ্চলটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই শব্দগুলো মনে যেন কেমন একটা প্রেরণা জোগায়, বুকের রক্ত যেন উন্মাদনায় নেচে উঠে। হাল্কা মেসিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে রমজান কয়েকজন সহযোদ্ধার সাথে পূর্ব দিক দিয়ে ক্রলিং করে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগিয়ে চলছে। শয়তানেরা বাঙ্কার থেকে আমাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল তাই ওদের বিশেষ ক্ষতি আমরা দূর থেকে করতে পারছিলামনা।
পশ্চিম দিকে রয়েছে ধীর প্রবাহিনী শীতের যমুনা। বাকি তিন দিক দিয়ে আমাদের আক্রমণ প্রবল ভাবে চলছে। অন্ধকারের মধ্যে অন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গোলাগুলির ফ্লাশিংয়ে মাঝে মাঝে গাছপালাগুলো দেখা যাচ্ছে। কতক্ষণ আমাদের এই মারমুখী যুদ্ধ চলছে সঠিক বলা মুস্কিল। তবে হিলি যখন আমাদের পুরো দখলে এসেছে তখন রাত প্রায় শেষ। একশো পাক সেনা ও ৫০ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। প্রচুর চীনা ও আমেরিকান আগ্নেয়াস্ত্র আমরা এখান থেকে দখল করে নিয়েছি। যমুনার পারে আমরা সকলে এসে মিলিত হচ্ছি। কিন্তু রমজান ও বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ দিকের রণাঙ্গণ থেকে ফিরছে না।
কিছুক্ষণ পরে সকলের চিন্তা বিষাদে পরিণত হল। আমাদের জয়ের আনন্দ নিমেষে মিলিয়ে গেল। যা ভাবিনি তাই বাস্তব নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। রমজানের মুমূর্ষু দেহটা সাথী সহযোদ্ধারা ধরাধরি করে নিয়ে এসেছে। ক্রোলিং করে এগোবার সময় মাথাটা একটু বেশি উপরে উঠে গিয়েছিল আর সেই অসতর্ক মুহূর্তে জয়ের ঠিক প্রান্ত সীমায় এসে শত্রুর বুলেট হেলমেট হীন মাথায় এসে লেগেছে।
সমস্ত মুখমন্ডল রক্তে লাল হয়ে গেছে। আমার বুকের মধ্যে তখন কি হচ্ছিল তা বোঝাতে পারবো না। মাথায় বাঁধা রুমালটা দিয়ে চোখ ও মুখের কাছের রক্ত মুছিয়ে দিযে দেখালাম তখনো চোক্ষের সে নির্ভীক দৃষ্টির একটুও পরিবর্তন হয়নি—ভয়ের বিন্দুমাত্র চিহ্ন সেখানে নেই। যমুনার জল একবার ওর মুখে এনে দিলাম তারপর সব শেষ। রমজান আমাদের মাঝে নেই! ওর আত্মত্যাগ যেন কোনদিন ব্যর্থ না হয়, রমজানের রক্তে ভেজা মাটি হাতে তুলে নিয়ে মাথায় দিলাম। যমুনার তীরে সাথী সহযোদ্ধা, দলনেতা, বিশ্বস্ত ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুকে কঠিন হাতে কবরে শুইয়ে দিলাম। চোখের জল ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। দেশকে পুরো স্বাধীন করে হিসেব নেবো রমজানের মত আর কত সাথীকে হারিয়েছি। বিদায় বেলায় বন্ধুর জন্য রেখে গেলাম এক দীর্ঘশ্বাস!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!