বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৮ নভেম্বর ১৯৭১
ওঁদের অশ্রু মুছাতে হবে
—মিন্টু বসু
বাংলার দিগন্তে ধীরে ধীরে লাল সূর্যটা প্রতিদিনের থেকে আরো উদ্ভাসিত হয়ে ফুটে উঠছে ভোরের পূব আকাশে। আর তার রঙের ছটায় বাংলার প্রাণে এসেছে নতুন আলোর দীপ্তি। শ্মশান বাংলায় আবার ফুল ফুটতে শুরু করেছে, আবার পাখী গান গাইছে, আবার রাখালের বাঁশীতে সুমধুর সুরধ্বনি বাজছে, আবার কচি কচি প্রাণের উদ্বেলিত আনন্দে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে।
একটা প্রচন্ড পশুশক্তির দানবীয় দলনে যে বাংলা দলিত-মথিত হয়ে গিয়েছিল—যে বাংলার মানুষের আত্মীয় পরিজন হারানোর ব্যথায় জীবন নীল হয়ে গিয়েছিল সেই বাংলা দানবীয় শক্তির শৃঙ্খল থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছে। সেদিন যেমন পশ্চিমা পশু শক্তির প্রচন্ড আক্রমণের মুখে বাংলার প্রতিটি মানুষ মুখ থুবড়ে পড়েছিল—পরবর্তী পর্যায়ে আবার যেমন একযোগে প্রতিশোধের স্পৃহায় কঠিন কঠোর হয়ে উঠেছিল, আজ তেমনি আবার যেন সবাই একযোগে জয়ের আনন্দে সমভাগী হতে পারে।
বাংলার এককোটি মানুষ পাক সৈন্যের বর্বরোচিত প্রাণ হরণের হাত থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই কোটি মানুষ আজ সর্বহারা। এদের বাংলাদেশে বাঁচার মত কোন অবলম্বনই আর পা জঙ্গীচক্র রাখেনি, এমন কি মাথা গুজবার মত স্থানটুকু পর্যন্ত এদের নেই। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হচ্ছে। বীর বিপ্লবী মুক্তিসেনারা প্রতিদিন অসংখ্য শত্রু হনন করে বাংলার মাটি মুক্ত করছেন আর এ সংবাদ শুনে অসংখ্য শরণার্থী মুক্তাঙ্গণে ফিরে আসছেন।
কিন্তু শরণার্থীরা মুক্তাঞ্চলে ফিরে আসছেন জীবনের এক বিরাট ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে। এদের চোখের সামনে আজ শুধু এক প্রশ্ন কেমন করে আমরা বেঁচে থাকব; আমাদের যে কিছুই নেই। এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে সর্বাগ্রে বাংলার বাকি ছ’ কোটি মানুষকে। এক কোটি মানুষের দুঃখ দুর্দশা ছ’ কোটি মানুষকে ভাগ করে নিতে হবে, তবেই হয়ত এই এক কোটি মানুষ আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবেন। মুক্তাঞ্চলে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এদেরকে আশ্রয় এবং ভরণ পোষণের ভার নিতে হবে সেই স্থানের জনগণকেই। যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা আজ সীমিত, অবশ্য পরবর্তি সময়ে নিশ্চয় বাংলাদেশ সরকার তাঁর শরণার্থীদের সমস্যার সমাধান সু-সংগঠিত ভাবে করবেন। কিন্তু আজকে সর্বাগ্রে বাংলার জনগণকেই এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্মরণ করা যাক, আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা ইদানিং কালিগঞ্জের মুক্তাঞ্চল সফরে গিয়েছিলেন, সেখানে শরণার্থীদের ফিরতে দেখে তিনি জৈনক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেছিলেন, এদের জন্য আপনাদের কি কর্তব্য! উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এক কঠিন অগ্নিপরিক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তির্ণ হয়েছি আমরা। আমরা আজ আর হিন্দু মুসলমান নই, বাংলাদেশের মানুষ আমরা বাঙালী—অতএব এদের দুঃখ আমাদের দুঃখ। এদের অভাব আমাদের অভাব আর এ অভাব আমরা সবাই একসঙ্গে পূরণ করব।
এ শুধুই উক্তি নয়, বাংলার মানুষের জন্য এ এক বাণী, তাই তাঁকে আমার ধন্যবাদ। বাংলার মানুষকে এই মুহূর্তে সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে তবেই হয়ত আবার আমরা সোনার বাংলাকে পূর্বের আসনে প্রতিষ্টিত করতে পারব।
তবু বলতে হচ্ছে, কঠিন অগ্নি পরিক্ষায় আমরা উত্তির্ণ হয়েছি একথা শুধু মুখে বললেই হবেনা কার্য্যতঃ দেখাতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে, সংঘবদ্ধ জনগণের দ্বারা কোন রকম সমস্যার সমাধান হয়নি। অতএব আজকের এ সমস্যার সমাধানও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে করতে হবে। নিশ্চয় আমরা ব্যর্থ হবনা। তাই আসুন আমাদের সম্মিলিত মুক্তাঞ্চলে যে সব শরণার্থী ফিরে আসছেন তাদের বাঁচার নতুন স্বপ্নকে স্বার্থকতায় রূপ দিই।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল