বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—নজরুল ইসলাম
উজিরপুর থেকে, ১৭ নভেম্বর ১৯৭১
মা,
অনেকদিন পর তোমায় লিখছি। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে। জানি না আমার এ লেখা তোমার হাতে গিয়ে পৌঁছবে কিনা। তোমার হাতে না পৌঁছলেও বাংলার অনেক মায়ের কাছেই আমার এ লেখাটুকু পৌঁছবে। তাদের কাছ থেকে তুমি জেনে নিও মা। জানি তুমি প্রত্যেক মুহূর্তেই ভাবছ আমাদের কথা। হয়তো ভাবছ কোথায় আছি, কি অবস্থায় কেমন আছি। আমি কিন্তু খুব ভাল আছি মা। আমিতো আমার কথা মোটেই ভাবি না। আমার ভাবনা হয় তোমার জন্য। কারণ নরঘাতক ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর মধ্যে তুমি ভয় ভীতির মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছ। জানি, তোমার তিন ছেলের বড় দু’টিই তোমার কোল ছেড়েছে। এ জন্য হয়তো তুমি খুব ভাবছ। হয়তো সবার অগোচরে চোখের জল ফেলছ। তাই না মা? দুঃখ করোনা। একবার ভেবে দেখ, রতন, টেলু, খোকন, বন্ধু মন্টু, অমূল্য, খোরসেদ ওদের কথা। ওরাওতো আমারই মত মায়ের কোল ছাড়া। ওদের মায়ের সাথে তুমিও তোমার ভাগ্যকে মিলিয়ে নিও। মা, তোমাকে রক্ষা করতেইতো তোমাকে ছেড়েছি। দীর্ঘ চব্বিশটি বছর ধরেইতো বাংলার মায়েরা, বোনেরা লাঞ্ছিতা। যদি তোমার এ হতভাগা ছেলেটি তার প্রাণের বিনিময়েও বাংলার মা-বোনদের দুঃখ কিছুটা লাঘব করতে সহায়তা করতে পারে তবেই না তোমার গৌরব।
জান মা, আজ বার বার মনে পড়ে আব্বার সেই কথা, “নো রিস্ক নো গেইন”। দেশ ও জাতীর এ চরম অবস্থায় তাকে উদ্ধার করতে হলে তোমাকে ‘রিস্ক’ নিতেই হবে। আব্বার একথা মনে হলে আমার মনে যে কতটুকু সাহস হয় তা তুমি জান না।
মা, পবিত্র রমজান মাসতো শেষ হয়েছে। ঈদ এসেছে।
আচ্ছা মা, তুমি কি বলতে পার প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কি আনন্দের বার্তা নিয়ে ঈদ এসেছে? তাই যদি হবে তা হলে আজকের দিনে কেন বাংলার ঘরে ঘরে শুনতে পাই কান্নার রোল? আমার বাংলা মা আজ কেন এত কাঁদছে? জানি মা এ দিনে তোমার মনেও অনেক ব্যথা লাগছে। ঈদের আনন্দ কারোই হবে না। সেই ভাল। যে দেশের মা-বোনেরা মান-ইজ্জতের ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে দিকে দিকে, যে, দেশে লাখো লাখো গরীব, অসহায়, নিরাশ্রয় মানুষ মরছে অকাতরে, যে দেশের লোক মাথা গুজবার স্থানটুকু হারিয়েছে, যে দেশের ভাইয়েরা প্রতি মুহূর্তে শত্রুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছে সে দেশে আনন্দ কিসের? আজ কোন আনন্দ নয় মা। আজ প্রতিজ্ঞা নেবার দিন। আজকের দিনে এই প্রতিজ্ঞাই আমাদের নিতে হবে, যে ঈদের আনন্দ আমরা করবো তবে তা পরাধীন দেশে নয়? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে। এ দিনে তুমিও এই দোয়াই করো মা, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে যেন তোমার কোলে ফিরে আসতে পারি। আর—আর সেই শুভ দিনের আগেই যদি আমি হারিয়ে যাই, যদি আমাকেও বিদায় নিতে হয় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে, তাহলে দুঃখ করো না মা। আমিতো তোমার পাশেই আছি, থাকবো। নিশীত রাতের নিস্তব্ধতায় শুনতে পাব তোমার কথা। রতন, টেলু, খোকন, মন্টু এবং আরো আরো বাঙালী ভাইদের দিকে তাকিয়ে দেখো, তাদের মাঝেই খুঁজে পাবে আমায়।
রাণী, রুণীকে ফজলুর কাছে অস্ত্র চালনা শিখে নিতে বলবে। তুমিও শিখে নিও। নান্নু ওর কাজ ঠিকমতই করছে। ওর জন্য ভেবো না। ও ভাল আছে।
আমাদের জন্য চাই তোমার দোয়া।
ইতি—
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল