You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | বাংলার বঞ্চনা- মীর্জা ওয়াজেদ আলী | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলার বঞ্চনা
মীর্জা ওয়াজেদ আলী

‘স্বাধীনতা’র ২৪ বছর পরে আজ আবার আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। আমরা বলতে বাংলাদেশের বাঙালীরা। কিন্তু কেন? ২৪ বছর পরে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অর্থ কি বদলে গেল? না, অভিধানে যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতার অর্থ একই। কিন্তু বাঙালীদের কাছে আজকের স্বাধীনতা আর ২৪ বছর আগের ‘স্বাধীনতা’র আকাশ-পাতাল তফাৎ। স্বাধীনতার অর্থ আর ব্যাখ্যা যদি কেউ জানতে চায়, তবে সে আসুক বাঙালীর কাছে।
সোনা পুড়ে যেমন খাঁটি হয় তেমনি বিগত ২৪ বছর ধরে এ পর্যন্ত দগ্ধ হতে হতে বাঙালীদের কাছে খাঁটি সোনার মত খাঁটি স্বাধীনতা ধরা পড়েছে। আমরা স্বাধীনতা বলতে বুঝি একাধারে ভাষাগত, সাহিত্যগত, সাংস্কৃতিক, বাকস্বাধীনতা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
একথা আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে যে স্বাধীনতার মোড়কে আমরা পেয়েছিলাম এক ঔপনিবেশিক শাসনের জগদ্দল পাথর। সে হলো পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতা। এই উপনিবেশবাদের চারাগাছটি ২৪ বছরে মহীরুহে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার শিকড় বিস্তার করেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশই ছিল গোটা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আর সেই বুনিয়াদের এক একটি ইট হলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এই বুনিয়াদের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো পশ্চিম পাকিস্তানের জৌলুসপূর্ণ চাকচিক্যময় বিরাট অর্থনৈতিক অট্টালিকা। কিন্তু এই অট্টালিকার ভার বহন করা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠলো, তারা বিদ্রোহ করলো।
পাকিস্তান নামক সেই মৃত রাষ্ট্রটির জন্মলগ্নেই এই ঔপনিবেশিকতার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার উলঙ্গরূপে প্রকাশ পেলো বিশেষ করে ১৯৫৪-৫৫ সালের পর থেকে। অর্থাৎ যখন থেকে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে তার অর্থনীতিক কাঠামোটিকে সাজানো শুরু হলো। এ সমস্ত নীতিকে সংক্ষেপে একটা গাভীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তা সেই গাভী যে বিচরণ করতো বাংলাদেশের মাটিতে, বাংলাদেশই করতো তার পরিচর্যা, কিন্তু দুধ দিত পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই দুধের শুধু ছিঁটেফোঁটাই পড়তো বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্যে।
১৯৫৪-৫৫ সাল থেকে পাকিস্তানের পাঁচসালা পরিকল্পনাগুলির রূপায়ণ হতে থাকে। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে দুই অঞ্চলের বৈষম্য। শুরু হলো সুপরিকল্পিতভাবে অর্থনৈতিক শোষণ। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বহির্বাণিজ্য, অন্তর্বানিজ্য, ব্যাঙ্ক, বীমা ইত্যাদি সকল অর্থনৈতিক শাখায় বাংলাদেশের বঞ্চনার কালো ছায়া নেমে আসতে থাকে। শুরু হলো বাংলাদেশ থেকে সম্পদ স্থানান্তরকরণ। সেই সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমি হলো শস্য-শ্যামলা, প্রতিষ্ঠিত হলো ভারী শিল্প ও কারখানা। আর সেই সমস্ত শিল্প কারখানায় উৎপন্ন দ্রব্যাদির বাজার হলো বাংলাদেশ। তার ওপর রয়েছে প্রতি বৎসরের বাড়তি ট্যাক্সের বোঝা। সব মিলিয়ে সাধারণ বাঙালীর অবস্থা হলো দুর্বিসহ। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আয় বৃদ্ধির রইলো না কোন সামঞ্জস্য। ৮০ টাকা বেতনে শ্রমিককে কিনতে হলো ৫৫ টাকা মণের চাল। সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষের মাত্রা বেড়েই চললো।
তাই আমরা দেখতে পাই গণআন্দোলনগুলিতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক জীবন তুচ্ছ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কারণ তারা বুঝেছিলো অনাহারে আর অর্দ্ধাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে গুলি খেয়ে মরা ভালো। তারা আজও লড়ছে। আজ হলো সংগ্রামের শেষ ধাপ—স্বাধীনতা সংগ্রাম।
আজ স্বাধীনতার পরমলগ্নে আমার দেশের কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি হবে? আগের মতোই কি দুবেলা অন্নের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করবো? ২৫ টাকা মণে পাট বিক্রি করে ৫০ টাকা মণে চাল কিনবো? শীতের দিনে বস্ত্রের অভাবে আবারও কি ঘুঁটে জ্বালিয়ে বসে থাকতে হবে বিনিদ্র রজনী? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। না আমি একথা বলতে চাইনা যে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দেশ স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু এটুকু আমরা নিশ্চয়ই আশা করবো যে এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকেরা রক্তচোষা জোঁকের মতো বাংলার যে সম্পদ অপহরণ করছে তার থেকে নিশ্চয়ই রেহাই পাবো। আর সেই সম্পদ আমাদের নিজস্ব কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খাটিয়ে অর্জিত আয়কে সুষম বন্টনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে ধীর ধীরে সহজতর করতে পারবো। দুবেলা অন্নের জন্য যেন বিদেশের কাছে হাত না পাততে হয় তার ব্যবস্থা আমরা নিশ্চয়ই করতে পারবো। ক্রমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আমরা সচেষ্ট হবো। (চলবে)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল