বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
নভেম্বর ৩০, করাচীর সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যটকদের যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। এই সীমান্তের বেশ কিছু অংশ পড়ছে চীনের সিন কিয়াং প্রদেশের সঙ্গে। এই অঞ্চল কাশ্মীরের সীমান্তের পশ্চিমে এবং কারাকোরামে গিরিপথ এর অন্তর্ভূক্ত। এই সংবাদ থেকে মনে হতে পারে চীন পশ্চিম পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহা্য্য করবে এই সীমান্ত মারফৎ—কিন্তু চীন প্রকাশ্যভাবে এরকম কোন বিবৃতি আজ পর্যন্ত দেয়নি। এটা কি তবে ইয়াহিয়ার আশা মাত্র?
আরো প্রকাশ দুই হাজার ছাত্র রাওয়ালপিন্ডিতে ভারতে সঙ্গে “জেহাদ” এর দাবী করে মিছিল করেছেন। কোথায় ছিলেন এই ধর্মপ্রাণ ছাত্ররা যখন পাক হানাদাররা বাংলার মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করে পাকিস্তানের কবর রচনা করেছে? এরা এসে দেখে যাক বাংলার মসজিদ কিভাবে তারা ধ্বংস করেছে, কিভাবে মসজিদের ওপর বাঙ্কার তৈরী করেছে।
করাচীর ইংরাজি দৈনিক ডেইলি নিউজ প্রস্তাব করেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সকল সোভিয়েট রাশিয়ান নাগরিককে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। সেখানে তৈল ও গ্যাস এর খনি সংক্রান্ত কাজে যুক্ত অনেক সোভিয়েট নাগরিক আছেন।
ইয়াহিয়ার দশদিন বাদে যুদ্ধে যাবার প্রস্তাবের ছয়দিন চলে গেছে। এই মাতাল, লম্পট জঙ্গীকর্তার কথাবার্ত্তায় শালীনতা বা অর্থ আর আশা করা যায় না। ভারতীয় সৈন্যরা বয়ড়ার গরীবপুরে এবং দিনাজপুরের হিলিতে পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছেন বাংলাদেশের মাটিতে ঠিকই। কিন্তু ট্যাঙ্ক নিয়ে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিবাহিনীর সমর্থকদের হত্যার কুচক্রান্ত ভারতীয় সেনা আর বসে বসে প্রত্যক্ষ করতে রাজী নয়। পাকিস্তান রেডিওর মত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর তফাৎ যদি পাকসৈন্যও মানতে ভুলে যায়—তাহলে তাদের সীমান্ত পার হয়ে আসাও বিচিত্র নয়। ভারতের নিরপরাধ মানুষ ও শরণার্থীদের জীবন সংশয় দূর করার জন্য ভারতীয় সৈন্য এই ট্যাঙ্ক ও প্লেন বিধ্বংসী কর্মসূচী নিয়েছে। পূর্ববঙ্গে কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের অনুপ্রবেশের দাবী এই পরিপ্রেক্ষিতে সবৈর্ব মিথ্যা। সেখানে খুলনা, যশোর, কুষ্ঠিয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও পুরানো ঢাকার জয়যাত্রা মুক্তিবাহিনীর নিজের কীর্তি।
০০০
পাকসৈন্য আজ মুক্তিবাহিনীর সামনে দিশাহারা হয়ে পালাচ্ছে। এবং গত দশদিনে যে সংখ্যক পাকসৈন্য খতম হয়েছে, গত ছ-মাসে তা হয়নি। অথচ যারা মুক্তিফৌজের সঙ্গের ঘনিষ্ঠ তাঁরা জানেন ভারতীয় সৈন্য বা অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়নি এই গত দশদিনেও। আসলে পাকসৈন্যের মনোবল গেছে ভেঙে। সাধারণ মানুষের রোষ ও ঘৃণা, তাদের অসহযোগিতা ও মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আঘাতে ক্লিষ্ট হয়েছে খানসেনারা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর সৈন্য বা অস্ত্র এদিকে আসছেনা। এই সমস্ত দেখে তাদের যুদ্ধ করার উৎসাহ ও সাহস গেছে কমে।
০০০
আপনার পুরনো বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকা দেখুন। ২১শে নভেম্বর সংখ্যায় সংবাদ রয়েছে বসন্তপুর-কালিগঞ্জের ২০ ঘন্টা মুক্তিযুদ্ধের খবর। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে একহাজার মুক্তিযোদ্ধা দুইহাজার পাকসৈন্যকে বসন্তপুর থেকে সরিয়ে দেয়। এই পাকদের ছিল এইচ.এম.জি. ও এম.এম.জি। তবুও তাদের অভাব ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্রর—মনোবলের অভাব।
এই অঞ্চলে ১৪ই নভেম্বর শ্যামনগরে ২ জন পাকসেনা ও ৬ জন রাজাকারের খতমের সংবাদ বেরোয়। ৩১শে অক্টোবর শ্যামনগর—কালিগঞ্জ থানায় ৩ জন খানসেনা খতমের খবর বেরোয়। ১০ই অক্টোবরে মিন্টু বসু “শ্যামনগর কালিগঞ্জ দুর্জয় ঘাঁটি কিন্তু…” তার ওপর মুক্তিবাহিনীর আঘাত প্রত্যক্ষ করে বিপ্লবী বাংলাদেশে লেখেন। সেসময়ে ক্যাপ্টেন হুদা বসন্তপুরে স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ উড়িয়ে আসেন। আরো আগে ১৯শে সেপ্টেম্বরের বিপ্লবী বাংলাদেশ এ দেখুন কালিগঞ্জে দুঘন্টা যুদ্ধে উদ্ধার করা একটি জীপের ছবি—যা ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে ৩ জন সেনা খতম ও ৭ জনকে আহত করে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা। তাহলে আজ নয়—বহুদিন কালিগঞ্জ-শ্যামনগর ও বসন্তপুরের পাকসেনারা দেখেছে বিভীষিকার মত তরুণ হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার দুর্বার আঘাত। এবারের ঈদের দিনে আবার তারা আসবে শুনে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ২০ ঘন্টা যুদ্ধের পর তারা তাদের দলবলসহ পালায়। নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচে সাধারণ মানুষ। আমি সেদিন গিয়েছিলাম বসন্তপুর ও কালিগঞ্জ দেখতে। দেখলাম পাকা ধান ঝরে যাচ্ছিল। মহানন্দে চাষীরা তা কেটে ঘরে তুলছে। মাছ, ডিম, তরিতরকারী এসেছে বাজারে। ওষুধের দোকানে দোকানদার বললেন “৭০০০ জরিমানা দিয়ে জান বাঁচিয়েছি। পাক দস্যুরা থাকাকালীন দোকান খুলিনি। মানুষ ওষুধ কিনতও না। ভাবত বাঁচাও যা, মরাও তা। এখন তো সবই অন্যরকম।”
মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলুক। দেশ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচুক। সর্বাঙ্গীণ মুক্তির দিন, স্বাধীনতার দিন আর বুঝি বেশি দেরী নাই।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল