বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১
রক্ত শপথ
—বিপ্লবী পথচারী
আট মাসের পথ পরিক্রমায় অনেক কিছুই দেখেছি আর অনেক কিছুই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। কত চেনা মুখ চির তরে হারিয়ে গেল আর কত অচেনা মুখ আজ চারি দিকে ভীর করে আছে। আমরা সৈনিক। সৈনিকদের কোনদিন স্থান, কাল ও পাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে নেই। সীমার বন্ধন ছিন্ন করে অসীমের মধ্যে ছোট ছোট স্বার্থের হানাহানি চিরতরে হারিয়ে যায়। একদিন ছিল যেদিন বরিশালকে কেন্দ্র করেই আমার চিন্তাধারা গড়ে উঠেছিল আর এই জায়গাটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় আজ কিন্তু সারা বাংলা দেশের মধ্যে ক্ষুদ্রত্তের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ মুক্তি যোদ্ধারা আজ আমার সবচেয়ে প্রিয় আত্মীয়। টুকরো টুকরো শরতের মেঘের মত মনের আনাচে কানাচে কত স্মৃতিই ভেসে ওঠে। পথের দেখায়, কত ভাই বোনদের দুঃখ বেদনার কথা শুনে মর্মাহত হয়েছি আবার পথে বেরিয়ে আরো করুণ বেদনাময় বিভৎস কাহিনীর সাক্ষ্য বহন করে আগের গুলো ভুলে গেছি। ছোট বেলায় ফরাসী বিপ্লবের শিশু সংস্করণের একটা বইয়ে পড়েছিলাম—রক্ত মূল্যে কেনা জিনিস রক্ত দিয়েই মানুষ রক্ষা করে। ফরাসী বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে একথা পরবর্তি সময়ে কতটা সত্যি হয়েছিল সে কথা ইতিহাসের সব ছাত্রেরই জানা আছে। আসল কথা হল দেশের সব মানুষ অন্তরের সাথে জিনিসটাকে কতটা গ্রহণ করতে পেরেছে তার মধ্যেই অনেকাংশে নিহীত থাকে মুল লক্ষ্যের যথার্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা শরীক হয়েছেন এবং আমিও যাদের সাথে সাথী সহ-যোদ্ধা হয়ে দিগন্ত প্রসারিত বাংলার মাঠ, ঘাট ও পথ প্রান্তর অতিক্রম করে চলছি তারা অনেকেই কিন্তু খুব গভীরে গিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণের মধ্যে যেতে চায়না। কিন্তু একটা সাধারণ সত্য তাদের কাছে স্পষ্ট সেটা হল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এ প্রশ্নে কিন্তু সবাই এক মত—এখানে কোনরূপ দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। কিছু কিছু এলোমেলো ঘটনার কথা এখানে তুলে ধরছি যদিও কোন রূপ তথ্য-বহুল কথা এর মধ্যে নেই। যারা সব কিছুর মধ্যে তথ্য খোঁজেন তাদের কাছে এর কোন মূল্যও নেই। পথ চলতে গিয়ে যে সব পথ ঘাটের মানুষের সাথে মিশেছি নিছক তাদেরই কথা বলছি।
পটুয়াখালি জেলা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবার পর প্রথমে আমরা আরো দক্ষিণে চলে যাই। মেজর জাফর আলী খাঁ পটুয়াখালি জেলার সামরিক বাহিনীর সর্বময় কর্তা। পটুয়াখালি ছেরে যাবার পূর্বের কথাটা বলতে গিয়ে এখনো চোক্ষে পানি আসে।
সাথী সহ-যোদ্ধাদের দুজনকে এখানে লোয়ালিয়া নদীর পারে ঘুম পারিয়ে রেখে গেছি, সে ঘুম আর কোন দিন ভাঙ্গবে না। শান্তিতে ঘুমাও সাথীরা! যে পথের নিশানা তোমরা রেখে গেছো সেখান থেকে যেন কোন দিন বিচ্যুত না হই আর প্রয়োজন হলে স্বাধীনতার জন্য তোমাদের পাশে শয্যা নিতে যেন কার্পন্য না করি। পটুয়াখালির কুখ্যাত মুসলিম লীগের দালাল ও শান্তি কমিটির সদশ্য রাজা মিঞা এখানে প্রভুদের হাতেই খতম হয়েছে। পটুয়াখালি যে হত্যালীলা হানাদাররা চালিয়েছে ইতিহাসে সে নৃশংসতার নজির খুঁজে পাওয়া যাবেনা। লোয়ালিয়া নদীর বুকে কচুরি পানার ন্যায় এখানে সেখানে বাংলার মানুষের লাস বহু দিন ভেসে বেরিয়েছে। শাহ আলম ও অরুণকে আমরা পটুয়াখালিতে হারিয়েছি। লঞ্চ ঘাটে নদীর পারে পূর্ব দিকের কদম গাছটার নীচে শহীদ সহ-যোদ্ধাদের কবরে শুইয়ে রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিয়েছি। মৃত্যুর অকাল পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শত্রু হানাদার আর পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার চেনা অচেনা ভাই বোনদের লাস। জব্বার, সতীর্থ সহ-যোদ্ধা অরুণের কবরের উপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বহু কষ্টে ওকে তুলে নিলাম। রাত গভীর হয়—চতুর্দিকে একটা থমথমে বিস্তব্ধতা; মনে হয় এক প্রেত পুরি। নদী পেরিয়ে আমরা কালিকাপুরে আদম আলীর বাড়ি গেলাম। আদম আলী একজন রিস্কা চালক প্রথম বেচারা ঘাবরে গিয়েছিল তারপর আমাদের দেখে খুশীতে আত্মহারা। ওর স্ত্রী রেহেনা আমাদের ঐ রাতে রেঁধে খাওয়ালেন।
তারপর দীর্ঘদিন চলে গেছে। আমতলী বাজারের সামরিক ছাউনি আক্রমন করে বেশ কয়েকটা শয়তানকে আমরা খতম করেছি। পথে পথে আরো অনেক ঘাঁটি উপর ঝটিকা আক্রমনে বহু শয়তানকে করেছি হত্যা এবং অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েছি ছিনিয়ে। এখন আমরা বরিশালের কাছাকাছি প্রায় সবগুলো গ্রামেই ছড়িয়ে আছি। বর্তমানে আমাদের দলে প্রায় দু-সহস্র মুক্তি যোদ্ধা আছেন। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে আধুনিক মারনাস্ত্র-যেগুলো আমরা শয়তানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। শত্রু সৈন্যদের যখন আমরা কোণঠাসা করে বিজয়ের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলছে। মুক্তি বাহিনীর প্রত্যেকটি সেনানি এই হীন চক্রান্তের ব্যাপারে সচেতন। ইস্পাত দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাঁরা ঘোষণা করছেন হয় পূর্ণ স্বাধীনতা বাংলাদেশ না হয় বীরের ন্যায় মৃত্যু বরণ দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শয়তানদের সব-রকমের ষড়যন্ত্র আমরা ব্যর্থ করে দেশকে স্বাধীন করবোই। পনেরো লক্ষ দেশবাসীকে যে শয়তান হত্যা করেছে তার সাথে কোন আপোসের কথাই উঠতে পারে না। লাখ লাখ মানুষ হত্যাকে যে শয়তানেরা আভ্যন্তরিণ ব্যাপারে বলে ধামা চাপা দিয়েছে আমাদের মুক্তি যুদ্ধে সে সব নরপশুদের নাক গলাতে হবে না। স্বজন হারানো শ্মশানের বুকে আপোস চাইনা প্রয়োজন হলে শ্মশান বা কবরে স্থান নেওয়াই শ্রেয় মনে করবো। আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীরাই আমাদের পথ নির্দ্ধারণ করতে পারবো। আজ, ভাই বোনদের রক্ত আর লাস মাড়িয়ে যে বাংলা দেশে পথ চলতে হচ্ছে সেখানে শান্তির বাণী আমরা শুনতে চাইনা। মা-বোনদের ইজ্জত, বাবার বুকফাটা আর্তকান্না আর শত সহস্র সাথী ভাই বোনদের লাসের বিনিময়ে পাক কাঠামোর মধ্যে জান থাকতে আমাদের কেউ নিতে পারবে না—এ কথা সকল বাঙালীর অন্তরের কথা আর রক্তের শপথ। তিন ছেলে আর স্বামীকে হারিয়ে রহিমের যে মা বরিশালের পথে পথে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাকে আমরা কি জবাব দেব? কি জবাব দেবো রোশেনারাকে যার স্বামীকে হাত পা বেঁধে কীর্তনখোলার জলে নিক্ষেপ করা হয়েছে। জবাবের ভাষায় কোথায়, ঝুন্টুর ছোট ভাই যখন প্রশ্ন করে দাদার হত্যাকারীদের আপনারা কবে খতম করবেন। কুষ্ঠিয়ার ইয়ুনুস, রাজশাহীর রহমান, ময়মনসিংহের বারেক ও আরো অনেক শহীদ ভাইদের প্রিয়জনেরা এসে যখন প্রশ্ন তুলবেন ওঁরা কি জান দিয়ে ছিল শয়তানের সাথে আপোস করার জন্য কি জবাব দেবো তাদের! আজ আমাদের মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুষ্ঠিয়া, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, বরিশার, পটুয়াখালি, ফরিদপুর, যশোহর, খুলনায় প্রায় সব জায়গা থেকেই হানাদার কুকুরেরা পালাই পালাই রব তুলেছে ঠিক এই সময়ই সাম্রাজ্যবাদী সারমেয়রা সমস্বয়ে আপোসের চিৎকার তুলছে। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, কপোতাক্ষ ও তেঁতুলিয়ার অনেক জল আট মাসের ব্যবধানে বয়ে গেছে। আঘাত অনেক খেয়েছি, এবারে শুরু হয়েছে আঘাত দেবার পালা। বাংলায় দুর্জয় মুক্তি যোদ্ধারা অস্ত্রের দ্বারাই পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে আপোসের মাধ্যমে নয়!
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল