You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১

প্রতি ঘরে, প্রতি মনে, দুর্গ

মুক্তিযোদ্ধারা আজ আঘাতের পর আঘাত হানছে, সঙ্গে সঙ্গে শুধু পাক হানাদারেরা নয়, সারা দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোও উন্মত্ত হয়ে উঠছে। ওরা উদ্গ্রীব হয়ে দেখছিল পাক শোষকের পশু শক্তির পাশব প্রয়োগ, ওদের আশা ছিল ঐ প্রচন্ড বর্বর নিপীড়নে বাঙালীর স্বাধীনতা কামনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে নিস্তেজ নির্বাপিত হয়ে পড়বে, বাঙালী মাথা হেট করে ঢুকবে দাসত্বের কারাগারে।
তা হল না। আঘাতের পর আঘাত হানছে মুক্তিবাহিনী, তাতে যেমন হানাদারদের দেহ রক্তাক্ত হয়ে উঠছে তেমনি আকুঞ্চিত হচ্ছে দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদের গলিত দেহ। সমগ্র মানুষজাতিকে দাসত্বের শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করবার জন্য দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের যে লৌহবেষ্টনী গড়ে উঠেছিল, একে একে তা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। নিরবচ্ছিন্ন অগ্নিবর্ষণ করেও ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিন্দুমাত্র খর্ব করা যায়নি। আলজেরিয়াকে দমন করা যায় নি কিউবাও দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ হয়ে সাম্রাজ্যবাদের শিকল কেটে বেরিয়ে এসেছে।
আজ এসেছে এই জগৎব্যাপী মুক্তি আন্দোলনের পুরোভাগেবাংলাদেশ—সেই বাংলাদেশ যার মানুষ এই সেদিনও ছিল নিরীহ নিরস্ত্র। আজ তার দেহে অক্ষৌনিহীর বল। আজ তাকে দেখে দুনিয়ার শোষিত জনসাধারণের মুক্তি আকাঙ্ক্ষা বেড়ে উঠছে। দেশে দেশে সাধারণ মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ বাংলাদেশের লোকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে চাইছে। জগৎব্যাপী মুক্তি সংগ্রামের নূতন স্ফুলিঙ্গ—এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম—যেমন বাংলার গ্রামে গ্রামে জ্বলে উঠছে, তেমনি তা যে আরও দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়বে না, তা কে জানে? কোথায় সাম্রাজ্যবাদের কোন্ সাজানো বাগান ছারখার হয়ে যাবেনা বাংলাদেশের প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্তে? আজ যদি অস্ত্রবলে আর শোষিত জনকে দাবিয়ে রাখা না যায়, সারা দুনিয়ার অস্ত্রাগার থেকে আহৃত মারণাস্ত্রে সজ্জিত ইয়াহিয়ার লম্পট শোষকবাহিনী যদি বাংলাদেশের প্রায় নিরস্ত্র মানুষের হাতে কুকুরের মত প্রহৃত হয়, তবে মানুষকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ক্রীতদাস করে রাখবার দিন ফুরোবে না? তখন কোথায় থাকবে শোষিত মানুষের ‍রুধির সিক্ত ক্লেদসৃষ্ট সম্পদে মুষ্টিমেয় শোষকগোষ্ঠির বিলাস ব্যসন?
তাই আজ দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি উৎক্ষিপ্ত। তারা জোট বাঁধছে বাংলাদেশকে নিরস্ত্র করতে, বাঙালীর উদ্যত মুষ্টিকে নিরস্ত করতে, তার কাঁধে দাসত্বের জোয়াল চাপিয়ে দিতে।
এই হিংস্র আক্রমণে মুক্তিবাহিনী বিচলিত হবে না। তাদের গতি অব্যাহত থাকবে, তাদের লক্ষ্য থেকে তাদের চোখ সরবে না। কিন্তু আজ এই যুদ্ধ শুধু মুক্তিবাহিনীর নয়—এ যুদ্ধ সারা বাংলাদেশের। তাই সমস্ত বাংলাদেশের জনমানসকে আজ শাণিত তরবারির মত তীক্ষ্ম করে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ : প্রতিটি ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে আর সে দুর্গের কেন্দ্র হবে প্রতিটি জাগ্রত উদ্বুদ্ধ বাঙালী। তাদের জানতে হবে এ যুদ্ধে তাদের প্রত্যেকের কী অংশ। তাদের স্পষ্ট জানতে হবে কোথায় কখন তাদের কী দিতে হবে, তাদের বহুমুখী প্রয়াস কতগুণে বাড়িয়ে তুলতে হবে।
আজ দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার বিশ্বব্যাপী প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে তার ভাড়াটে প্রচারকদের বাকচাতুর্যে বাঙালীর মনকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করবে, তাকে পিষে মেরে ফেলবার ভয় দেখাবে তাকে মিথ্যা আশা দেখাবে, লোভাতুর করতে চেষ্টা করবে। কখনো আওড়াবে শান্তির বাণী—এমন শান্তি যাতে ইয়াহিয়ার হাতে থাকবে চাবুক, আর বাঙালী হয়ে থাকবে পিছ-মোড়া। কখনো দেখাবে বোমার ভয়, দুর্ভিক্ষের ভয়। কখনো দেখাবে দাসত্ববরণের পুরস্কার—উৎকোচ।
কিন্তু সব কৌশল নিষ্ফল হবে যদি প্রতিটি বাঙালী বোঝে যে আজ বিশ্বে শোষণের অন্তিম মুহূর্ত্ত। এই সেদিনও চীনই বলেছে আজ প্রতিটি জাতি চায় স্বাধীনতা, প্রতিটি শোষিত চায় মুক্তি—তাদের আর কোনো কামনা নেই। ঠিক কথা, তাই বাঙালী চায়, বিদেশী পাক শোষকের পরাধীনতার লুপ্তি, চায় বাঙালীর জাতীয় স্বাধীনতা, এবং সর্বপ্রকার শোষণের অবসান। যেদিন প্রতিটি বাঙালীর মনে এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাবে যে তার শক্তি এমন এক বাংলার জন্ম দেবে যা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত, সেদিন গড়ে উঠবে প্রতিটি ঘরে দুর্গ। সেদিন আর দূরে নয়। সেদিন কাছে এগিয়ে আনছে মুক্তিবাহিনীর অমর দৃষ্টান্ত।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!