You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১

বিজয় বার্তা

“ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত”

সিলেট :
তুকার বাজারের কাছে পাক সেনা ও গেরিলাদের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই হয়। ফলে ৮ জন পাকসৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়।

ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রণাঙ্গন :
গত ১৫ই নভেম্বর নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়ার পাকসেনাদের উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।
ঢাকা শহরে ও উপকন্ঠে গেরিলাদের প্রচন্ড আক্রমণের ফলে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামাল হয়ে পড়ে এবং ১৭ই নভেম্বর সকাল ৫টা থেকে ঢাকা শহরে আকস্মিকভাবে কার্ফ্যু জারী করে এবং প্রতি বাড়ি বাড়ি তল্লাসী চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার
সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী শালদা নদী ও নয়া পাড়ায় এক সম্মুখ সমরে পাক সেনাদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। এই সম্মুখ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ব্যবহার করে। ত্রিশজন পাকসেনা নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাক বাহিনীর কাছ থেকে ৩টি এলএমজি, ৫টি টমিগান ও ১২টি রাইফেলসহ পঞ্চাশ হাজার গুলি হস্তগত করে। এসকল অস্ত্রশস্ত্র সবই বিদেশী। বর্ত্তমানে শালদা নদী ও নয়াপুর সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী রণাঙ্গন :
গত ১৬ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা রাজশাহী জিলার গোদাগারি এলাকায় পাক সেনাদের ঘাঁটি অবরোধ করে এবং প্রচন্ডভাবে আক্রমণ
চালায়। ফলে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়, দক্ষিণ খোটকিবাড়ীতে গেরিলারা ৩ জন শত্রুসৈন্য খতম করে। জাতিবাঙ্গা ও পাবেলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে গেরিলারা রেললাইন ধ্বংস করে ও শত্রুসৈন্যের চলাচল ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়।
রংপুর জেলার আটটি থানা সম্পূর্ণ পাক হানাদারমুক্ত। প্রায় ১২ হাজার বর্গমাইলব্যাপী এলাকায় সাতলাখ জনতা স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করছে। এইসব এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে থানা পর্য্যায় পর্য্যন্ত প্রশাসনিক কার্য্য পরিচালনা করছে।

বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত এক সংবাদে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। এই এলাকার ফরিদপুর, আলাগলি, হাকিমপুর, বাকরআলিম রাধাকান্তপুর, পাংকা পিরোজপুর, পোলাডাঙ্গা, চিলমারি, সাহেবনগর প্রভৃতি সীমান্ত চৌকি থেকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের সম্পূর্ণরূপে হটিয়ে দিয়েছে। সেগুলি এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
এ ছাড়াও নবাবগঞ্জ শহরের উপকন্ঠে ইসলামপুর, বারমারিয়ায় উপর বাগডাঙ্গা, সুন্দরপুর, ছোটকলকাতা, ইলশামারী, দেবনগর প্রভৃতি গ্রামগুলিতে ১৩ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে রাজাকার ও খান সেনাদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা মুক্তি বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। মুক্তিবাহিনী এখানে এখানে ৫টি ৩০৩ রাইফেল দখল করেন ও পাঁচজন রাজাকারকে বন্দী করেন।

গেরিলাদের ব্যাপক আক্রমণ
ময়মনসিংহ :
ময়মনসিংহের ঘোষগাঁও এলাকা থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করে মুক্তিবাহিনী তাদের দখল কায়েম করেছে।
উত্তরবঙ্গে ও পূর্ববঙ্গে অন্যতম সংযোগস্থল দেওয়ানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাতেও মুক্তিবাহিনী পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই এলাকাগুলোর মধ্যে আছে ডাংধর, চররামপুর, গামখাওয়া, হাতিবস্থা ইত্যাদি। এখানে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই জেলার তেলিখালিতে পাক সেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে গেরিলারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এখানে ৬৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১ জন গেরিলার হাতে বন্দী হয়। গত ১৪ই নভেম্বর ময়মনসিংহের অন্য আর একটি অঞ্চলে গেরিলাসেনারা অতর্কিত আক্রমণে অনে জুনিয়র কমিশন ও সামরিক অফিসার সহ ৯ জন পাক সেনাকে খতম করে।
গত কয়েক সপ্তাহের সংবাদে জানা যায় এই জেলা গেরিলাদের ব্যাপক আক্রমণে দুই শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছে।

রাজাকার ও পাক সৈন্যের মধ্যে সংঘর্ষ
কুষ্টিয়া-যশোহর ও খুলনা রণাঙ্গন :
বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে রায় পাড়াতে পাকসেনা ও রাজাকারদের মধ্যে গোলা বিনিময় হয়—ফলে ৪০ জন রাজাকারের মৃত্যু ঘটে। এই সংঘর্ষের কোন কারণ জানা যায়নি।
গত ১২ই নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের ঘাঁটি ঘেরাও করে এবং প্রচন্ড আক্রমণ চালায়; ফলে ১৭ জন পাক সেনা খতম হয়।
১৪ই নভেম্বর বীর গেরিলারা আঙ্গুলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাও করে এবং ১২ জন পশ্চিমা পুলিশ খতম করে।
নাটসি গাগারি যোগাযোগ পথে এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১১ জন হানাদার খতম করা হয়।
খোদাইপুরে পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এক বিরাট সংঘর্ষে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১৩ জন পাকসেনার মৃত্যু ঘটে।
মাকুরা মোহনপুরে একটি সামরিক ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফলে বহু খানসেনা হতাহত হয়। গেরিলারা এই ক্যাম্প থেকে ৫৭টি রাইফেল হস্তগত করে।

বরিশাল :
নাজিরপুর থানার সন্নিকটে মুক্তিযোদ্ধাদের এক আক্রমণে পাক বাহিনীর ২ খানা গান বোট এবং ২ খানা লঞ্চের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। অপর এক আক্রমণে ৩ জন পাক ফৌজসহ ১৭ জন রাজাকার খতম হয়।
স্বরূপকাঠিতে পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে বীর গেরিলারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পাক ফৌজের লেফটেনেন্ট আনোয়ার সহ ২১ জন খানসেনাকে খতম করে। এই সংঘর্ষে ৪৭ জন খানসেনা জখম হয়।

গানবোট ও লঞ্চের ক্ষতিসাধন
বানরীপাড়া-নাজিরপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়; ৪ জন জাতিয় শত্রু, ৩ জন চর, ৯ জন রাজাকার ও ৭ জন দালালকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ৪টি রাইফেল, ১টি ষ্টেনগান, ১টি চীনা সার মেসিনগান, ১টি মর্টার, ৫টি অটোমেটিক রাইফেল, ১১টি গ্রেনেড ও ২৫০টি হাতবোমা উদ্ধার করা হয়।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!