বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৮ নভেম্বর ১৯৭১
সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে
দেশে দেশে সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম
—অধ্যাপিকা রেহানা বেগম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
খুব খুসী মনে সে বলল, “আমরা এখন অনেক জিনিষ কাই এবং সবাই দুধ খাই, (We have a lot eat now, and everybody drinks milk), অথচ আগে এরা ভাত আর কালো বীন ছাড়া কিছুই খেতে পেতনা বললেন ওর বাবা।”—এ গল্প কিউবার শকতরা ৯০ জনের গল্প।
কারণ কিউবার বিপ্লবীদের দুটোই ধ্বণি ছিল “Liberty of Death” (হয় স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু); এবং “Revolution means to construct” (বিপ্লব মানেই কিছু গঠন করা) কিউবার নতুন সরকারের কাজের পরিকল্পনাগুলোকে যদি তলিয়ে দেখা যায় তবে দেখা যাবে :-
১৯৫৯ হচ্ছে “The year of Liberation;”
১৯৬০—“The year of Agrarian Reform;”
১৯৬১—“The year of the First Ecocnomic Plan” এবং
১৯৬২ হচ্ছে “year of Industrialisation”.
কাজকর্মের মধ্য দিয়ে কিউবার নতুন সরকারের পায়ের তলার মাটি শক্ত হ’ল। সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদ পেল মানুষ এই প্রথম। অবশ্য প্রতিবিপ্লবীদের কাছে এর অর্থ হল ভয়াবহ।
একজন বড় ব্যবসায়ীর ভাষায় :-“ভয়াবহ অবস্থা। সন্ত্রাসের রাজত্ব। বন্ধুর সঙ্গে খোলাখুলি ভাবে রেস্তোরাঁ—ক্লাবে কথা বলা যায় না।…কোথাও কি শুনেছো কথা বলার জন্য গুলি করা হয়?” (Terrible condition. Terror. He and his friends do not dare talk at their clubs for fear. …Did he know of anyone who been shot for talking?”) তাঁর মতে অবিলম্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং এই সরকারকে উৎখাত করে দেশে আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা উচিত।
আবার একজন মার্কিন শিল্পীর (Douglas Gorsline) মতে :-কিউবা স্বাধীনতায় মাতোয়ারা। ঠিক যেন স্বাধীনতার পর প্যারিস বা নিউইয়র্ক ঠিক বিপ্লবের জয়ের পর। একমাত্র স্বাধীন দেশেই হয় একজন স্বতঃস্ফূর্ত খুসীর মেলামেশা। এখানে বড় বড় চুল দাড়িওয়ালা, হাতে রাইফেল যুবক, কিন্তু তাদের দেখে ভয় হয়না, কারণ কিউবানরা কিউবানদের ভয় পায়না। এরা যে বিপ্লবের রক্ষাকর্তা, অত্যাচারী নয়ত…তাদের তো আমেরিকা বিরোধী মনে হ’লনা, বরঞ্চ তাঁরা বলে “কেন তোমাদের সরকার এই সময় আমাদের সাহায্য করেনা? তোমরা কি বুঝতে পারছনা যে আমাদের দেশের মানুষ এই প্রথম স্বাধীনতার আস্বাদ পেলো?”
কিউবার এই মাতোয়ারা ভাব সইতে পারলোনা আমেরিকা। আমেরিকার এ অঞ্চল ছিল সাম্রাজ্যবাদের নিশ্চিদ্র দুর্গ। কিউবা এই সুদৃঢ় দুর্গের প্রথম ইট বসালো। ভয় এই পথে হুড় হুড় করে বন্যার জল ঢুকবে। কিউবা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সবদেশকে। তাই প্রথম থেকেই কিউবার বিরুদ্ধে প্রতি বিপ্লবীদের আক্রমণ সংগঠিত করল। কিউবা পরাস্ত করল প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তকে। কিউবা বুঝতে পারল তার নিজের অনেক ক্ষমতা থাকলেও আমেরিকার মত শক্তির বিরুদ্ধে বুঝতে গেলে তার পরাক্রান্ত মিত্র প্রয়োজন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কিউবা বন্ধুত্বের হাত বাড়াল সোভিয়েতের দিকে। রাশিয়া সাগ্রহে, সানন্দে গ্রহণ করল কিউবার বন্ধুত্বের প্রস্তাবকে।
কিউবার বিপ্লবী কাজকর্ম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই প্রতিফলিত হচ্ছিল। কাস্ত্রো ঘোষণা করলেন “আমি একজন মার্ক্সবাদী। ইতিমধ্যে রাশিয়া ছাড়াও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক হল। আমেরিকার কমিউনিষ্ট ভীতি কানায় কানায় পূর্ণ হল। আমেরিকা নানাভাবে বিপ্লবী রাষ্ট্রকে বানচাল করার চেষ্টা করল। কিউবা সোভিয়েতের কাছে একটা মাঝারী ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাঁটি তৈরী করে দেবার জন্য অনুরোধ করল আমেরিকার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য। সোভিয়েত রাজী হল। কথামত সোভিয়েত জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রওয়ানা হলে ১৯৬২’র অক্টোবরে আমেরিকা বাধা দেয় এবং ক্যারিবিয়াস সমুদ্র অবরোধ করে। সোভিয়েত প্রতিবাদ করলে তার জাহাজ ডুবিয়ে দেবার হুমকী দেয়। সোভিয়েত পাল্টা হুমকী দিয়ে বলে তাহলে যুদ্ধ অনিবার্য এবং সে যুদ্ধের দায় দায়িত্ব আমেরিকার মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ বুঝি শুরু হয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় চীন ভারতের সম্পর্কও খুব তিক্ত—সীমান্তে চীন ভারত যুদ্ধ হচ্ছে। এই বিপদের মধ্যেও ভারতবর্ষ সঠিক রাজনৈতিক চিন্তার পরিচয় দিয়ে সোভিয়েত সমর্থন জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সংস্থার সেক্রেটারী উ-থান্ট ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকা কিউবা ও সোভিয়েতকে অনুরোধ করে আলোচনায় বসতে শেষ পর্যন্ত আলোচনা হয় একটা মীমাংসায়ও পৌঁছে যায়। ঠিক হল আমেরিকা বা তার বন্ধু রাষ্ট্ররা কিউবার বিপ্লবী সরকারকে বিপন্ন করবে না। কিউবার কথা ছিল সে অন্যত্র উৎসাহ দেবেনা। সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ফিরিয়ে দিতে রাজী হল। এই মীমাংসায় চীন খুব অসন্তোষ প্রকাশ করল সোভিয়েতের বিরুদ্ধে। তবে কিউবার সাহায্যে খুব একটা কিছু বড় ভূমিকা চীন কখনই নেয়নি। কিউবা স্বভাবতই এই মীমাংসায় খুব খুসী হতে পারল না। তবে আপাততঃ একটা ভাল সমাধান এবং যুদ্ধের থেকে পৃথিবী অব্যাহতি পাওয়ায় অনেক স্বস্তিবোধ করল।
ফিদেল আজ পুরোপুরি কমিউনিষ্ট, তার দলবলও তাই। তবে পুরোপুরি সোভিয়েত বা চীন কোনদিকেই নেই। তবে কমিউনিজমও তাঁর বিপ্লবের মত স্বতন্ত্র কোন দূরে ফেলা মতবাদ নয়।
কাস্ত্রো’ তার বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর কিউবা ও কিউবার সংগ্রামী সৈনিকরা সত্যি সত্যিই স্বাধীনতা কামী মানুষের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল