বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৮ নভেম্বর ১৯৭১
শ্যামনগর-কালিগঞ্জ-দেভাটা থানা মুক্ত
সাতক্ষিরায় যুদ্ধ চলছে
(বিশেষ প্রতিনিধি)
২৫শে নভেম্বর, বাংলাদেশ।
বাংলার বীর বিপ্লবী মুক্তি সেনারা অসীম বীরত্বের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ করে খুলনার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেভাটা থানা হানাদার মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, সাতক্ষিরার দখল নিয়ে মুক্তি যোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, আশা করা যাচ্ছে দু’ একদিনের মধ্যে সাতক্ষিরাও সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হবে।
লেফটেন্যান্ট বেগ ও লেফটেন্যান্ট মাইনুলের নেতৃত্বে একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শ্যামনগর থেকে পাকসৈন্যদের হটিয়ে দিয়ে শ্যামনগর থানার সম্পূর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। এখানের যুদ্ধের হতাহতের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে লেঃ বেগ জানিয়েছেন হতাহতের সংখ্যা প্রচুর।
শ্যামনগর থানার হরিনগর পাকসেনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি প্রয়োগ করেও পাক সৈন্যরা দুর্বার মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। প্রচন্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অবশেষে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছেড়ে পাক সেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এখানে বহু অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়েছে।
ক্যাপ্টেন হুদা, লেফটেন্যান্ট হাসান, লেফটেন্যান্ট শচীন, লেফটেন্যান্ট এম. আলী ও লেফটেন্যান্ট এম.আর. চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকশত রণোন্মত্ত মুক্তিসেনা নিয়ে কালিগঞ্জের বসন্তুপুরের পাক ছাউনির উপর দুর্বার আক্রমণ চালালে পাক সৈন্যরা পিছু হটতে থাকে। কালিগঞ্জ পাক সৈন্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। এখানে কয়েকশত বাঙ্কার করে তার মধ্যে এতদিন আত্মগোপন করে কালিগঞ্জকে দখল করেছিল হানাদার বাহিনী। বসন্তপুরের পতনের পর খান সেনারা কালিগঞ্জ আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিহত অগ্রসরের মুখে টিকতে না পেরে পাক সেনারা কালিগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছেড়ে পিছু হটতে থাকে। কালিগঞ্জ মুক্ত হলে মুক্তিসেনারা দেখতে পান প্রতিটি বাঙ্কারের সামনে কামান সাজান আছে। অবশেষে একটা কামানের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে নিলে দেখা যায় সেগুলো কামান নয়, কতগুলো খেজুর গাছকে কামানের মত সাজিয়ে রেখে এতদিন এখানকার জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে।
এই সমস্ত মুক্ত এলাকা সফর করতে গিয়ে দেখতে পেলাম, কালিগঞ্জের সর্বত্র খানসেনারা পাকা বাঙ্কার করেছিল। এমন কি প্রতিটি দালান ও মসজিদের উপর!
দেভাটা থানাটিও হানাদার মুক্ত হয়েছে, কালিগঞ্জের পতনের পর খানসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেভাটা থেকে পালিয়ে যায়। এখন সাতক্ষিরা দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। সাতক্ষিরার আংশিক এরি মধ্যে মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন হুদা জানালেন, “২/১ দিনের মধ্যে সাতক্ষিরা আমাদের দখলে এসে যাবে।” এখানকার প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে বেশ দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন দেখলাম, এখানকার জনগণ বললেন এতদিনে আমরা মুক্ত আলোয় বেরোতে পারছি এই সমস্ত এলাকার হাট বাজার আবার পূর্ণদ্যমে চালু হয়েছে। সর্বত্রই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। আরো দেখলাম, মেজর এম.এ জলিল একদল বিদেশী সাংবাদিকদের মুক্ত এলাকা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। এছাড়া মুক্ত এলাকায় বহু শরণার্থী থেকে ফিরে যেতে দেখে স্থানীয় জনগণকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তাঁরা জানালেন, এই সমস্ত এলাকা হানাদার মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক শরণার্থীরা ফিরে আসছেন। তাঁরা আরো জানালেন, যতদিন না শরণার্থীরা নিজেদের উপর নির্ভর হতে পারছেন ততদিন পর্যন্ত এদের ভরণপোষণের ব্যয় ভার সমস্ত আমরাই বহন করব। আমরা এখন আর হিন্দু-মুসলমান নই আমরা সবাই বাঙালী।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল