বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১
স্বাধীনতার এক নাম : ভিয়েতনাম—ভিয়েতনাম
সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তিতীর্থ ভিয়েতনাম। সমস্ত সংগ্রামী মানুষের আদর্শ ভিয়েতনাম। তাই দিকে দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের কন্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে একটি নামে “আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম।
খুব বড় দেশ নয়, খু্ব একটা লোকসংখ্যাও নয় এই ভিয়েতনামে। আনাম, টংকিন ও কোচিন চায়না এই তিনটি প্রদেশে নিয়ে গড়ে উঠেছে যে দেশ, আজ তার নাম ভিয়েতনাম। সাধাসিধে ছোট্ট মানুষগুলো, আমাদের মত ভাত, মাছ খেতে ভালবাসে; দেখতে কিছু অসাধারণ নয় কিন্তু নির্ভেজাল দেশপ্রেমের আগুন ঘা তাদের বুকে জুগিয়েছে অদম্য সাহস তাতেই তারা হয়ে উঠেছে অসাধারণ।
দেশের মধ্য দিয়ে চলে গেছে মেকং নদী। তার পলি মাটিতে ফলেছে অজস্র ফসল, আর নদীর তীরে অনেক পুরোনো কালে গড়ে উঠেছিল এক বিরাট সভ্যতা—আনামী সভ্যতা। তাই এই দেশের ইতিহাস পুরোনো—পুরোনো এর ঐতিহ্য। আপন স্বাধীনতাও রক্ষা করেছিল অনেক দিন। সাম্রাজ্যবাদী লোভের শিকার হল ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে—লোভীর নাম ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ—ইংরেজের দোসর। ইন্দোচীনের (ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্বোডিয়া) উপর ফরাসী আধিপত্য চলেছে ১৯৪৫ পর্য্যন্ত।
১৯১৭’র রুশ বিপ্লবের প্রভাব কম বেশী পরাধীন সব দেশের উপরই পড়েছিল। ইন্দোচীনেও বিপ্লবের হাওয়া এসে পৌঁছেছিল। ১৯১৯’র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই সন্ধিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উইলসন যে চৌদ্দ দফা শর্ত দিয়েছিলেন তার একটি ছিল Right of self-determinations. (ছোট ছোট রাজ্যগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার)। ভিয়েতনামের এক যুবক জোরালো ভাবে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ভিয়েতনামের জন্য দাবী করে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে উইলসনের কাছে এক দাবী পত্রের সনদ পেশ করেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ একে গ্রাহ্য করেনা। এই যুবকটি ফরাসী দেশের সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য ছিলেন। লস্করের বেশে গোপনে জাহাজে করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফরাসী দেশে চলে যান। ঐখানেই তিনি কমিউনিস্ট হন, এবং সোভিয়েত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য সোভিয়েত দেশে যান। এখানে তিনি লেনিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তারপর দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী মানুষদের নিয়ে দল তৈরী করেন। ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ভিয়েতনামে তৈরী হয় মুক্তি বাহিনী। এই যুবকটির নাম সমস্ত মানুষের একটি ভালবাসার নাম—নাম তার হো-চি-মিন্।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া শুরু হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৩৯’এ শুরু হয় যুদ্ধ। ১৯৪৫’এ সামরিক ভাবে (Military Coup) গোটা ইন্দোচীনকে দখল করে নেয় জাপানী সাম্রাজ্যবাদ। প্রভুত্বের হয় হাত বদল। ছিল সাম্রাজ্যবাদী ফরাসীদের দখলে, চলে গেল ফ্যাসীবাদী জাপানের হাতে। ভিয়েতনামের মানুষ প্রানপনে ফ্যাসীবাদকে রুখতে চেষ্টা করেছে, পারেনি। কিন্তু ফ্যাসীবাদী জাপান ভিয়েতনামকে বেশীদিন পদানত রাখতে পারেনি। ১৯৪৫’এ ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। আগষ্ট মাসে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৪১ থেকেই ভিয়েতনামের আন্দোলন হয়েছে জোরালো। এই সময় হো-চি-মিন ভিয়েতনামের সমস্ত জাতীয়তাবাদী মানুষকে নিয়ে সম্মেলন করেন। এই সম্মেলনেই জন্ম লাভ করেন “League for the Independence of Vietnam” এই সংগঠনে কমিউনিস্ট এবং অকমিউনিস্ট জাতীয়তাবাদীরা এক সঙ্গেই কাজ করে। সমর অধিনায়ক জেনারেল গিয়াপের নেতৃত্বে হোচিমিন এক গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৯৪৫’এ জাপান ইন্দোচীন দখল করে এবং আনামের রাজা বাও দাইকে (Bao Dai) তাদের তাবেদার সরকারের প্রধান পদে নিয়োগ করে। হোচিমিন এই সরকারকে অস্বীকার করে এবং বাও দাইকে এই সরকার থেকে পদত্যাগ করে তাদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানান। ১৯৪৫’এ হোচিমিন এক সরকার গঠন করেন। ২২শে আগষ্ট তারিখে।
জাপান আত্মসমর্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্স আবার তার পুরোনো উপনিবেশ দখল করতে চেষ্টা করে। ফরাসী প্রেসিডেন্ট দ্যগল উপনিবেশগুলো পুনরুদ্ধার করার পথে তার মত দিলে ফ্রান্স ভিয়েতনামে অনুপ্রবেশ করার তোরজোর শুরু করে দেয়। যুদ্ধকালীন মিত্রপক্ষীর শক্তিবর্গের (রাশিয়া, আমেরিকা, বৃটেন) সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চীন সৈন্য ভিয়েতনামের উত্তরে এবং ইংরেজ সৈন্য দক্ষিণ দিকে জাপানীদের সঙ্গে লড়াই করে ভিয়েতনামের মাটি থেকে বিতাড়িত করে। তারপর চীনারা হোচিমিনের সরকারকে স্বীকার করে দেশে ফিরে যায়। আর ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে ফরাসীরা ভিয়েতনামের দক্ষিণ দিকে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ফ্রান্স ১৯৪৫’এ যুদ্ধে নামতে পারেনা। কারণ তখন ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ছিল কমিউনিষ্টদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা; তাঁরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় ভাবে তাঁদের মত প্রকাশ করেন। ১৯৪৬’র মধ্যে মার্কিনীদের চাপে ফ্রান্স কমিউনিষ্টদের সরকার থেকে বিতাড়িত করে এবং যুদ্ধের সপক্ষে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভ করে।
ফ্রান্স ১৯৪৫’এ হোচিমিনকে প্রস্তাব দেয় যে তিনি ফরাসী দেশের অন্তর্ভূক্ত থেকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেন কিনা? হো-চি-মিন দৃঢ় ভাবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন; এবং আসাম, টংকিন, কোচিন চায়নাকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রজাতান্ত্রিক ভিয়েতনাম গঠনের প্রস্তাব রাখেন। তার উত্তরে ফ্রান্স ১৯৪৬’র নভেম্বরে উত্তর ভিয়েতনামের হাইকং শহরে বোম-বর্ষণ করে। ডিসেম্বরে গিয়াপের নেতৃত্বে এক বাহিনী টংকিনে ফরাসী বাহিনীকে আক্রমণ করে। শুরু হয় যুদ্ধ।
যুদ্ধ চালাতে চালাতে ফরাসীরা বাও দাইকে হাত করার চেষ্টা করে। ১৯৪৯’র মার্চে বাও দাই ফ্রান্সের সঙ্গে তাদের শর্তানুযায়ী এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। বৃটিশ অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য নিয়ে ফরাসী বাহিনী ভিয়েতনামে প্রচন্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। ভিয়েতনামের মানুষ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন পণ করে লড়াইয়ে নামে। হো-চি-মিন গেরিলা বাহিনীকে নিয়ে শহর ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ১৯৪৬’এ রেডিওতে হো-চি-মিন ঘোষণা করেন ; “আমাদের দেশ আক্রান্ত। সমস্ত স্বাধীনতাকামী, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াও। আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন। এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরা লড়াইয়ে নেমেছি।”
পৃথিবীর সবাই শুনল। কিন্তু সেদিন ভিয়েতনামের পাশে দাঁড়াবার মত অনেক দেশ ছিলনা। এখানে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলাদেশের ছাত্রদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা। ১৯৪৬—তখন ভারতবর্ষ স্বাধীন নয়। দুই বাংলা এক। দুই বাংলার ছাত্রছাত্রীরা হো’র এই আহ্বানে স্কুল কলেজে ধর্মঘট করে মিছিল করে এলো রাস্তায়। বাংলাদেশের সর্বত্র সেদিন ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করল। তাঁদের দাবী দমদম বিমান বন্দর দিয়ে কোন ফরাসী উড়োজাহাজ যেতে দেবোনা। কলকাতার সিনেট হলে ছাত্ররা সমবেত হলেন পুলিশ গুলি চালালো। সিনেট হলের সিঁড়ি ধীররঞ্জন ও সুখেন্দু বিকাশের রক্তে লাল হল। ময়মনসিংয়ের ছেলে অমলেন্দু প্রাণ হারাল, অনিতা আহত হল। ক্রুদ্ধ সিংহের মত ছাত্ররা গর্জন করে উঠল। সেই গর্জনের সামনে পরাক্রান্ত বৃটিশ রাজও ছ’ মাসের জন্য দমদম বিমান বন্দর বন্ধ করে দিল ফরাসীদের জন্য। পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে পারেনি, কিন্তু এতে ভিয়েতনামের সেদিন অনেক উপকার হয়েছিল।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল